মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব-১৬

0
887

#মেঘমিশ্রিত_পূর্ণিমা 🤎
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব:১৬

“কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানিও, আমি পাশেই আছি। ভিড়ের মধ্যে যাওয়ার দরকার নেই। মনে থাকবে?”

আমি শব্দহীন স্বরে, ‘হম’ উচ্চারণ করলাম। ধ্রুব স্যার আশ্বাস পেলেন না। চটজলদি আমার মুঠোফোন নিয়ে নিলেন। তার ফোন নাম্বার সেভ করে পুনরায় হাতে ধরিয়ে দিলেন। অতঃপর সামনের দিকে অগ্ৰসর হলেন।
প্রিন্সিপাল স্যার ডিনারের আয়োজন করেছেন। প্রিন্সিপাল বলে কথা ছোট খাটো অনুষ্ঠানে তার চলে না, তাই বড় করে আয়োজন করেছেন। উপস্থিত আছেন ভার্সিটির অনেকেই এবং স্যারের আত্মীয় স্বজন। সেদিনের দুর্ঘটনার পর আমাকে একা ছাড়তে নারাজ মামা। তাই বাবুইকে সাথে দিয়েছেন। কালো রঙের শাড়ি পড়েছি দু’জনে।
দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পায়ে ব্যথা উপলব্ধি করলাম। বাবুইকে নিয়ে পাশের চেয়ারে বসলাম। ওয়েটার ডেকে সফ্ট ডিঙ্কের গ্লাস নিলাম। বাবুইয়ের হাতে দিয়ে আরেকটা নেওয়ার পূর্বেই ট্রে উল্টে ডিঙ্ক বাবুইয়ের শাড়িতে। বাবুই নাক ফুলায়। বিরক্ত সে। চ্যাঁচিয়ে বলে, “চোখে দেখতে পান না আপনি, কী করেছেন এটা?”

“স্যরি ম্যাম। পেছন থেকে ধাক্কা দেওয়াতে সামলাতে পারিনি, স্যরি।”

আমি বাঁধা দিয়ে বললাম, “ইটস্ ওকে। গো।”

“আপু তুমি ওকে যেতে দিলে কেন?”

“সে ইচ্ছে করে এইসব করেনি, প্রচণ্ড ভিড়, ধাক্কা লেগেছে।‌”

বেশ খানিকটা ভিজে গেছে শাড়ির। আঠালো ভাব শাড়ি থেকে। বাবুই এখানে এক মুহুর্ত থাকতে নারাজ। বাড়িতে যাবে সে। উপায়ান্তর না পেয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। ততক্ষণে ধ্রুব স্যার ও রাহাত স্যার হাজির। তড়িগড়ি করে বেরুতে দেখে প্রশ্ন করলেন,

“কোথায় যাচ্ছ তোমরা?”

বাবুই উল্টো ঘুরে গায়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমতা-আমতা করে বলি, “ওয়েটার ভুল করে ডিঙ্ক ফেলে দিয়েছে। অনেকটা। এখন থাকা সম্ভব হচ্ছে না।”

ধ্রুব স্যার ও রাহাত স্যার একে অপরের সাথে আলোচনা করলেন। রাহাত স্যার নির্দ্বিধায় প্রস্থান করলেন। কিয়ৎক্ষণ পর ফিরে এলেন একটা ছাই রাঙা শাড়ি নিয়ে। ধন্যবাদ জানিয়ে চড়ুইকে নিয়ে চ্যাঞ্জিং রুমে গেলাম। বাবুই নিজেই চেঞ্জ করে নিল।

এই সামান্য ঘটনাটাকে নিছক দুর্ঘটনায় ভেবে উড়িয়ে দিলেও পরবর্তীতে সহ্য করতে হয়েছিল প্রবল যতনা। কেউ একজন পরিকল্পনা করে সবটা করেছিল। জুসটা আমার শাড়িতে পড়ার পরিবর্তে বাবুইয়ের শাড়িতে পড়েছিল।

পরদিন সকালে ভার্সিটিতে গিয়ে থমকে গিয়েছিলাম। কয়েক মুহুর্তের জন্য চমকে ছিলাম। পুরো ভার্সিটিতে ধ্রুব স্যারের ছবি টানানো। সাথে শুভ জন্মদিন লেখা। আজ ধ্রুব স্যারের জন্মদিন? অথচ আমি জানতামই না। তারিখ দেখার উদ্দেশ্যে মুঠোফোন বের করতেই স্তব্ধ হয়ে গেলাম মিনিটের ব্যবধানে। আজ ২৯শে ফেব্রুয়ারি। চোখজোড়া পূর্ণ হয়ে এলো নোনাজলে। ধ্রুব স্যারই ধ্রুব। এতদিন আমাকে ঠকিয়েছে। ধ্রুবের বন্ধু সেজে আমার অনুভূতি নিয়ে মজা করেছেন। আর যাই হোক, দুজনের জন্মদিন একই দিনে হতে পারে না। আমি কৌতূহল দমিয়ে রাখতে ব্যর্থ হয়ে অফিস রুমের দিকে অগ্ৰসর হলাম। সেখানে ধ্রুব স্যারের বাবা মায়ের নাম দেখে বেশ চমকেছিলাম। তিনি ধ্রুব এটা পুরোপুরি নিশ্চিত। এর জবাব তাকে দিতেই হবে।
নিশ্চুপ হয়ে ক্লাসে গিয়ে বসলাম। মিনিট দশেকের মাথায় হাস্যোজ্জ্বল মুখে ধ্রুব স্যার প্রবেশ করলেন। সবাই তখন এক দৃষ্টিতে ধ্রুব স্যারকে দেখছিল। আজ গাঢ় সবুজ রঙের শার্ট পড়ছে। নিত্যদিনের মত সাজ হলেও ভিন্ন লাগছে দেখতে। একে একে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে সকলে। ধ্রুব স্যার হাসি মুখে সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে। এইসব সহ্য হলনা আমার। অতিশয় ক্ষোভে ফুঁসতে ফুঁসতে বেরিয়ে এলাম ক্লাসরুম থেকে।‌ পিছু পিছু ধ্রুব স্যার এলেন। হাত ধরলেন মাঝরাস্তায়। আমি এক ঝটকায় সরিয়ে ফেললাম। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললাম, “একদম আমাকে স্পর্শ করবেন না। একদম না। আপনি ধ্রুবের বন্ধু সেজে আমার অনুভূতি নিয়ে খেলেছেন। কক্ষনো ক্ষমা করব না আপনাকে।”

ধ্রুব স্যার আশাগ্ৰস্থ কণ্ঠে বললেন, “আমার কথাটা শুনো আগে।”

“শুনব না। নিশ্চয়ই আবার মিথ্যা বলবেন।”

ধ্রুব স্যারকে তোয়াক্কা না করে বেরিয়ে এলাম ভার্সিটি থেকে।
.
পাতা ঝরা বিকেল। সূর্য মেঘের অন্তরালে ঢাকা। আর্দ্র বাতাস বইছে। চোখজোড়ার বাঁধ ভেঙেছে। বুকে চেপে রাখা অসহ্য যন্ত্রনা। তৎক্ষণাৎ পায়ের শব্দ শোনা গেল। আমি পিছু ফিরলাম না। এই সময়ে বাবুই আসে। কঠোর গলায় বললাম,

“বাবুই একটু নিচে যা। একা থাকতে দে।”

গেল না। পায়ের শব্দ প্রবল আকার ধারণ করল। পায়ে এসে দাঁড়াল। ধ্রুব স্যারকে দেখে একটু চমকালাম।

“আপনি এখানে? আমাকে কল্পনায় জ্বালাচ্ছে এবার। স্বপ্নে জ্বালিয়ে হয়নি বুঝি?”

সন্দিহান স্বরে বললেন, “আমি তোমার স্বপ্নেও আসি বুঝি?”

দৃষ্টি ভ্রম মনে করে চোখ পরিষ্কার করে পুনরায় তাকালাম। ধ্রুব স্যার একহাত রেলিংয়ের ওপর রেখে দাঁড়িয়ে আছে। শান্ত কণ্ঠে বললেন, “এটা তোমার দৃষ্টিভ্রম নয়। আমি সত্যিই এসেছি।”

একটু স্তব্ধ হলেও তিনি যে রেলিং টপকে এসেছেন, এটা নিশ্চিত।
আমি উল্টো পথ ধরলাম। পেছন থেকে ধ্রুব স্যার গম্ভীর গলায় বললেন, “চলে যাচ্ছ? আমার কিছু কথা ছিল।”

সোজা হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, “বলুন কী বলবেন?”

ধ্রুব স্যার নিশ্চুপ হয়ে রাস্তার দিকে চেয়ে আছেন। তার দৃষ্টি আজ শান্ত, বড্ড অচেনা ঠেকছে। হাজারও কথা চোখের মাঝে ভেসে আছে। বিরক্ত নিয়ে বললাম,
“কেন এসেছেন এখানে? আপনার সাথে আমার কোনো কথা থাকতে পারে না। চলে যান। কেউ দেখলে সমস্যা হবে।”

“তোমার নাই বা থাকতে পারে, কিন্তু আমার আছে।” একরোখা জবাব দিলেন।

“চুপ করে না থেকে কী বলবেন, বলুন।”

সংক্ষেপে বলেন, “স্যরি।”

“কেন?”
কিয়ৎক্ষণ স্থির থেকে অসহায় কণ্ঠে বললেন, “কীভাবে শুরু করব, বুঝতে পারছি না। আমি তোমার সাথে এতদিন অনেক অন্যায় করেছি। কী করব বলো, বাবার মৃত্যুর শোকে পাথর হয়ে গেছিলাম। একদিকে বাবার মৃত্যু অন্যদিকে পড়াশোনার চাপ। আমি প্রস্তুত ছিলাম না। হুট করে মা মিথ্যা বলে তোমার সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়। তোমাকে দেখে বারো তেরো বছরের মেয়ে মনে হয়েছে। আমি বিরক্ত হয়েছিলাম। তাই না জানিয়ে দেশের বাইরে চলে গেছিলাম।”

সৌজন্য হাসি দিয়ে বললাম, “তো! কী করব আমি। আমি কী প্রস্তুত ছিলাম। মা আমাকেও জোর করেছিল। বিয়ের পর কাউকে কিছু না জানিয়ে হুট করে জার্মান চলে গেলেন। আপনার জন্য আমার মা হার্ট অ্যাটাক করেছে। চলে গেছে। আপনার মায়ের কাছে অপরাধী হয়েছি। নিজেকে দোষারোপ করেছি, মায়ের কোল খালি হয়েছে আমার জন্য।”

“মানছি, আমি ভুল করেছি। একটা সুযোগ দেওয়া যায়না। আমি সব ঠিক করে দিবো। তোমার জীবনটাকে গুছিয়ে দিবো।”

“আমার জীবন গোছানোই আছে। অযথা গোছাতে গেলে আরো অগোছালো হয়ে যাবে।”

“কিন্তু আমার জীবন যে অগোছালো? আমি তোমাকে ছাড়া ভালো থাকতে পারব না।”

“এটা আপনার আবেগ। কথাগুলো আপনার মস্তিষ্ক ভাবছে, মন নয়। মানুষের মন ভালো থাকার চাবিকাঠি। অপরাধবোধ থেকে এইসব করছেন। আবেগ কেটে গেলে আমাকে ফেলে দিবেন। একবার অনেক কষ্ট সবকিছু সামলে নিয়েছি আর পারব না।
সেদিন আন্টি এসে ডিভোর্স পেপার নিয়ে গেছে। আমি সাইন করে দিয়েছি। জজ রায় দিলেই আপনি মুক্ত..

কথার সমাপ্তি টানার পূর্বেই হাত চেপে ধরলেন তিনি। অতঃপর রেলিংয়ের সাথে চেপে ধরলেন। ঝুঁকে গেলাম বাইরের দিকে। ভারসাম্য বজায় রাখতে ধ্রুব স্যারের গলা জড়িয়ে নিলাম। অব্যক্ত স্বরে বললাম,
“কী করছেন কী? তুলুন!”

“না, আমার কথায় রাজি না হলে এখান থেকে ফেলে দিবো।”

তাচ্ছিল্যর হাসি দিয়ে বললাম, “পারবেন না, বিশ্বাস আছে।”

ধ্রুব স্যার সোজা করে দাঁড় করিয়ে করুন গলায় বললেন,‌ “এই বিশ্বাসটুকু রাখো। সব ঠিক করে দিবো।”

“সম্ভব নয়।”
বলে পিছু দেখলাম না। দ্রুত পা জোড়া গতিশীল করে নিচে নেমে এলাম। শরীর ক্রমশ কেঁপে কেঁপে উঠছে। ধ্রুব সু্যোগ চাইছে অথচ আমি দিতে পারছি না। মন থেকে মেনে নিতে পারছি না। কষ্টে ভেতরটা ছিঁড়ে আসছে। আমি নিরুপায়।
_____

রাস্তা পাড় হওয়ার প্রচেষ্টা করছি। বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে। রাত হয়ে এসেছে। কাঁধে জামা কাপড় ভর্তি ব্যাগ। কিছুদিনের জন্য ছোট মামার বাড়িতে থাকব। মন ভালো হলে ফিরে আসব এই শহরে। বাবুইয়ের সামনে পরীক্ষা, তাই ওকে ছাড়া একাই যাচ্ছি। হুট করেই একটা গাড়ি এসে থাকম সামনে। পথ আঁটকে দাঁড়াল। মাথা তুলে অবলোকন করার পূর্বেই মুখের সামনে স্প্রে করল কেউ। সেকেন্ড খানেকের জন্য থেমে গেলাম। ভারী হয়ে উঠল মাথা। দ্রুত কাঁধের ব্যাগটা খামচে ধরলাম। ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে যেতে নিলেই ধরে ফেলল কেউ। ততক্ষণে চোখজোড়া আঁধারে আবৃত। উন্মুক্ত করতে ব্যর্থ। আমাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল। গাড়ির ভেতরে রাখল। সবকিছু স্পষ্ট বুঝতে পারলাম। পরক্ষণেই জ্ঞান হারালাম।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

#মেঘমিশ্রিত_পূর্ণিমা 🤎
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১৬ [বর্ধিতাংশ]

পিটপিট করে চোখ মেলে অবলোকন করতেই অচেনা, অজানা জায়গা দৃষ্টিতে বন্দি হল। আমি দ্রুত উঠে বসার প্রয়াস করলাম। ধীরে ধীরে মনের মাঝে দৃশ্যগোচর হল তখনকার স্মৃতি। তীব্রতর ভীত হলাম। অতিশয় দ্রুত ছুটে গেলাম বাইরের দিকে। মাঝপথে থেমে গেলাম কারো শান্ত কণ্ঠে,

“জ্ঞান ফেরার পর শক্তি বেড়েছে দেখতে পাচ্ছি।”

থেমে গেল পা। স্তব্ধ হল মন। মুহুর্তে জন্য প্রশান্তির হাওয়া স্পর্শ করল দেহ। উৎকণ্ঠা মিলিয়ে গেল। চটজলদি পেছনে ফিরলাম। ধ্রুব সোফায় আয়েস করে বসে ফোন টিপছে। বোধগম্য হতে দ্বি মুহূর্ত লাগল না, তিনিই আমাকে অপ’হর’ণ করেছেন। অতি মাত্রায় ক্ষোভে গজগজ করতে করতে ধ্রুবের সামনে গিয়ে রাগান্বিত স্বরে বললাম,
“আপনি নিশ্চয়ই আমাকে কি’ডন্যা’প করেছেন, তাই না ধ্রুব স্যার।”

“কার এত সাহস তোমাকে স্পর্শ করবে? আমি কাউকে কি’ডন্যা’প করিনি। শুধু আমার বউকে আমার কাছে নিয়ে এসেছি।সে রাগ করে চলে যাচ্ছিল, তাই অজ্ঞান করে এনেছি। সোজাসুজি বললে তো আসত না, তাই।”
বলেই ফোন দিয়ে মুখ আড়াল করে নিলেন। তড়তড় করে রাগের মাত্রখ বেড়ে গেল। এবার দিগুন ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললাম, “বড় বড় কথা বলতে লজ্জা করছে না আপনার। আমি কত ভয় পেয়েছিলাম। আপনি না জানিয়ে আমাকে কিডন্যাপ করেছেন।”

“আর কতবার বলব, আমি আমার বউকে এনেছি। তাছাড়া কি’ডন্যা’প কি জানিয়ে করে?”

“তা কেন আপনার বউকে এনেছেন, শুনি?”

“কেন আবার বাসর করতে। আবহাওয়া দেখেছ কী সুন্দর। তারউপর আজ আমার জন্মদিন। এইটুকু গিফ্ট তো পেতেই পারি।”

“আপনি আবার মজা করছেন?”

তিনি ফোন রেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, “একদমই নয়, আ’ম সিরিয়াস।”

“আপনি আবার মজা করছেন। দেখুন..

“সময় নেই, তাড়াতাড়ি দেখাও। এমনিতেই সব দেখা হয়ে গেছে। নতুন কিছু নেই, তুমি খুশি হয়ে দেখাতে চাইছ, না করতে পারি?”

মুখ কুঁচকে এলো অস্বস্তিতে। অব্যক্ত স্বরে বললাম, “মানে, ক কী দেখেছেন আপনি?”

ধ্রুব সৌজন্য হাসি দিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলেন। ধ্যান ভাঙতেই দৃষ্টির অগোচরে তিনি। দুইরুমের একটা ফ্লাট। পরিবেশ দেখে মন হচ্ছে, এখানে কেউ থাকত। আমি ব্যালকেনিতে দাঁড়ালাম। চারিদিকে সবুজ গাছ-গাছালি। এখান থেকে দূরে অস্পষ্ট নদী দেখা যাচ্ছে। পাল তোলা নৌকা। তাতে মৃদু হলদেটে আলো জ্বলছে। আমাকে যে করেই হোক এখান থেকে পালিয়ে যেতে হবে। আমি দ্রুত ওড়নাটা রেলিংয়ের সাথে শক্ত করে বেঁধে নিলাম। ধীরে ধীরে রেলিংয়ের ওপর দাঁড়াতেই দরজা খোলার মৃদু শব্দ পেলাম। অতিদ্রুত নামার প্রয়াস করতেই ছিটকে পড়ে যেতে নিলাম। দ্রুত রেলিং ধরে ফেললাম। এখান থেকে পড়লে হাত পা ভাঙবে না, সামান্য একটু ব্যথা পাবো। ততক্ষণে ধ্রুব ছুটে এসেছে ব্যালকেনিতে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার আমার পানে তো একবার বাঁধা ওড়নাটার পানে দেখছে। হাতের উপর তার আর্দ্র হাত স্পর্শ করলেন। হিমশীতল রুপ ধারণ করল। রেলিং আয়ত্ত থেকে বেরিয়ে গেল। দ্রুত হাত ধরলেন তিনি। টনক নড়ল আমার। শঙ্কিত কণ্ঠে বললাম, “ক কী করছেন?”

“কিছু না, শক্ত করে ধর। নতুবা পড়ে যাবে।”

হাত ছাড়লেন না, উপরে তোলার প্রয়াসও করলেন না। রেলিংয়ে বসলেন। ফোনের স্ক্রিনের মৃদু আলো পড়ছে তার মুখে। চোখের পলক সেকেন্ডের ব্যবধানে বেশ কয়েকবার পড়ছে। ক্ষণে ক্ষণে ওষ্ঠদ্বয় ঈষৎ নড়ে উঠছে। নজরকাড়া হাসি। একহাতের সাহায্য ফোনে অ্যাঞ্জেলা গেমস বের করে তাকে খাইয়ে দিচ্ছে। এই বয়সে এসে এইসব করছে। অবিলম্বে ক্ষুধায় কাতর হয়ে উঠলাম। সকাল থেকে না খেয়ে আছি। গোটা একদিন অতিবাহিত হয়েছে। এদিকে মামাকে জানানো হয়নি। নিশ্চয় দুঃচিন্তা করছেন। আদুরে গলায় বললাম,

“শুনছেন, তুলুন আমাকে।”

“না। তুমি যেথায় যাচ্ছিলে, যাও। ” রিনরিনে গলায়।

“আমি যাবো না, প্লীজ তুলুন।”

পরক্ষণেই হাত ধরে টেনে তুললেন। ইতস্তত করে বললাম, “আমি বাড়িত যাবো।”
ভ্রু কুঁচকালেন ধ্রুব। রেলিংয়ে বাঁধা ওড়নাটা খুলে কাঁধে রাখলেন। ঈষৎ ঝুকে কোলে তুলে নিলেন ধ্রুব। কক্ষে এনে বিছানায় ছুঁড়ে ফেললেন। ওড়না দিয়ে হাত পা বেঁধে দিলেন। উৎকণ্ঠা হয়ে বললাম, “হাত পা বাঁধছেন কেন?”

“চুপ না করলে মুখটাও বেঁধে দিবো।”
আমি নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলাম। ধ্রুব চলে গেলেন। আমি এদিক ওদিকে অবলোকন করলাম। মন মুগ্ধকর সৌন্দর্যে নিবদ্ধ সবকিছু।‌ ঘড়ির কাঁটার টিকটিক শব্দ হল। দেয়াল ঘড়িতে রাত একটা ছুঁই ছুঁই। যখন জ্ঞান হারিয়ে ছিলাম, তখন আনুমানিক ছয় কি সাতটা বাজে। এতক্ষণ জ্ঞানহীন অবস্থায় ছিলাম, ভাবতেই শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে।
ততক্ষণে ধ্রুব ফিরে এসেছে। হাতে আমার মুঠোফোন। কললিস্ট দেখিয়ে রাগান্বিত গলায় বলে, “রাহাত তোমাকে কেন ফোন করেছে? ওর কাছে তোমার নাম্বার গেল কীভাবে?”

হতবাক হলাম কিঞ্চিৎ। “কীসব বলছেন? রাহাত স্যারের সাথে এখন অবধি আমার কথাই হয়নি।”

ঝংকার তুলে মুঠোফোনটা বেজে উঠল পুনরায়। ধ্রুব এগিয়ে দিলেন কথা বলতে। আমি রিসিভ করতে ব্যর্থ হলাম। বিনিময়ে তিনি রিসিভ করে কর্ণকুহ্বরে ধরলেন। কথা বলতে বললেন।

“চড়ুই, কোথায় তুমি? কতবার ফোন করেছি রিসিভ করনি কেন!”

সৌজন্য হাসি দিয়ে বলি, “আমি একটু বান্ধবীর বাড়িতে এসেছি, সময় পাইনি।”

অবিলম্বে ধ্রুব ফোনটা ছুঁড়ে ভেঙ্গে ফেললেন। ডাগর ডাগর চোখ চেয়ে বললাম, “আমার ফোন?”

ঝাঁজালো গলায় বললেন, “নেই। আমি তোমার বান্ধুবী হই? হবু বরকে সত্যিটা জানাতে ভয় পাচ্ছ?”

বলেই হুরমুরিয়ে বিছানায় আসন পেতে বসলেন। বামহাতে আবদ্ধ করলেন নিজের বাহুডোরে। ভরকে গিয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম তার মুখপানে। সময়ের ব্যবধানে নিজের ফোনটা পকেট থেকে বের করে ফোন করলেন কাউকে। পরিচিত কণ্ঠ চিনতে বিন্দু পরিমাণ অসুবিধে হয়নি। ইনি রাহাত স্যার। হাতপা ছোড়াছুড়ি করে বললেন,

“শোন রাহাত, তোর হবু বউ বান্ধবীদের বাড়িতে যায়নি। তোকে মিথ্যা বলেছে। সে তো তোর বন্ধুর সাথে এক বাড়িতে, এক ঘরে, এক বিছানায় আছে।
কেমন মেয়ে ভেবে দেখ, এখনও কি তুই বিয়ে করবি?”

“চড়ুই তোর সাথে, ফোনটা ওকে দে।”

“ওর লজ্জা করছে। তুই তো প্রথম থেকেই জানিস, ও কেমন। সুতরাং বিয়েতে না করে দে।”

কল কেটে ফোনটা রাখলেন টেবিলের উপর। হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিলেন। অতঃপর বিছানায় শুয়ে পড়লেন টান টান হয়ে। আদুরে গলায় বললেন চুলগুলো টেনে দিতে। আমি দ্বিধা দ্বন্দ্বকে অবকাশ দিয়ে মাথায় হাত রাখলাম ধ্রুবের। তিনি ভাঙা গলায় বললেন,
“জানো শ্রেয়া। আমি সত্যি অসহায় ছিলাম। তোমাকে অবহেলা করেছি। মানুষ ভুল শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করে, আমিও তাই করেছি। কিন্তু পারছি না। চার বছর অন্তর অন্তর আমার জন্মদিন আসে। এবারও এসেছিল। তোমার সাথে কাটাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সম্ভব হয়নি। আমার জীবনের সবচেয়ে কালো দিন ছিল এটা। সারাদিন টেনশনে চলে গেছে। [দীর্ঘশ্বাস নিয়ে]
পালিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। তুমি পাশে ঘুমিয়ে পড়।”

শ্রেয়া নামটা শুনে একটু থমকে গেলাম। চমকালামও বটে। আমি ধ্রুবের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ভাবতে লাগলাম। কষ্ট লাগল, মন খারাপ হল। ভাবতে ভাবতে ঘণ্টাখানেক পেরিয়ে গেল। ততক্ষণে ধ্রুব তলিয়ে গেছে তন্দ্রাঘোরে। ফাঁকা হাতটা চোখের সামনে এনে পরখ করে উঠে দাঁড়ালাম। তিনি গভীরতর তন্দ্রায়। ভাঁজ করে রাখা কম্বলটা টেনে গায়ে জড়িয়ে দিলাম। রান্নাঘরের দিকে অগ্ৰসর হলাম। দেখতে তো বসবাসের উপযোগী, রান্নার সামগ্রী থাকতে পারএনা, এটা হতেই পারেনা। কেক তৈরি করার সকল উপকরণ পেয়ে গেলাম। কেকটা মাইক্রোওভেনে রেখে চায়ের পানি চুলায় দিলাম। চিনি, চায়ের পাতা দিয়ে দাঁড়ালাম। ফুটছে দেখে চুলার আঁচ কমিয়ে দিয়ে অন্যরুমে গেলাম। সেখানে আমার জামা কাপড় ভর্তি ব্যাগটা পড়ে আছে নিচে। একটা সবুজ রঙের শাড়ি পেলাম। সন্তুষ্ট হলাম এতেই। অনিচ্ছার সত্বেও সাথে চলে এসেছে, এতেই ঢের। শাড়িটা গায়ে জড়ালাম। পুনরায় রান্নাঘরে ফিরে এলাম। কেক ইতোমধ্যে হয়ে এসেছে। কাপে চা ঢেলে ধ্রুবের রুমে গেলাম। শাড়ি পড়ে নতুন বউয়ের ন্যায় লজ্জা নামক জিনিসটা ঘিরে ধরেছে। কাবু হলাম। নিজেকে শান্ত করে ভেতরে প্রবেশ করলাম। ধ্রুব উবুত হয়ে ঘুমিয়ে আছে। বালিশটা সরে গেছে। মুখশ্রীতে তৈলাক্ত ভাবটা জেগে উঠেছে। মায়াবী লাগছে তাকে। ইচ্ছে করে হাত বাড়িয়ে তার মুখশ্রী স্পর্শ করতে। নিজের ভাবনায় নিজেই লজ্জানত হলাম। কম্পন সৃষ্টি হল। চায়ের কাপটা রীতিমতো ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল। দুইহাতে আগলে ধরলাম দ্রুত। ছ্যাকা লাগল হাতে। আহ্ করে আর্তনাদ করে উঠলাম। অবিলম্বে ধ্রুব লাফ দিয়ে উঠে বসলেন। বিচলিত হয়ে বললেন, “ক কী হয়েছে?”

ক্রমাগত কাঁপছে হাত। চটচটে গলায় বললাম, “চা, আপনার চা।”

আমার মাথা থেকে পা অবধি অবলোকন করে শান্ত গলায় বললেন,

“বাহ্! আজকে তোমাকে বউ বউ লাগছে।”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]