মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব-২৪

0
642

#মেঘমিশ্রিত_পূর্ণিমা 🤎
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২৪

“কী হয়েছিল চড়ুই, কাঁদছিলে কেন? কীসব বলছিলে শর্ত মানবে, দেখা করব?”

একেরপর এক প্রশ্ন করেও যেন শান্ত হতে পারলেন না ধ্রুব। অশান্ত হয়ে উত্তরের প্রতিক্ষায় চেয়ে আছেন। উপায়হীন আমি। কী জবাব বা প্রতিক্রিয়া দেওয়া উচিত বুঝতে ব্যর্থ। অব্যক্ত কণ্ঠে বললাম,

“কোথায় কাঁদছিলাম?”

“কাঁদো নি বলছ? তোমার গলা মলিন কেন ছিল? শর্তই বা কীসের?”

অস্পষ্ট স্বরে বললাম, “আমি বাবুইকে শর্তের কথা বলছিলাম। আপনি ফোন করেছেন নাম্বার না দেখেই।”

ধ্রুব সন্দিহান গলায় বললেন, “সত্যি বলছ তো?”

তৎক্ষণাৎ ক্লাস রুমের কথা মনে পড়ল। ধ্রুবের ঘুমের কথাটা জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, তার ব্যক্তিগত কথা। অভিমানে জর্জরিত হয়ে প্রত্যুত্তর দিলাম,
“এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার স্যার, আপনাকে বলতে বাধ্য নই। অথচ সেই বোধটুকুও নেই আপনার।”

ধ্রুব মাথা নিচু করলেন। ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলেন মৃদু। প্রসারিত হল মুখশ্রী। আমার অভিমান বুঝতে তিনি সফল। হাতটা নিজের আয়ত্তে নিলেন। জিন্সের পকেট থেকে মেহেদি বের করলেন। ডিজাইন করে দিলেন সন্তর্পণে। হাতে আর্দ্র স্পর্শ পেয়ে অবলোকন করলাম আমি। নড়ালাম না হাত, পাথরের ন্যায় বসে রইলাম স্থির হয়ে। এক হাতে মেহেদী পড়িয়ে অন্যহাতেও শুরু করলেন। আমি মুখ ভার করে রাখলাম। পুরো হাতে মেহেদী দেওয়া শেষ করে বললেন,
“তুমি কী তুলো খাও চড়ুই? চড়ুই পাখির শরীর নরম হয় জানতাম। কিন্তু চড়ুইয়ের শরীরও নরম। জিম করে এত নরম শরীর হয় কী করে? [ব্যঙ্গ করে বললেন] ললিপপ খেলে এত নরম থাকে বুঝি?”

আমি প্রত্যুত্তর না দিয়ে হাতের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। করতলের মাঝ বরাবর ছোট সাইজে ‘D’ লেখা। লুকানো, খুঁজে পাওয়া দুস্কর। ডিজাইন বেশ চমৎকার। আর কী কী গুনে মিশ্রিত তিনি।
মুচকি হেসে বললেন, “প্রথমত, আজ বিয়েতে থাকার কথা ছিল। অবশ্যই তোমার হাতজোড়া রাঙা থাকার কথা ছিল। কিন্তু আমার জন্য সম্ভব হয়নি, তাই আমিই রাঙিয়ে দিলাম। দ্বিতীয়ত, তুমি আমার ব্যক্তিগত। তাই ব্যক্তিগত রাখাই শ্রেয়। ব্যক্তিগত আর পেশা জিনিস দু’টো একসাথে মেশাতে চাইছি না। এতে আমার লাইফেও যেমন প্রভাব পড়বে, তারচেয়ে বেশি তোমার লাইফে। এবার বলো, তুমি কী চাও?”

তার দেওয়া যুক্তি যথার্থ। আমি ভুল! শুধু ভুলই নয়, চরম ভুল। আমিও চাই একটা দূরত্ব রাখতে।

গলা চুলকাচ্ছে। কানের ভেতরেও চুলকাচ্ছে, পিঠও ছাড়ছে না। একমাত্র এই কারণে দুই হাতে দেই না। মুচড়া-মুচড়ি করা শুরু করে দিলাম। ধ্রুব দাঁড়ালেন পেছনে এসে। আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। তৎক্ষণাৎ হিম স্পর্শ পেলাম পিঠে। চেইন খুলে জায়গায় চুলকিয়ে দিচ্ছেন‌। পলক থেমে গেল চোখের। কম্পন ছড়িয়ে পড়ল সর্বাঙ্গে। দ্রুত কণ্ঠে বললাম, “কী করছেন?”

“তোমাকে সাহায্য করলাম।” চেইন টেনে বললেন।

“আমি কি আপনাকে সাহায্য করতে বলেছি? ছিঃ! ছিঃ!”
ভ্রু কুঁচকালেন তিনি। গালের কোণায় স্লাইড করতে করতে বললেন, “আমি অন্য মেয়েকে স্পর্শ করেছি বুঝি? নিজের বিবাহিত বউকে স্পর্শ করেছি।
আমি চাইলে এই মুহূর্তে বাসরটাও করতে পারি, কে আটকাবে শুনি?”

লজ্জায় চোখ কুঁচকে এলো। ক্ষুদ্র হল মুখশ্রী। দৃষ্টি সরিয়ে ফেললাম। মাথা ধরে উঠল। মনে পড়ল, সেই দিনের কথা! আমার জ্বর আসার কারণে লাইব্রেরীতে ধ্রুব জ্বর পট্টি দিচ্ছিলেন। স্বপ্নটা সত্যি হল বলে। প্রসঙ্গ পাল্টে বললাম, “আপনি বাসর ছাড়া আর কিছু বলতে পারেন না?”

“পারি। ওমা! পারব না কেন? শুধু এই বাসরটাই করা হয়নি। দেখতে চাইছিলাম পারি কি-না?”

“সরুন, সরুন।”
তৎক্ষণাৎ শব্দ করে হাঁটতে হাঁটতে উপস্থিত হলেন রাহাত স্যার। কর্ণপথে মুঠোফোন ধরা। আমি সরে এলাম। রাহাত স্যার ফোনটা নামিয়ে স্বাভাবিক গলায় বললেন,
“তুমি এখানে কী করছ? বাড়িতে যাও। তৈরি হও। আজ মা তোমাকে দেখতে যাবে।”

অব্যক্ত স্বরে বললাম, “মা দেখতে আসবে মানে? কার মা, কীসের মা, কাকে দেখতে আসবে?”

“কাকে আবার তোমাকে। আমার মা আর ধ্রুবের মা।”

ধ্রুব অবাকের সুরে বললেন, “মা তো গ্ৰামে।”

“আন্টির সাথে কথা হয়েছে, তিনি অনুষ্ঠান শেষেই শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হবেন।”

_____
আঁধারে নিমজ্জিত আকাশ। মিটিমিটি তারারা জুড়ে রয়েছে বুক। ভাসমান বড় চাঁদের এক খণ্ড অনুপস্থিত। লুকিয়ে আছে অন্ধকারে। ঠিক তেমনি ঘোমটার আড়ালে লুকানো আমার লজ্জামিশ্রিত মুখশ্রী। রাহাত স্যারের বমা এসেছে, সাথে এসেছেন ধ্রুব এবং তার মা রমিলা আন্টি। টি টেবিলের উপর হরেক রকমের খাবার সাজানো। সকলে একটু খেলেও ধ্রুব স্পর্শ অবধি করেনি। গম্ভীর তার মুখমণ্ডল। নিজের মা যখন ঘটক সেজে ছেলের সামনে তার বউকে বন্ধুর হাতে তুলে দেয়। হাসব না-কি কাঁদব বুঝতে পারলাম না। এদিকে বাবুইয়ের চিন্তায় মশগুল। উপায় খুঁজে পাইনি। আমার ভাবনার ইতি টেনে রমিলা আন্টি বললেন,
“আমার বউমা বলে বলছিনা, লক্ষ্মী মন্ত্র মেয়ে।”

রাহাত স্যারের মা ফিচেল হেসে বললেন, “তা বুঝলাম, ভার্জিন মেয়ে তো!”

ধ্রুব এবার তেড়ে উঠলেন। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন, “কেন? ভার্জিন না হলে ছেলের বিয়ে দিবেন না বুঝি, তাহলে আসতে পারেন।
রাহাত তোর মাকে নিয়ে যা..

সবাই মুখ টিপে হাসলেন। রাহাত স্যার তার মাকে বললেন, “মা, কীসব বলছ? তোমাকে যার জন্য এনেছি সেটা দেখো।”

বলেই পাশে ইশারা করলেন। বাবুই আমার পাশেই বসা। রাহাতের মা হাত বাড়িয়ে বাবুইকে একবার ডাকলেন। বাবুই তার পাশে বসতেই সোজাসাপ্টা বললেন,
“তোমরা দুইজন ঐ ঘরটাতে গিয়ে কথা বলে এসো। আমি বরং বাবুইয়ের সাথে কথা বলি।”

মামুনির দিকে তাকাতে তিনিও সায় দিয়ে যেতে বললেন। আমি দ্রুত পা চালিয়ে ঘরে ঢুকলাম।

__
“রাহাত স্যার, আপনি তো জানেন আমার আর ধ্রুব স্যারের ব্যাপারটা। তবুও কেন এইসব করছেন?”

রাহাত স্যার জানালা ঘেঁষে দাঁড়ালেন। পাঞ্জাবির কলার উঁচু করে হাওয়া করছেন। খোলা জানালার হাওয়াতে লেপ্টে আসা চুলগুলো পেছনে স্তরে স্তরে গুছিয়ে নিতে নিতে বললেন, “দুইজনের মধ্যবর্তী দূরত্ব ঘুচিয়ে দিতে হলে, তৃতীয় ব্যক্তির প্রয়োজন পড়ে।”

আমি কথাগুলো ধীর সুস্থে আওড়ালাম।
দরজা খোলা। তবে একটু ভেড়ানো। কড়া নাড়ল কেউ। আমি দরজার কাছে গেলাম। মামুনি চা দিয়ে গেলেন দুইকাপ। আমি টেবিলের উপর ট্রে রেখে চা ভর্তি কাপটা এগিয়ে দিলাম। রাহাত স্যারের হাতে তখন আমার ফোন। আমি দ্রুত কেড়ে নিলাম। চায়ের কাপ জোরপূর্বক হাতে ধরিয়ে দিলাম। অন্যপাশে এসে দাঁড়ালাম। আমার ফোন বিছানায় ছিল। মেসেজের টোন শুনে তিনি ধরেছেন। আমি ফোনে স্ক্রিন লক করে রাখা পছন্দ করিনা। কিন্তু একটু তো সাবধান হওয়ার প্রয়োজন ছিল।

চায়ের কাপটা তীক্ষ্ণ শব্দে টেবিলের উপর রাখলেন। ছিটকে পড়ল তরল চা। চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, “এইসব কী চড়ুই? তোমাকে এই ধরনের মেসেজ কে পাঠিয়েছে? তুমি রিপ্লাই করছ আবার।
পুরোটা আমি পড়তে চাই, ফোন দাও।”

আমি ফোনটা শাড়ির নিচে লুকিয়ে তড়িগড়ি করে বললাম, “প্লীজ কাউকে বলবেন না, আমার অনুরোধ।
আমি আপনাকেও বলতে চাইছি না।”

“চড়ুই আমাকে বলো, আমি জানতে চাই। তুমি বলা না অবধি কাউকে বলব না। প্লীজ!”

চোখজোড়া ছলছলিয়ে উঠল। ঘনঘন পলক ফেলে সামলে নিলাম। ধীরে ধীরে খুলে বললাম সবটা। সেদিনের ঘটনা থেকে আজ অবধি। তিনি বিস্মিত হলেন। হতবাক হয়ে বললেন,
“তুমি আগে কেন বলো নি আমায়?”

“জানালে সমস্যা হতে পারে, তাছাড়া আমি চাইছি না কেউ জানুক।”

রাহাত স্যার ক্ষোভে ফুঁসতে লাগলেন ক্রমাগত। ড্রেসিং টেবিলের উপর সাজানো জিনিসগুলো ছুঁড়লেন। দৃঢ় করে চুল চেপে ধরে টেনে টেনে বললেন, “এই জা’নোয়া’রের বাচ্চাদের আমি ছাড়ব না। আমার বাবুইয়ের ভিডিও তো দূরে থাক, ওর দিকে বাজে দৃষ্টিতে তাকালেও চোখ তুলে নিবো।”

আমি হতবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম রাহাত স্যারের পানে। সেই একই ক্ষোভ, একই রাগ, এক কথা বলার ভঙ্গি। শুধু গায়ের রঙ একটু চাপা, উজ্জ্বল শ্যামলা। বাদবাকি সব একই।

দরজায় নক পড়ল। আমি চোখ মুছতে অন্যদিকে ফিরলাম, রাহাত স্যার তিনিও উল্টো ঘুরে দাঁড়ালেন।
নিঃশব্দে প্রবেশ করলেন কেউ। শব্দ নেই হাঁটায়। এত বিচক্ষণ চিন্তাশক্তি কেবল ধ্রুবের। আমার ধারণা সঠিক প্রমাণ করে ধ্রুব বললেন, “তোরা দুজন দুইদিকে ফিরে আছিস কেন আর ঘরের অবস্থা এমন কেন?”

আমি ফিরলাম না। রাহাত স্যার সরল ভাষায় বললেন, “কী লুকাব? বস!”

“তা বসব। কিন্তু চড়ুই মুখ লুকিয়ে আছো কেন?”
বলেই এগিয়ে এলেন আমার দিকে। মুখ তুলে চোখ রাখলেন চোখে। আমার দৃষ্টি বরাবরের মতো নিচু। তিনি হা হুতাশ করে বললেন, “চড়ুই কাঁদছ কেন? কী হয়েছে?”

“কিছু না, এমনিতেই!”

রাহাত স্যার বললেন, “তোর বউ কেন কাঁদছে, আমি কীভাবে বলব? আশ্চর্য!”

“সেই তো! তোরা কীভাবে বলবি? তবে আমিও ধ্রুব। ইরফান মাহতাব ধ্রুব। তোদের লুকোচুরিও খুঁজে বের করব। [আমার দিকে ফিরে] আমি হয়ত তোমার যোগ্য নয়, তাই জানার অধিকারও নেই।”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]