❝মোহ মেঘের আলাপন ❞
লেখিকা: “নূরজাহান আক্তার আলো”
[১৫]
-”আ আম আমার বাবার কি হয়েছিলো?”
মেধার মুখে এমন প্রশ্ন শুনে আমান দৃষ্টি তুলে তাকালো। সে কেবিনের অপর বেডে বসে ফোন স্কল করছিলো। আদিত্য গেছে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে। টেস্টের রিপোর্ট এসেছে সেগুলোই দেখাতে। মেধার জ্ঞান ফিরেছে দেখে আমান চট করে উঠে দাঁড়ালো। উচ্চশব্দে চেঁচিয়ে নার্সকে ডেকে ঝটপট ডাক্তারকে ডাকতে বললো। মেধা তখনো জবাবের আশায় তাকিয়ে আছে। তার অনেক কিছুই জানার আছে। বাবা সুস্থ
অবস্থায় গেল হঠাৎ কি হলো?তাছাড়া বাবা তাকে সব কথায় শেয়ার করতো। মনের যত কথা আছে খোলা মনে বলতেন, পরামর্শ চায়তেন। এমনকি গতকালও বাবার সঙ্গে কত হেসে
মজা করে কথাও বলেছে। ওর জন্য কী কী আনতে হবে তা মনে করিয়েও দিয়েছে। কই তখন তো একবারো মনে হয় নি বাবা অসুস্থ। ক্ষুণাক্ষরে টেরও পায় নি প্রিয় বাবাকে হারিয়ে ফেলবে। আর কখনো পারবেও না ছুঁয়ে দেখতে। ইস, আগে যদি টের পেতো কখনোই কল কাটতো না। না দূরে কোথাও যেতে দিতো। এসব ভেবে মেধার কান্না বেড়ে গেল। বাঁধভাঙ্গা
কষ্টে পুড়তে লাগল। তখন আমান মেধায় মাথায় আলতো হাত রেখে আদুরে কন্ঠে বলল,
-”খারাপ লাগছে বনু? কোথায় কষ্ট হচ্ছে বল আমায়?”
মেধা তখনো কেঁদেই যাচ্ছে। তার অশ্রুফোঁটা অঝরে গড়িয়ে যাচ্ছে দু’ চোখের কার্ণিশ বেয়ে। বাবার মুখটা চোখের সামনে ভাসছে। কানে বাজছে, ” ওহ আম্মাজান, আম্মাজান। ”
কাঁদতে কাঁদতেই মেধা এবার অস্পষ্টভাবে উচ্চারণ করলো, “বা বা বাবা, ওহ বাবা, কোথায় তুমি বাবা?”
মেধাকে ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে দেখে আমানের চোখ ছলছল করে উঠলো। বুক টা কেঁপে উঠলো অসহায় মেধার মুখখানা দেখে। সেও নীরবে অশ্রু ঝরাতে লাগল। সে আবার কারো কান্না দেখতে পারে না। আপনজনদের কান্না তো আরো নয়।
তবে একটা সময় মেধাকে সে সহ্যই করতে পারতো না। চুপি
চুপি আড়ালে ডেকে মেরেছে অনেকবার। ইচ্ছে করে ওর চুল টেনে, ঝুঁটি খুলে দিয়ে কাঁদিয়েছে বহুবার। মেরে আবার খুব কড়াভাবে হুমকি দিতো যাতে কাউকে না বলে। একদিন এটা আদিত্য দেখেও নিয়েছিলো। তারপর ওকে কান ধরে উঠবস করে মেধাকে সরিও বলিয়েছিলো। এতে তার রাগটা দ্বিগুন বেড়ে গিয়েছিলো। এমনিতে মেধার কারণে সে মাকে কাছেই পায় না। তার মা মেধাকে ভালোবাসে। তখন আবার ভাইটাও
মেধার দলেই নাম লিখালো। তার মতে সেটা ছিলো অন্যায়, ঘোর অন্যায়। এসব চিন্তা সর্বদা ওর মাথায় ঘুরপাক খেতো। এছাড়া মেধা তার নিজের বোনও নয়, খালাতো বোন। খালা মারা গেছে মানে মেধা এখন পর। সম্পর্কের তালটা নড়বড়ে
তাহলে কেন ভালোবাসবে? কেন আদর -আহ্লাদ করবে তার কাছে? এসব ভাবতো আর ছোট্ট মেধার উপরে রাগ মিটাতো সে।
যদিও এসব ধারণা বদলে গিয়েছে অনেক আগেই। একবার মারাত্মকভাবে বাইক এক্সিডেন্ট করে পা ভেঙে ফেলেছিলো সে। ডাক্তার জানিয়েছিলেন আর কখনোই হাঁটতে পারবে না সে। সারাজীবন হুইল চেয়ারের সাহায্য নিতে হবে। পঙ্গুত্বকে বরণ করতে হবে।একথা শুনে মেধার সে কী কান্না। কাঁদতে কাঁদতে জ্বর বাঁধিয়ে ফেলেছিলো। তার কথা ছিলো, “আমাল আমান বাইয়ের পা ঠিক করে দাও ডাকতাল। বাইয়া যে কুব কষ্ট পাচ্ছে।”
সেদিনের সেই কান্নায় তার মন গলিতে দিয়েছিলো। অনুভব করেছিলো এমন মিষ্টি একটা বোন থাকলে মন্দ হয় না।বরং বেশ ভালো হবে। আর আদিত্যের ওদের তুলনায় অনেক বড় হওয়াতে মেধা আদিত্যের কাছে কম ঘেঁষতো। দূর থেকেই সে আদিত্যকে ফলো করতো।কেন জানি আদিত্য ছোট থেকেই কম কথা বলে, হুইহুলোড় থেকে সর্বদা দূরে থাকে। অথচ সে মেধাকে এত মারতো তাও মেধা ওর কাছেই ঘুরঘুর করতো। ধীরে ধীরে মেধা বড় হতে থাকল তার আবদারও বেড়ে যেতে লাগল। দিন দিন আপন বোনের মতোই ভালোবাসা আদায় করে ছাড়লো। সে এখন জোর গলায় বলতেও পারে, মেধা তার ছোট বোন। এমনকি তার কিছু কিছু বন্ধুরা তাই জানে।
সেই সঙ্গে অঘোষিত ভাবে মেধার নির্দিষ্ট কোনো বাসা নেই। সবগুলো তাই দখলে। আর আদিত্যের মেধার প্রতি দূর্বলতা আগেই ধরে ফেলেছিলো সে। তবে কখনো বুঝতে দিতো না।
তাছাড়া বিগত তিনটাদিন নিজের চোখে দেখেছে আদিত্যের ছটফটানি। ওর লালবর্ণ নেত্রজোড়া মেধার দিকে স্থিরীকৃত।
সেই সঙ্গে তার দৃষ্টিতেই স্পষ্ট প্রণয়ের গভীরতা। মোদ্দাকথা,
আদিত্য অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে না, মুখ ফুটে বলতেও পারে না মনের কথা। কিন্তু ওর নিগূঢ় ভালোবাসায় বিন্দুমাত্র খাঁত নেই। সেই দিক থেকে মেধা রাণী সৌভাগ্যবতী। এসব ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে আমান তার চোখ মুছে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বলল,
-”জানিস এই তিনদিন আমার ভাইটার কি অবস্থা করেছিস?
তোর বিরহে কি অবস্থা করেছে সে নিজের?”
তখনো মেধার ডাগর ডাগর চোখ থেকে ঝরে যাচ্ছে অজস্র নোনাজল। আমান পুনরায় তার চোখ মুছে দিতেই আদিত্য দৌড়ে কেবিনে প্রবেশ করলো। আমান একবার বড় ভাইয়ের
দিকে তাকিয়ে কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে গেল। কেবিনের দরজা লাগানোর শব্দ কানে যেতেই আদিত্য কালবিলম্ব করলো না। চট করে মেধাকে বুকের সঙ্গে মিশিয়ে নিলো। তিনদিনে এক
রাশ বিরহ জমেছে বুকের বাঁ পাশে। হারানোর ভয়টাও নির্মম ভাবে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাকে। স্বস্ত্বি যেনো বিলুপ্ত এই পৃথিবী থেকে। একদিন সীমা বেগম আর অন্যদিকে মেধা। অথচ এ দু’জনের মাঝের তার সুখ লুকায়িত। তখন মেধা আদিত্যের বুকে মুখ লুকিয়ে করুণ সুরে বললো,
-”বলুন না বাবার কি হয়েছিলো? আমাকে রেখে বাবা কেন চলে গেল?”
-”এসব কথা এখন থাক।”
-”না আমি এখনই জানতে চাই, প্লিজ বলুন।”
-”আঙ্কেলের হার্টে সমস্যা ছিলো৷ সেটার চিৎকার করতে উনি দেশের বাইরে গিয়েছিলেন। তুমি কান্নাকাটি করবা ভেবে সব
কথা তোমার থেকে গোপন করেছিলেন। সেই সঙ্গে আমায়ও আদেশ দিয়েছিলেন যাতে না জানায়। তারপর ওখানে গিয়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়ে জানলেন অপারেশন করালে নাকি সুস্থ হয়ে যাবেন। যদিও ডাক্তার স্পষ্টভাবে এও বলেছিলেন সুস্থ হওয়ার চান্স ফিফটি ফিফটি। উনি তোমার কথা ভেবেই আর পিছ পা হন নি। অপারেশন করাতেই রাজি হয়ে যান।
উনার কথা ছিলো ‘আমি আমার মেয়েটার সঙ্গে আরো কিছু দিন বাঁচতে চাই।’ উনি উনার সিদ্ধান্তে অটল থাকায় আমিই আমানকে উনার কাছে পাঠায়। আর তোমাদেরকে বলতে বলি ট্যূরে যাচ্ছে।তারপর ডাক্তারের কথামতো অপারেশনের
ডেট ঠিক হয়। এই অবধি ঠিকই ছিলো…।”
-”তারপর?”
-”তারপর হঠাৎ উনার প্রেশার হাই হয়ে যায়। সেই সঙ্গে দেখা দেয় আরো কিছু জটিলতা। আর তখনই উনি……!”
মেধা চোখজোড়া বন্ধ করে নিলো। পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে। তখন ডাক্তার এসে চেকআপ করে কিছু মেডিসিন দিলেন। মেধার জেদের কাছে হার মেনে তাকে বাসাতে নিয়ে যাওয়া হলো। কিন্তু সে বাসায় না গিয়ে প্রথমে গেলো বাবার কবর দেখতে। তার মায়ের পাশে তার বাবা চিরদ্রায় শায়িত।
সে অশ্রু ঝরিয়ে দু’টো কবরের মাটিতেই হাত বুলিয়ে কাঁদতে
লাগল। সময় গড়ালো, ঘন্টাও পেরোলো। কিন্তু মেধা অনড় হয়ে সেখানেই বসে রইল। তারপর কীসব ভেবে আদিত্যকে বলল,
-”আমার বাবা আমার সঙ্গে আরো কিছুদিন বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন। তা তো হলো না। তবে আমি বেঁচে থেকে কী বা করবো?”
এমন প্রশ্নে আদিত্য নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে রইল। বুকে অদৃশ্য আনলে পুড়তে থাকলো। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
-”আমার জন্য বেঁচে থাকা যায় না?”
-”আজ অথবা কাল আমাকে আপনারও বোঝা মনে হবে না এর গ্যারান্টি কি?”
-”প্রিয় মানুষটি কখনো কারো বোঝা হয় না। তবে হ্যাঁ তোমার ভালো জন্য যখন যা করতে হয় আমি তাই’ই করবো। কারণ তুমি আমার কাছে তোমার বাবার দেওয়া শ্রেষ্ঠ আমানত।”
এই কথার জবাবে মেধা আর টু শব্দ করল না। বরং নিচের দিকে তাকিয়ে অশ্রু ঝরাতে লাগল।তারপর আরো কিছুক্ষণ থেকে ওরা বাসায় ফিরলো। সীমা বেগম মেধাকে দেখে বুকে জড়িয়ে অশ্রু ঝরালেন। কঠিন সত্যকে মেনে নিতে বললেন।
কারণ ‘মৃত্যু ‘ আমাদের জীবনে শুদ্ধতম কঠিন সত্য। এখানে কারো হাত নেই। আর এই সত্যকে মেনে বেঁচে থাকার নামই জীবন।এমন অনেক কথা বলে মেধাকে বুঝালেন, স্বাভাবিক
হতে আশ্বত্ব করলেন। তারপর উনি নিজ হাতে মেধাকে অল্প খাবার আর ওষুধ খাওয়ালেন। মেধার মাথা নিজের কোলে রেখে আলতো করে ওর চুলে বিলি কাটতে থাকলেন। এমন করাতে একটা সময় মেধা ঘুমিয়ে গেল। সীমা বেগম মেধার কপালে চুমু এঁকে সুন্দরভাবে শুঁইয়ে পাশেই বসে রইলেন।
রাতের খাবার টেবিলের আদিত্যের বাবা সবাইকে বললেন মেধাকে সঙ্গ দিতে, বোঝাতে। তার মন খারাপ যেনো না হয় সেটা খেয়ালও রাখতে। উনার কথায় বাকিরা সহমত হলেন
। আর পরেরদিন থেকে সকালেই তাই করলো। আমান যখন তখন মেধাকে জ্বালানো পরিমান বাড়িয়ে দিলো। আদিত্যও মেধার পছন্দের কিছু না কিছু রোজ এনে তার রুমে রাখে। মেধা কখনো ছুঁয়ে দেখো তো কখনো ধারে কাছেও ঘেঁষে না।
সীমা বেগম এবং আদিত্যের বাবাও পিছিয়ে নেই। উনারাও যথাসাধ্য চেষ্টা করেন মেধাকে ভালো রাখতে, খুশি রাখতে।
এভাবেই তার দিন কাটতে লাগল। মেধা পুনরায় পড়াশোনায় মনোনিবেশ করলো। সেই সঙ্গে তিক্ত পরিস্থিতি মেনে আগের তুলনায় নিজেকে স্বাভাবিক করার লড়াই চলতেই থাকলো।
এভাবে সুখে, দুঃখে অতিবাহিত হয়ে গেল তিনমাস। আত্নীয় স্বজন সীমা বেগমকে আকার ইঙ্গিত অন্য কিছুই বলে। তবে
উনি গুরুত্ব দেন না। তবে এবার উনিও ভেবেছেন আদিত্যের সঙ্গে মেধার বিয়ে সম্পূর্ণ করবেন। এ সপ্তাহে মেধার পরীক্ষা শেষ তাই সামনে সপ্তাহেই শুভ কাজ সেরে ফেলবেন। মনের মতো করে সাজিয়ে ঘরে তুলবেন মেধাকে। আদিত্যের পাশে মেধা রেখে দু’চোখ ভরে দেখবেন, দোয়া করবেন। পরিশেষে ওদের ভালোবাসার মিষ্ট পূর্ণতা পাইয়ে তৃপ্তির হাসি হাসবেন।
কিন্তু জীবন তো কারো পরিকল্পনা মাফিক সরল পথে চলে না, এটা হয়তো সীমা বেগমের স্মরণ ছিলো না।
To be continue……..!!