মোহ মেঘের আলাপন পর্ব-১৬+১৭

0
314

❝মোহ মেঘের আলাপন ❞
লেখিকা: “নূরজাহান আক্তার আলো”
[১৬]

দিনটি বরিবার। গ্রীষ্মের ভ্যাপসা গরমে অতিষ্ঠ জন জীবন।
তার উপরে সকাল থেকে বিদ্যুৎ নেই।বাসার জেনারেটরেরও সমস্যা দেখা দিয়েছে। এত গরমে সীমা বেগমের প্রেশার হাই হয়ে যাচ্ছে। উনি মাঝে মাঝে আইস ব্যাগ মাথাতে দিয়ে বসে পড়ছেন। এত গরমে গালি দিয়ে ফেলেছেন বেশ কয়েকবার।
দিবে না নাই বা কেন? এত গরম সহ্য হয়?মূলত রাগে দুঃখে মুখে গালি এসে যাচ্ছে। আর গত সপ্তাহ থেকে গরম বেড়েছে সেই সাথে লোডশেডিংয়ের পরিমানও তত বৃদ্ধি পাচ্ছে।এসব অশান্তি গুলো একসাথে। এর মানে হয়! এখন যদি গরমের ঠেলায় উনি মারা যান তবে এই দায় ভার কে নিবে? নিবে বা কেন? এতে তো কারো কিছু যায় আসে না। এসব ভেবে উনি
বাগানে গিয়ে বসলেন। রোদের তাপে ফুল গাছ গুলো কেমন নেতিয়ে আছে। উনি সময় নিয়ে গাছে পানি দিলেন। আগাছা পরিষ্কার করলেন। ততক্ষণে সূর্যের তেজ বেড়ে গেছে। রোদে
শরীর পুড়িয়ে দিচ্ছে। সকালের আবহাওয়াতেও যেনো গরম ঢেলে পড়ছে।উনি বিরক্তিতে ‘চ’ শব্দ করে চলে এসে সোফায়
শরীর এলিয়ে দিলেন। মাথা কেমন জানি করছে। আজকাল মেপে গুনে খাবার খাচ্ছেন তবুও প্রেশার খুব সমস্যা করছে।
এই প্রেশার মৃ’ ত্যু’ ডেকে আনবে নাকি কে জানে? যদিও তা
নিয়ে আর কোনো চিন্তা নেই। দুই ছেলে বড় হয়ে গেছে, মেধা
সঠিক সঙ্গী পেয়েছে। এই আমানের একটা গতি হলে ভালো হতো। ছেলেটার বড্ড বেশি জেদ। কবে যে মাথা ঠান্ডা হবে? ভালো মন্দের তফাৎ বুঝবে। তবে নিজের হাতে গড়া সংসার নিয়ে খুব সুখেই আছেন, ভালো আছেন। এখন মারা গেলেও আফসোস নেই। তবে বড্ড শখ দুই ছেলের বউ দেখার। প্রাণ ভরে তাদের জন্য দোয়া করার। কিন্তু শরীরের যা অবস্থা..!
এসব ভেবে উনি চুপ করে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। গতরাত থেকে উনার মনটা বড্ড উতলা হয়ে আছে। কীসব টেনশন এসে মস্তিষ্কে খোঁচা দিয়ে যাচ্ছে। প্রথম প্রথম পাত্তা না দিলেও এখন মনে হচ্ছে খারাপ কিছু ঘটবে। এতে বাসাটা শান্তি হারিয়ে নিষ্প্রাণ হয়ে যাবে।এসব নানা চিন্তায় মশগুল
সীমা বেগম। তখন মেধা বেজার মুখে এসে পাশে বসল। ওর গালে ব্রণ উঠেছে।ফর্সা গালে লাল টকটক করছে দুটো ব্রণ।
সীমা বেগম দৃষ্টি তুলে মেধার দিকে তাকিয়ে চুপ করে আছে।
বাবা-মা মরা মেয়েটার গতি করতে হবে শীঘ্রই। ওকে নিয়েও আজকাল অনেকের কানাঘুষা হচ্ছে। এইতো গতকালই তো
এক প্রতিবেশী ইঙ্গিতে অনেক কিছুই বললেন। আগুনে আর ঘি পাশাপাশি রাখলে বিপদ বাড়বে তার ইঙ্গিতও দিলেন।এর
জবাবে কিছু বলেন নি তিনি। তবে কতদিন বা চুপ থাকবেন?
এই শুক্রবারেই আদিত্য আর মেধার বিয়ের কাজটা সম্পূর্ণ
করবেন। উনাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে তখন মেধা বললো,

-”মামনি কিছু কি হয়েছে? শরীর খারাপ করছে তোমার?”

-”আদিত্য কোথায়?”

-”জানি না, ফোন করে ডাকবো?”

-”ফোন করে বল বাইরে থেকে সকালের নাস্তা আনতে। কেন জানি খুব অস্থির লাগছে আমার।”

-”তুমি রুমে গিয়ে একটু শুয়ে থাকো আমি বলছি।”

-”পন্ডিতি করে তোকে রান্না করতে যেতে হবে না। যা বলছি তাই কর।”

-”হুম।”

ঠিক তখন বিদ্যুৎ এলো। সিলিংয়ের বাতাস শরীরে লাগতেই জুড়িয়ে গেল মন। প্রাণ যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো। প্রশান্তিতে চোখজোড়া বুজে এলো।তখন সীমা বেগম উঠে রুমের দিকে যেতে যেতে বললেন মেধাকে পন্ডিতি না করতে।বাসায় কেউ কেউ নেই হিতে বিপরীত হতে পারে।জবাবে মেধা ভদ্রমেয়ের মতো সম্মতি সূচক মাথা নাড়ালো। তারপর উপরের যেতে পা বাড়াতে বাইকের হর্ণ শুনতে পেলো। দাঁড়িয়ে গেল সেখানেই।
ওইতো আমান এসে গেছে। ওকে দিয়ে নাস্তা আনাতে হবে।
আমান শিষ বাজাতে বাজাতে ঢুকতেই মেধা গিয়ে বলল,

-”ভাইয়া, নাস্তা বাইরে থেকে আনতে বলেছে মামনি।”

-”আম্মু অসুস্থ নাকি?”

-”হুম, প্রোশার বেড়েছে।”

-”তোর বরকে গিয়ে বল কেবল বাইরে থেকে আসলাম।এখন ফ্রেশ হয়ে ঘুমাবো আমি।”

-”না, চলো, আমিও যাবো তোমার সঙ্গে। আমার ভীষণ ক্ষুধা লেগেছে। তাছাড়া আদিত্য ভাইও বাসায় নেই। উনার বন্ধুর মা মারা গেছে গতরাতে সেখানেই গেছে, ফিরে নি এখনো।”

একথা শুনে আমান প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে মেধার দিকে তাকিয়ে রইলো। তখন মেধা বিশ্বজয় করা হাসি হাসলো। সেটা দেখে আমান তার কপালে একটা ঠুয়া মেরে বললো,”চল সামনে হাঁট।”
মেধা এবার ওর বিরক্তমাখা মুখ দেখে খিলখিল করে হেসে সামনে এগোতে থাকল। দু’জনে বাইকে উঠে গেট পার হতেই আদিত্যের গাড়ির মুখোমুখি হলো। আমান দ্রুত ব্রেক কষলে
আদিত্য মুখ বাড়িয়ে মেধাকে জিজ্ঞাসা করলো,

-”কোথায় যাওয়া হচ্ছে? ”

-”বাইরে, নাস্তা আনতে।”

-”দু’জন যাওয়া লাগবে? তুমি বাসায় চলো আমান যাক।”

-”আমি রাস্তা না চিনালে ভাইয়া যাবে কীভাবে, সে রাস্তাঘাট কিছু চিনে না, কি ভাইয়া ঠিক বলেছি না?”

-”জি ভাবিজান, ঠিক বলেছেন। এজন্য চিরকৃতজ্ঞ আমি।”
(আমান)

আমানের এই জবাবে মেধা পুনরায় হাসতে লাগল। ওর হাসি দেখে দুই ভাইয়ের মুখেও হাসি ফুটলো।তারপর পাশ কাটিয়ে বাইক নিয়ে যেতেই আদিত্য আমানকে বললো, “সাবধানে। ”
আমান ভাইয়ের কথা শুনে মুখভর্তি হাসি নিয়ে জবাবে মাথা ঝাঁকাল। আদিত্য এখন ওর সঙ্গে অল্প সল্প কথা বলে। ইঙ্গিত করে বোঝায় এটা ওটা করার। তাকে আবার সুযোগ দিয়েছে অপকর্ম ছাড়ার।তাই সে এখন নিজেকে শুধরে নিচ্ছে। বাবা মায়ের পা ধরে কেঁদে মাফও চেয়েছে। উনাদের সঙ্গে বহুবার খারাপ ব্যবহার করেছে, কষ্ট দিয়েছে। আর তার এই অমূল পরিবর্তনের যথেষ্ট কারণও আছে। সেই কারণ হচ্ছে মেধার বাবার মৃ’ ত্যু’। রোজোয়ানের মারা যাওয়ার পর গভীরভাবে সে কিছু উপলব্ধি করেছে। ওর মন এবং মস্তিষ্কে একটা কথা গেঁথে গেছে ‘জীবন সুন্দর। মৃত্যু অবধারিত।” আর এই মানব
জীবনে এই দুটো বাক্য চিরন্তন সত্য।ওর এসব ভাবনার ছেদ ঘটলো মেধার কথা শুনে। মেধা আদিত্য বলছে,

-”মামনি অসুস্থ এখন ঘুমাচ্ছে বোধহয়। আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন আমরা যাবো আর আসবো।

-”হুম।”

তখন আমান বাইক স্টার্ট করতেই মেধা আদিত্যদের দিকে ফ্রায়িং কিস ছুঁড়ে দিলো। আমান সামনের মিরবে তা দেখে হো হো করে হেসে উঠলো। আদিত্য ঠোঁট কামড়ে এক ভ্রুঁ উচু করে মেধার দিকেই তাকিয়ে আছে। আমানের সামনে এমন করার মানে হয়? মেয়েটা বড্ড জ্বালাচ্ছে আজকাল।না এরে
আর ছেড়ে রাখা যাবে না। যথা সম্ভব তার শরীরে বৈধ ট্যাগ লাগাতে হবে। আদিত্যকে ভ্রু কুঁচকে দেখে মেধা গেয়ে উঠল,

-”ওগো এভাবে তাকিও না। তোমার ওই প্রখর দৃষ্টিতে আমি বরবাদ হয়ে যাচ্ছি, নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছি পুরোটাই….।”

ততক্ষণে আমানের বাইক চলতে শুরু করেছে। তখনো মেধা চেঁচিয়ে বলে যাচ্ছে,

-”তুমি গিয়ে জলদি ফ্রেশ হও প্রিয় আমি আসছিইইইইইইই।”

আর ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আদিত্য উচ্চারণ করলো, “ফাজিল একটা।”

এরপর আদিত্য ওর গাড়ি নিয়ে বাসায় প্রবেশ করলো আর ওরা গেল নাস্তা আনতে। আদিত্য মাকে নিচে না পেয়ে ফ্রেশ হয়ে সীমা বেগমের রুমে গেল, প্রেশার চেক করলো। এখনো হাই প্রেশার দেখে মাথায় পানি ঢালতে সাহায্য করলো। মাথা মুছে হালকা খাবার খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে দিলো। সীমা বেগম শুয়ে আছেন আর আদিত্য উনার মাথা টিপে দিচ্ছেন। বেশ আরামের উনি বন্ধ নয়নজোড়া একবার খুলে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। মন থেকেই দোয়া এলো ছেলের জন্য। আদিত্যের কল পেয়ে জেনারেটর ঠিক করার লোকও এসে গেছে। সময় নিয়ে লোকটা জেনারেটর ঠিক করে টাকা নিয়ে চলে গেল। সীমা বেগমও ঘুমিয়ে পড়েছেন। আদিত্যের কল আসায় সে মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে নিজের রুমে চলে গেল। অফিসের ব্যাপারে কীসব আলোচনা করে কলটা কাটতেই তার ঘড়িতে নজর গেল। ওর যাওয়া প্রায় দেড়ঘন্টা
হতে যাচ্ছে। এত দেরি তো হওয়ার কথা না, তবে? সে আরো
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আমানকে কল দিলো। কিন্তু আশ্চর্য জনক ভাবে বার বার ফোন বন্ধ পাচ্ছে। মেধার নাম্বারে কল দিতেই তার ফোন রুমে বেজে উঠলো। জ্যামে পড়েছে ভেবে আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো। কিন্তু না ঘন্টার কাটা টিক
টিক করে চলতেই থাকলো, সময়ও গড়াতে লাগল। এভাবে চার ঘন্টা পেরিয়ে গেল। আদিত্য এবার উতলা হয়ে উঠলো।
বাসার সদর দরজাটা লক করে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।
ওরা বেশিরভাগ যে রেস্টুরেন্টের খাবার খায়, সেখানে গিয়ে জানতে পারলো আমান আসে নি। সামনের মোড়ে আমানের এক ফ্রেন্ডের বাবার বিরিয়ানি হাউজ আছে। সেখানে গিয়ে জানলো আমান গতরাতে গিয়ে বিরিয়ানি খেয়েছিল, আজ সকালে আসে নি। এভাবে অনেক জায়গায় খুঁজতে থাকলো আদিত্য। এমনকি আমানদের বন্ধুদের ফোন করেও খোঁজ করলো, তবুও কোনো সন্ধান মিললো না। এভাবে হন্ন হয়ে খুঁজতে খুঁজতে আরো ঘন্টা তিনেক পেরিয়েও গেল। অজানা ভয়ে তার বুক কাঁপছে। সেই সঙ্গে খোঁজ নিয়েছে আশেপাশে কোথাও এক্সিডেন্ট হয়ে কী না। না আজকে এক্সিডেন্টও হয় নি।আদিত্য টেনশনে ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে বাসায় ফিরে গেল। বাসায় গিয়ে দেখে বাবা মা খেতে বসেছেন তাই কিছু বললো না সে। তবে সীমা বেগম প্রশ্ন ছুঁড়লো,

-”আদিত্য বানর দু’টো বাসায় নেই, কোথায় গেছে জানো?”

-”হুম, টেনশন করো না ঘুরতে গেছে চলে আসবে।”

-”তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন বাবা? কিছু হয়েছে?”

-”না গরমে, এই শরীর রান্না করলে তুমি?”

-”এখন দুপুর তিনটে বাজে। মেধাকে বললাম তোমাকে ফোন করে সকালের নাস্তা আনতে।কিন্তু তুমি পুরো সকাল পেরিয়ে দুপুরে এলে, তারপর হুট করে কোথায় চলেো গেল। এখনো এলে তাও খালি হাতে। এদিকে মেধা আর আমানটাও নেই। আচ্ছা প্রেশার বেড়েছে বলে কী না খাইয়ে মারার পরিকল্পনা করছো তোমরা, হুম?”

মায়ের এমন কথা শুনে আদিত্য মৃদু হাসলো। প্যাকেট দেখে বুঝতে রইল না খাবার বাইরে থেকে এসেছে। তাহলে বাবাই এনেছে খাবার। আদিত্য আর না দাঁড়িয়ে রুমে গেল। এক বন্ধুর মাধ্যমে পুলিশের সাহায্যে খোঁজ চালালো। সময় ধীর গতিতে এগোতে থাকলো। একটা সময় দিন পেরিয়ে রাতও কেটে গেল। ধীরে ধীরে একথা চারদিকে ছড়িয়ে গেল। নিকট আত্মীয়রা বাসায় এসে নানান যুক্তি দেখাতে লাগলেন। কেউ কেউ মুখের উপর বলেও দিলো,

-”আমান বোধহয় মেধাকে ভালোবাসতো। তাই বিয়ের আগে
মেধাকে নিয়ে পালিয়েছে।”

একথা শোনা মাত্রই সীমা বেগম খৈই হারিয়ে ফেললেন। উনি হতবাক হয়ে গেলেন। সেই সঙ্গে থরথর করে কাঁপতে লাগল পুরো শরীর। উনি নিজের ভারসাম্য ধরে রাখতেও পারলেন না। সেন্স হারিয়ে ঢেলে পড়লেন মেঝেতে।

To be continue……….!!

❝মোহ মেঘের আলাপন ❞
লেখিকা: “নূরজাহান আক্তার আলো”
[১৭]

আদিত্য এখনো নিজের মতো যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
হসপিটালেও খোঁজ নিয়েছে। কিন্তু আশানুরূপ কোন খবরই পায় নি।তবুও সে হতাশ না হয়ে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
আর মনে প্রাণে একটা দোয়া করছে, দু’জনে যেখানে থাকুক সুস্থ থাকুক। কারণ দু’জনেই তার প্রিয়জন। ওদিকে আত্মীয় স্বজন ও কিছু পড়শী মনগড়া বক্তব্য পেশ করছে ড্রয়িংরুমে বসে। কখনো তারা আমানের দিকে আঙুল তুলছে; কখনো বা মেধার দিকে।যেমন, মেধা ভালো মেয়ে হলে কখনো এমন করতো না। চরিত্র খারাপ বলেই এমন করেছে। তাছাড়া ওর বাবা খুব ভালো মানুষ ছিলো। তবে মেধা কেন এমন হলো?
তাছাড়া আদিত্যের মতো সোনার টুকরোকে এভাবে ঠকায়?
আদিত্যের কোনদিক কম ছিলো? বরং আমানের চেয়ে ঢের গুন ভালো সে।আমানকেও বলি হারি যায়, এই কাজ করতে পারলো? তাও কী না আপন মায়ের পেটের ভাইয়ের সাথে?
একবারো বিবেকে বাঁধল না? ক্ষুণাক্ষরে মায়ের কথা স্মরণ হলো না?স্মরণ হবে কীভাবে পিরিতের রসে ডুবে বুদ্ধি সুদ্ধি
সব লোপ পেয়েছে। হায়রে, জীবন! এমন করলে কে কাকে বিশ্বাস করবে? এহেন নানান ধরনের কথা হচ্ছে ড্রয়িংরুমে।
আমানদের নিঁখোজের কথা কানে পৌঁছাতেই বড় মামা এসে মাথা হেট করে বসে আছেন। কী হচ্ছে কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না উনার। আত্মীয়দের কথা শুনে টেনশনও বেড়ে যাচ্ছে। কে জানে কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যে! এদিকে আদিত্যের বাবা সীমাকে নিয়ে হসপিটালে ছুঁটেছেন। কারণ এ অবস্থায়
বাসায় থাকলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভবণা বেশি। মায়ের
কথা শুনে আদিত্য ছুটে গেছে হসপিটালে। বিগতদিন থেকে খাওয়া দাওয়া নেই। রাতও পার করছে নির্ঘুমে। সর্বদা একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করছে বুকের বাঁ পাঁজরে। হঠাৎ ওরা কোথায় গেল, কেন গেল, এই প্রশ্নগুলো তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। তবে কী সত্যি আমান মেধাকে….! কেবিনের বাইরে বসে আদিত্য এসবই ভাবছিলো। অবুজ মনটা কত কী ভেবে চলেছে। মনপ্রাণে এটাও চাচ্ছে আত্মীয়দের বলা কথা মিথ্যা হোক, সে বরাবরই মতোই গর্বের সঙ্গে বলতে পারে, না তার প্রিয় মানুষটা তাকে ঠকায় নি। তার ভাইও বেইমানি করে নি।
আদিত্যের এসব চিন্তার ছেদ ঘটলো আজানের মধুর সুরে।
সে বাবাকে বসিয়ে রেখে মসজিদে গেল। যোহরের আজান
পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই মুসল্লিরা ছুটছে মসজিদের পানে। তাদের রবের প্রার্থনা করতে। সিজদাহ্ লুটে রবের সঙ্গে নিজের সখ্য গড়তে। নিজের চাওয়া -পাওয়া রবের কাছে জাহির করতে।
মাশাল্লাহ, কি সুন্দর সেই দৃশ্য! আদিত্য মসজিদে অজু সেরে সালাত আদায় করে পুনরায় হসপিটালে ফিরে এলো। বাবার জন্য খাবার আনতে ভুলে নি সে। নিজে খাওয়া নিয়ে মিথ্যে বলে বাবাকে একপ্রকার জোর করে খাওয়ালো। সত্যি হচ্ছে,
তার গলা দিয়ে কিচ্ছু নামবে না, বার বার মেধার অশ্রুসিদ্ধ চোখজোড়া মুখের সামনে ভেসে উঠছে। কানে বাজছে তার খিলখিল হাসির শব্দ। সেই সঙ্গে অদৃশ্য কেউ যেনো বার বার বলছে, “তাকে বাচাঁও আদিত্য, তাকে বাঁচাও।”

সীমা বেগমকে একটা কেবিনে রাখা হয়েছে। আদিত্য বাবার পাশে বাইরে বসে আছে। ক্ষণে ক্ষণে ফোন করে জিজ্ঞাসাও করছে কাকে খোঁজ মিলেছে নাকি? কিন্তু না, ফলাফল শূন্য।
খানিকবাদে জুরুরি কল আসায় ওর বাবা কিছুক্ষণের জন্য অফিসে গেল। আদিত্য ঠাঁই’ই বসে রইলো সেভাবে। লালবর্ণ চোখের কার্ণিশে জমেছে অশ্রুবিন্দু। দুই দিন হয়ে গেল প্রিয় মুখটাকে দেখে নি সে, ছোঁয়া তো দূর।কই তার প্রাণভোমরা?
কারো খিলখিল শব্দে তার প্রাণটাও জুড়াচ্ছে না। কেউ কল করে এটা ওটা আনার আবদার করছে না। রাতে বেলায় ঘুম ভাঙিয়ে আইসক্রিম খাওয়ার আবদারও করছে না। বাসায় রাখা আইসক্রিমে তার আবার পোষায় না। সে স্টোডিয়ামের
নিয়ন আলোয় হাঁটতে হাঁটতে আঙুলের ভাঁজে আঙুল গুঁজে আইসক্রিম খেতে ভীষণ পছন্দ করে। কখনো কখনো তার পথ আঁটকে মিষ্টি হেসে সুন্দর করে বলবে, ‘ভালোবাসি প্রিয় মানুষ, ভীষণ ভালোবাসি।’
এছাড়া রোজ অফিসের যাওয়ার পূর্বে সীমা বেগমের চোখ ফাঁকি দিয়ে ওর রুমে যাবেই যাবে। তারপর তাকে শক্ত করে
জাপটে ধরে বুকে মাথা রেখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে। না সে নিজে নড়বে আর না তাকে নড়তে দিবে। ওভাবে থাকার পর বলবে,
– ‘আদিত্য ভাই।’
-‘এখনো ভাই?’
-‘কবুল বলার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ভাই, হা হা হা।”
-‘তা এভাবে জাপটে ধরেছেন কেন? লজ্জা নেই আপনার?’
-‘ ছিলো তবে ভালোবাসার দরে বেচে দিয়েছে।’
-‘বুঝলাম, তা কি বলতে এসেছেন বলে ধন্য করুন আমায়।’
-‘কি বলতে এসেছি ভুলে গেছি। তবে কারো দিকে তাকাবেন না, সাবধানে যাবেন আর অবশ্যই সাবধানে ফিরে আসবেন।
আমি কিন্তু অপেক্ষায় থাকবো।’
-‘হুম, কিছু লাগবে?’
-‘না, তবে ঝাল কিছু আনলে মাইন্ড করবো না।’
রোজ এভাবেই ওর সকাল শুরু হতে মিষ্টি একটা অনুভূতি নিয়ে। অথচ দু’ দিন কেটে গেল তাকে ছাড়া। ওর মনে হচ্ছে জীবন থেকে সুখ হারিয়ে গেছে। মন বড্ড ব্যাকুল হয়ে আছে তার জন্য। কখন পাবে তার খোঁজ? শক্ত করে বুকে জড়িয়ে
নেওয়ার সুযোগ হবে তো? নাকি চিরতরে হারিয়ে ফেলবে ওর সুখপাখিটাকে?

আদিত্য চেয়ারে মাথা ঠেকিয়ে নিশ্চুপ হয়ে বসে রইল। সময় কাটতে থাকলো নিজ গতিতে। বিকালের আজানের পরপর নার্স এসে জানালো তাকে সীমা বেগম ডাকছেন। উনি তার সঙ্গে কথা বলতে ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। একথা শুনে আদিত্য ঝটপট উঠে কেবিনে প্রবেশ করলো। মায়ের হাত শক্ত করে ধরে পাশে বসে মৃদু হাসলো। ওর মুখ দেখে সীমা বেগম হু হু করে কেঁদে উঠলেন। মুখে বার বার বলতে লাগলেন, ‘বাবা, আমার সোনা বাবা, কষ্ট পাস না, তোর মেধাকে তোর কাছেই ফিরিয়ে এনে দিবো আমি।’
মায়ের কথা শুনে আদিত্য হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো। তারপর মা ও ছেলে অঝরে অশ্রুও ঝরালো। একটুপরে আদিত্যের বাবাও এসে সেখানে পৌঁছালেন। হঠাৎ সীমা বেগমের কিছু কথা স্মরণ হলো। আত্মীয়দের বলা কথাগুলো মস্তিষ্কে বার বার ঘুরপাক খেতে লাগলো। তখন উনি ঠান্ডা মাথায় ভেবে জেদ ধরলেন বাসায় যাওয়ার। উনাকে আর কোনোভাবেই হসপিটালে রাখা গেল না। তাই বাধ্য হয়ে আদিত্য এবং ওর বাবা উনাকে বাসায় নিয়ে আসলেন। উনাকে আসতে দেখে কিছু কিছু আত্মীয় স্বান্ত্বণার বাণী ছড়ানোর আগে আদিত্য মুখ খুললো, “আপনারা এখন আসতে পারেন, আম্মুর এখন
বিশ্রামের প্রয়োজন।”
মুখের উপর যেতে বলায় অনেকে মুখ কুঁচকে অসন্তোষ হয়ে বেরিয়ে গেলেন। বড় মামার সঙ্গে সীমা বেগম কি নিয়ে যেনো আলোচনা করছে। আদিত্য এক গ্লাস পানি হাতে নিয়ে মুখে দিতে যাবে তখনই শুনতে পায় বাইক আসার শব্দ। সে দ্রুত গ্লাস রেখে এগিয়ে যাওয়ার আগে বিধস্ত অবস্থায় আমানকে ঢুকতে দেখা যায়। আমান কোনোদিকে না তাকিয়ে ভাইয়ের পায়ের কাছে বসে পড়ে। আদিত্যের পা জোড়া জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। তার কান্নার শব্দে হতবাক হয়ে যায় উপস্থিত সকলে। আদিত্য ভাইয়ের রক্তাক্ত অবস্থা দেখে
স্বাভাবিকভাবে বলল,

-” মেধা কোথায়?”

এই প্রশ্নে আমানের কান্না গতি দ্বিগুন বেড়ে গেল। আদিত্যের মা এগিয়ে এসে আমানকে হ্যাচকা টানে দাঁড় করিয়ে বলল,

-”আমার মেয়ে কোথায়? ওকে কোথায় রেখে এসেছিস? কী হলো বল, মেধা কই?”

আমান কান্নার চোটে কথায় বলতে পারছে না। অনেক চেষ্টা করে সে টু শব্দও উচ্চারণ করতে পারল না সে। নিশ্চুপ থাকা সীমা বেগম সহ্য করতে না পেরে থাপ্পড় মেরে দিলেন তার বাঁ গালে। আমান এক পা পিছিয়ে গেল তাতে। ব্যথাযুক্ত গালে
থাপ্পড় পড়াতেও টু শব্দ করলো না সে। এবার আদিত্য মাকে সরিয়ে আমানের কাঁধে দুই হাত রেখে সুন্দরভাবে বলল,

-”বল না ভাই কি হয়েছে তোদের? না বলে কোথায় বা চলে গিয়েছিলি তোরা? তোর এই অবস্থা কেন? আর মেধা কই? সে ঠিক আছে? ভয় পাস না ভাই প্লিজ বল আমাকে, আচ্ছা
এক্সিডেন্ট করেছিলি? কোন হসপিটালে সে আছে বল?”

আদিত্যের জবাবে আমান না বোধক মাথা নাড়ালো। অর্থাৎ এর কোনোটাই না। আদিত্য এবার ঢোক গিলে বলল,

-”এক্সিডেন্ট করিস নি তবে কিডন্যাপ হয়েছিলি?”

একথার জবাবে আমান হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো। ওর এই মাথা নাড়াতোতে সবার বুক কাঁপতে থাকলো অজানা ভয়ে। আদিত্য এবার ব্যাতিব্যস্ত হয়ে আমানকে জিজ্ঞাসা করতেই থাকলো। পূর্বের সব ঘটনা মনে করে আমানের শরীর থরথর করে কাঁপছে। তা দেখে ওকে একটু পানি খাইয়ে সময় দিলো নিজেকে সামলে নিতে। এরপর আমান জানাল, নাস্তা নিয়ে ফেরার সময় হঠাৎ ওদের পথ আঁটকে দাঁড়ায় কালো রংয়ের
একটা গাড়ি। তারপর কিছু বুঝে ওঠার আগেওদের গাড়িতে তুলে নেয়। তারপর চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় এক পুরনো গোডাউন। ওটা কার গোডাউন, কোন জায়গা, সে জানে না। ওখানে গিয়ে তাকে চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে ফেলা হয়। তারপর হকিস্টিক দিয়ে মারতে থাকে অনবরত। ওর মুখ বাঁধার জন্য চিৎকার করতে পারছিলো না সে। আর গাড়িতে থেকে নেমে মেধাকে অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া হয়। কারণ মেধার সাড়া শব্দ সে আর পায় নি। আর মুখে রুমাল গুঁজে থাকায় কিছু বলতেও পারে নি। পরে বেধড়ক মার খেয়ে সেন্স লেস হয়ে ঘন্টা দুয়েক পর সেন্স ফিরলে দেখে মেঝেতে পড়ে আছে।
হাত পা খোলা, তবে অন্ধকার রুম। এত অন্ধকার কিন্তু দেখা যাচ্ছিল। তখন দুপধাপ পা ফেলে দু’জন এসে পুনরায় ওকে বেঁধে ফেলে। আর শাসিয়ে বলে ওদের স্যার আসবে এখনই, যদি চিমটি পরিমানও বে’ য়া’ দ’ বি করি জানে মেরে দিবে।
ঠিক তখনই মেধার চিৎকার শুনতে পায় আমি। সে আমার নাম ধরে ডাকছিলো, আমার সাড়া না পেয়ে, আদিত্য বাঁচাও
বলতেই কেউ তাকে স্বজোরে থাপ্পড় মেরে বসে। এত জোরে মারে যে সেই শব্দটা আমিও শুনতে পায়। মেধা কেঁদে উঠলে তখন কেউ একজন বলে,

-”আদিত্যের পার্ট চুকে গেছে বেইব, এখন থেকে এই উদয়ের খেল শুরু। তাই কথায় কথায় আদিত্য আদিত্য না করে শুধু আমার নাম জপ করবে, ওখে বেইব?”

এইটুকু বলতেই সীমা বেগম আঁতকে উঠলেন। বড় মামাও নামটা শুনেই দাঁড়িয়ে গেছেন। আদিত্যের বাবাও মনে হলো ভীষণভাবে চমকে গেছেন। তখন সীমা বেগম আতঙ্ক ভরা কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন,

-”ক ক কি নাম বললি? ”

-” উদয়।”

-”ওই সাইকো টা বেঁচে আছে..!”

একথা শুনে আমানের সঙ্গে আদিত্যেও ভ্রু কুঁচকে ফেললো। কারণ এই নামের কাউকে চেনা না তারা।তবে কে এই উদয়?
কি বা তার উদ্দেশ্য? তখন আদিত্য বাকিটকু বলতে বলায় আমান পুনরায় বলতে লাগল। তারপর মেধা টানতে টানতে আমানের সামনে দাঁড় করায় উদয়। সে বুঝতে পারে তাদের উপস্থিত তবে চোখ বাঁধা থাকায় কিছুই দেখতে পারে না সে।
তখন একজন এসে আমানের চোখ খুলে দেয়, রুমের লাইট জ্বালিয়ে দেয়, ওকে দেখে মেধা কাছে যেতে গেলেই পুনরায় থাপ্পড় মেরে দেয় উদয়। মেধাকে মেঝেতে পড়তে দেখে কিছু বলতে ছটফট করলে তখন উদয় আমানকে বলে,

-”ব্রো, তোমার ভাইয়াকে বলিও কা’না লেং’ড়া দেখে নিজের গলায় একটা ঝুলে নিতে। আমার ফুল আমি নিয়ে গেলাম। সেই সঙ্গে তাকে এটাও জানিয়ে দিও, এই ফুল আমার আর এই ফুলের মধুর ভাগীদারও শুধু আমিই। সে যেনো ভুলেও
আগাছার মতো বাঁধ সাধতে না আসে। আর আসলে তাকে
উপড়ে ফেলতেও দু’বার ভাববো না আমি। এখন তুমি অতি ভদ্র ছেলের মতো আমাদের বিয়ের সাক্ষী হিসেবে ঝটপট সাইন করে দাও। নয়তো এত আদর যত্ন করবো জীবনেও ভুলতে পারবা না।”

To be continue……..!