❝মোহ মেঘের আলাপন ❞
লেখিকা: “নূরজাহান আক্তার আলো”
[১৮]
-“এখন তুমি অতি ভদ্র ছেলের মতো আমাদের বিয়ের সাক্ষী হিসেবে ঝটপট সাইনটা করে দাও। নয়তো এত আদর যত্ন করবো জীবনেও ভুলতে পারবে না।”
একথা কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই আমান হতবাক হয়ে গেল। সে কি বললো? বিয়ের সাক্ষী? কাদের বিয়ে? ওর আর মেধার? মেধাকে সে চিনলো কিভাবে ? তাছাড়া হঠাৎ বিয়ে বা কেন?
কী উদ্দেশ্যে এই ছেলের? নাকি কোনো ভাবে ভয় দেখাচ্ছে?
এতে ওর কী লাভ? তখন এসব ভাবতে ভাবতেই ওর চোখে ভেসে উঠলো আদিত্যের মুখ। তাতেই ওর বুক কেঁপে উঠলো অজানা ভয়ে। এখন যদি সত্যি সত্যি এদের বিয়ে হয়েই যায় তখন কী হবে? ফিরে গিয়ে আদিত্যকে কী জবাব দিবে? সে
মেনে নিতে পারবে এই কষ্টটা? নাকি দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে যাবে? ভাইকে এভাবে নিঃশেষ হতে দেখতেও পারবে না সে।
তাছাড়া চেনা নেই, জানা নেই, এমন ছেলের হাতে মেধাকেও তুলে দিতে পারবে না। আপন বোন না হলেও নিজের ছোট বোনের মতোই ভালোবাসে সে। আর বোনের জীবন এভাবে
ধ্বংস হতে দিবে না, কিছুতেই না। প্রয়োজন মার খেয়ে মরে যাবে তবুও সে সাইন করবে না। মেধা একমাত্র আদিত্যেরই।
আর ওদিকে হয়তো আদিত্য ব্যাকুল হয়ে ওদেরকে খুঁজছে।
না পেয়ে কী অবস্থা সবার কে জানে! তাছাড়া সীমা বেগম?
যদি উদয়কে আঁটকাতে না তবে উনাকে কীভাবে সামলাবে? উনার আদরের মেয়েটা অন্যের ঘরে চলে যাবে। বাসাও শূন্য হয়ে যাবে। সীমা বেগম মানতে পারবে তো? মনে মনে এসব ভেবে আমান জোরে জোরে ওর মাথা ঝাঁকাল। না, সে আর এসব ভাবতে পারছে না। মুক্তির পথ খুঁজে বের করতেই হবে তাকে। নয়তো সব এলোমেলো হয়ে যাবে, সব। এদিকে তার ভাই আর অন্যদিকে মা। এদের দু’জনের মুখে হাসি ফোটাতে তাকে কিছু একটা করতে হবে। আমান যখন মনে মনে এসব ভাবতে ব্যস্ত তখন তার কানে এসে লাগল স্বজোরে আরেক
থাপ্পড়ের শব্দ। উদয় পুনরায় মেধাকে মেরেছে। আমান ওর রাগ সামাতে না পেরে ছটপট করে ব্যর্থ হলো। তারপর ক্ষিপ্ত নজরে তাকিয়ে রইলো উদয়ের দিকে। মেধাকে কাঁদতে দেখে উদয় মেধাকে পুনরায় থাপ্পড় মেরেছে। কানের কাছে এভাবে ফ্যাচফ্যাচ করে কান্না তার পছন্দ নয়। প্রচন্ড বিরক্ত লাগে।
থাপ্পড় মেরেও সে বিরক্ত নিয়ে মেধার দিকে তাকিয়ে আছে।
ভাবখানা এমন যেনো তৃতীয় থাপ্পড় দিলে বলে। মেধা গালে হাত দিয়ে এবার নিঃশব্দে কাঁদছে। তখন উদয় বললো,
-”আর একফোঁটা অশ্রুও যদি গড়িয়েছে তোমার ভাইয়ের শরীর থেকে আমি তার দ্বিগুন ফোঁটা র’ক্ত ঝরাবো। কথায় নয় এবার কাজে দেখাবো।”
-”কি করেছি আমি? কেন এমন করছেন আমার সঙ্গে? ”
-”যাহ্ বাবা আমি আবার কি করলাম? এখনো কিছু করি নি বেইব, তাছাড়া কেবল তো শুরু।”
-”ছেড়ে দেন আমাদের, প্লিজ। আমি আপনার পায়ে পড়ছি আমাদের ছেড়ে দেন।”
-”আমার, হাত, পা, ঠোঁট, মুখ, যা ইচ্ছে ধরো তাও ছাড় পাবে না সোনাপাখি।”
-”আমি আদিত্যকে ভীষন ভালোবাসি। আমাকে ওর কাছে যেতে দিন। কথা দিচ্ছি আপনার কথা কাউকে বলবো না।”
-”ওর নাম মুখে এনো না জান। মেজাজ বিগড়ে গেলে খবর আছে তোমার। তুমি আমাকে ভালোবাসবা; শুধু আমাকে।”
যখন ওরা কথা বলায় ব্যস্ত তখন আমান উদয়কে ভালো করে লক্ষ্য করলো। বয়স আদিত্যের মতোই। সুদর্শনও বটে। আভিজাত্যপূর্ণ পোশাকে স্মার্টনেস বেশ ভালোভাবেই ফুটে উঠেছে। চোখে মুখে তীক্ষ্ণতার ছড়াছড়ি। ঠোঁটে লেপ্টে আছে তাচ্ছিল্যের হাসি। একথায় উদয় নজরকাড়া সুদর্শন। ছেলে হয়ে এটা মানতে সে অনুদারতা করবে না। তবে মেধার কথা শুনে মনে হচ্ছে সেও উদয়কে চেনে না। অথচ উদয় মেধাকে কিডন্যাপ করে বিয়ে প্রসঙ্গেও চলে এলো। এখন কথা হচ্ছে উদয় মেধাকে কীভাবে চেনে? নাকি ট্যাপে ফেলার জন্য তার নতুন চাল? তখন হঠাৎ উদয় কাউকে ডাকতেই দু’জন পুরুষ সেখানে উপস্থিত হলো। সম্ভবত উকিল উনারা। এসে একটা ফাইল এগিয়ে দিলো উদয়ের দিকে। উদয় সেটা দেখতে দেখতে আমানের মুখোমুখি দাঁড়ালো। তারপর ফাইলে দৃষ্টি নিবন্ধ করেই বললো,
-”আমার সম্পর্কে খোঁজ খবর নিলে ভালো কিছু শুনবে না, সাইকো, পাষাণ, হৃদয়হীন, এসবই বলবে লোকে। যদিও এর একটাও মিথ্যে নয়। এই সমস্ত গুন আমার মধ্যে বিদ্যামান।
এখন কথা হচ্ছে, এসব জেনেই মেধাকে আমার হাতে তুলে দিবে তুমি। নাও সাইন করো এতে, সময় নেই আমার হাতে।”
একথা বলে আমানের হাত খুলতে ইশারা করে একজনকে।
সে লোক এসে হাত না খুলে বেধড়ক মারতে থাকতে তাকে। মার দেখে মেধা ওর নিকটে আসতে গেলে উদয় তাকে ধরে ফেলে। মেধা চিৎকার করে কেঁদে মারতে নিষেধ করলে সেই ব্যাক্তি শোনে না, বরং আরেকজন এসে যুক্ত হয়। মেধা নিজ চোখে দেখতে পারে না আমানের র’ ক্তা’ ক্ত দেহ। ওর পুরো শরীর কাঁপতে থাকে থরথর করে। ওর কাঁপুনি দেখে উদয় তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে থুতনি রেখে বললো,
-”আমি জানতাম তোমার ভাই হাত খুললেই আমার উপরে আক্রমণ চালাবে। তাই আগেভাগে থার্ড ডোজ কমপ্লিট করে নিচ্ছি। ঠিক করেছি না, তুমিই বলো? ইস, এসব নিয়ে চিন্তা করতে হবে না তোমার। আর কেঁদে কেঁটে কি করেছো হুম?
এসব ঝামেলা মেটাতে আমি তো আছি নাকি?”
আমানের ততক্ষণে করুণ অবস্থা। সে মারের চোটে নিভুনিভু চোখে মেধার দিকে একবার তাকিয়ে জ্ঞান হারিয়েছে। তখন উদয় মেধাকে নিয়ে চলে যায় পাশের রুমে। তারপর মেধাকে
আদিত্যকে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে, আমানের লা/শ গুম করারও ভয় দেখায়। একটা সময় মেধা থম মেরে যায়। এটা বুঝে যায় উদয়ের হাত থেকে তার নিস্তার নেই। এই লোকটা কিছুতেই তাকে ছাড়বে না। সে আদিত্যকেও আর পাবে না।
চিরতরে হারিয়ে ফেলবে প্রিয় মানুষটাকে। উদয় তখন চলে যেতে উদ্যত হতে পা বাড়িয়ে বলে,
-”আর আধা ঘন্টা ওয়েট করো আদিত্যের লা/শ দেখে নাহয়
নিজেকে আমার জন্য প্রস্তুত কোরো। সব নষ্টের গোড়া ওই আদিত্য তাই না? ওকে ওর ব্যবস্থায় করছি আমি।”
-”ক কো কোথায় সাইন করতে হবে?”
একথা শুনে উদয় চট করে দাঁড়িয়ে যায়। মুখভর্তি হাসি নিয়ে ঘুরে তাকায় মেধার মুখপানে। তারপর সুন্দর করে দেখিয়ে দেয় কোথায় সাইন করতে হবে। মেধাও সাইন করে পাথরের ন্যায় বসে থাকে থম মেরে। উদয় নিজেও সাইন করে ঝটপট মেধার গালে একটা চুুমু খেয়ে দ্রুত বেরিয়ে যায়। একটু পরে কাজি এসে শরীয়ত মোতাবেক বিয়েও পড়ায়। একবুক কষ্ট চেপে মেধাকে উদয় নামেই ‘কবুল’ উচ্চারণ করতে হয়। সেই সঙ্গে না চায়লেও উদয়কেই স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে হয়।
আর উদয় জ্ঞান হারানো অবস্থায় সাক্ষী হিসেবে নিয়ে নেয় আমানের আঙুলের টিপ ছাপ। তারপর মেধার নাকে রুমাল চেপে অজ্ঞান করে ফেলে চোখের পলকেই। মেধা কিছু বুঝে উঠার আগেই দ্রুত কোলে তুলে বেরিয়ে যায় সেখান থেকে।
পরে আমানের জ্ঞান ফেরার পরে নিজেকে আবিষ্কার করে নির্জন এক জায়গায়। আদূরেই থাকে তার বাইক। মেধাকে আশেপাশে না দেখে সে সেই অবস্থায় ছুঁটে আসে ভাইয়ের কাছে। তারপর সবাইকে খুলে বলে তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া এক একটা ঘটনা। সব শুনে আদিত্য টলটলে পায়ে নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হয়। সবার ডাক উপেক্ষা করে দরজা আঁটকে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে বিছানায়। তার চোখের কোণা বেয়ে গড়াতে থাকে হৃদয়ভাঙ্গার জল। বুকে শুরু হয় অসহ্য দ’হ’ ন। যে দহনে ঝলসাতে থাকে ওর বুকের বাঁ পাশ। ইস,
এত কষ্ট কেন হারানোর ব্যথায়?ধীরে ধীরে বুকটা কেন ছেঁয়ে যাচ্ছে এক বিশাল শূন্যতায়। কই তার মেধা? কই সে? আর কি আসবে না ওর কাছে? দেখাও কি আর পাবে না? সবার দৃষ্টি এড়িয়ে চঞ্চল পায়ে এসে জড়িয়ে ধরে বলবে না, ‘দেখি দেখি সারাদিনের এনার্জিটুকু নিয়ে নি।’
দুষ্টুমি করে তাকে সরিয়ে দিলে রাগে নাক ফুলিয়ে পুনরায় জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে বলবে না,
-”এই যে মিস্টার শুনুন এই বুকটা শুধু আমার জন্যেই তৈরি।
এখান থেকে আমি প্রতিনিয়ত শান্তি লুফে নিবো।কেউ যেনো
কখনো এই স্থানটা পাওয়া তো দূরে স্পর্শ করতেও না পারে। এখানে শুধু আমি আছি আর আমিই থাকবো, বুঝলেন?”
___________________________________
মেধার যখন চোখ খুলে তাকায় তখন দুপুর। জানালার পর্দা মেলে দেওয়ায় আবহাওয়াটা বোঝা যাচ্ছে না। এসি চলছে।
এজন্য শীত লাগছে বোধহয়। সে আশেপাশে দৃষ্টি ঘুরাতেই নজর পড়ে উদয়ের ফটোফ্রেমের দিকে। তার মনে পড়ে যায় ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। হারানোর কষ্টে ভারি হয়ে থাকে বক্ষপাশ। চোখ ফেটে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু। বুকেও শুরু হয় নিষ্ঠুর তোলপাড়। অতি প্রিয় মানুষটার মুখটা ভেসে ওঠে চোখের পাতায়। সেই সঙ্গে মুখ থেকে বেরিয়ে আসে একটা অতি প্রিয় শব্দ ‘আ আ আদি ত্য।’
তখন সুসজ্জিত রুমের দরজা ঠেলে কেউ প্রবেশ করে। শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখে উদয়। ওর পরনে কালো টি শার্টের সঙ্গে কালো টাউজার। কানে ইয়ারফোন গুঁজে রাখা। হাতে আধ খাওয়া আপেল। মুখে মিটিমিটি হাসি। উদয় জানালার পর্দা
সরিয়ে মেধাকে বললো,
-”আমার রাজ্যে তোমাকে সু-স্বাগতম মাই লাভ।”
এই কথাটা বলতে বলতেই উদয় এগিয়ে মেধাকে একটানে দাঁড় করিয়ে জানালার পাশে চলে গেল। থাই গ্লাস ভেদ করে দৃষ্টি গেল বাইরের দিকে। মেঘলা আকাশ। তখন উদয় থাই
গ্লাস সরাতেই চোখ পড়লো অনেক বড় বড় বিল্ডিং। দেশের
আকাশে বাতাসে কেমন অচেনা টান অনুভব করলো মেধা।
অদ্ভুত ঠেকলো তার কাছে। মস্তিষ্কেও খেলে গেল কিছু প্রশ্ন।
তখন তার চঞ্চল দৃষ্টি দেখে উদয় ঝাপটে ধরলো বাহুডোরে।
অতঃপর হাতের বাঁধন শক্ত করে ফিসফিস করে বলল,
-”আমরা আছি তোমার আদিত্যের ধরা ছোঁয়ারও বাইরে। এই সেই সুদূর আমেরিকা।”
-”আদিত্যের ভয়ে এখানে এসেছেন বুঝি?”
-”হা হা হা, আদিত্যকে ভয়? তাও আবার আমি? জোক্সটা কিন্তু দারুণ।”
ওর হাসি মেধার সহ্য হলো না। আচমকা উদয়ের কলার ধরে
ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললো,
-”কেন করলেন এমন? কি অপরাধ আমার? কোন অপরাধে
আমাকে এত বড় শাস্তি দিলেন? বলুন, বলুন, বলছি।”
-”বেশ করেছি।”
একথা শুনে মেধার রাগ তুঙ্গে। সে আর ভাবনা চিন্তা না করে থাপ্পড় দিতে হাত তুললেই উদয় তা ধরে ফেললো। মুখের ভাবভঙ্গি মুহূর্তেই পাল্টে গেছে তার। মুখে ফুটে উঠেছে চাপা ক্রোধ। হটাৎ সে মেধার হাত পেছনে মুচড়ে ধরে বাঁ গালে ওষ্ঠ ছুঁয়ে বললো,
-”জান, তুমি যত দুঃসাহস দেখাবে আমি আমার আদরের মাত্রা তত বাড়বো। বাকিটা তোমার ইচ্ছে। ”
-”আপনাকে আমি ঘৃণা করি, ছাড়ুন আমায়। আপনার স্পর্শে আমার শরীর গুলিয়ে যাচ্ছে, বমি পাচ্ছে আমার।”
-”মজার ব্যাপার কি জানো? নিষিদ্ধ কাজে আমি আকৃষ্ট হই বেশি। কেউ কিছু বারণ করলে আমি সেটাই না করা অবধি শান্তি পাই না। সরি বউ তোমার এই কথাও রাখতে পারলাম না।”
To be continue……!!
❝মোহ মেঘের আলাপন ❞
লেখিকা: “নূরজাহান আক্তার আলো”
[১৯]
আমান! আমান! এ্যাই আমান, দরজা খুল!
হঠাৎ রুমের দরজায় কড়াঘাত পড়াতে আমানের ঘুম ভেঙে যায়।বার দু’য়েক অস্পষ্টভাবে হু হু করে পুনরায় ঘুমে তলিয়ে যায় সে। কিন্তু আবারও শক্ত হাতের বারি পড়ে ওর দরজায়।
এবার সে প্রচন্ড বিরক্ত নিয়ে উঠে বসে। মুখে ‘ চ ‘ শব্দ করে চোখজোড়া খুলতে চেষ্টা করে। ঘুমে দু’চোখ বুজে আসছে। দরজাটা খুলে দেখাটা তার জন্য দায় হয়ে পড়েছে। অসহ্য ব্যথায় শান্তি পাচ্ছিল না একদন্ডও। শরীর যেনো অবশ হয়ে
যাচ্ছিলো। নড়েচড়ে বসতে পারছিলো না ঠিকমতো। এজন্য ব্যথার সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খেয়েছিলো। আর ওষুধের প্রভাবে এখন ঘুমে চোখ খুলে তাকাতে পারছে না। মাথাটাও ধরেছে।
মোটেও ইচ্ছে হচ্ছে না কে ডাকছে, কেন ডাকছে, উঠে গিয়ে তা দেখতে। তখন উক্ত ডাক পুনরায় তার কানে পৌঁছালো।
দুমদুম কড়াঘাতও চলছে তখনো। না আর বসে থাকাটা ঠিক হবে না। একথা ভেবে উঠে দরজা খুলতেই মায়ের মুখ দেখে হাসলো। অতঃপর কিছু বলার আগেই সীমা বেগম বললেন,
-”আদিত্য এক্ষুণি তোমাকে ডাকছে ওর রুমে যাও।”
-”কেন?”
-”জানি না। শুধু বললো কথা আছে তোমাকে ডেকে দিতে।”
-”একটু পরে যাই আম্মু? শরীরটা ভীষণ খারাপ আমার। ”
-”জরুরি না হলে আদিত্য নিশ্চিয়ই তোমাকে ডাকতো না। কী বলে শুনে এসো। এমনিতেই ওর মন মেজাজ ভালো নেই।”
-”মেধার কোনো খোঁজ দিয়েছে পুলিশ?”
-“না, তবে শীঘ্রই দিবে ইনশাআল্লাহ।”
-”ভাইয়া কিছু খেয়েছে? জ্বর এসেছিলে তা কমেছে?”
-”জ্বর কমেছে তবে কফি ছাড়া কিচ্ছু টি মুখে তুলে নি। ”
-”ওহ আচ্ছা তুমি যাও, আমি গিয়ে দেখি কী বলে।”
একথা বলে আমান আদিত্যের রুমের দিকে পা বাড়ালো। আর সীমা বেগম চলে গেলেন নিজের কাজে। মনটা ভীষণ খারাপ উনার। বাসাটা কেমন শূন্য শূন্য লাগছে। মেধার হাসি কানে বিঁধছে না। চঞ্চল পায়ে এসে হাত ধরে টেনে বাগানের সদ্য ফোটা ফুল দেখাচ্ছে না। না খাওয়ার বাহানা দিচ্ছে না।
চুলে বিলি কেটে দেওয়ার জন্য পেছন পেছন ঘুরছে না। হুট করে এসে হাও করে চমকে দিয়ে খিলখিল করে হাসছে না।
আদিত্যের বাবার পাকা চুল তুলে দিয়ে টাকার হিসাব নিয়েও ঝগড়া করছে না। প্রয়োজনীয় জিনিস না পেয়ে বাড়ি মাথায় তুলছে না। এত নিশ্চুপ বাসা উনি চান নি। উনি সবসময় চান উনার বাসা হাসি, খুশি, সুখে, ভরে থাকুক। কিন্তু বাসার হাসি যেনো হঠাৎ হারিয়ে গেছে, মলিন করে দিয়েছে চারিপাশ।
একথা ভেবে উনি নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলেন।মেধার বাবাকে
কথা দিয়েছিলেন মেধাকে যত্নে রাখবে। ছোট বোনের শেষ স্মৃতিটুকু আজীবন নিজের কাছেই রাখবে। কিন্তু হলো কই?
দমকা এক ঝড়ে সব যে উলট পালট গেল। সুখপূর্ণ সংসারে
এখন সুখের অভাব। ওদিকে আদিত্যের দিকে তাকানো যায় না। ছেলেটার মুখ দেখলেই বুক ফেটে যায়। খাওয়া দাওয়াও ছেড়ে দিয়েছে।তাছাড়া উনি অবগত আদিত্য মেধাকে ভীষণ ভালোবাসে।মুখচোরা স্বভাবের আদিত্য নিগূঢ় ভালোবাসার প্রকাশ করতেও পারে না ঠিকমতো। তবে তার ভালোবাসায় খাত নেই আর না আছে স্বার্থের নির্মোক। ছেলেটা শুধু অতি গোপনে ভালোবাসতে জানে, আগলে রাখতে জানে। মেধার কষ্টের নিজেকে পুড়াতে জানে। উনি আর ভাবতে পারছেন না। চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে উঠেছে উনার। চোখের পানিতে
রাস্তা দেখতে না পেয়ে সেখানেই বসে পড়লেন। মুখে আঁচল গুঁড়ে অঝরে কাঁদতে লাগলেন। সেই সঙ্গে একটা কথায় বার বার বলে যাচ্ছেন,
”মেধা মা আমার ফিরে আয়, মা। তোকে ছাড়া আমরা ভালো নেই। তোর আদিত্যও ভালো নেই রে,, একটুও ভালো নেই।”
একথা ভেবে সেখানে বসেই অশ্রু বিসর্জন দিতে থাকলেন।
সহধর্মিণীর মনের কথা বুঝে আদিত্যের বাবার নেত্রেও অশ্রু
জমা হলো। মেধাকে উনি নিজের মেয়ের মতো দেখেন, খুব ভালোওবাসেন। এখন অবধি উনি সীমা বেগমকে বলেন নি, একটা রাজকন্যার ভীষণ শখ উনার। যে রাজকন্যা নেচে গেয়ে পুরো বাসা দাপিয়ে বেড়াবে। কত কী আবদার করবে উনার কাছে। মনমতো জিনিস না পেলে নাক ফুলাবে, ঠোঁট উল্টে কেঁদে দিবে। আরো কত কী!আদিত্য আমান হয়ে সীমা বেগমের জটিল সমস্যার কারণে উনাকে জরায়ু অপসারণ করতে হয়েছিলো। ফলে চিরতরে মাতৃত্ব হারান সীমা বেগম।
একথা শুনে যদি সীমা বেগম ভেঙ্গে পড়েন, কষ্ট পান, তাই কখনো রাজকন্যার কথা বলাও হয় নি। তবে উনার এই শখ পূরণ হয়েছে মেধার মাধ্যমে। মেধা এমন একটা মেয়ে সবাই দেখে বলবে ভীষণ ভদ্র। তবে সে ভীষন চঞ্চল, দুষ্টু প্রকৃতির। আর ওর চঞ্চলতায় সবাইকে বাধ্য করে ভালোবাসতে। মেধা নিঁখোজ হওয়ার পর থেকে উনি নিজেও একদন্ড বসে নেই।
যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন খোঁজ নেওয়ার। বড় ছেলের মুখের হাসি ফিরিয়ে না দেওয়া অবধি উনি শান্তি পাচ্ছেন না।
বাবা হয়ে উনি সহ্য করতে পারছেন না ছেলের মলিন মুখ, অশ্রু ভেজা টইটম্বুর চোখ। হঠাৎ ফোনে কল আসাতে উনার এসব ভাবনার ছেদ ঘটলো। চোখ মুছে, গলা পরিষ্কার করে,
উনি কথা বলতে বলতে দ্রুত প্রস্থান করলো।
আদিত্য সদ্য গোসল সেরে রুমে এসেছে। হাতে থাকা ভেজা তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছছে।ওর মুখভঙ্গি অত্যান্ত স্বাভাবিক।
তখন দরজায় নক পড়াতে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিলো।
সে অবগত আমান এসেছে। তখন আমান খুঁড়িয়ে হেঁটে রুমে প্রবেশ করলো। আদিত্য তাকে বসতে বলে নিজে গিয়ে কফি করে আনলো। ততক্ষণ আমান বসে গেম খেলায় মনোযোগী হলো। একটুপরে ধোঁয়া ওঠা কফির মগ নিয়ে আদিত্য ফিরে এলো।একটা মগ আদিত্য নিজে নিয়ে অন্যটা এগিয়ে দিলো আমানের হাতে। তারপর আমানের মুখোমুখি বসে কফিতে চুমুক দিলো। ব্ল্যাক কফি! ওর দেখে আমানও সিপ নিয়ে মুখ কুঁচকে চুপ করে বসে রইলো। কারণ ব্ল্যাক কফি তার ভীষণ অপছন্দ।
কিন্তু আদিত্য স্বাভাবিক ভাবে পান করতে থাকল। কারণ সে সর্বদা ব্ল্যাক কফিই পান করে। আমান মগটা সেন্টার টেবিলে রেখে ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। বোঝার চেষ্টা করছে আদিত্যের মতিগতি। কিন্তু কিছুই বুঝলো না। এছাড়া
কেন জানি সাহসও পাচ্ছে না কিছু জিজ্ঞাসা করতে। এভাবে
বেশ কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর আমান কিছু বলার আগে আদিত্য বললো,
-”এখন একটা কাজ করতে বলবো, করবি?
-”হুম বলো।”
-”একটা কারণে তোকে আমি দু’টো অপশন দিবো। আর এই দুটোর মধ্যে তুই একটা অপশন বেছে নিবি।”
-”কি কারণ ভাইয়া?”
-”অপশন গুলো বলি তাহলেই বুঝে যাবি।”
-”আচ্ছা বলো।”
-” প্রথম অপশন, এখন তোর সামনে আমি বিষ খাবো সেটা তুই বসে বসে দেখবি। না কাউকে ডাকতে পারবি আর না আমাকে বাঁধা দিতে পারবি। আর দ্বিতীয় অপশন, মেধার খোঁজ দিবি। ”
একথা শুনে আমান হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। মানে কি?
এটা কোনো কথা? এর একটাও সে এখন করতে পারবে না।
তার হতভম্ব মুখ দেখে আদিত্য হাসলো। তারপর বললো,
-”বল কোন অপশনটা নিবি?”
-”একটাও না।”
-”কেন, আরো অপশন লাগবে?”
-”হুম।”
-”ওকে, তাহলে গুনে গুনে দশ মিঃ সময় দিলাম তোকে। এই
দশ মিনিটের মধ্যে আমাকে যা মিথ্যে বলেছিস সবটা সুন্দর করে সত্য দিয়ে উপস্থাপন করবি। নয়তো কি হবে দশ মিনিট পরে বুঝবি।”
-”ক কি বলছো ভাইয়া? কোন মিথ্যের কথা বলছো? আর আমি তোমাকে মিথ্যে কেন বলবো? আমার অবস্থা দেখেও তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না? তাছাড়া এমন পরিস্থিতিতে কেউ মজা করে? সত্যি বলছি, আমি তোমাকে মিথ্যে বলি নি।”
আদিত্য আর একটু শব্দও করলো না। ইশারায় ঘড়ি দেখিয়ে কফিকে চুমুক দিলো। মাথার উপর দ্রুত গতিতে চলা সিলিং ফ্যানের বাতাসেও আমান ঘামছে। সে মিথ্যা বলে নি একথা বলে যেতে উদ্যত হতেই হাতে টান পড়লো। আদিত্য চট করে উঠে দরজা আঁটকে হকিস্টিক হাতে তুলে নিলো। আমানের এবার চোখ দু’টো কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। সে দু’পা পিছিয়ে বার বার বলতে লাগল, ”সত্যি বলছি আমি কিছু জানি না, সত্যিই জানি না আমি। ”
-”সত্যিই জানিস না?”
-”না।”
-”তাহলে তোর মুখ বাদে শরীরের আর কোথাও আঘাতের চিহ্ন নেই কেন? মেরে সেন্স হারিয়ে ফেলেছিলো না তোকে?
আচ্ছা যে মেরেছে তার শরীরে শক্তি নেই নাকি তুই বিখ্যাত জাদুকর? যে জাদুর বলেই আঘাতের চিহ্ন রাতারাতি মুছে ফেলেছিস এমন কিছু?যা এটাও নাহয় বাদই দিলাম, তোরা নিঁখোজ থাকাকালীন তোর ফোনটা আমাদের পূর্বের বাসার লোকেশনে কেন? তাও আট ঘন্টা! মেধাকে আঁটকে তোকে নিশ্চয়ই বাসায় বিশ্রাম করতে পাঠিয়েছিলো না। নাকি তুই
অদৃশ্য হয়ে সেখান থেকে ঘুরে এসেছিলি? ফোন হারায় নি এটাও সিওর। কারণ ফোন বর্তমানে তোর কাছেই রয়েছে।
একটু আগে ফোনে গেমও খেলেছিস। আর কিডনাপারের নামটা কী যেনো বলেছিলি? ওহ হ্যাঁ, উদয়। তাকে কীভাবে চিনিস তুই?ও বাবা মায়ের থেকে উদয় নাম শুনেছিলি না?
আর সেখান থেকেই….! যা এসব কিছুবাদ দিলাম, এবার বল, বেধড়ক মার খেয়ে আধমরা হয়ে বাইক চালিয়ে বাসায় আসলি কীভাবে?”
To be continue…..!!