❝মোহ মেঘের আলাপন ❞
লেখিকা: “নূরজাহান আক্তার আলো”
[২১]
-”মেধাকে কিডন্যাপ কেন করেছিস? কোন স্বার্থে করেছিস? আর জানতে চাই না। ইচ্ছে হলে মেরে লা’শ ভাসিয়ে দিস নয়তো মেরে গুম করে দিস। আর খোঁজ নিবো না, জানতেও চাইব না। সেই সঙ্গে এটাও ভুলে যাস আদিত্য তোর কাছে মৃত। আর তুই নিজের হাতে তোর ভাইকে মে’রে ফেলেছিস।”
-”শুনবে না কেন করেছি? ”
-”ইচ্ছে নেই।”
আদিত্য তার কথা শেষ করে চলে যাচ্ছিল। তার কিছু বলার নেই। কী বা বলবে খুঁজেই পাচ্ছে না। ভীষণ এলোমেলো সে।
একদিকে মেধা অন্যদিকে ভাইয়ের প্রতারণা। এসব মিলিয়ে বুক সহ্যহীনভাবে জ্বলছে, ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। হওয়াটাই বুঝি স্বাভাবিক! কারণ বুকের স্থান দেওয়া মানুষগুলো যখন বুকে আঘাত করে তখন ভীষণ লাগে।এতটা লাগে যা বলে প্রকাশ করার মতো না। ঠিক যেভাবে আমান তাকে দিয়েছে। তার’ই চোখের সামনে থেকে মেধাকে নিয়ে গিয়ে আঁটকে রেখেছে।
যেটা ছিলো ওর কল্পনাতীত। অহেতুক কষ্ট দিচ্ছে ওদেরকে। মনগড়া কথার ছলে মিথ্যাের উপর মিথ্যে বলে ধোঁকা দিয়ে গেছে প্রতিনিয়ত।যেটা সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে ওকে। এমনকি স্বার্থের বশে ভালো মন্দের তফাৎ দেখে নি আমান।
একবারো ভাবি মা ও ভাইয়ের কথা। ভাবে নি তিলতিল করে গড়া ওদের পরিবারের সন্মানের কথা। তার বিবেক বাঁধে নি এতিম মেয়েটার সঙ্গে এমন কিছু করতে। সেও তো ভাই বলে বিশ্বাস করে তার সঙ্গে গিয়েছিলো। অথচ আমান…..! আজ একথা বলতেই হচ্ছে, আমান সত্যিই না ভালো ভাই, আর না ভালো ছেলে, আর না ভালো একজন মানুষ। সবদিক থেকে সে শূন্যের কোঠায়। সেই সঙ্গে বিশ্বাসেরও যোগ্য না। এসব ভেবে আদিত্য আমানের কথা উপেক্ষা করে চোখ মুছে পা বাড়াতেই শুনতে পেলো,
-”দেড় কোটি টাকা ঋণ করে ফেলেছি আমি। ঠিকই শুনেছো দেড় কোটি টাকা!”
একথা শুনতেই আদিত্য থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো। সে হতবাক হয়ে ঘুরে তাকালো আমানের দিকে। আমান ততক্ষণে উঠে মেঝেতে হেলান দিয়ে বসেছে। তার দৃষ্টি সামনে পড়ে থাকা কাঁচের দিকে। আদিত্যের চোখের দিকে তাকানোর সাহস ওর নেই। তাই দৃষ্টি নত করেই বলতে লাগল,
-”এত টাকার ঋণ থেকে মুক্তির পথ জানা নেই আমার। দিনে দিনে এতগুলো টাকা ঋণ করে ফেলেছি। এই টাকার জন্যই নানান সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত।উঠতে বসতে
পাওনাদারীদের কথা শুনতে হচ্ছে। ‘আমি নেশাখোর ‘একথা মানতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই আমার। নেহাৎ মজার ছলে এক কী দু’দিন নেশা করতাম আগে।কিন্তু এটা কীভাবে যেনো খুব
প্রিয় হয়ে উঠলো। ধীরে ধীরে আসক্ত হয়ে পড়লাম এতে। এ
নেশারঝোঁক ধীরে তীব্রমাত্রায় বাড়তে থাকলো। পূর্বে হাজার
টাকার নেশাতে হতো এখন সেটা লাখ টাকায় নেমেছে। নেশা
খোর নেশা নিবেই, এটা চিন্তা করে যার থেকে নিতাম দ্বিগুন দাম নিতো আমার থেকে। নেশা উঠলে কাটা মুরগির মতো ছটফট করতাম তখন মাথা কাজ করতো না। তার নিধারিত
দামেই রাজি হয়ে যেতাম। কখনো কখনো বাবা মায়ের সঙ্গে অশান্তি করে, টাকা চুরি করেও, নেশা করতে হয়েছে। বাধ্য হয়েছি করেছি। যখন তুমি নেশার কথা জেনে গেলে তখন আমার হাতে আর কিছু করার ছিলো না। তোমার কথা না শুনাতে তুমি কথা বলা বন্ধ করে দিলে। বন্ধুরা একথা জেনে বুদ্ধি দিলো একনেশা কাটাতে আরেক নেশার সাহায্য নিতে। পরে মেয়ে…! তুমি এটাও জেনে গেলে। আমার মুখ দেখাও বন্ধ করে দিলে। কিন্তু আমি সত্যি বলছি ভাইয়া, আমি বহু বার চেষ্টা করেছি। তবে ব্যর্থ হয়েছি। তাছাড়া, ‘ ভালো হয়ে যাবো’ বললেই তো আর একটা নেশাখোর ভালো হতে পারে না। হঠাৎ নেশা ছাড়া তার পক্ষে সম্ভবও হয়ে ওঠে না। কারণ যখন নেশা উঠে তখন আমি নিজের মধ্যে থাকি না। মাথাতে কাজ করে না। সবকিছু তুচ্ছ মনে হয়। মনে হয়, যে কোনো মূল্যে আমার নেশাদ্রব্য চাই-ই চাই। নেশায় জীবন। আমার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। আর বাকিতে খেতে খেতে এত টাকা ঋণ হয়ে গেছে৷ এখন টাকা না দিলে সেটাও আর দিচ্ছে না। তুমি আর বাবা এমনি এমনি তো আর টাকা আমাকে দিতে না। অশান্তি করে যা পেতাম তাতেও কাজে আসতো না। তাই
মেধাকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করে মোটা অঙ্কের কিছু টাকা হাতাতে চেয়েছিলাম। যদিও মেধার ক্ষতির চিন্তা ভাবনাতেও ছিলো না আমার। আমারও তো বোন হয় তাই না? তাছাড়া এই কাজ বাইরের কারোর সঙ্গে করতে গেলে খুব রিক্স হয়ে যেতো। পুলিশের ঝামেলা পোহাতে হতো। এসব ভেবে চিন্তে বন্ধুরা বললো মেধাকে কিডন্যাপ করা সবচেয়ে ভালো হবে। টাকা হাতে পেয়ে গেলে পরে তোমাকে জানালে তুমিও মেনে নিবে। আমিও তো জানি তুমি আমাকে খুব ভালোবাসে। তাই এই কথা ভালো ভেবে ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
-”ভালোবাসার মূল্য এত দারুণভাবে শোধ করলি?”
-”ভাইয়া কষ্ট পেও না। আর কখনো এমন করবো না। বিশ্বাস করো, নিরুপমা হয়ে একাজ করতে বাধ্য হয়েছি। প্লিজ মাফ করো আমাকে। তোমার পায়ে পড়ি ভাইয়া, বাঁচাও আমাকে।
বাঁচতে চাই আমি। আমি, আমি এক্ষুণি তুষারকে বলে দিচ্ছি মেধাকে বাসায় পৌঁছে দিতে। তুমি চিন্তা কোরো না, মেধা এই ঠিক আধাঘন্টার মধ্যে বাসায় পৌঁছে যাবে।”
-”তাই?”
-”মেধা আমার বন্ধুর বাসায় আছে। দাঁড়াও ফোন দিচ্ছি।”
-”তোর কি মনে হয়? তোর বন্ধুর বাসায় থাকলে এখানে আর এক মুহূর্ত থাকতাম আমি?”
-” ম মানে?”
-” মানে তোর বিশ্বস্ত বন্ধু তোর উপরে উল্টো চাল চেলেছে।
সে মেধাকে নিয়ে ঢাকার বাইরে চলে গেছে। তোর বিশ্বাসের ধার সে ধারে নি। এত কথা জানি না, শুধু জানি যদি আমার মেধার শরীরে সামান্য একটু আচঁড় লাগে তোদের কাউকেই আস্ত রাখবো না আমি, কাউকে না।”
-”ভাইয়া তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে। ভ ভাইয়া …!”
আমান কথা শেষ করতেই আদিত্য দ্রুত স্থান ত্যাগ করলো।
ভুলেও আর পিছু ফিরে তাকালো না। কথা বলা তো দূর। ওর
যাওয়া দেখে আমান তাকে ডাকতেই থাকলো। তবে আদিত্য পিছু ফিরেও তাকালো না। সীমা বেগম থম মেরে ড্রয়িংরুমেই
বসে ছিলেন। উনি সব সত্য আদিত্যের মুখে শুনতে চান। কী হয়েছে, সবটা জানা জরুরি। আদিত্যকে নামতে দেখে উনি কিছু জিজ্ঞাসা করতে উদ্যত হলেন, তার আগেই আদিত্যের ফোনে কল আসলো। আদিত্য কলটা রিসিভ করে চুপ থেকে
অপর পাশের ব্যক্তির কথা শুনে দৌড়ে বেরিয়ে পড়লো। ওর যাওয়া দেখে সীমা বেগম হতবাক তাকিয়ে রইলেন। ওদিকে
আমান ফোন হাতে নিয়ে তুষারকে কল দিতেই আছে। কিন্তু সে যতবারই কল দিচ্ছে ফোন সুইচ অফ বলছে। তার মানে আদিত্য যা বলছে সব সত্যি? তবে তুষার মেধাকে নিয়ে…? আমান আর ভাবতে পারলো না। সে ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লো। এখন তার নিজের প্রতি নিজেরই ঘৃণা হচ্ছে। তুষার এমনিতেই মেয়েবাজ ছেলে। যদি মেধার ক্ষতি করে ফেলে? একথা ভেবে আমানের মাথাটা ভনভন করে ঘুরতে লাগলো।
চোখের পাতায় ভেসে উঠলো মেধার মায়াবী মুখশ্রী। কানে বেজে উঠলো তার খিলখিল করে হাসার শব্দ। আমান আর ভাবতে পারলো না বহুকষ্টে উঠে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বেরিয়ে পড়লো বাসা থেকে।
বিপদের সময় ভীষণ দীর্ঘ হয়। হাতে ঠেলেও যেনো পার করা যায় না। ঘড়ির কাঁটা চলতে চলতে রাত পেরিয়ে গেছে। কিন্তু
এখনো কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নি। সীমা বেগম ছেলেদের ফেরার অপেক্ষায় ড্রয়িংরুমেই বসে আছেন। নেত্র জোড়ায় জলে টইটম্বুর। মলিন মুখ। আদিত্যের বাবা বার বার বলেও উনাকে রুমে নিয়ে যেতে পারেন নি। এটাও বোঝাতে পারেন নি, উনি অসুস্থ। এমন করলে আরো অসুস্থ হয়ে পড়বেন।
এভাবে ভোর হলো, সকাল হলো, ধীরে ধীরে বেলাও গড়াতে
থাকলো। কাজের বুয়া এসে সকল কাজ সেরে, নাস্তা বানিয়ে চলেও গেল। নাস্তা পড়ে রইলো টেবিলের উপরেই। না আছে কারো খাওয়া ইচ্ছে আর না কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার তাড়াহুড়ো।
সীমা বেগম সোফাতে বসে নিজের ভাবনার মগ্ন। তখন মনে হলো বাসায় কারো গাড়ি ঢুকেছে। উনি চটজলদি উঠে দ্রুত দরজার কাছে দাঁড়াতেই কেউ হামলে পড়লো উনার বুকের উপর। মেধাকে দেখে উনি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। খুব শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে পরক্ষণেই মেধার মুখে একের পর এক দিতে থাকলেন স্নেহের পরশ। আদিত্যের বাবা বের হয়ে এই দৃশ্য দেখে এগিয়ে এলেন। ছলছল নেত্রে তাকিয়ে মেধার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তখন আদিত্য উনাদের পাশ কাটিয়ে উপরে চলে গেল। না টু শব্দ করলো আর না কাউকে কিছু বলার সুযোগটুকু দিলো। সীমা বেগম মেধাকে বসিয়ে পানি নিয়ে নিয়ে আসতেই আদিত্যকে নিচে নামতে দেখা গেল। তার হাতে কালো রঙের একটা ফাইল। আদিত্য নিচে নেমে সরাসরি ওর মায়ের হাতে ফাইলটা দিয়ে বলল,
-”আমি মেধাকে নিয়ে চলে যাচ্ছি। আর এক মুহূর্ত থাকাও আমার পক্ষে সময় নয়। এই ফাইলটা আমানকে দিয়ে দিও, আসছি।”
সীমা বেগম প্রত্যুত্তরে কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেলেন না। আদিত্য মেধার হাতটা শক্ত ধরে ধরে হাঁটতে গেলে মেধা চট করে দাঁড়িয়ে গেল। না বোধক মাথা নাড়ালো। অর্থাৎ যাবে না সে। তখন আদিত্য তার মুখের দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,
-”যদি এই মুহূর্তে আমার সঙ্গে না যাও তবে চিরতরে হারাবে আমায়। এবার সিদ্ধান্ত তোমার।”
To be continue………..!!
❝মোহ মেঘের আলাপন ❞
লেখিকা: “নূরজাহান আক্তার আলো”
[২২]
-”যদি এই মুহূর্তে আমার সঙ্গে না যাও তবে চিরতরে হারাবে আমায়। এবার সিদ্ধান্ত তোমার।”
-”আ আদিত্য..।”
-”আমি বাড়তি কথা শুনতে ইচ্ছুক নয়।”
-”তাই বলে বাসা থেকে চলে যাবেন?”
-”থাকো তবে।”
একথা শুনে মেধা ছলছল দৃষ্টিতে মামনির দিকে তাকালো।
সে দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে। একদিকে মামনি অন্যদিকে অতি প্রিয় মানুষটা। কী করবে বোধগম্য হচ্ছে না। যার জন্য এত লড়াই তাকে ছাড়া থাকবে কীভাবে? দিনই বা কাটবে কী করে? সে যে ভীষণ ভালোবাসে মানুষটাকে। আদিত্য মেধার দিকে না তাকিয়ে হাঁটা ধরতেই শার্টে টান খেলো। মেধা ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে তার পানে। আদিত্য ওর হাতের মুঠোয় থেকে শার্ট ছুটাতেই মেধা শব্দ করে কেঁদে দিলো। ঘাড় ঘুরিয়ে সীমা বেগমকে বিচার দিলো,
-”মামনি কিছু বলো প্লিজ।”
একথা শুনে সীমা বেগম হাসলেন। কিঞ্চিৎ অবাক হোন নি তিনি। এমন কিছুই ঘটবে উনি যেনো আগে থেকে জানতেন।
আদিত্য মেধার হাত থেকে হাত ছুটাতেই তখন সীমা বেগম বললেন,
-”যাচ্ছো যাও, তবে কষ্ট করে আর একটা ঘন্টা থেমে যাও।”
-”কেন?”
-”কিছু কাজ বাকি আছে। আশা করি এক ঘন্টায় খুব একটা ক্ষতি হবে না তোমার।”
আদিত্য মায়ের কথায় কোনো জবাব না দিয়ে সোফায় গিয়ে বসলো। অর্থাৎ থেমে যাবে। ওকে বসতে দেখে মেধার মুখে হাসি ফুটলো। সে কিছু বলতে গেলে আদিত্য মুখটা ঘুরিয়ে
নিলো। তখন সীমা বেগম জলদি আদিত্যের বাবাকে ডেকে কিছু বলে বাইরে পাঠালেন। তারপর মেধাকে ডেকে নিজের রুমে নিয়ে গেলেন। যাওয়ার আগে আদিত্যকে বলে গেলেন, একটা পাঞ্জাবি পরে আসতে। কিন্তু আদিত্য গেল না সেখানে সেভাবেই বসে রইল। ঠিক পনেরো মিনিটের মধ্যে আদিত্যের বাবা একজন কাজি ডেকে আনলেন। সীমা বেগমও মেধাকে লাল শাড়ি পরিয়ে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে আনলেন। তাকে বসালেন আদিত্যের পাশে। বড় মামা আসছেন রাস্তায় উনি।
আদিত্য মায়ের উদ্দেশ্য বুঝে এবারও কিছু বললো না। বরং কাজি যখন যা যা বললেন সেসব করলো সে। এর খানিক্ষন পরেই বড় মামা-মামী উপস্থিত হলেন। নিকট আত্মীয়ও চলে এলেন জরুরি তলবে। তারপর সকলের উপস্থিতিতে তাদের শুভ পরিণয় সম্পূর্ণ হলো। বৈধভাবে তারা জুড়ে গেলো একে অন্যের সাথে। মেধা নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে ওর চিরসখা হিসেবে গ্রহণ করলো প্রিয় মানুষটাকে। এসব করতে করতে প্রায় এক ঘন্টা ঘনিয়ে এলো। এক ঘন্টা হতে যখন আর দশ মিনিট বাকি তখন আদিত্য সীমা বেগমের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললো,
-”আমার ফ্ল্যাটে উঠছি আপাতত। আগামীকাল এসে নতুন সংসার গুছিয়ে দিয়ে যেও। বাসা আলাদা হচ্ছে তবে আমি
কিংবা মেধা কেউ পর হয়ে যাচ্ছি না। সর্বদা সর্বক্ষণ আমি রইবো তোমাদের পাশে। আর কেন চলে যাচ্ছি, অজানা নেই তোমার। তাই মন খারাপের কিছু নেই। খুব ভালো থেকো তোমরা, সাবধানে থেকো, চলো মেধা।”
একথা বলে আদিত্য এক কাপড়ে মেধার হাত ধরে বেরিয়ে গেল। মেধা ঘাড় ঘুরিয়ে ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে সীমা বেগমের দিকে। উনিও স্থির হয়ে ওদের চলে যাওয়া দেখছে।
আদিত্য মেধাকে তার গাড়িতে বসিয়ে নিজে বসলো ড্রাইভিং সিটে। মেধা বিনাবাক্য গাড়িতে বসে জানালায় মাথা ঠেকিয়ে অঝরে কাঁদতে লাগলো। এমন তো হওয়ার কথা ছিলো না!
বাবা মাকে হারিয়ে আরেকটা পরিবার পেয়েছিলো। সকলের
সঙ্গে থাকতে চেয়েছিলো মিলেমিশে। সেই সঙ্গে চেয়েছিলো খুব সাধারণ একটি জীবন। যেখানে চাওয়া পাওয়ার হিসাব নেই। একা হওয়ার ভয় নেই। থাকবে এক টুকরো সুখ। অথচ হচ্ছে তার বিপরীত। বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী ওর জীবন এতটা জটিল হয়ে গেছে যেটার সমাধান হাতের বাইরে। এই যেমন, সেদিন আমানের সঙ্গে গিয়ে যেই বিপদে পড়েছিলো সে, ভেবেছিলো আর কখনো আদিত্যের দেখা পাবে না। সে আর বলতেও পারবে না, ‘ভালোবাসি আদিত্য, আমি ভীষণ ভালোবাসি তোমায়।’ কাঁদতে কাঁদতে তার হঠাৎ’ই সেদিনের কথা মনে পড়ে গেল। সে ভাবতে লাগলো সেই ঘটনার কথা।
মেধা যখন চোখ খুলে তাকায় তখন দুপুর। জানালার পর্দা মেলে দেওয়ায় আবহাওয়াটা বোঝা যাচ্ছে না। এসি চলছে।
এজন্য শীত লাগছে বোধহয়। সে আশেপাশে দৃষ্টি ঘুরাতেই নজর পড়ে উদয়ের ফটোফ্রেমের দিকে। তার মনে পড়ে যায় ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। হারানোর কষ্টে ভারি হয়ে থাকে বক্ষপাশ। চোখ ফেটে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু। বুকেও শুরু হয় নিষ্ঠুর তোলপাড়। অতি প্রিয় মানুষটার মুখটা ভেসে ওঠে চোখের পাতায়। সেই সঙ্গে মুখ থেকে বেরিয়ে আসে একটা অতি প্রিয় শব্দ ‘আ আ আদি ত্য।’
তখন সুসজ্জিত রুমের দরজা ঠেলে কেউ প্রবেশ করে। শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখে উদয়। ওর পরনে কালো টি শার্টের সঙ্গে কালো টাউজার। কানে ইয়ারফোন গুঁজে রাখা। হাতে আধ খাওয়া আপেল। মুখে মিটিমিটি হাসি। উদয় জানালার পর্দা
সরিয়ে মেধাকে বললো,
-”আমার রাজ্যে তোমাকে সু-স্বাগতম মাই লাভ।”
এই কথাটা বলতে বলতেই উদয় এগিয়ে মেধাকে একটানে দাঁড় করিয়ে জানালার পাশে চলে গেল। থাই গ্লাস ভেদ করে দৃষ্টি গেল বাইরের দিকে। মেঘলা আকাশ। তখন উদয় থাই
গ্লাস সরাতেই চোখ পড়লো অনেক বড় বড় বিল্ডিং। দেশের
আকাশে বাতাসে কেমন অচেনা টান অনুভব করলো মেধা।
অদ্ভুত ঠেকলো তার কাছে। মস্তিষ্কেও খেলে গেল কিছু প্রশ্ন।
তখন তার চঞ্চল দৃষ্টি দেখে উদয় ঝাপটে ধরলো বাহুডোরে।
অতঃপর হাতের বাঁধন শক্ত করে ফিসফিস করে বলল,
-”আমরা আছি তোমার আদিত্যের ধরা ছোঁয়ারও বাইরে। এই সেই সুদূর আমেরিকা।”
-”আদিত্যের ভয়ে এখানে এসেছেন বুঝি?”
-”হা হা হা, আদিত্যকে ভয়? তাও আবার আমি? জোক্সটা কিন্তু দারুণ।”
ওর হাসি মেধার সহ্য হলো না। আচমকা উদয়ের কলার ধরে
ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললো,
-”কেন করলেন এমন? কি অপরাধ আমার? কোন অপরাধে
আমাকে এত বড় শাস্তি দিলেন? বলুন, বলুন, বলছি।”
-”বেশ করেছি।”
একথা শুনে মেধার রাগ তুঙ্গে। সে আর ভাবনা চিন্তা না করে থাপ্পড় দিতে হাত তুললেই উদয় তা ধরে ফেললো। মুখের ভাবভঙ্গি মুহূর্তেই পাল্টে গেছে তার। মুখে ফুটে উঠেছে চাপা ক্রোধ। হটাৎ সে মেধার হাত পেছনে মুচড়ে ধরে বাঁ গালে ওষ্ঠ ছুঁয়ে বললো,
-”জান, তুমি যত দুঃসাহস দেখাবে আমি আমার আদরের মাত্রা তত বাড়বো। বাকিটা তোমার ইচ্ছে। ”
-”আপনাকে আমি ঘৃণা করি, ছাড়ুন আমায়। আপনার স্পর্শে আমার শরীর গুলিয়ে যাচ্ছে, বমি পাচ্ছে আমার।”
-”মজার ব্যাপার কি জানো? নিষিদ্ধ কাজে আমি আকৃষ্ট হই বেশি। কেউ কিছু বারণ করলে আমি সেটাই না করা অবধি শান্তি পাই না। সরি বউ তোমার এই কথাও রাখতে পারলাম না।”
উদয়ের কথা শুনে মেধা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে। সে বুঝে গেছে জোর খাটিয়ে কিছু করা যাবে না। এখানে বুদ্ধির খেল দেখাতে হবে। ওকে নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে
উদয় ভাবে মেধা তার সব কথায় বিশ্বাস করেছে। তাই হিরো সাজতে আরো অনেক কথা বলে মেধাকে। তবে মেধা কিন্তু
তখনো জানতো না উদয়ের পরিচয়ে তুষার। তখন তুষারের ফোনে কল আসে। তুষার মুখ ফসকে বলে ফেলে, হ্যাঁ তুষার
বলছি বলুন।’ একথা শুনতেই মেধার সন্দেহ প্রবল হয়। তাও সে কিছু বলে না।মনমরা হয়ে বসে থাকে রুমের এক কোণে।
পরে তুষারের সেই ভাড়া করা ফ্ল্যাটে তারই এক বন্ধু মেধাকে দেখতে আসে। মেধা তখন ঘুমের ভাণ ধরে শুয়ে ছিলো। ওর বন্ধু তুষারকে বলে,
-”আমানের বোনটা কিন্তু দেখতে জোস। তবে আমান শা’লা’ আসলেই গাধা। নয়তো এত সুন্দর মেয়েকে এভাবে রেখে যায়? আমরা তো মাল খেয়ে টাল হয়ে পড়ে থাকি। কখন কী ঘটিয়ে ফেলি বলা যায়?”
-”ঘটনা ঘটাবো বলেই তো আমানের চোখ ফাঁকি দিয়ে অন্য জায়গায় এনেছি মাম্মা। ইউটিউব দেখে হিরোদের মতো কত্তগুলো বুলি আওড়ে শুনিয়েছি।”
-”চুপ চুপ এসব কথা বলিস না। শুনে নিলে ঝামেলা করবে।”
-“তা ঠিক। আচ্ছা শোন ওদিকের খবর শুনেছিস?”
-”হুম আমানের ভাই আদিত্য..! ”
ওদের বাকি কথা শুনতে পারে নি। তারা কথা বলতে বলতে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। আর তখনই সে জানতে পারে এরা কে, এবং এদের উদ্দেশ্য কী।পরে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটানোর
পর, সে এক শীতল হাতের স্পর্শ পায়। কেঁদে ফুলে ওঠা নেত্র তুলে তাকাতেই দেখে আদিত্য। আদিত্যকে দেখেই সে হামলে পড়ে তার বুকে। গলা জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ লুকিয়ে ভাসিয়ে দেয় আদিত্যের বুক। আদিত্যও খুব শক্ত করে জড়িয়ে রাখে তাকে। অনেক কষ্টে সে মেধার খোঁজ পেয়েছে। তারপর তারা রুম থেকে বের হতেই দেখে আমান বেধড়ক মারছে তাদের বন্ধুদের। সেটা দেখেও আদিত্য কথা বলে নি দাঁড়াও নি আর একমুহূর্ত। মেধাকে নিয়ে সোজা চলে আসে বাসায়। মেধার এসব ভাবনার ছেদ ঘটলো গাড়ির হর্ণ শুনে।সে মুখ তুলতেই
আদিত্য বললো,
-”কান্নাকাটির কী হলো বুঝলাম না। সব মেয়েরা চায় বরকে নিয়ে আলাদা থাকতে। দু’জনার টোনাটুনির সংসার পাততে। শশুড়-শাশুড়ি, দেবর-ননদের, ঝামেলা থেকে মুক্তি পেতে। তুমি এসব চাওয়ার আগেই পেয়ে গেলে। তাহলে বোকার মতো কাঁদছো কেন হুম? এখন তোমার উচিত, বরকে নিয়ে চুটিয়ে প্রেম করা। রোমান্সের রসে তলিয়ে যাওয়া। ”
মেধা জবাব দিলো না। বরং সিটে হেলান দিয়ে বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। ওকে মনমরা দেখে আদিত্যই বললো,
-”রজনীগন্ধা, গোলাপ, আর কোন কোন ফুল আনবো?”
-”ফুল? ফুল কি করবেন?”
-”বলে কি মেয়ে, রুম সাজাতে লাগবে না?”
-”কি আশ্চর্য! রুম সাজাবেন কোন দুঃখে?”
-”দুঃখে না রে পাগলি সুখে।”
-”এই পরিস্থিতিতেও সুখ কিলবিল করছে আপনার মনে?”
-”সুখী মানুষের মনে সুখ কিলবিল করা স্বাভাবিক।”
-”শুনি কোন সুখের ঠেলায় ফুল কিনবেন।”
-”আজ আমাদের ফাস্ট নাইট। রুমে না সাজালে কীভাবে হবে হুম? বিয়ে যখন করেছি বাসর তো ক…।”
আদিত্য তার কথা শেষ না করতেই দেখে মেধা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। তাকে আরেকদফা অবাক করতে সে সত্যি সত্যিই গাড়ি থামিয়ে অনেকগুলো ফুল কিনে আনলো।
সব ফুল এনে রাখল মেধার কোলে।
To be continue…….!!