ম্যারি মি পর্ব-০৩

0
3

#ম্যারি_মি – ০৩
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

পাবলিকে পরীক্ষা দিয়ে সমুদ্রের ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিল ধ্রুব। কিন্তু ফাহিম মাহবুব ছেলেকে নিজের মতোই আর্মির অফিসার হিসেবে দেখতে চান। ধ্রুব সেটা জেনে বাবার ইচ্ছে পূরণ করতে ক্যাডেটে ভর্তি হয়। সমুদ্রের ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার কারণ হলো সারাদিন সমুদ্রের সাথে থাকা। দুজন একসাথে থাকবে পড়বে। এটাই মূল কারণ। ধ্রুবর পড়াশোনা নিয়ে কোনো ইচ্ছে অনিচ্ছে নেই। যখন শুনেছে তার মতো ঘাড়ত্যাড়া সন্তানকে নিয়েও তার বাবা স্বপ্ন দেখেন তখনই নিজের সিদ্ধান্ত বদলেছে। ভর্তি বাতিল করে ক্যাডেটে পড়াশোনা করতে কেউ তাকে বলেনি, ফাহিম মাহবুব শুধু নিজের ইচ্ছে টা বলেছিলেন। তারা মা বাবা হিসেবে কখনো সন্তানদের উপর কিছু চাপিয়ে দিতে চান না।

রোদ কমে গিয়ে আকাশ ধীরে ধীরে লাল হচ্ছে। বিকেল বেলা সমুদ্রকে হসপিটালে রেখে ধ্রুব বের হলো। ইতিমধ্যে সে নিনীকার বাড়ির ঠিকানা পেয়ে গেছে। উদ্দেশ্য বাড়ির আশপাশটা একটু চক্কর মেরে আসা। পরে ভাবা যাবে কি করা যায়।

বাহির থেকে ছোট্ট রাজপ্রাসাদ মনে হয়। সাদা রঙের বড় গেইট। বাড়ির চারিদিকে দেয়ালের বাউন্ডারি, তাতে কাঁচ গুঁজে রাখা। চুর ডাকাত যাতে ঢুকতে না পেরে সেইরকম ব্যবস্থা। ধ্রুব গেইটের সামনে এলো। গেইট থেকে চারিদিকের বাউন্ডারি ঘুরলো৷ বাগানের সাইটে সুইমিংপুল। বাড়ির মালিক তবে বেশ শৌখিন। আবারও ঘুরে যখন ধ্রুব গেইটের সামনে এলো তখন চোখে পড়লো উপরে বড়বড় করে লেখা ‘শেখ বাড়ি।’ গেইট ভেতর থেকে বন্ধ। নিশ্চয়ই ভেতরে দারোয়ান আছে।

ধ্রুব আবারও ঘুরে ঘুরে দেখলো। বারান্দা গুলোর দিকে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে ভালো করে দেখতে লাগলো। ধ্রুবর পাশ দিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন এক লোক। পাজামা পাঞ্জাবি পড়োনে হাতে একটি বড়ো ছাতা। ধ্রুবকে উঁকিঝুকি দিতে দেখে সন্দেহের নজরে তাকালো। পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে বললেন,

‘ কি চাই এখানে? ‘

ধ্রুব নির্লিপ্ত ভাবে বলল,

‘ কিছু চাইলে নিজেই নিয়ে নিতে পারবো। আপনি নিজের কাজ করুন। ‘

‘মুরুব্বিদের সাথে এ কিরকম ব্যবহার? ‘

ধ্রুব গাল চুলকে বলল,

‘ আপনি কি আমাকে চিনেন? ‘

‘ না তুমি কে বাবা? ‘

‘ ওইযে শেখ বাড়ি দেখছেন? শেখ বাড়ির একমাত্র মেয়ের একমাত্র জামাই আমি। শুনেছেন উত্তর? এবার যান। ‘

লোকটি বড়বড় চোখে তাকালো,

‘ কি বলো সত্যি? ‘

ধ্রুব বিরক্ত হলো,

‘ আপনাকে আমি মিথ্যা বলতে যাবো কেন? ‘

‘ কিন্তু বাবা আমি তো জানতাম শেখ বাড়ির কন্যা অবিবাহিত। তারই জন্য বিয়ের সম্মন্ধ নিয়ে যাচ্ছিলাম এখনই। ‘

ধ্রুব আগ্রহ নিয়ে তাকালো,

‘ তাই নাকি? ‘

‘ হ্যাঁ বাবা, শেখ কন্যার জন্য সেই কত বছর ধরে নানান সম্মন্ধ আসে, এবারও আসছে একটা। পাত্র সবসময়ের মতোই সেরা। কিন্তু সেরা হলে তো লাভ হবে না, শেখ সাহেব তো মেয়েরে বিয়াই দিবার চান না। কত ভালো ভালো পাত্র, এমন সুপাত্র কি হাতছাড়া করা ঠিক? এতোদিন কারণ খুঁজছি কেন শেখ সাহেব রিজেক্ট করেন, আজ তোমারে দেখে কারণ টা বুঝতে পারলাম। চলো শেখ বাড়ি, শেখ সাহেবের সাথে কথা বলে চলে যাই। মেয়ের বিয়ে দিলো অথচ মিষ্টি পেলাম না। ‘

ধ্রুব লাফ দিয়ে সরে গেলো।

‘ আপনিই যান, আমার কাজ আছে। ‘

মুরুব্বি হাত টেনে ধরলেন।

‘ আরে কি বলো জামাই, চলো যাই। নিনী আম্মার পাশে তোমারে কেমন মানায় আমারে দেখতে হবে না নাকি? অনেক দিনের শখ ছিলো অমন চাঁদের মতো সুন্দর পুতুলের পাশে কারে মানায় সেটা দেখার। আজ আমার শখটা পূরণ হইবো। চলো জামাই যাই। ‘

ধ্রুব পড়লো মহা বিপদে। শেখ বাড়িতে যদি সে এখন যায় তবে শেখ বাড়ির কর্তা তার জান নিয়ে নিবে নিশ্চিত৷ হাত ছাড়াতে চেষ্টা করলো,

‘ চাচা আপনিই যান, আমি একটা কাজে যাবো আর্জেন্ট। ‘

মুরুব্বি শুনলেন না, ধ্রুবকে টেনে নিয়ে গেলেন গেইটের কাছে। গেইটের লকে ছাতা দিয়ে বাড়ি দিতেই দারোয়ান এসে খুলে দিলো। বলল,

‘ আপনি এ সময়? ‘

মুরুব্বি ছাতা দিয়ে বাড়ি দিলেন।

‘ বাড়ির একমাত্র জামাই সাথে নিয়ে দাড়িয়ে আছি, আবার জিজ্ঞেস করস এ সময় কেন। নালায়েক পথ ছাড়। ‘

দারোয়ান রেগে গেলো। ধ্রুবকে দেখে নিয়ে বলল,

‘ মাল খাইয়া আসছেন নাকি? শেখ স্যারের স্পষ্ট মানা আপনি যেনো বাড়িতে ঢুকতে না পারেন। নিনীকা আপারে বিয়া টিয়া দিতো না। ‘

মুরুব্বি হু হু করে হাসলেন। ধ্রুবর কাঁধ চেপে ধরে বললেন,

‘ বাড়ির জামাই নিয়ে আসছি, শেখ সাহেব আমাকে বললেই পারতেন যে মেয়েরে বিয়ে দিয়ে দিছেন। আমি কি প্রতিদিন সম্মন্ধ নিয়ে কষ্ট করে আসতাম? ‘

দারোয়ান ছেলে প্রায় ধ্রুবর বয়সী।

‘ আপনার কি মাথায় সমস্যা হইছে? কি বলেন এগুলা?

ধ্রুব নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। মুরুব্বি আবার চেপে ধরলেন। দারোয়ানকে ঠেলে ঢুকলেন ভেতরে। সদর দরজা খোলা। বাগানের কাছের টেবিলে ঝুরি ভর্তি ফুল নিয়ে বসে আছে কেউ। পড়োনের সাদা গাউন লম্বা হওয়ায় মাটিতে জায়গা করে নিয়েছে। মাথায় পাথরের ক্রাউন। চুলগুলো পিঠ জুড়ে ছড়িয়ে আছে। ধ্রুবর গলা শুকিয়ে গেলো। মেয়েটির মুখের এক পাশ দেখা যাচ্ছে। প্রিন্সেসদের মতো সাজগোছ পোশাক। এক মনে সে ঝুরি থেকে ফুল নিয়ে মালা বানাচ্ছে। ধ্রুবকে এর মধ্যে মুরুব্বি টেনে নিয়ে গেছেন আরও কাছে। ধ্রুব দেখলো মেয়েটি কানে সাদা ফুল গুঁজে দিয়েছে। ধ্রুবর চোখ বড়বড় হয়ে গেলো। মেয়েটি ঘুরে তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসছে। এ যে নিনীকা!

ধ্রুব চোরা চোখে রক্তজবার মতো ঠোঁট দেখছে। নিজেকে শাসিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। মুরুব্বি নিনীকার সাথে কথা বলতে লাগলেন।

‘ আম্মা আপনার যে বিয়ে হইছে আমারে তো জানাইলেন না। ভাগ্যিস আপনার জামাইয়ের সাথে দেখা হলো, দামান বাবাই তো বললো সব। ‘

নিনীকার হাসি মুখ চুপসে গেলো। জ্বলজ্বল চোখজোড়া দিয়ে ধ্রুবকে পরোখ করলো। ধ্রুব বুঝতে পেরে টেনেটুনে পড়োনের শার্ট ঠিক করতে লাগলো। মুরুব্বি আবারও বললেন,

‘ শেখ সাহেব কই? ‘

নিনীকার আলতো স্বরে বলল,

‘ বাবা অফিসে, একটু পরই ফিরবেন। ‘

ধ্রুব অবাক হয়ে তাকালো। ভার্সিটিতে দেখা রাগী মেয়েটি নরম কন্ঠে কথা বলছে। এক মানুষের কতো রুপ৷

‘ আমি ততোক্ষণ কি বসবো আম্মা? ‘

নিনীকা চেয়ার এগিয়ে দিলো।

‘ আপনি বসুন ‘

‘ দামান বাবাজি ও বসুক, তার সাথে তো তেমন করে পরিচয়ই হলো না। ‘

নিনীকার ভ্রু কুঁচকে গেলো,

‘ দামান? ‘

মুরুব্বি দাঁত বের করে হাসলেন,

‘ মানে জামাই বাবা আরকি, কিছু মনে করবেন না আম্মা আমগো সিলেটি ভাষায় দামান বলে এইটারে। ‘

নিনীকা হতভম্ব হলো। এতোক্ষণ কিছুই তার মাথায় ঢুকেনি। তবে বুঝতে পারছে ধ্রুব কিছু একটা করেছে। রাগ বাড়লো। তেড়ে গেলো ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব দু কদম পিছিয়ে গেলো। নিজের পক্ষে বলল,

‘ আমি কিছু করিনি, দাড়িয়ে ছিলাম আর এই বেশি কথা বলা চাচা আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন আমি তোমাদের কে হই। তো আমি বলেছি যে যাই হই না কেন জামাই নিশ্চয়ই হবো না। বিশ্বাস করো আমি জানতাম না এটা তোমাদের বাড়ি। উনি নিজে কি থেকে কি ভেবে ফেলেছেন আমি জানি না। তখন থেকে টানাটানি করছেন। আমাকে জোর করে এখানে নিয়ে এলেন। গলা ছুঁয়ে বলছি আমি মিথ্যা বলছি না। ‘

ঘটক মুরুব্বি বড়বড় চোখে তাকিয়ে আছেন। চেয়ার থেকে উঠে পড়লেন।

‘ কি কও এগুলা বাবাজি? ‘

ধ্রুব এক দৌড়ে গেইটের বাহিরে চলে গেলো। একটু থেমে বলল,

‘ যা সত্যি তাই বলেছি, বাঁচতে চান তো পালান। ‘

ধ্রুব উধাও, ঘটক মুখ কাচুমাচু করে বললেন,

‘ বিশ্বাস করেন আম্মা, আমি আপনার বিয়ার প্রস্তাব নিয়ে আসছিলাম। পথে এই ছোকড়াটার সাথে দেখা। সে নিজেই বলছে আপনাদের বাড়ির জামাই, আমি কিছু জানি না আম্মা। ‘

নিনীকা হাত ভাজ করে দাড়িয়ে আছে। ক্ষুব্ধ চোখে তাকিয়ে আছে ঘটকের দিকে। ঘটক ঢুক গিললেন। শেখ সাহেব অনেক রাগী মানুষ, যদি এসব জানেন তবে তিনি কখনো আর এ বাড়িতে পা দিতে পারবেন না। পাত্ররা তাকে এতো এতো টাকা দেয় শুধুমাত্র শেখ বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাওয়ার জন্য। এই পথটা বন্ধ হলে তাকে পথে বসতে হবে। নিনীকার সামনে হাতজোড় করলেন,

‘ মা গো আমি সত্যিই কিছু জানি না। শেখ সাহেব কে কিছু বলবেন না মা। ‘

‘ ঠিক আছে, তবে আপনাকে কথা দিতে হবে আপনি আর কখনো আমাদের বাড়িতে পা রাখবেন না। ‘

জীবন বাঁচানো ফরজ। জীবন বাঁচলে অনেক কাজ করে খাওয়া যাবে। ঘটক নিনীকার কথা রাখবেন বললেন। ছাতা হাতে নিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেলেন গেইট দিয়ে৷ নিনীকার চোয়াল শক্ত। ধ্রুব যে কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছিলো সেটা সে বুঝতে পেরেছে।

(চলবে)