#ম্লান_সন্ধ্যায় (২৩)
বাড়ি থেকে বেরিয়ে ও কিছুদূর হেঁটেই এগোলো।কোন কিছু ভাবার জন্য হাঁটাটাই যুতসই।প্রথমে খালার বাড়িতে যাওয়ার কথা মনে হলেও, এখন মনে হচ্ছে হুট করে এভাবে ওখানে যাওয়া ঠিক হবে না। বিয়ের পর মেয়েদের জন্য পূর্বেকার পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে যায়। বারবার শশুরবাড়ি থেকে ওখানে যাওয়াটা ওদের কাছে হয়তো বিরক্ত লাগবে।ওদের সমাজে স্বামীর সাথে মনোমালিন্য হলে পরিবারের লোকেরা প্রথমে শশুরবাড়ি বয়কট করার ডাক দিলেও, কয়েকঘণ্টা বা কয়েকদিন পর সুর বদলে যায়। তখন একরকম মরিয়া হয়ে ওঠে, মেয়েকে শশুরবাড়ি পাঠাতে।এসব তো ওর নিজের চোখে দেখা। বাবার বাড়িতে এমনিতেই আর যাওয়ার ইচ্ছে নেই, তাদের কথা মাথায় এলে মন জুড়ে বিতৃষ্ণা ছেয়ে যায়। এখন অন্ততঃ খালাদের সাথে ও সম্পর্ক নষ্ট করতে পারবে না। তাহলে এখন ঠিক কোথায় যাবে ও?
সূর্যের সোনালী আলোয় পৃথিবী উদ্ভাসিত। বেলা নটা হলেও, এখনো শীতটা সরেনি। কোয়েলিয়া গায়ের শালটা আরেকটু টেনে দেয়।এটা অফিস টাইম,তাই কলোনির নির্জন রাস্তাটাও এখন ব্যস্ত। দিনের আলোয় এত গাড়ি কিংবা বাইক চলাচলে ওর অস্বস্তি হচ্ছিল,যদিও গাড়ির ভেতরের কারোরই সময় এবং আগ্রহ নেই ফুটপাত ধরে হেঁটে যাওয়া মানবী টির দিকে তাকানোর।
কোয়েলিয়া এবার বেশ ভাবনায় পড়লো। রাগের মাথায় এভাবে বেরিয়ে আসাটা ঠিক হয়নি। বারবার ভাবা উচিত ছিল বর্তমানে আফসার শিকদারের বাড়ির ব্যতীত পৃথিবীতে আর কোথাও ওর জন্য নিরাপদ আশ্রয় নেই।একটি মাত্র জায়গা ছিল কিন্তু সেখানে ও কোনোমতেই যাবে না। নিজের এই বদমেজাজের জন্য ও বিরক্ত। আগে ওর ভেতরে এমন রাগ ছিল না, না ছিল এত আত্মসম্মানের ছড়াছড়ি। এখানে আসার পর থেকে স্বভাবটা প্রায় এদের মতো হতে চলেছে। কথা কম বলা,অযথা না হাসা, ইদানিং আরও একটা সমস্যা হলো কেউ বাঁকা কথা বললে ওর রাগ তরতর করে বাড়ছে, সেই সাথে কয়েকটা কথা না শোনাতে পারলে ভালো লাগে না। অথচও বিয়ের আগে দরিয়া বেগমের কটুকথা শুনতে শুনতে ও এগুলোকে স্বাভাবিক মনে করতো।
পেছনের গাড়ি থেকে অবিরাম হর্ণের আওয়াজে ওর ভাবনার সুতো কাটে।এতে ও বেশ ক্ষিপ্ত হয়ে কথা শোনানোর জন্য পেছন ফিরে কিছুটা এগিয়ে যায়, কিন্তু রাগটা আর দেখানো হয় না। গাড়িতে সরফরাজ ছিল, হেসে বলল,
‘উঠে আসুন। তারপর ভাববেন কোথায় গেলে সুবিধা হবে। ততক্ষন আমি ড্রাইভ করতে থাকবো।’
কোয়েলিয়া তাও নড়েনা।ও দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিল। সরফরাজ মেয়েটার মুখ দেখে বুঝলো।বললো,
‘এখনো আমাকে নিয়ে ভয় আছে?’
এ কথায় কাজ হয়। কোয়েলিয়া ওর পাশে বসলে সরফরাজ গাড়ি হাঁকায়। রাস্তার মোড়ে আসতেই,সরফরাজ লুকিং গ্লাসে দেখলো পেছন থেকে একটা গাড়ি দ্রুতবেগে এগিয়ে আসছে। অনিকের গাড়ি চিনতে ওর অসুবিধা হয়না।ও মৃদু হেসে ডান দিকে যায়,আজ তার ভাইটাকে এই মেয়েটা হয়রান করেই ছাড়বে। কিন্তু খারাপ কিছু না ঘটলেই ভালো।ও একবার পাশ ফিরে তাকাতে চাইলেও তাকায় না,এ নারী যে ওর জন্য নিষিদ্ধ। ভাইয়ের বৌকে কামনা করার মতো হীন মানসিকতার মানুষ ও না। কিন্তু এ মেয়েকে ওর ভালো লাগে,বড় ভালো লাগে, তাই বলে ও এই নারীকে চায়না। শুধুমাত্র বিকৃত মস্তিষ্কধারীরাই অন্যের ভালোবাসাকে কেড়ে নিতে চায়।
*
অনিক কিছুক্ষণ গাড়ি নিয়ে এদিক ওদিক ঘোরার পর হঠাৎ ওর মনে হলো,ও বোকার ন্যায় কাজ করে ফেলেছে। এভাবে কাওকে খোঁজ করা যায় নাকি!কিন্তু ওর অবাক লাগছিল, এতটুকু সময়ের ভেতর কিভাবে ও চোখের আড়াল হলো।ও গাড়ি ফেরালো।মণি ঠিকই বলেছে, আজকাল ওর উপস্থিত বুদ্ধি কমে গেছে।এত বিচক্ষণ একজন হয়েও এমন পরিস্থিতির জন্য অ্যালকোহলকেই দায়ী করা চলে। ইদানিং আরেক সমস্যা দেখা দিয়েছে,রোজ সকালেই ও বুকের বাম পাশটায় ব্যাথা অনুভব করে।আজ সকালেও ব্যাথাটা ছিল, তাইতো ওসময় সহজেই রাগটা বেড়েছিল।শরীর অসুস্থ থাকলে মন এমনিতেই বিক্ষিপ্ত থাকে।যদিও তখনকার গোঁ ধরে বসে থাকার জন্য এখন এতো চিন্তা করতে হচ্ছে। কিন্তু ও বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছে, যেভাবেই হোক সব ঠিক করে নেবে।মণির কথামতো পায়ে ধরবে, অবশ্য এটা ও পারবে কিনা এ নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তবে ভুলটা যেহেতু ওর ,তাই ও নত স্বীকার অবশ্যই করবে।ও বাড়ির দিকে গাড়ি ফেরালো। একবার শুধু ওকে হাতের কাছে পায়, সারাজীবনের মতো ঘরে আটকে রাখবে। কিন্তু তার আগে অভিমানিনীকে খুঁজে পেতে হবে।মানিনীর মানভঞ্জনের জন্য ও আজ নিজের কাঠিন্যের খোলস ছুড়ে ফেলে দেবে।আর কখনোই ও প্রেয়সীর ওপর রাগ করবে না, না আর কখনো মুখের ওপর কথা শোনাবে।এই সকালকে সাক্ষী রেখে ও প্রতিজ্ঞা করলো।
*
সরফরাজ শৌখিন মানুষ,তা ওর ড্রয়িং রুম দেখেই যে কেউ আন্দাজ করবে। ঘর সাজানো জিনিসের বাহুল্য নেই, না অযথা আসবাবের।সোফা পাতা, পাশেই বুকশেলফ, একটিমাত্র বৃহৎ আকৃতির ফুলদানি,তাতে কৃত্রিম বেগুনি রঙা ছোট ফুল আর সবুজ ঘাসের ন্যায়, দূর থেকে দেখলে জীবন্ত মনে হয়। কোয়েলিয়ার সবথেকে ভালো লাগলো,ক্রিস্টালের ফুলদানিতে জলে ভেজানো লাল, সাদা গোলাপী রঙা দু প্রজাতির তাজা ফুলগুলোকে, যদিও এগুলোর নাম ও জানে না। তবে এগুলো সম্ভবত গতকালকের।কেননা ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে পাপড়ির ওপর কয়েকটা কালো দাগ পড়েছে।
কোয়েলিয়ার সামনে একটা ম্যাগাজিন রাখা, ওপরে বাঁকা বাঁকা করে লেখা ‘সাহিত্য সমাবেশ’ ডিসেম্বর সংখ্যা।সরফরাজ ওর সময় কাটানোর উপায় হিসেবে এটা রেখেই কিচেনে ঢুকেছে। স্বাভাবিকভাবেই অন্যের বাসায় সময় কাটতে চায় না। কোয়েলিয়ার বেশ বিরক্ত লাগতে শুরু করলো। বিরক্তি লাঘবের চেষ্টা হিসেবে হাত বাড়িয়ে সাহিত্য সমাবেশটি নিলো।
সরফরাজের প্রতি যে ভয়টা পূর্বে ছিল, এখন আর নেই।সে রাতে ও যখন থানায় যাওয়ার জন্য সিএনজি নেওয়ার উদ্দেশ্যে মেইন রাস্তার দিকে যাচ্ছিল,তখন মাঝপথে সরফরাজের সাথে দেখা।ও তখন ওকেই আনতে যাচ্ছিল। রাস্তায় কোয়েলিয়া বিব্রত ছিল, সেদিনের কথাগুলোর নিগূঢ় অর্থ ও পরে ভালো করেই বুঝেছিল। তাইতো ওর পাশে থাকতে অস্বস্তি লাগছিল। নেমে যেতে ইচ্ছে হলেও, কোন উপায়ন্তর না পেয়ে ইচ্ছেকে চেপে রেখে ল্যাম্পপোস্টের হলদে আলো আর অন্ধকারে তৈরি আবছায়ার দিকে তাকিয়েছিল। বোধহয় সেটা বুঝতে পেরে সরফরাজ ওকে বলেছিল,
‘দেখুন আমি যদি সেদিন মনের কথাগুলো না বলে চেপে রাখতাম, তাহলে দিনদিন সেগুলো মনের ভেতরে দ্বন্দ্ব করে আপনার প্রতি আমার টান আরও বাড়িয়ে তুলতো। হয়তো তখন আপনি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে, আমার আচরণে বুঝে যেতেন।যেটার জন্য আমাদের ভেতরকার সম্পর্কগুলো খারাপ হতো।আপনি,অনিক,মামা আমাকে ভুল বুঝতেন। শেষমেশ বড়রকমের একটা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হতো,যেটা এতদিনের সম্পর্কের বন্ধন কে দূর্বল করে দিতো।ঠিক এজন্য আমার মনের কথা আপনাকে বলেছিলাম। আপনার থেকে দূরে থাকতে চাইনি, কারণ নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের আকর্ষন প্রবল। জানেন তো মানুষের মনের ঠিক নেই, কিছু একটা অঘটন ঘটলে সবকিছু ওলোটপালোট হয়ে যেত। সেদিন আমি বলেছিলাম বিধায় বুঝেছিলাম অনিক আপনাকে ভালোবাসে।আর ঠিক এই কারণেই আমি এখন স্বাভাবিক। নিজের আবেগকে প্রশ্রয় দেবার মতো বয়স আমার নেই, না অন্যের জিনিস কেড়ে নেবার বাসনা। ভালোবাসার মতো অনুভূতিকে আমি শ্রদ্ধা করি। আমি আমার ভাইয়ের ভালোবাসা কেড়ে নেবার মতো পাপ কখনোই করবো না।তাই আমার সামনে অস্বস্তি বোধ করার কিছু নেই। আমি নারীদের সম্মান করি।’
কোয়েলিয়া প্রত্যেকটি শব্দ মন দিয়ে শুনেছিল। তাইতো ও এখন সরফরাজের সাথে স্বাভাবিক। একসাথে বসে কথা বলার সময় ওর এখন আর অস্বস্তি আসে না। একারণেই সরফরাজের বলাতে ওর বাসায় এসেছে। কোয়েলিয়া সহিত্য সমাবেশের পাতা ওল্টাচ্ছিল কিন্তু পড়ার মতো মানসিকতা ওর নেই।ওর মাথায় ঘুরছিল,অনিক কি ওকে খুঁজবে?যদি ওকে নিতে আর না আসে, তখন কি করবে? পরক্ষণেই আবার নিজেকে বোঝাচ্ছে,সময় কখনও থেমে থাকে না । একটা না একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। এমন না যে ও পড়তে লিখতে জানে না।ধ্যাৎ ও এখন আর কিছু ভাববে না।সব নষ্টের মূল এই ম্যাগাজিনটা,এটা ধরার পর থেকেই আনকুড়ি মানকুড়ি ভাবনার উদয় হচ্ছে। সাহিত্য সমাবেশেটা একরকম টেবিলের ওপর ছুঁড়ে ফেলে ও মনোযোগ দিলো ফুলগুলোর ওপর।ওর ভালো লেগেছে শুভ্র রঙা ফুলটাকে ,যেটা দেখতে কিছুটা প্রজাপতির ন্যায়।ও আঙুল দিয়ে আলতো করে পাপড়ি ছুঁয়ে দিলো।
‘ফুল পছন্দ করেন?’
কোয়েলিয়া পাশ ফিরে সরফরাজকে দেখে চমকায় না। মৃদু হেসে বলে,
‘সঙ্গীত এবং ফুল নিষ্ঠুরেরাই পছন্দ করে না।কি নাম এই ফুলটার?’
‘এমারিলাস লিলি।আর পাশের ওগুলো জারবেরা।’
‘আপনি ফুলপ্রেমী! ছেলেদের এই দিকটা সচরাচর মেলে না।’
সরফরাজ হাসলো। তারপর বললো,
‘ঝটপট ফ্রেশ হয়ে আসুন।’
কোয়েলিয়া হাতমুখ ধুয়ে এসে টেবিলে সারাহ কে দেখলো।সারাহ উৎফুল্ল হয়ে,প্রশ্নের পর প্রশ্ন শুরু করে দিল। সরফরাজ হোয়াইট সস পাস্তা আর ফ্রুট কাস্টার্ড বানিয়েছে। কোয়েলিয়া অবাক হলো না, কলমাকান্দার শেষ রাতে ওরা রাকিব হোসেনের বাড়ির উঠোনে বসে সরফরাজের হাতের বুনো হাঁস ঝলসানো আর নান রুটি খেয়েছিল। এবং বলতেই হবে রান্না এবং খাবার ডেকোরেশনে সরফরাজ অনেক মেয়েকেও হার মানাবে।
ও বললো,
‘সকালের খাওয়া নিশ্চয়ই হয়নি। চুপচাপ বসে পড়ুন, আপত্তি চলবে না।’
এতক্ষণে ও ভুলেই গিয়েছিল, গতরাত থেকে কিছুই মুখে দেয়নি। সরফরাজের কথায় পেটের আকুতি বুঝতে পারলো।তাই আপত্তি করলো না।খেতে খেতে ওরা কথা বলছিল।
সারাহ বললো,
‘ভাইয়ার হাতের পাস্তাটা জোস। বাকিগুলো তো মুখেই দেওয়া যায় না।’
সরফরাজ কটমট করে তাকালো।সারাহ ভেঙচি কেটে বললো,
‘সত্যি বললে দোষ! মনে নেই বিফ খিচুড়ির কথা!’
‘ওটা তোর জন্য পুড়েছিল। তোকে বলেছিলাম,হিট কমিয়ে দিতে। না করে ফোন নিয়ে পড়েছিলি।ভাগ্যিস তাড়াতাড়ি এসেছিলাম, নয়তো একটা এক্সিডেন্ট ঘটে যেত। কাছে দাঁড়িয়েও পোড়া গন্ধ নাক অব্দি পৌঁছায় না।’
‘তখন আমার ঠান্ডা লেগেছিল।আর শোন,তোমার খিচুড়ি এমনিতেই ভালো ছিল না।’
‘তাহলে খেয়েছিলি কেন?তোকে তো জোর করিনি।’
‘তোমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য। তোমার যা স্বভাব,আপু তো শুধু শুধু ছিঁচকাদুনে বলে না।’
‘সারাহর বাচ্চা, এখন ভালো হবে না কিন্তু।’
‘প্রতিদিন এক কথা বলতে ভালো লাগে না।কান খুলে শোন, আমি সারাহ, আমার বাচ্চাকে তুমি মামু ডাকবে,বুঝেছ?’
ওদের ঝগড়া কোয়েলিয়া বেশ উপভোগ করে।তবে ও ওদেরকে থামালো। এতদিনের অভিজ্ঞতায় জানে,দুভাইবোন একবার তর্ক শুরু করলে আর থামার নয় নেয়না।তর্কযুদ্ধে কেউ কারো কাছে হার মানতে নারাজ।ভাইবোনের আচরণ টম জেরীর সাথে বেশ মেলে। সারাহ বেশিক্ষণ কথা না বলে থাকতে পারে না।ও বললো,
‘ভাবী,তুমি ফোন বন্ধ করে রেখেছ কেন?মা আমাকে বললো, তোমাকে কল করতে, কিন্তু তোমার ফোন তখন বন্ধ ছিল।’
‘তুই মা’কে বলেছিস, উনি এখানে!’
‘পাগল আমি!জানো,ভাইয়ার অবস্থা নাকি দেখার মতো।ভাবী আজ সেরকম একটা দৌড় করালো।মাঝেমাঝে এরকম টাইট দেওয়া ভালো।’
কোয়েলিয়া চামচ দিয়ে খাবার নাড়াচাড়া করতে করতে বললো,
‘আমি ইচ্ছে করে এসব করিনি। সবকিছু অসহ্য ধরে গিয়েছিল।’
‘ভাইয়া আসলেই একটু বেশি খসখসে হয়ে গেছে।এটা না করলে ও ঠিক হতো না।’
কোয়েলিয়া কপালে ভাঁজ ফেলে বললো,
‘খসখসে কি?’
‘মানে ভালো করে কথা বলতে পারে না।’
‘খসখসে না বলে খচ্চর বললে মানানসই হতো।’
সারাহ হেসে উঠলো। সরফরাজের আগেভাগেই খাওয়া শেষ করেছে। কোয়েলিয়ার খেতে ইচ্ছে হচ্ছিল না, কিন্তু এদিকে উদরে খাবার চাচ্ছে। ও খাবার মুখে নিতেই আবার ডোরবেল বাজলো। সরফরাজ হেসে বলল,
‘নিন, আমার বাসায় বেড়ানো শেষ।’
কোয়েলিয়া বিস্মিত হয়ে বললো,
‘উনি কিভাবে জানলো?’
ও সন্দিহান চোখে তাকালে,সারাহ বললো,
‘সত্যি বলছি আমি কিচ্ছু বলিনি।’
‘তাহলে এত তাড়াতাড়ি জানলো কিভাবে।’
‘অনুমান।’
সরফরাজের কথায় কোয়েলিয়ার খাওয়া ওখানেই পড়ে রইলো। এখন আসলে কি হতে চলেছে ওর জানা নেই।অনিক ভেতরে ঢুকলো। সরফরাজের ফ্লাটে কোয়েলিয়াকে দেখে ওর রাগ হলেও সেটা চেপে রাখলো। এখন রাগ করা মানে সবকিছু আরও জটিল করা। এমনিতেই কত কথা খরচ করতে হবে কে জানে?ও এগিয়ে এসে কোয়েলিয়ার পাশের চেয়ারে বসে বললো,
‘দ্রুত খাওয়া শেষ করো। খাবার নষ্ট করা আমার পছন্দ না।’
কোয়েলিয়ার বুকটা কেন জানি ঢিপঢিপ করছিল। এভাবে কি খাওয়া যায়!ও প্লেটটা সরিয়ে রাখলো।
‘কি হলো খাচ্ছো না কেন?’
‘আর খাবো না।’
অনিক ওর দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়। কোয়েলিয়া পানি খাওয়া হলে, গম্ভীর গলায় বললো,
‘চলো।’
কোয়েলিয়া তাও ওঠে না। লোকটা বললেই কি ও চলে যাবে! কখনোই না।সে তো আর ওর কাছে মদ ছাড়ার প্রতিজ্ঞা করেনি।যতক্ষণ কথা না দিচ্ছে ও নড়বে না।
অনিক বুঝলো কোয়েলিয়া এত সহজে যাবে না।ও হাত ধরে চেয়ার থেকে টেনে তুললো।হাতের বন্ধন এতটুকু শিথিল না করে, ওকে টানতে টানতে নিয়ে বেরিয়ে গেল। যাবার আগে পেছন ফিরে সরফরাজের দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।যার মানে দাঁড়ায়, তোকে পরে দেখে নেব।
*
কোয়েলিয়ার রেগে আছে।অল্প নয়, প্রচন্ড রেগে আছে,যার প্রতিফলন ওর বড় বড় নিঃশ্বাসে।অনিক রাস্তার একপাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ওর রাগ দেখছে।ওর বেশ ভালো লাগছে এই মেয়েকে দেখতে। কোয়েলিয়া এর মধ্যে বারকয়েক গাড়ির দরজা খোলার চেষ্টা করেছে,যদিও তা লক করা। অনিক ওর দিকে পানির বোতল এগিয়ে দিলে ও হাতের ধাক্কায় সরিয়ে দেয়। রাস্তাটা নির্জন, অনিক বাড়ির দিকে না গিয়ে উল্টো রাস্তা ধরে এখানে গাড়ি থামিয়েছে। দুএকটা যানবাহন মাঝেমাঝে হর্ণ বাজিয়ে চলে যাচ্ছে আর মাথার ওপর কা কা স্বর ব্যতীত তেমন কোলাহল নেই। কোয়েলিয়ার কপালের ওপরে কয়েকটা চুল লেপ্টে আছে।অনিক হাত দিয়ে সেগুলো সরিয়ে দিতে গেলে, কোয়েলিয়া ওর হাত সরিয়ে দেয়।অনিক রাগ করে না, হেসে বলে,
‘রাগ কি কমেছে?একটা ব্যাপার বুঝলাম না, শান্তশিষ্ট মেয়েটার ভেতরে এতো রাগ কিভাবে এলো!’
কোয়েলিয়া ক্ষিপ্ত হয়ে বলে,
‘আমাকে ওভাবে টেনে আনলেন কেন?লক খুলুন, আমি যাবো না আপনার সাথে।’
‘তাহলে কোথায় যেতে চাও?’
‘জানি না।’
‘একারণেই আজীবন আমার সাথে থাকতে হবে।চাইলেও থাকবে না চাইলেও।’
‘কক্ষনো না। আপনি বসে বসে মদ গিলবেন,আর আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেটা দেখবো?পারবো না। সিগারেটের গন্ধ ও সহ্য করতে পারবো না। আমার এসব ভালো লাগে না।’
অনিক কথার জবাব দেয়না।ও মনে মনে পরবর্তী কথাগুলো গুছিয়ে নেয়। সারাক্ষণ ভেবেছে কিভাবে ও প্রতিজ্ঞাটা করবে। কিন্তু এখন সবকিছু জড়িয়ে যাচ্ছে। তবুও সমস্ত জড়তা কাটিয়ে ও বলে,
‘আমি এসব খাওয়া ছেড়ে দেব। কিন্তু এগুলো একদিনের ব্যাপার নয়। অনেকটা সময় লাগবে ছাড়তে, হয়তো বছরখানেকের বেশি। ততদিন কি একটু অপেক্ষা করা যায় না?’
অনিকের আকুতি ভরা কন্ঠে কোয়েলিয়া কিছুটা কোমল হয়। এরপর বলে,
‘ছেড়ে দেবার কথা দিচ্ছেন তো?’
অনিক হুট করে ওর হাত দুটো ধরে। অনিকের করতলের উষ্ণতায় ওর মনজুড়ে কেমনতর অনুভূতি খেলে যায়।অনিক বলে,
‘আমি কথা দিচ্ছি। কিন্তু এজন্য অনেকটা সময়ের দরকার।দেবে তো সেটুকু সময়?’
কোয়েলিয়ার সব রাগ চলে যায়।বৈধ সম্পর্কের এই এক সমস্যা, বিপরীত মানুষটার প্রতি বেশিক্ষণ রাগ করে থাকা যায় না। একটু অনুরোধ,একটু পরাভাব সমস্ত রাগ ধুয়ে ফেলে।রাগ পড়ে গিয়ে ওর মুখ আনত হয়। মৃদুস্বরে বলে,
‘আপনি চেষ্টা করলে আমার ধৈর্য্য ধরতে আপত্তি নেই।’
অনিকের মন পুলকিত হয়ে উঠে। এতটুকু তেই অভিমানিনীর মন গলবে ভাবতে পারেনি। ভেবেছিল না জানি কত কি করতে হয়।অনিক নিজের খুশি প্রকাশ করতে, মুঠোবন্দী কোয়েলিয়ার হাতে গভীর চুম্বন করে। অনেকদিন পর নিজের জীবনকে ওর আকাশে ওড়া রঙিন ঘুড়ির ন্যায় মনে হলো। নিজের কাছে নিজেকে ও একবিংশ বয়সী যুবক হিসেবে আবিষ্কার করলো,যার কাছে প্রেম জিনিসটা স্বর্গীয় অনুভুতির ন্যায়,যার জন্য সে স্বেচ্ছায় জীবন দিতে পারে।ওর খুব ইচ্ছে করলো,সারা শহরজুড়ে প্রেয়সীর হাত ধরে হাঁটে। মনে কেমন অসাধ্য সাধনের জোর এলো। সবকিছু কতো সহজ আবার কঠিন।
অনিক কোয়েলিয়ার কপাল থেকে চুল সরিয়ে দিয়ে বললো,
‘আজ আমরা উদ্দেশ্যহীন ঘুরবো।’
‘সাফিয়া?ও তো মন খারাপ করবে।’
‘চিন্তা নেই, মণির সাথে ওর ভাব জমেছে। আজকের এই সময়টা শুধু আমাদের।’
চলবে…
®️ সুমি খানম
#ম্লান_সন্ধ্যায় (২৪)
একটি সুন্দর দিনের পূর্বাভাস পাওয়ার জন্য চোখ মেলে নিজেকে প্রিয় মানুষের বক্ষে আবিষ্কার করাটাই যথেষ্ট।এ এক অন্যরকম অনুভূতি,অন্যরকম পাওয়া। বিপরীত মানুষটার বুকে মাথা গুঁজে তার হৃদযন্ত্রের অবিরাম স্পন্দনের ছন্দ মনে যে আলোড়ন আনে,যে পরম ভালোলাগার তৈরি করে,তা পুরুষজাতটার বোঝার সাধ্যি নেই।কোয়েলিয়ার জীবনে অতঃপর এমন একটি রঙিন সকাল এলো,যদিও এখন বসন্ত নয়, শীতের রিক্ততা সবখানে।অবশ্য ভালোবাসা এবং প্রেমময় মূহুর্তের জন্য ঋতুর ওপর নির্ভরতা কি আদৌ দরকার আছে!পর্দা টানা ছিল না, জানালার ফাঁক গলে আসা আলোয়,চোখ মেলে সর্বপ্রথম ও অনিককে দেখতে পেল।ওর কাছে সবকিছু স্বপ্ন মনে হচ্ছে।সময় এভাবে এততাড়াতাড়ি বদলে যাবে ও কখনো ভাবেনি। বিয়ের প্রথমদিন যে মানুষটাকে দেখেছিল,আজ সে বদলে গেছে।এই প্রভাতে আঁখিজোড়া মেলে ও এক নতুন অনিককে দেখলো।
অনিক ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘুমুচ্ছে। গতকালকের ঝামেলায় দাড়ি কামানোর সুযোগ পায়নি, একদিনের ব্যবধানে ওর মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চুলগুলো কপালে এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে। কোয়েলিয়া মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল।হাতটা বাড়িয়ে অনিকের মুখটা আলতো করে ছুঁয়ে দিলো।অনিক জেগেই ছিল,ঘুমটা ওর অনেক আগেই ভেঙেছে। কিন্তু এমন উষ্ণ স্পর্শ ছেড়ে উঠতে ওর মোটেও ইচ্ছে নেই।কোয়েলিয়ার নরম হাতের ছোঁয়া ওর মনে শিহরণ জাগালেও চোখ খুললো না। অপেক্ষা করলো,প্রেয়সীর আরও পাগলামীর। ঘুমের ভান ধরে এমন খেলার মানুষ হতে ওর মোটেও আপত্তি নেই। কোয়েলিয়া ওর নাকে জোরে একটা টান মেরে দুহাতে গলাটা জড়িয়ে ধরলো।দীর্ঘ ঘুমের পর শরীর জুড়ে আলস্যের ছড়াছড়ি।অনিক সুযোগ বুঝে কোয়েলিয়ার কপালে গভীর উষ্ণতা ছড়িয়ে দেয়। কোয়েলিয়া চমকে মাথা উঁচু করে তাকাতেই, অনিকের হাসিছড়ানো মুখটা দেখে ভীষণ লজ্জা পেল।চটপট উঠতে গিয়েও বাঁধা পেলে, অগত্যা ওভাবে থাকতে হয়।
অনিক মৃদুস্বরে বললো,
‘ম্যাচিউর হয়েও এতো লজ্জা!’
কোয়েলিয়া ওর বুকে মুখ গুজে বললো,
‘আপনি ঘুমাননি?’
‘ঘুমের ঘোরেই তোমার সাথে কথা বলছি। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তোমাকে দেখছি।’
‘সোজাসুজি উত্তর দিতে খুব কি ক্ষতি হয়?’
‘যেমন প্রশ্ন তেমন উত্তর।’
‘ছাড়ুন। আপনার সাথে কথা বলাই উচিত নয়।’
‘যাও,আটকাচ্ছে কে?’
কোয়েলিয়া রাগ করে উঠে যেতে চায়, কিন্তু অনিক আরও শক্ত করে ওকে ধরে। কোয়েলিয়া কপট রাগ দেখায়,
‘যেতে বলে আটকাচ্ছেন কেন?’
‘আমি কোথায় বাঁধা দিলাম। তোমাকে তো আমার হাত-পা ধরে রেখেছে। ওদেরকে ছাড়তে বলো।’
কোয়েলিয়া অনিকের হাতে জোরে চিমটি কাটে। অনিক সামান্য ব্যাথা পেলেও ছাড়েনা।বরং ও কোয়েলিয়ার অধরযুগল আক্রমণ করে।আবেশে কোয়েলিয়ার চোখদুটো মুদে আসে, সেই সাথে একটা সুক্ষ ব্যাথাও অনুভব করে।ওর ঠোঁট কেটে গেছে।অনিকের মুখে বাঁকা হাসি, কোয়েলিয়ার নাক টেনে দিয়ে বলে,
‘প্রতিশোধ।’
‘আপনি অতি খারাপ একজন মানুষ।’
কোয়েলিয়ার কন্ঠে অভিমান লক্ষ্য করে অনিক হাসে, কোয়েলিয়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,
‘ভালোর সাথে ভালোরা থাকতে পারে না। তুমি ভালো,তাই আমার মতো খারাপকে পেয়েছ। এখন এই মন্দ মানুষটাকে ভালোবাসতে হবে, সারাজীবন এভাবেই থাকতে হবে।’
‘কিজন্য! আমার বয়েই গেছে, আপনার সাথে থাকতে।’
‘চলে যাওয়ার নাম করলে একেবারে মেরে ফেলবো।’
‘আমি আপনাকে ভয় পাইনা।’
‘সত্যি?’
কোয়েলিয়া উত্তর দিলো না।পরম আবেশে অনিকের গলা জড়িয়ে ধরলো।বাইরে আজ সূর্য না উঠলেও, আকাশের মন খারাপ থাকলেও,এই দুটি আজ এই মুহূর্তে সবচেয়ে সুখী।
*
লিমা বেগমের অবস্থা এবার বেশ গুরুতর।সাদ্দাম যে বরাবরের মতো এবার মিথ্যে বলেনি, ভদ্রমহিলা কে দেখে নাজমা বুঝলো।বয়স্ক হবার দরুন হাসপাতালে নেওয়া হয়নি, চব্বিশঘণ্টা খেয়াল রাখার জন্য একজন নার্স আনা হয়েছে। লিমা বেগম বাকশক্তি হারাননি।কথাবার্তা স্পষ্ট হলেও, আগের মতো একনাগাড়ে বলতে পারেন না, দুতিনটে শব্দ বলার পরই হাঁপিয়ে যাচ্ছেন। নাজমাকে দেখে লিমা বেগম বিলাপ আরম্ভ করেন। নানারকম কেচ্ছাকাহিনী শেষে ছোট ছেলের বৌ যে গরুর মাংস খাওয়া নিয়ে কথা শুনিয়েছে এও বলতে ভুললেন না।অবশ্য এমন কুমিরের কান্না নাজমার মনে বিন্দুমাত্র আঁচড় কাটতে পারলো না।ও বেশ বিরক্ত হয়ে বললো,
‘ছোট বৌ তো ভুল কিছু বলেনি।এই বয়সে আপনার বাছবিচার করে খাওয়া উচিত। এমনিতেই কয়েকদিন পর পর আপনার পেট খারাপ হয়। কি দরকার ছিল এমন গুরুপাক খাবার খাওয়ার।’
‘মনের কষ্ট যারে বলি, সেই এখন আমারে অপরাধী বানায় দিলো।’
লিমা বেগম ইনিয়েবিনিয়ে কাঁদতে শুরু করে।নার্স একবার বারণ করলেও কান দিলো না, বরং ধমক দিয়ে বলল,
‘একদম খবরদারি করবা না। কথা বলতে নিষেধ করার তুমি কে?’
মেয়েটা বেজায় চটে গেল। কয়েকদিন ধরে এনার ফ্যাচফ্যাচে কান্নায় মেয়েটা বিরক্ত।ও চড়চড়ে গলায় বলল,
‘আমার দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করতে না দিলে, আপনার বড় ছেলেকে বলে কিন্তু চলে যাব।’
লিমা বেগম আর কিছু বলতে পারে না। ছেলেরা ওনার এমন কান্নাকাটি ভালো চোখে দেখে না। বুড়ো হলে এই এক যন্ত্রণা ছেলেমেয়েরা ভয় পায়না বরং শাসন করে।তার ওপর এমন অসুখ বিসুখ জীবনের আনন্দ শুষে নিয়েছে।
নাজমার অসহ্য লাগছে।এই মহিলাকে দেখলেই ওর এমন হয়। কিছু কিছু মানুষ আছে,যাদের ওপর রাগ বিরক্তির জন্য কারণের প্রয়োজন হয়না,মুখদর্শনই তরতর করে রাগ বৃদ্ধির নিয়ামক।নাজমা কড়া গলায় বলল,
‘আপনি এখন থামবেন। এরকম নাকিকান্না কেঁদে আমাকে সবকিছু থেকে বঞ্চিত করেও আপনার সুখ হয়নি। কয়েকদিন পর পর আমাকে ডেকে এনে এসব বেহুদা কথা পাড়েন, ওদিকে দাদাভাই আমার সাথে রাগারাগী করে। আমি নিচু ঘরের মেয়ে বলেই এতকিছুর পরও আপনার খারাপ খবরে ছুটে আসি। কিন্তু এবার শেষবারের মতো বলে দিলাম,যেদিন আজরাঈল আসবে, সেদিন ডাকবেন।তার আগে যেন এবাড়ি থেকে কোন ফোনকল না যায়।’
লিমা বেগম দমে গেলেন। নাজমাকে মনে মনে তিনি খুব ভয় করেন। বহুবছর আগে দেখা নতমস্তকে মিনমিন করা নাজমা এখন নেই,সময় পরিস্থিতি ওকে বদলে দিয়েছে। কথাবার্তা সংক্ষিপ্ত,শির হয়েছে উঁচু, ছেলেমেয়ে ব্যতীত কারো সামনে হাসে না।বাইরের সবার কাছে তিনি দাম্ভিক, অহংকারী, আফসার শিকদারের যোগ্য বোন।
লিমা বেগম আচমকা দূর্বল হস্তে শিয়রের পাশে বসা নাজমার বাম হাতখানা চেপে ধরে। নাজমা বিচলিত হয় না,জানে এই বয়স্ক মহিলা এখন এমন কোন আবদার করবে যা ও রাখতে পারবে না। উপরন্তু ওর মুখ থেকে তিক্ত কথা শুনে চুপ মেরে থাকবে। লিমা বেগম আকুতি ভরা কন্ঠে বলে,
‘আমি অনেক অন্যায় করেছি,আমারে মাফ করে দেও।তোমারে যত্ম না করে অনেক খারাপ ব্যবহার করছি। তোমার জীবন নষ্ট..’
নাজমা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
‘যা বলার সোজাসাপ্টা বলুন। ভনিতা আমার পছন্দ না।’
লিমা বেগম ঢোক গেলে। মনে একটু সাহস সঞ্চয় করার চেষ্টা করে, কেননা এরপরের কথাগুলো শেষে উনি নাজমার রোষের শিকার হবেন। তবুও বললেন,
‘বৌ তোমার আর শফির তো তালাক হয়নাই। তুমি আবার এই সংসারে ফিরে আসো। আমরা সবাই তোমারে মাথায় করে রাখবো।আর কতদিন একলা থাকবা।’
নাজমা নিজের হাত সরিয়ে ফেললো। কঠোর স্বরে বলল,
‘থুতু ফেলে দিয়ে পুনরায় মুখে তুলে নেবার স্বভাব নাজমার নেই। দুধের শিশুগুলো আজ বড় হয়েছে, এখন আপনার ছেলেকে আমার দরকার নেই। আমি নাজমা,অন্যের ব্যবহার করা জিনিস ছুঁই না।’
‘পুরুষ মানুষ ওমন একটু আধটু করে।একটাই তো বিয়ে করেছে,তাও আমার শফিরে একা রেখে মিলি এখন ছেলেমেয়ে নিয়ে আলাদা থাকে। তুমি আসলে তো সমস্যা নেই।’
‘আপনার স্বভাব এখনও বদলায়নি।’
লিমা বেগম নরম সুরে বলে,
‘দেখো বৌ,আর কতকাল ভাইয়ের ঘাড়ে বসে থাকবা। তোমার ভাইয়ের ছেলের বৌ এসেছে, ওদের সংসারে অযথা থেকে কি হবে।’
‘শুনুন,লিমা বেগম। আমার নিজের যা অবশিষ্ট আছে,তা দিয়ে আমি অনায়াসেই জীবন কাটাতে পারবো।যখন আমার একজন সঙ্গীর প্রয়োজন ছিল, ছেলেমেয়েদের বাবার প্রয়োজন ছিল, তখন যদি একাই সব সামলে নিতে পেরেছি,তবে এই বয়সে এসে কেন আপনার ছেলের মতো ইতর একজনের সাথে থাকতে যাব। ভুল করার আগেই বোঝা উচিত ছিল, দাদাভাইয়ের অমত মানে কোনো না কারণ নিশ্চয়ই আছে। একটা জানোয়ারকে ভালোবেসে আমার দাদাভাইয়ের মনে যে আঘাত করেছিলাম,তা আজও তাড়া করে বেড়ায়।’
‘মুখে লাগাম টানো বৌ। তুমি শফিরে অপমান করছো।’
‘তাও তো কম বলি।একা পেয়ে আমাকে শারীরিক এবং মানসিক যে অত্যাচারগুলো করেছিলেন,সেসব আপনারা ভুললেও আমি ভুলিনি। আমার দাদাভাই কখনো আমাকে একটা চড় পর্যন্ত মারেননি, অথচো সেই আদুরে গায়ে আপনি গরম খুন্তি চেপে ধরেছিলেন।সে দাগের অংশবিশেষ কিন্তু এখন ও আছে।’
নাজমা ব্লাউজের হাতা উঠিয়ে একটা কাঁটা দাগ দেখিয়ে বললো,
‘মনে পড়ে এই দাগের কথা? টেবিলে খাবার দিতে দেরি করেছিলাম বিধায় ছুরিকাঘাত করেছিলেন।’
লিমা বেগম জবাব দিতে পারেন না। অতীতের ভুলগুলোর জন্য আজ শুধুই বুকভরা আফসোস।শফিটা ভালো নেই।হার্টের রোগী হয়েও একা ফ্লাটে কাটাতে হয়।মরে পচে গেলেই তবে মানুষ ওর মৃত্যুর কথা জানতে পারবে।এ যে পাপের শাস্তির সামান্য নমুনা।
পুরোনো স্মৃতি মনে পড়ায় নাজমার চোখমুখ কঠিন হয়।ও বলে,
‘আমি সব অত্যাচার সহ্য করে, এগুলোকে সংসার জীবনের অংশ হিসেবে মেনে নিয়েছিলাম।দাদাভাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে জানোয়ারটার ভবিষ্যতের ব্যবস্থা করেছিলাম। ভেবেছিলাম,এসব তো আমারই।যেই সবকিছু পেয়ে গেলেন, ওমনি আমার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেল।ছেলেকে ফুঁসলিয়ে পরকীয়ায় যেমন সাহায্য করেছিলেন, সেরকমই আবার বিয়ে দিন।মনে নেই কি বলেছিলেন, পুরুষ মানুষ অমন কাজ একটু আধটু করবেই। তারপর কোন উপায় না পেয়ে আমার চরিত্র নিয়ে কথা উঠালেন।কি লাভ হয়েছিল,সবার সামনে আমাকে নষ্টা উপাধি দিয়ে? আমার সম্মান তো সামান্যও কমেনি।আমার আপনজন আমাকে ত্যাগ করেনি।শেষ বয়সটা আমি সবার সাথে কাটাতে পারবো। কিন্তু আপনি এবং আপনার ছেলের সে সুযোগ নেই। সারাহ কে কিছু বলিনি মানে ও যে কখনো সত্যিটা জানবে না এমন নয়। তখন কি হবে ভাবতে পারছেন?কান খুলে শুনে রাখুন,আজকের পর আমাকে ডাকবেন না। আমার ভাইয়ের কাছে আমি কি,তা অনেক আগেই জেনেছেন। আপনার ছেলে শুধুমাত্র আমার কারণে পৃথিবীতে শ্বাস নিচ্ছে।বাধ্য করবেন না,এই বয়সে ও আমার আক্রোশের শিকার হয়ে সবকিছু হারাক।’
লিমা বেগম কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু দরজায় সারাহ কে দেখে একটি কথাও উচ্চারণ করতে পারলেন না। নাজমা যখন এবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়, তখন সারাহ আঠারো মাসের বাচ্চা। এতবছর ধরে ওর থেকে সবকিছু গোপন রাখা হয়েছে, ছেলের বৌয়েরাও ওকে সবটা বলতে সাহস পায়নি। যতটুকু বলেছে, ওনার কারণে সারাহ সেগুলো বিশ্বাস করেনি।সর্বক্ষণ চোখে চোখে রেখেছে, কেউ যাতে কান ভাঙাতে না পারে। কিন্তু আজ বোধহয় সব জানলো। শেষ বয়সে এসে সবকিছুর সাথে সাথে বুঝি প্রিয় নাতনীকেও হারাবে।
বাড়িভর্তি মানুষজনকে উপেক্ষা করে নাজমা বাইরে বের হলো।এ বাড়ির অনেককিছু বদলে গেলেও,আজও এখানে ঢুকলে পুরোনো ক্ষতগুলো তাজা হয়ে ওঠে।স্ত্রীকে ক্ষতবিক্ষত করতে আঘাতের প্রয়োজন নেই, পরকীয়াই যথেষ্ট।
নাজমা দ্রুতপায়ে বাইরে গেল। দাদাভাই আজকে আবার রাগ করবে। নাজমা আর হয়তো একটি দিন এবাড়িতে পা দেবে, কিন্তু ওটাই শেষ।ড্রাইভার বাইরে অপেক্ষা করছিল। লিমা বেগম সরফরাজকে দেখতে চেয়েছিল, কিন্তু এবাড়িতে পা রাখতে সে নারাজ।ও তো তাও মা’কে এখানে নিয়ে আসে, নাজমার মেজো সন্তান শ্রাবণী এদের নাম শুনলেই তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে।
গাড়িতে সারাহ কে দেখে নাজমা অবাক হয়।সারাহর মুখটা ভার, প্রচন্ড অভিমান নিয়ে বললো,
‘এতদিন কেন বললে না ,মা? আমি তোমাদের এতই পর।’
নাজমা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
‘দাদীর থেকে দূরে থেকো না। উনি তোমাকে ভালোবাসেন।যে কটা দিন পৃথিবীতে আছেন,সব ভুলে ওনার সাথে থেকো।’
‘তোমরা সবাই জানতে সবকিছু, তবে আমাকে কেন বলো নি।কাকিমনিরাও একটু একটু বললেও বিশ্বাস করিনি। কিন্তু আজ বুঝলাম ওনারাই সত্যি বলতেন। এতদিন ভাবতাম, তুমি স্বেচ্ছায় বাবাকে ত্যাগ করেছো।’
‘সত্যিই তাই। আমি স্বেচ্ছায় এসেছিলাম। কারণ সতীনের সাথে একসংসারে থাকার মানসিকতা আমার ছিল না । এখন আর ওসব কথা তোলার প্রয়োজন নেই। আমার বাচ্চাগুলো এখন কতো বড় হয়ে গেছে, এখন আমার ভাবনা কিসের।’
*
আজ সকাল থেকেই আকাশের মন ভালো নেই। বৃষ্টি হবার সম্ভাবনা রয়েছে। শীতের বৃষ্টি অনাহুত, তার আগমন মানেই হাড়কাঁপানো শীতের আবির্ভাব।কোয়েলিয়ার হাতে কোন কাজ নেই,তাই নিজের ঘরে বসেই অসমাপ্ত উপন্যাসখানা শেষের চেষ্টায় মনোনিবেশ করেছে।জানালার পাশে চেয়ার টেনে ও পড়ায় মগ্ন। বাইরে গুমোট ভাব, গাছের পাতা নড়ছে না, এমনকি পাখিগুলোর কোন সাড়াশব্দ নেই।ভরদুপুরে নির্জন বাড়িটা আরও নির্জন। সাফিয়া নাজমার সাথে ওনার ঘরে।দাদী নাতনি এরমধ্যেই বেশ ভাব জমিয়ে ফেলেছে। অবশ্য সকাল থেকে সাফিয়া কোয়েলিয়ার সাথেই ছিল।ওর হাতে খাবার খেতে খেতে কতো শত গল্প করেছে।মাঝে কয়েকবার মায়ের কাছে যাবার বায়নাও ধরেছে। কোয়েলিয়া মিছে সান্ত্বনা দিয়ে শিশুটির মন ভুলিয়ে রেখেছে। যতদিনে বিভা ছাড়া পাবে, ততদিনে সাফিয়া অনেকটা বড় হবে। তখন কি ও নিজের মা’কে ভুল বুঝবে? একজন জেলখাটা কয়েদি ভাববে? কোয়েলিয়ার কাছে এটাকে অপরাধ মনে হয় না। দিনের পর দিন মানসিক অশান্তিতে ভোগা একজন নারীর রাগের বশবর্তী হয়ে খু’ন করাটা একেবারে অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু সাফিয়া যখন সব বুঝতে পারবে, তখন যদি কোয়েলিয়া থাকে,সে ওর ভুলটা ভেঙে দেবে। একজন মায়ের শূন্যতা কিছুটা হলেও ও বোঝে।
ওর ভাবনার সুযোগ নিয়ে অনিক পেছন থেকে ওর খোলা চুলে টান মারলো। কোয়েলিয়া চমকে পেছনে তাকায়।বই পড়তে বসলে সবসময় ও গভীর ভাবনায় ডুবে যায়। একারণেই ও বরাবরই ক্লাসের মাঝারি ধরনের ছাত্রী ছিল। কোয়েলিয়া ওকে উপেক্ষা করে পুনরায় পড়ায় মনোনিবেশ করে। এহেন অবহেলা অনিকের সহ্য হয় না।ও কোয়েলিয়র হাত থেকে বইটা নিয়ে বিছানায় ছুড়ে ফেললো। কোয়েলিয়া ক্ষেপে যায়। উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
‘এটা কি করলেন?’
‘তুমি এখানে কি করছো?’
‘কেন?অন্য কোথাও থাকার কথা ছিল!’
‘তুমি এখানে থাকবে কেন? কোথাও দেখেছো হাসবেন্ড ওয়াইফ আলাদা থাকে!’
‘এতদিন তো ছিলাম।’
‘পূর্বের কথা ভিন্ন। এখন থেকে আর নয়। পরবর্তীতে আলাদা ঘরে থাকার চিন্তা করলে খুব খারাপ হবে।’
কোয়েলিয়া মুখ ফিরিয়ে বলে,
‘আপনি আমার সাথে কেমন আচরণ করেছিলেন মনে আছে। কিভাবে ভাবলেন আমি আপনার ঘরে যাব? আমি বেহায়া না বুঝেছেন।’
অনিক কিছু বললো না।এ মেয়ে ওর সাথে তর্ক না করে ছাড়বে না।ও কোয়েলিয়ার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল। সিঁড়ির কাছে গিয়ে কোয়েলিয়া হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,
‘আমি যাবো না। আপনি আমাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিলেন। আমি ভুলিনি সেসব।’
‘সেজন্য আর কতবার ক্ষমা চাইবো। এখন কি রোজ একবার করে ক্ষমা চাইতে হবে, তাহলে আমি আবার সরি।’
‘সরি বললেই কিছু হয় না।’
‘তাহলে কি করতে হবে?’
‘জানি না। আমি আপনার সাথে যাবো না।’
‘আচ্ছা!’
অনিক কোয়েলিয়াকে চমকে দিয়ে ওকে কোলে তুলে নেয়। কোয়েলিয়া নিজেকে ছাড়াতে ব্যস্ত হতেই,অনিক ওকে নিয়ে উপরে উঠতে শুরু করে।
‘আমাকে নামান। আপনার কষ্ট হয়ে যাবে। আমি হেঁটে যেতেই পারবো, নামিয়ে দিন।’
‘উহু, তোমাকে বিশ্বাস নেই।’
অনিক ওকে কক্ষে এনে তবেই নামায়। কোয়েলিয়া ওর থেকে সরে গিয়ে দাঁড়ালো। অনিকের টেবিলের ওপর অ্যালকোহলের বোতল দেখে তর্জনী উঁচিয়ে শাসায়।
‘আবার খেয়েছেন?’
‘মাত্র এক পেগ।’
‘আপনার সাথে কোনোমতেই থাকা যাবে না।’
‘বললাম তো সামান্যই খেয়েছি।’
‘দিনদুপুরে মদ খায় কোথায় দেখেছেন?’
অনিক এগিয়ে গিয়ে ওর কোমর আকড়ে নিজের সাথে মিশিয়ে বললো,
‘এত রাগ কেন?’
‘কেন?রাগ দেখানোর অধিকার শুধু আপনারই আছে?’
‘ভালো মানুষদের রাগ করা মানায় না।’
‘আমি খুব খারাপ। এতদিন ভালো সেজে ছিলাম, পরিস্থিতি আমাকে ধৈর্য্য ধরতে বাধ্য করেছিল।’
‘ঝগড়া করতে চাইছো, আপত্তি নেই।’
‘আমাকে ছাড়ুন।একটা কথাও রাখার প্রয়োজন মনে করেন না। আমি অসুন্দর এটাই কি আমার কথা অবহেলার কারণ!’
‘তোমার মুখে সাধারণ মেয়েদের মতো কথা মানায় না।’
‘আমি অসাধারণ নই।’
অনিক ওকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে পেছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরে।
‘সামনে তাকাও।’
কোয়েলিয়া সামনে তাকিয়ে দুজনের প্রতিবিম্ব ব্যতীত কিছুই খুঁজে পায় না।দর্পনে ওদের চোখাচোখি হয়।অনিক ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা।ও কোয়েলিয়ার কাঁধে হাত দুটো রেখে বলে,
‘আমরা একসাথে কতো সুন্দর,দেখো। সামনের ওই ভালো মেয়েটার সাথে খারাপ ছেলেটা। ভালো খারাপের পারফেক্ট কম্বিনেশন। পুরো পৃথিবীর কাছে তুমি সাধারণ হতে পারো, কিন্তু আমার চোখে তুমি অসাধারণ।’
‘শব্দমালা প্রয়োগে বশ করতে হবে না। এমনিতেই হার মেনেছি।’
‘জিতেছো তুমি। আমি খারাপ কিন্তু একেবারেও খারাপ নই।’
‘নিজের প্রশংসা করতে তবুও ছাড়বেন না। খারাপ মানুষ।’
অনিক কোয়েলিয়ার ঘাড়ে মুখ গুজে তপ্ত শ্বাস ফেলে বলে,
‘মন্দ বলেই ভালো একজনকে পেয়েছি।’
চলবে…
®️ সুমি খানম