যদি দেখার ইচ্ছে হয় পর্ব-১৮+১৯

0
249

#যদি_দেখার_ইচ্ছে_হয়
#আফসানা_মিমি
|পর্ব: আঠারো|

” আমরা মনে করি, আমরাই পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃখি মানুষ কিন্তু যখন অন্যজনের দুঃখের বর্ণনা শুনি তখন মনে হয়; আমরা তো তার থেকেও সুখে আছি। দেখো অন্তু, মনি মার দুঃখের সামনে তোমার দুঃখ কিছুই না।”

জীবনের কঠিন সত্যের মুখোমুখি অন্তিক আজ। মিষ্টির মনি তারই মা, রুনা। যিনি বিগত দুই যুগ ধরে পূন্যালয়ের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। অন্তিক মায়ের হাতে মাথা ঠেকে কাঁদছে। কত দিন, কত রাত মায়ের জন্য কেঁদেছে। মা মা বলে গলা শুকিয়ে ফেলেছে! কিন্তু মা আর ফিরে আসেনি। অন্তিক মায়ের হাতে চুমু এঁকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ” একাই চলে এসেছিলে কেন মা! তুমি কী একটা আবারও ভাবোনি, মা হারা ছেলের সাথে ছলচাতুরী মানুষেরা কীরকম আচরণ করতে পারে। তুমি এতোটা স্বার্থপর কীভাবে হতে পারলে,মা?”

রুনা মাথার ঘোমটা ঠিক করে ছেলের দিকে তাকায়। বিগত দুইদিন ছেলেকে মন ভরে দেখেছে সে। শক্ত কর্মঠ ছেলের অন্তরে এখনো নমনীয় ভাব বিদ্যমান। ছেলের মাথায় হাত রেখো প্রত্ত্যুত্তর দেয়,” জীবনটা বৃক্ষের ন্যায় দীর্ঘ হলেও যখন ক্ষত সৃষ্টি হয়! তখন আপনজনের শান্তির জন্য নিজেকে কোরবানি দিতে হয়।”

” মনি মা, এখানে এসেও ভালো ছিল না অন্তু। এমন কোনদিন নেই যে তোমার কথা মনে করে পাগলামি করে নাই। আমি যখন মনি মার কাছে আসি তখন আমার মাঝেই তোমাকে খুঁজে বেড়াতো, মনি মা। তোমার শত হাজার গল্প শুনতে ভালো লাগতো, অন্তু। দাদা তোমার যুবক বয়সী একটা ছবি দাদীর কাছে চিঠির সাথে পাঠিয়েছিল। আমি চুপি চুপি ছবিখানা দেখে তোমাকে ভালোবেসে ফেলি। দাদাকে যখন দাদী আমার ব্যাপারে জানায়, দাদা অপেক্ষা করেনি। এক সপ্তাহের মধ্যেই আমাকে তোমার সাথে বিয়ের ব্যবস্থা করে।”

অন্তিক অবাক দৃষ্টিতে মিষ্টির দিকে তাকায়। সে মনে মনে ভাবে, মিষ্টি কী জেনে বুঝেই অন্তিককে বিয়ে করেছে! কই অন্তিক ঘুনাক্ষরে টের পায়নি। অন্তিক নিজের মনকে প্রশ্ন করে, মিষ্টি তাকে বলেনি নাকি সে জানতে চায়নি। মিষ্টির উপর অন্তিকের অভিমান হয়। সে সব জানা স্বত্ত্বেও অন্তিককে কিছু বলেনি বলে। অন্তিক গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,” তুমি সব জানতে, মিষ্টি?”
” অল্প অল্প জানি। যতটুকু জানি সব তোমায় ঘিরেই।”

অন্তিক কিছু বলে না। কিন্তু সে মোল্লা বাড়ি থেকে মায়ের চলে আসার পিছনের মূল কারণ শুনতে আগ্রহী। রুনা বুঝতে পারে বিষয়টা। গভীর নিশ্বাস ত্যাগ করে অতীতের কালো দিনগুলোর কথা বলতে থাকে।
বিদারক দিনগুলোর বর্ণনাদাতা সহ আরো দুজন মানুষের চোখ বেয়ে অশ্রু ঝড়ছে। অন্তিক মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। মায়ের মাথায় হাত রেখে বলে,” তোমার সাথে হওয়া অন্যায়ের এক একটা হিসাব দিতে হবে তাদের। তোমার গা ছুঁয়ে বলছি মা, আমি সবাইকে দেখে নিব।”
————————–

বাবার ভিটায় পা রেখেছে রুনা। সাথেই তার সন্তান ও সন্তানের স্ত্রী। মিষ্টিদের বাড়ি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরেই রুনার বাবার বাসা। মাসে একবার রুনা এখানে এসে ঘর বাড়ি পরিষ্কার করে যেত। অন্তিক ভাড়া বাড়িতে উঠতে চেয়েছিল কিন্তু সেই রাজি হয়নি। বাবার ভিটা এমনিতেই পড়ে আছে। এরমাঝে মিষ্টি অন্তঃসত্ত্বা। রুনা মিষ্টিকে নিয়ে কোনো রিক্স নিতে চায় না। তাই ছেলে বউকে নিয়ে বাবার বাড়ি উঠেন। পুরোনো বাড়িটা মিষ্টির বেশ পছন্দ হয় সে অন্তিকের হাত জড়িয়ে ধরে বলে,” বাড়িটা সুন্দর না, অন্তু?”

অন্তিক টু কথাও বলেনি সে মিষ্টির হাত ঝাড়া দিয়ে ফেলে হনহন করে ঘরে চলে যায়। মিষ্টি অবাক নয়নে স্বামীর চলে যাওয়া দেখে রুনাকে প্রশ্ন করে,” তোমার ছেলের মতিগতি আমি কিছুই বুঝিনা, মনি মা। বাহিরের জগতে সে নুন ছাড়া ভাত কিন্তু আমার সামবপ আসলেই লঙ্কা সহ ভাত। যার সকল ঝাল আমার উপরই খাটায়।”

রুনা হাসেন। মিষ্টিকে তার চেনা আছে। অন্তিক রাগ করেছ তিনি জানেন মিষ্টি তার ছেলের রাগ ঠিকই ভেঙে ফেলবে।

রাতের খাবারের পরে মিষ্টির শরীর খারাপ লাগছিল। ঘরে এসেই সে বিছানায় শুইয়ে পড়ে। নড়াচড়া করার শক্তিটুকুও অবশিষ্ট নেই। অন্তিকও এরমধ্যেই বাসায় ফিরে আসে। সে মিষ্টিকে দেখেও না দেখার ভান করে ফ্রেশ হতে চলে যায়। চোখ বন্ধ অবস্থায় মিষ্টি সব কিছু উপলব্ধি করতে পারছে। দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে মিষ্টি তাকায়। অন্তিক গোসল সেরে বের হয়েছে। গা মুছে মিষ্টিকে দেখিয়ে সে তোয়াল চেয়ারের উপর শব্দ করে ফেলে ধপাধপ পায়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। অন্তিকের কাণ্ড দেখে মিষ্টি অন্তিককে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে, ” ইশ, ঢং দেখে বাচি না!”

অন্তিক ঘরে থেকে বের হয়ে এই নিয়ে পাঁচবার পিছনে ফিরে তাকিয়েছে। উদ্দেশ্য মিষ্টি তার পিছু আসছে কী না তা দেখার। মিষ্টির আগমনের কোনো লক্ষ্মণ না পেয়ে অন্তিক ভাবুকের স্বরে বলে, ” আশ্চর্য! আমি এতো করে মিষ্টিকে বুঝাতে চাইছি যে, আমি রাগ করেছি। সে কী বুঝতে পারছে না! নাকি বুঝেও বুঝছে না।”

অন্তিক নিজেকে পুনরায় প্রশ্ন করে,” মিষ্টি কী আমাকে ভুল বুঝে নিয়েছে? ”

অন্তিক ফট করে ঘুরে নিজেদের ঘরের দিকে এগোয়! তাড়াহুড়োয় শার্টের হাতা লোহার সাথে বেজে ছিঁড়েও ফেলে। কিন্তু ঘরে প্রবেশ করতেই তার চক্ষু চড়কগাছ! মিষ্টি খুব আরামে ঘুমাচ্ছে। অন্তিক মাথা চুলকে মুচকি হেসে বলে,” আমাকে চিন্তায় রেখে মহারাণী কী সুন্দর ঘুমাচ্ছে।”

এক পা দুই পা ফেলে মিষ্টির কাছে এগিয়ে আসে অন্তিক। মাথা নীচু করে মিষ্টির গালে ও ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁয়ে দেয় সে। গলার কাছটায় ছোট ছোট চুমু এঁকে হতাশার সুরে বলে,” আমার অভিমান কী ধরতে পেরেছো, চন্দ্রিমা!”
মিষ্টি ঘুমের ঘরে উত্তর না দিলেও অন্তুকের গলা জড়িয়ে পাশ ফিরে শোয়। অন্তিক তা দেখে মুচকি হাসে। মিষ্টির হাত ছাড়িয়ে দরজা আটকে নেয় সে। এরপর মিষ্টির পাশে শুয়ে তাকে বুকের সাথে মিশিয়ে নেয় সে। মাথায় চুমু এঁকে বলে,” এবার তোমার সাথে লুকোচুরি খেলব,চন্দ্রিমা! সজাগকালে তোমাকে ছুঁয়ে দিতে না পারলেও তোমার ঘুৃমানের ফায়দা নিব, মিষ্টি রাণী! তুমি হয়তো জানো না, তোমার ঠোঁটের স্বাদ অমৃতের চেয়েও সুস্বাদু। এই স্বাদ আমার প্রতিদিন, প্রতি ঘণ্টা, প্রতি মিনিট, প্রতি সেকেন্ড প্রয়োজন।”

মিষ্টিকে উন্মুক্ত বুকের সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে ভবিষ্যতের ব্যপারে ভাবতে শুরু করে, অন্তিক।
——————————–

সকাল থেকেই বমি করছে মিষ্টি। অন্তিক গিয়েছিল বাজার করতে। বাড়ি ফিরে মিষ্টির আেহাল দশা দেখে বিচলিত হয়ে পড়ে। রুনা ছেলেকে আশ্বাস দেন, এই সময়ে এমন হয়ই কিন্তু অন্তিক নাছোড় বান্দা মিষ্টির অসুস্থতায় পাগল হয়ে রওনা হয় হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।
হাসপাতালে গাইনী বিশেষজ্ঞ মরিয়ম জানায়, ” সব ঠিকঠাক আছে। বেশি করে পানি খেতে। ডাক্তার দেখানো শেষে বউ শাশুড়ি কেবিন থেকে বের হয়ে আসে। অন্তিক তখন বাহিরে ছিল। মা ও স্ত্রীকে ফিরতে দেখে বলে,” সব ঠিকঠাক আছে তো মা!”
” উফ তুমি অযথা চিন্তা করছো, অন্তু। আমি ও বাবু ঠিক আছি।”
অন্তিক বাঁকা চোখে তাকিয়ে নজর অন্যত্র সাথে সাথেই ঘুরিয়ে নেয়। অদূরে দোকান দেখিয়ে বলে,” আমার সন্তান যেন সুস্থ থাকে বলে দিলাম। যা যা প্রয়োজন সব এনে দিব। স্ত্রীর কোনো কষ্ট পেতে দিব না। তোমরা ঐ চেয়ারটায় বসো। আমি ঔষধ নিয়ে আসছি।”

অন্তিক চলে যেতে নিলে মিষ্টি পথ আটকায়।
” এখানে কেউ তোমার বা আমার পূর্ব পরিচিত নয়। একটা টেস্ট করিয়ে নিলে হয় না!”

” মিষ্টি ঠিক বলেছে। এখন তুই বাহ্যিক দিক থেকে মেনে নওতে পারছিস ঠিকই কিন্তু কোনো একদিন যদি মিষ্টিকে ভুল বুঝে ছেড়ে যাস তখন এই মেয়ের কী হবে?”

মায়ের কথায় অন্তিক মাথা তুলে তাকায়। তার চোখ জোড়া লাল বর্ণ ধারণ করেছে। সে দাঁতে দাঁত চেপে ধরে বলে,” আমার জীবন থাকতে মিষ্টিকে ছেড়ে দিবও না আর কোথাও যেতেও দিব না।”

অন্তিক ব্যস্ত পায়ে হাসপাতালের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। আজ কী হবে সে জানে না কিন্তু নিজের জন্য হলেও ডাক্তার দেখাবে।

রিপোর্ট এসেছে বিকাল চারটায়। অন্তিক না দেখেই বাড়ি ফিরে বসে। মিষ্টি তখন বরইয়ের আচার খাচ্ছিল। অন্তিকের আগমনে সে নড়েচড়ে বসে। হাতের আচার একপাশে রেখে বলে, ” এই অবেলায় কীসের রিপোর্ট নিয়ে এলে?”

অন্তিক নিঃশব্দে রিপোর্টখানা মিষ্টির হাতে দেয়। আজ তার মধ্যে রিপোর্ট দেখার কোনো শক্তি অবশিষ্ট নেই। সে অন্যপ্রান্তে ফিরে অপেক্ষা করতে থাকে। এমতাবস্থায় মিষ্টি রিপোর্ট পড়ে আর্তচিৎকার করে ওঠে বলে,” এটা কীভাবে সম্ভব, অন্তু?”

চলবে…………

#যদি_দেখার_ইচ্ছে_হয়
#আফসানা_মিমি
|পর্ব: ঊনিশ|

নীল গগনতলে কালো মেঘের আগমনে যেমন পুরো পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যায় অন্তিকের মুখশ্রীতে তেমন আঁধার নেমে এসেছে। রক্তিম চোখজোড়া রিপোর্টের উপর নিবদ্ধ। শরীর থরথর করে কাঁপছে। মিষ্টি অন্তিকের কাঁধে হাত রাখো। ভরসার হাত। অন্তিকের মাও এসে উপস্থিত হয়েছেন তিনার মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি।

” নিজ কার্য হাসিল করার জন্য এরা এরচেয়েও নীচে নেমেছিল পূর্বে।”

অন্তিক রিপোর্ট শক্ত করে ধরে বলতে শুরু করে, “সবাইকেই কর্মফল ভোগ করতেই হবে। কেউ শান্তি পাবে না, আমি কাউকে ছাড়বো না।”

মিষ্টির ভয় হচ্ছে। সে অন্তিকের উদ্দেশ্যে বলে, ” রিপোর্ট নরমাল। তোমার কোনো সমস্যা নেই। তাছাড়া আমরাও চলে এসেছি, সুখে আছি। বলছিলাম কি,,,,,

” কি বলবে, তাদের ছেড়ে দিব? কেন ছেড়ে দিব, বলো! আমাকে সারাজীবন মিথ্যার উপরে রেখেছে, তোমাকে বিয়ে করার পর অপরাধবোধ কুঁড়ে কুঁড়ে আমাকে খেয়েছে। দিনে দিনে ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছিলাম। কতোবার নিজের অক্ষমতার জন্য আত্মহত্যা করতে চেয়েছি হিসাব নেই। আর তুমি বলছো আমি তাদের ছেড়ে দিব?”

” আমি তো বলছিলাম,,,,,,

” তোমাকে কিছুই বলতে হবে না। তুমিই না তাদের সামনে বাঘিনী রূপে নিজেকে দাঁড় করিয়েছিলে, আজ কী হলো!নাকি ভেবে নিব, তুমি করলেই সব ঠিক আর আমি করলেই বেঠিক।”

ছলছল চোখে মিষ্টি অন্তিককে দেখছে। মানুষ রাগের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। সঠিক ভুল অনুধাবন করার শক্তি হারিয়ে ফেলে। অন্তিকের রক্তিম চাহনি মিষ্টি সহ্য করতে পারছে না। সে অশ্রুসিক্ত নয়নে কাঁপা স্বরে বলে, ” ডাক্তার বলেছে তিন থেকে চার মাস জার্নি না করতে। আমি বলতে চেয়েছিলাম, মনি মার সাথে অন্যায়ের যথাযথ প্রমাণ যোগার করে তারপর আমরা ফিরে যাই! তুমি আমার পুরো কথা শুনলে না অন্তু! আমি একজন মেয়ে! আমার মন আছে, সবসময় বুকে পাথর চেপে লড়াই করার শক্তি থাকে না। অবশ্য তুমি বুঝবে না, কারণ আমি তোমাকে মনে প্রাণে চেয়েছি। আমারই ভুল, তোমাকে জোর করে ভালোবাসতে বাধ্য করেছি।”

মিষ্টি এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করে না। চোখের পানি মুছতে মুছতে নিজের ঘরের দিকে দৌড়ে চলে যায়। রুনা ছেলের দিকে এগিয়ে আসেন। অদূরে কাঁঠাল গাছে চড়ুই ছানার চি চি শব্দ ভেসে আসছে। তিনি সেদিকে আঙুল উঁচিয়ে দেখিয়ে বলেন, ” ঐ বাচ্চাদের দেখো! পেটের ক্ষুধায় চিৎকার করছে কিন্তু নিজে খাবার জোগাড় করতে পারছে না। মা পাখি বা বাবা পাখি নিশ্চয়ই খাবারের সন্ধানে নেমেছে! মা পাখি একাই কিন্তু খাবার খোঁজছে না বাবা পাখিটা অবশ্যই সাহায্য করছে। তোমাকে রেখে আসার কারণ তো বলেছিই, তুমি তখন ছোট ছিলে কিন্তু তোমার বাবা তো ছিলেন! তিনি আমি থাকতে যেমন পরিবারের প্রতি উদাসীন ছিলেন আমি চলে আসার পরও ছিলেন। নয়তো জল জ্যান্ত মানুষ জীবিত থাকার পরও কীভাবে তার সন্তানের সাথে অন্যায় হতে থাকে! সে পারতো না, সন্তানের মুখে দু বেলা ভাত তুলে দিতে! আমি মনে করি, আমাদের মা ছেলের জীবন তছনছের পেছনে তোমার বাবা দায়ী। আমাদের সাথে যা হওয়ার হয়েছে, আমরা সময়টাকে আর ফেরাতে পারব না। কিন্তু তুমিও কী তোমার স্ত্রী, সন্তানের প্রতি উদাসীন থাকবে? জীবন থেকে শিক্ষা নাও, অন্তু! মেয়েটা ভুল বলেনি। মিষ্টি তোমার জন্যই নিজের জীবন পরওয়া না করে অন্ধকার থেকে আলোতে ফিরিয়ে আনতে মোল্লা বাড়িতে পা ফেলেছে।”

অন্তিক খুবই মনোযোগ সহকারে মায়ের কথা শুনে। মিষ্টির সাথে এভাবে কথা বলা তার মোটেও ঠিক হয়নি। ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে বেশ সময় নিয়েছে অন্তু। সে মাথা নীচু করে রুনার উদ্দেশ্যে বলে, ” আমি ক্ষমা চেয়ে নিব, কিন্তু মিষ্টিও শাস্তি পাবে মা, আমার থেকে তোমার কথা লুকানোর জন্য শাস্তি পেতেই হবে।”

অন্তিক প্রস্থান নেয়। রুনা অবাক হয়ে তাকিয়ে রয় ছেলের যাওয়ার দিকে। বিড়বিড় করে বলে, ” এই ছেলেকে কী আমিই পেটে ধরেছি? আমি তো এতো ত্যাড়া নই, তাহলে ও কার মতো হয়েছে?”

মিষ্টি চুপচাপ বিছানায় বসে আছে। সে কাঁদছে না। পেটে হাত রেখে অনাগত বাচ্চার নিকট অভিযোগ করছে,
” দেখলি তো! তোর বাবার শয়তানি? আমাকে কষ্ট দিতে এক পা আগায় পিছায়ও না। সবসময় আমাকে কষ্ট দেয়। কথা বলবো না বুঝলি! এজন্যই ছেলেদের উপর দিয়ে ভালোবাসা দেখাতে নেই। এরা মাথায় চড়ে বসে।মনে করে, মেয়েরা তো তাদের ভালোবাসেই! কখনো ছেড়ে যাবে না। কিন্তু তারা তো জানে না, মেয়েরা যেমন ভালোবাসতে জানে তেমন কষ্ট দিতেও জানে।”

অন্তিক দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মিষ্টির সবগুলো কথা শুনে মুচকি হাসে। মনে মনে আফসোস করে, কীভাবে সে মিষ্টিকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছে! মেয়েরা কী এমনই হয়! স্বামীরা যতোই কষ্ট দিক না কেন, ধৈর্য্য সহকারে শ্বশুর বাড়িতেই পড়ে থাকে। স্বামী নামক পুরুষ দেখেও দেখে না। অন্তিকের নিজের উপর রাগ হচ্ছে,সে তো সেই সকল কাঙ্গাল পুরুষদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে যারা বউ বাচ্চার প্রতি উদাসীন থাকে। অন্তিক চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এতো সহজোই সে ভেঙে পড়বে না। মাথা ঠান্ডা করে তার সব করতে হবে। শব্দহীন পদচারণে অন্তিক ঘরে প্রবেশ করে। মিষ্টি আড়চোখে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ে। সে আজ কোনোভাবেই অন্তিককে দেখবে না। কেননা অন্তিককে দেখামাত্রই মিষ্টির রাগ ভেঙে যাবে। অন্তিক টেবিলের উপর খাতা কলম নিয়ে লেখতে বসে। মিষ্টির দিকে তার মনোযোগ নেই যেন! অনেক সময় ধরে কিছু আঁকিবুঁকি করে খাতা রেখেই ঘর থেকে বের হয়ে যায়।
অন্তিক সচারাচর বাড়িতে থাকলে মিষ্টির আশেপাশেই ঘুরঘুর করে। বই খাতার সাথে যোগাযোগ রাখেই না। মিষ্টির কাছে না এসে খাতায় কী এমন দরকারী কথা লেখেছে সে! কথায় আছে, কৌতূহল দমিয়ে রাখতে নেই, মিষ্টি পা টিপে টিপে খাতাখানা হাতে নেয়। প্রথম লাইনে চন্দ্রিমা লেখা দেখে ভ্রু যুগল কুঁচকে পড়তে শুরু করে,

চন্দ্রিমা,
আমার প্রাণেশ্বরী। আমার সাহসী বাঘিনী। তোমার বাঘিনী রূপটাকে আমি যেমন খুব পছন্দ করি দুর্বল দিকটা তেমন ঘৃণা করি। মেয়ে হয়েছো বলেই যে মাঝে মাঝে দুর্বলতা প্রকাশ করাতে হবে, এটা কোথায় লেখা আছে? আজ তোমার চোখে সহসের বদলে ভয় দেখে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। তার জন্য ক্ষমা চাইছি, চন্দ্রিমা! কিন্তু তোমাকে আমি ক্ষমা করব না। আমার সাথে কাটানো প্রতিটা দিনের হিসাব করে শাস্তি দিব তোমাকে। ভাবছো কীসের শাস্তি? বলছি, আমাকে এতোদিন ধোঁকায় রাখার শাস্তি,মায়ের ব্যাপারে না জানানোর শাস্তি, আমার থেকে আমাকে বেশি ভালবাসার শাস্তি। এবার তোমাকে শাস্তিটাও বলে দিচ্ছি বউ! আমি তোমার সাথে থেকেও তোমার সাথে থাকব না। বুঝলে না তো! তৈরি হও! আমি এসে বুঝাচ্ছি। আমার মিষ্টি অত্যাচারের জন্য তৈরি হও বউ! তোমার রসালো ঠোঁটের স্বাদ পরখ করার মতো মহৎ কাজটা তো আর বাদ দিতে পারি না! এবার ডাবল সময় নিব। শাস্তিটা সুইট না! ঠিক তোমার মতো। অপেক্ষার সময় খুবই কঠিন। আমি আসছি ভিটামিন-এ নেওয়ার জন্য, তুমি তৈরি তো!”

লেখাগুলো পড়ে মিষ্টি শুকনো ঢোক গিলে। পিছনে তাকাতেই দেখতে পায়, অন্তিক ভিলেন হাসি দিয়ে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। মিষ্টি পিছনে পেছাতে পেছাতে বলে, ” আমি খুব রাগ করেছি, অন্তু! আমি আগের মতো নেই। যেচে ভালোবাসা অনেক নিয়েছি, আর নয়। আত্মসম্মানবোধ নামক কিছু আছে নাকি! ঘর থেকে বের হয়ে যাও, অন্তু! ভিটামিন-এ, বি, সি,ডি কিছুই পাবে না বলে দিলাম।”

মিষ্টির কথা অন্তিক শুনেও না শোনার ভান ধরে এগোতে থাকে। মিষ্টি তা দেখে বলতে থাকে, ” ছেড়ে দে শয়তান! তুই আমাকে পাবি কিন্তু মন পাবি না!”

————————–

” কী রে রুস্তম! ব্যবসা কেমন চলছে? বর্ডারে মা’ল পাঠাতে কোনো সমস্যা হয়নাই তো? আমি কিন্তু কালুর কাছে তোর পুরুষ্কার পাঠিয়ে দিছি।”

” আমারে কবে ফেরত আনবেন, উস্তাদ! মেলা বছর তো এইদিকে থাকলাম, বউডারে দেহি না কত বছর ধইরা! আমনে কইছেন হেয় ভালা আছে। আমারে ছাইড়া যায় নাই। বউডার লাইগা আইজকাইল বুকটা পুড়তাছে। এইবার মা’ল চালান হইলে কিন্তু আমি কালুরে রাইখা ফেরত আইমু।”

” তোর বউ ভালাই আছে রে, রুস্তম! আমি দিনে তিন বেলা নিজে গিয়া দেইখা আসি, তোর বউরে।”

কথাগুলো বলে অজ্ঞাত লোকটি কোমড় থেকে গামছা খুলে মুখশ্রীতে লেগে থাকা ঘাম মুছতে মুছতে সহকারী রুস্তমকে মুঠোফোনে কথাগুলো বলে বিশ্রী হাসি দেয়। তার সামনেই বুকে এক টুকরো চাদর জড়িয়ে একজন মহিলা সিগারেটের ধোঁয়া আকাশে উড়িয়ে দিচ্ছে। তার মুখেও হাসি। অজ্ঞাত লোকটা মহিলার বুকের নরম অংশে হাত চেপে বলে, ” আইতে চাইলে আয়! কিন্তু তোর বউয়ের তো মেলা আবদার! পূরণ করতে পারবি তো? সোনার বালা কেনার টাকা জমাইছোস তো!”

রুস্তম টাকার পুঁটলি হাতে নিয়ে দেখে আরো পঞ্চাশ হাজার কম আছে। সে পুনরায় ফোনে বলে, ” এইবার মা’ল ডাবল চালান করমু উস্তাদ, পঞ্চাশ হাজার টেহা রেডি করো!”

ফোন কে’টে অজ্ঞাত লোকটি মহিলার উদ্দেশ্যে বলে, ” তোর না’গ’র তো তাড়ায় আছে। তা সেখানে যাইবি নাকি রে, মা”””’গি!”

মহিলা সিগারেট অজ্ঞাত লোকটার হাতে সঁপে দিয়ে প্রত্ত্যুত্তরে বলে, ” যাইয়া কি করমু! ঐ হালার ইঞ্জিন এতোদিনে নষ্ট হয়ে গেছে। তোমার লগে থাকবার পারি, টেহা পাই, খাওন পাই আর কী লাগে!”

অজ্ঞাত লোকটি পুনরায় বিশ্রী হেসে মহিলাকে বিছানায় ফেলে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বুকের চাদর মাটিতে ফেলে বুকের নরম অংশে কামড় বসিয়ে বলে, ” মাথা নষ্ট করিস না! মা”””গি তোর এতো তেজ? দেখি, আমারে খুশি করে দেখা তো!”

” তোমারে খুশি করান লাইগা সব করতে রাজি আছি। একটা কথা কও তো! বউ ঘরে আছে,বাইরে হাজার মৌমাছির গতরে এতো স্বাদ পাইয়াও মন কেন ভরে না?”

অজ্ঞাত লোকটি কথাটা শুনে মহিলার গলায় চেপে ধরে বলে, ” মুখের সামনে খাওন পাইয়াও খাইতে না পারার যন্ত্রণা তুই কী বুঝবি, মা”””””’গি! পুরা পৃথিবীর মাইয়াগোর গতরে যা পাই না তা রুনার গতরে পাইছি। আমার রুনারে লাগবো, রুনারে ছাড়া আমার শরীরের আগুন নিভবো না।”

চলবে……………..