যদি দেখার ইচ্ছে হয় পর্ব-২০+২১

0
325

#যদি_দেখার_ইচ্ছে_হয়
#আফসানা_মিমি
|পর্ব: বিশ|

চায়ের দোকানে বসে আরামে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে রুস্তম। চঞ্চল চোখ জোড়া নতুন শিকারের খোঁজ করছে। মালিকের আদেশে দুইদিনে লুকিয়ে নেত্রকোনার সুসং দুর্গাপুরে আসে। সেখান থেকে ১০০ টাকা ভাড়া দিয়ে লাল পাহাড়ের আদিবাসীদের এলাকায় এসেছে। হাশেমের দোকানে বসে অদূরেই চৌদ্দ পনেরো বছর বয়সী মেয়ে নালার পানিতে ঝিনুক কুড়াচ্ছে। চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে একটা বিস্কুটের প্যাকেট হাতে এগিয়ে যায় মেয়েটির দিকে। হ্যাংলা পাতলা রুস্তম লাফ দিয়ে সহজেই নালায় নেমে পড়ে। ঝিনুক কুড়ানোর বাহানায় মেয়েটির সাথে কথা বলতে চেষ্টা করে,
” তোর গতরের কাপড়টা দেহি খুব সুন্দর। কইত্তে নিছিলি রে!”

সহজসরল মেয়েটির নাম আসমা। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামারঙা। একগাল হেসে উত্তর দিল, ” বড়ো আফা ঢাহা থেইকা আনছিল। পায়জামায় ছিঁড়া পাইয়া আমারে দিয়া দিছে।”

রুস্তম নড়েচড়ে দাঁড়ায়। অপরিচিত মানুষের সাথে কথা বলছে তারমানে মেয়েটি বড্ড বোকা অথবা সহজসরল। রুস্তম ভাবে, ঘরে যদি বউ রাইখা না আসতো তাহলে এই মাইয়ারে নিজের করে নিতো। অবশ্য বিয়ের আগে যে সে সুপুরুষ ছিল সেটাও বলা পাপ হবে। তার চোখ জোড়া জ্বলজ্বল করে ওঠে। যাদুমিশ্রিত কথা শুরু করে,
” আহারে আহারে কী কইলি রে তুই! পরীর লাহান মাইয়া নাকি অন্যের গতরের কাপড় পরে?”
” তুমি কেডা?”
আসমা ঘাড় ঘুরিয়ে রুস্তমের দিকে তাকায়। চোখে মুখে তার প্রশ্নের সমাহার। সুযোগ পেয়ে রুস্তম পুনরায় বলতে শুরু করে,” লাল পাহাড়ে ম্যাডামের লগে আইছি। বস্তা ভইরা টেহা লইয়া আইছে দান করার লাইগা। ধলিপাড়ার সবাই যাইয়া আনছে। হাশেম ভাইরে জিজ্ঞেস করো, হের বউও তো আনলো।”
আসমা গলা উঁচু করে হাশেমকে জিজ্ঞেস করে, ” ও গো হাশেম ভাই, হাঁচা কথা নাকি?”

বোকা ছেলেটা হ্যাঁ বলে মাথা নাড়ায়। আসমার মনে সন্দেহের বীজ তখনও বিদ্যমান। নালা থেকে উঠে কাপড় ঝেড়ে সে বলে, ” তোমার ম্যাডাম লাল পাহাড়ে তাইলে তুমি এইহানে কি করবার আইছো?”

” আমি তো বিঁড়ি টানতে আইছিলাম। পাহাড়ে দোকান নাই তুমি জানো না?”

কুপ্রকৃতির মানুষ অভিনয়ে সর্বদা পটু থাকে।রুস্তম তার প্রমাণ। দুর্দান্ত অভিনয়ের জন্য পুরষ্কার সে পাবে। আসমা সহজেই বিশ্বাস করে ফেলে। কোমড়ে গুঁজে রাখা ওড়না গায়ে জড়িয়ে লাল পাহাড়ের চূড়ায় এগোতে থাকে।

কথায় আছে, লোভে পাপ পাপে মৃত্যু। আসমার বিষয়টাও এমন। জবুথুবু হয়ে গাড়ির ভেতরে বসে আছে সে। ঠোঁট কে’টে র’ক্ত ঝড়ছে তার। গাড়িতে সে একা নয়, আট থেকে দশজন মেয়েও তার মতো অসহায় অবস্থায় পড়ে আছে।
বাহিরে রুস্তম বিস্তৃত হেসে টাকা গুনছে। এবার তার মালিক তার উপর সন্তুষ্ট হবেই হবে। টাকার ঘ্রাণ নিয়ে রুস্তম লোভাতুর স্বরে বলে, ” কাওয়া কা কা করলেই ফিরতে হয় না, বোকার দল! কাওয়া যে কখন শকুনের রূপ নিবো কইবার পারবা না।”

মোটা অঙ্কের টাকা পকেটে ঢুকিয়ে গাড়ির পেছনটায় দুইবার আঘাত করে চিৎকার করে বলে ওঠে,” লও মিয়া রওনা হও! বর্ডারে লোক পাইয়া যাইবা। মালগুলারে সাবধানে লইয়া যাইয়ো যেন পালাতে না পরে।”

রুস্তম হেসে সিগারেট ধরায়। আবারও এই পৃথিবীতে কুৎসিত বিকৃত মস্তিষ্ক বহুরূপীর জয় হয়ে গেলো।

——————————–

ঘুমের ঘোরে মিষ্টির মনে হলো কেউ তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে রেখেছে যেন ছেড়ে দিলেই সে পালিয়ে যাবে। পেটের কাছটায় বেশি ভারী অনুভব হয় তার। চোখ খুলতেই তার চোখ জোড়া চড়কগাছ হয়ে যাবার উপক্রম হয়। অন্তিক তার পেটের কাছে মুখ গুঁজে কী যেন বিড়বিড় করে বলছে। মিষ্টি আধশোয়া হয়ে জিজ্ঞেস করে,” কি বলছে সে?”

অন্তিক নিরুত্তর। শ্রবণহীনতার ভঙ্গিতে পুনরায় বলতে থাকে,” আমার প্রিন্সেস, বলে দাও তো! আমি কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক নই!”

অন্তিকের নীরবতার কারণ মিষ্টির বুঝে আসে। বার কয়েকবার সে অন্তিককে ডাকে। অন্তিক ভুলেও টু শব্দ পর্যন্ত করেনি। মিষ্টি চুপচাপ অন্তিকের পাগলামো দেখে গান ধরে,

যদি দেখার ইচ্ছা হয়
তোমার নিঠুর মনে লয়
কালিন্দীর ঘাটে আইসো দুপুরের সময়

আমি জল ভরিবার ছল করিয়া
দেখব নয়ন ভরিয়া জল ভরিবার
আমি জল ভরিবার ছল করিয়া
দেখব নয়ন ভরিয়া
দেইখো আসিয়া

আমার বন্ধু চিকন কালিয়া,,,,,,,,,

মুগ্ধ দৃষ্টিতে অন্তিক মিষ্টির গান শোনে। মোহিত হয়ে মিষ্টির কাছাকাছি বসে। চোখে চোখ রেখে বলে,” আমি তোমাকে ভালো রাখতে চাই, চন্দ্রিমা! তুমি বরাবরই আমার কাছে অচেনা একজন নারী হয়ে আছো। আমি কী বিশ্বাসের যোগ্য ছিলাম না? মনিমা-ই যে আমার মা তা জানালে কী খুবই অপকার হয়ে যেত, বলো?”

মিষ্টি অন্তিকের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়। মানুষটার চেহারায় সে মিথ্যা রাগ খুঁজে পেয়ে দুর্বল হেসে বলে,” তুমি হয়তো জানো না, অন্তু। আমি এতিম। আমার বাবা, মা আসল বাবা মা নয়। পূন্যালয়ে আমাকে যখন আনা হয়েছিল তখন আমার বয়স তিন কী চার হবে। মনি মা আমাকে দেখে নিজ সন্তানের মতো যত্ন করতে শুরু করেন। এর পরের বছরই বাবা মা আমাকে দত্তক নেয়। দাদীই মূলত আমাকে দেখে মায়ায় জড়িয়ে যায়। আর রইলো মনি মার কথা! সঠিক সময়ে সঠিক কাজ করতে বলা হয়েছিল আমাকে। মনি মার কাছে তোমার গল্প শুনতাম। ক্রমশই দুর্বল হয়ে পড়ছিলাম। কিন্তু তোমাকে এভাবে পেয়ে যাব কল্পনাও করতে পারিনি। তুমি আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছো তোমারই অগোচরে। আমি কীভাবে তোমাকে সত্য বলতাম যদি আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও! সইতে পারব না। আমাকে মনি মা তেমনভাবে শিক্ষা দিয়েছেন যেভাবে আমি মোল্লা বাড়ির কীটদের সাথে লড়াই করতে পারব। কতটুকু পেরেছি জানি না। তবে আমার অন্তুকে মিথ্যা জাল থেকে বের করে আনতে পেরেছি তাতেই ধন্য।”

অন্তিক দীর্ঘশ্বাস ফেলে।এই পৃথিবীতে কেউ পূর্ণ নয়। মিষ্টিকে বুকে জড়িয়ে ধরে। মাথায় অধর ছুঁয়ে বলে, ” আমি যেমন তোমার কাছে সাদা কাগজের মতো পরিষ্কার থাকতে চাই, তোমার ক্ষেত্রেও তাই। জীবনে যতোই ঝড় আসুক না কেন। কোনো কথা লুকাবে না।”

মিষ্টি মাথা সায় দিয়ে অন্তিকের বুকে মুখ গুঁজে।

————

পোলাও রান্না হচ্ছে মোল্লা বাড়িতে। লায়লা বেগম খুশিতে গদগদ প্রায়। খুশিতে জবরদস্ত রান্না করছেন। কলি মুখে কালো মাক্স লাগিয়ে সারা বাড়ি ঘুরছে আর বেসুরে গান গাইছে। গানের সুরে লায়লা বেগমের পিত্ত জ্বলে ওঠে। এমন কুৎসিত স্বরে কেউ গায় নাকি? প্রশ্নটা মনে আসতেই হাঁক ছাড়ে, ” কই গেলি রে কলি, মানুষটা আইজ কতদিন পরে বাসায় আসবো! ঘর দোরে ঝাড়ু ও তো লাগাতে পারোস! কী দিন আসলো! পুলাপাইন মায়ের কাজে হাত বাড়ায় না।”

” রান্না করার জন্য তুমি তো আছোই! এতদিন পর শান্তিতে বাড়িতে থাকছি তোমার সহ্য হচ্ছে না বুঝি! ক্যাচাল না পেরে কাজ করো।”

” আমি তো কাজ করবোই,কাজের মহিলা যে! তোরা কী পরের বাড়ি আর যাবি! মায়ের ঘাড়ে আছোস বুঝোস না। পরের ঘরে গেলে চুলের মুঠি ধরে কাজ করাবো। আর কাজে ফাঁকিবাজি করলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিব।”

” ঠিক যেভাবে আমাদের বের করে দিয়েছো, সেভাবেই। তাই না মা!”

আকস্মিক পিয়াসের স্বর শুনে চমকায়িত লায়লা বেগম। ইতঃস্তত হয়ে বলে, ” ইয়ে মানে আমি!”

” থাক আর বলতে হবে না। পাপ বাপ কেও ছাড়ে না কথাটা জানো তো! ভেবেছিলাম তুমি অন্তিকের কাছে পরনারী হলেও আমার তো মা! অন্ততঃ আমাকে বা আফিয়াকে মেনে নিবে কিন্তু আমার ধারণা ভুল, অহংকার ও দাম্ভিকে তুমি অন্ধকারে ডুবে আছো। কীভাবে পারলে তুমি অন্তিককে মিথ্যা অপবাদ দিতে?”

” মিথ্যা কখন বললাম। ডাক্তার যা বলেছে তাই বলেছি।”

পিয়াসের রাগ চরম পর্যায়ে। সে চিৎকার করে বলতে শুরু করে, ” তোমার ডাক্তার, রিপোর্ট তোমার মতোই ছলনাময়ী। দিনের পর দিন ছেলেটাকে তুমি অন্ধকারে রেখেছো। মিথ্যা রিপোর্টের ভয় দেখিয়ে যা ইচ্ছে করিয়েছো। এভাবেই তুমি ক্ষমা পাবে? কখনোই না। তোমার বিচার হবে, দুনিয়াতে না হোক হাশরের মাঠে হবে। একজন নিরপরাধ মানুষকে তিলে তিলে শেষ করার শাস্তি তুমি পাবে।”

পিয়াস যেভাবে এসেছিল সেভাবেই চলে যায়। লায়লা বেগম কিছুক্ষণ ছেলের কথা ভেবে পুনরায় গোস্তের লবন চাখতে এগিয়ে যায়। ফিরোজ আজ দশদিন পর বাড়ি আসবে। মানুষটা প্রায় সময় বাহিরে কাজে মগ্ন থাকে। এসব কষ্ট কী আর আজকালকার ছেলে মেয়ে বুঝবে? তারা তো সম্পর্ক কী তাই বুঝে না। এত বছরের বৈবাহিক জীবনে লায়লা বেগম কতো মা’র খেয়েছে হিসাব নেই। প্রত্যেকবারই সে সব ভুলে স্বামীকে খুশি করার প্রায়শ করতে থাকে।
———————-

ছোট্ট এই পৃথিবীতে মানুষের চাহিদার শেষ নেই। এসব চাহিদা মেটাতে মানুষ অবশ্যই ভালো কাজ করবে না। অসৎপথ বেছে নিবে। নাজিমউদ্দীনের মৃত্যু স্বাভাবিক মৃত্যু বলে মিষ্টির মনে হয়নি। সে অন্তিককে অবগত করলে বিষয়টা গাঢ় চোখে দেখে। আড়ালেই কাজ শুরু করে বন্ধু শাওনের মাধ্যমে। শাওন পেশায় একজন পুলিশ কর্মকর্তা। আজই সে ময়মনসিংহ থেকে এসেছেন অন্তিকের কাছে। অনেকটা জরুরী তলবে নিজের অফিসে ডেকেছেন অন্তিককে। অন্তিক এসে উপস্থিত হয় আড়াইটার মধ্যে। শাওন দেখা মাত্র কুশল বিনিময় করে একজন সহকারীকে কাউকে নিয়ে আসার খবর পাঠায়। মিনিট পাঁচেক পর একজনকে নিয়ে উপস্থিত হয় সহকারী। শাওন তাকে দেখিয়ে বলতে শুরু করে, ” একে চিনো? এই ছেলের নাম রুস্তম। নারী ব্যবসা করে। নেত্রকোণা থেকে ধরে নিয়ে এসেছি ব্যাটাকে। নারী পাচার করছিল, হাতেনাতে ধরা পড়ে। তোমার দাদার ঘরের খাট থেকে যেই হাতের ছাপ পেয়েছিলাম তা এর সাথে মিলে।”

অন্তিক অবিশ্বাস্যের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রুস্তমকে তার খুব ভালে করেই চেনা। তার চাচার কাঠের দোকানের কর্মচারী রুস্তম। বিগত এক বছর যাবত তাকে দেখেনি অন্তিক। নাজিমউদ্দীন একবার তার কথা জিজ্ঞেস করায় ফিরোজ বলেছিল সে নাকি কাজ ছেড়ে দিয়েছে। তবে কীভাবে তার হাতের ছাপ মোল্লা বাড়িতে থাকবে?
তবে কী অন্তিক যা ভাবছে তাই! এসবের পিছনে কী ফিরোজ চাচা দায়ী?

চলবে………….

#যদি_দেখার_ইচ্ছে_হয়
#আফসানা_মিমি
|পর্ব: একুশ|

অপরাধীরা যতোই চালাক হোক না কেন। ছোট্ট একটি ভুলের জন্য ধরা পড়েই যায়। হোক সেটা ত্রিশ বছর পর বা সত্তর বছর পর। রুনা নিত্যদিনের মতোই পূন্যালয়ে যাওয়ার জন্য তৈরী হয়ে নেয়। মিষ্টি রান্না করছিল, শরীর যতোটা খারাপ থাকুক না কেন সে তার মনি মাকে রন্ধ্রনশালায় পা মাড়াতে দেয় না। রুনা পরিপাটি হয়ে মিষ্টিকে দেখতে আসে। মেয়েটা নাকে আঁচল চেপে রান্না করছে। তার মনি মাকে সে কষ্ট দিবে না কিন্তু সে ঠিকই কষ্ট করছে।
” তোকে মানা করলেও শুনিস না, মা। কতো করে বললাম আমি রান্না করি, রাজি হলি না। দেখ তো, এখন কত কষ্ট হচ্ছে!”

মিষ্টি নাক চেপেই ভ্রু যুগল কুঁচকে নেয়। খুন্তি রুনার দিকে তাক করে বলে,” মা ডাকছো কিন্তু মায়ের কাজ করতে দিচ্ছো না! তুমি কেমন মা শুনি?”

” মশকরা করিস না। তোর কতদূর হলো, অন্তিক এলো বলে। রান্না শেষ করে জিরিয়ে নে তো এবার। আমি চললাম।”

মিষ্টির বলতে ইচ্ছে করছে, তুমি যেও না মনি মা! আমার মন আজ কু ডাকছে। আসন্ন বিপদের আশংকা হচ্ছে। মুখে কিছু না বললেও রুনা বুঝতে পারেন।
” এদিকে আয় দেখি!”

মিষ্টি যেন এই ডাকটারই অপেক্ষায় ছিল। ধীরপায়ে মনি মার দিকে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে বলে,” আমার একা একা ভালো লাগে না। ভয় হয়।”
রুনা পরম মমতায় মিষ্টির পিঠে হাত বুলিয়ে বলে, ” আমার সাহসী বাঘিনীকে এতো দুর্বল হলে চলবে? আমি তো তোকে এই শিক্ষা দেইনি,মা! শত্রুদের সামনে ভয় নয়, মোকাবিলা করতে হয়। শক্তি দিয়ে নয়, বুদ্ধি দিয়ে পরাজিত করতে হয়।”

” আমার মাঝে আরেকটি অস্তিত্ব অনুভব করার পর থেকে সাহস নামক বল পাই না, মনি মা! আমার ক্ষতি হোক কিন্তু আমাদের ভালোবাসা চিহ্নের কোনো ক্ষতি হতে দিতে পারব না।”

মিষ্টি কথাগুলো বলেই চোখের জল ফেলতে থাকে। রুনা হেসে চোখের জল মুছে দেয়। মিষ্টির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ” আর কিছু সময়, এই বুঝি অন্তু এলো। তুই ফ্রেস হতে হতেই দেখবি চলে এসেছে।”

” আচ্ছা, সাবধানে যেও!”

” আমাদের ছেড়ে তো ভালোই আছো দেখছি, নতুন সংসার গড়েও নিয়েছো।”

রুনা বাহিরে পা বাড়াতে নিতেই পুরুষালী কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। তার সামনে হাসিমুখে একজন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। রুনা দৃষ্টি ঝাপটিয়ে চেনার চেষ্টা করছে সে। কিছুক্ষণ পর স্মৃতির পাতা থেকে ছেলেটিকে চেনার পর রুনার চোখের কোণায় অশ্রু জমা হয়। ছেলেটি পিয়াস, মোল্লা বাড়িতে এই ছেলেটাই তার সাথে মান অভিমান বিনিময় করতো।

” সুখে আর রইলাম কই! তোরা আমার সুখের নীড়ে ভাগ বসাতে চলে এসেছিস।”

পিয়াস বিস্তর হাসে। সে মাথা নীচু করে অপরাধীর ন্যায় দাঁড়িয়ে বলে,” আমি তোমাদের নিতে এসেছি চাচী। চাচা তোমার কথা শুনে ঠিক নেই। অসুস্থ হয়ে পড়েছে।”

কায়েসের অসুস্থতার কথা শুনে রুনার চোখমুখ শক্ত হয়ে আসে। অভিমানের পাল্লা যে খুব ভারি! এত বছরেও মানুষটা তার একটিবারের জন্যও খোঁজ নেয়নি। সে কী জানতো না যে, রুনা পূন্যালয়ে আছে। বুকে পাথর চেপে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলে,” ডাক্তারের কাছে না নিয়ে এখানে কী করছো?”
” চাচার ডাক্তার নয়, তোমাকে প্রয়োজন।”
” আমি যাব না।”
মিষ্টি এবার এগিয়ে এসে রুনার কাঁধে হাত রেখে বলে, ” বাবার কোনো দোষ নেই মনি মা! আমরা সবাই এক নই, বাবা মানুষটা একটু সহজসরল। তোমার দূরত্ব তাকে অসহ্যকর ব্যাধি প্রদান করেছে। আমি বাবার অস্থিরতার সাক্ষী মনি মা! তিনি তোমার পথ চেয়ে রোজ বাড়ির সামনে দুই থেকে তিন ঘণ্টা বসে থাকেন। বাবা মনে করেন, তুমি যেমনভাবে কোনো এক সকালে বাবাকে ফেলে চলে এসেছো ঠিক এমন এক সকালে বাবার কাছে ফিরে আসবে।”

রুনার চোখ বেয়ে অশ্রু ঝড়ছে। তবে কী সে কাঁদছে? এতো বছরের মনের কোণে জমিয়ে রাখা কষ্ট কী মিইয়ে যাচ্ছে? ভাঙা স্বরে রুনা প্রশ্ন করে, ” অন্তিক কোথায়?”
” অন্তিক গাজীপুরে। শাওন জরুরী কল করেছিল। দাদার মৃত্যুর ব্যাপারে কিছু একটা বলতে চায়। আমিও যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু অন্তিক নিষেধ করে। এখানে তোমাদের ফিরিয়ে আনতে বলে।”

রুনা গভীর নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। পূন্যালয়ের মায়া কী তবে এখানেই শেষ করতে হবে তাকে?
—————–

মিষ্টিরা যখন পিয়াসের ভাড়া বাসায় পৌঁছে তখন ভোর সকাল। মিষ্টি ইচ্ছে করেই সকালের সময়টা বেছে নিয়েছে। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই মিষ্টি পিয়াসের উদ্দেশ্যে বলে, ” ভাইয়া,আমি আচার খাব।”

” সাত সকালে খালি পেটে আচার খাবি? কিছু খেয়ে নে, তারপর খাস!”

রুনার কথার প্রত্ত্যুত্তরে মিষ্টি জিদ ধরে সে এখনই আচার খাবে। পিয়াস বিষয়টা বুঝতে পেরে রুনাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে, গলির মোড়ে একটা শপ চব্বিশ ঘণ্টা খোলা থাকে। তা তুমি অপেক্ষা করতে পারবে? নাকি গিয়ে খাবে। অবশ্য গিয়ে খেলে তোমারই লাভ, যত ইচ্ছে খেতে পারবে।”

” শপে বসে খাব।”

পিয়াস নিষ্টিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। রুনার উদ্দেশ্যে বলে, ” আমি ফোন করে আফিয়াকে বের হতে বলে দিচ্ছি। তুমি সামনে আগাও চাচী! ”

রুনাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে মিষ্টিকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে পিয়াস। মিষ্টি মুচকি হেসে কৃতজ্ঞতার সহিত পিয়াসের দিকে তাকায়।
” ধন্যবাদ ভাইয়া।”
” মানুষের মনের আশা পূরণ করতে কতোই না আনন্দ পাওয়া যায়, তাই না মিষ্টি!”

কথাটা বলে দুজনেই একসাথে হেসে উঠে। বহুকালের মান অভিমান আজ ভাঙবে।

পিয়াসের অ্যাপার্টমেন্টের সামনে বিশাল বাগান রয়েছে যেখানে এক পাশে গাড়ি পার্কিং করার জায়গাও আছে। রুনা চারপাশ ভালো করে লক্ষ্য করে খুব সন্তুষ্ট হয়। সে শুনেছে এত বিশাল বড় এরিয়াতে বাচ্চারা বিকালে খেলা করে রুনার মন তখন পীন্যালয়ের জন্য কাঁদবে না। সময় পাড় করতে পারবে। রুনা সামনেরদিকে আগাতে নিলেই কেউ একজন তার কাঁধে হাত রাখে। রুনা ভাবে পিয়াস অথবা মিষ্টি। পিছনে ফিরে যখন মানুষটাকে দেখতে পায় তখন তার হাত থেকে ব্যাগগুলো জমিনে আছড়ে পড়ে। কাঁপা কাঁপা স্বরে শুধায়,
” অন্তিকের বাবা!”

আন্তিকের বাবার যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না। কাঁপা হাতে সে রুনা গালে হাত রেখে বলে,” তুমি ফিরে এসেছো রুনা!”

অন্তিকের মা চোখ বন্ধ করে নেয়। কতদিন পর সে মানুষটার স্বর শুনতে পারছে? কতদিন পর মানুষটা ছোঁয়া অনুভব করছে? সে মাথা হ্যাঁ বোধক ইশারা করে সম্মতি জানায়। আর ওদিকে কায়েসের বিশ্বাস হচ্ছে না। সে কাঁপা হাতে রুনার হাত ধরে ব্যাগগুলো আরেক হাতে নেয়। সামনের দিকে এগিয়ে যেতে নিয়ে রুনার উদ্দেশ্যে বলে,
” চলো একসাথে হাঁটি।”

” আমাকে কিছু বলার নেই, অন্তিকের বাবা?”

এক পা সামনে এগিয়েও থেমে যায় কায়েস। রুনার কণ্ঠস্বর আজ কত বছর পর শুনছে! অন্তরে যেন ধাক্কা খেল সেই কথায়। কত অভিযোগ জমা আছে সেথায়! কায়েস নির্বোধ, অবুঝ ছিল পূর্বে। তারই সামনে বউ বাচ্চার উপর কতেই না অত্যাচার হতো! কিন্তু সে কিছুই বলতে পারত না।

” শেষ বয়সে অভিযোগ করার মতো কিছু নেই, রুনা! মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তোমার পাশে থাকতে চেয়েছিলাম। উপরওয়ালা হয়তো সেই আশা পূরণ করেছেন।”

দূর থেকে পিয়াস ও মিষ্টি সবটাই দেখছে। পিয়াস নির্বিকার হলেও মিষ্টি নয়, সে দুজনকেই কাছ থেকে দেখেছে। বুঝেছে তাদের মনের কষ্ট। তাইতো আজ তাদের এখানে এনে দাঁড় করাতে পেরেছে।

—————————–

জীর্ণশীর্ণ হয়ে অন্তিক পিয়াসের ফ্ল্যাটের সামনে এসে কলিং বেল চাপ দেয়! কিয়ৎসময় পর মিষ্টি এসে দরজা খুলে দেয়। অন্তিকের জীর্ণশীর্ণ অবস্থা দেখে চিৎকার করে ওঠে সে। ততক্ষণে অন্তিক জমিনে লুটিয়ে পড়ে। মিষ্টি অন্তিকের মাথা নিজের কোলে রেখে অস্থির চিত্তে বলতে শুরু করে, ” চোখ খুলো অন্তু! কী হয়েছে তোমার? আমার দিকে তাকাও না! এই অন্তু, এই!

চলবে………………