#যে_প্রেম_হঠাৎ_আসে❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম.
– পর্ব:১১
সেদিনের পর টানা দশদিন চলে গেল। কিন্তু ইহানের আর খোঁজ খবর নেই। তাকে আর এলাকায় পাওয়া যায় না, পাওয়া যায় না ঝন্টুর চায়ের দোকানে, পাওয়া যায় না তার কক্ষের বেলকনির ঘরে, আজকাল আর কেউ গিটারের সুর বাজায় না, অনুজাকে কেউ বিরক্ত করে না, বাসস্ট্যান্ডে কেউ দাঁড়ায় না, জোর করে অনুজার পাশের সিটটা দখল করে না, হুটহাট ভালোবাসার আবদার নিয়ে কেউ আশেপাশে আসে না। বিষয়গুলোয় হিসেবে অনুজার ভালো থাকার কথা কিন্তু অনুজা ভালো থাকতে পারছে না। ভিতরে ভিতরে বিষণ্ণতায় কুঁকড়ে যাচ্ছে। অথচ অনুজা নিজেই চেয়েছিল ইহান চলে যাক তার জীবন থেকে। আর চলেও গেছে। তবুও কেন ভালো থাকা যাচ্ছে না— বুঝতে পারছে না অনুজা। আজকাল দিনকাল তার মোটেও পছন্দ হয় না। খালি মনে হয় চারপাশে শুধু রয়েছে শূন্যতা, শূন্যতা, শুধুই শুন্যতা।’
দিনটি মঙ্গলবার। ইহানের চলে যাওয়ার এগারো দিন চলছে। বিকেলের আকাশটা আজ বড় মায়াময়। নীল আকাশে সাদা মেঘেরা ভাসে। তবুও অনুজার মন ভালো হয়না। অনুজা দাঁড়িয়ে আছে তার বেলকনির রেলিং ধরে। সামনেই শূন্যতায় ঘিরে মরে পড়ে আছে ইহানের ঘরখানা। অনুজার আজ টিউশনি ছিল তবুও অনুজা যায়নি। ইদানীং তার কিছুতেই মন বসে না। রাজ্যের সব মনখারাপ বুঝি তার নিকটই বাসা বেঁধেছে। অনুজা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অনুজার হঠাৎ মনে পড়ল তার আর ইহানের প্রথম দেখার কথা। অনুজা সেদিনও আজকের মতো বেলকনির মাঝবরাবর তাকিয়ে ছিল। আজও তাকিয়ে আছে। তবে তফাৎ একটাই সেদিন ইহান ছিল আজ ইহান নেই। ইহানের সেই মায়াময়ী চাহনি আজ কোথায় নেই?— কেউ শীতল কণ্ঠে বলছে না।
“আমার শহর ভীষণ অসুস্থ রাত্রীপ্রিয়া, আপনি কেন সুখের ঔষধ হয়ে আমার শহরে আসেন না?”
আচমকাই অনুজা ঠুকরে কেঁদে উঠল। শব্দ হলো সেই কান্নায়। কান্নার শব্দ নিজ কানে শুনতে পেতেই চমকে উঠল অনুজা। আকস্মিক কান্ডে নিজেরই অবাক লাগল। তবুও অনুজার কান্না থামে না। অনুজা হাতের উল্টোপিঠে নিজের চোখের পানি মুছে। কান্নায় মিশ্রিত কণ্ঠে বলে,
“তুই অন্তত এটা ভাবিস না অনু, ইহান চলে গেছে বলে তোর কান্না আসছে। অদ্ভুত! আমি কাঁদছি কেন— আমি ইহানকে ভালোবাসি না। ও চলে গেছে বলে আমার কান্না আসছে না। না। অনু কাঁদবি না।”
অনুজা দ্রুত চোখের পানি আটকানোর চেষ্টা চালায়। তবুও কাজ হয় না। আপনাআপনি গড়িয়ে পড়ে পানি। অনুজার রাগ লাগে। নিজের মাথা শক্ত করে চেপে ধরে চেঁচিয়ে ওঠে অনুজা। কিছুক্ষণের মাঝে থেমেও যায়। হঠাৎই কারো কণ্ঠ শোনা যায়৷ সে বলে, “আপনি কাঁদছেন নাকি অনু?”
অনুজা অবাক চোখে সামনের তাকায়। শার্ট প্যান্ট পড়ে ইহান দাঁড়িয়ে। মুখে তার চওড়া হাসি। অনুজা চোখ মুখ শক্ত করে বলে,
“আশ্চর্য কাঁদব কেন?”
“কেন কাঁদবেন– কি করে বলব!”
“আপনি এতদিন ছিলেন কোথায় ইহান?”
“কেন আমায় খুব মিস করছিলেন বুঝি?”
“আপনায় মিস করতে যাব কেন আমি?”
“এত মিথ্যে প্রকৃতি সইবে না অনু।”
“বাজে বকা বন্ধ করুন।”
“আচ্ছা করলাম। আপনি কাঁদলে সুন্দর লাগে না। প্লিজ কাঁদবেন না।”
“আমি কাঁদছি না বললাম তো।”
“কেন মিথ্যে বলেন?”
“এটাই সত্যি ইহান।”
“আচ্ছা মেনে নিলাম। আমি তো এখন আর বিরক্ত করি না। আপনি তবুও কাঁদেন অনু?”
এবার অনুজার রাগ ওঠে। খানিকটা তীক্ষ্ণ আওয়াজে বলে,
“আপনাকে কতবার বলব আমি কাঁদছি না।”
“আচ্ছা মেনে নিলাম। এখন তো আর মাঝরাতে চাঁদের আলো দেখতে আপনার সমস্যা হয় না। রাস্তাঘাটেও কেউ বিরক্ত করে না। তবুও আমার শূন্যতায় ঘেরা বেলকনির দিকে তাকিয়ে আপনি কেন কাঁদছেন অনু?”
“এবার বাড়াবাড়ি হচ্ছে ইহান। আমি বলছি তো আমি কাঁদছি না।”
“আমায় ভালোবাসেন অনু?”
“না বাসি না।”
“মুখে বলেন ভালোবাসি না, অথচ আপনার চোখের পানি বলছে আমার রাত্রীপ্রিয়া আমিহীনা থাকতে পারে না। কেন কাঁদছিলেন অনু? বলুন কেন কাঁদছিলেন? উত্তর দিন? আমায় ভালোবাসেন?– সত্যি করে বলুন।’
অনুজার রাগ এবার সপ্তম আকাশে। সে ভয়ংকর আওয়াজে বলল, “আপনায় বলছি না আমি কাঁদছি না। আমি কাঁদছি না ই..।”
“আপা তুমি একা একা কার সাথে কথা বলো?”
আচমকা ছোট বোনের কণ্ঠ শুনে চুপসে গেল অনুজা। তনুজা তখনও বিমুঢ় চেয়ে। সে বাহির থেকে শুনতে পেয়েছে অনুজা কার সাথে যেন রাগারাগি করছে। প্রথমে ভেবেছিল ফোনে। কিন্তু পরে দেখে না। এরপর ভাবল হয়তো সামনের বিল্ডিংয়ের কারো সাথে। কিন্তু সেখানেও দেখল কেউ নেই। অনুজাকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আবার প্রশ্ন করল তনুজা,
“আপা কথা বলছ না কেন?”
অনুজা বিস্মিত নজরে সামনের বেলকনির দিকে তাকায়। সেখানে ইহান নেই। কেউ নেই। তাহলে এতক্ষণ অনুজা কার সাথে কথা বলছিল। অনুজার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিল আচমকা। তার মানে অনুজা এতক্ষণ ইহানকে নিয়ে হ্যালুসিনেশনে ছিল। কি অদ্ভুত! অনুজা বিস্মিত কণ্ঠে বলে,
“এক গ্লাস পানি নিয়ে আয় তনু।”
তনুজা দেরি করল না। কোনরকম বলল, “পানি খাবা আপা– আমি এক্ষুণি নিয়ে আসছি।”
তনুজা ছুটে যায়। অনুজা নিচে বসে পড়ে। অনেক্ক্ষণ চুপ করে রয়। তার বিশ্বাস হচ্ছে না এতক্ষণ ইহানকে কল্পনা করে তার সাথে কথা বলছিল অনু। তনুজা ফিরে এসে পানির গ্লাসটা হাতে দেয়। অনুজা ঢকঢক করে পুরো পানিটা শেষ করে। এরপর চোখ বন্ধ করে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে রয়। তনুজাও বসে পাশে। মলিন কণ্ঠে শুধায়,
“আপা কি হইছে তোমার?”
অনুজার উত্তর আসে সঙ্গে সঙ্গে। সে শান্ত স্বরে আওড়ায়, “কিছু না।”
–
বাসস্ট্যান্ডে আজ প্রবল ভীড়। অনুজার ভার্সিটিতে একটা জরুরি ক্লাস আছে। ক্লাসটা না করলেই নয়। তবুও অনুজা ঠিক করেছে আজ ভার্সিটি যাবে না। মাঝে মাঝে জীবনের সব জরুরির কাজকেও জরুরি দিতে নেই। অনুজার ভাবনার মাঝে বাস আসে। একে একে দাঁড়িয়ে থাকা সব যাত্রীরা উঠে পড়ে। অনুজা ওঠে না। কনডাক্টর জিজ্ঞেস করে,
“আপা যাইবেন না?”
অনুজা মাথা নাড়িয়ে জানায়, ‘না।’
উত্তর শুনে কনডাক্টর বাসের পিঠে বারি মারে। সঙ্গে সঙ্গে বাস চলতে শুরু করে। অনুজার জন্য দাঁড়ায় না। চলে যায়। অনুজা ততক্ষণ তাকিয়ে থাকে যতক্ষণ বাসটা তার দৃষ্টিসীমা না ছাড়ে।’
অনুজা হাঁটা ধরে। বাসের সিট তাকে বড্ড পীড়া দেয়। এই মনে হয় আচমকা ইহান এসে বসল পাশে। আর বলল, “আমায় ভালো কেন বাসেন না অনু?”
আকাশটা মেঘলাময়। বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব। অনুজা হাঁটছে। গন্তব্যহীন হাঁটছে। হঠাৎ তার সামনে দিয়ে একটা ভ্যান গেল। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল সেদিনের ভ্যানের ঘটনা। ইহানের অদ্ভুত সব কান্ড। চায়ের দোকান, ভ্যান, বাসের ছাঁদ। নামহীন সেই সুন্দর নগর। ইহানের দেয়া শাড়ি। শাড়িটা অনুজা আনেনি। আসার সময়ই ফেরত দিয়েছিল। ইহান তখনও কিছু বলেনি। সেদিন শেষ সময়ে অনুজা বোধহয় একটু বেশি বলেদিয়েছিল। ওভাবে বলা ঠিক হয়নি। মানুষটা কষ্ট পেয়েছে। অনুজা বুঝতে পেরেছে। কিন্তু কি করত? ওভাবে না বললে ইহান কখনই পিছু ছাড়ত না। অনুজা নানা কিছু ভাবতে ভাবতে হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে এসে দাঁড়াল টিউশনিতে যাওয়ার সেই রাস্তায়। সেই ড্রেনের সামনে। আজও পানি জমেছে। অনুজার মনে পড়ল ইহানের সেদিনকার তাকে বাঁচানোর দৃশ্য। সঙ্গে বলা, “দেখলেন অনুজা, আপনার প্রেমবৃষ্টিতে নিজেকে ভিজাতে পারলাম না, অথচ নর্দমার বৃষ্টি কি সুন্দর আমায় ভিজিয়ে দিল।”
অনুজা হঠাৎ হেসে ফেলে। ছেলেটা আসলেই একটা পাগল ছিল। অনুজা হাঁটে। বাড়ির পথে আসতে আসতে দুপুর গড়ায়। হেঁটে এসে দাঁড়ায় ঝন্টুর চায়ের দোকানে। এলাকায় অন্যান্য ছেলেরা কেরাম খেলছে। আর হই হুল্লোড় চেঁচামেচি করছে। কিন্তু এই হুল্লোড়ের মাঝেও অনুজার মন খারাপ। ভীষণ খারাপ। কারন এত হুল্লোড়ের মাঝেও ইহান নেই। নেমে আসে দীর্ঘশ্বাস। অনুজা আবার হাঁটে। হঠাৎ বৃষ্টি নামে। প্রবল জোরের বৃষ্টি নয়। টিপটিপ বৃষ্টি। অনুজা সেই বৃষ্টির মধ্যেই হাঁটে। মনে পড়ে,
“এক সন্ধ্যার মুহুর্তে অনুজা শাড়ি পড়ে দাঁড়িয়ে। বৃষ্টির পরে এলাকার এক মোড়ে হাঁটু অবদি পানি জমে। সেই মুহূর্তে ইহান হাজির। কতশত কথা সেদিন।’
অনুজার বুকে তীব্র ব্যাথা ওঠে। সে আকাশ পানে তাকায়। করুণ কণ্ঠে শুধায়,
“মানুষ হারাইয়া যায়, তাদের স্মৃতি কেন– হারায় না।”
অথচ ইহান হারাতে চায়নি।’
#চলবে…
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ।]
#TanjiL_Mim♥️.