যেদিন তুমি এসেছিলে পর্ব-২১+২২

0
862

#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#পর্ব_২১
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
দুপুরের দাপদাহ গরমে প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত। সকাল থেকে বিদ্যুৎ নেই। জেনারেটর চলছে। তবে শান্তি মিলছে না। বাতাসটাও লাগছে ভ্যাপসা গরম। গরমে অস্থির হয়ে বারান্দায় পায়চারি করে অর্ষা। একটু যে ছাদে যাবে তারও তো কোনো উপায় নেই। রোদে একদম পুড়ে যেতে হবে। সে কী করবে না করবে কিচ্ছু ভেবে পাচ্ছে না। সময়ও কাটতে চাইছে না এভাবে। জহির চৌধুরী অফিসে গেছেন। আহিল গেছে বাইরে। ছেলে মানুষ আর কতকক্ষণই বা বাসায় থাকে? আমেনা বেগম ঘুমিয়ে আছেন। সকালে ঘুমের ওষুধ খেয়েছেন বিধায় ঘুমটাও হচ্ছে কড়া। এই মুহূর্তে অর্ষারও ইচ্ছে করছে টুপ করে একটা ওষুধ পেটে চালান দিয়ে ঘুমের রাজ্যে প্রবেশ করতে। এতে অন্তত জাগতিক গরম থেকে রেহাই মিলবে কিছু সময়ের জন্য। তবে এটা সম্ভব নয়। ঘুমের ওষুধগুলো বেশি পাওয়ারের। খেয়ে টাল হয়ে শুয়ে থাকলে আবার সকলে ভেবে না বসে শোকে-দুঃখে অর্ষা সুই’সাইড করতে চাচ্ছে।

পায়চারি করতে করতে আরো হাঁপিয়ে পড়েছে সে। বাসায় এখন রেণু আপাই শেষ সম্বল। তার সাথে গল্পগুজব করে সময় কতটুকু পার করা যায় দেখা যাক। সে রেণুর রুমের দিকে পা বাড়ায়। দরজা ভেতর থেকে চাপানো।

অর্ষা দরজায় করাঘাত করে বলল,’রেণু আপা? ঘুমিয়েছেন?’

রেণু ঘুমায়নি। সজাগ-ই ছিল। সে ব্যস্ত পায়ে বিছানা থেকে নেমে এলো। চাপিয়ে রাখা দরজা নিজেই খুলে বলল,’আরে আপামুনি। আহেন ভিতরে আহেন।’

অর্ষা ভেতরে গিয়ে খাটে বসল। রেণু পাশে বসে গদগদ হওয়া ভঙ্গিতে বলল,’আমার যে কী কপাল আপামুনি।’

‘এ কথা বলছেন কেন?’

‘এইযে আপনে আমার ঘরে আইছেন।’

অর্ষা মলিন হেসে বলে,’আপনার রুমটা অনেক সুন্দর রেণু আপা। গোছানো, পরিপাটি। আমার বাবার বাড়ি কিন্তু এত সুন্দর না। এত পরিপাটিও নয়। পুরনো আমলের রঙচঙ ধরা বাড়ি।’

রেণু যেন একটু বিমর্ষ হলো। বিষাদিত কণ্ঠে বলল,’তবুও আপা আপনের বাপের ভিটা আছে। আমার তো নিজের বলতে কিছুই নাই।’

গল্প করার প্রসঙ্গ পেয়ে অর্ষার ভালো লাগছে। সে বিছানায় পা তুলে বসে বলল,’আমায় বলা যাবে আপনার জীবন কাহিনি?’

রেণু হাসল। হাসিটা আনন্দের কিংবা সুখের মনে হয়নি অর্ষার। মানুষ তো শুধু খুশি হলেই হাসে না। অতি কষ্টেও মানুষ হাসে। আর সেই হাসিটা ঠোঁটে স্পষ্ট হলেও, আসলে হাসিটা বের হয় পাঁজর ছিঁড়ে। সেই ব্যথা কখনো কাউকে দেখানো যায় না আবার বোঝানোও যায় না।

অর্ষা তাকিয়ে আছে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। রেণুর চোখজোড়া হঠাৎ-ই কেমন ছলছল করে ওঠে। সে ঠোঁটে সেই বিষাদমাখা হাসিটুকু ধরে রেখেই বলল,

‘আমি যহন ছোডো আছিলাম তহন আমার আব্বায় মা’রা গেছে। নানা-নানি জোর কইরা আম্মারে আবার বিয়া দিছে। আমি সৎ বাপের বাসাতেই থাকতাম। আম্মা বিয়া করছিল বইলা দাদা-দাদি আর কোনো সম্পর্ক রাখে নাই আমগোর লগে। আরেকটু বড়ো হওনের পর আমার একটা বুইন হইছিল। সেই বুইন হইতে গিয়া আমার মা-ও মই’রা যায়। সৎ বাপে আরেকখান বিয়া করে। এহন তো ঐ বাড়ির কেউ আমারে রাখব না। নানা গিয়া নিয়া আসলো। বয়স যহন আমার ১৭ তহন নানাও মা’রা গেল। বাইত্তে মামা, নানি আর আমি। মামা বিয়া ঠিক করল ৪০ বছরের এক ব্যাডার লগে। ব্যাডার আগের ঘরের বউয়ের লগে তালাক হইছিল। আমার বিয়ার এক বছরের মাথায় ঐ বউ আবার ফিইরা আসতে চায়।’

এটুকু বলে রেণু থামে। ওড়নার কোণায় চোখ মুছে নেয়। অর্ষার বুকের ভেতরে কেমন উত্থানপতন শুরু হয়। রেণুর মাঝে সে নিজেরও কিছু প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাচ্ছে।

রেণু আবার বলা শুরু করে,’এরপর জামাই আমারে তালাক দিলো।’

‘আশ্চর্য! আপনার স্বামী তার আগের বউকে গ্রহণ করল?’

‘হ। কারণ হের পুলাপাইন হের পা ধইরা অনেক কান্নাকাটি করছে। আর হেয়-ও আগের বউরে মেলা ভালোবাসতো।’

‘তারপর কী হলো?’

‘তারপর আর কী হইব? মামা বাসায় রাখব না সোজা বইলা দিলো। গেরামের এক পরিচিত বড়ো বইনের সাহায্যে ঢাকায় আইলাম। ঐ আপাই এই বাইত্তে কাম নিয়া দিছিল। ভাগ্যিস এই বাসায় কাম পাইছিলাম। এই বাড়ির মানুষগুলান যে কত্ত ভালো আপা হেইডা আমি কইয়াও শেষ করতে পারমু না। দেহেন একটা রুম আমারে দিয়া দিছে। কোনো কাজের মানুষরে কেউ এত আহ্লাদ দিয়া রাখে কন? খালাম্মা আমারে নিজের মেয়ের মতোই দেহে। বাড়ির বেবাক মানুষজন আমারে ভালোবাসে। আগের কথা এখন আর মনে পড়ে না। অনেকদিন পর আপনে জিগাইলেন তাই মনে পড়ল।’

বোকাসোকা অর্ষা কাঁদছে। সে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে রেণুকে জড়িয়ে ধরে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,’আল্লাহর ওপর ভরসা রাখবেন রেণু আপা। তিনি অবশ্যই সকল বান্দার ভালো চান।’

‘ভরসা আছে আপামুনি। তিনি চাইছেন বইলাই তো এহন আমি এত ভালা আছি।’

অর্ষা চোখের পানি মুছে বলল,’আপনি আর বিয়ে করলেন না কেন?’

‘মন মই’রা গেছে আপা। একজনরেই ভালোবাসছিল। তারে হারাইয়া মনও মই’রা গেছে। মানুষ যে কয় বিয়ার পর ছেলে-মেয়ে আর একলা থাকতে পারে না; এইগুলা ভুয়া কথা। আবার সইত্যও হইতে পারে। কিন্তু মনের চাহিদা না থাকলে কি আর শরীর তার চাহিদা খোঁজে? আমার এমন কোনোদিন লাগে নাই। আমি একলাই ভালা আছি এই বাড়ির সবার লগে।’

অর্ষা হাসার চেষ্টা করে। রেণুর সংঙ্গায়িত করা ভালোবাসার সংঙ্গা বোঝার চেষ্টা করে সে। অনুধাবন করে, আসলে ভালোবাসার ব্যাখা একেকজনের কাছে একেক রকম। ভিন্ন, বিচিত্র সকল ব্যাখা; তবুও সকলে এক নামে যা বোঝে তা হলো ‘ভালোবাসা’।

‘আপা একটা কথা কই?’

রেণুর প্রশ্নে সম্বিৎ ফিরে পায় অর্ষা। প্রত্যুত্তরে বলে,’অবশ্যই।’

‘আপনে অনেক ভালা। সহজ-সরল।’

অর্ষা হাসে। রেণু বলে,’সত্যি কইতাছি। বড়ো ভাইজানরেও তো আমি অনেক বছর ধইরা দেখছি। হেয় একেবারে চুপচাপ স্বভাবের। ব্যথা পাইলে, কষ্ট পাইলেও কাউকে কইতে পারে না। হেয় যদি কাউরে কষ্ট দেয় তাইলে ঐ মানুষের চেয়ে নিজে বেশি কষ্ট পায়।’

‘আপনি কী করে জানলেন?’

‘একদিন ভাইজান কিরিকেট (ক্রিকেট) খেইলা বাসায় আইছে। ঐদিনও অনেক গরম পড়ছিল। তার হাঁটুতে কেমনে জানি ব্যথা পাইছিল। রক্ত পড়তেছিল। তাও কাউরে কিছু কয় নাই। আমি জিগাইলাম, ‘ভাইজান পায়ে কী হইছে?’ ভাইজান কইল,’কিছু না। তুমি যাও এখান থেকে।’ আমি তাও জেরা করতেছিলাম। পরে রাগ হইয়া আমারে একটা ধমক দিছিল। নিজের রুমে গেছিল গা। আমি কিন্তু কিছু মনে করি নাই। পরেরদিন সকালে চা দিতে গেছিলাম তখন ডাইকা কয়,’রেণু আপা কিছু মনে কোরো না। কাল খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছি। স্যরি।’ আপনে যদি তহন তার মুখটা দেখতেন তাইলে বুঝতেন।’

অর্ষা দীর্ঘশ্বাস নেয়। মানুষটা ভেতরে ভেতরে গ্লানিবোধ করে অথচ কষ্টও দেয়। হয়তো অনিচ্ছায় এমন করে ফেলে। এছাড়া ক’জনই বা পারে সবসময় নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে? চাপা স্বভাবের লোকগুলো সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলেও বোধ করি হঠাৎ আসা রাগগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। আহনাফও বোধ হয় তেমন-ই একজন মানুষ।

রেণু ফের বলল,’আসলে আপা সব-ই ভাগ্য। নইলে বিয়া ঠিক হইল একজনের লগে আর হইল আপনার লগে। সব-ই আল্লাহর ইচ্ছা। তয় এতটুকু কইতে পারি, স্বামী হিসাবে জীবন ভালা একটা মানুষ পাইছেন। এই বাড়ির দুই ভাইজান-ই হিরার টুকরা। একটুও বানাইয়া কইতাছি না। ছোডো ভাইজানরে তো আপনে ভালো কইরাই চিনেন। আস্তে আস্তে বড়ো ভাইজানরেও চিনতে পারবেন।’

অর্ষা বাঁকা হাসে। ঐ মানুষটাকে চেনার তো কোনো উপায়-ই নেই। এছাড়া কেন জানি সে কোনো আগ্রহও খুঁজে পায় না তাকে চেনার কিংবা বোঝার জন্য। কাগজে-কলমের মাধ্যমে একটা সম্পর্কে আটকা পড়লেই কি আগ্রহ, ইচ্ছে জন্ম নেয় নাকি? তারা দুজনই দু’মেরুর মানুষ। বর্তমানে আছেও দু’প্রান্তে। বহুদূর!

কারেন্ট এলো বিকেলের দিকে। দুপুরে একবার গোসল করেছিল অর্ষা। কারেন্ট আসার পর আবার গোসল করেছে। অল্পকিছু খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। সকালের ঘুমটা এখনো বাকি পড়ে আছে। ঘুম ভাঙে তার সন্ধ্যায়। জহির চৌধুরী সেই সময়ে বাড়ি ফেরেন। অর্ষা ঘুম থেকে উঠে মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কীভাবে বাড়ির মানুষদের জানাবে সেটাই ভাবছিল। যদিও কথাটি সবার আগে তার আহনাফকে জানানো উচিত ছিল। যেহেতু কাগজে-কলমে সে তার স্বামী হয়। কিন্তু সে তো এখানে নেই। তার সাথে কোনো যোগাযোগও নেই অর্ষার। সূতরাং যা বলার জহির চৌধুরী এবং আমেনা বেগমকেই জানাতে হবে।

সে তাদের ঘরের দুয়ারে গিয়ে কড়া নেরে বলল,’আসব?’

ভেতর থেকে জহির চৌধুরী বললেন,’এসো।’

অর্ষা ভেতরে গিয়ে মাথা নত করে দাঁড়ায়। আসার পূর্বে সব কথা তো মনে মনে গুছিয়ে নিয়েছিল। এখন তাহলে সব এমন গুলিয়ে যাচ্ছে কেন? নার্ভাসও লাগছে খুব!

‘কিছু বলবে?’ জিজ্ঞেস করলেন আমেনা বেগম।

জহির চৌধুরী বললেন,’বসো আগে। বসে বলো কী বলবে। এত নার্ভাস কেন হচ্ছ? বিনা সঙ্কোচে বলো কী বলবে।’

অভয় পেয়ে মনে একটু সাহস ফিরে পায় অর্ষা। না বসে দাঁড়িয়েই বলল,’আসলে কিছু কথা বলতে চাই। যদি কিছু মনে না করেন…. আসলে এভাবে বাড়িতে বসে থাকতে ভালো লাগে না। আমি তো একটা জব করতাম শো-রুমে। আপনারা যদি অনুমতি দিতেন তাহলে আমি আবারও ঐ জবটা করতে চাই।’

জহির চৌধুরী কিছুক্ষণ মৌন থেকে বললেন,’ঐ চাকরীটাই লাগবে? নাকি সময় কাটানোর জন্য করতে চাচ্ছ?’

‘সময় কাটানোর জন্যই।’

‘বাড়ির বউদের দিয়ে কাজ করানোর বিষয়টা আমার পছন্দ নয়। তবে তোমার বিষয় আলাদা। এখনো অনেক শখ, স্বপ্ন তোমার বাকি আছে। আমি বাবা হয়ে সেগুলো পূরণ করব। তবে সময় কাটানোর জন্যই যখন চাকরী নিতে চাচ্ছ তখন আমি বলব, শো-রুমে চাকরী করার দরকার নেই। একটা কিন্ডারগার্ডেন টিচারের জব নিতে পারো। আমি সাহায্য করব। সমস্যা আছে?’

অর্ষা মাথা নাড়িয়ে বলল,’সমস্যা নেই।’

‘ঠিক আছে। দুটো দিন অপেক্ষা করো। আমি কাল-পরশু কথা বলে তোমাকে নিয়ে যাব।’

‘ধন্যবাদ আঙ্কেল।’

জহির চৌধুরী হেসে ফেলেন। তার হাসিতে আমেনা বেগমও হাসেন।

‘এখনো আঙ্কেল হই নাকি?’ হেসে হেসেই প্রশ্ন করলেন জহির চৌধুরী।

অর্ষা সলজ্জিত হেসে বলল,’আসলে অভ্যেস হয়ে গেছে তো!’

‘কিন্তু আমার যে আব্বু ডাক শুনতে ইচ্ছে করে। আফরিনটা বাসায় থাকে না তো! ভেবেছিলাম দু’ছেলের দু’বউ আসবে মানে আমার দু’মেয়ে আসবে। ওরা আমায় আব্বু বলে ডাকবে। কিন্তু এখন তো দেখছি বড়ো মেয়ে আঙ্কেলই ডাকছে!’

অর্ষা কী বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে রইল। আমেনা বেগম বললেন,’আরে এখনো অনেক সময় আছে। আগেই এত উতলা হচ্ছ কেন? ও’কে একটু সময় দাও।’

‘মেয়ে বলে কথা! সময় তো দেওয়াই যায়। দিলাম। সন্ধ্যায় নাস্তা করেছ মা?’

মা ডাক শুনে অর্ষার ভেতরটা শান্তি অনুভব করল। সে সন্তুষ্টচিত্তে বলল,’না। একসাথে খাব।’

‘আচ্ছা সবকিছু রেডি করো। আমরা আসছি।’

‘জি, আচ্ছা।’ বলে অর্ষা চলে যায়।

জহির চৌধুরী দীর্ঘনিশ্বাস নিয়ে বলেন,’কবে যে দুজনকে একসাথে দেখব!’
_______
অফিস শেষ করে বাড়িতে ফিরেছে আহনাফ। সময় তো তার নিয়মমাফিক চলে যাচ্ছে। তবে প্রতিটা সময়ই তার বিরক্তের সাথে কাটে। মনে শান্তি পায় না। অস্থির লাগে। একটু শান্তির জন্য কত কিছুই না করে। তবুও কোথাও যেন কমতি রয়েই যায়। রয়ে যায় শান্তির অভাব।

আহনাফের সাথে আজ ওর কলিগ হেলেনও বাড়িতে এসেছে। সে বেশ চটপটে ও চঞ্চল স্বভাবের। বিদেশি হওয়ার দরুণ এমনিতেই ফরসা; যেমন তার উচ্চতা তেমন শরীরের গড়ন। দেখলে মনে হবে চকোলেট বয়। তার ২৮ বছরের জীবনে গার্লফ্রেন্ডের সংখ্যাও অসংখ্য।

হেলেন ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে আশেপাশে চোখ বুলাল। সম্ভবত সে ক্যাথিওনকে খুঁজছে। কেননা এর পূর্বেও সে বাড়িতে এসেছে। তাই নতুন করে খুটিয়ে দেখার কিছু আছে বলে মনে হয় না।

গলার টাই ঢিলা করে, শার্টের হাতা গুটিয়ে আহনাফও পাশে বসল। তাকে ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। মনে যেখানে বিষাদ সেখানে শরীরে ক্লান্তি ভর করাটা অতি স্বাভাবিক।

হেলেন আহনাফের কাঁধে হাত রেখে বলল,’চলো বাইরে থেকে ঘুরে আসি।’

আহনাফ চোখ বন্ধ করে সোফায় শুয়ে রয়েছে। ইতিমধ্যে সে ঘটনাটি হেলেনকেও শেয়ার করেছে। সবার মতো হেলেনও চিল মুডে বলেছিল,’প্যারা নেওয়ার কিছু নেই।’ আসলে পরিস্থিতি যার, সমস্যাও শুধু সে-ই উপলব্ধি করতে পারে।

কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে হেলেন আবার ডাকল,’হেই আহনাফ!’

আহনাফ এবার সোজা হয়ে বসল। গা ঝাড়া দিয়ে বলল,’না, বাইরে কোথাও যাব না। তুমি বসো, আমি কিছু খাবার নিয়ে আসি।’

হেলেন আহনাফের হাত টেনে ধরে বলল,’এখানে কিছু খাব না। আজ বাইরে খাব। এজন্যই তো তোমার সাথে বাসায় এলাম। তোমার কোনো বারণ শুনব না। যাও রেডি হয়ে নাও।’

আহনাফ বেশ কয়েকবার প্রস্তাব নাকচ করার পরও হেলেন জেদ ধরে বসে আছে। অবশেষে আহনাফ যাওয়ার জন্য রাজি হয়। ফ্রেশ হয়ে দুজনে একত্রে বেরিয়ে পড়ে। হেলেন একটা বারে নিয়ে যায়।

আহনাফ সেখানে গিয়ে বিরক্ত প্রকাশ করে বলে,’এখানে কেন?’

‘আমার গার্লফ্রেন্ডের বার্থডে আজ। এখানে সেলিব্রেট করা হবে।’

আহনাফ ভ্রুঁ কুঁচকে বলল,’তোমার তো গার্লফ্রেন্ডের অভাব নেই। কোনটার বার্থডে?’

হেলেন হেসে ফেলে। হাসলে গালে ডিম্পল পড়ে। তাই তার হাসির প্রেমেও পড়েছে অসংখ্য রমণী। সে ডিম্পলওয়ালা হাসি দিয়ে বলল,’কয় নাম্বার মনে নেই। তুমি বোধ হয় দেখোনি।’

‘ঠিক আছে। তুমি যাও। আমি এখানেই আছি।’

‘আমার সাথে এসো।’

‘না। হৈচৈ ভালো লাগে না। আমি এখানেই ঠিক আছি।’

‘শিওর?’

‘১০০% শিওর।’

‘ওকে। আমি তাড়াতাড়িই ফিরে আসব।’

হেলেন অন্যদিকে যাওয়ার পর আহনাফ একটা সফট্ ড্রিঙ্কস নিল। সফট্ মিউজিকের সাথে সফট্ ড্রিঙ্কস। দারুণ কম্বিনেশন! এরপর থেকে সে শুধু একবার নয় বরং প্রতিদিনই হেলেনের সাথে বারে আসে। ড্রিঙ্কস করে। আগের তুলনায় এখন সে একটু স্বস্তি পায়। স্বল্প সময়ের জন্য হলেও অনেক কিছু ভুলে থাকতে পারে। রাতে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলেই শান্তি! ঘুম!
.
.
লামিয়া ও জুঁইয়ের বাড়ি ছাদ থেকে গ্রাউন্ড ফ্লোর অব্দি ঝাড়বাতি দিয়ে সাজানো হয়েছে। চারদিকে আলোকসজ্জা। চোখ মেলে তাকানোটাই দুষ্কর। জহির চৌধুরীর কথা মতো অর্ষা কিন্ডারগার্ডেনে জব নিয়েছে। বাচ্চাদের সাথে হেসে-খেলেই তার সময় কেটে যায়। বিয়ের প্রভাব, অথবা সেদিনের ঘটনা; কোনোটাই এখন তার জীবনে প্রভাব ফেলে না। সে এখন দিব্যি আছে। না আছে সাংসারিক চাপ আর না আছে স্বামীর জন্য দুশ্চিন্তা। দুশ্চিন্তা করেই বা কী হবে? মানুষটা তো বহুদূর। তার চেনা এলাকায়। ভালোই আছে নিশ্চয়ই!

দুই বান্ধবীর বিয়ে উপলক্ষে তিনদিন ছুটি নিয়েছে। একদিকে যেমন তার আনন্দ লাগছে অন্যদিকে কষ্টও লাগছে। বিয়ের পর কি ওদের আগের মতো করে আর পাওয়া যাবে? মন খারাপ ও আনন্দ এ দুইয়ের সংমিশ্রণ মনে মিলিয়ে সে আহিলের সাথে বিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে। অর্ষার মন খারাপ আহিলের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় না।

সে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করে,’মন খারাপ কেন তোর?’

‘এমনি ‘

‘এমনি?’

‘হু, এমনি।’

বাড়িতে ঢুকে আশিক আর দিদারকে একসাথে পাওয়া গেল। দুজনের দৃষ্টিই মেয়েদের একটা দলের দিকে। সম্ভবত দুজনে কিছু আলোচনা করছে।

অর্ষা এগিয়ে গিয়ে দু’হাতে দুজনের গালে আস্তে চপেটাঘাত করল। আচানক এমন প্রহারে দুজনেই ধড়ফড়িয়ে ওঠে। মেয়েদের দলটার দিকে তাকিয়ে দিদার চাপাস্বরে বলে,

‘মারধোর করবি ভালো কথা। প্রয়োজনে নিজে লাঠি কিনে দেবো। আড়ালে নিয়ে বেধড়ক পিটাবি। এভাবে মেয়েদের সামনে মারছিস কেন? একটা মান-ইজ্জতের বিষয় আছে না?’

আহিল বলল,’মান-ইজ্জত থাকলে এভাবে হা করে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে আছিস কেন?’

‘বন্ধু তুমি বুঝবা না
আমার মনের বেদনা,
চাইয়া একটু দেখো না;
কী সুন্দর ললনা।’

আশিকের কবিতা শুনে অর্ষা কপাল থাপরায়। আহিলকে বলে,’এই চিড়িয়াগুলোর সাথে তুই থাক। আমি জুঁই আর লামিয়ার কাছে গেলাম।’

লামিয়া এবং জুঁই একই এপার্টমেন্টে থাকে। বাড়ির সামনে থাকা বিশাল বড়ো মাঠের সামনে বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে। রিসিপশনের অনুষ্ঠান হবে কমিউনিটি সেন্টারে। অর্ষা স্টেজের সামনে গিয়ে দেখে জুঁই আর লামিয়াকে দু’পাশে রেখে রেশমি মাঝখানে দাঁড়িয়েছে। ফটোগ্রাফার একের পর এক ছবি ক্লিক করেই যাচ্ছে।

অর্ষাকে দেখে ওরা তিনজনেই উত্তেজনায় লাফিয়ে ওঠে। শুধু ভারী লেহেঙ্গা পরে থাকায় জুঁই আর লামিয়া আসতে পারে না। রেশমি দৌঁড়ে আসতে গিয়ে একজন ফটোগ্রাফারকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়।

বেচারা ফটোগ্রাফার কিছু বুঝে ওঠার আগেই চিৎ পটাং। আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে ফেলে অর্ষা, লামিয়া আর জুঁই। কিন্তু রেশমির কোনো হেলদোল নেই এতে। সে দৌঁড়ে এসে অর্ষাকে জড়িয়ে ধরে। হড়বড় করে বলা শুরু করে,’এতক্ষণে তোর আসার সময় হলো? এতগুলা কাপলের মাঝে নিজেকে কত এতিম এতিম লাগছিল জানিস?’

অর্ষা হেসে বলল,’আর এতিম লাগবে না। চলে এসেছি।’

এরমাঝে বাকি মেয়েদের ‘বর এসেছে, বর এসেছে’ ধ্বনিতে হৈ-হুল্লোড় করতে শোনা যায়। অর্ষা আর রেশমি একে অপরের দিকে তাকিয়ে দৌঁড়ে গেইটের কাছে যায়। ওদের পূর্বেই মেয়েরা গেইট ধরে রেখেছিল।

গ্যাঞ্জাম পার্টির সকলে গিয়ে মিলিত হলো বাকিদের সাথে। শুরু হয় দু’পক্ষের দর কষাকষি। তুমুল তর্ক চলছে দু’পক্ষের মাঝে। আশিকের সাথে বরপক্ষের এক মেয়ের বেশ কথা কাটাকাটি হচ্ছে। এক পর্যায়ে হুট করে আশিক থেমে যায়। ভালো করে তাকিয়ে রেশমির কানে কানে বলে,’দোস্ত দেখ, মেয়েটা সুন্দর না?’

রেশমি তখন চাঁদার টাকা তোলা নিয়ে ব্যস্ত। আশিকের কথা শোনার মতো সময় নেই তার। আশিক নিজেই এবার সবার হট্টগোল থামিয়ে মেয়েটির উদ্দেশ্যে বলল,

‘শোনো সুন্দরী, অপরূপা
যদি আমায় দাও তোমার দিল,
তোমার পক্ষ থেকে মিটিয়ে দেবো আমি সকল বিল।’

ওর কবিতা শেষ হওয়ার সাথে সাথে অর্ষা ও রেশমি দু’পাশ থেকে দুজনে আশিকের দু’গালে থা’প্পড় বসায়। পুরো পরিবেশ এখন থমথমে। বরপক্ষের মেয়েরা মিটমিট করে হাসছে। আশিকের অভিমান হয়। অর্ষা কিংবা রেশমির ওপর নয়; অভিমান হচ্ছে ঐ মেয়েটির জন্য। তাকে দরদ দেখাতে গিয়ে সে নিজে বান্ধবীদের হাতে থা’প্পড় খেল, অথচ মেয়েটি কষ্ট না পেয়ে মুখ টিপে হাসছে! আচ্ছা কষ্ট না পাক, একটু দুঃখী দুঃখী ভান তো করাই যেত। তাই নয় কী?

মেয়েটি দুঃখী না হলেও আশিক মুখটা দুঃখী দুঃখী করে বলল,

‘যার জন্য করলাম চুরি
সে-ই বলল চোর,
আমি আর কিছু বলব না;
অর্ষা, রেশমি তোরা সবাই বরপক্ষকে ধর।’

চলবে…

#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#পর্ব_২২
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। স্কুলের বাচ্চারা আজ কিছুতেই পড়তে চাচ্ছে না। অর্ষার স্কুল জীবনের কথা মনে পড়ে যায়। স্কুলে থাকতে বৃষ্টি হলে ওরা-ও কখনো ক্লাস করতে চায়নি। আসলে বৃষ্টির ঝুমঝুম শব্দে ক্লাসে মন বসতোই না। বান্ধবীরা মিলে জানালার কাছে বসে থাকত। টিচারের অগোচরে জানালার কপাট খুলে রেখে বৃষ্টিতে হাত ছোঁয়াত। কত মধুর ছিল সেই সময়গুলো! এছাড়া তখন ক্লাসেও উৎসব উৎসব একটা ভাব চলে আসতো। বৃষ্টির দিনে খিচুড়ি যেমন অত্যাবশ্যক খাবার মনে হয় তেমনই; ক্লাসে তখন গান গাওয়াটাও ছিল অত্যাবশ্যক। কেউ গান পারুক আর না পারুক তাও গাইতে হতো। গান না পারলেও তখন সমস্যা ছিল না। বৃষ্টির শব্দের কারণে অত মানুষের কান অব্দি গান যেত-ই না। সকলে তো টিনের চালে পড়তে থাকা বৃষ্টির রিমঝিম শব্দই শুনত।

অনেকদিন বাদে স্কুলের পুরনো সময়গুলো স্মৃৃতিচারণ করে আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে অর্ষা। আজ তার ক্লাসেও বাচ্চারা গান গাইছে, হৈ-হুল্লোড় করছে। ওদের মাঝেই যেন নিজের সেই ছোট্ট বেলার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছে সে। সেই সাথে দু’হাত ভরে কুড়িয়ে নিচ্ছে অতীতের সুখ, আনন্দগুলো।

স্কুলের দপ্তরি এসে ক্লাসের দরজার সামনে দাঁড়ায়। অর্ষার উদ্দেশ্যে বলে,’ম্যাডাম, আপনের ভাই আসছে দেখা করতে।’

ভ্রুঁ কুঞ্চিত হয় অর্ষার। এই অসময়ে,বৃষ্টির মধ্যে রুহুলের স্কুলে আসার কারণ কী?

অর্ষা বলল,’বসতে দিন। আমি আসছি।’

দপ্তরি চলে যাওয়ার পর অর্ষা ক্লাসের সকল ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্য করে বলল,’আমি এখনই চলে আসব। তোমরা কেউ বাইরে বের হবে না। আর ক্লাসে একদম চেঁচামেচি করবে না।’

সকলে সমস্বরে বলল,’আচ্ছা ম্যাম।’

‘আচ্ছা ম্যাম’ বললেও যে সবাই দুষ্টুমি, মারামারি, চেঁচামেচি করবে; এমনকি কয়েকজন বাইরেও বের হবে এটা অর্ষা খুব ভালো করেই জানে। সময়টা তো সেও পার করে এসেছে এক সময়।

টিচার রুমে অপেক্ষা করছিল রুহুল। অর্ষাকে ভেতরে যেতে দেখে বলল,

‘বারান্দায় চল।’

অর্ষা আর ভেতরে না গিয়ে বারান্দাতেই গেল। রেলিঙের সাথে দাঁড়িয়ে বলল,’হঠাৎ?’

‘কেমন আছিস?’ জিজ্ঞেস করে রুহুল।

অর্ষা মাথাটা মৃদু নাড়িয়ে বলল,’আলহামদুলিল্লাহ্‌। তুমি?’

‘আমিও আলহামদুলিল্লাহ্‌। কিন্তু একটু সমস্যা হয়েছে। এজন্যই তোর কাছে আসা।’

‘কী হয়েছে?’

‘একটু ঝামেলার মধ্যে আছি। এক মাসে বেশ ঋণ জড়িয়ে পড়েছি। টাকার জন্য মানুষজন চাপ দিচ্ছে খুব।’

‘ঋণ? কী করে ঋণ করলে?’

‘এইতো তোর বিয়ের খরচ, আবার সংসার কত কী!’

‘আমি যতটুকু জানি বিয়ের খরচবাবদ সমস্ত টাকা আহিলের বাবা দিয়েছিল।’

‘ঐ টাকায় কি সব হয়েছে নাকি? ধার করতে হয়েছিল না?’

অর্ষা ভাইয়ের চোখের দিকে তাকায়। কেন জানি মনে হচ্ছে রুহুল মিথ্যা বলছে। আর যাই হোক,বিয়ের খরচের জন্য একটা টাকাও সে নিজের পকেট থেকে দেয়নি। বলা বাহুল্য দিতে হয়নি।

সে দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল,’এখন কী করবে তাহলে?’

‘কী করব? তুই আমাকে সাহায্য করবি।’

‘আমি?’

‘হ্যাঁ। এত বড়ো বাড়িতে বিয়ে হয়েছে। আর ভাইকে টাকা দিয়ে সাহায্য করতে পারবি না?’

‘তুমি বলতে চাইছ আমি তাদের কাছে টাকা চাইব?’

‘প্রয়োজন হলে তো চাইতেই হবে। তুই টাকা চাইলে ওরা তো আর ফিরিয়ে দেবে না।’

‘দেখো ভাইয়া, আমি তাদের থেকে কোনো টাকা চাইতে পারব না। তোমার যদি খুব বেশি প্রয়োজন হয়, তাহলে ক’টা দিন অপেক্ষা করো। আমি বেতন পেলেই পুরো টাকা তোমায় দিয়ে দেবো।’

রুহুল ক্ষেপে যায়। ধমকে ওঠে সে অর্ষাকে। তার গর্জন বৃষ্টির গর্জনের কাছে নস্যি বলে অর্ষা ব্যতীত অন্য কারও কর্ণকুহর অব্দি প্রবেশ করতে পারেনি।

রুহুল চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,’কয় টাকা পাস তুই? সাত হাজার না আট হাজার? ঐ টাকায় আমার কিছুই হবে না। আমার পঞ্চাশ হাজার টাকা লাগবে।’

হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকে অর্ষা। অস্ফুটস্বরে মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে,’পঞ্চাশ হাজার!’

‘হ্যাঁ, পঞ্চাশ হাজার। আপাতত বিশ হাজার নিয়ে দে।’

‘আমি কী বলে তাদের থেকে এত টাকা নেব?’

‘যা খুশি কিছু একটা বলবি।’

একটু থেমে সে অর্ষার হাত ধরে। ইমোশোনাল হয়ে বলে,’প্লিজ বনু! আমার দিকটা একটু ভাব। প্রতিদিন মানুষের কথা শুনতে শুনতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। না করিস না সোনা বোন! ভাইকে সাহায্য কর।’

অর্ষা একটুখানি মৌন থেকে বলল,’আচ্ছা। আমায় দু’দিন সময় দাও।’

‘দু’দিন পর দিবি তো?’

‘হ্যাঁ।’

রুহুল অর্ষার গালে হাত রেখে বলল,’আমার লক্ষী বোন। আসছি এখন।’

এরপর সে ছাতা মেলে স্কুল থেকে চলে যায়। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে অর্ষা। শ্বশুরের থেকে সে টাকা তো নেবে না। বিয়ের সময় আহনাফের আত্মীয়-স্বজন, মেহমান অনেকেই মুখ দেখে,আদর করে টাকা দিয়েছিল। সব মিলিয়ে ষাট থেকে থেকে সত্তর হাজার টাকা হবে সম্ভবত। সে ঠিক করেছে সেখান থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা রুহুলকে দিয়ে দেবে। ভাই তবুও ভালো থাকুক।

অর্ষা ক্লাসে ফিরে যায়। বৃষ্টিও ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। ক্লাস শেষ করে বাড়ির পথে রওনা হয় সে। সব সময়ের মতো আজও রিকশার সংকট দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টি হলে রিকশা কি আকাশের চাঁদ হয়ে যায় নাকি আল্লাহ্ মালুম!

সে কাদা-পানির মাঝে খুব সাবধানে পা ফেলে হেঁটে যাচ্ছে। রাস্তার অপজিট থেকে হঠাৎ কারও ডাক শুনতে পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। একটি ছেলে হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে আসে।

একগাল হেসে অর্ষাকে বলে,’আমায় চিনতে পেরেছ? আমি হাফিজ।’

অর্ষা মৃদু হেসে বলল,’হ্যাঁ। কেমন আছো?’

‘আমি তো আলহামদুলিল্লাহ্‌ ভালো আছি। তুমি কেমন আছো বলো?’

‘আমিও ভালো।’

‘হঠাৎ করে তোমার কী হয়েছে বলো তো?’

‘কই! কিছু না তো।’

‘কিছু না হলে এমন উধাও হয়ে গেছ কেন? শো-রুমে আসো না। কেয়া আপুরও কোনো খোঁজ নেই। তোমায় অনেক খুঁজেছি জানো। ফোন নাম্বারও নেই যে যোগাযোগ করব।’

অর্ষা একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,’আমি তো ফোন ব্যবহার করতাম না।’

‘ওহ, হ্যাঁ! স্যরি ভুলে গেছিলাম। এবার বলো, কাজে কেন আসো না?’

একটুখানি সময় চুপ করে থেকে অর্ষা বলল,’আমার বিয়ে হয়ে গেছে।’

হাফিজ একটু থমকাল। মুখের হাসিটা যেন মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল তার। তবুও সে মিথ্যে হাসার চেষ্টা করে বলল,

‘মজা করছ?’

‘না, মজা কেন করব? সত্যিই বলছি।’

‘হঠাৎ করে বিয়ে! কীভাবে কী? আমি তো কিছুই বুঝতেছি না।’

একটু সময় নিয়ে অর্ষা সংক্ষেপে বিস্তারিত সব বলল। সব শুনে মন খারাপ হয়ে যায় হাফিজের। কিছু বলার মতো ভাষাও খুঁজে পাচ্ছে না।

অর্ষা হাত ঘড়িতে সময় দেখে বলল,’অন্য একদিন কথা হবে হাফিজ। ঐযে ঐ স্কুলটা দেখছ? আমি এখন ওখানেই জব। একদিন সময় করে এসো।’

‘হুম।’

‘আজ তাহলে আসি? আল্লাহ্ হাফেজ।’

‘সাবধানে যেও।’

অর্ষা মৃদু হেসে হাঁটা ধরে। হাফিজ নিষ্পলক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মাথা নত করে। বুকচিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়। আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সেও হাঁটা ধরে। মেয়েটা ভীষণ বোকা! একবারও বুঝতে পারল না, হাফিজের মনে তার জন্য সুপ্ত এক অনুভূতি ছিল। সেই অনুভূতির লাগাম টানতে হবে এবার অতিসত্বর।
.
.
জহির চৌধুরীর শরীর খুব একটা ভালো নয়। বেশ কয়েক দিন ধরেই তিনি বাড়িতে রেস্ট নিচ্ছেন। তার বদলে অফিসের দেখভাল করছে এখন আহিল। আহিল এখনো অদক্ষ। তাই তাকে সম্পূর্ণ সময় গাইড করছে অফিসের বিশ্বস্ত ম্যানেজার। আজকাল আহিলও বিজি অফিস নিয়ে।

অর্ষা সরাসরি আগে জহির চৌধুরীর রুমে যায়। তিনি টিভিতে নিউজ দেখছিলেন।

‘কেমন আছেন এখন?’ ভেতরে যেতে যেতে বলল অর্ষা।

তিনি টিভি অফ করে বললেন,’ভালো আছি মা। বসো। একি! ভিজে গেছ তো অনেকটা।’

‘ও কিছু না। মাত্রই তো এলাম তাই।’

‘বৃষ্টির মধ্যে ভিজে আসার কী দরকার ছিল? ফোন করতে আমায় ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দিতাম।’

‘আপনি অস্থির হবেন না তো। আমি একদম ঠিক আছি।’

‘এখন ঠিক আছো। পরে না-ও থাকতে পারো। যদি জ্বর চলে আসে? ফোন গিফ্ট করলাম পছন্দ হয়নি?’

‘কী যে বলেন! পছন্দ কেন হবে না?’

‘তাহলে ফোনের ব্যবহার কেন করছ না? ফোন দাওনি কেন?’

‘আমি এতকিছু ভাবিনি তখন। এখন আপনি একটু রিল্যাক্স হোন তো।’

‘আমার আর রিল্যাক্স! সবকিছু কেমন যেন হয়ে গেল। বড়ো ছেলেটা একটু খোঁজ-খবরও নেয় না। আমি ফোন করলেও রিসিভ করে না।’

এ কথার পিঠে অর্ষার কিছু বলার নেই বলে সে চুপ হয়ে যায়। জহির চৌধুরী দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলেন,

‘তুমি যাও তাড়াতাড়ি জামা-কাপড় পালটে নাও। পরে কিন্তু ঠান্ডা লেগে যাবে।’

‘যাচ্ছি।’

‘যাচ্ছি নয়, এখনই যাও। ফ্রেশ হয়ে খেয়ে-দেয়ে আসো। তারপর গল্প করব বাপ-বেটি মিলে।’

অর্ষা মুচকি হেসে বলল,’আচ্ছা।’

সে ফ্রেশ হয়ে ডাইনিংরুমে খেতে আসে। আমেনা বেগম ওর জন্যই অপেক্ষা করছিলেন।

অর্ষা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল,’আপনি এখনো খাননি?’

‘ক্ষুধাই লাগে না। কী করি বলো তো!’

‘এভাবে তো আপনিও আরো অসুস্থ হয়ে পড়বেন।’

তিনি আর কিছু বললেন না। অর্ষা সন্তর্পণে জানতে চাইল,’মন খারাপ?’

‘না, ঠিক আছি। তুমি খাও।’

অর্ষা আর কিছু না বলে চুপচাপ খাওয়া শুরু করে। তবুও মনের ভেতর একটা খুতখুতানি রয়েই যায়। খাওয়া শেষ করে তিনি চলে যাওয়ার পর অর্ষা রেণুকে জিজ্ঞেস করে, সে কিছু জানে নাকি।

উত্তরে রেণু হতাশ হয়ে বলে,’বড়ো ভাইজানের চিন্তায় এমন অবস্থা হইছে।’

টেবিল গুছিয়ে সে আবার শ্বশুর-শাশুড়ির রুমের দিকে যায়। আমেনা বেগম জহির চৌধুরীকে বলছিলেন,’এভাবে কী হয় বলো তো? ছেলে বাউণ্ডুলে হয়ে বিদেশে পড়ে আছে। মেয়েটা এখানে ছন্নছাড়া জীবন কাটাচ্ছে। এটা কি সংসার? এভাবে কি ওরা কখনো কেউ কাউকে বুঝতে পারবে?’

‘আমরা কী করতে পারি?’ জানতে চাইলেন জহির চৌধুরী।

‘অর্ষাকে আহনাফের কাছে পাঠিয়ে দেই?’

‘ও কি রাজি হবে? তাছাড়া হিতে যদি বিপরীত হয়?’

‘বিপরীত কী হবে? অর্ষা একবার আহনাফের কাছে গেলে আহনাফ তো আর ও’কে তাড়িয়ে দেবে না। অন্তত আহনাফ এটা কখনোই পারবে না। এই কাজ আমার ছেলে করবে না।’

জহির চৌধুরী চিন্তিত হয়ে বললেন,’এমনটাই সম্ভবত করা উচিত। নয়তো দুজনের জীবনই নষ্ট হয়ে যাবে। আমি তো ভাবছি অর্ষা রাজি হবে কিনা এই নিয়ে।’

‘বুঝিয়ে বললে নিশ্চয়ই রাজি হবে।’

‘আচ্ছা দেখছি। আমি কথা বলব ওর সাথে।’

লুকিয়ে কারও কথা শুনতে হয় না। তবে এ কথাগুলো অর্ষা না শুনেও থাকতে পারেনি। তার কৌতুহলী মন তাকে এখানেই আটকে রেখেছিল। দরজার আড়াল থেকে এ সমস্ত কথা শুনে সে আর ভেতরে যায়নি। নিজের রুমে চলে গেছে।

কিছুক্ষণ রুমে পায়চারি করে ম্যাসেঞ্জারে ‘গ্যাঞ্জাম পার্টির’ গ্রুপে ভিডিয়ো কল করে অর্ষা। একে একে সবাই জয়েন হয়।

আশিক প্রথমেই তার অবান্তর কবিতা দ্বারা কথোপকথন শুরু করে। বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে বলে,

‘অর্ষা তোর দু’চোখে কেন দুশ্চিন্তার বর্ষা?’

রেশমিও বলল,’কী হয়েছে রে অর্ষা? মন খারাপ নাকি তোর?’

দিদার বলে,’মুখটা ওমন করে রাখছিস ক্যান? দুলাভাই কি ডিভোর্স দিছে?’

লামিয়া ধমক দিয়ে বলে,’হারা’মজাদা! লা’ত্থি খাবি। ফালতু কথা বলস ক্যান?’

‘ঐ খাড়া আহিল কই? ব্যাটায় দেখি দশ ঘণ্টা আগে একটিভ ছিল। অফিসেই থাকে নাকি দিন-রাত?’ বলল আশিক।

জুঁই সবাইকে থামিয়ে বলল,’তোরা থাম তো। অর্ষাকে বলতে দে কী হইছে।’

এতক্ষণে কথা বলার সুযোগ পেয়ে অর্ষা বলল,’সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতেছি।’

‘বিস্তারিত বল কী হয়েছে।’

শ্বশুর-শাশুড়ির বলা কথাগুলোই সে বন্ধুদের বলে। সব শুনে ওরাও সায় দেয়। ওরাও অর্ষাকে বুঝিয়ে বলে সম্পর্কটাকে অন্তত একটা সুযোগ যেন দেয় সে। বন্ধুরা এতভাবে বোঝালেও অর্ষার মন দোনোমনা করছিল।
________
দু’দিন পরের কথা। অর্ষা স্কুলে থাকতেই রুহুল ফোন করে। ভাই সচারচর তাকে ফোন করে না। সে তো টাকা যা চেয়েছিল দিয়েছে, তাহলে এখন আবার হঠাৎ ফোন কেন?

সে ফোন রিসিভ করার পর রুহুল অন্য কোনো প্রসঙ্গে না গিয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করল,’তোর স্কুল ছুটি কয়টায়?’

‘তিনটায়।’

‘ছুটির পর বাসায় আসিস। তিয়াসের খুব জ্বর। তোর কথা বলতেছে সকাল থেকে।’

তিয়াস অসুস্থ শুনে বুকটা কেঁপে ওঠে অর্ষার। সে জিজ্ঞেস করে,’হঠাৎ করে জ্বর আসলো কীভাবে?’

‘আর বলিস না, সারাক্ষণ পানি নিয়ে খেলে। তোর ভাবি কাজ করছিল তখন বৃষ্টিতে গিয়ে ভিজেছে।’

‘ডাক্তার দেখিয়েছ?’

‘হ্যাঁ।’

‘আচ্ছা আমি ছুটির পর বাসায় যাব। ক্লাসে আছি এখন। রাখছি।’

‘আচ্ছা ঠিকাছে।’

ফোন রাখলেও মনে শান্তি পাচ্ছিল না অর্ষা। ছোটোবেলা থেকে তিয়াসকে সে রেখেছে। তিয়াসও মায়ের চেয়ে কম ভালোবাসে না অর্ষাকে। পুত্রতুল্য তিয়াস অসুস্থ শুনে মাতৃমন কষ্টে ছেঁয়ে যায় অর্ষার। কোনো রকম সে ক্লাসটা শেষ করে প্রিন্সিপালের থেকে ছুটি নিয়ে নেয়। এভাবে অস্থিরতার সাথে ক্লাস নেওয়া মুশকিল। বাড়ি যাওয়ার আগে সে কিছু ফলমূল আর তিয়াসের পছন্দের চকোলেট নিয়ে নেয়।

বাড়ি গিয়ে দেখে তিয়াস খুব কান্না করছে। কুসুম ও’কে কোলে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে।

অর্ষাকে দেখে কুসুম তিয়াসের উদ্দেশ্যে বলল,’ঐ দেখো কে এসেছে।’

তিয়াস এক পলকের জন্য কান্না থামিয়ে বাড়ির মূল ফটকের দিকে তাকায়। অর্ষাকে পেয়ে তার কান্না পুরোপুরি থেমে যায়। অর্ষাও ততক্ষণে কাছে এসে পড়েছে। সে হাত বাড়িয়ে তিয়াসকে কোলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে।

আহ্লাদী হয়ে বলে,’কী হয়েছে আমার বাবাটার? আমার সোনা বাবা কান্না করে কেন?’

তিয়াস কিছু বলে না। শুধু ঠোঁট ফোলায়। এক্ষুণী আবার কেঁদে দেবে দেবে ভাব। অর্ষা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,’ওলে আব্বুটা! কান্না করে না। দেখো ফুপি তোমার জন্য কী এনেছি।’

সে চকোলেটগুলো দেখায় তিয়াসকে। এবার সে হাসে। চকোলেট নিয়ে খাওয়া শুরু করে। কুসুমের দিকে বাকি ফলমূলগুলো এগিয়ে দিয়ে বলে,’এগুলো ভেতরে নাও ভাবি।’

কুসুম প্যাকেটগুলো নিয়ে ভেতরে গেল। অর্ষা তিয়াসকে নিয়ে বারান্দাতেই রইল। কিছুক্ষণ বাদে কুসুম ফলমূল কেটে আনে। মোড়া এগিয়ে দিয়ে বলে,’বসে খেয়ে নে আগে।’

‘আমার এখন খিদে নেই ভাবি।’

‘ফল খেলে পেট ভরবে না। তোর ভাই যে বলল তিনটায় আসবি। তাই আর কিছু রান্নাও করিনি আমি। ঘরে সকালের রান্না করা ইলিশ মাছের তরকারি শুধু।’

‘স্কুল তিনটা বাজেই ছুটি হয়। তিয়াস অসুস্থ শুনে আমি আগেই ছুটি নিয়ে এসে পড়েছি।’

‘আচ্ছা বোস এখন। ফল খেতে থাক আমি তরকারি গরম করি।’

‘আমি এখন কিছুই খাব না ভাবি।’

কুসুম অবশ্য ওর কথা শুনল না। তরকারি গরম করে চুলায় ভাত বসাল। ভাত বসিয়ে অল্পবিস্তর তিয়াসকে নিয়ে গল্প বলল। ভাত রান্না শেষে ডিম ভাজি করে বলল,

‘তিয়াসকে আমার কাছে দে। তুই হাত-মুখ ধুয়ে আয়।’

কুসুমের হঠাৎ এমন পরিবর্তনে অর্ষা অবাক না হয়ে পারল না। অবাক যেমন হয়েছে, তেমন খুশিও হয়েছে। সে এত বেশি ইমোশোনাল যে, চোখে পানিও চলে এসেছে। তিয়াসকে নেওয়ার জন্য কুসুম হাত বাড়ালেও তিয়াস গেল না।

অর্ষা ও’কে কোলে নিয়েই মুখ ধুয়ে খেতে বসল। নিজের সাথে সাথে তিয়াসকেও খাইয়ে দিচ্ছে।

কুসুম পাশেই বসে ছিল। বলল,’আহনাফের কী খবর? কবে আসবে বলছে কিছু?’

‘না। আমার সাথে কথা হয়নি।’

‘কী বলিস! যাওয়ার পর একবারও কথা হয়নি? এমন হলে সংসার চলবে কীভাবে।’

অর্ষা নিশ্চুপ। কুসুম বলল,’যা হোক, তোর ভাইকে এতগুলো টাকা দিলি কোত্থেকে? তোর শ্বশুর দিছে?’

‘না। ওগুলো বিয়েতে ঐ বাড়ির আত্মীয়-স্বজন, মেহমানরা আমায় দিয়েছিল।’

‘ও।’

একটু থেমে কুসুম ফের বলল,’তোর গলার চেইনটা তো সুন্দর। কে দিয়েছে?’

‘ফুপি।’

‘ওহ। ভালোই তো জিনিস, টাকা-পয়সা পেয়েছিস।’

অর্ষা কৃত্রিম হাসে। সন্ধ্যা অব্দি এই বাড়িতে থেকে তিয়াসকে ঘুম পাড়িয়ে অর্ষাও বিদায় নেয়। শ্বশুরবাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিল বলে, দেরি করে আসায় তারা কোনো দুশ্চিন্তা করেনি।

নাস্তার টেবিলে বসে অনেক ভেবে-চিন্তে আমেনা বেগম এবং জহির চৌধুরী অর্ষার সুইজারল্যান্ডে যাওয়ার প্রসঙ্গ তোলেন।

জহির চৌধুরী চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলেন,’দেখো মা, আমরা কিন্তু তোমাকে জোর করছি না। শুধু রিকোয়েস্ট করছি। রিকোয়েস্ট যে রাখতেই হবে এমনও কোনো কথা নেই। তোমার ইচ্ছে না হলে যাওয়ার দরকার নেই।’

চামচ দিয়ে চায়ের কাপে চা নাড়ছিল অর্ষা। আর চুপচাপ কথা শুনছিল। এই মানুষগুলোর প্রতি সে ভীষণ কৃতজ্ঞ। এছাড়া ঐ মানুষটার প্রতি তার কোনো টান কিংবা অনুভূতি না থাকুক, কাগজে-কলমে তো সে তার স্বামী হয়। তার জন্য না হয় সে সুইজারল্যান্ড গেল-ই।

সে চামচ পিরিচের ওপর রেখে মৃদু হেসে বলল,’আমি যাব।’

আমেনা বেগম কিংবা জহির চৌধুরী কেউই ভাবতে পারেনি অর্ষা যে রাজি হবে। অর্থাৎ অর্ষার সম্মতি তাদের নিকট অপ্রত্যাশিত ছিল।

জহির চৌধুরী সন্তুষ্টচিত্তে অর্ষার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। বললেন,’এই সপ্তাহের মধ্যেই আমি তোমার যাওয়ার ব্যবস্থা করছি।’
______
‘আমার একলা আকাশ থমকে গেছে
রাতের স্রোতে ভেসে
শুধু তোমায় ভালবেসে
আমার দিনগুলো সব রঙ চিনেছে
তোমার কাছে এসে
শুধু তোমায় ভালবেসে।’

গাড়িতে শ্রেয়া ঘোষালের এই গানটি চলছিল। অবশেষে সেই কাঙ্ক্ষিত দিনটি আসে অর্ষার সুইজারল্যান্ড যাওয়ার। সে অনেক বেশি নার্ভাস ফিল করছে। বুকের ভেতর কেমন ঢিপঢিপ শব্দ হচ্ছে। যাওয়ার ডেট এত দ্রুত ফিক্সড করা হয়েছিল যে বন্ধুদের সাথে দেখা করারও সুযোগ হয়নি। এখন তো একেকজন একেক জায়গায় আছে। ওদের ফিরতেও সময় লাগবে। তাই দেখা হলো না।

এয়ারপোর্ট পৌঁছে ইমিগ্রেশন অব্দি অর্ষাকে এগিয়ে দিলেন জহির চৌধুরী। সবকিছু বারবার করে বলে বুঝিয়ে দিয়েছেন। এই প্রথম অর্ষা বাংলাদেশের বাইরে কোথাও যাচ্ছে। একদিকে যেমন ভেতরে ভেতরে উত্তেজনা কাজ করছে, অপরদিকে বেশ ভয়ও লাগছে।

প্লেনে ওঠার পর ভয়ের সাথে নার্ভাসনেসও কাজ করছে। তার মতো আরো অনেক বাঙালিই আছে এখানে। তবে এখানে যে যার মতো। অর্ষার চোখ আটকায় এক কাপলের দিকে। তারা অর্ষার অপজিটে বসেছিল। দুজনে বেশ খুনসুটি করছে। এই দৃশ্য দেখে অর্ষার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে। সে একটা ম্যাগাজিন নিয়ে পড়তে শুরু করে।

বেশ কিছুক্ষণ পর পাশের সেই কাপল মেয়েটির হাত থেকে ফোনটা পড়ে যায় অর্ষার পায়ের কাছে। অর্ষা ফোনটি তুলে দেয়।

মেয়েটি হেসে বলে,’থ্যাঙ্কিউ।’

অর্ষাও মৃদু হেসে বলল,’ওয়েলকাম।’

‘তুমি একা?’ জানতে চাইল মেয়েটি।

অর্ষা ‘হ্যাঁ’ বোধক মাথা নাড়াল। মেয়েটি বলল,’ওহ। কোথায় যাচ্ছ?’

‘সুইজারল্যান্ড।’

‘আমরাও সুইজারল্যান্ড-ই যাচ্ছি। আমি একচুয়ালি জানতে যাচ্ছি, সুইজারল্যান্ডের কোথায় যাচ্ছ?’

‘আমার হাজবেন্ড থাকে ওখানে।’

‘আই সি! আমরা যাচ্ছি হানিমুনে। বাই দ্য ওয়ে, আমি যুথিকা।’ হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল মেয়েটি।

অর্ষাও হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে বলল,’অর্ষা।’

অর্ষা খেয়াল করেছে ছেলেটি যুথিকার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। যুথিকা একবার সেদিকে তাকিয়ে বলল,’বড্ড ঘুমপাগল আমার বর! আবার এমনিতেও কয়েকদিন ধরে বেশ জার্নি করা হয়েছে তো, তাই তেমন ঘুমাতেও পারেনি।’

অর্ষা নিরব থেকে হাসল শুধু। যুথিকা তার বিয়ের গল্প বলল, বাংলাদেশে কোথায় থাকে, কোথায় কোথায় ঘুরেছে সব গল্প করছে অর্ষার সাথে। অর্ষারও শুনতে খারাপ লাগছে না। এটলিস্ট তার সময় তো কাটছে!

প্লেন ল্যান্ড করার পর এয়ারপোর্টেও দুজনের গল্প চলল। অবশেষে যুথিকা ওর হাজবেন্ডকে নিয়ে বিদায় নেয়। এদিকে ইমিগ্রেশন পার হয়ে চারপাশে অর্ষা আহনাফকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। জহির চৌধুরী বলেছিলেন, অর্ষা পৌঁছেই এয়ারপোর্টে আহনাফকে পাবে। কিন্তু তাকে তো কোথাও পাওয়া যাচ্ছে। এত আলোকসজ্জার মাঝে রাত কত হয়েছে সেটাও সে জানে না। আরেকটু এগিয়ে যেতেই ব্যস্তভাবে সামনে আসা এক ছেলের সাথে ধাক্কা লাগে অর্ষার। লাগেজটি হাত থেকে ছিটকে পড়ে। সেই সাথে স্লিপ খেয়ে নিজেও পড়ে যায়।

ছেলেটি ততক্ষণে সামনে এগিয়ে গেলেও আবার পেছনে আসে। অর্ষার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,’আ’ম সো স্যরি।’

অর্ষা ব্যথায় মুখটা বিকৃতি করে একাই উঠে দাঁড়াল। লজ্জিত ভঙ্গিতে একবার আশেপাশেও তাকাল। না, বাংলাদেশের মানুষজনের মতো এরা উৎসুক হয়ে তাকিয়ে নেই।

এদিকে অর্ষা হাত না ধরে একাই উঠেছে বলে ইগোতে লাগে সামনে থাকা ছেলেটির। সে তীক্ষ্ণভাবে অর্ষাকে নোটিশ করে। ব্লু জিন্সের সাথে সাদা রঙের একটা কামিজ পরা। গলায় ওড়না ঝুলানো। পায়ে সাদা কেডস্। গায়ের রঙ শ্যামলা। দেখেই মনে হচ্ছে বাঙালি। বাঙালি একটা মেয়ে তার মতো চকোলেট বয়কে এভাবে অগ্রাহ্য করল? স্ট্রেঞ্জ! নিজে নিজেই এসব ভেবে বিস্মিত হয় হেলেন। সে তো এসেছিল বাংলাদেশ থেকে আসা তার ভার্সিটির এক বান্ধবীকে রিসিভ করতে। হুট করে যে এখানে এই অঘটন ঘটে যাবে তা কে জানত?

সে ব্যাপারটিকে আর না ঘাটিয়ে অর্ষাকে আবার স্যরি বলে চলে গেল। অর্ষাও লাগেজটি তুলে নিয়ে সামনে এগোতে থাকে। তার দু’চোখ শুধু আহনাফকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।

চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]