যেদিন তুমি এসেছিলে পর্ব-২৫+২৬

0
851

#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#পর্ব_২৫
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_______________
অর্ষার জ্বরের রেশ কাটে পরেরদিন সকালে। এখন সে পুরোপুরি নিজেকে সুস্থ অনুভব করছে। বিপত্তি বাঁধে পূর্বে করা তার আচরণের জন্য। না জানি কত কী সে বলেছে, করেছে। বুকভরে শ্বাস নেয় সে। বাংলাদেশে এখনো কারও সাথে যোগাযোগ করা হয়নি। গতকাল রাতে লজ্জায় দৌঁড়ে সেই যে রুমে চলে এসেছে; আর বের হয়নি। আহনাফ অবশ্য দরজার ওপাশ থেকে বলেছিল,’খাবার টেবিলে আছে। খেয়ে মেডিসিন নিও।’

আলসেমিতে অর্ষার ওঠা হয়নি। আর খাওয়া-ও হয়নি। সে চটজলদি ফ্রেশ হয়ে নেয়। সকাল সকাল গোসল করায় শরীর ও মন দুটোই আরো বেশি ফ্রেশ লাগছে এখন। জানালার পর্দা সরিয়ে জানালাটা মেলে দেয়। এক ফালি রোদ্দুরের সঙ্গে তিরতির করে ঘরে প্রবেশ করে মৃদুমন্দ বাতাস। চুল থেকে তোয়ালে খুলে ভালো করে মুছে নেয়। এরপর তোয়ালে কোলে নিয়েই বিছানায় বসে।

হোয়াটসএপে গিয়ে দেখে বন্ধুদের অনেকগুলো ম্যাসেজ এসেছে। আমেনা বেগমও ম্যাসেজ করেছিলেন। শুধু আহিলের কোনো ম্যাসেজ নেই। সে সর্বপ্রথম কলটি ভয়ে ভয়ে আহিলকেই করে। ফোন রিসিভ করার সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায় জেনেও সে কল করে। নিশ্চয়ই অনেক রেগে আছে আহিল। হয়তো আর কথাও বলবে না।

তার চিন্তা-ভাবনাকে মিথ্যে প্রমাণিত করে আহিল ফোন রিসিভ করল। অর্ষা কিছু বলার পূর্বে আহিলই বলল,’কী অবস্থা? কেমন আছিস?’

আহিলের স্বাভাবিক ব্যবহারে ঘাবড়ে যায় অর্ষা। রাগ ঝাড়লে, বকলেই হয়তো একটু স্বস্তি লাগত।

‘শুনছিস?’ বলল আহিল।

অর্ষা আমতা আমতা করে বলল,’হ্যাঁ। আলহামদুলিল্লাহ্‌ ভালো আছি। তুই?’

‘আলহামদুলিল্লাহ্‌। জ্বর কমেছে?’

অর্ষা অবাক হয়। বিস্ময় নিয়ে জানতে চায়,’তুই জানতি?’

‘রেণু আপার কাছে শুনেছি।’

‘তুই কি আমার ওপর রাগ করে আছিস আহিল?’

‘না।’

‘তুই এভাবে কেন কথা বলছিস? আমার ভয় হচ্ছে। তুই আমায় বকা দে, রাগ দেখা। তাও এখন এমন স্বাভাবিক আচরণ করিস না। খুব অভিমান হয়েছে না?’

আহিল একটু হাসল বোধ হয়। বলল,’রাগ-অভিমান সবার ওপর করা যায় না। অধিকার থাকা লাগে। আগে আমরা শুধু বন্ধু ছিলাম। এখন আমাদের অন্য একটা সম্পর্ক হয়েছে। আমার আপন ভাইয়ের ওয়াইফ তুই। বন্ধুত্বের অধিকার মিইয়ে গেছে এখন। তোর সংসার, স্বামী এখন প্রায়োরিটির শীর্ষে। একটা বিবাহিত মেয়ের জীবনে এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। এটা নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। শুধু আফসোস একটা জায়গাতেই! আমার রাগকে দেখতে গিয়ে, আমার ভালো চাওয়াটা কেউ দেখলি না। আমি নিশ্চয়ই কখনো তোর খারাপ চাইনি। এখনো চাই না। ভাইয়ার সাথে তোর বিয়েটা যেভাবেই হোক না কেন, আমিও চাই তুই ভাইয়ার সাথে সুখী হ। আমার ভাইয়া মানুষটা অনেক ভালো। হয়তো পরিস্থিতি ও’কে, তোকে অনেকটা বদলে দিয়েছে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে।’

অর্ষা নিরুত্তর। কিছুক্ষণ দু’পাশেই নিরবতা বজায় থাকে। এরপর আহিলই বলল,’অফিসে আছি। রাখছি এখন। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করিস। ভালো থাকিস। আল্লাহ্ হাফেজ।’

ফোন কাটার পরও অর্ষা কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকে। অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছে সে। সত্যিই তো, কী হতো একটাবার যদি সাহস করে আহিলকে সব জানাতো সে? সারাটা জীবন সে বোকাই রয়ে গেল।

বুকভরে শ্বাস নিয়েও মনে শান্তি মিলছে না। কোথায় যেন একটা শূন্যতা। পরাণ টিকছে না তার এই দেশে। নিঃসন্দেহে সুইজারল্যান্ড অপরূপ একটি দেশ। কিন্তু তবুও; নিজের জন্মভূতি, নিজের মাতৃভূমির প্রতি যেই টান, ভালোবাসা প্রতিটি মানুষের মনে রয়েছে তার কাছে তো অপার সৌন্দর্যও নস্যি। তবে হ্যাঁ,দেশের প্রতি এত টান থাকারও হেতু রয়েছে। বিশেষ হেতুটিই হচ্ছে প্রিয়জন, প্রিয় মানুষ। অর্ষার প্রিয় মানুষ বলতে শুধু গ্যাঞ্জাম পার্টির সদস্য, কেয়া আর তিয়াস-ই ছিল। কেয়া যে কোথায় আছে, কেমন আছে সেটাও সে জানে না। অন্যদিকে ভাই-ভাবিকে সে বিশেষ প্রিয় ভাবলেও ওরা তো প্রতিটা মুহূর্তে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিত; আপন হয়েও তারা ঠিক কতটা পর! আর এভাবেই এই দুটি আপন মানুষের মনের আঙিনা থেকে ধীরে ধীরে বিলুপ্তি ঘটেছে। সম্প্রতি সে সুইজারল্যান্ড আসার পর আরো কিছু প্রিয় মানুষের শূন্যতা উপলব্ধি করতে পারছে। এর মাঝে রয়েছে জহির চৌধুরী, আমেনা বেগম, রেণু আপা আর স্কুলের বাচ্চারা। বাচ্চাগুলো যখন শুনল, অর্ষা চাকরীটা ছেড়ে দিয়েছে তখন কত অনুনয়বিনয়-ই না করেছিল ওরা! বারবার অনুরোধ করে বলেছিল, অর্ষা যেন স্কুল থেকে চলে না যায়। মন চাইলেও কি আর সব অনুরোধ রাখা যায়? যায় না। আসলে সম্ভব হয়ে ওঠে না। পারতপক্ষে অর্ষার পক্ষেও বাচ্চাগুলোর অনুরোধ রাখা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

বিছানা ছেড়ে উঠে ভেজা তোয়ালেটা বারান্দায় মেলে দেয় সে। এরপর ফোন করে আমেনা বেগমকে। তিনি দু’বার রিং হতেই ফোন রিসিভ করেন। হয়তো ফোন তখন হাতেই ছিল।

উৎকণ্ঠিত হয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন,’অর্ষা মা! তুমি ভালো আছো?’

‘মা’ ডাকটা সে যতবার জহির চৌধুরী এবং আমেনা বেগমের মুখে শোনে, ততবার তার অন্তর প্রশান্তিতে ছেঁয়ে যায়। মনে হয় এরচেয়ে শ্রুতিমধুর ডাক আর কিছু কখনো হতেই পারে না।

অর্ষা ক্ষীণস্বরে বলল,’আলহামদুলিল্লাহ্‌ আমি ভালো আছি। আপনারা ভালো আছেন?’

ওপাশ থেকে দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনা গেল। তিনি বললেন,’আমাদের আর ভালো থাকা। দুশ্চিন্তায় নাওয়া-খাওয়া’ও ঠিকমতো হয়নি। তুমি সত্যিই ভালো আছো বলো?’

‘হ্যাঁ, আন্টি।’

‘আমি ভিডিয়ো কল দিচ্ছি।’

তিনি কল কেটে ভিডিয়ো কল দিলেন। স্নিগ্ধ অর্ষাকে দেখে এতক্ষণ বাদে মনে হলো তার বুকের ওপর থেকে ভারী পাথরটা নেমে গেছে। তিনি নিরব থেকে কিছুক্ষণ শুধু তাকিয়েই রইলেন। অস্বস্তি ফিল হলেও অর্ষাও চুপ করে রইল।

মুগ্ধ কণ্ঠে আমেনা বেগম বললেন,’মাশ-আল্লাহ্! আমার মেয়েটা কী ভীষণ সুন্দর!’

অর্ষা বেশ লজ্জা পেল। সরাসরি প্রসংশা যেকোনো মানুষকেই লজ্জায় ফেলতে সক্ষম। সেই সময়ে দরজায় টোকা পড়ে। অর্ষা ফোন হাতে নিয়েই দরজা খুলে দেয়। আহনাফ এসেছে।

ফোনের ওপাশ থেকে আমেনা বেগম জিজ্ঞেস করলেন,’কে এসেছে?’

অর্ষা আবারও আগের জায়গায় এসে বসে বলল,’আপনার ছেলে। দেবো?’

‘না। ওর সাথে পরে কথা বলতে পারব। আগে তোমার সাথে বলি। সকালে খেয়েছ তুমি?’

‘না। একটু আগেই ঘুম থেকে উঠলাম।’

‘কত বাজে খেয়াল করেছ? এখনো খাওনি কেন? খাওয়া-দাওয়ায় কিন্তু ফাঁকিবাজি চলবে না একদম।’

অর্ষা মৃদু হেসে বলল,’আচ্ছা।’

‘তোমার জ্বর কমেছে?’

‘হ্যাঁ। আঙ্কেল কোথায়?’

‘সে আজ অফিসে গেল। জরুরী একটা মিটিং আছে। তোমার সাথে কথা বলবে বলে কাল অনেক রাত অব্দি জেগে ছিল।’

এ কথা শুনে অনুশোচনায় দগ্ধ হয় অর্ষা। বিমর্ষস্বরে বলে,’স্যরি আন্টি। শরীরটা খুব খারাপ লাগছিল, তাই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।’

‘ধুর পাগলী! সে অফিস থেকে এলে আমি ফোন দেবো তোমায়।’

‘আচ্ছা। আপনি খেয়েছেন সকালে?’

‘হ্যাঁ, মা।’

‘রেণু আপা কেমন আছে?’

‘ভালো আছে। কথা বলবে?’

‘হ্যাঁ।’

আমেনা বেগম রেণুকে ডেকে দিলেন। রেণু ভীষণ-ই খুশি হয়েছে, অর্ষা তার সাথে কথা বলতে চেয়েছে বলে।

সে হাসি হাসি মুখে জিজ্ঞেস করল,’আপা ভালা আছেন?’

অর্ষাও মৃদু হেসে বলল,’হ্যাঁ। আপনি ভালো আছেন?’

‘হ। তয় আপনের কথা অনেক পড়ে। বাড়িডা আবার খালি হইয়া গেল।’

অর্ষা গোপনে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,’আমিও আপনাদের সবাইকে অনেক মিস করি রেণু আপা।’

অর্ষা কথা বলতে বলতেই খেয়াল করেছে আহনাফ তৈরি হচ্ছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যখন পারফিউম স্প্রে করছিল শরীরে তখন অর্ষার মাথা ঘুরে যাওয়ার জোগার। না, আহনাফের সৌন্দর্যে নয় বরং সে পারফিউমের ঘ্রাণে মুগ্ধ। মাতাল করা ঘ্রাণ! বারবার কথার তাল কেটে যাচ্ছিল তার। সে আরো কিছুক্ষণ কথা বলে কল কেটে দেয়।

হঠাৎ করেই তার পূর্বের বেশকিছু কথা মনে পড়ে যায়। যেখানে আহনাফ তার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিল। অর্ষা মানে, আহনাফ পরিস্থিতির শিকার বলেই এমন ব্যবহার করে ফেলেছিল। কিন্তু তবুও মন তো সেসব মানে না। সে তো এক রাশ বিষণ্ণতা নিয়ে চুপটি করে বসে থাকে। এখানে আসার পর অবশ্য আহনাফ তার অনেক টেক-কেয়ার করেছে। এতেই আহনাফের ওপর থেকে অর্ধেক অভিমান তার উবে গেছে।

আহনাফ শার্টের হাতা ফোল্ড ফোল্ড করতে করতে অর্ষাকে জিজ্ঞেস করল,’কাল রাতে খাওনি কেন?’

অর্ষা গম্ভীর হয়ে বলল,’ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।’

অর্ষাকে হঠাৎ গম্ভীর ও চুপচাপ দেখে আহনাফ পূণরায় প্রশ্ন করে,’কী হয়েছে?’

অর্ষা প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকায়। আহনাফ পাশের চেয়ারে বসে। ফোন চাপতে চাপতে বলে,’কাল তো বেশ চঞ্চল ছিলে দেখলাম। আজ কী হলো?’

‘কিছু না।’

‘মন খারাপ?’

‘তেমন কিছু নয়।’

‘তোমরা মেয়েরা একেক সময় একেক রকম বর্ণ ধারণ করো। বোঝাই মুশকিল হয়ে পড়ে।’

‘বুঝলাম না।’

‘কিছু না। আমি অফিসে যাচ্ছি। কিছুক্ষণ পর একজন মেইড আসবে। সে আমার পুরাতন মেইড ছিল। এখন থেকে এখানেই থাকবে। কিছু প্রয়োজন হলে তাকে বলবে।’

‘তাকে ছাড়িয়েছিলেন কেন?’

‘অফিসের কাজে একেক সময় একেক জায়গায় থাকতে হতো তাই প্রয়োজন হয়নি। এখন তোমার দেখাশোনা করার জন্য হলেও কাউকে দরকার। আমি তো অফিস বাদ দিয়ে সবসময় বাসায় থাকতে পারব না। তোমার যা-ই দরকার হোক না কেন, তাকে বলবে। আমি আজ তাড়াতাড়িই ফিরে আসব।’

‘আচ্ছা।’

আহনাফ চলে যাওয়ার সময় অর্ষা পিছু ডেকে বলে,’আপনার বিড়ালটাকে বলবেন হুটহাট যেন আমার কাছে না আসে।’

আহনাফ ভ্রুঁ কুঁচকে তাকায়। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে বলে,’কিছুক্ষণ পর হানি এসে নিয়ে যাবে। আমি অফিস থেকে ফেরার পর আবার নিয়ে আসব।’

এই হানিটা আবার কে জিজ্ঞেস করার পূর্বেই আহনাফ চলে যায়।
সে উঠে গিয়ে দরজা লক করে আবার ফিরে আসে। খিদে পেয়েছে ভীষণ। কিছু খাওয়াটা জরুরী। সে ডাইনিং টেবিলে দেখে, আহনাফ নাস্তা বানিয়ে ঢেকে রেখে গেছে। বাটার লাগানো ব্রেড, ডিম পোচ, জুস আর দুধ। এছাড়া এমনিতে ফলমূল তো আরো আছেই। সে একটা ব্রেড আর জুস খেয়ে উঠে যাচ্ছিল তখন কলিংবেল বাজে। সে ডোর গ্লাসে দেখতে পায় অতিরিক্ত ফরসা করে মাঝ বয়সী এক মহিলা। তার সাথে রয়েছে ৬/৭ বছর বয়সী একটা ছেলে।

অর্ষা দরজা খুলে দিতেই মহিলাটি তার পরিচয় দিলো। অর্থাৎ ইনিই আহনাফের বলে রাখা সে মেইড। দরজা থেকে সরে দাঁড়ায় অর্ষা। মহিলাটি ব্যাগ নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। ভদ্রতাসূচক অর্ষা ওদের জন্য দুটো গ্লাসে জুস নিয়ে আসে।

মহিলাটি ভীষণ খুশি হয়। অর্ষার বেশ প্রসংশাও করে। অর্ষা বিনয়ের সাথে ওদের বলল,’আপনারা নাস্তা করেছেন?’

ছেলেটি তুর্কিশ ভাষায় বলল,’না। আমি ভীষণ ক্ষুধার্ত।’

এই ভাষা অর্ষার বোধগম্য হলো না। মহিলাটি তখন ইংলিশে ট্রান্সলেট করে বললেন,’আমরা তুর্কিশ তো তাই এই ভাষায় কথা বলি। তোমার সাথে ইংরেজিতেই বলব সমস্যা নেই। ওর খিদে পেয়েছে, এটাই বলেছে।’

অর্ষা হেসে ওদেরকে খেতে নিয়ে গেল। কথা বলে জানতে পারল মহিলাটির নাম লিলিয়া আর ছেলেটির নাম স্মিথ। হাজবেন্ডের সাথে থাকে না সে। ছেলে নিয়ে আলাদাই থাকে। ওদের সাথে গল্পের মধ্যিখানে আরো একবার দরজায় টোকা পড়ে।

অর্ষা দরজা খুলে দেখতে পায় ফুটফুটে পুতুলের মতো একটা বাচ্চা মেয়ে। কালো একটা ফ্রক পরেছে। মনে হচ্ছিল যেন স্বর্গের পরী। বাচ্চাটি পরিচয় দিয়ে বলল,’হাই! আমি হানি।’

অর্ষাও হেসে প্রত্যুত্তর করল,’আমি অর্ষা।’

‘আমি তোমার কথা জানি।’

অর্ষা ভারী অবাক হয়ে বলল,’তাই নাকি? কে বলেছে আমার কথা?’

‘আহনাফ ভাইয়া।’

‘ওহ আচ্ছা।’

‘ক্যাথিওন কোথায়? আমি ও’কে নিতে এসেছি।’

অর্ষাও ভাবছে, সত্যিই তো? বিড়ালটাকে তো সে সকাল থেকে কোথাও দেখল না। গেল কোথায়?

সে শুকনো মুখে বলল,’আমি তো জানি না।’

লিলিয়া তখন বলল,’তুমি ভয় পাও বলে ক্যাথিকে পাশের রুমে আটকে রেখেছে।’

অর্ষা অবাক হয়। আবার একটু ভালোও লাগছে ওর কথা আহনাফ ভাবছে বলে। অন্যদিকে বেচারা ক্যাথির জন্য একটু মায়াও লাগছে।

হানি দরজা খুলে ক্যাথিকে নিয়ে আসে। অর্ষার থেকে বিদায় নিয়ে নিজের বাড়িতে চলে যায়। আহনাফ যেই রুমে গত দু’রাত থেকেছিল সেই রুমেই এখন থেকে লিলিয়া আর স্মিথ থাকবে। অর্ষার মনটা বিষন্ন হয়ে যায়। আহনাফের রুমে তো কোনো সোফাও নেই। তাহলে সে কোথায় ঘুমাবে? ফ্লোরে?

লিলিয়া অর্ষাকে বলল,’তোমার শরীর এখনো দুর্বল আছে। তুমি গিয়ে রেস্ট নাও।’

অর্ষা ঘরে ফিরে এলো। এবার বন্ধুদের সাথে কথা বলা প্রয়োজন। সে প্রথমে হোয়াটসএপে একটা গ্রুপ খুলে সবাইকে এড করে। তারপর ম্যাসেজ লিখে,’কেমন আছিস তোরা?’

রেশমি লিখে,’বেয়া’দব! এতদিন পর কথা হচ্ছে কল না দিয়ে টেক্সট করছিস কেন?’

আশিক লিখল,’হ্যাঁ, হ্যাঁ। ভিডিয়ো কল দে। দেখি তোরে।’

‘ইয়েস আমিও দেখতে চাই। খেয়ে খেয়ে কি মোটা হয়ে গেছিস তুই?’ লিখল দিদার।

দিদারের রিপ্লাইতে জুঁই লিখল,’তোর খাওয়া-দাওয়া ছাড়া আর কোনো কথা নাই মুখে?’

লামিয়া বিরক্ত হলো। কথা বাড়াতে না দিয়ে ভিডিয়ো কল দেয়। একে একে সবাই জয়েন হয়। অর্ষা ভেবেছিল, আহিল হয়তো আসবে না। এখানেও সে অর্ষাকে ভুল প্রমাণিত করে। সেও জয়েন হয়।

সবার উদ্দেশ্যে বলল,’আমি অফিসে আছি। ফাইল দেখছি। তোরা কথা বল, আমি লাইনেই থাকব।’

আহিল কথা বলুক বা না বলুক, ওদের সাথেই যে থাকবে এতেই সকলে খুশি। মিউট করে ফোনটা ডেস্কের ওপর রাখে আহিল। আর নিজের কাজে মনোনিবেশ করে।

লামিয়া অর্ষাকে বলে,’চোখমুখ এমন শুকিয়ে গেছে কেন বোকারানী?’

অর্ষা বলল,’জ্বর এসেছিল।’

‘এখন কেমন আছিস?’

‘ভালো। তোদের কী অবস্থা?’

সবাই বলল,’আমরাও ভালো আছি।’

অর্ষা জুঁইয়ের উদ্দেশ্যে বলল,’তুই কি রান্না করছিস নাকি?’

‘হ্যাঁ, রে।’

আশিক পিঞ্চ মেরে বলল,’ঠিকই আছে। আর কত বসে বসে খেতে চাস? কাজ করে খা।’

জুঁই ধমক দিয়ে বলল,’বেদ্দপ তুই চুপ কর! এই বাড়িতে কাজের লোক আছে বুঝেছিস। কিন্তু আমার রান্না করতে ভালো লাগে তাই আমিই রান্না করি।’

দিদার বলল,’ওরে বাপরে! কোনো জন্মে তো আমগোরে রান্না করে খাওয়াইলি না।’

রেশমিও সাপোর্ট দিলো দিদারকে। বলল,’হ্যাঁ, তাই তো!’

জুঁই আমতা আমতা করে বলল,’সমস্যা কী, খাওয়াবোনে একদিন। এখন তোরা চুপ কর তো। অর্ষার সাথে কথা বলতে দে।’

আশিক বাঁধ সেজে বলল,’তুই চুপ কর। অর্ষার সাথে আমার গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা আছে।’

‘এই বা’লগুলা ভিডিয়ো কলে আইসাও পারলে মারামারি করে। অ’সভ্যগুলা! আমারে সুযোগই দিতাছে না।’ বিরক্ত হয়ে বলল লামিয়া।

ওর কথা অবশ্য কেউই আমলে নিলো না। আশিক বলল,’অর্ষা শোন।’

‘শুনছি,বল।’ বলল অর্ষা।

‘তুই যখন সুইজারল্যান্ড থেকে দেশে আসবি তখন আমার জন্য একটা কম্বল আনিস।’

সবাই ওর কথা শুনে হাসতে শুরু করে। আশিক ধমক দিয়ে বলে,’আশ্চর্য! তোরা হাসছিস কেন?’

জুঁই কেবিনেটের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে হাসতে হাসতে বলে,’এতকিছু থাকতে শেষমেশ কম্বল আনতে বললি?’

‘জুঁই, চুপচাপ রান্না কর তুই
নয়তো জোর করে দিবো খাওয়াই,
কাঁচা মাছ রুই।’

জুঁই বমি করার ভান ধরে বলল,’ইয়াক! আঙ্কেলের বাচ্চা খাচ্চো’র, পিশাচ!’

আশিক যেন শুনেও শুনল না এমনভাবে সকলের উদ্দেশ্যে বলল,’দাঁত-কপাটি বের করে না হেসে আমার কথা শোন সবাই। সামনে তো শীত আসতেছে। আমার তো আর বউ নাই। সো, শীতে কম্বল-ই আমার মতো মিসকিনদের সম্বল। ক্লিয়ার?’

সকলে সমস্বরে হেসে বলল,’ক্লিয়ার।’
.
সবার সাথে কথা বলেও অর্ষার হাতে ছিল অফুরন্ত সময়। কী করে সময় কাটাবে সেটা সে কিছুতেই বুঝতে পারছিল না। তাই ঘর থেকে বের হয়। লিলিয়া রান্নাঘরে ছিল। অর্ষাকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘কিছু খাবে?’

অর্ষা দু’দিকে মাথা নেড়ে বলল,’না।’

সে ড্রয়িংরুমের দিকে পা বাড়াল। সোফায় পায়ের ওপর পা রেখে স্মিথ আধশোয়া অবস্থায় বসে ছিল। ওর হাতে একটা গল্পের বই। খুবই মনোযোগ দিয়ে সে বইটি পড়ছিল বলে মনে হচ্ছে অর্ষার। সে স্মিথের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে গলা পরিষ্কার করে কাশি দিলো।

স্মিথ চোখ তুলে তাকায়। অর্ষাকে দেখে সোজা হয়ে বসে। অর্ষা হেসে ওর সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করে।

ওর পাশে বসে জিজ্ঞেস করে,’তুমি কি পড়াশোনা করো?’

স্মিথ মাথা নেড়ে বলল,’হুম। ক্লাস ওয়ান।’

‘ওহ। বাইরে যাবে? আমি তো এখানকার কিছু চিনি না।’

‘দূরে যাওয়া যাবে না। স্যারের নিষেধ আছে।’

‘স্যার কে?’

‘আহনাফ স্যার।’

স্মিথ আহনাফ বলল ঠিকই, তবে নামটা শোনা গেল ‘আনাফ’। অর্থাৎ উচ্চারণের সময় ‘হ’ উহ্য ছিল।

অর্ষা ঠোঁট উলটে বলল,’ওকে। ছাদে তো যাওয়া যাবে?’

স্মিথ বলল,’হ্যাঁ।’

স্মিথ অর্ষাকে সাথে করে বাইরে নিয়ে গেল। বাড়ির পেছনের দিকটায় ছাদে যাওয়ার জন্য সিঁড়ি রয়েছে। লোহার তৈরি পাকানো সিঁড়ি। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার সময় আনন্দ অনুভব করছিল অর্ষা। তার তো বেশ ভালোই লাগছিল। ছাদে উঠতেই দমকা বাতাসে জামা-কাপড়, চুল ওড়া শুরু করে। বাতাসের তোড়ে তো নিজেই স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না।

ঝলমলে রোদের আলোয় সুইজারল্যান্ডের প্রকৃতির সৌন্দর্য যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। দূর-দূরান্তের যেদিকে দৃষ্টি যায়, সেদিকেই বিশালাকৃতির সবুজ মহিরুহে ঘেরা। অকস্মাৎ বাতাসে তার ওড়নাটি উড়ে নিচে পড়ে যায়। তড়িঘড়ি করে সে এবং স্মিথ রেলিঙের কাছে যায়। ঝুঁকে নিচে তাকিয়ে দেখে আহনাফ মাথা উঁচু করে ছাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আর ওড়নাটি পড়ে আছে তার পায়ের সামনে।

আহনার কটমট করে তাকিয়ে বলে,’দুপুরবেলা ছাদে কী? তাও আবার রোদের মধ্যে। নিচে নামো জলদি।’

অর্ষা স্মিথকে নিয়ে দ্রুত নিচে নেমে আসে। আহনাফ ততক্ষণে ওড়নাটি তুলে হাতে নিয়েছে। অর্ষা আসতেই ওর হাতে দিয়ে বলল,’ভেতরে যাও।’

অর্ষাও বিনাবাক্যে স্মিথকে নিয়ে ভেতরে চলে যায়। মিনিট পাঁচেক পরে আহনাফ ক্যাথিওনকে সাথে নিয়ে ফিরে এলো। ও’কে দেখেই অর্ষার জানকারি, পানকারি শুরু হয়ে যায়। সে খেয়াল করেছে, ক্যাথিওনকে এড়িয়ে চলতে চাইলেও পারে না। বিচ্ছু বিড়ালটা ঠিক ওর পেছন পেছন-ই ঘোরে। অসহ্যকর!

এই যেমন এখন সে ঠিক অর্ষার মুখোমুখি বসে আছে সেন্টার টেবিলের ওপর। অর্ষা বসে আছে সোফায়। উঠে যে রুমে যাবে সেটাও পারছে না। এর দুটো কারণ রয়েছে। প্রথমত, রুমে এখন আহনাফ রয়েছে। সেও যদি এখন রুমে যায়, তাহলে আহনাফ ভাবতেই পারে অর্ষা তার পিছু পিছু ঘুরছে। কিন্তু এই ভাবনাটা তো আর সত্য হবে না। সে যদি যায়, তবে এই পাজি বিড়ালটার জন্যই যাবে। দ্বিতীয় কারণটা হচ্ছে, ক্যাথিওন নিজেই। ওর ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে অর্ষা বসা থেকে ওঠা মাত্রই ক্যাথিও ওর পিছু নেবে। এতে অর্ষার ভয় আরো বাড়বে। তাই সে একদম উপায়ান্তরহীন হয়ে অসহায়ের মতো ড্রয়িংরুমের সোফাতেই বসে রইল।

অর্ষা প্রায় বিরক্ত হয়ে ফিসফিস করে ক্যাথিওনকে বলল,’ওভাবে তাকিয়ে আছো কেন অ’সভ্য, বেয়া’দব বিল্লি! নেহাৎ ভয় পাই বলে তোমার অত্যাচার সহ্য করছি। নয়তো কান দুটো টেনে বুঝিয়ে দিতাম আমি কী! না, তাও পারতাম না। মারতে গেলেও মায়া লাগত।’

ক্যাথি ম্যাউ ম্যাউ করে উঠে।

অর্ষা বলে,’কিছু বললেই ম্যাউ ম্যাউ করে উঠবে না তো! এই দুইটা শব্দ দ্বারা তুমি সবসময় কী বোঝাতে চাও? শোনো, তোমার মালিক যেমন তুমিও তেমন। কথা নেই, বার্তা নেই শুধু গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে থাকো। খবরদার বলছি, আমার পিছু নেবে না।’

কথাগুলো বলে সে সাহস সঞ্চয় করে উঠে দাঁড়ায় রান্নাঘরে যাবে বলে। ক্যাথিই বা কম কী? সেও অর্ষার পিছু নেয়। রান্নাঘরের কেবিনেটের ওপর উঠে আগে গিয়েই বসে থাকে। অর্ষা খেয়াল না করে সেখানে হাত রাখতে গিয়ে ক্যাথির মাথায় চাপ পড়ে। ক্যাথি সাথে সাথে অর্ষার হাতে নখের আঁচড় বসায়। ব্যথায়, ভয়ে চেঁচিয়ে ওঠে অর্ষা। লিলিয়া রান্নাঘরেই ছিল। সে এগিয়ে আসে অর্ষার কাছে। চিৎকার শুনে আহনাফ আর স্মিথও রান্নাঘরে ছুটে আসে।

নখের আঁচড়ে রক্ত বেরিয়ে গেছে। আহনাফ বিস্মিত হয়ে বলল,’হাতে কী হয়েছে?’

উত্তর দিলো লিলিয়া। সে বলল,’বিড়াল খাঁমচি দিয়েছে।’

আহনাফ তড়িঘড়ি করে অর্ষাকে বেসিনে নিয়ে এলো। ট্যাপ ছেড়ে পানির নিচে ক্ষতস্থান রাখল। আঁচড় দেওয়া স্থানটি জ্বলছিল ভীষণ। অনেকক্ষণ এভাবে রেখে পানি শোষণকারী ব্যান্ডেজ দিয়ে ক্ষতস্থানে হালকা চাপ দিয়ে অল্প যেই রক্তটুকু ছিল সেগুলো মুছে ফেলে।

ক্যাথিও সেখানেই ছিল। অর্ষার ভীষণ রাগ হচ্ছিল বিড়ালটির ওপর। আহনাফ জিজ্ঞেস করল,’এখনো কি জ্বলছে?’

অর্ষা মিইয়ে যাওয়া গলায় বলল,’তেমন না।’

‘কমে যাবে। না কমলে বলবে, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।’

‘হুম।’

আহনাফ এবার অবাক করা একটা কাণ্ড করল। ক্যাথিওনকে কোলে নিয়ে সে বাড়ির বাইরে রেখে এলো। অর্থাৎ বাড়ির দরজার সামনে রেখে দরজাটি লাগিয়ে দিলো।

অর্ষা অবাক হয়ে জানতে চাইল,’ও’কে বাইরে রাখলেন কেন?’

‘এটা ওর শাস্তি।’

‘শাস্তি! প্রাণীদেরও কেউ শাস্তি দেয় নাকি? তাছাড়া ও’কে যে শাস্তি দিচ্ছেন, ও বুঝবে?’

‘বুঝবে। ও’কে নিয়ে তোমার এত টেনশন করা লাগবে না। তুমি নিজের খেয়াল রাখো।’

আহনাফ রুমে চলে যাওয়ার পর অর্ষা অসহায়ভাবে লিলিয়ার দিকে তাকায়। লিলিয়ার এখানে কিছু করার নেই। তাই সেও একবার অসহায়ভাবে অর্ষার দিকে তাকিয়ে আবার কিচেনে চলে যায়। ড্রয়িংরুমে এখন শুধু স্মিথ আর অর্ষা।

স্মিথ বলল,’ক্যাথিওন খুব ভালো। ও কখনো কাউকে কামড় বা খামচি দেয় না। তোমাকেও হয়তো ইচ্ছে করে দেয়নি।’

অর্ষা হতাশসুরে বলল,’কী জানি!’

একটু থেমে ফের চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,’কিন্তু এই বিড়ালটা কেন সবসময় আমার পিছু পিছু ঘোরে?’

স্মিথ হাসে। অর্ষা খেয়াল করল, হাসলে বাচ্চাটিকে অসম্ভব সুন্দর লাগে। স্মিথ হাসতে হাসতে বলল,’তোমাকে মনে হয় ক্যাথির ভালো লাগে।’

‘কী জানি!’ ঠোঁট উল্টাল অর্ষা।

অনেকক্ষণ সে স্মিথের সাথে ড্রয়িংরুমেই বসে থাকে। বিড়ালটি কী করছে দেখার জন্য দরজার পাশে থাকা জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। দেখতে পায় ক্যাথি দরজার সামনে চুপচাপ বসে আছে। এবার মায়া হলো অর্ষার।

সে চুপিচুপি দরজা খুলে বাইরে যায়। ক্যাথির সামনে বসে বলে,’আমায় খামচি দিয়ে কাজটা কি ঠিক করেছ বলো? দেখলে এখন শাস্তি হিসেবে বাইরে থাকতে হচ্ছে।’

ক্যাথি তাকিয়ে আছে অর্ষার দিকে।

‘ওভাবে তাকিয়ে থেকে লাভ নেই। আবার খামচি দেওয়ার কথা ভাবলে বাড়ি ছাড়া হতে হবে বুঝেছ?’

একটুখানি চুপ থেকে বলল,’এমনিতে তুমি অনেক কিউট আছো। দেখলে আদর করতে মনে চায়। আবার ভয়ও লাগে। যাই হোক, এই মুহূর্ত তোমার জন্য আমার মায়া হচ্ছে। তাই তোমাকে বাড়িতে ঢুকতে দিচ্ছি। যাও ভেতরে যাও।’

ক্যাথি তখনো শুধু তাকিয়েই রইল। অর্ষা বলল,’কী হয়েছে? যাও।’

ক্যাথি তাও নড়ল না। অর্ষা এবার হাত দিয়ে ইশারা করে বলল,’হুশ, হুশ যাও। ভেতরে যাও হুশ।’

ক্যাথির তবুও কোনো হেলদোল না দেখে বিরক্ত হলো অর্ষা। ধরে যে ভেতরে নিয়ে যাবে তাও তো ভয়ে পারবে না। তারচেয়েও বড়ো কথা যদি আবারও খামচি দেয়?

ওর চিন্তা-ভাবনায় পানি ঢেলে আহনাফ সেখানে উপস্থিত হয়। কর্কশকণ্ঠে বলে,’তুমি এখানে কী করছ?’

ভয়ে দাঁড়িয়ে যায় অর্ষা। তুতলিয়ে বলে,’আসলে…ও তো বিড়াল। এতকিছু বোঝে না। এভাবে বাইরে রাখাটা ঠিক হচ্ছে?’

‘ও বিড়াল কিন্তু তুমি তো নও। ও বোঝে না, কিন্তু তুমি বোঝো। সূতরাং তুমিও এখন ওর সাথে বাইরে থাকো।’

‘মানে কেন? আমি কী করলাম?’

‘ও অন্যায় করেছে ও’কে শাস্তি দিয়েছি। অপরাধীর প্রতি দরদ দেখানোর জন্য এখন তুমিও শাস্তি পাবে।’ এই বলে আহনাফ দরজাটা ভেতর থেকে লাগিয়ে দিলো। অর্ষা আটকাতে গিয়েও পারল না। অগত্যা সেও পা ভাঁজ করে ক্যাথির সামনে বসে পড়ে।

মুখটা বিকৃতি করে ক্যাথিকে বলল,’এজন্যই কখনো কারও ভালো করতে নেই।’

ক্যাথি এতক্ষণে লেজ নাড়িয়ে বলল,’ম্যাউ, ম্যাউ।’

‘ওরে বাপরে! তুই তো কম ফা’জিল নোস! এখন ঠিকই ম্যাউ ম্যাউ করছিস।’

‘হোয়াট আর ইউ ডুয়িং হেয়ার?’

দ্রুত ইংলিশ বলা ব্যক্তিটির দিকে ঘাড় বাঁকা করে তাকাল অর্ষা। কালো জিন্স প্যান্টের সাথে আকাশী রঙের ঢিলেঢালা একটা টি-শার্ট পরনে একটি ছেলে। তাকে চেনা চেনা লাগছে। পরক্ষণে মনে পড়ে, এই ছেলেকে তো সে এয়ারপোর্ট দেখেছিল। এখানে কী করছে?

অর্ষাকে বিস্মায়ভূত হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে হেলেনও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। সেও অবাক হয়ে বলল,’তুমি!’

চলবে…
আমার পেইজে লাইক দিন, আগামীকাল নতুন পর্ব দিবো।

[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]

#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#পর্ব_২৬
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
__________________
অজানা আশঙ্কায় আতঙ্কিত দেখাচ্ছে অর্ষাকে। সুইজারল্যান্ডে আসার পর এয়ারপোর্টের ঘটনাটি পূণরায় তার চোখের দৃশ্যপটে ভেসে ওঠে। মনে পড়ে যায় সুজিকার কথা। বিভীষিকাময় অতীতের রাতের কথা মনে পড়ে ভয়ে কাঁপতে থাকে সে। একটু একটু করে পেছাতে থাকে। দরজায় পিঠ ঠেকে গেলে সে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ায়।

হেলেন বুঝতে পারছে না, হঠাৎ করে অর্ষার মুখাবয়ব এমন পরিবর্তন হয়ে গেল কেন। সে চোখ দুটো ছোটো ছোটো করে জানতে চায়,’কী হয়েছে?’

অর্ষার ভয় কেন জানি আরো বেড়ে যায়। সে যে আহনাফকে ডাকবে সেটাও পারছে না। এই মুহূর্তে তার কথা বলার শক্তিও যেন লোপ পেয়েছে।

দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে হেলেন বলে,’হেই, তুমি এমন করছ কেন?’

সেই সময়ে ক্যাথি অর্ষার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে ‘ম্যাউ ম্যাউ’ করছে। অর্ষার ভয় এতে আরো বেড়ে যায়।

ক্যাথির চিৎকার শুনেই আহনাফ এসে দরজা খোলে। হঠাৎ দরজা খোলায় অর্ষা কিছু বুঝে ওঠার আগেই, পড়তে যাবে তখন আহনাফ দু’হাতে ও’কে ধরে ফেলে। ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে অর্ষা। ওর শরীরের কাঁপুনি টের পেয়ে আহনাফ জিজ্ঞেস করে,

‘ঠিক আছো তুমি?’

‘এই মেয়ে কে?’ জানতে চায় হেলেন। আহনাফ তখনো হেলেনকে খেয়াল করেনি। প্রশ্নের বাণ তার দিকে আসায়, সে হেলেনের দিকে তাকায়।

অর্ষাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে হেলেনকে বলে,’তুমি কখন এলে?’

‘মাত্রই। কিন্তু এই মেয়ে কে?’

আহনাফ দরজা থেকেই লিলিয়াকে ডেকে অর্ষাকে তার সাথে পাঠিয়ে দিলো। হেলেনকে নিয়ে বসল ড্রয়িংরুমে।

হেলেন অস্থির হয়ে আবারও সেই একই প্রশ্ন করে,’বলছ না কেন এই মেয়ে কে?’

আহনাফ ছোটো করে বলে,’অর্ষা।’

হেলেন ঠোঁট উলটে বলে,’অশা?’

‘অর্ষা। মাই ওয়াইফ।’

আহনাফের কথা শুনে হেলেন যেন সাত আসমান থেকে ধপাস করে নিচে পড়ে গেল। অবিশ্বাস্যকণ্ঠে বলল,’সিরিয়াসলি?’

‘ইয়েস।’

‘আমি তাকে দেখেছি।’

এবার আহনাফও অবাক হলো। বিস্ময় প্রকাশ করে জানতে চাইল,’মানে! কীভাবে?’

‘সেদিন বার থেকে ফিরে রিশিতাকে যে এয়ারপোর্ট আনতে গেলাম? এয়ারপোর্টেই দেখেছিলাম।’

আহনাফের এবার আফসোস হলো। তার কাছে যদি অর্ষার ছবি থাকত এবং হেলেনকেও দেখাত, তাহলে নিশ্চয়ই সেই রাতে অর্ষাকে অমন বিপদের মুখোমুখি হতে হতো না। অবশ্য তার-ই বা কী দোষ? সে কি আর জানত নাকি যে, অর্ষা তাকে না জানিয়ে সুইজারল্যান্ড আসবে!

‘কী হলো? চুপ করে আছো কেন?’ আহনাফকে নিশ্চুপ বসে থাকতে দেখে প্রশ্ন করল হেলেন।

আহনাফ বলল,’না, এমনি। কী খাবে বলো?’

‘উম! এখানে কিছু খাব না। বারে যাব চলো।’

‘এখন?’

হেলেন হাত ঘড়িতে সময় দেখে বলল,’একটু পর গেলেও হবে। বাই দ্য ওয়ে, এই মেয়েটা তো সুন্দর। তাহলে মেনে নিচ্ছ না কেন?’

আহনাফ হেসে বলল,’তোমার মতো সুন্দরের পূজারি হলে হয়তো পারতাম।’

হেলেন হাসল। লিলিয়া এসে আহনাফকে জানাল, অর্ষার আবার জ্বর এসেছে। চিন্তিত হয় আহনাফ।

হেলেনের উদ্দেশ্যে বলল,’কফি পাঠাচ্ছি। তুমি একটু বসো। আমি আসছি।’

হেলেন হেসে বলল,’শিওর।’

আহনাফ রুমে গিয়ে দেখল, অর্ষা কম্বল জড়িয়ে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে আছে। শরীর কাঁপছে তার। আহনাফ ওর কপালে হাত রেখে বলল,’কী হলো হঠাৎ?’

অর্ষা তখন জ্বরের ঘরে। চোখ বন্ধ করে রেখেছে। আহনাফ জিজ্ঞেস করে,’তুমি কি ভয় পেয়েছ?’

অর্ষা নিরুত্তর রইল। আহনাফ বুঝতে পারে, এখন আর প্রশ্ন করে কোনো কাজ নেই। তাই সে অর্ষাকে জ্বরের ট্যাবলেট খাইয়ে আবার শুইয়ে দিলো। কিছুক্ষণের মাঝে অর্ষা ঘুমানোর পর সে রুম থেকে বের হয়।

হেলেন ফোন চাপছিল। আহনাফকে দেখে জিজ্ঞেস করে,’সবকিছু ঠিক আছে?’

আহনাফ মাথা নাড়িয়ে সায় দিয়ে পাশে বসল। হেলেন মুচকি হেসে বলে,’ইউর ওয়াইফ ইজ সো ইনোসেন্ট এন্ড অলসো সি ইজ রিয়েলি বিউটিফুল।’

‘হ্যাং অন অ্যা মোমেন্ট। আর ইউ ফ্লার্টিং?’

হেলেন তার সুন্দর হাসিটা হেসে বলল,’নো, ম্যান। আ’ম জাস্ট টেলিং ট্রু।’

‘দ্যান প্লিজ স্টপ ইট!’

‘হোয়াই? আর ইউ ফিলিং জেলাস?’

‘নেভার এভার। প্লিজ চেঞ্জ দ্য টপিক।’

হেলেন পূণরায় হাসল। তার মন বলছে, আহনাফ যত-ই না বলুক না কেন; মনে মনে ঠিক-ই হিংসা হচ্ছে তার। লিলিয়া তখন এসে বলল,

‘খাবার তৈরি। খেতে আসো।’

হেলেন বাধা দিয়ে বলল,’না। আমরা আজ বাইরে খাব।’

‘বাইরে কেন?’ জানতে চাইল আহনাফ।

হেলেন বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টিয়ে বলল,’বিশেষ কোনো কারণ নেই। আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই।’

আহনাফ অনেকটা ইতস্তত করে বলল,’আজ কোথাও না যাই?’

হেলেন দুষ্টু হেসে ভ্রুঁ নাচিয়ে বলে,’কেন হু? অশাকে রেখে যেতে মন সায় দিচ্ছে না?’

আহনাফ গম্ভীর হয়ে বলে,’এমন কিছু নয়।’

‘তাহলে আর সমস্যা কী? চলো।’

হেলেনের এমন একটা কথা বলার পর, এখন আর না গিয়ে উপায় নেই। সে রুমে গিয়ে তৈরি হয়ে নিল। রুম থেকে বের হওয়ার সময় আড়চোখে একবার ঘুমন্ত অর্ষাকে দেখেও নেয়।

লিলিয়ার উদ্দেশ্যে বলে,’একটুপর অর্ষাকে ঘুম থেকে তুলে খেতে দিয়েন।’

হেলেন তাড়া দিয়ে বলল,’দেবে, দেবে। তুমি চলো এখন।’

আহনাফ যাওয়ার পথে কিছুটা উঁচুস্বরে বলে গেল,’আর হ্যাঁ, ক্যাথিওন যেন অর্ষার কাছে না যায় খেয়াল রাখবেন।’
.
অর্ষার ঘুম ভাঙে সাড়ে পাঁচটার দিকে। এরমাঝে লিলিয়া এসে বেশ কয়েকবার ডেকে গেছিল। অর্ষা ওঠেনি। শরীর ঘেমে একাকার অবস্থা। জ্বর ছেড়েছে বোঝা যাচ্ছে। কিছুটা ক্লান্তবোধও করছিল। তাই অন্যকিছু না করে আগে গোসল করে আসে।

ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে স্মিথকে দেখতে পায়। স্মিথ বলল,’মম খেতে ডাকে।’

‘যাও,আসছি।’

‘ওকে।’

স্মিথ চলে যাওয়ার পর চুলগুলো ঝেড়ে নেয় অর্ষা। চিরুনি দিয়ে সুন্দর করে আঁচড়িয়ে খেতে যায়। লিলিয়া কড়া একটা কফি বানিয়ে দিয়েছে।

মগ হাতে নিয়ে অর্ষা জিজ্ঞেস করে,’এটা কী?’

‘কফি।’ লিলিয়ার উত্তর।

‘এমন কালো কুচকুচে কেন?’

‘ব্ল্যাক কফি। খাও, ভালো লাগবে।’

অর্ষা এক চুমুক দিয়েই সাথে সাথে মগ টেবিলের ওপর রেখে দিলো। বমি আসছে তার। তেতোয় মুখ নষ্ট হয়ে গেছে। সে মুখটা বিকৃতি করে বলল,’ইয়াক ছি! এত বাজে কফি আমি জীবনেও খাইনি।’

স্মিথ বলল,’এটার স্বাদ এমনই। তবে উপকারী।’

‘আমার এত উপকার দরকার নেই ভাই। আমাকে দুধ-চিনি মেশানো কফি দিতে বলো।’

অর্ষাকে জোর করে লাভ নেই বুঝতে পেরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে লিলিয়া। অর্ষার কথামতো কফি বানিয়ে টেবিলের ওপর রাখে। কিচেনে যাওয়ার সময় অর্ষা পিছু ডেকে বলে,’উনি কোথায়?’

‘কে? আহনাফ?’

‘হ্যাঁ।’

‘হেলেনের সাথে বাইরে গেছে।’

‘হেলেন কে?’

‘ওর বন্ধু। তখন যে এসেছিল।’

অর্ষা অবাক হয়ে বলল,’তার বন্ধু!’

‘হ্যাঁ। কিন্তু তোমার হঠাৎ কী হয়েছিল?’

অর্ষার মনটা খারাপ হয়ে যায়। সে বলে,’এমনি কিছু না। আপনি যান।’

লিলিয়া চলে যাওয়ার পর সে কফিতে চুমুক দেয়। স্মিথ তখনো গল্পের বইটা পড়ছিল।

‘ক্যাথিওনকে কি এখনো বাইরেই রেখেছে?’ স্মিথের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করল অর্ষা।

‘না। তোমার সাথেই ঘরে এনেছিল।’

‘কোথায়? দেখছি না যে?’

‘নিচে তাকাও।’

অর্ষা নিচে তাকিয়ে এক লাফে পা দু’টো চেয়ারের ওপর তুলে ফেলে। ক্যাথি ওর পায়ের কাছেই বসে ছিল। এমন করায় ক্যাথি মাথা তুলে ওর দিকে তাকায়। স্মিথ শব্দ করে হাসে।

অর্ষা চোখ বন্ধ করে বলে,’উফ আল্লাহ্!’

স্মিথ তখন বলল,’তুমি ভয় পেও না। ও তো কিছু করবে না।’

‘হ্যাঁ, কিছু করবে না। এই দেখো হাতে এখনো আঁচড়ের দাগ রয়েছে।’ নিজের হাতটা দেখিয়ে বলল অর্ষা।

‘তুমি ও’কে একটু আদর করলে কী হয়?’

‘কিহ! আদর? আরে ভাই, ধরতে গেলেই তো ভয় লাগে।’

স্মিথ মুখে হাত দিয়ে হেসে বলে,’তুমি অনেক ভীতু।’

অর্ষার মুখটা চুপসে যায়। মুখটা একটুখানি করে বলে,’জানি!’
_______
সারা বিকাল এদিক-ওদিক ঘুরে সন্ধ্যায় বারে এসেছে হেলেন আর আহনাফ। হেলেনের আগমন হওয়া মাত্র মেয়েরা ছুটে আসে কাছে। আহনাফ পাশ কাটিয়ে সাইডে চলে যায়। দূর থেকে দেখতে পায়, মেয়েরা পারে না শুধু হেলেনকে খেয়ে ফেলে।

সে একটা চেয়ারে বসে। এত হৈ-হুল্লোড়ের মাঝেও হুট করে অর্ষার কথা মনে পড়ে যায়। জ্বরের মধ্যে মেয়েটাকে রেখে আসা কি ঠিক হলো? মন তো তার এভাবে আসাকে সায় দিচ্ছে না মোটেও।

তখন একটি মেয়ে বিয়ারের বোতলে চুমুক দিতে দিতে আহনাফের কাছে আসে। হাত বাড়িয়ে বলে,’ডান্স করার পার্টনার হবে?’

আহনাফ মৃদু হেসে বলে,’স্যরি।’

‘ইট’স ওকে।’ বলে মেয়েটা যেভাবে এসেছিল সেভাবেই আবার চলে যাচ্ছিল। তখন হেলেনের সাথে দেখা হয়।

হেলেনের গলা জড়িয়ে ধরে বলে,’হেই! কোথায় ছিলে তুমি? মিস করেছিলাম।’

হেলেন গলা থেকে মেয়েটির হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,’মিস ইউ টু সুইটহার্ট। তুমি ইনজয় করো। আমি একটু পর আসছি।’

‘ওকে।’

মেয়েদের ছাড়িয়ে আহনাফের কাছে আসে হেলেন। পাশের একটা চেয়ারে বসে বলে,’তুমি এখানে কী করছ?’

‘দেখছি।’

‘কী?’

‘এতগুলো মেয়েকে কীভাবে সামলাচ্ছিলে সেটাই।’

হেলেন শব্দ করে হেসে ফেলে। দুটো ওয়াইনের গ্লাস নিয়ে একটা আহনাফের দিকে এগিয়ে দেয়।

আহনাফ গ্লাসটি সরিয়ে দিয়ে বলল,’স্যরি। ড্রিঙ্ক করব না আজ।’

হেলেন অবাক হয়ে বলল,’কেন? অশার জন্য বুঝি?’

হেলেন বারবার অর্ষার নামটা ভুল উচ্চারণ করছিল বলে আহনাফও মৃদু হাসে। বলে,’বাড়িতে তো আর আমি এখন একা থাকি না। অর্ষা, লিলিয়া আন্টি আর স্মিথও আছে। বিষয়টা খারাপ দেখায়।’

হেলেন ঠোঁট টিপে হেসে বলে,’সত্যি করে বলো তো, তুমি কি অশাকে ভালোবাসার চেষ্টা করছ?’

আহনাফ স্মিত হেসে বলে,’লাভ ইজ নট এনি পারপোজলি সাবজেক্ট। ইট’স প্রোপারলি ম্যাটার অফ হার্ট।’

‘বুঝলাম।’ কাঁধ নাচিয়ে বলল হেলেন।

যেই মেয়েটা একটু আগে আহনাফকে ডান্স করার জন্য বলেছিল সেই মেয়েটা আবার এসেছে। বেশ নে’শা যে করেছে সেটা বোঝা যাচ্ছে,মেয়েটির হাঁটার ধরণ দেখে।

সে পূণরায় হেলেনের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,’এবার তো চলো!’

হেলেন ও’কে ছাড়াতে গিয়ে হাতের ড্রিঙ্কসটা আহনাফের টি-শার্টের ওপর পড়ে। হেলেন তড়িঘড়ি করে বলে,’স্যরি, স্যরি ম্যান।’

আহনাফ টি-শার্ট ঝাড়তে ঝাড়তে বলল,’ইট’স ওকে।’

হেলেন এবার মেয়েটিকে বলল,’এখন ডান্স করার মুড নেই বেবি। তুমি যাও।’

মেয়েটি কয়েকবার রিকোয়েস্ট করেও হেলেনকে রাজি করাতে পারল না। তাই বিরক্ত হয়েই চলে গেল।

মেয়েটির যাওয়ার পথে একবার তাকিয়ে আহনাফ বলল,’গেলে না কেন?’

‘শী ইজ অ্যা ক্রেজি গার্ল। এন্ড শী ওয়ান্টস টু শেয়ার দ্যা বেড উইথ মি।’

‘সো হোয়াট? আফটার অল শী ইজ ইউর গার্লফ্রেন্ড।’

‘হোয়াটএভার! ইউ নো, আ’ম স্টিল ভার্জিন! এন্ড আই ওয়ান্ট টু লস মাই ভার্জিনিটি উইথ মাই ট্রু লাভ।’

আহনাফ ভ্রুঁ উঁচিয়ে বলল,’গ্রেট!’
_______
ভিডিয়ো কলে কথা বলছিল অর্ষা, আশিক, দিদার, রেশমি আর জুঁই। লামিয়া আর আহিল অনুপস্থিত। অনলাইনেই নেই ওরা।

অর্ষা মনমরা হয়ে বলে,’আমি তো খুবই অশান্তিতে আছি জানিস?’

‘কী হয়েছে আবার? ভাইয়া কিছু বলেছে?’ জিজ্ঞেস করল রেশমি।

‘না। উনার একটা বিড়াল আছে। ভীষণ জ্বালায়।’

‘জ্বালায় মানে?’

‘মানে সারাক্ষণ আমার পেছনে ঘুরঘুর করে।’

আশিক অবাক হয়ে বলে,’বলিস কিরে! শেষমেশ বিলাইও তোর পেছনে ঘোরে?’

জুঁই ভেংচি কেটে বলল,’একদম তোর মতো স্বভাব।’

আশিক চোখমুখ শক্ত করে বলল,’তোরে দেখলেও মনে হয় বিলাই,
এই সুখে আয় তোরে একটু কিলাই।’

‘ফাল’তু!’

রেশমি বলল,’বিড়ালটা কোথায়?’

‘ড্রয়িংরুমে। পিছুই ছাড়ছিল না। তাই ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে বসে আছি।’

সবাই শব্দ করে হেসে বলে,’কবে যে তুই একটু চালাক আর সাহসী হবি।’

‘যতই চালাক আর সাহসী হই না কেন, বিড়াল বা কোনো প্রাণী আমি ধরতে পারব না।’

কথার মাঝে দরজায় টোকা পড়ে। বাইরে থেকে আহনাফের গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।

‘উনি এসেছে। পরে কথা বলছি।’ বলল অর্ষা।

‘ঢং। রোমান্স-টোমান্স তো কিছু করবি না। তাহলে আমরা কলে থাকলে কী সমস্যা?’ ভেংচি কেটে বলল রেশমি।

‘তোরা বড্ড বেশি বাজে কথা বলিস। রাখছি আমি।’

কল কেটে দরজা খুলে রীতিমতো অবাক হয় অর্ষা। ভয়ে দু’পা পিছিয়ে যায়। একবার আহনাফের হাতের দিকে তাকায়, আরেকবার পায়ের দিকে। ক্যাথিওন দাঁড়িয়ে আছে পায়ের কাছে। অন্য একটা বিড়াল আহনাফের হাতে।

অর্ষা অস্থির হয়ে বলে,’এটা কে?’

‘দেখতে পাচ্ছ না বিড়াল?’

‘এটাকে কোত্থেকে ধরে আনলেন আবার?’

‘রাস্তায় পেয়েছি।’

‘আশ্চর্য! রাস্তায় পেলেই এমন কুকুর, বিড়াল ধরে আনতে হবে? ওদের বাগানবাড়ি বানাবেন নাকি এটা?’

আহনাফ ভ্রুঁ কুঁচকে বলল,’তোমার কী সমস্যা?’

‘আমার কী সমস্যা মানে? একটা বিড়াল কি কম পড়েছিল যে আপনি আরো একটা নিয়ে এসেছেন?’

‘মনে করো তাই।’

অর্ষা এতটাই বিরক্ত হলো যে কিছু বলতেও পারছে না। আহনাফ লিলিয়াকে ডেকে বিড়ালটিকে তার কোলে দিলো। বলল,’ও’কে পরিষ্কার করে কিছু খেতে দিও।’

ক্যাথি আহনাফের সাথেই রুমে ঢুকল। অর্ষাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় আহনাফের গায়ে ড্রিঙ্কসের গন্ধ পায় অর্ষা।

নাকমুখ কুঁচকে বলে,’আপনি ড্রিঙ্কস করেছেন?’

আহনাফ ফিরে তাকায়। অর্ষা নিজেই আবার বলে,’আপনি ড্রিঙ্কস কেন করেন? আমি সত্যিই ভাবতে পারছি না। বিশ্বাসও হচ্ছে না। আপনি জানেন না এটা শরীরের জন্য কত খারাপ?’

আহনাফ সত্যটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। তার ভেতরের সত্তাটা বলে উঠল,’এই মেয়েকে সবকিছুর কৈফিয়ত কেন দিতে হবে?’

তাই সে গম্ভীর হয়ে বলল,’অয়েল ইউর ওউন বিজনেস।’

অর্ষার মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে তো ভালো কথা-ই বলেছে। তবুও কেন আহনাফ তার সাথে এমন শক্ত হয়ে কথা বলে? রাগ করে সে ঘর থেকেই বের হয়ে গেল। ক্যাথিও ওর পিছু যাওয়া ধরে তখন আহনাফ ও’কে ধরে ফেলে।

কোলে তুলে নিয়ে বলে,’জানিস যে অর্ষা তোকে পছন্দ করে না, তবুও কেন সারাক্ষণ ওর পিছু পিছু ঘুরিস?’

অর্ষা নিজের ফোনটা নিতে এসে কথাটি শুনতে পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। কথার মাঝে ফোঁড়ন কেটে বলে,’আমি কখন বলেছি, ক্যাথিকে পছন্দ করি না? আমি ভয় পাই। তার মানে তো এই নয় যে অপছন্দ করি। বাচ্চাদের উলটা-পালটা বোঝাবেন না।’

আহনাফ ভ্রুঁজোড়া উঁচু করে বলে,’যেভাবে বলছ মনে হচ্ছে, ক্যাথি তোমার বাচ্চা।’

‘আপনার বাচ্চা হতে পারলে আমার বাচ্চা হতে পারবে না কেন?’

‘বাচ্চা হলে দূরে সরিয়ে দিতে না নিশ্চয়ই?’

‘ভয় পেলে আমি কী করব?’

‘ভয় দূর করবে।’

‘হয় না। স্পর্শ লাগলেই ভয় লাগে। কেমন জানি লাগে! আমি বলে বোঝাতে পারব না।’

এই পর্যায়ে আহনাফ হেসে ফেলে। অর্ষা গম্ভীর হয়ে শুধায়,’হাসছেন কেন?’

‘মানুষের কত রকম ফোবিয়া থাকে। আর তোমার কিনা বিড়ালে ফোবিয়া রয়েছে!’

‘শুধু বিড়াল নয়, আমি অন্য প্রাণীও ভয় পাই। এমনকি হাঁসের বাচ্চা, মুরগির বাচ্চাও।’

‘তুমি তো ভীষণ অদ্ভুত। সাপ, বাঘ দেখে ভয় পাওয়াটা না হয় মানানসই। তাই বলে, বিড়াল; এমনকি হাঁস-মুরগিও?’

অর্ষা থম মেরে তাকিয়ে থাকে। একটু না হয় ভয়-ই পায়। এতে এত অবাক হওয়ার কী আছে?

ক্যাথিকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে আলমারি থেকে জামা-কাপড় বের করতে যায় আহনাফ। তখন জিজ্ঞেস করে,’তোমার জ্বর সেরেছে?’

‘হুম।’

‘তখন এত ভয় পাচ্ছিলে কেন?’

‘আপনার বন্ধুকে দেখে।’

কাবার্ড থেকে ট্রাউজার আর সাদা টি-শার্ট বের করে, অর্ষার দিকে তাকায়। জিজ্ঞেস করে,’কেন?’

অর্ষা নতমুখে জানায়,’সেই রাতের কথা মনে পড়ে গেছিল।’

‘ভুলে যাও অর্ষা। চেষ্টা করো সম্পূর্ণ ভুলে যেতে। স্বাভাবিক হও। দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে।’

অর্ষা মুখ তুলে তাকায়। মানুষটাকে দেখে। কথা শেষ করে ততক্ষণে আহনাফ ওয়াশরুমে ঢুকে গেছে। অর্ষা এই মানুষটিকে ঠিক বুঝতে পারে না। কখনো ভীষণ নরম তো কখনো ভীষণ কঠোর। কখনো ভীষণ কেয়ারিং তো কখনো ভীষণ রাগী। হতাশ দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে সে।

আহনাফের গোসল শেষ হলে দুজনে একসাথে খেতে বসে। স্মিথ আর লিলিয়া আগেই খেয়ে নিয়েছে। মূলত অর্ষাই লিলিয়াকে জোর করে বলেছিল,’বাড়িতে এসেই অনেক কাজ করেছেন। খেয়ে রেস্ট নিন এখন।’

খাওয়ার সময়ও অর্ষা খেয়াল করল ক্যাথিওন ওর পায়ের কাছে বসে খাচ্ছে। সে তখন আহনাফকে জিজ্ঞেস করে,’ওর নাম ক্যাথিওন কেন?’

এমন প্রশ্নে আহনাফ একবার তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। বলল,’আমি রেখেছি তাই।’

‘আচ্ছা। ক্যাথিওন মানে কী?’

‘জানিনা। শুধু জানি একটা নাম। মাথায় এসেছে রেখে দিয়েছি।’

‘ও ছেলে নাকি মেয়ে?’

আহনাফ ফের এক পলক তাকিয়ে আবার খাওয়ায় মনোযোগ দিয়ে বলল,’চেক করে দেখো।’

অর্ষা কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। ওর রিয়াকশন দেখে মনে মনে হাসি পায় আহনাফের। সে ভাবলেশহীনভাবে বলে,’ছেলে।’

খাওয়া শেষ করে ঘুমানোর সময় মুখটা কাচুমুচু করে দাঁড়িয়ে রইল অর্ষা। আহনাফ আরাম করে বিছানায় একটু শুয়েছিল।

অর্ষার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,’মুখ অমন করে রেখেছ কেন?’

‘আমি ঘুমাব কোথায়?’

‘ছাদে।’

‘কী?’

‘শোনোনি কী বললাম? কাঁথা-বালিশ নিয়ে ছাদে চলে যাও। তুমি তো আবার কারও সাথে ঘুমাতে পারো না।’

অর্ষা কী করবে বুঝতে পারছে না। আহনাফ কি সত্যিই চাইছে অর্ষা ছাদে যাক? নাকি মজা করে বলল কথাটা?

আহনাফ বিছানা থেকে উঠে বলল,’দেখো অর্ষা, পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে শেখো। লিলিয়া আন্টি আর স্মিথ ঐ রুমে। আর এখানে রুম-ই দুটো। আমাদের এক রুম শেয়ার করা ছাড়া উপায় নেই।’

অর্ষা মনে মনে ভাবল, নিজে যে কত পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিয়েছে তা তো সে দেখেছেই। কিন্তু মুখে ছোটো করে বলল,’আচ্ছা।’

‘তুমি শুয়ে পড়ো। আমি ক্যাথিকে লিলিয়া আন্টির রুমে রেখে আসছি।’

‘থ্যাঙ্কিউ।’

‘কেন?’

‘এটলিস্ট ও’কে অন্য রুমে রাখার জন্য।’

আহনাফ কোনো রকম প্রত্যুত্তর করল না। ক্যাথিকে কোলে তুলে নিল। ক্যাথি যখন বুঝতে পারল, তাকে এই রুমের বাইরে রাখা হবে তখন আহনাফের কোল থেকে এক লাফ দিলো। লাফ দেওয়ার সময় ও’কে ধরতে গিয়ে পাশে দাঁড়ানো অর্ষাকে নিয়ে বিছানায় পড়ে যায় আহনাফ। ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে যায় দুজনই। অর্ষা মুখটা কাঁদোকাঁদো করে বলল,’ম’রার বিড়াল!’

আহনাফ জ্ঞানশূন্য হয়ে তাকিয়ে রয়েছে। অর্ষা দু’হাত দিয়ে আহনাফকে ঠেলে ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,’আপনার ওয়েট কত?’

অস্ফুটস্বরে আহনাফের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে,’হোয়াট!’

অপরদিকে তার মন তাকেই বলে ওঠে,’কী আনরোমান্টিক মেয়ে রে বাবা!’

চলবে…

[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]