যেদিন তুমি এসেছিলে পর্ব-৩১+৩২

0
803

#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#পর্ব_৩১
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
আহনাফ যখন রুমে ফেরে তখন ঘুটঘুটে অন্ধকারে রুমের কিছুই ঠাওর করতে পারছিল না। কিছুক্ষণ সে থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকে। বুকের ভেতর ঢিপঢিপ আওয়াজ হচ্ছে। অর্ষা কি এখনো জেগে আছে? তাহলে তো সাড়ে সর্বনাশ হয়ে যাবে। অন্ধকারে চোখ সয়ে আসার পর সে একটু একটু করে বিছানার দিকে এগিয়ে যায়। অর্ষার কোনো সাড়াশব্দ নেই।

কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে নিঃশব্দে খাটের ওপর বসে। তবুও অর্ষার কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। এবার সে কিছুটা ঝুঁকে অর্ষার মুখের দিকে তাকায়। বুঝতে পারে অর্ষা ঘুমিয়ে পড়েছে। বুকের ওপর থেকে যেন ভয় ও লজ্জার ভারী পাথরটা নেমে গেল। লম্বা করে শ্বাস নেয় সে। কোলবালিশটা মাঝখানে রেখে আবারও শুয়ে পড়ে।

ঘুমে চোখ যখন লেগে আসছিল, তখন ধপ করে আহনাফের গায়ের ওপর অর্ষা হাত রাখে। ভয় পেলেও নিজেকে ধাতস্থ করে নেয় আহনাফ। খুব সন্তর্পণে অর্ষার হাতটি সরিয়ে বিড়বিড় করে বলে,

‘হুশ! দূরে থাকো, দূরে, দূরে।’
______________

আজ আর সূর্য উদয় হওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে ঘুম থেকে উঠতে হয়নি আহিলকে। আফরিন বেড়াতে আসবে বলে, কিছুদিন সে অফিসে যাবে না।

সকাল আটটা নাগাদ ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িংরুমে আসে। রেণু এসে চা দিয়ে যায়। আমেনা বেগম রান্নাঘর থেকে ফিরে এসে বলেন,

‘যাবি কখন আফরিনের বাসায়?’

‘এইতো বের হব এখন।’

‘দুপুরের আগে আগেই পৌঁছে যাবি। তোর জন্য রান্নাবান্না করতেছে আফরিন।’

‘ও’কে আবার এসব কে করতে বলল?’

‘বলা লাগবে নাকি? ও তো এমনই।’

আহিল কিছু বলল না। তিনি পাশে বসে বললেন,’যাওয়ার সময় মনে করে কিছু নিয়ে যাস কিন্তু।’

‘হ্যাঁ, নেব।’

চা শেষ করে আহিল বেরিয়ে পড়ে। বাজারে গিয়ে বাইক থামিয়ে ফলমূল কেনে।

পেছন থেকে মেয়েলী কণ্ঠস্বরে ভেসে আসে,’আমায় একটা আপেল দেন তো।’

আহিল ভ্রুঁ কুঁচকে পেছনে তাকায়। বিরক্ত হয়ে বলে,’আবার তুমি!’

সকাল চুলের বিনুনি নাচিয়ে নাচিয়ে বলল,’হ্যাঁ, আমি। আপনি কি অন্য কাউকে আশা করেছিলেন নাকি?’

‘ফাউল কথা বলবে না।’

‘আচ্ছা বলব না। এখন কি আপেল দেবেন? আচ্ছা থাক! লাগবে না।’

আহিল ওর কথায় পাত্তা না দিয়ে কী কী নেবে সেগুলো দোকানদারকে বলছিল। সকাল উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে,

‘জানেন আজ না আমি ভীষণ খুশি। আমি ভাবতেও পারিনি, এত তাড়াতাড়ি আবার আমাদের দেখা হবে। নিঃসন্দেহে আজকের দিনটা আমার জন্য শুভ। আজকে কার মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠেছিলাম?’ বলে চিন্তিত হয়ে ভাবতে লাগল সকাল।

আহিল গম্ভীর হয়ে বলল,’কিন্তু আমার দিনটা খুবই খারাপ আজ।’

‘ইশ! কেন? এই দোকানের ফল ভালো নয়?’

‘দোকানের ফল ঠিকই আছে। আমার সমস্যাটা তোমায় নিয়ে। এভাবে হুটহাট কেন দেখা হয় বুঝতে পারছি না।’

‘আহা! না বোঝার কী আছে? এটা হচ্ছে মনের কানেকশন। টান বুঝছেন গভীর টান।’

‘বড্ড বাচাল তো তুমি। আচ্ছা তোমার সমস্যাটা কি আমায় বলো তো। কী চাও তুমি?’

‘আপাতত আপনার নামটা বলেন। আর ফোন নাম্বার দিলেই হবে।’

‘থাপ্রিয়ে যখন দাঁত ফেলে দেবো তখন বুঝবে মজা।’

‘সবসময় এমন কাঠখোট্টা মেজাজে কথা বলেন কেন? আমি কি প্রেম করতে চেয়েছি নাকি?’

‘তুমি চাইলেই আমি রাজি হব?’

‘আমি কী জানি? আচ্ছা আমরা ফ্রেন্ড তো হতেই পারি?’

‘না, পারি না। আমার অলরেডি অনেকগুলা ফ্রেন্ড আছে। নতুন করে আর প্রয়োজন নেই।’

‘কেন, গার্লফ্রেন্ড বুঝি বারণ করেছে?’

আহিল ভ্রুকুটি করে প্রশ্ন করে,’কে গার্লফ্রেন্ড?’

‘ঐযে রেস্টুরেন্টে যার সাথে গেছিলেন।’

আহিল কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। কী যেন ভেবে বলে,’হ্যাঁ, ঠিক ধরেছ।’

সকাল মুখটা কাঁদোকাঁদো করে বলে,’তার মানে সত্যিই আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে?’

‘হ্যাঁ।’

এতক্ষণ নিতু আর বিথী চুপ করে ছিল। এবার নিতু মুখ খুলে সাংঘাতিক একটা কথা বলে ফেলে।

সে আহিলের উদ্দেশ্যে বলল,’সে যে আপনার গার্লফ্রেন্ড হয় তার প্রমাণ কী?’

নিতুর প্রশ্নে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় আহিল। এদিকে টনক নড়ে সকালেরও। অসাধারণ কোনো ক্লু খুঁজে পেয়েছে এমনভাবে বলল,

‘হ্যাঁ, তাই তো!’

‘তোমাদেরকে আমি প্রমাণ কেন দিতে যাব? তোমরা কে?’ বলল আহিল।

সকালও ওর জায়গায় অটুট থেকে বলল,’না, বললে আমিও বিশ্বাস করি না। আর আপনাকে আমি জ্বালাবই।’

আহিল ভেবে-চিন্তে বলল,’ওর সাথে কথা বলিয়ে দেবো তোমায়। তাহলে তো বিশ্বাস করবে?’

‘হু।’

‘ওকে। বাট একটা শর্ত আছে।’

‘কী?’

‘এরপর আর কখনোই তুমি আমাকে জ্বালাবে না। আমার সামনেও আসবে না। মনে থাকবে?’

‘ওকে।’

‘ঠিক আছে। তিনদিন পর আমার রেজাল্ট দেবে। চারদিনের দিন অর্থাৎ সোমবার সেই রেস্টুরেন্টে এসো। আমি ও’কে নিয়ে আসব।’

‘আচ্ছা।’

আহিল দোকানদারের বিল মিটিয়ে এক প্যাকেট আপেল সকালের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,’এগুলো তোমার।’

আহিল চলে যাওয়ার পর বিথী হেসে বলে,’লোকটা রাগী হলেও মন ভালো!’
.
.
অর্ষা ঘুম থেকে ওঠার আগেই আহনাফ উঠে পড়েছে। ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িংরুমে এসে বসে। ফুপি এসে কফি দিয়ে বললেন,

‘অর্ষা কোথায়? নাস্তা করবি না তোরা?’

‘ও এখনো ঘুমাচ্ছে।’

‘তো ডাকিসনি কেন? ডেকে আন যা।’

আহনাফ গম্ভীর হওয়ার ভান ধরে বলল,’আমি পারব না। নেহাকে পাঠাও।’

নেহা তখন ড্রয়িংরুমেই আসছিল। আহনাফের শেষ কথাটি শুনতে পেয়ে বলল,’কোথায় পাঠাতে বলছ ভাইয়া?’

ফুপি বললেন,’যা তো, অর্ষাকে ডেকে আন।’

‘ওকে।’ বলে নেহা আবার ওপরে চলে যায় অর্ষাকে ডাকতে।

ফুপি এবার আহনাফের পাশে বসেন। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে রয়েসয়ে বললেন,’তুই কি এখনো অর্ষাকে মেনে নিতে পারিসনি?’

‘এই প্রশ্ন কেন করছ?’ কফিতে চুমুক দিয়ে বলল আহনাফ।

‘জানতে চাচ্ছি। তুই উত্তর দে।’

‘সম্পর্ক স্বাভাবিকই আছে।’

‘কেমন স্বাভাবিক? মেনে নিয়েছিস তো?’

আহনাফ চুপ করে থাকে। ফুপি দীর্ঘনিশ্বাস নিয়ে বলেন,’যা হওয়ার তা তো হয়ে গেছে আহনাফ। এবার তো সম্পর্কটাকে একটা সুযোগ দে। আমি তোকে ফোর্স করছি না। জোর করে কিছু চাপিয়েও দিচ্ছি না। শুধু বলছি, একটু ভেবে দেখ।’

প্রত্যুত্তরে আহনাফ শুধু স্মিত হাসি প্রদান করল।

ফুপি ব্রেকফাস্ট সাজাতে চলে যাওয়ার পর নেহা আসে। সোফায় বসে আহনাফের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসে।

আহনাফ লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করে,’হাসছিস কেন?’

নেহা মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বলে,’কাল যা করেছ না!’

আহনাফ থতমত খেয়ে যায়। তুতলিয়ে বলে,’কী করেছি?’

‘এত ড্রিঙ্কস করেছ কেন? জানো মামনী কত বকেছে আমাকে আর ভাইয়াকে?’

আহনাফ হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। গম্ভীর হওয়ার ভান ধরে বলে,’ঠিকই তো আছে। মিথ্যা বলেছিলি কেন?’

নেহা এ কথার উত্তর না দিয়ে মুচকি হেসে বলল,’যাই হোক, সীনটা কিন্তু দারুণ ছিল।’

‘কীসের সীন?’

‘দেখবে?’

আহনাফ প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। নেহা পকেট থেকে ফোন বের করে তুলে রাখা ছবিটি দেখায়। বিস্ময়ে হা হয়ে যায় আহনাফের মুখ।

সে অবিশ্বাস্যকণ্ঠে বলে,’এরা কারা?’

‘এহ, ঢং! এরা কারা না? তুমি আর ভাবি।’ ভেংচি কেটে বলল নেহা।

‘অসম্ভব! এটা কী করে সম্ভব? হায় আল্লাহ্! তুই ইডিট করেছিস?’

‘তুমি কি পাগল হয়ে গেছ ভাইয়া? তোমাদের ছবি আমি ইডিট করতে যাব কেন? দেখো ড্রেস দেখো। মুখ দেখো। ছবি দেখলেই তো বুঝা যায় ইডিট নাকি রিয়েল। কাল তো ড্রিঙ্কস করে নেশার ঘোরে ছিলে তাই ভুলে গেছ।’

আহনাফ আশেপাশে একবার তাকিয়ে বলল,’এক্ষুণী ছবি ডিলিট কর তুই।’

নেহা অবাক হয়ে বলল,’কী! কেন? এত সুন্দর রোমান্টিক ছবিটা ডিলিট করব কেন?’

‘তোর রোমান্টিকের খ্যাতা পুড়ি! তুই এক্ষুণী ছবিটা ডিলিট কর।’

‘না।’

আহনাফ কড়া করে একটা ধমক দিতে গিয়েও থেমে গেল। কণ্ঠস্বর যথাসম্ভব ঠাণ্ডা রেখে বলল,’সোনা বোন আমার, কলিজা আমার। কী খাবি তুই? আইসক্রিম নাকি চকোলেট? তোর একাউন্টে টাকা লাগবে? কত পাঠাব? আচ্ছা তোর বার্থডে কবে? কী গিফ্ট নিবি এবার?’

নেহা ফিক করে হেসে ফেলে। হাসতে হাসতে বলে,’তুমি একটা ড্রামা কিং।’

আহনাফ মুখটা কাঁদোকাঁদো করার ভাব ধরে বলল,’কর না ডিলিট! এমন করিস কেন? ভাইয়ের কষ্ট বুঝবি না তুই?’

ফুপির গলা পাওয়া যায় তখন। খেতে ডাকছেন তিনি। নেহা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,’তোমাকে ছবিটা হোয়াএসপে পাঠিয়েছি। ডিলিট করতে মন চাইলে তোমার ফোন থেকে ডিলিট করো। আমার ফোন থেকে এত সুন্দর ছবি আমি ডিলিট করব না।’

‘তোরে এতগুলা অপশন দিলাম তাও করবি না? কী লাগবে তোর বল শুধু একবার।’

‘কিচ্ছু লাগবে না। আমি ঘুষ খাই না।’

আহনাফ চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,’আস্ত ঘাড়ত্যাড়া একটা! অ’সভ্য, বদমাই’শ।’

নেহাও দাঁত কেলিয়ে হেসে বলে,’তোমারই তো বোন।’

‘আচ্ছা শোন না, ছবিটা অর্ষাকে দেখাসনি তো?’

‘এখনো না। তবে দেখাব।’

‘মাফ চাই। এই কাজ করিস না বনু। ছবি ডিলিট করতে হবে না। শুধু কাউকে দেখাইস না। এই রিকোয়েস্টটা রাখ প্লিজ!’

নেহা একটু ভেবে হেসে বলল,’আচ্ছা।’

খাওয়ার টেবিলে আহনাফ অর্ষার দিকে ঠিকমতো তাকাতেও পারছিল না। বারবার মনে শুধু একটা প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছিল। অর্ষা কি জানে এসব? নাকি নেশা বা ঘুমের ঘোরে ছিল? এই প্রশ্নগুলো তো অর্ষাকে করাও যাবে না। কী যে এক অশান্তির ভেতর সে আছে!

সেদিন দুপুরেই ওরা ফুপির বাড়ি থেকে নিজেদের বাড়ি জুরিখ শহরে ফিরে আসে। ফুপা-ফুপি, নিহিত আর নেহা অনেক রিকোয়েস্ট করেছিল আজকের দিনটা যেন অন্তত থেকে যায়। কিন্তু আহনাফ রাজি হয়নি। সকালেই ফিরে আসতো, ঘুম থেকে উঠতে লেট হওয়ায় দুপুরে রওনা দিয়েছে।

বাড়িতে ফিরে অর্ষা এক নতুন আহনাফকে আবিষ্কার করল। মানুষটা মনে হয় আর আগের মতো গম্ভীর নেই। রাগ করে না, ধমক দেয় না। কেমন যেন চুপচাপ থাকে। মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে না। এড়িয়ে চলে। প্রথম প্রথম বিষয়টা অর্ষা পাত্তা না দিলেও এখন দিচ্ছে। তার হঠাৎ পরিবর্তন মানতেও কষ্ট হচ্ছে।

লিলিয়া আর স্মিথ ফিরে আসার পর অর্ষা আবারও আহনাফের রুমে ফিরে এসেছে। ভেবেছিল এবার হয়তো আহনাফ স্বাভাবিক আচরণ করবে। কিন্তু ভাবনা ভুল ছিল। আরো যেন নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিল আহনাফ। এদিকে ওর পরিবর্তনে দুঃখে, কষ্টে কান্না পায় অর্ষার।
.
আজকে পরীক্ষার রেজাল্ট দেবে বলে সকাল থেকেই চিন্তায় ছিল গ্যাঞ্জাম পার্টি। সকাল হতে না হতেই সবাই মিলে ভিডিয়ো কলে এসেছে। চুপচাপ নিরবতা চলছে শুধু।

আশিক কটনবার দিয়ে কান চুলকিয়ে বলে,’কাহিনি কী মামা? সবাই এমন চুপ করে আছিস কেন? জামাই-বউ মর’ছে নাকি তগো?’

জুঁই চোখ পাকিয়ে বলল,’আজেবাজে কথা বলবি না একদম।’

‘তাইলে কী করমু? আমিও এহন চুপ করে থাকমু?’

‘হ, থাক। চুপ থাক।’

‘কিন্তু কারণ কী?’

লামিয়া মুখটা গোবেচারা করে বলল,’রেজাল্ট দিবে যে জানিস না? টেনশন হচ্ছে বাল!’

‘জানি তো। কিন্তু টেনশন কইরা লাভ কী? বিশেষ কইরা তুই, অর্ষা আর জুঁই তো একদম নিশ্চিন্তে আছিস। তোদের তো বিয়ে হয়েই গেছে। তোরা এখন আর ফেইল করলেই কি, আর পাশ করলেই কি!’

দিদার ওর সাথে সহমত পোষণ করে বলল,’এটা কিন্তু ঠিক কথা।’

লামিয়া ধমক দিয়ে বলল,’তগো মুখে পোকা পড়ব। ফেইল করব কেন বেদ্দপ?’

‘না মানে, কইলাম আরকি।’

আহিল বলল,’তোরা এবার চুপ তো থাক। আমার একটা কথা শোন। রেশমির হেল্প লাগবে।’

রেশমি নখ কামড়াচ্ছিল দাঁত দিয়ে। আহিলের কথা শুনে সেভাবেই বলল,’কী?’

‘কালকে আমার সাথে রেস্টুরেন্টে যেতে হবে আর…’

পুরো কথা শেষ হওয়ার আগে দিদার লাফিয়ে উঠে বলল,’শুধু রেশমি একা কেন? আমি কী দোষ করলাম? না মানে, আমরা কী দোষ করলাম?’

‘আগে কথা তো শেষ করতে দে।’

‘আরে রাখ! আমাদেরও ইনভাইট কর। তুই আর অর্ষা যে এ+ পাবি ঐডা আমরা জানি। আমাদেরও ট্রিট দিতে হবে। রেশমি একা কেন পাবে?’

‘এত বেশি বুঝিস কেন? বলতে আমায়।
রেশমি তোকে আমার গার্লফ্রেন্ড সেজে একটু অভিনয় করতে হবে কাল। ঐ পিচ্চি মেয়েটাকে জাস্ট বিশ্বাস করাতে হবে আমার গার্লফ্রেন্ড আছে।’

‘কেন রে ভাই? আমি কি অভিনেত্রী নাকি? আমি পারব না এসব। অন্য কাউকে বল।’

‘প্লিজ! ও তোকেই দেখেছিল আমার সাথে। এজন্য তুই গার্লফ্রেন্ড সেজে কথা বললে বিশ্বাস করবে। আর আমিও বলেছি তুই আমার জিএফ।’

‘সবসময় তোরা বলির পাঠা কেন আমাকেই বানাস বল তো? এমনেই তো কোনো বর নাই, বয়ফ্রেন্ড নাই; তার ওপর এই মিথ্যা নাটক করলে কি এই জীবনে আর বফ, বর কিছু পামু?’

‘আরে সেন্টি খাওয়া অফ কর তো।’

অর্ষা মনমরা হয়ে বলল,’আচ্ছা আমায় জানাইস তোরা রেজাল্ট। আমার ক্ষুধা লাগছে। খাব এখন।’

‘আচ্ছা খেয়ে নে আগে।’ বলল জুঁই।

আহনাফ আজ অফিসে যায়নি। কোন উপলক্ষে বা কেন যায়নি সেটা অর্ষাও জানে না। আহনাফ বলেনি। আজকাল তো সে ঠিকমতো কথাই বলে না। খেতে বসতে গিয়ে জানালা দিয়ে দেখল গ্লোরিয়া আর হেলেন আজ আবার এসেছে। আর আহনাফও সেখানেই রয়েছে।

আবার গ্লোরিয়ার সাথে এমন হেসে কথা বলা সহ্য হচ্ছিল না। সে আপেলে কামড় বসিয়ে মুখ গম্ভীর করে তাকিয়ে থাকে। স্মিথকে নিয়ে বাইরে যায়। বাড়ির সামনে ঘাসের ওপর বসে মিছে গল্প করে স্মিথের সাথে। তার দৃষ্টি ও মন তো সামনের দিকেই ছিল। অর্ষাকে দেখে হেলেনও এগিয়ে আসে।

অর্ষার পাশে বসে জিজ্ঞেস করে,’কেমন আছো অশা?’

নিজের নামের করুণ দশা দেখে মনে মনে দীর্ঘশ্বাস নেয় অর্ষা। এরপর হেসে বলে,’ভালো। আপনি?’

‘আমিও ভালো। সাদা জামায় তোমায় সুন্দর লাগছে। পরীর মতো।’

অর্ষা মৃদু হেসে বলল,’থ্যাঙ্কস।’

এরপর হেলেন গল্প জুড়ে দেয়। এই গল্প, সেই গল্প; শেষ নেই যেন। প্রথমে অর্ষার বিরক্ত লাগলেও এখন ভালো লাগছে। কারণ এই দেশ সম্পর্কে সে অনেক কিছুই জানতে পারছে।

আহনাফ আর গ্লোরিয়াও ওদেরকে গল্প করতে দেখছিল। কথা বলতে বলতে হেলেন থেমে যায়। হাত বাড়ায় অর্ষার দিকে। সহসা এমন হওয়ায় ঘাড় একটু পিছিয়ে নেয় অর্ষা।

হেলেন অর্ষার চুল থেকে ছোটো একটা পোকা এনে হেসে বলে,’এই পোকাটা তোমার চুলে ছিল।’

হঠাৎ করে তখন গ্লোরিয়া আর আহনাফের আগমন ঘটে সেখানে। অভাবনীয় একটা কাজ করে বসে আহনাফ। অর্ষার হাত ধরে উঠিয়ে দাঁড় করায়। গ্লোরিয়া, হেলেন আর স্মিথের দিকে তাকিয়ে বলল,’সবাই ভেতরে আসো।’

এরপর অর্ষার হাত বগলদাবা করে ভেতরে নিয়ে যেতে যেতে বিড়বিড় করে বলল,’এত হিহিহি, হাহাহা ভালো নয় বুঝছ!’

চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ। রি-চেক দেওয়া হয়নি। ভুলত্রুটি মার্জনীয়।]

#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#পর্ব_৩২
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_________________
অপ্রতিভ দৃষ্টিতে স্থির তাকিয়ে রয়েছে অর্ষা আহনাফের দিকে। অর্ষা দুর্বোধ্য হাসে। হুটহাট এই লোকটার হয় কী? বিড়বিড় করে সে কী-ই বা বলছে?

ড্রয়িংরুমে গিয়ে হাত ছাড়ে আহনাফ। সোফার ওপর বসে ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। না তাকিয়েও স্পষ্ট বুঝতে পারছে চার জোড়া বিস্ময় করা দৃষ্টি তার দিকেই নিবদ্ধ। অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে যাচ্ছে সে। কিন্তু বাইরে সে চেষ্টা করছে নিজেকে স্বাভাবিক দেখানোর। পায়ের ওপর পা তুলে বসে, পা নাড়াতে নাড়াতে নার্ভাসনেস দূর করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। লজ্জায়, সংকোচে পাশে উপস্থিত মানুষগুলোর দিকে তাকাতেও পারছে না। হঠাৎ করে যে তার কী হলো! কোন ভূতে ধরেছিল? ভূত নাকি পেত্নী? শেওড়া গাছের পেত্নী নিশ্চয়ই তার ঘাড়ে চেপে বসেছিল। নতুবা সে এমন হাস্যকর একটা কাণ্ড কেন ঘটাতে যাবে? বিরক্তিকর!

আহনাফ অনেকটা সাহস নিয়ে পাশে ওদের দিকে তাকাল। এবার আরো বেশি নার্ভাস হয়ে গেল সে। সবাই চোখদুটো গোল গোল করে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে কেন? কী এমন অসম্ভব, অদ্ভুত কাজটা সে করে ফেলেছে হু?

আহনাফ হাসার চেষ্টা করে বলল,’কী…কী ব্যাপার? দাঁড়িয়ে কেন? বসো তোমরা।’

হেলেন আর গ্লোরিয়া পাশের ডাবল সোফায় বসল। অর্ষা নিজেও কিছুটা লজ্জা পেয়েছে। তাই সে বসল না। স্মিথকে নিয়ে কিচেনে যেতে যেতে বলল,

‘আমি কফি নিয়ে আসছি।’

‘ভেতরে কেন আসতে বললে?’ প্রশ্ন করল গ্লোরিয়া।

আহনাফ থমকায়। মুখে বিব্রতকর হাসির ছটা। কেন ভেতরে আসতে বলেছে, তা তো সে নিজেও জানে না। সব দোষ ঐ অদৃশ্য শ্যাওড়া গাছের পেত্নীর।

সে বিব্রতকর হাসিটা হেসেই বলল,’আসার পর থেকেই তো বাইরে দাঁড়িয়ে আছো। খাবে না নাকি?’

‘বাহিরেও খেতে পারতাম। ওখানেই তো বেশ ভালো লাগছিল।’

‘খাওয়ার পর না হয় আবার যাওয়া যাবে।’

অর্ষা কফি নিয়ে আসে তখন। সবার হাতে কফি দিয়ে চলে যাওয়ার মুহূর্তে হেলেন পিছু ডাকে।

অর্ষা ঘুরে দাঁড়ানোর পর হেলেন বলল,’তুমি খাবে না?’

অর্ষা একবার আহনাফের দিকে তাকাল। আহনাফ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে। একবার চোখাচোখিও হয়ে গেল দুজনের।

দৃষ্টি সরিয়ে অর্ষা হেলেনের দিকে তাকাল। স্মিত হেসে বলল,’আপাতত ইচ্ছে করছে না।’

‘কফি খেতে আবার ইচ্ছেও লাগে নাকি? যাও কফি নিয়ে এসো। এক সাথে খেতে খেতে আড্ডা দিই।’ বলল হেলেন।

এভাবে বলার পরও মুখের ওপর না করাটা অভদ্রতা। তাছাড়া হেলেন আহনাফের বন্ধু। বাড়িতে এসেছে গেস্ট হয়ে। তাকে তো আর অপমান করা যায় না। তাই সে হেসে বলল,

‘আচ্ছা।’

অর্ষা কিচেন থেকে নিজের জন্য কফি এনে হেলেনের পাশের সিঙ্গেল সোফাটিতে বসল। কফির মগে চুমুক দিয়ে একবার সেদিকে সরু দৃষ্টিতে চাইল আহনাফ।

হেলেন কফির মগে চুমুক দিয়ে বলল,’আজ নাকি তোমার রেজাল্ট দেবে?’

অর্ষা মাথা নাড়িয়ে বলল,’হ্যাঁ।’

‘কখন?’

‘বাংলাদেশের সময়ে দুপুর বারোটার মধ্যেই বা তার কিছুক্ষণ বাদেই রেজাল্ট পাবে সবাই।’

‘তারমানে সুইজারল্যান্ডের সময়ে আটটার পরেই পেয়ে যাবে?’

‘হুম।’

হেলেন ঘড়িতে সময় দেখে বলল,’তাহলে আর বেশিক্ষণ নেই। এখন ৭:৫০ বাজে।’

অর্ষা নিরুত্তর থেকে মৃদু হাসল শুধু। হেলেন বলল,’জানো আজ সকাল সকাল আমরা এখানে কেন এসেছি?’

অর্ষা ঠোঁট উল্টিয়ে বলল,’না তো!’

‘তোমার রেজাল্ট দেবে আজ তাই আহনাফ আমাদের ট্রিট দেবে। আজ আমরা সবাই একসাথে ঘুরব। তাই তো আহনাফও আজ অফিসে যাবে না বলে ছুটি নিয়েছে।’

হেলেনের কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই বিষম খায় আহনাফ। এদিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে অর্ষা। সে তো এসবের কিছুই জানত না। এখন তার ভয় লাগছে। পরীক্ষা সে ভালো দিয়েছে। কিন্তু আহনাফের এত পসেসিভ ভাবনা দেখে ভয় লাগছে, যদি রেজাল্ট ভালো না আসে? সে কেন আগেই তার বন্ধুদের ট্রিট দেওয়ার কথা বলল? এটলিস্ট রেজাল্ট জানার পর তাদের ট্রিটের কথা বলতে পারত! এতক্ষণ রেজাল্ট নিয়ে তার মাঝে কোনো উত্তেজনাই ছিল না। কিন্তু এখন ভয়ে, উত্তেজনায় হাত-পা কাঁপছে।

এদিকে বেফাঁসে কথাগুলো বলে ফেলা হেলেনের দিকে রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করে তাকিয়ে রয়েছে আহনাফ। এসব অর্ষার সামনে বলাটা কি খুব বেশি জরুরী ছিল? আহম্মক একটা!

পরিস্থিতি কীভাবে স্বাভাবিক করবে আহনাফ কিংবা অর্ষা কেউ-ই বুঝতে পারছে না। হেলেন হয়তো নিজের ভুলটা বুঝতে পারল তাই প্রসঙ্গ পালটিয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘তুমি কোন সাবজেক্ট থেকে পরীক্ষা দিয়েছ?’

অর্ষা মিহিকণ্ঠে বলল,’আর্টস।’

‘এরপর কোন সাবজেক্ট নিয়ে পড়ার ইচ্ছে আছে?’

‘ইকোনোমিকস্।’

‘দ্যাট’স গুড।’

আহনাফ এবার উঠে দাঁড়িয়ে বলল,’তোরা কথা বল। আমি রেডি হয়ে আসছি।’

লিলিয়া তখন নাস্তা নিয়ে এসেছে। আহনাফকে যেতে দেখে বলল,’সকালেও তো নাস্তা করোনি। এখনো করবে না?’

‘রেখে দাও। পরে খাব।’ যেতে যেতে বলল আহনাফ।

অর্ষা কিছুক্ষণ বসে ওদের সাথে গল্প করতে করতে নাস্তাও করে নিল। এরপর সে রুমে চলে গেল রেডি হওয়ার কথা বলে। দরজায় ক্যাথিওন দাঁড়িয়ে ছিল। ও’কে পাশ কাটিয়ে অর্ষা ভেতরে ঢুকল।

আহনাফ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিল। অর্ষাকে দেখে জিজ্ঞেস করল,

‘গল্প করা শেষ?’

‘মানে?’

‘জিজ্ঞেস করলাম গল্প করা শেষ কিনা।’

‘কী এমন গল্প করলাম?’

‘আমি কি জানি?’

অর্ষা অযথা আর কথা বাড়াল না। এতদিন তো ঠিকমতো কথাই বলেনি। আর আজ যা একটু কথা বলছে তাও আবার ঠেস মেরে বলতেছে। এই লোকের পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত শুধু সমস্যা আর সমস্যা।

আলমারি থেকে নিজের জামা-কাপড় বের করে ওয়াশরুমের দিকে যাচ্ছিল, আহনাফ তখন পিছু ডাকল।

বলল,’আজ কোন ড্রেস পরছ?’

অর্ষা হাতের জামা-কাপড় দেখিয়ে বলল,’টপস্।’

‘এসব পরার দরকার নাই। জিন্স পরো সমস্যা নেই। বাট সাথে লং গাউন নয়তো কামিজ পরো।’

‘এটায় কী সমস্যা?’

‘এত প্রশ্ন করছ কেন? এটায় তোমায় ভালো লাগবে না তাই বললাম। তোমার ইচ্ছে হলে পরতে পারো।’

অর্ষা বিড়বিড় করে বলল,’ঘাড়ত্যাড়া!’

আবার আলমারির কাছে ফিরে গিয়ে মেরুন রঙের একটা কামিজ বের করে বলল,’এটা পরি?’

আহনাফ জামাটা দেখে বলল,’পরো।’

অর্ষা রেডি হতে চলে যায়। শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে দেখে আহনাফ এখনো রুমেই আছে।

অর্ষা তোয়ালে দিয়ে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে বলল,’আপনি এখানে বসে আছেন কেন? উনারা বোরিং ফিল করছে না একা একা?’

‘না। গ্লোরিয়া চলে গেছে। হেলেন আর স্মিথ টিভি দেখতেছে।’

গ্লোরিয়া চলে গেছে শুনে মনে মনে ভীষণ খুশি হলো অর্ষা। তবে খুশিটা প্রকাশ না করে অবাক হওয়ার ভান ধরে বলল,

‘ওমা! কেন? আজ না আমাদের সাথে ঘুরতে যাওয়ার কথা?’

‘হু। কথা তো এমনই ছিল। কিন্তু ওর বাড়ি থেকে ফোন এসেছে। জরুরী দরকার। তাই চলে গেল।’

অর্ষা মনে মনে বলল,’বেশ হয়েছে।’

এরপর সে সাজগোজ করার জন্য আয়নার সামনে বসল।

‘হেলেনকে তোমার কেমন লাগে?’

আহনাফের প্রশ্নটা শুনে কিছুক্ষণ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে থাকে অর্ষা।

আহনাফ জুতার ফিতা বাঁধতে বাঁধতে বলল,’বলছ না যে?’

হুঁশে এসে অর্ষা বলল,’কেমন লাগবে আবার?’

‘সেটাই তো জিজ্ঞেস করছি।’

‘এই প্রশ্ন কেন করছেন সেটাই তো বুঝতে পারছি না।’

‘এমনিই।’

‘সে আপনার ফ্রেন্ড। ছেলে হিসেবে খারাপ নয়।’

‘তাই?’

‘জি।’

‘এজন্যই বুঝি এত হেসে হেসে কথা বলো?’

‘কী?’

‘কিছু না।’ বলে আহনাফ রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

অর্ষা কিছুক্ষণ ওর যাওয়ার পথে তাকিয়ে থেকে বলে,’নিজে যখন গ্লোরিয়ার সাথে দাঁত কেলিয়ে কথা বলে তখন কিছু না! আর আমি হেসে কথা বললেই দোষ!’

এই মুহূর্তে সালমান খানের একটা গান মনে পড়ছে প্লাস মনেও ধরছে,’মে কারু তো শালা, ক্যারেক্টার ঢিলা হে!’
_______

আহনাফ, অর্ষা, হেলেন আর স্মিথ এই চারজনে মিলে ঘুরতে যাওয়ার জন্য বের হলো। গাড়ি ড্রাইভ করছে আহনাফ। প্যাসেঞ্জার সিটে বসে আছে হেলেন। আর পেছনে বসেছে অর্ষা, স্মিথ।

খাঁজবিহীন সরু রাস্তা ধরে গাড়ি এগিয়ে চলছে। গন্তব্য আজ উদ্দেশ্যহীন। যেহেতু ঘুরতে বের হওয়া হয়েছে তাহলে সেটা একেবারেই গন্তব্যহীন হয় কীভাবে?

অর্ষা গাড়ির কাচ নামিয়ে দিতে বলল। আহনাফ বিনাবাক্যে কাচ নামিয়ে দিল।

‘আচ্ছা আমরা কোথায় যাচ্ছি?’ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে প্রশ্ন করল অর্ষা। ঠিক কার উদ্দেশ্যে প্রশ্নটি করা হয়েছে, তা ঠিক বোঝাও যাচ্ছে না। তবে উত্তরটা হেলেনই দিল,

‘লং ড্রাইভে।’

লং ড্রাইভ শুনে অর্ষার মুখটা হা হয়ে গেল। লং ড্রাইভে যাবে তাও কিনা আবার ফ্রেন্ড আর আণ্ডাবাচ্চাকে সাথে নিয়ে। অর্ষার ভীষণ আফসোস হলো। সে নিজে এক নিরামিষ, তার কপালে জুটেছেও এক নিরামিষ। কী আর করার! সবই হচ্ছে কপাল।

গাড়ি প্রথমে একটা রেস্টুরেন্টের সামনে থামে। আহনাফ আগে নেমে সবার উদ্দেশ্যে বলে,

‘নামো।’

অর্ষার জানতে ইচ্ছে করল, লং ড্রাইভের কথা বলে এখানে কেন! তবে আহনাফের গম্ভীর মুখ দেখে প্রশ্নটি আর করা হয়নি। শেষে রাগে যদি হেলেনের সামনেও ধমক দেয় তখন? তারচেয়ে শ্রেয় চুপ করে থাকা।

আহনাফ রেস্টুরেন্টে আগে ঢুকল। স্মিথ অর্ষার ডান হাত ধরে হাঁটছে। বামপাশে রয়েছে হেলেন। সে ফিসফিস করে বলল,

‘সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে তোমার জন্য।’

অর্ষা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে হেলেনের দিকে তাকাল। তবে হেলেনের থেকে তার সুন্দর হাসিটা ব্যতীত কোনো উত্তর পেল না।

ভেতরে যাওয়ার পর সবাই মিলে একটা টেবিল দখল করে বসে। কিছুক্ষণ বাদে একজন ওয়েটার এসে সুন্দর একটি কেক দিয়ে যায়।

অর্ষা উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে জানতে চায়,’আজ জন্মদিন নাকি কারও?’

প্রশ্নটা ইংরেজিতে করায় হেলেন আর স্মিথও বুঝতে পারল। হেলেন হেসে বলল,’নাহ্। কেকের ওপর লেখাটা দেখো।’

অর্ষা মাথাটা একটু উঁচু করে লেখাগুলোর দিকে তাকাল। সেখানে লেখা,’কংরাচুলেশন ফর ইউর ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট অর্ষা।’

বিস্ময়ে হতবাক অর্ষা। সে তো এখনো তার রেজাল্টই জানে না। বাইরে ঘুরতে আসার চক্করে গ্যাঞ্জাম পার্টির সাথে কথাও হয়নি। কী এসেছে তার রেজাল্ট?

এবার আহনাফ, হেলেন আর স্মিথ সমস্বরে বলল,’কংরাচুলেশন।’

‘আপনি জানেন আমার রেজাল্ট?’ প্রশ্নটি অর্ষা আহনাফের উদ্দেশ্যে করেছে।

আহনাফ মৃদু হেসে মাথা নাড়িয়ে বলল,’হ্যাঁ। আহিল জানিয়েছে। গোল্ডেন এ প্লাস!

খুশিতে চোখ-মুখ চকচক করে ওঠে অর্ষার। আনন্দে এবার কান্না পাচ্ছে।

আহনাফ তখন শীতলকণ্ঠে বলল,’তুমি অনেক ভালো স্টুডেন্ট, আহিল এটা বলেছিল। আজ প্রমাণও পেলাম। সত্যি বলতে ভীষণ খুশিও হয়েছি।’

এ কথার পরে আর অশ্রু আটকে রাখা গেল না। দু’ফোটা অশ্রুকণা চোখের কার্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল।

একসাথে কেক কেটে, অল্পকিছু খাওয়া-দাওয়া করে আবার চারজনে মিলে ঘুরতে বের হয়। রেস্টুরেন্টে থাকতে আমেনা বেগম আর জহির চৌধুরীর সাথেও কথা হয়েছে। তারা অর্ষার রেজাল্ট শুনে ভীষণ খুশি হয়েছে। বন্ধুদের সাথে বাড়িতে ফিরে জমিয়ে আড্ডা দেবে বলে এখন খুব একটা কথা হয়নি। অর্ষা, আহিল, জুঁইয়ের গোল্ডেন এ প্লাস এসেছে, রেশমি আর দিদার এ প্লাস পেয়েছে আর লামিয়া আশিকের এ গ্রেড এসেছে। একটুর জন্য প্লাস মিস! শুধু এটুকুই কথা হয়েছে সকলের।
.
.
ঘুরাঘুরি শেষ করে রাতে বাঙালি রেস্টুরেন্টে খাবার খেতে এসেছে সবাই। হেলেন ঝাল একদম খেতে পারে না। তবুও জেদ ধরে ঝাল খেয়েছে। এখন তার করুণ অবস্থা। অর্ষা পানির বোতল, জুসের বোতল এগিয়ে দিল। এসব কিছুই আহনাফ দেখল সরু দৃষ্টিতে।

ঝালে হা-হুতাশ করতে করতে হেলেন বলল,’আর জীবনেও বাঙালি রেস্টুরেন্টে খাব না।’

‘বাঙালি রেস্টুরেন্টের দোষ নেই। ঝাল ছাড়া খাবার, কম ঝাল দেওয়া খাবারও ছিল। আপনি তো ইচ্ছে করেই এই ডিশ নিলেন।’ বলল অর্ষা।

‘আমি কি জানতাম নাকি তোমরা এত ঝাল খাও?’ ঝালে চোখ-মুখ লাল করে বলল হেলেন।

আহনাফ মিষ্টি জাতীয় খাবার এগিয়ে দিল। সেখান থেকে অল্পকিছু খেয়ে কিছুটা ঝাল কমার পর সবাই এবার বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হয়। হেলেনকে বাসায় ড্রপ করে দিয়ে ওরা নিজেদের বাড়ির উদ্দেশ্যে যায়।

স্মিথ অর্ষার গা ঘেঁষে ঘুমিয়ে পড়েছে। অর্ষা স্মিথের মাথাটা কোলের ওপর নিয়ে পিঠে হালকা চাপড় দিতে লাগল, যাতে ঘুমটা ভালো হয়। আহনাফ ভিউ মিররে তাকিয়ে এসব দেখছিল।

অর্ষাও যে আহনাফকে খেয়াল করেনি, বিষয়টা এমনও নয়। কিন্তু আবার গম্ভীর আহনাফকে দেখে তার মনটা খারাপ হয়ে যায়। এতক্ষণ তো বেশ ভালোই ছিল। হঠাৎ করে তাহলে আবার কী হলো?

অর্ষার ভাবনার মাঝেই আহনাফ গাড়ি ব্রেক করে। ভিউ মিররে অর্ষার দিকে তাকিয়ে বলে,’নামো। আমি গাড়ি গ্যারেজে রেখে আসছি।’

স্মিথকে কোলে তুলে নিল অর্ষা। আহনাফ নেমে গাড়ির দরজা খুলে দিলো। অভিমানী দৃষ্টিতে তার দিকে অর্ষা তাকালেও, আহনাফের দৃষ্টি ছিল ভাবলেশহীন। অর্ষা মনমরা হয়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে। আহনাফ ওর যাওয়ার পথে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মৃদু হাসে।

স্মিথকে লিলিয়ার কাছে দিয়ে অর্ষা নিজের রুমে গেল। লিলিয়া পেছন থেকে জিজ্ঞেস করল,

‘আজ কেমন ঘুরলে?’

অর্ষা ফিরে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,’খুব ভালো।’

‘স্মিথের জন্য তোমায় কষ্ট করতে হলো।’

‘না, আন্টি! বরং ওর সঙ্গ আমার ভীষণ ভালো লেগেছে।’

লিলিয়া হাসল। বলল,’যাও ফ্রেশ হয়ে নাও আগে।’

অর্ষা মুচকি হেসে রুমের দিকে পা বাড়ায়। তিয়াসের কথা বড্ড মনে পড়ছে। কেমন আছে সোনা বাবাইটা! কতদিন দেখা হয় না, কোলে নিয়ে আদর করা হয় না। এসব ভেবে মনটা তার আরো খারাপ হয়ে যায়।

ক্যাথিওন আর অ্যানিওন-ও এসেছে অর্ষার পিছু পিছু। আগে অ্যানিওন পালিয়ে বেড়ালেও এখন আর পালায় না। সেও এখন ক্যাথিওনের দেখাদেখি অর্ষার পিছু পিছু ঘোরে। কথায় আছে, সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে। ওদের ব্যাপারটাও এখন এমন।

মন খারাপের পরিমাণ একটু বেশি থাকায় ওদের উপস্থিতি আজ খুব বেশি ভয় পাওয়াল না। এছাড়া শরীরও ভীষণ ক্লান্ত। ফ্রেশ না হয়েই বিছানায় শুয়ে পড়বে সেই সময়ে তার ফোনটা বেজে ওঠে।

হোয়াটসএপে আননোন নাম্বার থেকে ফোন এসেছে। অর্ষা ফোন রিসিভ করে ক্লান্তস্বরে বলে,’হ্যালো।’

ঐপাশে নিরবতা। অর্ষা আবার বলল,’হ্যালো! কে বলছেন?’

‘কেমন আছিস?’

ম্রিয়মাণ কণ্ঠে ভেসে আসা কথাগুলো শুনে বিদ্যুৎ চমকানোর মতো চমকে যায় অর্ষা। অস্পষ্টস্বরে বলল,

‘কেয়া আপু!’

ঐপাশ থেকে কেয়া বলল,’হ্যাঁ। কেমন আছিস বললি না তো?’

কেয়ার ওপর এতদিনে জমে থাকা সকল রাগ-অভিমান গলে পানি হয়ে গেছে। সে কান্না করে ফেলে। ফোঁপানোর শব্দ শুনে কেয়া বলে,

‘অর্ষা? কাঁদছিস কেন তুই? আজকের দিনেও কেউ কাঁদে? কত ভালো রেজাল্ট করেছিস তুই!’

অর্ষা কান্না থামিয়ে কোনো রকমে বলল,’কেয়া আপু! তুমি কোথায় চলে গেছ বলো? কেন এভাবে চলে গেলে সেদিন? কোথায় আছো তুমি? এই নাম্বার কোথায় পেলে? এতদিন পর মনে পড়েছে? আমাদের সবাইকে ছেড়ে যাওয়ার কারণটা কী?’

ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে দীর্ঘশ্বাসের শব্দ ভেসে আসে। এরপর কেয়ার মৃদু শব্দের হাসি। হেসে কেয়া বলল,’তোর রেজাল্টের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা রইল। ভালো থাকিস।’

কথা শেষ করার সাথে সাথে ফোন কেটে দিল কেয়া। অর্ষাও সাথে সাথে আবার ফোন দিল। রিং হওয়ার পরও ফোন রিসিভ করছে না। অর্ষা আবার ট্রাই করে। বেশ কয়েকবার ট্রাই করার পর এখন আর কল যাচ্ছে না। কেয়া ব্লক করে দিয়েছে!

অর্ষাকে নিরব, নিস্তব্ধ ও অস্থির দেখে শব্দহীনভাবে রুমে প্রবেশ করে আহনাফ। ক্যাথি আর অ্যানি ও’কে দেখে ম্যাউ ম্যাউ শুরু করে। একবার অর্ষার দিকে তাকায়, আর একবার আহনাফের দিকে। হয়তো বোবা প্রাণী দুটো আহনাফকে বলতে চাচ্ছে, অর্ষা কেঁদেছে।

আহনাফ কিছু বলল না। অর্ষার পাশে বসে জুতা খুলতে খুলতে বলল,’কী হলো হঠাৎ? মন খারাপ কেন?’

আটকে রাখা কান্নাগুলো বারবার যেন দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। অর্ষা ফুঁপিয়ে ওঠে। আঁৎকে ওঠে আহনাফ।

মৃদুস্বরে ডাকে,’অর্ষা!’

অর্ষা এবার শব্দ করেই কেঁদে ফেলে। আহনাফ অস্থিরচিত্তে জিজ্ঞেস করে,’কী হয়েছে তোমার?’

উত্তর না পেয়ে অর্ষার দু’বাহু ধরে নিজের দিকে সোজা করে বসায়। হাত দুটো চেক করতে করতে জিজ্ঞেস করে,’ক্যাথি কি আবার খাঁমচি দিয়েছে? নাকি অ্যানি?’

অর্ষা কথা বলতে পারল না। ঠাই হিসেবে আহনাফের বিশ্বস্ত বুকটাকে বেছে নিল। যেখানে এখন সে ভরসা পায়, স্বস্তি পায়, শান্তি অনুভ করে। দু’হাতে সে শক্ত করে আহনাফকে জড়িয়ে ধরে।

আহনাফ অর্ষার মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরেকণ্ঠে বলল,’প্লিজ ডোন্ট ক্রাই! আই অলওয়েজ ওয়ান্ট টু সী স্মাইল ইন ইউ ফেস। এই? অর্ষা আমায় বলো কী হয়েছে?’

চলবে…

[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]