#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#পর্ব_৩৩
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
ছোট্ট পেলব শরীরখানা কিছুক্ষণ বাদে বাদে ঈষৎ কেঁপে উঠছে। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেছে অর্ষার। আহনাফ নিরুপায় ভূমিকা পালন করছে। অনেকবার জিজ্ঞেস করেও কোনো উত্তর খুঁজে পায়নি। তাই নিশ্চুপ থেকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কান্নার গতি কমলেও; একটু পরপর ফুঁপিয়ে উঠছে।
আহনাফ মৃদুস্বরে বলল,’অনেক রাত হয়েছে অর্ষা। এখন ঘুমাও।’
আহনাফকে ছেড়ে দিল অর্ষা। দু’হাতে চোখের পানি মুছে ওয়াশরুমে চলে গেল। আহনাফ কিছুক্ষণ সেভাবেই বসে রইল। অর্ষা ফ্রেশ হয়ে আসার পর সেও গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসে। এসে দেখে অর্ষা লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়েছে। ক্যাথিওন আর অ্যানিওনকে ডিম লাইটের আলোয় দেখা যাচ্ছে গুটিসুটি হয়ে অর্ষার পায়ের কাছে বসে আছে। আহনাফ আনমনেই হেসে ওঠে। ঘুণাক্ষরেও যদি অর্ষা একবার টের পায়, ওরা দুটোয় ওর এত নিকটে বসে আছে! তাহলে নির্ঘাত অর্ষা চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলবে। হঠাৎ-ই তার মনটা আবার খারাপ হয়ে যায়। অর্ষা এভাবে কাঁদল কেন? সারাটা দিন তো সব ভালোই ছিল।
বুকভরে শ্বাস নেয় সে। আবছা আলো-অন্ধকারে অর্ষার ঘুমন্ত মুখটির দিকে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ তাকিয়ে থাকে। তারপর ক্যাথি আর অ্যানিকে লিলিয়ার কাছে দিয়ে সেও নিঃশব্দে অর্ষার পাশে শুয়ে পড়ে। আনমনে ভাবতে থাকে,’মেয়েটি কি ঘুমিয়ে পড়েছে?’
_________
সকাল, নিতু আর বিথী স্কুলের সামনে থাকা সেই রেস্টুরেন্টে এসে বসে আছে। আজকে আহিল ওর গার্লফ্রেন্ডকে কি সত্যিই নিয়ে আসবে? ভাবতেই তো বুকটা কেমন ধ্বক করে উঠছে।
সকালকে মনমরা হয়ে বসে থাকতে দেখে নিতু জিজ্ঞেস করল,’মুখ পেঁচার মতো বানিয়ে রেখেছিস কেন?’
সকাল বিমর্ষ হয়ে বলল,’টেনশন হচ্ছে খুব। যদি সত্যিই উনার গার্লফ্রেন্ড থাকে?’
‘থাকলে থাকবে। দুনিয়াতে কি ছেলের অভাব আছে নাকি?’
‘উঁহু! কিন্তু তার বড্ড অভাব। সে তো এক পিস-ই।’
‘মাথা গেছে পুরা তোর!’ বিরক্ত হয়ে বলল বিথী।
সকাল গাল ফুলিয়ে বলল,’উনি যদি মিঙ্গেল হয়, তাহলে আমি আজ ক্লাসই করব না।’
‘আরে আজব! ক্লাস কেন করবি না?’
‘কারণ উনার গার্লফ্রেন্ড আছে এটা যদি সত্য প্রমাণিত হয় তাহলে বিষয়টা আমার ভালো লাগবে না। কষ্ট পাব। আর কষ্ট পাওয়া মন নিয়ে ক্লাস করা যায় না।’
বিথী কিছু বলতে যাবে নিতু তখন কনুই দিয়ে দু’পাশে দুজনকে খোঁচা দেয়। চোখের ইশারায় সামনে তাকাতে বলে। ওর ইশারা অনুযায়ী সকাল এবং বিথী সামনে দৃষ্টিপাত করে। মুহূর্তেই সকালের মনটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। আহিলের হাত ধরে আছে রেশমি। দুজনের মুখেই লেগে আছে অমায়িক হাসি।
আহিল রেশমিকে নিয়ে ওদের সামনের চেয়ারে বসল। ফোনের সময় দেখে বলল,’স্যরি তিন পিচ্চি। একটু দেরি হয়ে গেল।’
তিনজনেই নিরুত্তর হয়ে তাকিয়ে রয়েছে শুধু। রেশমি ওদেরকে পরখ করে একগাল হেসে বলল,’আসলে কী হয়েছে বলো তো, রেজাল্ট দেওয়ার আনন্দে দুজনে গতকাল রাত জেগে কথা বলেছি। ওর ঘুম সকালে তাড়াতাড়ি ভাঙলেও আমার ঘুম ভাঙেনি। একটু বেশি ঘুমাই কিনা তাই আরকি! কিন্তু আমার জান খুব ভালো জানো।’ বলে রেশমি আহিলের গাল টেনে দিলো।
আহিল প্রথমে গরম চোখে তাকালেও সকালের দিকে দৃষ্টি পড়ায় হাসার চেষ্টা করে।
সকাল নিষ্পলক তাকিয়ে রয়েছে। তার চাহনী কাতর, অসহায়। নিঃসঙ্গ প্রায় ঠেকছে তার।
আহিল রেশমির হাত নিজের হাতে নিয়ে বলল,’পরিচয় করিয়ে দেই। ও হচ্ছে রেশমি, আমার গার্লফ্রেন্ড। আর রেশমি, ও হলো সকাল। আর এই দুজন সকালের বান্ধবী।’
রেশমিও হাসিমুখে বলল,’ওহ আচ্ছা আচ্ছা! সকাল তো ভোরের সকালের মতোই স্নিগ্ধ দেখছি। তো তোমাদের নাম কী?’
নিতু ও বিথীর উদ্দেশ্যে প্রশ্নটা করে রেশমি আহিলের কাঁধে মাথা রাখল। আহিল একটু উশখুশ করলেও কিছু বলল না।
‘আমার নাম নিতু। আর ওর নাম বিথী।’ মুখে জোরপূর্বক হাসি টেনে বলল নিতু।
রেশমি এবারও হেসে বলল,’ও আচ্ছা আচ্ছা। খুব সুন্দর নাম।’
এরপর আহিলের দিকে তাকিয়ে বলল,’জান খাবার অর্ডার করবে না?’
রেশমির অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি অ্যাক্টিং দেখে আহিলের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। জান, প্রাণ, ফুসফুস আবার কী! রেশমি অবশ্য ওর রিয়াকশনে ভয় পেল না। বরং সে সকালদের উদ্দেশ্যে বলল,
‘তোমরা কী খাবে?’
সকাল এতটা সময় চুপ করেই ছিল। এবার বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। জোরপূর্বক মুখে হাসি টেনে বলল,’কিছু খাব না আপু। ক্লাসে দেরি হয়ে যাবে। যাচ্ছি এখন।’
রেশমি অস্থির হয়ে বলল,’সেকি! না খেয়েই কেন যাবে? এটলিস্ট চা-কফি তো কিছু খাও।’
‘না, আপু। ভাগ্যে থাকলে অন্য একদিন। ভালো থাকবেন আপনারা। আপনাদের দুজনের জন্যই অনেক শুভকামনা রইল।’
আহিল মুচকি হেসে বলল,’তোমার জন্যও দোয়া রইল পিচ্চি। বাই দ্য ওয়ে, তুমি এবার তোমার কথা রাখবে তো?’
রেশমি জানতে চাইল,’কীসের কথা আহিল?’
সকাল প্রত্যুত্তরে মেকি হাসি দিয়ে বলল,’নিশ্চিন্তে থাকুন। আর বিরক্ত করব না আপনাকে।’
এরপর সে নিতু এবং বিথীকে নিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেল। ওরা বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিল আহিল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
‘তোরে এত ওভার অ্যাক্টিং কে করতে বলছে হ্যাঁ?’
রেশমিও বা কম যায় কী! সেও ধমক দিয়ে বলল,’একশো বার করব। তোকে যে সাহায্য করেছি এটাই তো তোর ভাগ্য। তুই আবার আমায় ধমক দিচ্ছিস? এই দিলি তুই উপকারের প্রতিদান?’
‘একটু গার্লফ্রেন্ড সেজে না হয় কথাই বলেছিস, এতে এমন আর কী-ই বা উদ্ধার করে ফেলেছিস শুনি?’
‘আহিলের বাচ্চা! পল্টি খাইলি না তুই? দাঁড়া এক্ষুণী আমি মেয়েটাকে সব বলে দেবো।’ বলে উঠে দাঁড়ায় রেশমি।
অবস্থা বেগতিক দেখে আহিল দ্রুত রেশমির হাত চেপে ধরে। গলা নরম করে বলে,
‘স্যরি। প্লিজ রাগ করিস না! প্লিজ! আসলে আমরা বন্ধু তো এরকম রোমান্টিক অভিনয় করতে ভীষণ অস্বস্তি লাগছিল। প্লিজ রাগ করিস না।’
রেশমি গাল ফুলিয়ে রাখল। আহিল আবার অনুনয় করে বলল,’প্লিজ!’
রেশমি শুনল না। হাত ছাড়িয়ে চলে যাওয়া ধরল। কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে আবার ফিরে আসল। আহিলের করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর হয়ে বলল,
‘ঠিকাছে রাগ করব না। এখন আমি যা খাব তুই তাই খাওয়াবি। আর বাড়িতেও পার্সেল করে দিতে বলবি।’
আহিল হেসে ফেলে। হাসতে হাসতে বলে,’তুইও তো পল্টিবাজ কম না।’
রেশমিও হেসে ফেলে। আহিলের পিঠে কিল বসিয়ে বলে,’তোরই তো ফ্রেন্ড!’
‘উফ! মাঝখান থেকে আমি কিল ফ্রি খেলাম।’
রেশমি খিলখিল করে হেসে ওঠে।
.
.
আহনাফের অফিসে যাওয়ার সময় অর্ষার ঘুম ভাঙে। ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসে আগে। আহনাফ তখন টাই বাঁধছিল। অর্ষার কেন জানি ইচ্ছে করছিল আহনাফের খুব কাছে গিয়ে সযত্নে টাই বেঁধে দিতে। তবে ইচ্ছেটা সে দমিয়ে নিল।
আহনাফ ও’কে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মৃদু হাসি দিয়ে বলল,’গুড মর্নিং।’
‘মর্নিং।’
‘মন খারাপ?’
‘উঁহু!’
‘কী হয়েছে আমায় বলা যাবে?’
অর্ষা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। কী বলবে এখন সে? কেয়া ফোন করেছিল এই কথা বললে কি সে রেগে যাবে? আবার আগের মতো ব্যবহার করবে? খারাপ ব্যবহার করলেও, কথাটা তো তাকে জানানো উচিত। তবে মন সায় দিচ্ছে না। আজ বড্ড স্বার্থপর হতে ইচ্ছে করছে। লুকিয়ে রাখতে ইচ্ছে করছে এই সত্যটি। জানা নেই কাজটা সঠিক হবে নাকি বেঠিক। সবসময় এত ঠিক-বেঠিক বিবেচনা করতে নেই। করতেও হয় না।
‘অর্ষা?’
আহনাফের ডাকে বুক থেকে ভারী দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে অর্ষার। দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে বলে,
‘কিছু হয়নি তো।’
‘সত্যি বলছ তো?’
‘হ্যাঁ।’
‘তাহলে কাঁদছিলে কেন?’
‘বাড়ির কথা মনে পড়ছিল। তিয়াসের কথা বেশি মনে পড়ছিল।’
আহনাফ এগিয়ে এলো অর্ষার কাছে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,’দেখা হবে আবার ইন-শা-আল্লাহ্। এখন খাবে এসো।’
এক চিলতে সুখ অনুভূত হলো যেন মনের কোণে। বিয়ের আগে তার শান্তির জায়গা ছিল বন্ধুরা। খুব খারাপ সময়ে আহিল এভাবে মাথায় হাত রেখে ভরসা দিত। আর আজ আহনাফ! মানুষটার মনে কি জায়গা করে নিতে পেরেছে অর্ষা?
‘এসো।’ বলে অর্ষাকে নিয়ে খেতে গেল। ক্যাথি আর অ্যানি ওদেরকে দেখে দৌঁড়ে আসে কাছে। অর্ষা ভয় পেয়ে আহনাফের শরীর ঘেঁষে দাঁড়ায়।
আহনাফ হেসে বলে,’এতদিন ওদের সাথে থাকছ, এবার তো একটু সাহস সঞ্চয় করো মনে।’
‘পারব?’
‘পারবে।’
অর্ষা স্মিত হাসে। আজ সকাল থেকেই আহনাফ তার সাথে ভালো ব্যবহার করছে। পরেও এভাবে কথা বলবে তো? নাকি আবার পরিবর্তন হয়ে যাবে? অর্ষা খায় আর আহনাফের দিকে তাকিয়ে আনমনে এসব ভাবে।
খাবার শেষ করে আহনাফ অফিসে যাওয়ার জন্য বের হয়। যাওয়ার পূর্বে অর্ষাকে বলে,’মন খারাপ কোরো না। সবসময় হাসি-খুশি থাকবে।’
দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসেছে অর্ষা। আহনাফ বেরিয়ে পড়েছে। সে এবার পিছু ডাকল,
‘শুনুন।’
আহনাফ দাঁড়িয়ে পড়ে। পিছু ফিরে বলে,’কিছু বলবে?’
‘একটা কথা বলব। রাগ করবেন না তো?’
‘সেটা তো বলার পর বলতে পারব।’
‘রাগ করলে বলব না।’
‘আচ্ছা রাগ করব না। বলো।’
অর্ষা কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বলল,’যদি কেয়া আপু কখনো আপনার কাছে ফিরে আসে, তাহলে আপনি কি গ্রহণ করবেন?’
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।
#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#পর্ব_৩৪
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
______________
‘তুমি কি খুব বেশি অসুস্থ?’
অর্ষা ভ্রুকুটি করে তাকায়। আহনাফও কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলে,
‘খুব বেশি অসুস্থ না হলে এসব কী প্রশ্ন করছ? ভেতরে গিয়ে রেস্ট করো।’
আহনাফ চলে যাওয়ার মুহূর্তে অর্ষা আবার পিছু ডেকে বলে,’এটা কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর ছিল না।’
‘তোমার বলা কথাটি আসলে কোনো প্রশ্নই ছিল না। বেশি কিছু বলব না, শুধু এতটুকুই বলি সময় অনেক কিছু বদলে দিয়েছে।’
‘যদি কেয়া আপু কখনো আপনার সামনে এসে দাঁড়ায়, আপনি দুর্বল হয়ে পড়বেন না?’
‘আমার মানসিক শক্তির প্রখরতা সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা নেই। অফিসে লেট হয়ে যাচ্ছে। যাচ্ছি আমি।’
কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে আহনাফ নিজেই পিছু ফিরে তাকায়। বলে,
‘অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা কোরো না। কোনো কিছু নিয়েই না। রিল্যাক্স থাকো, ফ্রি থাকো। ভয় পেও না।’
আহনাফ গ্যারেজের দিকে চলে যায়। কিছুক্ষণ বাদে তাকে গাড়িসহ বের হতে দেখা যায়। যতক্ষণ গাড়িটি দেখা গেল, অর্ষা ততক্ষণ-ই দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইল।
দরজা লাগিয়ে সে ভেতরে চলে আসে। স্মিথ আজ স্কুলে যায়নি। লিলিয়া খাচ্ছে। তাকে দেখে অর্ষা জানতে চাইল,
‘স্মিথ আজ স্কুলে গেল না কেন?’
‘ওর শরীরটা খারাপ।’
‘ওহ। আচ্ছা রেস্ট নিক।’
‘তোমার কি মন খারাপ?’
অর্ষা হাসার চেষ্টা করে জিজ্ঞেস করল,’কেন জিজ্ঞেস করছেন?’
‘মুখ দেখে মনে হচ্ছে। আবার চিন্তিতও দেখাচ্ছে।’
‘না, না কিছু হয়নি।’ মাথা নাড়িয়ে বলল অর্ষা।
‘আমায় শেয়ার করতে পারো।’
‘কিছু হয়নি আন্টি।’
লিলিয়া খুব বুঝতে পারছে অর্ষা কিছু লুকাচ্ছে। তবে সে জানার জন্য জোর করল না। বলার হলে অর্ষা তাকে নিশ্চয়ই বলত। তাই প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,
‘আজ দুপুরে কী খাবে?’
‘যা ইচ্ছে রান্না করিয়েন।’ বলতে বলতে সে রুমে চলে যায়।
কিছুক্ষণ উদাস মনে একপাশে হাঁটাহাঁটি করে। বারান্দায় যায়, রুমে আসে। কিছুতেই মন টিকছে না। ভালো লাগছে না। বিষণ্ণ মন ভালো করার উপায়ও জানা নেই। বারবার মনে একই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। সত্যি বলতে মনের ভেতর একটা ভয়ও ঢুকে গেছে। যদি সত্যিই আহনাফ কেয়াকে ফিরিয়ে নেয় তখন অর্ষা কী করবে? নাহ্! সে তো এসব ভাবতেই পারছে না। দম আটকে আসছে। এতদিন বাদে কেয়া-ই বা কোত্থেকে এলো? কেন ফোন দিল? শুধুমাত্র রেজাল্টের জন্য শুভকামনা জানানোর জন্যই? নাকি এর পেছনে আবার অন্য কোনো কারণও ছিল! সবশেষে প্রশ্ন আরো রয়েই যায়। কেন কেয়া সেদিন পালিয়েছিল আর কোথায়-ই বা আছে সে!
এত এত প্রশ্নের যন্ত্রণায় মাথা ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম। ভয় যেন তাকে কুঁড়েকুঁড়ে খাচ্ছে। কোথাও, কোনো কিছুতেই একটুখানি স্বস্তি খুঁজে পাচ্ছে না সে।
মাথা ধরে বিছানায় শুয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ বাদে ফোন আসে লামিয়ার। অর্ষা ফোন রিসিভ করে বলল,
‘কী ব্যাপার বোকারানী? ভুলেই গেছিস একদম।’
‘ধুর! ভুলব কেন?’
‘ভুলবিই তো। বর পেয়ে বন্ধুদের ভু্লে গেছিস। কাল না বাসায় ফিরে ফোন দেওয়ার কথা ছিল? দিসনি কেন?’
‘অনেক টায়ার্ড ছিলাম রে। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, টের-ই পাইনি।’
‘হয়েছে। এখন আর এত অজুহাত দেখাতে হবে না। কী করছিস বল?’
‘এইতো শুয়ে আছি।’
‘তোদের ওখানে এখন সকাল নাকি দুপুর? মনেই তো থাকে না বাল!’
অর্ষা মৃদু হেসে বলল,’সকাল। বাংলাদেশের সাথে চার ঘণ্টা ডিফারেন্স তো। আমাদের এখানে সাড়ে দশটা বাজে।’
‘ও। এইখানে দুপুর হয়ে গেছে। ভাইয়া কোথায়? অফিসে?’
‘হুম।’
‘শালার কী কপাল! যাকে নিয়ে এক সময়ে স্বপ্ন দেখেছি, এখন সে বান্ধবীর বর হয়। আবার তাকেই আহ্লাদ করে ভাইয়া ভাইয়া ডাকছি।’ বলে লামিয়া শব্দ করে হাসে।
অর্ষাও মৃদু হাসে। হাসি থামিয়ে লামিয়া জিজ্ঞেস করে,
‘কী হয়েছে তোর? মন খারাপ কেন?’
‘সবাই আজ এই প্রশ্নটাই কেন করতেছিস?’
‘কোন প্রশ্ন?’
‘এইযে মন খারাপ কেন।’
‘মন খারাপ বলেই তো জিজ্ঞেস করলাম। এখন ঝটপট বলে ফেল দেখি, কী হয়েছে?’
‘কিছু হয়নি রে। এমনিই ভালো লাগছে না।’
‘আচ্ছা তোকে একটা গুড নিউজ দেই। শুনে তোর মন ভালো হয়ে যাবে।’
‘তাই? বল শুনি।’
‘সামনের মাসের দশ তারিখে আমি আর নিহাল সুইজারল্যান্ডে আসছি?’
‘সত্যিই? খুব খুব খুশি হয়েছি।’
‘তুমি রেডি থেকো জান। তোমাকে আমি রোমান্টিক হওয়ার টিপস দেবো এবার।’
‘ধুর! তোর ফাইজলামি ইহকালে আর যাবে না।’
‘না, আমি সিরিয়াস।’
‘চুপ! বাকি সবাই কোথায়?’
‘জানিনা। কথা হয়নি। আহিল তো মনে হয় অফিসে। জুঁই আমার মতোই শ্বশুরবাড়ি। আর বাকিরা কী করে বলতে পারলাম না।’
‘একবার সময় করে সবাই ভিডিয়ো কলে আসিস।’
‘তুই আর এই কথা বলিস না তো! আমরা ঠিকই আসি। কিন্তু আপনি নিজেই পরে আসেন না।’
‘সত্যি কথা বলব। সবার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে।’
‘আচ্ছা গ্রুপে জিজ্ঞেস করবোনে সবাই কখন ফ্রি থাকে।’
‘ঠিক আছে। দুপুরে খেয়েছিস?’
‘না রে। গোসল করে এসে তোকে কল দিলাম।’
‘যা খেয়ে নে আগে। পরে কথা হবে আবার।’
‘ঠিক আছে। আল্লাহ্ হাফেজ।’
ফোন কাটার পরও অর্ষা মনে স্বস্তি পাচ্ছে না। আহনাফকে দেখতে ইচ্ছে করছে। তার সঙ্গ পেতে ইচ্ছে করছে। আজ যে কখন অফিস থেকে আসবে কে জানে!
_________
সকাল স্কুল থেকে ফিরেই চুপচাপ। বলেছিল ক্লাস করবে না। কিন্তু রাগে, দুঃখে স্কুলে চলে যাওয়ায় আর বের হতে পারেনি। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও ক্লাসে বসে থাকতে হয়েছিল। পুরোটা ক্লাসেও সে নিরব ভূমিকা পালন করেছিল। নিতু আর বিথী কত কী বুঝাল। সকাল অবশ্য এসব কিছুই মনোযোগ দিয়ে শোনেনি। চোখের সামনে বারবার আহিল এবং রেশমির হাস্যোজ্জ্বল মুখটা ভেসে উঠেছে।
সেলিনা বেগম রুমে এসে দেখেন স্কুল ড্রেস না খুলেই সকাল শুয়ে আছে। তিনি ভেতরে ঢুকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘কিরে কী হয়েছে?’
সকাল মাথা উঁচু করে সেলিনা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল,’কিছু না মা।’
‘ফ্রেশ না হয়ে শুয়ে পড়লি যে?’
‘এমনিই।’
‘হয়েছে কী?’
‘কিছু হয়নি তো!’
‘তাহলে ফ্রেশ হয়ে খেতে আয়।’
‘ইচ্ছে করছে না এখন।’
‘অতশত কথা বুঝি না। জলদি আয়।’ বলে তিনি সকালকে ঠেলে উঠিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকিয়ে দিলেন।
ফ্রেশ হয়ে গোমড়ামুখে খেতে বসল সকাল। সেলিনা বেগম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেয়েকে দেখছেন। প্লেটে খাবার বেড়ে দিয়ে বললেন,
‘কতকিছুই তো শেয়ার করিস আমার সাথে। ইদানীং এমন কী হলো যে আমায় শেয়ার করা যায় না?’
সকাল নিরুত্তর। তিনি ফের বললেন,’তুই চাইলে আমায় বলতে পারিস সকাল। হয়তো আমি তোকে ভালো কোনো সাজেশনও দিতে পারব।’
সকাল করুণচোখে তাকিয়ে বলল,’আমি বলতে পারব না।’
‘চাইলেই বলা যায়। প্রতিটা মায়ের উচিত তার মেয়ের সাথে ফ্রি হওয়া। ভালোমন্দ বোঝানো। ফ্রেন্ডের মতো আচরণ করা। তাহলে মেয়েরা ভুল খুব কম করে। মায়েরা ভুল, ঠিক বুঝিয়ে দেয়। তুই কি আমায় বলবি সকাল?’
সকাল মাথা নত করে বলল,’আমায় তুমি ভুল বুঝো না মা। আসলে একটা ছেলেকে আমার ভালো লাগে। ওর সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানি না। ডেয়ারের মাধ্যমে কথা শুরু হয়েছিল। এরপর কীভাবে যেন ভালো লেগে গেছে।’
‘তারপর?’
‘সমস্যা হলো ওর গার্লফ্রেন্ড আছে।’
‘নামও জানিস না?’
‘আজ জেনেছি। ওর নাম আহিল।’
‘ওর গার্লফ্রেন্ড আছে এজন্য মন খারাপ?’
সকাল নিরুত্তর। তিনি জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বললেন,
‘আমি এখন যেই কথাগুলো বলব সেগুলো তোর ভালো না-ও লাগতে পারে। কিন্তু কথাগুলো যদি তুই মনে ও মাথায় রাখিস তাহলে উপকার তোরই হবে।’
সকাল জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। তিনি বলেন,’তোর বয়স কম। এই বয়সটা হলো প্রজাপতির মতো রঙিন। যা দেখবি তা-ই ভালো লাগবে। কতশত ছেলেকে চোখে ভালো লাগবে! এটা যে খারাপ তা বলব না, এটা বয়সের দোষ। অধিকাংশ ছেলে-মেয়ের সাথেই এমনটা হয়। এটা অস্বীকার যদি কেউ করে তবে সে মিথ্যে বলছে। তবে হ্যাঁ, ভালোলাগাটা কেউ প্রকাশ করে তো আবার কেউ করে না। আহিলকে তোর ভালো লেগেছে। লাগতেই পারে। এতে কোনো সমস্যা নেই। সমস্যাটা তখনই সৃষ্টি হবে, যখন তুই জানিস যে এই সম্পর্কটা হবে না; তবুও সব ছেড়েছুড়ে এসব চিন্তা করবি। এটা তোর মানসিক কষ্টের কারণ হবে, তোর ক্যারিয়ার নষ্টের কারণ হবে। তাই আমি বলব, যা হয় হোক সব মেনে নিবি। জীবনটা এখানেই শেষ নয় বরং শুরু। এসব চিন্তাভাবনা মাথায় একদম আসতে দিবি না। সব বাদ দিয়ে স্টাডিতে ফোকাস কর। সামনে তোর জন্য আরো ভালো কিছু যে অপেক্ষা করছে না তা কি তুই জানিস? আল্লাহর সিদ্ধান্তের ওপর ভরসা রাখ। আমার কথা বুঝতে পেরেছিস মা?’
মায়ের কথাগুলো যেন ম্যাজিকের মতো কাজ করল। যতটা খারাপ লাগা, কষ্ট এতক্ষণ মনের ভেতর ছিল এখন আর ততটা নেই। নিজেকে অনেকটা হালকা লাগছে। সে মাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বলে,
‘থ্যাঙ্কিউ আমার ম্যাজিশিয়ান মা। তোমার কথাগুলো আমি মনে রাখব। আর এসব নিয়ে ভাবব না।’
সেলিনা বেগম খুশি হলেন। সকাল যে তার কথাগুলো পজিটিভ ভাবে নিতে পেরেছে এতেই তিনি খুশি।
.
.
আহনাফ রাত করে বাড়ি ফিরেছে আজ। অর্ষা আসার পর থেকে তাড়াতাড়ি ফিরলেও আজ এসেছে দেরি করে। আসার পর থেকে ঠিকমতো কথাও বলছে না।
অর্ষা খাবার নিয়ে বসে আছে। আহনাফ ফ্রেশ হয়ে এসে চেয়ার টেনে বসল। প্লেটে খাবার নিতে নিতে বলল,’তুমি এখনো খাওনি?’
‘না।’
‘রাত জেগে অপেক্ষা করার দরকার নেই। খেয়ে নেবে এখন থেকে।’
‘আপনার কি অফিসে খুব কাজ?’
‘হু। লিলিয়া আন্টি আর স্মিথ কি খেয়েছে?’
‘হুম।’
আহনাফ আর কিছুই বলল না। চুপচাপ খাচ্ছে এখন। খাওয়ার পরও আর কোনো কথা বলল না। চুপচাপ শুয়ে রয়েছে। পরেরদিন সকালেও একই ঘটনা ঘটল। আহনাফ আগের চেয়েও গম্ভীর হয়ে গেছে। অর্ষা আগ বাড়িয়ে কথা বলতে গেলেও এড়িয়ে চলছে। বার বার সেধে কথা বলতেও খারাপ লাগে। তাই অর্ষাও হাল ছেড়ে দিয়ে একদম চুপচাপ হয়ে গেছে।
একদিন সকালের কথা। আহনাফের ঘুম থেকে উঠতে লেট হয়ে গেছে। তাড়াহুড়া করে গোসল সেরে আসে। বিছানার ওপর রাখা শার্ট তাড়াতাড়ি গায়ে জড়াতে গিয়ে দেখে সবগুলো বোতাম ছেঁড়া।
সে চেঁচিয়ে অর্ষাকে ডাকে। অর্ষা দৌঁড়ে আসে লিভিং রুম থেকে। ভীতিকণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
‘কী হয়েছে?’
আহনাফ এগিয়ে যায় অর্ষার কাছে। একদম কাছাকাছি গিয়ে বলে,’কী হয়েছে? জানো না তুমি? শার্টের বোতাম কেন ছিঁড়েছ?’
অর্ষা হা করে তাকিয়ে থাকে। অবাক হয়ে বলে,’আমি ছিঁড়েছি? কই না তো!’
‘মিথ্যে বলবে না বলে দিচ্ছি।’
‘আমি মিথ্যে বলছি না।’
আহনাফ ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করে,’আমাকে দেখে কি বোকা মনে হয়?’
অর্ষা নার্ভাস হয়ে বলে,’হ্যা!’
‘কী!’
‘না! মানে হ্যাঁ, না।’
আহনাফ কটমট করে তাকিয়ে থাকে। অর্ষা ঢোক গিলে বলে,
‘ঠিক আছে, শার্টটা খুলুন। আমি বোতাম লাগিয়ে দিচ্ছি।’
আহনাফ ভ্রুঁ কুঁচকে বলে,’সিরিয়াসলি? শার্ট খুলব?’
অর্ষা ইতস্ততবোধ করে। সে তো শার্টের বোতাম লাগানোর জন্যই বলল। আহনাফ আবার অন্যভাবে নিল নাকি কথাটা? সে দৃষ্টি নামিয়ে আমতা আমতা করে বলে,
‘নয়তো বোতাম লাগাব কীভাবে?’
আহনাফ বাঁকা হেসে বলে,’আমি তো ভেবেছিলাম সিনেমা, ড্রামায় যেমন নায়ক শার্ট পরা অবস্থাতেই নায়িকা বোতাম সেলাই করে লাগিয়ে দেয়, তুমিও তাই করবে। যদি তা-ই না করো তাহলে শার্টের বোতাম ছিঁড়লে কেন?’
অর্ষা ভ্রুকুটি করে তাকায়। এই লোকটাকে সে কিছুতেই বোঝে না। একটু আগে বোতাম ছেঁড়া বলে তাকে ধমকাল; যদিও সে আদতে সত্যিই ছিঁড়েনি। এখন আবার বলছে সে শার্ট পরা অবস্থাতেই যেন সিলিয়ে দেয়। অসম্ভব! আহনাফও অবশ্য এমন কিছু চায়নি। তাই সে শার্ট খুলে বিছানায় ফেলে অন্য একটা শার্ট পরে নেয়।
অফিসে যাওয়ার পূর্বে বলে যায়,’রাগ ভাঙানোটাও এখনো শিখতে পারোনি।’
অর্ষা কিছুই বুঝল না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল।
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]