#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#পর্ব_৩৭
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
স্তব্ধ প্রায় আহনাফের দৃষ্টি অর্ষার দিকে স্থির। সে ঠিক দেখছে, ঠিক শুনছে নাকি সবটাই তার বিভ্রম; এসব নিয়ে এখন সে সন্দিহান। অর্ষা কি সত্যিই গান গাইল? তাও আবার তাকে ডেডিকেট করে?
গান শেষ করে অর্ষাও চুপ করে বসে রয়েছে। তার মাথা নত। হাত-পা এখনো কাঁপছে। আহনাফের দিকে তাকানোরও পর্যন্ত সাহস হচ্ছে না। চোখ দুটো সে লজ্জায় বন্ধ করে রেখেছে।
ঠিক কতক্ষণ এভাবে কেটেছে তা রুমে উপস্থিত থাকা দুজনের কেউ-ই বুঝতে পারেনি। রুমের পিনপতন নিরবতা কাটিয়ে আহনাফ-ই প্রথম বলল,
‘তুমি অনেক সুন্দর গান গাও।’
ফট করে চোখ মেলে তাকাল অর্ষা। দৃষ্টি মেলে স্বচ্ছ ধাতব আয়নায় আহনাফের মুখটি দেখে নিল। তবে ব্যর্থ হলো, মানুষটির মুখাবয়ব বুঝতে।
অর্ষা নিরুত্তর রইল। আহনাফ নিজে থেকেই প্রশ্ন করল,’গানটা কি তুমি আমায় ডেডিকেট করলে?’
এরপর কয়েক সেকেন্ড থেমে আয়নার সামনে থাকা ফোন দেখে বলল,’ওহ আচ্ছা, তুমি গান রেকর্ড করছিলে! স্যরি, আমি ভেবেছিলাম আমার জন্য গেয়েছ।’
অর্ষা প্রচণ্ড রকম আহত হলো। মানুষ রসকষহীন হয় ঠিক আছে। তাই বলে এতটা? দুজনকে একই রকম হতে হবে? আহনাফের রাগ ভাঙানো তো দূরে থাক! তার নিজেরই এবার প্রচণ্ড রকম রাগ হচ্ছে। বৃথা, বৃথা! সবকিছু বৃথা। উনার রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করাটাও বৃথা। অযথাই সে এতসব চেষ্টা করতে গিয়েছিল।
রাগের চোটে অর্ষা আর কিছু না বলেই বসা থেকে উঠে গেল। ফোনটা অফ করে বিছানায় রেখে আলমারি থেকে থ্রি-পিস নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। রাগে তার কান্নাই চলে আসছে। গানটা তার জন্য গেয়েছি কিনা এটা জিজ্ঞেস করার পর উত্তর দেওয়ার একটা সুযোগ তো দিতে হবে? সুযোগ তো দিলোই না, উলটো নিজের মতো করে সব ভেবে নিল। বে’কু’ব একটা! সে কি এটাও বোঝে না অর্ষা কাকে গান রেকর্ড করে শোনাবে? সে তো সোশ্যাল মিডিয়াতে কখনো গান আপলোড করে না। এসব তো তার জানা কথা। ধ্যাত! এসব বলেই বা কী হবে! দুজনই চাপা স্বভাবের, আনরোমান্টিক হলে এমনটা হওয়া অস্বাভাবিক কিচ্ছু নয়।
নিজের মনে প্রলাপ বকতে বকতে কাপড় পরিবর্তন করে ওয়াশরুম থেকে বের হয় অর্ষা। শব্দ করে ওয়াশরুমের দরজা লাগানোতে আহনাফ চমকে ওঠে।
ভ্রুঁ কিঞ্চিৎ বাঁকা করে জিজ্ঞেস করে,’কী হয়েছে?’
অর্ষা গম্ভীর হয়ে উত্তর দিলো,’কিছু না।’
‘শাড়ি কেন চেঞ্জ করলে? সুন্দর লাগছিল তো।’
অর্ষা বিছানায় নিজের জায়গায় গিয়ে বসল। বালিশ ঠিক করতে করতে বলল,’আমি কারো থেকে প্রসংশা শুনতে চাইনি।’
এরপর সে অন্যপাশ ফিরে শুয়ে পড়ে। আহনাফ অর্ষার হঠাৎ এমন পরিবর্তনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। এতদিন সে অর্ষার ভীতু স্বভাব দেখেছে। লজ্জা পেতে দেখেছে। ভয় পেতে দেখেছে। কান্না করতে দেখেছে। কখনো রাগ কিংবা অভিমান করতে দেখেনি। আজ প্রথম সে অর্ষার এমন রূপ কিংবা স্বভাবের সাথে নতুন করে পরিচিত হয়েছে। মনে মনে সে বিড়বিড় করে বলল,
‘সবকিছু কেমন উলটো হয়ে গেল মনে হয়! রাগ তো আমার করার কথা। ও কেন রাগ করছে?’
পরেরদিন সকাল থেকে সবকিছু আরো বেশি পরিবর্তন হতে শুরু করল। আগে শুধু আহনাফ গম্ভীর হয়ে থাকলেও, রাত থেকে অর্ষাও গম্ভীর হয়ে থাকে। ঠিকমতো কথা বলে না। সহজ ভাষায় বলতে গেলে প্রয়োজন ছাড়া আহনাফের সাথে কোনো রকম বাক্য বিনিময় করে না। সকালে দুজনে একসাথে এখন আর নাস্তাও করে না। আগে আহনাফ বাড়ি ফিরলে অর্ষা সাথে সাথে রুমে যেত। কিন্তু এখন আর সেটা করে না। বরং আহনাফের বাড়ি ফেরার সময় হলে সে স্মিথকে নিয়ে টিভিতে কার্টুন দেখে কিংবা ও’কে পড়ায়। নতুবা লিলিয়ার সাথে গল্পগুজব করে। লিলিয়া জোর করে পাঠাতে চাইলেও অর্ষা যায় না। একটা না একটা অজুহাত, বাহানা দাঁড় করিয়ে দেয়।
আহনাফও পরিবর্তনে কম যায় না। অর্ষার পরিবর্তনে তারও রাগ বেড়েছে। সেও এখন আর রাতে বাড়িতে খায় না। বাইরে থেকে ডিনার করে আসে। সকালে অর্ষা ঘুম থেকে ওঠার আগেই অফিসে চলে যায়। কালেভদ্রে হুটহাট সকালে অর্ষা আগে উঠলে তখনই যা একটু চোখাচোখি হয় তবে ভুলেও বাক্য বিনিময় হয় না। কফি প্রয়োজন হলে এখন আর সে অর্ষাকে বলে না। হয় লিলিয়াকে বলবে নয়তো নিজে গিয়ে বানিয়ে আনবে। আগে প্রায়ই চেষ্টা করত অফিসের কাজ শেষ করে সন্ধ্যার মধ্যে বাড়িতে ফিরতে। এখন সেই চেষ্টা তো দূরে থাক; কাজ আগে শেষ হলেও বাড়িতে ফিরে লেট করে। সেই সময়টুকু হেলেনের সাথে কিংবা অফিসের কোনো কলিগের সাথে কাটায়। বারে যায় নয়তো সিনেমা দেখতে যায়। তবে হ্যাঁ, বারে গেলেও সে ড্রিঙ্কসটা এখন আর করে না।
দুজনের আমূল পরিবর্তন দিনের সূর্য এবং রাতের চন্দ্রের মতোই দৃশ্যমান হয় লিলিয়ার সামনে। সে বেশ কিছুদিন ধরেই দুজনের পরিবর্তনগুলো লক্ষ্য করছিল। সরাসরি অবশ্য এসব বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করেনি। ভেবেছিলেন মান-অভিমান হয়েছে হয়তো। ঠিক হয়ে যাবে। সময়ের সাথে সাথেও যখন কোনো কিছুই ঠিক হচ্ছিল না তখন তিনি আমেনা বেগমকে সবটা জানান। সব শুনে আতঙ্কে আমেনা বেগমের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। পাছে দুজনের সম্পর্কটা আবার শুরু হওয়ার আগেই শেষ না হয়ে যায়! এই ভয়ে বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে ওঠে।
তিনি অস্থিরচিত্তে জানতে চান,’তুমি আমায় আগে কেন এসব বলোনি লিলিয়া?’
‘আমি ভেবেছিলাম সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।’
‘তুমি ভাবলেই সব হবে? বাচ্চা দুটোর মনে কী চলছে তা তো তুমি, আমি কেউ জানি না। ভয় হচ্ছে ভীষণ। যতই চাচ্ছি সম্পর্কটা স্বাভাবিক করতে, ততই দেখছি বেঁকে যাচ্ছে। এমন কেন হচ্ছে লিলিয়া?’
লিলিয়া আমেনা বেগমকে আশ্বস্ত করে বললেন,’আপনি টেনশন করবেন না ম্যাম। শান্ত হোন। সবকিছু আবার ঠিক হয়ে যাবে।’
‘কীভাবে ঠিক হবে? একজন রাগ করলে অন্যজন রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করে। এখন দুজনই যখন রাগ করে থাকে, তখন রাগ কে ভাঙাবে? তুমি নাকি আমি?’
লিলিয়া অসহায় দৃষ্টিতে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমেনা বেগম হা-হুতাশ করে বলেন,’এখন আমি কী করব লিলিয়া?’
‘আপনি একটু শান্ত হোন ম্যাম। এমন করলে তো শরীর খারাপ করবে আপনার।’
‘তুমি আছো শরীর খারাপ নিয়ে! আমার তো মন চায় ম’রে যাই। ওদের সুন্দর একটা সম্পর্ক বোধ হয় আমার দেখা হবে না।’
আমেনা বেগমের দুশ্চিন্তা বেশ ভালো করেই লিলিয়া বুঝতে পারছে। কেননা সে জানে, আমেনা বেগম আহনাফকে কতটা ভালোবাসেন। তিনি এটাও জানেন, আমেনা বেগম কতটা চেষ্টা করছেন ছেলে এবং বউকে এক করার জন্য।
আমেনা বেগম রেণুকে ডেকে এক গ্লাস পানি আনতে বললেন। পানি পান করে লিলিয়াকে জিজ্ঞেস করলেন,’অর্ষা এখন কোথায়?’
‘কিচেনে। রান্না করছে। আজ নাকি ওর ফ্রেন্ড আসবে। রাতে এখানেই ডিনার করবে।’
আমেনা বেগমের কপালে ভাঁজ পড়ে। আনমনে বলেন,’ফ্রেন্ড!’
পরমুহূর্তে মনে পড়েছে এমনভাবে বললেন,’ওহ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। লামিয়া সুইজারল্যান্ড যাবে অর্ষা বলেছিল আমায়। কখন ওদের ফ্লাইট জানো কিছু?’
‘আরো আগেই নাকি চলে এসেছে। হোটেলে উঠেছে আপাতত। সন্ধ্যায় এই বাসায় আসবে।’
আমেনা বেগম খুশি হয়ে বললেন,’যাক ভালোই হলো। লামিয়া এলে আমার সাথে কথা বলিয়ে দিও তো।’
‘ঠিক আছে।’
‘এখন গিয়ে অর্ষাকে সাহায্য করো। আমি রাখছি।’
ফোন রেখে লিলিয়া কিচেনে যায়। অর্ষা সবজি কাটতে কাটতে জিজ্ঞেস করে,’আজকে উনি কখন আসবে জানেন?’
লিলিয়া বলল,’না।’
‘ফোন দিয়ে বলবেন, পারলে যেন আজ তাড়াতাড়ি আসে।’
‘তুমি ফোন দিলেই তো হয়। ঝগড়া হয়েছে তোমাদের?’
অর্ষা কৌশলে প্রশ্নটি এড়িয়ে গিয়ে বলল,’এখনই ফোন করে বলে দিন। তাহলে উনি অফিসের কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করতে পারবেন।’
লিলিয়াও অর্ষার এড়িয়ে যাওয়াটা বুঝতে পারল। তবে কিছু বলল না আর এই বিষয়ে।
.
.
সন্ধ্যার আগ দিয়ে সব রান্নাবান্না শেষ করে, বাড়ি-ঘর গুছিয়ে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে অপেক্ষা করছিল অর্ষা। আহনাফ এখনো আসেনি। লিলিয়া ফোন করার পর শিওর আসতে পারবে নাকি জানে না বলেছিল। তাই অর্ষা ধরেই নিয়েছে, সে হয়তো আজও রাত করেই বাড়িতে ফিরবে।
কলিংবেলের শব্দ শুনেই অতি উৎসাহে দরজা খুলতে চলে যায় অর্ষা। দরজা খুলে রীতিমতো অবাকও হয়। লামিয়া, নিহাল দাঁড়িয়ে আসে। ওদের ঠিক পেছন থেকেই হেঁটে আসছে আহনাফ।
লামিয়া তো আনন্দে চিৎকার করে শক্ত করে অর্ষাকে জড়িয়ে ধরে। অন্যদিকে অর্ষা আনন্দে কেঁদে ফেলে।
শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেই লামিয়া জিজ্ঞেস করে,’কেমন আছিস?’
‘আমি তো ভালো আছি। তুই কেমন আছিস? ঠিকঠাকভাবে আসতে পেরেছিস তো?’
‘ইয়েস ম্যাম। ভাইয়া আমাদের হোটেল থেকে পিক করেছে।’
অর্ষা অবাক হয়ে একবার আহনাফের দিকে তাকাল। তার দৃষ্টির ভাষায় জিজ্ঞাসাবাদ।
আহনাফ বুঝতে পেরে বলল,’আহিলের থেকে খোঁজ নিয়েছিলাম কোন হোটেলে আছে। তাই ভাবলাম অফিস থেকে ফেরার পথে সাথে করে নিয়েই আসি।’
অর্ষা প্রত্যুত্তরে আহনাফকে কিছু না বলে ওদেরকে ভেতরে নিয়ে গেল। ড্রয়িংরুমে বসিয়ে হালকা নাস্তা আনতে যায়। ওর পিছু পিছু ক্যাথি আর অ্যানিও যায় রান্নাঘরে। আবার ওর সাথেই আসে। এসব দেখে লামিয়া হেসে জিজ্ঞেস করে,
‘এ দুটো তোর বডিগার্ড নাকি?’
লামিয়ার পাশে বসে অর্ষা বলল,’কী জানি ভাই! এই বাড়িতে আসার পর থেকেই পিছু ছাড়ে না।’
‘এখন আর ভয় পাস না?’
‘পাই। তবে আগের মতো না। নে খাওয়া শুরু কর।’
এরপর সে নিহালের দিকে তাকিয়েও খেতে বলল। আহনাফও ফ্রেশ হয়ে এসে ওদের সাথে যোগ দেয়। অর্ষা লিলিয়া এবং স্মিথের সাথেও লামিয়া আর নিহালের পরিচয় করিয়ে দিলো।
গল্প করতে করতে লামিয়া আহনাফের উদ্দেশ্যে বলল,’ভাইয়া কয়টা দিন অফিস থেকে ছুটি নিতে পারবেন না?’
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আহনাফ বলল,’হঠাৎ ছুটি কেন?’
‘না, মানে তাহলে চারজন একসাথে কোথাও ঘুরতে যেতাম। আমাদের সাথে আপনাদের হানিমুনটাও নতুন করে হয়ে যেত।’
লামিয়ার বেফাঁসে বলে ফেলা কথা শুনে বিষম ওঠে আহনাফের। অর্ষা অপ্রস্তুত হয়ে যায়। নিহাল অপ্রতিভ হয়ে লামিয়ার থেকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে।
তিনজনের এমন মুখভঙ্গি দেখে লামিয়া বলে,’কী ভাই? তোমাদের রিয়াকশন এমন কেন? আমি তো আর এক রুমে হানিমুন করার কথা বলিনি।’
অর্ষা কটমট করে তাকিয়ে বলে,’মুখটা অফ কর প্লিজ! তুই এখনো তেমন কিছুই খাসনি। আগে খাওয়া শুরু কর।’
লামিয়াও নাছোড়বান্দা। সে আবারও আহনাফের কাছে জানতে চায়,’ভাইয়া যাবেন না হানিমুনে?’
আহনাফ অপ্রস্তুত হাসার চেষ্টা করে। একবার নিহালের দিকে তাকায় তো একবার লামিয়ার দিকে। নিহালও আহনাফের মতো অপ্রস্তুত হাসার চেষ্টা করে। অর্ষা তো ভুলেও আহনাফের দিকে তাকাচ্ছে না। ও তো ভাবতেও পারেনি, একদম শুরুতেই প্রথমদিন লামিয়া এমন কোনো কথা বলতে পারে। বলেছে তো বলেছে তাও আবার আহনাফকে! সবার সামনে! হায় আল্লাহ্!
আহনাফের মনের ভেতর এখন একটা গানের সুরই বারবার বাজতেছে,’আমি ফাঁইসা গেছি, আমি ফাঁইসা গেছি মাইনকা চিপায়!’
পরিস্থিতি সামলাতে নিহাল বলল,’ভাইয়া ওরা খাওয়া-দাওয়া করুক। গল্প করুক। চলেন আমরা একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি।’
নিহালের প্রস্তাবে আহনাফ যেন প্রাণ ফিরে পেল। বিদ্যুৎবেগে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,’হ্যাঁ, শিওর। চলুন।’
লামিয়াকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিহালকে নিয়ে বাড়ি থেকে সটকে পড়ল আহনাফ। যাওয়ার পথে বিড়বিড় করে বলল,’এমন শালীকা যেন আল্লাহ্ শত্রুকেও না দেয়!’
চলবে…
#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#পর্ব_৩৮
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
‘তোর কী লজ্জা-শরম কিছু নেই? মুখে কিছুই আটকায় না? কোথায় কী বলতে হবে সেটাও জানিস না?’
গম্ভীর হয়ে প্রশ্নগুলো লামিয়ার দিকে ছুঁড়ে দিল অর্ষা। লামিয়া তখন আপেল খাচ্ছিল। অর্ষার প্রশ্ন শুনে ভ্রুঁ জোড়া কুঞ্চিত করে রাখে।
আরো একবার আপেলের টুকরায় কামড় বসিয়ে বলে,’কী আজব! তুই এত হাইপার হয়ে যাচ্ছিস কেন? আমি তো খারাপ কিছু বলিনি।’
‘খারাপ কিছু বলিসনি, আবার ভালো কিছুও বলিসনি।’
‘কোনটা ভালো বলিনি বল তো?’
‘উনাকে তোর হানিমুনের কথা কেন জিজ্ঞেস করতে হবে? তখন নিহাল ভাইয়াও ছিল।’
‘তাতে কী এমন সমস্যা হয়েছে শুনি? সম্পর্কে তোর হাজবেন্ড আমার দুলাভাই হয়। আর আমার হাজবেন্ড তোর দুলাভাই হয়। এত আনইজি ফিল করার কী আছে?’
‘তোর মতো ঠোঁটকাটা স্বভাবের মানুষদের কাছে দুনিয়ার সবকিছুই স্বাভাবিক।’
লামিয়া এবার গাল ফুলিয়ে বলল,’কতদিন পর আমাদের দেখা হয়েছে! কোথায় একটু আদর-যত্ন করবি। তা না করে তুই আমায় বকতেছিস? বিয়ের পর এত চেঞ্জ হয়ে গেছিস? এখন আমাদের একটুও ভালোবাসিস না।’
অর্ষা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে লামিয়ার কাঁদো কাঁদো মুখটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সে এখানে এমন কী-ই বা বলল? সে একটু আহ্লাদী হওয়ার চেষ্টা করে বলল,
‘তুই ভুল বুঝতেছিস লামু। আমি তো শুধু…’
‘তুই আর আমার সাথে কথাই বলিস না। চুপ থাক।’
অর্ষা তাকিয়ে থাকে নিরুত্তর হয়ে। লামিয়াও কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। এরপর ব্যাগ থেকে ফোন বের করে বলে,
‘কেউ আমাকে বাড়ির ওয়াইফাই পাসওয়ার্ডটা দেবে?’
এই যাত্রায় অর্ষা হেসে ফেলে। ফোনটা নিয়ে ওয়াইফাই কানেক্ট করে দেয়।
লামিয়া সরাসরি হোয়াটসএপে গিয়ে ভিডিয়ো কল করে। ভাগ্য ভালো থাকায় সবাই তখন অনলাইনেই ছিল। একে একে সবাই কলে জয়েন করে।
লামিয়ার গোমড়া মুখ দেখে প্রথমেই সবাই জানতে চায়,’কী হয়েছে তোর? মুখটা ওরকম করে রেখেছিস কেন?’
লামিয়া কাঁদোকাঁদো স্বরে অভিযোগ করে বলল,’তোরা কি জানিস, আমাদের বোকারানী কত চেঞ্জ হয়ে গেছে?’
সবাই চোখ বড়ো বড়ো করে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। উৎকণ্ঠিত হয়ে রেশমি জিজ্ঞেস করে,’কেন রে? কী হয়েছে?’
‘ও আর আমাদের ভালোবাসে না!’
অর্ষা চুপচাপ লামিয়ার কাহিনি দেখছিল আর বাকি বন্ধুদের কথা শুনছিল। আশিক এবার মৃদু ধমক দিয়ে বলে,
‘নাটক না করিয়া, কী হইছে বলো ফেলিয়া। নয়তো এমন থা’প্প’ড় দিমু, পরে ফ্যাসফ্যাস করে দিবা কান্দিয়া।’
জুঁই এবার আশিককে পাল্টা ধমক দিয়ে বলে,’তোর বোরিং কবিতা আগে বন্ধ কর প্লিজ!’
আশিক তেলে-বেগুনে জ্ব’লে উঠে বলে,’হোয়াট! বোরিং কবিতা? কোনটাকে তুই বোরিং কবিতা বলছিস মূ’র্খ নারী! তোর কোনো আইডিয়া আছে? আছে কোনো আইডিয়া? আমি যদি কবিতার বই বের করি, হাজার হাজার মেয়ে ভক্ত আমার পিছু পিছু ঘুরবে। আর সেদিন লাইন ধরে তোদের আমার অটোগ্রাফ নেওয়া লাগবে। তবুও আমি তোদের পাত্তা দেবো না। বিশেষ করে তোকে। তোর কুইকুই স্বভাব আমার একদম পছন্দ না আন্টির বাচ্চা জুঁই!’
লামিয়া এবার চিৎকার করে বলে,’বা’লগুলা থামবি তোরা! তোদের ঝগড়া শোনার জন্য ফোন দিছি?’
সবাই এবার চুপ হয়ে যায়। আহিল বলে,’লামিয়া তুই বল কী হয়েছে?’
‘বলিস না ভাই দুঃখের কথা!’
নাক টেনে এবার লামিয়া সব বলল। সব শুনে বাকিরা হাসতে হাসতে শেষ। লামিয়ার এতে রাগ আরো বেশি হয়।
আহিল লামিয়াকে শান্ত করে বলে,’তুই রাগ করতেছিস কেন? অর্ষা ঠিকই বলেছে। সব কথা কি সবার সামনে বলা মানায়?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ এখন তো তুই ওর সাপোর্ট নিবিই। এসেছিলাম দুইটারে রোমান্টিক বানাব। আর এদিকে বোকারানী আমার বে’ই’জ্জ’তি করতেছে।’
অর্ষা এবার নিজের জায়গা ছেড়ে লামিয়ার পাশে গিয়ে বসে। গলা জড়িয়ে ধরে বলে,’আচ্ছা স্যরি। ভুল হয়ে গেছে আমার। মাফ কর এবার।’
লামিয়া মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকে। দিদার বলে,’ঝগড়াঝাঁটি অনেক হয়েছে। এবার মিলেমিশে যা দুজনে।’
লামিয়া মুখ গোমড়া করেই বলল,’আমি জুস খাব।’
অর্ষা হেসে বলল,’আমি নিয়ে আসছি।’
আশিক বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে বলল,’লামিয়া আসার সময় মনে করে কম্বলটা কিন্তু নিয়ে আসিস।’
‘মুখ খারাপ করিস না।’
‘ভালো কথা বললেও তোর মুখ খারাপ হয়। মন খারাপ হয়। মেজাজ খারাপ হয়। সব খারাপ শুধু তোর-ই কেন হয় বল তো?’
‘ধুর! তোর সাথে ঝগড়া পরে করব। এখন আমার কাজ আছে। ফোন রাখি।’
রেশমি জিজ্ঞেস করল,’তোর আবার কী কাজ?’
‘রোমান্টিক বানাতে হবে না দুইটারে? সেই কাজ।’
সবাই হেসে বলল,’অল দ্য বেস্ট।’
ফোন রেখে সোফার ওপর পা উঠিয়ে বসল লামিয়া। অ্যানিওন ওর সামনে ফ্লোরে বসে রয়েছে। ক্যাথিওন অর্ষার পিছু পিছু কিচেনে গিয়েছে।
লামিয়া অ্যানিওনের দিকে তাকিয়ে হেসে হেসে বলল,’কী ব্যাপার বিল্লু? কী দেখো? তোমাদের বাড়ির কর্তা আর কর্তী যে এত আনরোমান্টিক জানো সেটা?’
অ্যানিওন ম্যাউ ম্যাউ করে ওঠে।
‘ম্যাউ ম্যাউ করো কেন? জানো নাকি জানো না? আচ্ছা যাই হোক, তুমি চুপ করে বসে থাকো। আমি কাজ করি।’
এরপর সে ফোনটা হাতে নিয়ে কী যেন করতে থাকে। অর্ষা জুস নিয়ে আসলে সে না তাকিয়েই বলল,’রাখ টেবিলের ওপর।’
জুসের গ্লাস রেখে অর্ষাও পাশে বসে। অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে ধৈর্যহারা হয়ে বলল,’এত মনোযোগ দিয়ে ফোনে কী করছিস?’
‘কাজ করছি।’
‘কাজ? কী কাজ?’
‘রোমান্টিক হওয়ার উপায় খুঁজতেছি গুগলে।’
‘কী! পাগল হয়ে গেছিস নাকি তুই? মাথা ঠিক আছে?’
‘সবই ঠিক আছে। শুধু তোরাই ঠিক নেই। আনরোমান্টিকের বস্তা!’
অর্ষা এবার লামিয়ার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে বলল,’এত মহান কাজ করার কোনো দরকার নেই ম্যাম। আপনি জুস খান।’
লামিয়া জুসের গ্লাস নিয়ে চুমুক দিয়ে বলল,’আচ্ছা বেশ। গুগল-টুগল বাদ। আমি নিজে থেকে তোকে কিছু ট্রিক্স শেখাচ্ছি।’
‘চুপ করবি?’
‘না। আচ্ছা তোরা কখনো চু’মু খেয়েছিস?’
অর্ষা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। লামিয়া উৎসাহের সাথে কাছে এসে শরীর ঘেঁষে বসে। হাত ধরে বলে,’আহা! লজ্জা পাচ্ছিস কেন? আমিই তো! বল না।’
‘প্লিজ! তোর এসব ফা’উ’ল কথা বাদ দে বইন।’
‘শোন, এগুলা ফা’উ’ল কথা না। রোমান্টিক কথা। তোরা যদি এমন আনরোমান্টিক থাকিস তাহলে আমাদের গ্যাঞ্জাম পার্টির আর খালা, মামা কিছু হওয়া লাগবে না। আমি তোকে শিখিয়ে দিলে সমস্যা কী?’
‘রাখ তো! সে যে কত রোমান্টিকতা বোঝে তা আমার জানা হয়ে গেছে। সেদিন তোদের কথামতো রাগ ভাঙানোর জন্য গান শুনালাম তাকে ডেডিকেট করে। তার পছন্দের খাবার রান্না করলাম। তার জন্য শাড়ি পরলাম। সাজলাম। আর সে কিনা! মানে কী বলব আর! জাস্ট বিরক্ত লাগে আমার।’
‘এই যা! তুইও দেখি তার ওপর রেগে আছিস?’
‘এমন করলে রাগ হবে না?’
‘অবশ্যই হবে। থাক, ব্যাপার না। এখন তো আমি এসেই পড়েছি। সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে।’
‘বাদ দে তো। তোর কিছু করা লাগবে না। তোরা ঘুরতে এসেছিস। ঘোরাফেরা কর। ইনজয় কর। ঐ ব্যাটাকে রোমান্টিসিজম বোঝাতে হবে না। শেখাতেও হবে না।’
‘শোন, রোমান্টিসিজম সব মানুষের মধ্যেই থাকে। কেউ প্রকাশ করতে পারে, আবার কেউ প্রকাশ করতে পারে না। সমস্যাটা হয় তোর মতো লাজুক আর তার মতো চাপা স্বভাবের মানুষদের জন্য।’
অর্ষা এই বিষয়ে আর কিছু না বলে অন্য কথা বলল,’কিছু খাবি? বানিয়ে দেবো?’
‘উম! চটপটি খেতে ইচ্ছে করছে খুব। বানিয়ে দিবি?’
‘অবশ্যই। তোর যা খেতে ইচ্ছে করবে আমাকে বলবি শুধু।’
লামিয়া খুশিতে অর্ষাকে জড়িয়ে ধরে বলল,’থ্যাঙ্কিউ জানু।’
অর্ষা কিচেনে যাওয়ার পর লামিয়া লিলিয়ার রুমে গেল। লিলিয়াকে বলল, সে যেন অর্ষাকে সাহায্য করতে না যায়। লিলিয়া জানতে চাইল,’ম্যামের সাথে তোমার কথা হয়েছে?’
লামিয়া এক চোখ টিপে বলল,’হ্যাঁ। আন্টির সাথে কথা হয়েছে।’
এরপর সে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। লিলিয়া মুচকি হাসে। লামিয়া বাড়ি থেকে বেরিয়ে গার্ডেনে যায়। সেখানে বেঞ্চে বসে আহনাফ আর নিহাল গল্পগুজব করছিল। লামিয়াও ওদের সাথে যোগ দেয়। আহনাফ ভয়ে ভয়ে থাকে। কখন আবার মুখ ফসকে কী বলে ফেলে কে জানে!
লামিয়া মুখটা অপরাধীর মতো করে বলল,’আমরা এসে আপনাদের ঝামেলায় ফেলে দিলাম তাই না ভাইয়া?’
‘এসব কথা কেন বলছ? অবশ্যই এমন কিছু নয়।’ বলল আহনাফ।
‘এমন কিছুই। আসার পর থেকে অর্ষা এটা, সেটা রান্না করছে। এখন আবার একা একা আমার জন্য চটপটি বানাচ্ছে। আমি কত করে বললাম, আমিও একটু হেল্প করি। শুনলই না। উলটো বলল আমি যেন নিহালের সাথে সময় কাটাই। তাই বললাম, তাহলে মেইডকে ডাক। মেইডের নাকি হঠাৎ করেই শরীরটা খারাপ তাই অর্ষা একাই সব করবে। এখন আমার খুব খারাপ লাগছে ভাইয়া।’
আহনাফ বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,’তুমি টেনশন কোরো না। আমি আছি তো! তোমরা গল্প করো। আমি যাচ্ছি ওর কাছে।’
আহনাফ চলে যাওয়ার পর লামিয়া খিলখিল করে হেসে ওঠে।
চুলোয় ডাবলি বুট আর আলু সেদ্ধ দিয়ে টক আগে বানিয়ে ফেলেছে অর্ষা। এখন কাঁচা মরিচ, পেয়াজ, শসা কুচি করছিল। আহনাফ তখন রান্নাঘরে আসে। অর্ষা একবার তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। সে ভেবেছিল হয়তো কিছু নিতে এসেছে। কিন্তু যখন দেখল, আহনাফ কিছু নিচ্ছে না, আবার যাচ্ছেও না তখন ঘুরে তাকাল।
গম্ভীরকণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,’কিছু খুঁজছেন?’
আহনাফও গম্ভীর হয়ে বলল,’না। তোমাকে হেল্প করতে আসলাম।’
‘দরকার নেই।’
‘কেন দরকার নেই?’
‘কারণ আমি পারব তাই।’
‘তুমি পারবে তো কী হয়েছে? ওরা তো আমারও গেস্ট। আমিও ওদের আপ্যায়নে অংশগ্রহণ করতে চাই।’
‘লাগবে না বললাম না?’
‘তোমার হেল্প না লাগলে নাই। বাট আমি হেল্প করব। কী করা লাগবে বলো? কোনটা বাকি আছে?’
‘কিছুই বাকি নেই। এগুলো কাটা হলেই হয়ে যাবে। টকও বানিয়ে ফেলেছি।’
‘তো বেশ! আমিও কাটব।’ বলে আহনাফ অর্ষার পেছনে দাঁড়াল। অর্ষার দু’হাতের ওপর নিজের দু’হাত রেখে সেও কাটাকুটির জন্য প্রস্তুত হয়।
আহনাফের হঠাৎ করে এভাবে সজ্ঞানে এত কাছে আসায় চমকে ওঠে অর্ষা। শিড়দাড়া দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায়। বুকের ভেতর ঢিপঢিপ শব্দটা আবার শুরু করেছে। সে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে আহনাফকে দেখার চেষ্টা করল। লজ্জায় তা আর হয়ে উঠল না। অর্ষার হাত চলছে না বলে, আহনাফ নিজেই এবার অর্ষার হাত ধরে শশা কুচি করছে। আর অর্ষা যেন রোবটের মতোই কাজ করে যাচ্ছে।
চলবে…