#রক্তিম_পূর্ণিমা
#পর্ব_৬
#লেখিকাঃদিশা_মনি
পলক ও ফারিয়া হাটতে হাটতে নিজেদের ক্লাসের দিকে এগিয়ে যায়। যেতে যেতেই তারা পাভেলের মুখোমুখি হয়। পলক পাভেলকে না বলে দূরে যাওয়ার কারণে বেশ বকা খায়। পলক সেসব গায়ে মাখে না। ফারিয়া পলককে বলে,
“তোর ভাই তোর জন্য কত কেয়ার কর। তোর ভাগ্যটা কত ভালো! ইশ, আমারো যদি এমন একটা ভাই থাকত!”
পলক একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“ভাগ্যের কথা তো বলা যায়না ফারিয়া। মানুষ কখন যে বদলে যায় সেটা বলা দায়। তবে আমি চেষ্টা করবো, যাতে সম্পর্কের মধুরতা না হারায়!”
ভার্সিটিতে প্রথম দিনকার ক্লাস করে ফারিয়া এবং পলক দুজনেই বেরিয়ে আসে। ফারিয়া পলককে বলে,
“ভার্সিটির প্রথম দিনটা তো মোটামুটি ভালোই গেল৷ এরপর কি হয় সেটা দেখি।”
এভাবেই গল্প করতে করতে তারা দুজনে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। এমন সময় তাদের মুখোমুখি দেখা হয়ে যায় আরাফাতের। আরাফাতের সাথে তার বন্ধু জাহিদও ছিল। আরাফাতকে দেখেই তো পলকের মাথা একদম গরম হয়ে যায়। সে আরাফাতকে পাশ কাটিয়ে যেতে নেবে এমন সময় আরাফাত তার পথ আটকে ধরে বলে,
“এই মেয়ে দাঁড়াও, তোমার সাথে আমার অনেক বোঝাপড়া বাকি আছে।”
পলক বুকে হাত গুজে দাঁড়িয়ে বলে,
“তোমার মতো ছেলের সাথে কথা বলার রুচি বা সময় কোনটাই আমার নেই।”
আরাফাত দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“আমার মতো ছেলে মানে কি, হ্যাঁ? আমি তো তোমাকে চিনিও না। তো আজ কেন তুমি সিনিয়রদের সামনে আমার বিপক্ষে কথা বললে? তোমার জন্য ওরা আমায় ক্লাবঘরে নিয়ে গিয়ে,,”
কথাটা বলেই নিজের কাধে হাত রাখে আরাফাত। দেখে বোঝাই যাচ্ছিল ভীষণ মার খেয়েছে। পলক যেন পৈশাচিক আনন্দ পেল। যা ফুটে উঠলো তার তৃপ্তির হাসিতে। আরাফাতের বন্ধু জাহিদ পলকের সেই হাসি দেখে বললো,
“এই মেয়ে! তুমি এভাবে হাসছ কেন? আর আমার বন্ধুর সাথে কি শত্রুতা তোমার? ও তো তোমার কোন ক্ষতি করে নি তাহলে শুধু শুধু ওকে বিপদে ফেললে কেন?”
পলকের চোয়াল শক্ত হয়। সে বলে,
“ধরুন ভবিষ্যতের কোন বোঝাপড়া মিটিয়েছি। আর এটা তো সবে শুরু। সামনে আরো কত কি বাকি আছে।”
জাহিদ অবাক হয়ে জানতে চায়,
“ভবিষ্যতের বোঝাপড়া মানে?”
“সেটা সামনেই জানতে পারবেন।”
বলেই পলক তাদের দুজনকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। ফারিয়াও যায় তার পিছু পিছু।
জাহিদ আরাফাতকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,
“মেয়েটা কিরকম অদ্ভুত তাইনা?”
আরাফাত মোহিত স্বরে বলে,
“আসলেই। মেয়েটাকে বেশ ইন্টারেস্টিং লাগল। বেশ সুন্দরীও আছে!”
“তোর মনে কি চলছে বল তো?”
“বুঝতে পারছিস নিশ্চয়ই?”
“তা আর বোঝার বাকি আছে! তুই তো এক নাম্বারের প্লেবয়। কত মেয়ের সাথেই তো..”
“এই মেয়েটা ডিফ্রেন্ট। একে একটু বেশিই ভালো লেগে গেছে। ভাবছি এবার সিরিয়াস রিলেশনে যাব।”
“তোর আর সিরিয়াস রিলেশন। তোর যা চরিত্র আমার তো মনে হয়, বিয়ের পরেও বউ ছেড়ে অন্য মেয়ের পিছু ঘুরবি।”
কথাটা বলেই দুই বন্ধু একসাথে হেসে উঠল।
এদিকে ফারিয়া পলকের পেছন পেছন আসতে আসতে বলল,
“তোকে কেন জানি আজ ভীষণ অচেনা লাগছে আমার পলক!”
পলক ফারিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
“হঠাত, এমন কেন মনে হচ্ছে তোর?”
“তোর কথাবার্তা অনেকটা জ্ঞানীদের মতো শোনাচ্ছে। যেন একলাফে তোর বয়স ৪/৫ বছর বেড়ে গেছে,জীবনে কত কিছুর অভিজ্ঞতা অর্জন করে ফেলেছিস এমন লাগছে।”
পলক একটা ক্রুর হাসি দিয়ে বলে,
“হয়তো এমনই!”
“মানে?”
“মানে কিছু না। চল সামনের দিকে যাই। ওদিকে একটা ফুচকাওয়ালা মামা আছেন। ওনার ফুচকার সেই স্বাদ। একবার খেলে জীবনে ভুলবি না৷ অবশ্য এরপর থেকে তুই রোজ রোজ ওনার দোকানে ফুচকা খাবি।”
“তুই এতকিছু কিভাবে জানলি পলক?”
“ম্যাজিক।”
ফারিয়া আর কথা না বাড়িয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। আর পলক ঘড়িতে সময় দেখতে থাকে।
ফারিয়া ও পলক সেই ফুচকাওয়ালার দোকানে ফুচকা খাচ্ছিল। ফারিয়া ফুচকা খেয়ে মুগ্ধ হয়ে বলে,
“সত্যিই তো দারুণ খেতে।”
তারা দুজনে ফুচকা খাওয়ায় ব্যস্ত ছিল এমন সময় হঠাৎ একটা মেয়ে দৌড়ে দৌড়ে এসে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে হাপাতে থাকে। পলক মেয়েটাকে দেখে কিছু একটা মনে করে। মেয়েটাকে ভীষণ চেনা চেনা লাগছে। একটু মনে করেই অবাক স্বরে বলে,
“তুমি মুসকান নাকি মুমতা?”
মাথার দুধারে বেনী করা লাল সালোয়ার কামিজ পরিহিত মেয়েটা অবাক চোখে পলকের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমি মুসকান! কিন্তু আপনি কি করে জানলেন যে আমার একটা যমজ বোনও আছে যে আমার মতোই দেখতে।”
পলক হালকা হেসে বলে,
“আমি তোমারই ব্যাচমেট তাই আমাকে আপনি করে বলতে হবে না। আর আমি তোমার ব্যাপারে সবটাই জানি। এটাও জানি যে, তুমি এই ভার্সিটির ছাত্রনেতা মেহরাজ চৌধুরীর বোন। তো যাইহোক, তুমি এত হাপাচ্ছ কেন? কিছু কি হয়েছে?”
মুসকান নিজের বিস্ময়কে দূরে ঠেলে বলে,
“ভার্সিটিতে দুই পক্ষের মারামারি চলছে। তার মধ্যে আমার ভাইয়াও রয়েছে। আমার এসব মারামারি দেখে ভীষণ ভয় লাগে। তাই ছুট্টে পালিয়ে এলাম।”
পলক বললো,
“কোথায় মারামারি হচ্ছে আমায় বলো তো। একটু ঘুরে আসি।”
মুসকান ইশারা করে দেখায়,
“ঐদিকে। কিন্তু ওখানে যেও না। বিপদ হতে পারে।”
পলক মুসকানের কথায় পাত্তা না দিয়ে সেদিকেই যেতে থাকে। ফারিয়া ফুচকা রেখে পলকের পেছনে ছুটতে ছুটতে বলে,
“পলক শোন আমার কথা। ওদিকে যাস না, বিপদ হতে পারে।”
কিন্তু কে শোনে কার কথা। পলক নিজের মতো সামনে এগিয়ে যেতে থাকে। একটু সামনে এগিয়ে যেতেই দেখে দুপক্ষের মারামারি চলছে। মেহরাজের বিপক্ষে লড়ছে এই ভার্সিটির গুণ্ডা বাহিনী বলে পরিচিত আশরাফ আলমগীর। পলকের সব মনে আছে। এই আশরাফ আলমগীর এর সাথে মেহরাজের সাপে-নেউলে সম্পর্ক। এই আশরাফ আলমগীর মোটেই সুবিধা লোক নয়। আশরাফ আলমগীরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তার ডান হাত তথা চাচাতো ভাই জুয়েলকে দেখে পলকের আরো রাগ হলো। মনে পড়ে গেলো কিছু তিক্ত স্মৃতি।
ফারিয়া সেখানে দৌড়ে আসতেই সে ফারিয়াকে বলল,
“তুই যা এখান থেকে।”
“কিন্তু তুই..”
“আমাকে নিয়ে চিন্তা করিস না। আমি সামলাতে পারব নিজেকে। তুই তো জানিস আমি অনেক বদলে গেছি। আর আগের মতো দূর্বল নই।”
বলেই সে আবার ঘড়ির দিকে তাকায়। পলকের বেশ ভালোই মনে আছে ৫ বছর আগে আজকের দিনে ভার্সিটিতে রক্তারক্তি ঘটে গেছিল। মেহরাজ, আশরাফ, জুয়েল প্রত্যেকেই মারাত্মক আহত হয়েছিল৷ তবে এবার সে মেহরাজকে বাঁচাতে চায়। তাই আগেভাগেই পুলিশকে ইনফর্ম করে রেখেছে৷ যেকোন সময় তারা চলে আসবে।
পলকের ভাবনার মাঝেই পুলিশের গাড়ির সাইরেন শোনা গেল। পুলিশের আসার শব্দে সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল।
পলক দেখলো আশরাফ একটা রড নিয়ে এগিয়ে আসছে মেহরাজের দিকে। সে ছুট্টে গিয়ে মেহরাজকে সরিয়ে নিয়ে আসে। মেহরাজ কিছু সময় হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে পলকের দিকে। পুলিশের আগমনে স্থান অনেকটাই ফাকা। পলক মেহরাজকে একটু দূরে একটা বটগাছের কাছে নিয়ে গিয়ে তার হাতে তৈরি হওয়া ক্ষততে ব্যান্ডেজ করিয়ে দিতে থাকে। মেহরাজ বলে ওঠে,
“কে তুমি? আমার এত উপকার করছ কেন?”
তখনই পলকের কানে ভেসে আছে স্মৃতি থেকে কিছু শব্দ।
“আমি তোমাকে আবারো সতর্ক করছি পলক, আরাফাত ছেলেটা ভালো না। তুমি ওর থেকে দূরে সরে আসো।”
পলক নম্রস্বরে বলল,”ধরুন, আমি কারো ঋণ শোধ করছি। যে একসময় আমার জীবনের আগাম বিপদ সম্পর্কে সতর্কবার্তা দিয়েছিল কিন্তু আমি তা উপেক্ষে করছিলাম। যার জন্য আমার জীবনটাই তছনছ হয়ে যায়!”
মেহরাজ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে পলকের মুখপানে।
দূর থেকে এই দৃশ্য দেখে সাদা টপস আর জিন্স পরিহিত একটা মেয়ে। তার থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়ানো শ্যামপুরুষকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,
“এই মেয়েটা কে হাসিব ভাই? ভাইয়ার এত খেয়াল রাখছে যে!”
হাসিব বলে,
” সকালে তোমাকে যেই মেয়ের কথা বলেছিলাম এটাই সেই মেয়ে, মুমতা।”
এমন সময় মুসকান সেখানে ছুটে আসে। হাসিবকে দেখেই তার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে ওঠে। কিন্তু হাসিবের পাশে মুমতাকে দেখে সেই হাসি মিলিয়ে যায়।
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨