রক্তিম পূর্ণিমা পর্ব-১২

0
73

#রক্তিম_পূর্ণিমা
#পর্ব_১২
#লেখিকাঃদিশা_মনি

পলক ছুটতে ছুটতে চলে আসে ফারিয়ার বাপের বাড়িতে। সেখানে এসেই সে দেখতে ফারিয়ার বাড়ির বাইরে অনেক ভিড়। তাদের মধ্যে কিছু লোক বলাবলি করছিল,
“বাবা-মায়ের লোভের জন্যই ওমন ফুলের মতো মেয়েটার জীবন এভাবে ঝড়ে গেল। ওরা তো শুধু ছেলের টাকা পয়সাই দেখেছে। ছেলেটা কেমন সেটা আর দেখে নি৷ এখন তার ফল পেতে হচ্ছে মেয়েটাকে। না জানি, ৫ বছর থেকে কি নিদারুণ কষ্ট ভোগ করেছে। আমি তো শুনেছি,মেয়েটার স্বামী দুনিয়ার এক নম্বর লম্পট। ঘরে বউ রেখে অন্য মেয়েদের সাথে নষ্টামি করত। রাত-বিরেতে মদ খেয়ে এসে বউয়ের গায়ে হাত তুলত। শ্বশুর-শাশুড়ীও তো কম অত্যাচার করতো না। আর এবার তো সব মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। প্রেগন্যান্ট মেয়েটাকে এমন ভাবে মেরেছে যে ওর পেটের বাচ্চাটা মরে গেছে, মেয়েটাকে তো দেখে এলাম এখনই, সারা গায়ে মারের দাগ। স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে। কোনরকমে প্রাণ চলছে। কি যে হবে!”

এসব কথা শুনে পলক হতবিহ্বল হয়ে যায়। পলক জানতো ফারিয়া ভালো নেই কিন্তু এতোটা খারাপ থাকতে পারে এটা ভাবতে পারেনি সে। পলকের চোখে জল চলে আসে। সে দ্রুত ছুটে যায় ফারিয়ার বাড়ির ভেতর। ফারিয়ার রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অশ্রু বিসর্জন করছে তার মা। ফারিয়াকে দেখেই তিনি কান্নার গতি বাড়িয়ে দিয়ে বলেন,
“তুমি এসেছ পলক?! আমার মেয়েটাকে একবার দেখে যাও। জানিনা, আর কতদিন বাঁচবে ও।”

পলক ফারিয়ার মাকে এড়িয়ে তার রুমে প্রবেশ করে। ফারিয়ার রুমে প্রবেশ করেই আতকে ওঠে। এই ফারিয়ার সাথে আগের ফারিয়ার কোন মিলই নেই। পুরো শরীর শুকিয়ে একদম কঙ্কালসার হয়ে গেছে। সারা শরীরে বিভৎস আঘাতের চিহ্ন। পলককে দেখে ফারিয়া নড়েচড়ে বসে। পলক ফারিয়ার পাশে এসে বসে। ফারিয়া ভাঙা ভাঙা স্বরে বলে,
“পলক,,তুই,,”

পলক নিজের চোখের জল আটকে রাখতে পারে না। হু হু করে কাঁদতে থাকে। এরইমধ্যে একজন ডাক্তার এসে বলেন,
“ওনার শারীরিক অবস্থা একদম ভালো না। জানি না, এভাবে আর কয়দিন বাঁচবেন।”

পলক চোখের জল মুছে বলে,
“ঐ জুয়েলকে আমি ছাড়ব না! ও তোর এই অবস্থা করেছে তাইনা? ওকে আমি জানেই মেরে দেব। আন্টি, আঙ্কেল আপনারা ঐ শয়তানটার নামে মামলা করেন নি?”

ফারিয়ার বাবা অসহায় কন্ঠে বলেন,
“আমরা সাধারণ মানুষ, ওত বড়লোকদের বিরুদ্ধে মামলা করে কি আমরা টিকতে পারব?”

“যদি এত কিছু জানতেন,তাহলে কেন ঐ পিশাচদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন নিজের মেয়েকে? টাকা দিয়ে কি সুখে থাকা যায়? এই সেই সুখের নমুনা! দেখছেন তো, কি অবস্থা করেছে ওরা ফারিয়ার। এখন আপনারা শান্তি পাচ্ছেন তো?”

ফারিয়ার বাবা কেঁদে ফেলেন। পলক ফারিয়ার হাত ধরে বলে,
“তুই নিজের সত্যিকারের ভালোবাসার মানুষটাকে বলি দিয়ে নিজের পরিবারের সিদ্ধান্তকে বেছে নিলি। আজ দেখ, তার কত সুন্দর ফল পাচ্ছিস।”

ফারিয়া কিছু বলে না৷ নিজের ভাগ্যের প্রতি তার করুণাও আসে না৷ বারংবার মনে হয়, তার এই পরিস্থিতির জন্য সে নিজেই দায়ী। পলক আবারো বলে,
“জানিস, তোর বিয়ের কিছুদিন পরই রুশাদ স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে চলে যায়। তোরও তো এটা শখ ছিল। যদি তুই নিজের পরিবারের কথা ভেবে এই স্টুপিডিটিটা না কর‍তি তাহলে দুজনে কত সুখী হতে পারতি ভেবে দেখ।”

ফারিয়ার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। এরইমধ্যে এক গম্ভীর পুরুষালি কন্ঠস্বর ভেসে আসে,
“ফারিয়া!”

ফারিয়া চকিতে তাকাতেই দেখতে পায় রুশাদকে। সে যেন নিজের চোখকে বিশ্বাসই করতে পারছিল না। রুশাদও ফারিয়ার এই দশা থেকে হতবিহ্বল। দুদিন আগেই সে বিদেশ থেকে ফিরেছে। আজ কি মনে করে এদিক দিয়ে যাচ্ছিল৷ ফারিয়ার কথা মনে পড়তেই এদিকে চলে এলো। তারপর লোকের মুখে ফারিয়ার বর্তমান অবস্থার কথা শুনে কোন কিছু পরোয়া না করে ছুটে এলো। রুশাদ এসেই ফারিয়ার পাশে বসে বলল,
“নিজের এ কি দশা করেছিস তুই? আমি তো তোর ভালোর কথা ভেবেই তোর সিদ্ধান্তকে সম্মান জানিয়েছিলাম। আর তুই নিজের জীবনটাকে এভাবে নষ্ট,,আগে আমি যদি জানতাম তুই এমন কিছু করবি তাহলে আমি তোকে কিছুতেই ঐ শয়তান জুয়েলকে বিয়ে করতে দিতাম না। তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করতাম।”

ফারিয়া হাসফাস করতে করতে বলে,
“আমার ভাগ্যে এটাই ছিল রে! তুই সুখী হ, এখন আমার শুধু এটাই চাওয়া।”

“তোকে চাওয়া আমি কিভাবে সুখী হবো? জানিস, আমি আজ অব্দি বিয়ে করিনি কারণ নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে তুই ছাড়া আর কাউকে কল্পনা করতে পারব না।”

ফারিয়া অস্থির হয়ে বলে,
“আমার জন্য এত ত্যাগ করিস না। আমি এতটা ডিজার্ভ করি না। একটা ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে করে নে। আমার জীবনে আর কিছু বাকি নেই। হয়তো কিছুদিন পরেই এই সব ব্যাথা যন্ত্রণা থেকে চিরতরে মুক্তি পাব।”

“ফারিয়া!”

রুশাদের কণ্ঠে চাপা রাগ। সে ফারিয়ার হাত শক্ত করে ধরে বলে,
“আমি তোর কিছু হতে দেব না। প্রয়োজনে শহরের সেরা ডাক্তার দেখাব, ফরেইনে নিয়ে যাব ট্রিটমেন্ট করাতে।”

“এসব করে কোন লাভ হবে না, আমার হাতে আর বেশি সময় নেই।”

“এমনটা হতে পারে না, ফারিয়া। আমি যে তোকে নিয়ে একটা সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখি!”

এরইমধ্যে পলক বলে ওঠে,
“তোদের জীবন সুন্দর করে গড়ে দেয়ার দায়িত্ব আমার৷ আমি কথা দিচ্ছি তোদের। সব ভুল শুধরে তোদের জীবনকে সুন্দর করে দেব।”

ফারিয়া ও রুশাদ দুজনেই অবাক চোখে তাকায় পলকের দিকে। পলক আর বেশি সময় নষ্ট না করে বাড়ির দিকে রওনা দেয়।

~~~~~~~~
নিজের বাড়িতে আসতেই চার বছর বয়সী একটা ছোট্ট ছেলে এসে পলকের কাছে ছুট্টে এসে তার কোলে এসে চড়ে। পলক অবাক চোখে চেয়ে আছে৷ জিজ্ঞেস করে,
“তুমি কে?”

“আমায় বুলে গেচ পুপি, আমি তো জিয়ান।”

এরইমধ্যে জান্নাত ছুটে এসে জিয়ানকে পলকের কোলে দেখে মৃদু হেসে বলে,
“তোমার ফুফু তো কেবল বাইরে থেকে এলো। অনেক টায়ার্ড, তুমি এভাবে তাকে জ্বালিও না। একটু রেস্ট নিতে দাও।”

পলক বুঝতে পারে এটা তারমানে তার ভাইয়ের ছেলে। আদর করে দেয় জিয়ানের গালে। একটু পর পাভেল আসতেই জিয়ান পলকের কোল থেকে নেমে পাভেলের কোল দখল করে। পাভেল আর জান্নাত মিলে তাদের ছেলেকে আদর করতে থাকে। পলক এসব দেখে বলে,
“যদি আমার অতীতের একটা পদক্ষেপ আমার ভাইয়ের জীবনটা এত সুন্দর করে পারে, ভবিষ্যতটাকে এতো উজ্জ্বল করতে পারে। তাহলে এভাবে আমি ফারিয়া ও রুশাদের জীবনও গুছিয়ে দেব।”

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
পলক তার ঘরের বেলকনিতে তাকিয়ে বারবার নিজের হাতঘড়িতে সময় দেখছে। এখন সময় ১১ টা বেজে ৫৯ মিনিট। পলক চোখ বন্ধ করে বলে,
“আমার মাত্র কিছু সময়ের অপেক্ষা। তারপর আমি আবার সময়ের পরিক্রমায় ভবিষ্যতে চলে যাব।”

কথাটা বলতে না বলতেই চাঁদ থেকে রক্তিম আভা এসে রাঙিয়ে দেয় পলকের ঘর। সে নিজের চোখ খোলা রাখতে পারে না। একটু পরেই প্রবেশ করে সময়ের চক্রবুহ্যে।

চোখ খুলতেই নিজেকে ঘুমন্ত অবস্থায় আবিষ্কার করে পলক। ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে নিশ্চিত হয় যে সে আবার অতীতে ফিরে এসেছে। তবে চার মাস পেরিয়ে এখন সে ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিলে পৌঁছে গেছে। পলকের মনে পড়ে ২০১৯ এর মে মাসেই ফারিয়ার সাথে জুয়েলের বিয়ে হয়েছিল৷ এখন তাকে যে করেই হোক এই বিয়েটা আটকাতে হবে, যাতে ফারিয়া সুখী হতে পারে।

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨