রক্তিম পূর্ণিমা পর্ব-১৫

0
64

#রক্তিম_পূর্ণিমা
#পর্ব_১৫
#লেখিকাঃদিশা_মনি

ফারিয়া হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলো পলকের কাছে। সুদীর্ঘ তিন সপ্তাহ চুটিয়ে প্রেম করার পর যখন তার এবং রুশাদের সম্পর্ক একটা চূড়ান্ত পর্যায়ে যাবার কথা সেই সময় নতুন এক সমস্যা যেন ঘিরে ধরেছে তাদেরকে। পলক ফারিয়াকে এভাবে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করে,
“কি হয়েছে ফারিয়া? তোকে এমন লাগছে কেন?”

“বাবা আমার বিয়ে অন্য যায়গায় ঠিক করেছে পলক। আমি বুঝতে পারছি না আমি কি করব।”

পলক একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। সে আগে থেকেই জানত যে এমন কিছুই হবে৷ তাই তো বেশ শান্তস্বরে বলে,
“বিয়েটা নিশ্চয়ই আমার ভাবির ভাই মানে ঐ জুয়েলের সাথেই ঠিক করেছে তাইনা?”

“তুই এটা কিভাবে জানলি?!”

অবাক হয়ে শুধায় ফারিয়া। পলক বলে,
“সেটা অন্য ব্যাপার। ওদিকে না ভেবে তুই আমার কথা শোন, তোকে যে বলেছিলাম এমন কিছু হলে তোর মা-বাবাকে রুশাদের কথা বলতে তো সেটা বলেছিস?”

ফারিয়া বলে,
“হুম, বলেছি। কিন্তু তারা আমার কথা শুনে বলল, রুশাদ এখনো স্টুডেন্ট। ওর কোন ভবিষ্যৎ নেই। আর সেখানে জুয়েল বড়লোক বাবার ছেলে, ওর বাবা-চাচার ব্যবসার অংশীদার ও। তাই ওর সাথে বিয়ে হলে আমি সুখে থাকব।”

পলক সামান্য হেসে বলে,
“বাবা-মায়েদের এই একটাই সমস্যা। তারা ভাবে যে, কেবল টাকা দিয়েই সুখী হওয়া যায়৷ কিন্তু আসলে এমনটা নয়৷ সুখে থাকার জন্য ভালোবাসাটাই বেশি জরুরি। হ্যাঁ, জীবনে টাকা পয়সার প্রয়োজন আছে তবে তার মানে এই না যে, হাইফাই ধনী কাউকে লাগবে যার চরিত্র খারাপ! একজন ভালো চরিত্রের মধ্যবিত্ত পুরুষ একজন ধনী দুশ্চরিত্র পুরুষের থেকে উত্তম। তাছাড়া আমাদের রুশাদ তো যে সে ছেলে না, কতটা মেধাবী ও। ও অবশ্যই জীবনে ভালো কিছু করবে। তুই একটা কাজ কর, রুশাদকে একটা ফোন কর। ওকে তোর বাসায় আজ বিকেলে আসতে বল। আমিও যাচ্ছি। বাকিটা আমরা দুজনে মিলে বুঝে নেব।”

কথাটা শুনেই ফারিয়া বলে,
“কিন্তু..”

“কোন কিন্তু নয়, যদি নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে হারাতে না চাস তাহলে আমি যা বলছি তাই কর। আমি তোর সুখের কথা ভেবেই সব করছি। তুই নিশ্চয়ই ঐ জুয়েলের মতো দুশ্চরিত্র কাউকে পেতে চাস না?”

ফারিয়া মাথা নাড়ায়। পলক নিজের ফোনের কিছু ছবি দেখে মৃদু হেসে বলে,
“এবার আমি কোমড় বেধেই নেমে পড়েছি ফারিয়া। তোর জীবনের যে নিষ্ঠুর পরিণতি আমি দেখেছি সেটা আমি আবারো রিপিট হতে দেব না। জীবনের এই দ্বিতীয় সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আমি তোকে একটা সুখী জীব উপহার দেব। এটাই আমাদের বন্ধুত্বের উপহার হবে।”

★★★★
ফারিয়া ও রুশাদকে সাথে নিয়ে ফারিয়ার মা-বাবার সামনে উপস্থিত হয়েছে পলক। সকলে সোফায় বসে আছে। ফারিয়ার মা সবার জন্য চা নিয়ে এলো। ফারিয়ার বাবা চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন,
“বলো, তোমাদের কি বলার আছে।”

ফারিয়া ও রুশাদ একে অপরের দিকে তাকায়। পলক বলে ওঠে,
“ফারিয়া তো আপনাকে সবটাই বলেছে আঙ্কেল। আমি তাই আশা করছি, আপনি বুঝে গেছেন আমরা ঠিক কি কারণে এখানে এসেছি।”

“হুম, সেটা জানি বৈকি! কিন্তু তোমাদের মুখ থেকে শুনতে চাই।”

পলক হালকা হেসে বলে,
“বেশ, তাহলে আমিই আপনাকে বলছি ব্যাপারটা। রুশাদ ও ফারিয়া একে অপরকে ভালোবাসে এবং তারা চায় বিয়ে করতে।”

“ব্যাপারটা এত সহজ নউ। আমি ফারিয়ার জন্য অন্য একটা পাত্র দেখেছি, যে রুশাদের থেকে অনেক বেশি যোগ্য। আর রুশাদ তো এখনো ছাত্র, তাছাড়া ওর ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ডও তেমন ভালো নয়। ওর বাবা একজন সাধারণ চাকরিজীবী, মধ্যবিত্ত পরিবার। আমি কোন ভরসায় আমার মেয়েএ ওর হাতে তুলে দেব?”

রুশাদ এবার বলে ওঠে,
“আমি আপনাকে এটুকু নিশ্চয়তা দিতে পারি যে, ফারিয়া আমার কাছে যথেষ্ট ভালো থাকবে। আমি ওর কোন অভাব হতে দেব না। আপনি দয়া করে, আমাদের রিকোয়েস্টটা রাখুন। আমরা একে অপরকে ছাড়া বাঁচব না।”

ফারিয়ার বাবা গম্ভীর স্বরে বলেন,
“দেখো, ছেলে। এসব আবেগী কথা সবাই বলে। কিন্তু দুনিয়া আবেগে চলে না৷ অভাব আসলে এই ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালিয়ে যাবে। আমি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছি নিজের মেয়ের সুখের কথা ভেবেই নিয়েছি। আমি যেই ছেলের সাথে ওর বিয়ে ঠিক করেছি তার কাছে নিঃসন্দেহে আমার মেয়ে অনেক ভালো থাকবে।”

এবার পলক বলে ওঠে,
“শুধুমাত্র অর্থবিত্ত দিয়ে কেউ ভালো থাকতে পারে না আঙ্কেল। ভালো থাকার জন্য ভালোবাসাটারও প্রয়োজন আছে। তাছাড়া, রুশাদ এতটাও অসহায় নয় যে, ওর সাথে বিয়ে হলে ফারিয়া কষ্টে থাকবে। যাইহোক, আপনাকে একটা উদাহরণ দেই, আমার ভাবি সে কিন্তু একটা স্বচ্ছল পরিবারের মেয়ে। আরো স্পষ্ট করে বললে, আপনি যার সাথে ফারিয়ার বিয়ে ঠিক করেছেন তারই আপন বোন!”

ফারিয়ার বাবা অবাক হন। পলক বলতে থাকে,

“সেই বড়লোক ঘরের মেয়ে কিন্তু ভালোবেসে আমার ভাইয়ের হাত ধরে চলে এসেছে। এবং আমাদের পরিবারে মধ্যবিত্ত ভাবে সুখেই জীবনযাপন করছে। আমাদের সবার সাথে মানিয়েও নিয়েছে৷ তার অতিরিক্ত কোন চাহিদাও নেই। এটাই হলো সত্যিকারের ভালোবাসা।”

ফারিয়ার বাবা বলেন,
“সবই তো বুঝলাম, কিন্তু…”

পলক বলে,
“আপনাকে আরো কিছু দেখাই..”

বলেই নিজের ফোন থেকে জুয়েলের কিছু ছবি বের করে দেখায়। যেখানে জুয়েল অন্য মেয়েদের সাথে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় আছে, কোথাও কোথাও নেশার আসরে তার ছবি। এসব দেখিয়ে পলক বলে,
“এখন আপনিই বলুন, এই ছেলের সাথে ফারিয়া বেশি ভালো থাকবে নাকি রুশাদের সাথে।”

ফারিয়ার বাবা এবার ভাবনায় পড়ে যায়। পলক বলে,
“আপনি ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিন, আংকেল। আমিও এমন একজন মেয়ের বাবাকে চিনি। যে শুধু ছেলের টাকা দিয়ে তার সাথে নিজের মেয়ের বিয়ে দিয়েছিল। এরপর কি হয়েছিল জানেন? সেই মেয়েকে তার স্বামী বিয়ের পর থেকে চরম অত্যাচার করেছে, শ্বশুর বাড়িতেও সে নির্যাতিত হয়েছে। এর পাঁচ বছর পর একদিন সে মৃতপ্রায় অবস্থায় বাপের বাড়িতে ফেরে। তখন তার বাবা আফসোস করে এটা নিয়ে। কিন্তু তখন আর কিছু করার নেই।”

পলক এখানে আসলে ভবিষ্যতে ঘটে যাওয়া ফারিয়ার ঘটনাই তার বাবাকে বলে। যেটা সে দেখে এসেছে। এসব শুনে ফারিয়ার বাবার চিন্তাভাবনার পরিবর্তন হয়। তিনি বলেন,
“তুমি ঠিকই বলেছ পলক, নিজের মেয়ের ভালোর কথা ভাবতে গিয়ে আমি ওর সর্বনাশই ঠেকে আনছিলাম। এই ছেলের সাথে বিয়ে হলে তো আমার মেয়ের জীবনটা নষ্ট হয়ে যেত।”

ফারিয়ার মা তার বাবাকে বলেন,
“তোমাকে আমি আগেই বলেছিলাম, সবকিছু চিন্তা ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিতে। কিন্তু তুমি আমার কথা শোনো নি।”

“কিন্তু এখন আমি সব ভুল শুধরে নেব। রুশাদ, তুমি তোমার বাবা-মাকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে এসো। আমি তোমার এবং ফারিয়ার সম্পর্ক মেনে নিতে প্রস্তুত।”

একথা শুনে ফারিয়া, রুশাদ দুজনেই চূড়ান্ত খুশি হয়। পলক বলে,
“আপনার বোধদয় দেখে ভালো লাগল।”

ফারিয়া পলককে জড়িয়ে ধরে বলে,
“ধন্যবাদ, দোস্ত। আজ তুই ছিলিস বলেই এটা সম্ভব হলো। আমাদের এই ভালোবাসাটা পূর্ণতা পেল।”

রুশাদও বলে,
“আমরা আজীবন তোর কাছে কৃতজ্ঞ থাকব পলক।”

পলক হেসে বলে,
“তোদের জীবন সুন্দর করাটা আমার দায়িত্ব ছিল। আমি সেটা করতে পেরেছি, এটাতেই আমি খুশি।”

পলক এবার ভীষণ সুন্দর একটা হাসি দেয়। ফারিয়া বলে,
“আশা করি, এবার তোর জীবনটাও সুন্দর হবে। মেহরাজ ভাইয়ের সাথে সব মান অভিমান মিটিয়ে ফেল।”

এহেন কথা শুনে পলক থমকে যায়। মেহরাজের চেহারা ভেসে ওঠে তার সামনে। সবার জীবনে সুখের ব্যবস্থা তো করল সে,,কিন্তু নিজের সুখের কি হবে?!

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨