রাখিব তোমায় যতনে পর্ব-২১

0
577

#রাখিব_তোমায়_যতনে
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ২১
নীবদ্ধ’র খোলা বুকে সুয়ে আছে শুদ্ধতা।প্রথম প্রথম বেশ লজ্জা পেতো শুদ্ধতা।তবে এখন আর ওতোটা পায়না লজ্জা। এই কয়েকদিনে যেন লোকটার বুকে মাথা রেখে ঘুমানো একটা অভ্যাসে পরিনত হয়েছে।নীবদ্ধ কপালের উপর হাত রেখে আরেকহাতে শুদ্ধতাকে জড়িয়ে ধরে আছে। শুদ্ধতা ভ্রু-কুচকালো নীবদ্ধকে দেখে।লোকটা কি নিয়ে এতো চিন্তা করছে যে ওর দিকে আজ ঠিকঠাকভাবে তাকাচ্ছেও না।অন্যদিন তো ওর সাথে কতশত গল্প করে।শুদ্ধতা এইবার নিজেই জিজ্ঞেস করে,
-‘ কি হয়েছে আপনার? কি নিয়ে এতো চিন্তা করছেন?’

চমকে উঠলো নীবদ্ধ।কপাল হতে হাতটা সরিয়ে নিয়ে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো শুদ্ধতার দিকে।শুদ্ধতার উদ্বিগ্ন চাহনী দেখে মৃদ্যু হেসে বলে,
-‘ কি নিয়ে চিন্তা করবো বলো?আমার চিন্তা ভাবনার একটাই তো বিষয়।আর সেটা হলো তুমি।’

বিরক্ত হলো শুদ্ধা।
-‘ উফ! ছাড়ুন তো আপনার এসব আবেগি কথা।এসন বলে ভাবছেন আমার প্রশ্ন এড়িয়ে যাবেন।’

নীবদ্ধ শব্দ করে হেসে বলে,
-‘ আচ্ছা তাই? কি কি প্রশ্ন তোমার?’

-‘ এইযে কি নিয়ে এতো চিন্তা করছেন আপনি?’

নীবদ্ধ লম্বা শ্বাস টেনে নিলো।এই মেয়েটা এমন ত্যাড়া।যা একবার বলবে তাই করে ছাড়ে।
-‘ জাহিদকে ধরেছি আমি।’

শান্তভাবেই জবাবটা নিলো শুদ্ধতা। সে ভালোভাবেই জানতো আজ নাহয় কাল এই কথাটা শুনবে ও।শুদ্ধতা বলে,
-‘ ভালো কথা তো।তাহলে এতো টেনশন করছেন কেন? এইবার ওই কুকু*রটার কাছ থেকে সব তথ্য বের করে মেইন কার্লপ্রিটকে ধরে ফেলবেন।’

-‘ তুমি যতোটা সহজ ভাবছো ততোটা সহজ না কাজটা শুদ্ধতা।’

-‘ তাহলে?’

-‘ জাহিদের কাছ থেকে যতোটুকু জানলাম।জাহিদ আসল আসামীকে এখনো দেখেইনি।ও আরেকজনের মাধ্যমে এইসব ড্রা*গস এনে সাপ্লাই করতো। তার নাম রকি।এই রকির সম্পর্কে আমিও শুনেছিলাম কিছু কথা।সে নাকি অনেক ভয়ানক সন্ত্রা*স।ওদের লোকদের আজ পর্যন্ত কেউ ধরতে পারেনি।আর যদি ওদের দলের একজনও ধরা পরে যায়।তাহলে তারা আত্মহ*ত্যা বেছে নেয়।ঠিক এইজন্যে আজও কেউ সঠিক প্রমান এখনো পায়নি।আর রকিকে আমি পুলিশের সাহায্যে ধরতেও পারি।কিন্তু রকি নিজেকে জীবিত অবস্থায় ধরা দিবে না।ও নিজেও সুই*সাইড করে নিবে।আর ও এটা করুক আমি চাই না।এমন হলে আমরা মেইন কার্লপ্রিট পর্যন্ত পৌছাতে পারবো নাহ। কিছু তো একটা করতে হবে এরজন্যে।যাতে রকি আমাদের প্লান সম্পর্কে একটুও না জানে।আর এই রকির মাধ্যমেই যে আমরা আমাদের আসল লক্ষ্যে পৌছাতে পারবো তা ১০০% গ্যারান্টি।’

সব শুনে শুদ্ধতা নিজেও একটু চিন্তিত হয়ে পরলো।বলল,
-‘ রকি কি করে?’

নীবদ্ধ’র ঠান্ডা জবাব,
-‘ রকি ওই মেয়ে আর শিশু পাচা*রকারি লোকদের মেয়ে জোগাড় করে দেয়।এই রকির অনেক বড় অবদান আছে এই ব্যবসায়।’

শুদ্ধতা সবটা ভালোভাবে শুনে নিলো।তারপর গভীরভাবে কিছু একটা ভাবলো।তারপর হঠাৎ বলে,
-‘ আমার কাছে একটা আইডিয়া আছে।যদি আপনি অনুমতি দিন বলব।’

হালকা রাগ দেখিয়ে নীবদ্ধ বলে,
-‘ আমার কাছে কিছু বলার জন্যে তোমার আবার পার্মিশন নেওয়া লাগে কবে থেক?একদিন বলেছি নাহ যা মনে আসবে অকপটে সব আমায় বলে দিবে।কোন দ্বিধা রাখবে নাহ।’

-‘ আচ্ছা আর এমন করবো নাহ।সরি।’

-‘ হুম তো এইবার বলো কি বুদ্ধি এসেছে তোমার মাথায়।’

অতঃপর শুদ্ধতা নিজের পরিকল্পনা সবটা জানালো নীবদ্ধকে।সবটা শুনে নীবদ্ধ অসম্ভবভাবে রেগে গেলো।রাগে ওর সারা শরীর কাঁপছে।মেয়েটা পাগল নাকি কিভাবে এই কথা বলতে পারলো ও? একটুও ভয় করলো না মেয়েটার?যে কার সামনে আর কাকে নিয়ে আসব বলছে?রাগটাকে কিছুতেই কন্ট্রোল করতে পারছে না নীবদ্ধ।শুদ্ধতা কাঠখোট্টা গলায় বলে,
-‘ এভাবে রাগার কি আছে? এটা অহেতুক রাগ বলে নাহ?’

নীবদ্ধ রাগে প্রায় চিৎকার করে বলে,
-‘ তোমার সাহস কিভাবে হলো এসব বলার? বুক কাঁপলো না একটুও তোমার?’

শুদ্ধতার শক্ত কন্ঠ,
-‘ নাহ কাঁপেনি।একটু কাঁপেনি।কেন কাঁপবে? অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করবেন আপনি।সেখানে যদি এই লড়াইয়ে সামান্য অংশিদারও আমি হতে পারি।তাহলে নিজেকে ধন্য মনে হবে।আর আমার শরীরেও রাজনৈতিক নেতার রক্ত বইছে ভুলে যাবেন নাহ।রাজনীতি করি না তো কি হয়েছে? তেজ আর রাগ কিন্তু আমার কোনটাই কম না আপনার থেকে।সেটা আপনি ভালোভাবেই জানেন।’

নীবদ্ধ দাঁতেদাঁত চিপে বলে,
-‘ তোমার এইসব আউল ফাউল কথা আমি শুনছি না।বুঝেছ তুমি?’

-‘ শুনতে হবে।এটাই বেটার আইডিয়া।’

-‘ শুদ্ধতা আমাকে রাগিও না।’

-‘ আপনি কেন জেদ করছেন?’

নীবদ্ধ রাগে কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।মেয়েটা কেন বুঝতে চাইছে না কিছু।রাগ লাল চোখজোড়া দিয়ে তাকালো শুদ্ধতার দিকে।তারপর শুদ্ধতাকে ওর বুক থেকে সরিয়ে বারান্দায় চলে গেলো উঠে।শুদ্ধতা নিজেরও রাগ লাগছে।তারপরেও নীবদ্ধ’র অবস্থাটা বুঝতে পেরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।ওর নিজেরও বুকটা কেমন যেন জ্বলছে।ও যা ভাবছে তা আসলেই অনেক বিপদজনক কাজ।কেটে গেলো এক ঘন্টা। কেউ কারো কাছে আসলো না।শুদ্ধতার বুকে চিনচিনে ব্যাথা করছে।এই কয়দিনে বেশ বুঝতে পেরেছে নীবদ্ধ নামক মানুষটি ওর হৃদয়ে গেঁথে গিয়েছে।এই মানুষটাকে ছাড়া এখন থাকা অসম্ভব।তবে কি লোকটাকে ভালোবেসে ফেলেছে ও? কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি কি কেউ কাউকে ভালোবাসতে পারে? এটা হয় কখনো? মনের ভীতর থেকে আওয়াজ আসলো।হয়তো এতো তাড়াতাড়িও ভালোবাসা হয়।ক্ষনিকের দেখাতেও কাউকে ভালোবাসা যায়।আবার কাউকে না দেখে শুধু অনুভব করেও ভালোবাসা যায়।
ভালবাসা হচ্ছে মনের মিল, পছন্দের মিল ভালো লাগার মিল আর ভালো বাসার মধ্যে রয়েছে হাসি, কান্না, মায়া মমতা, আবেগ, সুখ আনন্দ সব কিছুই, মানুষ অতি আবেগ আপ্লুত হয়ে কারো প্রেমে পড়ে যায় নিজের ভালো লাগা থেকে। আর ভালবাসা তখন সত্য হয় যখন দুটি মন একত্রিত হয়ে এক সুতোয় বেঁধে যায় তবে ভালোবাসার আরেক নাম বিশ্বাস। আর শুদ্ধতা বিশ্বাস করে লোকটাকে।খুব বিশ্বাস করে।আলতো হাসলো শুদ্ধতা। কিভাবে যে লোকটা ওর মনের শক্ত খোলস ভেঙ্গে ভীতরে প্রবেশ করে ফেললো বুঝতেই পারেনি।তপ্ত শ্বাস ফেলে বিছানা থেকে উঠে দাড়ালো শুদ্ধতা।পা বাড়ালো বারান্দার দিকে।নীবদ্ধ বারান্দায় রাখা চেয়ারে বসে আছে মাথা নিচু করে।হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ।ঠিক তখনই ঘারে কারো নরম হাতের ছোঁয়া পেয়ে চোখ মেললো ও। সে জানে এই স্পর্শটা কার।তবুও তাকালো না।বড্ড অভিমান জমেছে মনে তার।নীবদ্ধ’র অবস্থা বুঝতে পেরে শুদ্ধতা বলে,
-‘ তাকাবেন নাহ আমার দিকে।’

-‘ কেন এসেছেন এখানে?’

নীবদ্ধ’র কাঠের কন্ঠে প্রশ্ন।শুদ্ধতা হেসে বলে,
-‘ বাহ এতো রাগ।তুমি থেকে আপনিতে চলে গিয়েছে?’

-‘ আগে তো আপনিই ডাকতাম।তো এখন ডাকলে সমস্যা কি?’

-‘ আগে তো বউও ছিলাম না।এখন বউ হয়েছি।’

-‘ বউ হয়েছো বলে কি যা বলবেন তাই শুনতে হবে?

-‘ হুঁ হবে।’

নীবদ্ধ এইবার তাকালো শুদ্ধতার দিকে।শীতল কন্ঠে বলে,
-‘ কেন রাগাচ্ছেন শুদ্ধতা?’

-‘ কোথায় রাগালাম?আপনি তো এমনিতেও রেগেই আছেন।আর আপনি ডাকা বন্ধ করুন।’

হতাশার নিশ্বাস ফেললো নীবদ্ধ।এই মেয়েটাকে বুঝিয়ে লাভ নেই।মেয়েটা কোন কথাই শুনে নাহ।আর শুদ্ধতার উপরে রাগারাগি চিৎকার চেচামেচি কোনদিন করতে পারবে না নীবদ্ধ।আর যদি এরকম করেও কোনদিন।তাহলে সেদিন নিজেকেই শেষ করে দিবে ও। শুদ্ধতার মুখোমুখি হয়ে দাড়লো নীবদ্ধ।বলে,
-‘ যাও ঘুমাতে যাও।’

-‘ আপনিও আসুন!’

নীবদ্ধ আগে আগে চলে গেলো বিছানায় ঘুমাতে।শুদ্ধতা অবাক হলো।তবে কিছু বললো না।চুপচাপ বারান্দার দরজা আটকিয়ে রুমের আলো নিভিয়ে নিজেও গিয়ে সুয়ে পরলো।তবে ঘুম আসলো না একটুও।বার বার নীবদ্ধ’র দিকে তাকাচ্ছে শুদ্ধতা।লোকটা অপাশ ফিরে সুয়ে আছে।এমন কেন করছে লোকটা? সে কি জানে নাহ?লোকটার বুকে মাথা না রাখলে শুদ্ধতার ঘুম আসে না।শুদ্ধতার নড়াচড়াতে নীবদ্ধ এইবার শুদ্ধতার দিকে ফিরে তাকালো।বলে,
-‘ কি হয়েছে?এমন নড়াচড়া কেন করছো?’

শুদ্ধতার চোখজোড়া এইবার ছলছল করে উঠলো।তবে চোখের জল গাল গড়িয়ে পরতে দিলো না।লোকটা কি জেনেও এইভাবে না জানার ভাণ ধরছে? অভিনয় করছে তার সাথে?শুদ্ধতা কিছু না বলে অন্যদিকে ফিরে চোখ বন্ধ করে নিলো।এদিকে নীবদ্ধ শুদ্ধতার ওই চোখজোড়ার চাহনী দেখে বুঝতে পারলো।বড্ড ভুল করে ফেলেছে ও।মেয়েটা কষ্ট পেয়েছে।নীবদ্ধ এইবার হেঁচকা টানে শুদ্ধতাকে নিজের দিক ফিরিয়ে ওকে বুকে টেনে নিলো।শুদ্ধতা জোড় প্রয়োগ করছে নীবদ্ধ থেকে নিজেকে ছাড়ানোর জন্যে।কিন্তু বেশি পারলো না।একসময় হাপিয়ে উঠলো।মাথা নুইয়ে দিলো নীবদ্ধ’র বুকে।নীবদ্ধ শুদ্ধতাকে আস্তেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো।শুদ্ধতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।শুদ্ধতা চোখে ঘুম নেমে আসলো।ঘুমের ঘোরে বিরবির করল,
-‘ আমার অভ্যাস বাজে করেছেন আপনি।আপনার বক্ষে নিজেকে সমর্পন না করলে আমার ঘুম আসে না।’

প্রসস্থ হাসলো নীবদ্ধ।আধোঘুমন্ত শুদ্ধতার কপালে অধর ছুইয়ে দিয়ে ওর কানে ফিসফিস করলো,
-‘ কিছু কিছু বাজে অভ্যাস আমাদের জন্যে ভালো
।খুব ভালো।এইযে তোমাকে বুকে না নিলে আমার ঘুম আসে না শুদ্ধতা। ঠিক তুমিও এখন আমায় ছাড়া ঘুমোতে পারো না।’

#চলবে____________
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।