#রাখিব_তোমায়_যতনে
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ২২
সকাল সকাল তৈরি হচ্ছে নীবদ্ধ আর শুদ্ধতা।নীবদ্ধ মুখ ভার করে আছে।কারন একটাই শুদ্ধতা কাল রাত যা বলেছে তাকে সেটাই মানতে হয়েছে।মেয়েটা এতো জেদি।শুদ্ধতা নীবদ্ধ’র এমন মুখশ্রী দেখে মৃদ্যু হাসলো।থাকুক একটু মুখ ভার করে সমস্যা নেই।আজ অনেক বড় একটা সার্প্রাইজ আছে লোকটার জন্যে।লজ্জামিশ্রিত হাসি দিলো শুদ্ধতা।হ্যান্ডব্যাগটা নিয়ে বলল,
-‘ আমি রেডি।চলুন।’
নীবদ্ধ হাতে ঘড়ি পরা শেষ করে বলে,
-‘ তুমি এখনো তোমার কথাই রাখবে?’
শুদ্ধতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
-‘ কেন এমন বাচ্চামো করছেন নীবদ্ধ? বললাম তো আল্লাহ্ ভরসা।কিছু হবে না।বিশ্বাস রাখুন আমার উপর।’
নীবদ্ধ আর কথা বাড়ালো না।শুদ্ধতার হাত ধরে নিচে চলে আসলো।ব্রেকফাস্ট করে ওরা রওনা হলো কাঙ্খিত স্থানে।নীবদ্ধ ড্রাইভ করতে করতে বলল,
-‘তুমি কাজটা করার আগে তোমাকে একজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিবো।’
শুদ্ধতা কথাটা শুনে প্রশ্ন করল,
-‘ কার সাথে পরিচয় করাবেন?’
-‘ এই কেসটা যেই পুলিশ অফিসারের আন্ডারে আছে।ওইযে আমি চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম এইজন্যেই।উনাকে চট্টগ্রাম থেকে ট্রান্সফার করিয়ে এখানে এনেছি।’
নীবদ্ধ’র আধো আধো কথা বুঝার চেষ্টা করলো শুদ্ধতা।কিন্তু ফলাফল শূন্য হলো।তাই বলল,
-‘ আপনি আমাকে এক নাগারে সব বলবেন?এইভাবে টুকরো টুকরো ভাবে বলায় আমি কিছু বুঝতে পারছি না।’
নীবদ্ধ লম্বা নিঃশ্বাস ফেললো।তারপর একে একে সব বলে দিলো শুদ্ধতাকে।সব শুনে শুদ্ধতা অবাক।নীবদ্ধ যে এতো কিছু করে ফেলেছে ভাবতেই পারেনি।লোকটা আসলেই অনেক চতুর।শুদ্ধতা বলে,
-‘ এইভাবে রিস্ক নিচ্ছেন কাউকে না জানিয়ে।এটা কি ঠিক বলেন?’
-‘ কোথায় আর জানালাম নাহ? তুমি তো সব জেনেই নিলে!’
-‘ ভালো করেছি জেনেছি।’
-‘ হুম! তবে শুদ্ধতা একটা কথা।আমি ঠিক যা যা বলব সবটা সেইভাবেই করবে।এমনিতেই আমি কিন্ত টেনশনে মরে যাচ্ছি।কিন্তু তুমি নাছোর বান্দা এইভাবে জেদ ধরে আছো।’
শুদ্ধতা নীবদ্ধ’র হাতে হাত রাখলো।নীবদ্ধ করুন চোখে তাকালো শুদ্ধতার দিকে।সে এখনো মন থেকে রাজি না শুদ্ধতার সিদ্ধান্তে।শুদ্ধতা নরম গলায় বলে,
-‘ আপনি তো জানেন আমি পারবো।বিশ্বাস করেন তো আমায়? আমি প্রমিস করছি কিছু হবে না আমার।আমি আপনার শুদ্ধতার কিছু হতে দিবো নাহ।’
নীবদ্ধ গাড়ি থামালো।তারপর মুখ এগিয়ে নিয়ে চুমু খেলো শুদ্ধতার ললাটে।শুদ্ধতা চোখ বন্ধ করে নিলো।সরে আসলো নীবদ্ধ।শুদ্ধতার গালে আলতো স্পর্শ করে বলে,
-‘ প্রমিসটা মনে রাখিও শুদ্ধতা।’
গাড়ি থেকে বের হয়ে আসলো নীবদ্ধ।অপরপাশে গিয়ে শুদ্ধতাকেও দরজা খুলে বের করে আনলো।শুদ্ধতা তাকিয়ে দেখে এটা একটা রেস্টুরেন্ট।শুদ্ধতা ভ্রু-কুচকালো। বলল,
-‘ এখানে কেন’
নীবদ্ধ শুদ্ধতার হাত ধরে বলে,
-‘ তিনি এখানেই আছে।চলো আমাদের অপেক্ষা করছেন তিনি।’
নীবদ্ধ শুদ্ধতার হাত ধরে রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করলো।দূর হতেই জুনায়িদ শেখকে দেখে নীবদ্ধ সেদিকে এগিয়ে গেলো।গিয়েই বলে,
-‘ আসসালামু আলাইকুম অফিসার সাহেব।’
জুনায়িদ শেখ হাসলেন।বলেন,
-‘ ওয়া আলাইকুমুস সালাম।কেমন আছেন মিঃএহসান।’
-‘ আলহামদুলিল্লাহ!! আপনি?’
-‘ এইতো আমিও ভালো আছি।’
শুদ্ধতা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে দুজনের কথা শুনছিলো শুধু।নীবদ্ধ এইবার শুদ্ধতাকে দেখিয়ে বলে,
-‘ মিট মাই ওয়াইফ শুদ্ধতা।’
শুদ্ধতা সালাম জানালো।জুনায়িদ শেখ সালামের জনাব নিয়ে বলেন,
-‘ হ্যালো মিসেস শুদ্ধতা।আমি জুনায়িদ শেখ।ইন্সপেক্টর জুনায়িদ শেখ।’
-‘ আমি শুদ্ধতা রহমান।’
জুনায়িদ শেখ ভ্রু-কুচকালেন।সন্দিহান গলায় বলেন,
-‘ আপনার বাবার নামটা জানতে পারি মিসেস শুদ্ধতা।’
-‘ জি অবশ্যই।আমার বাবার নাম রাশেদ রহমান।’
নামটা শোনামাত্রই যেন অস্থির হয়ে উঠলো জুনায়িদ শেখ।ব্যাকুল কন্ঠে বলেন,
-‘ শুভ্রতা তোমার বোনের নাম?’
অবাক হলো শুদ্ধতা।জুনায়িদ শেখ এর মুখে নিজের বোনের নাম শুনে।বলে,
-‘ হ্যা কিন্তু আপনি কিভাবে জানলেন?’
শুদ্ধতার প্রশ্নটায় চুপ করে যান জুনায়িদ শেখ।নতমস্তকে চুপচাপ বসে রইলেন। নীবদ্ধ গম্ভীর গলায় বলেন,
-‘ কি হলো অফিসার? আপনি চুপ হয়ে গেলেন কেন?শুদ্ধতা কিছু জিজ্ঞেস করেছে!’
জুনায়িদ শেখ তাকালেন শুদ্ধতার দিকে।তারপর ধীর আওয়াজে বলেন,
-‘ আপনার ওয়াইফকে দেখেই আমার যেন অনেক চেনা চেনা লাগছিলো।মনে হচ্ছিলো আমার চেনা কারো সাথে ওর মুখটা অনেক মিলে।সে আর কেউ না উনার বোন শুভ্রতা ছিলো।কিন্তু মনের সন্দেহ মনেই রাখলাম।একরকম চেহারা প্রায় অনেরই হয়ে থাকে।সেখানে তো উনার হালকা পাতলা মিল আসে।কিন্তু উনি উনার নামের শেষে পদবীটা বলায় আমি আরো অবাক হই।কারন শুভ্রতার নামের পদবীও এইটাই ছিলো।তাই উনার বাবার নাম জিজ্ঞেস করলাম।তারপর আমার সন্দেহটাই সঠিক হলো।’
শুদ্ধতা এসব আমলে নিলো।তার প্রশ্ন একটাই।এই অফিসার তার বুবুর নাম জানলো কিভাবে?শুদ্ধতা গম্ভীর গলায় বলে,
-‘ বাট আপনি আমার বুবুকে চিনেন কিভাবে?’
জুনায়িদ শেখ শুকনো ঢোক গিললেন।অনেক বছরের ধামাচাপা দেওয়া বেদনাদায়ক দিনগুলো আবার মনে পরতে লাগলো।একের পর এক ঢোক গিলে নিজেকে ধাসস্ত্ব করতে লাগলেন। নীবদ্ধ ভ্রু-কুচকে তাকে দেখছে।হঠাৎ কি এমন হলো যে জুনায়িদ শেখ এমন করছেন।নীবদ্ধ তাও কিছু বলল নাহ।এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলো তার দিকে।জুনায়িদ শেখ পুরো পানিটুকু এক নিশ্বাসে খেয়ে নিলেন।নিজেকে একটু শান্ত করে এইবার আস্তেধীরে বলা শুরু করলেন,
-‘ শুভ্রতাকে আমি ভালোবাসতাম।’
চমকে উঠলো শুদ্ধতা আর নীবদ্ধ।অবাক নয়নে তাকালো জুনায়িদ শেখ এর দিকে।জুনায়িদ শেখ ওদের দৃষ্টি দেখে আলতো হাসলেন আবার বলেন,
-‘ তোমরা কেউ কোন প্রশ্ন করো না।আমি সব বলছি।’
শুদ্ধতা আর নীবদ্ধ একে-অপরের দিকে তাকিয়ে আবার জুনায়িদ শেখের দিকে তাকালো।তারপর মাথা নাড়িয়ে হ্যা বুঝালো।জুনায়িদ শেখ বলা শুরু করলেন,
-‘ একটা কেস নিয়ে আমি এখানের ভার্সিটিতে আসতে হয়। নাম ছিলো *****বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানেই প্রথম দেখি শুভ্রতাকে।তখন আমি পুলিশে নতুন নতুন জয়েন করেছি।এক দেখাতেই যে এইভাবে কাউকে ভালোবাসা যায় আমি জানতাম না।ভার্সিটিতে খোঁজ লাগিয়ে জানতে পারলাম।তার নাম শুভ্রতা।বিশ্বাস করো শুভ্রতাকে দেখার পর যেন আমার পুরো দুনিয়া এলোমেলো হয়ে গেলো।সারা দিনরাত শুভ্রতার কথা মাথায় ঘুরতো।কারনে অকারনে ছুটে চলে যেতাম ভার্সিটিতে শুভ্রুতাকে একটু দেখার জন্যে।এইভাবে এক বছর চলে গেলো।ভাবলাম, নাহ এইভাবে আর কয়দিন চলবে।ভালোবাসার কথাটা শুভ্রতাকে বলার সিদ্ধান্ত নিলাম।সেদিন ছুটি নিলাম।নিজেকে পরিপাটি করলাম।এতো খুশি ছিলাম আমি। একটা মেয়েকে বলে ভার্সিটির পিছনে নদী আছে সেখানে আসতে বললাম। শুভ্রতা এলোও।আমি যে কি খুশি হয়েছিলাম।আবার প্রচন্ড নার্ভাস ও ছিলাম।নিজের মনের কথা বললাম শুভ্রতাকে।কিন্তু শুভ্রতা বলল ও নাকি অন্য কাউকে ভালোবাসে।তাই আমার প্রপোজাল এক্সেপ্ট করতে পারবে না।আমাকে খুব সুন্দরভাবেই মানা করে দিলো।কিন্তু শুভ্রতার ওই মিষ্টি কথাগুলোই আমার হৃদয়ের বিষধর তীরের মতো বিধছিলো।ঝাঝরা করে দিচ্ছিলো আমার হৃদয়।আমি চলে আসি সেখান থেকে।মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম আর কখনো শুভ্রতার মুখোমুখি হবো নাহ।যেই কেসটা নিয়ে আমি তদন্ত করছিলাম সেই কেসের সুবাদে জানতে পারলাম শুভ্রতা যেই ছেলেটাকে ভালোবাসে আসলে সে একজন মাদক ব্যবসায়ী।ওই ভার্সিটির ছেলেমেয়েদের কাছেই ড্রা*স বিক্রি করতো।কিন্তু আমার কাছে পাকাপোক্ত কোন প্রমান ছিলো না।এইজন্যে ওকে ধরতে পারছিলাম নাহ।আমার মনটা অস্থির হয়ে উঠলো।শুভ্রতার জীবটা এইভাবে নষ্ট হতে দেখতে পারছিলাম নাহ।একদিন সাহস নিয়ে গেলাম শুভ্রতার কাছে। ওই ছেলেটার সত্যিটা বললাম।শুভ্রতা অনেক রেগে গেলো।বিশ্বাস করানোর জন্যে প্রমান চাইলো।আমার কাছে পাকাপোক্ত প্রমান না থাকায় দেখাতে পারলাম নাহ।ফলস্বরূপ শুভ্রতা অনেক রেগে গেলো।সেদিন পুরো ভার্সিটির সামনে আমাকে অপমান করলো।আমি নাকি শুভ্রতাকে পাওয়ার জন্যে এসব করছি এটা বললো।চড়ও মেরেছিলো।আমি নির্বাক ছিলাম সেদিন।শুভ্রতার প্রতি অনেক রাগ তৈরি হলো।ওকেও আমি পালটা চড় মেরে বলেছিলাম,” একদিন তুমি বুঝবে আমার প্রতিটা কথা সত্যি ছিলো।তখন তুমি অনেক কাঁদবে।এই দিনটার জন্যে আফসোস করবে।কিন্তু তোমার কাছে কোন পথ খোলা থাকবে না।” শুভ্রতা বিপরীতে আমায় বলেছিলো তাকে যেন আর কোনদিন আমার মুখ না দেখাই।আমিও কিছুটা রাগ আর আকাশসম অভিমান নিয়ে চলে আসি। কেসটা অন্য একজনকে হস্তান্তর করে দেই।কারন আমি আর চাইছিলাম না শুভ্রতার মুখোমুখি হতে।তার কিছুদিন পর জানতে পারলাম শুভ্রতা ওই ছেলেটাকেই বিয়ে করেছে।সেদিন আমি পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলাম। অবুঝের মতো কাজ করে বসলাম।হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে।আত্মহ*ত্যার চেষ্টা করলাম।কিন্তু আল্লাহ্ রহমতে প্রানে বেঁচে গেলাম।বাবা মা অনেক কাঁদলো।জানতে চাইলো আমার এমন করার কারন।আমি বলতে পারলাম না।বুঝাতে পারলাম নাহ আমার হৃদয়ের ব্যাথাগুলো।কিন্ত্য এরপর থেকে নিজেকে শক্ত করলাম।মনে প্রানে দোয়া করলাম শুভ্রতা ভালো থাকুক।সুখে থাকুক।আমি নাহয় ওর স্মৃতি নিয়েই সারাটাজীবন কাটিয়ে দিবো।এইভাবে কেটে গেলো এতোগুলো বছর।কিন্তু আমি আজও শুভ্রতাকে ভুলতে পারিনি। আজও আমি শুভ্রতাকে ভালোবাসি।খুব ভালোবাসি।আমার মনে ওর যে জায়গাটা আছে আজও কাউকে দিতে পারিনি
তাইতো বাবা মার এতো বলা সত্ত্বেও আমি আজও বিয়ে করতে পারি নি।শুভ্রতা আমাকে পুরো নিস্ব করে দিলো। তাও যদি মেয়েটা ভালো থাকে সুখে থাকে এই দোয়াই করবো।’
সব শুনে নীবদ্ধ বাকরুদ্ধ।কেউ কাউকে এতোটা ভালোবাসতে পারে আজ জুনায়িদ শেখকে না দেখলে জানতো নাহ।এর মধ্যেই শুদ্ধতা ফুফিয়ে উঠলো।দুহাতে মুখ ঢেকে কান্নারত গলায় বলে উঠলো,
-‘ বুবু তুমি এ কি করলা বুবু।একজনের সত্যিকারের ভালোবাসাকে পায়ে ঠেলে সরিয়ে দিলে বুবু।একজন বেঈমানের জন্যে। এ কি করলে বুবু।নিজের দোষে নিজের সুখ নষ্ট করলে।কেন করলে বুবু।আজ তুমি তার ভালোবাসা গ্রহন করলে অনেক সুখে থাকতে বুবু।ভালো থাকতে। ওই বেঈমানটাকে বিয়ে কেন করলে তুমি।নিজেকে মৃত্যুর মুখে নিজেই ঠেলে দিলে।আর দেখো একসময় নিজেই নিজেকে শেষ করে দিলে।কেন করলে বুবু? কেন করলে? আজ তোমার কারনে কতোগুলো মানুষ কষ্ট পাচ্ছে বুবু।আর তুমি যার কারনে এতোগুলো মানুষকে কষ্ট দিলে সে তো দিব্যি ভালো আছে তোমাকে ছাড়া।কেন এমন করলে বুবু।’
শুদ্ধতাকে এইভাবে হাউমাউ করে কাঁদতে নীবদ্ধ এই প্রথম দেখলো।এই প্রথম মেয়েটাকে এইভাবে ভেঙ্গে পড়তে দেখলো।নীবদ্ধ’র বুকে ব্যাথা উঠলো। অসহনীয় ব্যাথা যাকে বলে। প্রেয়সীর চোখের জল যে তার সহ্য হচ্ছে না।
#চলবে________
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।