রাঙা আলোর সন্ধ্যা পর্ব-২৩+২৪

0
9

#রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা
#পার্ট_২৩
জাওয়াদ জামী জামী

” এমন খচ্চরের মত করছেন কেন? আমাকে ঘুমাতে দিন। ” পুলক আশফিকে জাপ্টে ধরতেই চেঁচিয়ে উঠল সে।

” আমার ঘুম হারাম করে তুমি ঘুমাবে, এটা হতে দিতে পারিনা। আগে আমি ঘুমাব, তারপর তুমি। ” পুলক আশফিকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।

” আপনি আর রাতচোরা পাখির মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। আপনার ঘুমের অপেক্ষায় থাকলে আমাকে সারাজীবন না ঘুমিয়েই কাটাতে হবে। এদিকে আপনি না ঘুমিয়ে কেম্নে বেঁচে আছেন সেটা আল্লাহই জানেন। ছাড়ুন আমাকে। ” আশফি চেষ্টা করেও পুলকের শক্ত বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারলনা।

” তিড়িংবিড়িং না করে আমার বুকে চুপটি করে শুয়ে থাক। দেখবে কখন ঘুমিয়ে গেছ টেরই পাবেনা। যতক্ষণ ঘুম না আসবে, ততক্ষণ আমার হৃৎস্পন্দনের আওয়াজ শোন। দেখবে প্রতিটি স্পন্দনে তোমার নাম উচ্চারিত হচ্ছে। আমার হৃৎস্পন্দন থেকে শুরু করে প্রতিটি শিরা-উপশিরায় শুধু তোমারই নাম। ”

পুলকের ঘোর লাগা গলা শুনে কেঁপে উঠল আশফি। ওর মন ছেয়ে যায় ভালো লাগায়। মৃদু হেসে সে-ও চুপটি করে পুলকের বুকে শুয়ে রইল। অনুভব করতে থাকল পুলক মির্জার প্রতিটি হৃদস্পন্দন। সুনির্দিষ্ট লয়ে দ্রিম দ্রিম শব্দে হৃদস্পন্দনেরা তাদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।

***

সোফায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে শাহেদ। ওর দীর্ঘদেহী শরীরটা সোফায় আটছেনা। ও একবার মনে করল স্টাডি রুমে গিয়ে ঘুমাবে। কিন্তু পরক্ষণেই তিয়াসার অনুনয় ভরা মুখটা চোখের সামনে ভাসতেই, সিদ্ধান্ত বদলালো। কষ্ট করেই শুয়ে রইল সোফায়। গত চার বছর যাবৎ এই মেয়েটাকে ভালোবেসেছে সে। যাকে দেখার জন্য হুটহাট ছুটে এসেছে এই শহরে। তিয়াসার কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থেকেছে। চুপিচুপি দেখেছে তাকে। মেয়েটাকে চুপিচুপি এক ঝলক দেখেই দুচোখের তৃষ্ণা মিটিয়েছে। বহু আকাংঙ্খিত সেই মেয়ের একটা চাওয়া পূরণ করতে না পারলে কিসের স্বামী হয়েছে সে!

তিয়াসার চোখে ঘুম নেই। জীবনের কঠিন সমীকরণ মেলানোর বৃথা চেষ্টা করছে সে। বারবার রিফাতের মুখটা মনে পরছে। তার হাসি, তার নেশাক্ত চাহনি সবকিছুই যেন চোখের সামনে জ্যান্ত হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। তিয়াসার ভয় হচ্ছে, একদিন না একদিন ওকে রিফাতের সামনে পরতেই হবে, সেদিন ওদের দু’জনের প্রতিক্রিয়া কি হবে? সেদিন দু’জন দু’জনকে দেখে কি ওরা মুখ ফিরিয়ে নিবে? রিফাত কি ওকে ঘৃণার চোখে দেখবে? আচ্ছা, রিফাত কি এখন থেকেই ওকে ঘৃণা করতে শুরু করেছে? যেদিন ওর সাথে দেখা হবে, সেদিন কি রিফাত ওর সাথে কথা বলবে? রিফাত সেদিন মুখ ফিরিয়ে নিলে ও নিজেকে কিভাবে প্রোবোধ দেবে! কিভাবে সামলাবে নিজেকে। দু ফোঁটা অশ্রুবৃষ্টি ঝরল তিয়াসার আঁখি গহবর থেকে। গোপন এই অশ্রুবৃষ্টির ফোঁটা কেউই দেখলনা। কেউই জানলনা ওর গোপন ব্যথা। তিয়াসাও নিশ্চিত মনে অশ্রু ঝরাচ্ছে।

তিয়াসার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনে চমকায় শাহেদ। এটা স্বাভাবিক নিঃশ্বাসের শব্দ নয়। ড্রিম লাইটের আবছা আলোয় তিয়াসার দিকে তাকায়। মেয়েটা পাশ ফিরে শুয়ে আছে। থেকে থেকেই ওর ফুলে উঠছে। শাহেদ বুঝল, তিয়াসা কাঁদছে। অপরাধবোধ ওকে ঘিরে ধরল। বারবার নিজেকে দোষারোপ করছে। কেন সে আগে থেকেই তিয়াসার সম্পর্কে জেনে নিলনা? কেন তিন তিনটা জীবন নিয়ে বাজী ধরল? ওর একটা ভুলের জন্য মেয়েটা কষ্ট পাচ্ছে। হয়তো ওকে ভালোবেসে সেই পুরুষও আজ বিবাগী হয়েছে। কান্নার সাথে সন্ধি করেই হয়তো সে-ও বেঁচে আছে! নিজেকে ধিক্কার দিল শাহেদ। আজ নিজেকে তুচ্ছ কীট বৈ কিছুই মনে হচ্ছেনা। এই রুমে আর থাকতে পারবেনা সে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। কান্নারা দলা পেকে গলায় এসে আটকে আছে। তাদের আজ মুক্ত না করলে সে বাঁচতে পারবেনা কিছুতেই। শব্দ না করে সোফা থেকে নেমে দরজা খুলল সে।

দরজা খোলার শব্দ পেতেই পেছনে ঘুরে তাকায় তিয়াসা। শাহেদকে বাহিরে যেতে দেখে অবাক হয় ভিষণই।

” কোথায় যাচ্ছেন? ” ভারি গলায় জিজ্ঞেস করল।

” স্টাডি রুমে। আমি সেখানেই অভ্যস্ত হয়ে গেছি। ” চোখ মুছে বলল শাহেদ।

” যাবেননা প্লিজ। দাদু জানলে আমি তার সাথে মিথ্যা বলতে পারবনা। ” হুট করেই কেঁদে উঠল তিয়াসা। অনেকতো লুকোচুরি করল। গোপনে আর কতইবা কাঁদা যায়।

তিয়াসাকে কাঁদতে দেখে বুকের ভেতর মোচড় দেয় শাহেদের। তিয়াসার চোখের পানি ওর বুকের পাঁজরে তীব্র আঘাত করেছে।

” আপনি শুয়ে পরুন। আমি ছাদ থেকে আসছি। ” পেছন ফিরে না তাকিয়েই বলল শাহেদ। এরপর ও ছাদের দিকে পা বাড়ায়।

শাহেদ চলে গেলে তিয়াসা বিছানায় পিঠ ঠেকায়। তখনো ওর কান্না বন্ধ হয়নি।

ছাদে এসে অসীম অন্তরীক্ষের পানে তাকায় শাহেদ। ঐ দূর অন্তরীক্ষে নিজের বেদনা সোপর্দ করে একটু হালকা হতে চায়। এই ধুলার ধরনীর বুকে আজ নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে। একা, অসহায় এক পুরুষ যে কিনা সব পেয়েও অপূর্ণার গহীন সাগরে হাবুডুবু খেতে খেতে খেই হারিয়ে ফেলেছে। বদলে গেছে জীবনের সব দিক, মুছে গেছে সব রং। একবার বাবা-মা’ কে হারিয়ে কোনরকম বেঁচে আছে। এবার ভালোবাসার মানুষকে যদি হারিয়ে তবে কি নিয়ে বাঁচবে সে। হাউমাউ করে কেঁদে উঠল ছেলেটা। আজ বাবা-মা’কে প্রথমবারের মত স্বার্থপর মনে হচ্ছে। কেন তারা ওকে একা করে চলে গেল? কেন নিজেদের সাথে নিয়ে গেলনা? তাদের ছেলে স্বার্থপর এই পৃথিবীতে কিভাবে বেঁচে থাকবে সেটা কেন একবারও ভাবলনা?

ছাদে সটান হয়ে শুয়ে পরল শাহেদ। তাকিয়ে আছে সুদূরে জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকা নক্ষত্ররাজির দিকে। তখনও ওর চোখ দিয়ে অনর্গল ঝরছে বেদনার নোনা জল।

***

” মল্লিকা, তোমার পুত্রধন কোথায়? সে গতকাল তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে আমার প্রতিপক্ষের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ভাংচুর করেছে, সেটাকি জানো? তুমি কি তাকে ভালো হতে বলবেনা? ” আতিক মির্জা চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন। তার সামনে বসে আছেন মল্লিকা মির্জা।

স্বামীর কথা শুনে মল্লিকা মির্জা চিন্তিত বদনে বসে থাকলেন। স্বামীর ন্যায় তিনিও চান তার ছেলে বদলাক। রাজনীতি ছেড়ে, মারামারি, হিংসা ছেড়ে একজন দ্বায়িত্বশীল পুরুষে পরিনত করুক নিজেকে। কিন্তু তার ছেলে কিছুতেই এই পথ থেকে এক কদমও দূরে সরছেনা।

” ভাইজান আজ বাসায় আসলে আমরা সবাই মিলে পুলকের সাথে কথা বলি। যেভাবেই হোক ওকে এসব থেকে দূরে রাখতে হবে। বউমা এসব শুনলে কি ভাববে, সেই চিন্তায় আমার মাথা ঘুরছে। ” মল্লিকা মির্জা মৃদু গলায় বললেন।

” কোথায় তোমার ছেলে? ”

” কোন একটা মিটিংয়ে যাবে বলে বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে সকালেই। ”

” বাহ! সকালে বেরিয়ে গেছে, অথচ এখন সন্ধ্যা হতে চলল, কিন্তু সেই নবাব এখনো বাসায় আসেনি! সে কি সারাজীবন এভাবেই গায়ে হাওয়া লাগিয়ে দিনাতিপাত করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে? তাকে বলে দিও, বসে বসে খেলে রাজার ভান্ডারও নিঃশেষ হয়ে যায়। ”

” আহ্ এভাবে বলোনাতো। রাগ না করে ওকে সবাই মিলে বুঝিয়ে বলি আগে। তারপর দেখ ও কি করে। তারপর দোষারোপ করো। ”

” আমি এখন বাহিরে যাব। বাসায় ফিরব দশটার দিকে। তোমার পুত্রধন আসলে আমাকে খবর দিও। ভাইও আজ তারাতারি আসবে। ভাই আসলেই তাকে বলে রেখ। ” চা শেষ করে বেরিয়ে গেলেন আতিক মির্জা।

***

আন্টি, তুমি আজকের পর থেকে আর বোয়াল মাছ রান্না করোনা। তোমাদের নতুন বউয়ের বোধহয় বোয়াল মাছে এলার্জি আছে। ” শাহেদ দাদুর পাশে বসে রাতের খাবার খাচ্ছে। আরেকটা চেয়ারে তিয়াসা বসেছে।

শাহেদের কথা শুনে তিয়াসা বেশ অবাক হয়েছে। ও এ বাড়ির কাউকেই বলেনি ওর বোয়াল মাছে এলার্জি আছে। আন্টি ওর জন্য ভালোবেসে বোয়ালমাছ ভুনা করেছিল। তাই ও না করতে পারেনি। এক টুকরা মাছ খেয়েছিল। আর তাতেই ওর পুরো শরীর ফুলে গিয়েছিল। তবে কাকতালীয়ভাবে ড্রেসিংটেবিলের ওপর এ্যালার্জির ঔষধও পেয়েছিল। সেটা খাওয়ার পরই ওর এ্যালার্জি কমে যায়। এখন তিয়াসা বুঝতে পারছে শাহেদ কোনভাবে বুঝতে পেরেছিল ওর সমস্যা হচ্ছে, আর সে-ই ঔষধ রেখেছিল। কিন্তু তিয়াসা এটা বুঝতে পারছেনা শাহেদ জানল কিভাবে?

” কি কও বাবা, আমারে তো নতুন বউ একবারও কয়নাই তার বোয়ালমাছে এ্যালার্জি! আমারে একবার কইলে আমি বোয়ালমাছ রান্নাই করতামনা। ও নতুন বউ, তুমি আমারে কইবানা? ” হায়হায় করে উঠল খাদিজা আন্টি।

” না আন্টি, আমার তেমন কিছু হয়নি। আপনি এত উদগ্রীব হবেননাতো। আপনি আমার জন্য কত ভালোবেসে রান্না করেছেন, কিন্তু আমি সেটা খাবনা সেটা কি করে হয়! হোকনা একদিন এ্যালার্জি, তবুও তো আপনার হাতের মজার রান্না খেতে পেরেছি। ”

তিয়াসার কথা শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন খাদিজা আন্টি।

” আন্টি, আজকের পর থেকে বোয়ালমাছ, পুঁইশাক, বাদামের তৈরী যেকোন খাবার বাসায় তৈরী করবেননা। আপনাদের নতুন বউয়ের এসবে এ্যালার্জি আছে। ”

এবারও তিয়াসা শাহেদের কথা শুনে চমকায়। এতকিছু শাহেদ জানল কিভাবে সেটা ভেবেই ওর মাথা ঘুরছে।

চলবে…

#রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা
#পার্ট_২৪
জাওয়াদ জামী জামী

” বেটা, তোমার চাচ্চু আর তোমার আব্বু লিভিং রুমে আছে। তোমাকে ডাকছে তারা। ” মল্লিকা মির্জা পুললকে বললেন।

” কোন সমস্যা, আম্মু? দুই অভিভাবক একসাথে হয়েছে যে, ঘটনা কি কঠিন কিছু? ”

” তেমন কিছুইনা। তুমি চল আমার সাথে। ”

মল্লিকা মির্জার পিছুপিছু লিভিং রুমে ঢুকল পুলক।

” আরিব্বাস, দুই নেতা একসাথে! এমনটা সচারাচর দেখা যায়না। আজকের এই মুহূর্তটা ক্যামেরা বন্দী না করলেই নয়। ” পুলক নিজের ফোন বের কয়েকটা ছবি তুলল।

” তোমাকে ক্যামেরাম্যানের কাজ করার জন্য এখানে ডাকা হয়নি। ” আতিক মির্জার গমগমে কন্ঠস্বর শুনে কপাল কুঁচকে তাকায় পুলক। কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল তার দিকে। বাবার মন পড়ার চেষ্টা করছে। কয়েক মুহুর্ত পর বুঝতে পারল ভদ্রলোক ওর ওপর রেগে আছেন।

” কি ব্যাপার মেয়র সাহেবের মুড সুইং করছে নাকি? ঘন্টা আনেক আগেই দেখলাম কয়েকজনের সাথে হেসে কথা বলতে, কিন্তু এখন মুখটা প্যাঁচার মত করে আছে। কাহিনী কি? ”

” পুলক বেটা, এভাবে নিজের বাবাকে পিঞ্চ মারতে নেই। জানো তো তোমার বাবা একটু ইমোশনাল। তোমার পিঞ্চের ভার সহ্য করতে না পেরে হয়তো বাড়ি থেকে বেরিয়েই যাবে। তখন মল্লিকা আবার দিশেহারা হয়ে ওকে খুঁজতে বেরোবে। ” কামরান মির্জা হাসি-হাসি মুখ করে বললেন।

” ওকে চাচ্চু, আমি সাইলেন্ট মুডে চলে গেলাম। ”

” ভাইয়া, আমি সিরিয়াস বিষয় নিয়ে কথা বলতে তোমাকে এখানে থাকতে বলেছি। কিন্তু তুমি আমার কথা না ভেবে ঐ উজবুকের পক্ষ নিয়ে কথা বলছ! ভেরি ব্যাড, ভাইয়া। ” আতিক মির্জা রেগে উঠলেন।

” আচ্ছা বল আমিও সিরিয়াস হয়েই তোর কথা শুনব। পুলক বেটা, তুমিও স্থির হয়ে বস। ”

চাচ্চুর কথামত পুলক সিঙ্গেল সোফায় বসল।

” আগামী দিনগুলো কিভাবে কাটাবে সেটা ভেবে দেখেছ? নাকি এমন বাউণ্ডুলে হয়েই দিন পার করতে চাইছ? ” আতিক মির্জা সরাসরি পুলককে জিজ্ঞেস করলেন।

” আমাকে কোন দিক থেকে আমাকে তোমার বাউণ্ডুলে মনে হয়! আমার নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে, সেখানে আমি সময় দেই। ”

” ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সময় দাওনা, আড্ডা দাও সেখানে। কিছু দুপেয়ে বানরদের সাথে সেখানে কিচিরমিচির কর বেশিরভাগ সময়। ব্যবসা কিভাবে করতে হয় সেটা তোমার জানা আছে? ‘

” আম্মু, আব্বু এসব কি বলছে দেখেছ! ” পুলক অসহায় চোখে তাকায় মল্লিকা মির্জার দিকে। কিন্তু মল্লিকা মির্জা পুলককে অবাক করে দিয়ে চুপচাপ থাকলেন।

” তোমার আম্মুও জানে আমি ভুল কিছু বলছিনা। শো-রুম ব্যবসার জায়গা। সেখানে আড্ডা দিতে তোমার লজ্জা করেনা? সেখানে একদল বখাটেদের দেখে কাস্টমার অন্য শো-রুমে যায়। শহরে কি আড্ডা দেয়ার জায়গার অভাব পরেছে? এছাড়াও প্রতিদিন কারো না কারো সাথে মারামারি করছ। এমন কোন দিন নেই যে তোমার ন্সে অভিযোগ আসেনা আমার কাছে। কেন? ” আতিক মির্জা চোখমুখ শক্ত করে রেখেছেন।

” আমি কখনোই কারো সাথে মারামারি করিনা। হ্যাঁ যারা অন্যায় করে শুধু তাদেরকেই মারি। তুমি ভালো করেই জানো অন্যায়কে প্রশ্রয় দিইনা আমি। আর কিছু বলার আছে তোমার? ” পুলক ভারি গলায় বলল।

” কেন নিজের অপরাধের ফিরিস্তি শুনতে ভালো লাগছেনা নাকি? আমি জানতে চাই, কবে বদলাবে তুমি? পড়াশোনা তো করলেইনা, একটা বিজনেস ধরিয়ে দিলাম, সেটাতেও মনযোগ দিচ্ছনা। এসবের থেকে গুণ্ডামি করতে কমফোর্টেবল ফিল করো বলে আমার মনে হয়। তবে আর নয়। বিয়ে করেছ, ঘরে বউ রেখে গুণ্ডামি করতে দিচ্ছিনা আর। হয় রাজনীতি নয় বিজনেস যেকোন একটা বেছে নিতে হবে তোমাকে। এবং সেই সাথে গুণ্ডামিও ছাড়তে হবে। ছাড়তে হবে অসৎসঙ্গ। আজকেই এই বিষয়ে তোমার সাথে আমি শেষ কথা বলছি। আমার কথা না শুনলে এরপর তোমাকে বাড়ি ছাড়তে হবে বলে দিলাম। এবং বউমাকে ছাড়াই তোমাকে এই বাড়ি ছাড়তে হবে। আমি বউমাকে তোমার মত কাণ্ডজ্ঞানহীন ছেলের সাথে কোথাও যেতে দেবনা। ” আতিক মির্জা যথাসময়ে মোক্ষম কথাটাই বললেন। কারন তিনি জানেন, তার ছেলে আশফিকে ছেড়ে কোথাও যাবেনা। তিনিও চান তার ছেলে এই বাড়িতেই থাকুক। তবে ছেলেকে ভয় দেখানোর সুযোগ ছাড়লেননা।

” আতিক, তুই একটু থাম। আমি কথা বলছি পুলকের সাথে। পুলক বেটা, তুমি যদি রাজনীতি করতে চাও তবে করতে পার। কিন্তু সেক্ষেত্রে বিজনেসও তোমাকে মন দিয়ে সামলাতে হবে। আর যখনতখন কারও সাথে মারামারি করা যাবেনা। আমরা সবাই চাই তুমি স্বাভাবিক জীবনযাপন কর। তুমি বিজনেস করতে চাইলে সবরকম সহযোগিতাই আমরা করব। সমাজের আর দশটা পরিবারের মত নয় তোমার পরিবার। এখানে তুমি ভালো কাজের সাপোর্ট সব সময়ই পাবে। আমি বলি কি, তুমি রাজনীতির চিন্তা বাদ দিয়ে বিজনেসে মনোনিবেশ কর। এতে নিজের পরিবার, বউমাকে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারবে। কিন্তু রাজনীতি করলে সেটা পারবেনা। ”

” কিন্তু চাচ্চু, আমি রাজনীতি করতে চাই। আর আমি এখন অনেকের কাছেই পরিচিত মুখ। আমি যদি রাজনীতি আর বিজনেস একসাথে সামলাতে পারি, সেক্ষেত্রে কি তোমাদের কোন সমস্যা আছে? ছোটবেলা থেকেই পরিবারের গুরুজনদের রাজনীতি করতে দেখে বড় হয়েছি। রাজনৈতিক কাজে কখনো তোমাদের সাথে, কখনো একাই অংশগ্রহণ করেছি, সেখানে কিভাবে আমি রাজনীতি না করে থাকব বল? যেখানে আমার রক্তেই রাজনীতি, সেখানে এসব ছেড়ে কিভাবে থাকব বল? আমি রাজনীতিও করব পাশাপাশি বিজনেসও সামলাব। তবে হ্যাঁ, আব্বুর ভাষায় যেটা গুণ্ডামি সেটা করবনা। কিন্তু চোখের সামনে কোন অন্যায় দেখলে তার প্রতিবাদ অবশ্যই করব। আর মেয়র সাহেবের
দিকে কেউ কুনজর দিলে, তাকে হিংসা করে তার ক্ষতি করতে চাইলে তাকে ছাড়বনা এ কথাও বলে রাখলাম। আর মেয়র সাহেব, বুদ্ধির গোড়ায় একটু তেল দিন। বুদ্ধি বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই আপনার মধ্যে। নইলে একবার চিন্তা করে দেখতেন, আপনার ছেলে কখনোই কোন গরীব-দুঃখী কিংবা অসহায় মানুষদের সাথে খারাপ আচরণ করেনি। সব সময়ই তাদের সাহায্য করার চেষ্টা করেছে। কেবলমাত্র তাদেরকেই আমি প্রতিহত করেছি, যারা আপনার ক্ষতি করতে চেয়েছে। ” লিভিং রুমের সকলেই বুঝতে পারছে পুলক রেগে গেছে। কারন ও রেগে গেলে সব সময়ই আতিক মির্জাকে আপনি সম্মোধন করে। পুলক কারও অনুমতির তোয়াক্কা না করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

” দেখলে মল্লিকা, তোমার ছেলের কাজ? ও কাউকেই সম্মান করতে জানেনা। আমাদের কোন কথাই রাখলনা সে! ” আতিক মির্জা সবিস্ময়ে বললেন।

” ও আমাদের যথেষ্ট সম্মান করে। আমাদেরও উচিত ওর সিদ্ধান্তকে সম্মান করা। ও তো ভুল কিছু বলেনি। ছোট থেকেই রাজনীতি দেখে বড় হয়েছে, ওর রক্তে রাজনীতি। তোমরা যেখানে রাজনীতি করছ, সেখানে ওকে কেন আটকাতে চাচ্ছ? তুমি কি ভেবেছ, আমরা চাইলেই ও রাজনীতি ছাড়বে? তুমি যদি ছেলেকে রাজনীতিতেই না আনবে তবে নিজে কেন রাজনীতি ছাড়লেনা? আব্বা চেয়েছিলেন আমরা ইতালি গিয়ে সেটেল হই। তুমি সেদিন কেন তার কথা শোনোনি? সেদিন তুমি আব্বার কথা শুনলে, আজ আমার ছেলে এই নোংরা রাজনীতিতে জড়াতোনা। তুমি ভালো করেই জানো আমি রাজনীতি পছন্দ করিনা, তবে সুযোগ থাকা স্বত্বেও কেন রাজনীতি ছাড়োনি? আজ তুমি আমার ছেলেকে বলছ, ও গুণ্ডামি করে! ও কখনোই গুণ্ডামি করেনি। ও শুধু তোমার শত্রুদের নিধন করছে। যারা সুযোগ পেলেই তোমাকে শেষ করে দিতে চায়। সবকিছু জানার পরও কেন অন্ধ হয়ে থাক? এতই যদি ছেলেকে ভালোবাস, তবে চল সব ছেড়ে ছুড়ে ইতালি চলে যাই। এতে আমার ছেলেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে। তোমাকে নিয়ে সব সময় চিন্তায় থাকবেনা। ” আজ মল্লিকা মির্জা স্বামীর ওপর রেগে গেলেন। তিনি চান পুলক রাজনীতি ছাড়ুক। কিন্তু তিনি এটাও জানেন, আতিক মির্জা যতদিন রাজনীতি করবে, ততদিন পুলকও রাজনীতি ছাড়বেনা।

আতিক মির্জা জানেন তার স্ত্রী ভুল কিছু বলছেনা। তিনি যদি ইতালি সেটেল হতেন তবে পুলক আজ এই পথ বেছে নিতনা। তবে তিনি এত সহজেই হাল ছাড়বেননা। ছেলেকে রাজনীতি থেকে ফিরিয়ে না আনা পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়েই যাবেন।

***

” শাহেদ বাবা, আইজ তোমার পছন্দের ফ্রুট সালাদ করছি। এখন ইকটু খাইবা? ” খাদিজা আন্টি শাহেদকে বলল।

” আমাকে দিতে পার। কিন্তু তোমাদের নতুন বউকে দিওনা। মধুতে তার এ্যালার্জি আছে। তার জন্য বরং মধু ছাড়া কোন স্যালাড কর। ”

তিয়াসা ড্রয়িং রুমে বসে দাদুর সাথে গল্প করছিল। ও শাহেদের কথা শুনে আবারও চমকায়। ও কিছুতেই বুঝতে পারছেনা শাহেদ এসব কথা জানলো কিভাবে?

” ও নতুন বউ, সত্যিই তোমার মধুতে এ্যালার্জি আছে! আমারে আগে কওনাই কেন? তুমি যেইগুলা খাইবানা আমারে আগেই কইয়া দিবা। তুমি না কইলে আমি জানমু ক্যাম্নে কও? ”

তিয়াসা চিন্তিত বদনে মাথা নাড়ায়। ও একটা চিন্তাই করছে শাহেদ এতকিছু জানল কিভাবে?

” দিদি ভাই, তুমি কি রান্না করতে জানো? ” দাদু প্রশ্ন করলেন।

” জানি, দাদু। আপনি কি খাবেন বলুন, আমি রান্না করে দেব। ”

” তুমি কালকে আমাদের জন্য হাঁসের মাংস রান্না করো। দাদু ভাইয়ের হাঁসের মাংস পছন্দের। দাদু ভাই বোধহয় কাল রাতেই চলে যাবে। যাওয়ার আগে ওর পছন্দের খাবারগুলো তুমি আর খাদিজা মিলে রান্না করো। ”

” ঠিক আছে, দাদু ভাই। ”

***

পুলক রুমে এসে কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থাকল। আশফিকে দেখেও কিছু বললনা। সবকিছু কিভাবে সামাল দেবে সেটাই চিন্তা করছে। রাজনীতি করে বিজনেস সামলানো ওর জন্য কঠিন হয়ে যাবে। কিন্তু ও বিজনেস ছাড়তে চায়না। দাদুর স্বপ্ন ছিল এই বিজনেসটা একদিন বড় হবে ওর হাত ধরে। তাই এই বিজনেস অন্য কারও হাতে দেয়ার ইচ্ছে নেই পুলকের।

” নাহ্ যতই যাইহোক না কেন, আমি পিছু হটবনা। রাজনীতির পাশাপাশি বিজনেসও সামলাব, তাতে যতই পরিশ্রম হোকনা কেন। ” পুলক আনমনে বলে উঠল।

” ওমা এতো দেখছি বদ্ধ উন্মাদ। আগে জানতাম এই বদ লোক শুধুই পাগল। এই উন্মাদের সাথে আমাকে একঘরে রাত কাটাতে হয়! ” পুলককে একা কথা বলতে দেখে আশফি ভয় পায়। গত কয়েকদিন পুলককে এভাবে একা কথা বলতে দেখেনি ও।

আশফির কথা শুনে টনক নড়ে পুলকের। ওর দিকে নেশাক্ত চোখে তাকায়।

” শুধুই কি এক ঘরে? বল এক বিছানায়, আমারই বুকে তোমার রাত কাটাতে হয়। এখন নতুন বউ জন্য তোমাকে ছাড় দিচ্ছি। যাক না আর কয়টা দিন। তখন দেখবে এই উন্মাদের সাথে আর কি কি করতে হয়। ” আশফির দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল পুলক।

পুলকের কথা শুনে আশফি লজ্জায় মুখ নিচু করল।

***

” আমি কাল ঢাকা যাচ্ছি। হয়তো আগামী তিনমাসের মধ্যে বাসায় আসবনা। আপনি কলেজ মিস দেবেননা। এখানে সকল সুযোগ-সুবিধা পাবেন পড়ার জন্য। গাড়িতে করে কলেজে যাবেন। আর এখানে টাকা রেখে যাচ্ছি, প্রয়োজনে খরচ করবেন। ” শাহেদ আলমারির ড্রয়ারে টাকা রেখে বলল।

” টাকা লাগবেনা আমার। ” তিয়াসা মৃদু গলায় বলল।

” যদি লাগে, তখন কি করবেন? ” শাহেদ সব সময়ের মতই ধীর গলায় কথা বলছে।

” আম্মুর কাছ থেকে নিব। ” ইতস্তত করে বলল তিয়াসা।

” যতদিন এই বাড়িতে আছেন, ততদিন আপনার সব দ্বায়িত্ব আমার। তাই না চাইলেও আপনাকে নিতে হবে। আপনার আম্মুর কাছ থেকে টাকা নিয়ে আমাদের ছোট করবেননা আশা করি।”

” যতদিন আছি মানে? ” তিয়াসা ভীত হয়ে জিজ্ঞেস করল।

” মানে, আমি আপনার মুক্তির পথ করে দিতে চাইছি। কাউকে জোর করে তার মনের বিরুদ্ধে কোন সম্পর্কে জড়িয়ে রাখতে চাইনা আমি। যেহেতু আগে জানতামনা আপনি অন্য কারও কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, তাই ভুল করে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু এখন যখন সবকিছু জেনেছি, তখন আপনার পায়ে বেড়ি দিতে চাইনা । যেহেতু আমি বাসায় থাকবনা সেহেতু আপনি মনযোগ দিয়ে পড়াশোনা করবেন। আর যখন চাইবেন তখনই আপনাকে মুক্তি দিতে রাজি আছি আমি। শুধু আমাকে একবার ডাকবেন, আমি এসে আপনাকে মুক্তি দিয়ে যাব। তবে যতদিন আপনি আমার স্ত্রী’র অধিকারে আছেন, ততদিন আপনার সকল দ্বায়িত্ব আমাকেই পালন করতে হবে। এবং আপনি না চাইলেও এটা আমাকে করতেই হবে। ”

শাহেদের কথা শুনে তিয়াসা কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল। ওর জীবন কঠিন সমস্যার দিকে মোড় নিচ্ছে সেটা ও অনুধাবন করতে পারছে। কি করে এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসবে সেই পথ জানা নেই ওর। সেদিন রিফাত ওকে বলেছিল, মন দিয়ে সংসার করতে। ও আগে কখনোই রিফাতের কথা অমান্য করেনি, এখনও করতে চায়না। ও রিফাতের কথা রাখতে সংসার করতে চায়। কিন্তু এই মানুষটা যে মুক্তি দিতে চাইছে? ও তো মুক্তি চায়না। এক ভাঙাচোরা হৃদয়ের মানুষের কথা রাখতে, আরেক শান্ত স্নিগ্ধ মানুষের সংসারে বাঁধা পরতে চায়। কিন্তু কিভাবে করবে এসব?

” আমি আপনার কাছে সময় চেয়েছি, মুক্তি চাইনি। দিন না আমাকে কিছুদিন সময়। ”

” আপনি চাইলে সময় নিতে পারেন। কিন্তু ফলাফল একই থাকবে। আমি জানি কাউকে সত্যিকারের ভালোবাসলে, অন্য কাউকে তার জায়গায় বসানো যায়না। যেটা আপনিও কখনোই পারবেননা, আর আমিও পারবনা। তাই অযথাই সময় চেয়ে নিজেকে কষ্ট দেবেননা। আপনি হয়তো নিজের কষ্ট সইতে পারেন, কিন্তু আমি পারিনা। ” শাহেদ ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছে।

শাহেদের কথা শুনে তিয়াসা ওর দিকে তাকায়। শেষের কথা দিয়ে সে কি বোঝাতে চাইল? কার কষ্ট সে সহ্য করতে পারেনা? তার নিজের? নাকি তিয়াসার?

***

বুকে কামড় অনুভব করতেই পুলক আশফির দিকে তাকায়। ও আশফিকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে ঘুমাচ্ছিল।

” কি ব্যাপার, এভাবে কামড়াকামড়ি করছ কেন? ক্ষুধা লেগেছে? ”

” এভাবে জড়িয়ে রাখলে আমার শরীর ব্যথা হয়ে যায়। নিঃশ্বাস নিতে পারিনা। ছাড়ুন আমাকে। ”

” আমার নিঃশ্বাসেই তুমি বেঁচে থাকবে। তাই তোমার নিঃশ্বাস না নিলেও চলবে। আর প্রতিদিন তোমাকে ম্যাসাজ দেয়ার জন্য আমি কাউতে পাঠিয়ে দেব। তাই এখন চুপচাপ ঘুমিয়ে পর। ”

” বদ লোক, তার নিঃশ্বাসে নাকি আমি বাঁচব! এটা কি কখনো হয়! বাপের জন্মেও এমন কথা শুনিনি। ”

” বাপের জন্মে শোনোনি, স্বামীর জন্মে শোন। এরকম আরও অনেক কথাই আছে যেগুলো বাপের জন্মে শোনোনি কিন্তু স্বামীর জন্মে শুনবে। স্বামী হিসেবে সেসব কথা তোমাকে শোনানোর দ্বায়িত্ব আমার। আবার স্বামী হিসেবে অনেক কিছু করার দ্বায়িত্বও আমার। সেসবও হবে ধীরে ধীরে। ”

” বদ লোক একটা। ”

” জানি। এবার ঘুমাও। ”

আশফি বুঝল পুলক ওকে ছাড়বেনা। তাই আর কিছু না বলে ঘুমানোর চেষ্টা করল।

চলবে…