রাঙা আলোর সন্ধ্যা পর্ব-৪৩+৪৪

0
162

#রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা
#পার্ট_৪৩
জাওয়াদ জামী জামী

” শ্বাশুড়ি আম্মা, আমাকে ডেকেছেন? ” নিলাশা হাঁই তুলতে তুলতে রিনা আক্তারকে জিজ্ঞেস করল।

” হ, ডাকছিই তো। বেলা হইছে, দুপুরের খাওন রান্ধন লাগবো। তুমি দুইডা রাইন্ধা ফালাও। সারাদিন ঘরে দরজা বন্ধ কইরা থাকতে তোমার লজ্জা করেনা? বাইত্তে তোমার শ্বশুর আছে, আরও গুরুজন আছে। তাগোর সামনে এম্নে দরজা বন্ধ কইরা থাকো কেম্নে? ” মুখ ঝামটা দিয়ে বলল রিনা আক্তার।

” সকাল আটটায় দুপুরের খাবার রান্না করব! একটু পরে রান্না করি? আর আমি দরজা বন্ধ করে রাখিনা, শ্বাশুড়ি আম্মা। দরজা ভেজিয়ে রাখি। তাই লজ্জারও কিছু নেই। ” নিলাশাও কম যায়না। সে তৎক্ষনাৎ রিনা আক্তারের মুখের ওপর বলল।

” আমার ভাইবোনের পোলা-মাইয়া তাড়াতাড়ি দুপুরের খাওন খায়। সেইজন্যই তোমারে তাড়াতাড়ি রান্ধবার কইতাছি। তোমার সাথে কতা কওন মানেই অপমান হওয়া। তুমি বেশরম মাইয়া, কতাও বেশি কও। ” রিনা আক্তার অকারনেই নিলাশাকে কথা শোনাচ্ছে।

” কিহ! ওরা তাড়াতাড়ি খায় জন্য আমাকে সকাল আটটার সময় দুপুরের খাবার রান্না করতে হবে? তারচেয়ে বরং সকালের নাস্তা ওদের জন্য কিছুটা রেখে দিন। ক্ষুধা লাগলে ওরা খেয়ে নেবে।ভালো কথা , যখন জানেনই আমি বেশরম, তখন যেচে আমার সাথে কথা বলতে আসবেননা। ” নিলাশা ত্যাড়ামো করে বলল।

” তোমারে রান্ধবার কইছি, তুমি রান্ধবা। এত কতা কিসের? এই বাড়ির মালিক তুমি না আমি? আমি যা কমু সেগুলানই করন লাগব। এই বাড়িতে আমার কতার বাহিরে কেউ যায়না। সেই হিসাবে তোমারেও আমার কতা শুনতে হইব। দুই দিনের মাইয়া তুমি এই বাড়িতে আইসা আমার উপর ছড়ি ঘুরাইবা, এইডা হইবনা। আর তোমার সাথে কতা কওনের কুন ইচ্ছাই আমার নাই। দরকার পরে তাই কতা কই। ” রিনা আক্তার রেগে গেছে।

” এই বাড়ির মালিক আপনিও না, আমিও না। এই বাড়ির মালিক রিফাতের বাবা। কারন এটা তার পৈতৃক ভিটা। আপনি আর আমি এই বাড়ির বউ। এই বাড়িতে আমাদের দু’জনের সমান অধিকার। বাই দ্য ওয়ে, আমি ঠিক এগারোটার সময় রান্নাঘরে ঢুকব। এর এক মিনিট আগেও নয়, আবার পরেও নয়। এরমধ্যে যদি আপনার বাপের বাড়ির আত্মীয়দের ক্ষুধা লাগে, তবে ঘরে অনেক খাবার আছে, সেগুলো খেতে দেবেন। আর সেটা যদি করতে না পারেন তবে নিজেই রান্নাঘরে যান৷ আর আমি একদিনের মেয়ে হই কিংবা দুইদিনের মেয়ে হই, আমার মতই আমি চলব। আমার ওপর কেউ ছড়ি সেইটা আমিও চাইনা। প্রয়োজনে ছড়ি ভেঙে লাকড়ি বানিয়ে রান্না করব। ” নিলাশা গটগটিয়ে নিজের রুমে চলে গেল।

রত্না পারভিনসহ বাড়ির প্রত্যেকেই নিলাশা আর রিনা আক্তারের কথপোকথন শুনছিলেন। নিলাশার সাহস দেখে সবাই একটু অবাকই হয়েছেন। তবে তারা মনে মনে খুশিও হয়েছেন। এতদিনে হয়তো রিনা আক্তারকে সোজা করার মানুষ এসেছে।

ঠিক এগারোটায় নিলাশা রান্নাঘরে ঢুকল। ওকে সাহায্য করার জন্য একজনকে পাঠিয়ে দিলেন রত্না পারভিন। সেই মেয়েটি মাছ-মাংস, তরকারি বেছে, কেটে ধুয়ে দিল। মসলা বেটে দিল। নিলাশা একে একে কয়েকরকম তরকারি রান্না করল। এছাড়াও পোলাও, ভাত, পায়েস রান্না করল। রিনা আক্তার মাঝেমধ্যে রান্নাঘরে এসে এটা সেটা রান্না করতে বলে গেল। নিলাশা বিনাবাক্যে সেগুলো রান্না করল।

রিফাত বাড়িতে না থাকায় দুপুরে ওর খেতে দেরি হল। নিলাশা ওর জন্য অপেক্ষা করছে। রিনা আক্তার তার মা, ভাইবোন, তাদের ছেলেমেয়েদের একসাথে খেতে দিয়েছে। নিলাশা খাবার ঘরে গিয়ে দেখল সে সবাইকে ইচ্ছেমত খাওয়াচ্ছে। নিলাশা না দাঁড়িয়ে রুমে আসল।

তিনটার দিকে রিফাত বাড়িতে আসলে ওকে খেতে ডাকল নিলাশা। রিফাত ফ্রেশ হয়ে খাবার ঘরে আসল। নিলাশা রিফাতকে খাবার দিতে গিয়ে অবাক হয়ে যায়। ও তিনরকম মাছের তরকারি রান্না করেছিল। এছাড়া মাংসও ছিল। এখন কোন বাটিতেই মাছ কিংবা মাংস দেখলনা নিলাশা। বাটিতে শুধু ঝোল পরে আছে। আর আছে পটল ভাজা, করলা ভাজা। পায়েসও নেই। নিলাশার মাথায় আগুন ধরে গেল। ও তন্নতন্ন করে খুঁজেও মাছ-মাংসের হদিস পেলনা। বাধ্য হয়ে গেল রিনা আক্তারের কাছে।

” শ্বাশুড়ি আম্মা, বাটিতে মাছ-মাংস কিছুই নেই যে। রিফাতকে কি দিয়ে খেতে দেব? তরকারি কোথায় রেখেছেন বের করে দিন। ”

” তরকারি আবার কনে রাখমু! সব শ্যাষ হইয়া গেছে। তুমি রিফাতরে এই বেলা ঝোল দিয়াই খাইতে দেও। রাইতে মাছ রাইন্ধা ওরে খাইতে দিও। ”

” দুই কেজি ওজনের রুই মাছ, এক কেজি পাবদামাছ, মলা মাছও ছিল পাঁচশো গ্রাম। এছাড়াও দুইটা মুরগী রান্না করেছিলাম। যা দিয়ে সবাই মিলে দুইবেলা খাওয়া যেত। আর আপনি বলছেন, এক বেলায় এতসব খাবার শেষ হয়ে গেছে? পায়েসও নেই দেখলাম। আপনার একবারও মনে হলোনা আমরা দু’জন এখনো খাইনি? ”

” তোমরা বাড়ির মানুষ। তাই এতকিছু ভাবি নাই। আর তাছাড়া একবেলা মাছ-মাংস না খাইলে মইরা যাইবা? কইলাম তো রাইতে খাইও। ”

” মাছ-মাংস না খেলে কেউ মরেনা। কিন্তু আবার অনেকেই হাভাতের মত না খেলেও বাঁচেনা। যাই হয়ে যাক না কেন তাদেরকে খেতেই হয়। ” নিলাশা রাগে গজগজ করতে করতে খাবার ঘরে আসল।

রিফাত আসলে ওকে শুধু পটল আর করলা ভাজা দিয়ে ভাত দেয় নিলাশা। রিফাত কোন প্রশ্ন না করে খেতে শুরু করল। নিলাশাকেও খেতে বলল। নিলাশা অল্প একটু ভাত নিয়ে খেয়ে নিল।

***

বিকেলে রিনা আক্তার তার ভাইবোনের ছেলেমেয়েদের খেতে দিয়েছে। ওরা খাবার ঘরে বসে মজা করে খাচ্ছে। নিলাশা কোন একটা প্রয়োজনে খাবার ঘরে গিয়ে অবাক হয়। সাতজন ছেলেমেয়ে মাছ-মাংস, পোলাও গোগ্রাসে গিলছে। অথচ দুপুরে ওরা শুধু ভাজি দিয়ে খেয়েছে। আর রিনা আক্তারও বলেছিল তরকারি শেষ হয়ে গেছে। নিলাশা চোখমুখ কুঁচকে এগিয়ে যায় রিনা আক্তারের কাছে। ওকে দেখে রিনা আক্তারের মুখ শুকিয়ে গেল।

” আরে আরে, এরা তো দেখছি মাছ-মাংস খাচ্ছে! যেগুলো আমি রান্না করেছিলাম। কিন্তু আপনি দুপুরে কেন বললেন, সব শেষ হয়ে গেছে? সেই সাথে অনেক কথাও শুনিয়ে দিলেন। এখন কি এতসব মাছ-মাংস আকাশ থেকে টুপ করে পরল? ”

” পোলাপানগুলা বিকালে খায় জন্য ইকটু তুইলা রাখছিলাম। ” শুকনো গলায় বলল রিনা আক্তার।

” পোলাপানগুলো বিকেলে খায়। বাহ বেশ ভালো। কিন্তু আমরা যে শুধু ভাজি দিয়ে খেয়েছি, তার বেলায়? আমাদের দু’জনের জন্য দুই টুকরো মাছ রাখলে কি খুব বেশি ক্ষতি হত? ” চিবিয়ে চিবিয়ে বলল নিলাশা।

” সারাদিন ইমুন কইরা খাই খাই কর কেন? বাপের বাড়িতে খাওনি নাকি? তোমার বাপে তোমারে এই বাইত্তে খালি খাওনের জন্যই পাঠাইছে? ভাবখান দেইখা মনে হইতাছে তুমি নতুন বউ নও। মনে হইতাছে এই বাইত্তে তুমি কয়েক বছর আগেই আইছ। লজ্জাশরম কিছুই নাই। বেহায়া মাইয়া মানুষ। ” চিৎকার করে উঠল রিনা আক্তার।

” আমি বাবার বাড়িতে কি খেয়েছি না খেয়েছি, তার কৈফিয়ত আপনাকে দেবনা। শুধু একটা কথাই বলব, আমি আপনার আত্মীয়স্বজনদের মত হাভাতে ঘরের মেয়ে নই। বেশি করে খাওয়ান হাভাতে গরিবদের। আমার মনে হচ্ছে এরা খাওয়ার জন্যই এখানে এসেছে। ” রিনা আক্তারের কথা শুনে রাগে নিলাশা হিতাহিত জ্ঞান হারিয়েছে। ও কি বলছে সেই হুঁশ ওর নেই।

” কি কইলা? তোমার এতবড় সাহস, আমার ইষ্টিকুটুমদের হাভাতে কও? আইজ এর একটা বিহিত আমি কইরাই ছাড়মু। দুইদিনের মাইয়া হইয়া আমার সাথে কাইজা কর? ” রিনা আক্তার যথারীতি চিৎকার শুরু করেছে। নিলাশা আর সেখানে দাঁড়ায়না। রুমে চলে যায়।

রিনা আক্তারের চিৎকার কিছুতেই থামছেনা। তার চিৎকার শুনে আফজাল হোসেন, রত্না পারভিন ছুটে আসলেন। রিনা আক্তারের ভাইবোনেরা সবাই বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। তারা গুজগুজ ফিসফিস করছে।

” এভাবে চিৎকার করছ কেন, রিনা? বাড়ি ভর্তি আত্নীয়-স্বজনরা আছে। এরমধ্যে তোমার চিৎকার না করলেই কি নয়? ” আফজাল হোসেন বিরক্ত হয়ে বললেন।

” হ এখন সব দোষ আমার। তোমার পোলার বউ ধোয়া তুলসীপাতা। দুইদিনের মাইয়া আমার ইষ্টিকুটুমগোর অপমান করতাছে, সেইডা তো তোমার চোখে পরবনা। ঐ মাইয়া কয় আমার ভাইবোনরা হাভাইত্তা, গরীব। যেমন তোমার পোলা, তেমনি তার বউ। দুইডাই শয়তান। আগে তোমার পোলায় আমার জীবন তছনছ করছে, এখন আবার তার বউ আইছে। ” আহাজারি করছে রিনা আক্তার।

” রিনা, তুমি থামবে? এসব কি? তুমি রিফাত আর বউমাকে অপমান করছ কেন? আমরা জানি রিফাত কেমন ছেলে। তোমার থেকে জেনে নিতে হবেনা। ” রত্না পারভিন রেগেই গেলেন।

” আপ্নে থামেন। আমার সংসারে কতা কবার জন্য আপনারে ডাকি নাই। আপ্নে নিজের সংসারে নাক গলান গিয়া। ” রত্না পারভিনকেও অপমান করল রিনা আক্তার।

রিনা আক্তারের অভিযোগের ঝুড়ি শুনে রুম থেকে বেরিয়ে আসল নিলাশা। রিফাতও বাড়িতে ঢুকে সব শুনে অবাক হয়েছে। ও ভেবে পাচ্ছেনা নিলাশা এসব কেন বলেছে? আফজাল হোসেন নিলাশার দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনিও দুঃখ পেয়েছেন নিলাশার বলা কথাগুলো রিনা আক্তারের মুখে শুনে। এই চারদিনেই তিনি নিলাশাকে মেয়ের স্থানে বসিয়েছেন। তাই এসব মানতে তার কষ্ট হচ্ছে।

নিলাশা বুঝতে পারছে ওকে সবার সামনে ছোট করবে এই মহিলা তাই এবার ও চুপ থাকলনা। একে একে সব খুলে বলল আফজাল হোসেনকে। সব শুনে আফজাল হোসেন স্তব্ধ হয়ে গেছেন। তারা সবাই ভালোমন্দ খেয়েছে কিন্তু রিফাত, নিলাশাকে খেতে দেয়নি রিনা! আফজাল হোসেন রাগী চোখে তাকালেন রিনা আক্তারের দিকে। রিনা আক্তার মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছে।

” এবার বলুন বাবা, আমার ভুল কোথায়? নিজের অধিকার চাওয়া কি অপরাধ? আমার পরিবার তুলে কথা বললে আমি কি মুখ বুজে সহ্য করব? চারদিন হয়েছে এই বাড়িতে এসেছি, এরইমধ্যে আমাকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে। কেন, বাবা? যেখানে আপনার ছেলে বাজার করে এনেছে, সেখানে তাকেই সেগুলো খেতে দিচ্ছেনা কেন? আমার জানামতে, আপনার ছেলে অনেক আগে থেকেই নিজের খরচে খায়। তারপরও কেন এত অবহেলা বলতে পারেন? সে উনার পেটের ছেলে নয় বলে? ” নিলাশা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল রিফাত ওকে থামিয়ে দেয়।

” নিলাশা, রুমে এস। অনেক কথা বলেছ, আর একটা কথাও নয়। ” রিফাতের ডাক শুনে নিলাশা রুমে চলে যায়।

***

” এই যে সারাদিন বাসায় শুয়ে-বসে কাটালেন, একটুও বিরক্ত লাগলনা আপনার! পুরুষ মানুষ এভাবে রুমে বসে বসে ঝিমায় সেটা আপনাকে দেখেই জানলাম। ” তিয়াসা শাহেদকে খোঁচা মেরে বলল।

তিয়াসার কথা শুনে শাহেদ ওর দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে। যার জন্য আজ সে অফিসে গেলনা, সে-ই বলছে এসব কথা!

” রাতে বারবার কে যেন রিকুয়েষ্ট করছিল আজ অফিসে না যেতে? কে যেন বলল, আমি আজ বাসায় না থাকলে তার খারাপ লাগবে আরও কতকিছু। ”

শাহেদের কথা শুনে তিয়াসা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। শাহেদ ল্যাপটপে কাজ করছিল। তিয়াসার হাসির ঝংকার ওর কাজে ব্যাঘাত ঘটায়। ল্যাপটপ বন্ধ করে উঠে দাঁড়ায় শাহেদ। এগিয়ে যায় তিয়াসার কাছে। তিয়াসার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দু’হাতের আঁজলায় ওর মুখ তুলে ধরল। শাহেদের স্পর্শ পেয়ে তিয়াসার ঠোঁট তিরতির করে কাঁপছে। ওর কম্পমান ঠোঁট শাহেদের তৃষ্ণা বাড়িয়ে দিল। নিজেকে বঞ্চিত করতে চায়না শাহেদ। শাহেদের কালচে খয়েরী ঠোঁট পরম আবেগে আঁকড়ে ধরল তিয়াসার ঠোঁট। আবেশে দু’জনের চোখ আপনাআপনি বন্ধ হয়ে গেল।

অনেকক্ষণ পর তিয়াসা শাহেদের বন্ধন থেকে মুক্ত হল। শাহেদ ওর কপালে চুমু দিয়ে আদুরে গলায় বলল,

” আধাঘন্টা অপেক্ষা কর, আমি একটু আসছি। ”

” কোথায় যাবেন? ” তিয়াসা মন খারাপ করে বলল।

” সারপ্রাইজ। ” শাহেদের ঠোঁটে দুষ্টু হাসি।

” তাড়াতাড়ি আসবেন কিন্তু। ”

” যথাআজ্ঞা, মহারানী। ” শাহেদ বেরিয়ে গেল।

আধাঘন্টা পরে শাহেদ রুমে এসে তিয়াসাকে কাছে ডাকল। তিয়াসা কাছে আসলে হাতে থাকা প্যাকেট থেকে বেলি ফুলের মালা বের করে অনভ্যস্ত হাতে তিয়াসার এলো চুলগুলো খোঁপা করে দিল। এরপর অনেক কষ্টে খোঁপায় ফুলের মালা জড়িয়ে দিল।

” আমার মিষ্টি বউটা আজ শাড়ী পড়েছে, দুপুরে দেখলাম চুলে খোঁপাও বেঁধেছে। লক্ষ্য করলাম ফুলের মালা ছাড়া আমার বউটাকে অসম্পূর্ণ লাগছে। তাই আমি খোঁপাটা এখন পূর্ণ করে দিলাম। আমি জানতাম বেলি তোমার পছন্দের ফুল। ”

তিয়াসা ফুলের মালা দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে গেল। ওর চোখ জোড়া অশ্রুতে টইটুম্বুর। যেকোন মুহূর্তে সেগুলো উপচে পরার জন্য প্রস্তুত। যে মানুষটাকে এতগুলো মাস দূরে সরিয়ে রেখেছে, সেই মানুষটাই ওর সকল প্রয়োজন বিনা প্রশ্নে পূরন করেছে, ওকে আপন করে নিয়েছে। আবার ওর পছন্দের বেলি ফুলের মালা এনেছে আজ! গোপনে ওর পছন্দ-অপছন্দ জেনে নিয়েছে। তিয়াসা ফুঁপিয়ে উঠে মুখ গুঁজল শাহেদের বুকে।

চলবে…

#রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা
#পার্ট_৪৪
জাওয়াদ জামী জামী

” তুমি আমার সাথে কাল ঢাকা যাবে। সব গোছগাছ করে নাও। ” নিলাশা রুমে আসলে রিফাত ওকে বলল।

” আমিতো বলেইছি সাতদিন এখানেই থাকব। আপনি অফিসের কাজ সেড়ে আমাকে নিয়ে একবারে চিটাগং যাবেন। ” নিলাশা গাল ফুলিয়ে বলল।

” তোমাকে আমি ঝগড়া করতে এখানে রেখে যাই! এত বড় পাগল এখনো হইনি। আমার অনুপস্থিতিতে এখানে তোমার সাতদিন থাকা মানেই কেয়ামত ঘটে যাবে। ” রিফাত ভয়ংকর হতাশ হয়ে বলল।

” আমাকে কি আপনার আজরাইল মনে হচ্ছে! আজরাইল ভাবলে ভুল করবেন। আমি হলাম গিয়ে একজন প্রতিবাদী নারী। যে নিজের স্বামীর সাথে ঘটা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে সদা তৎপর। এভাবেই যদি প্রতিটা ঘরে নারীরা প্রতিবাদ করতে পারে, তবে দেশের সৎমায়েরা আর সৎ থাকবেনা। ” নিলাশা রিফাতকে অনুসরণ করে গুরুগম্ভীর গলায় বলল।

” দেশের সৎমায়েরা সৎ না হয়ে কি হবে? অসৎ হবে? তাহলেই সব খেল খতম। তখন ঘরে ঘরে তোমার মত প্রতিবাদী নারী আর একটাও রাখবেনা দেশবাসী। প্রতিবাদী নারীদের বিরুদ্ধে কঠিন আন্দোলন শুরু হবে। আর তাছাড়া দেশের প্রতিটা ঘরেও সৎমা নেই। তাই তোমাকে এই গুরু দ্বায়িত্ব না নিলেও চলবে। দেরি না করে গোছগাছ শুরু কর। ” রিফাত একটু কড়া গলায় বলল।

রিফাতের কথা শুনে নিলাশার মন ভিষণ খারাপ হয়ে যায়। ও মনে মনে আগামী সাতদিনের জন্য কতকিছুই ভেবে রেখেছিল। কিন্তু লোকটা মনে হয় সেটা হতে দেবেনা। নিলাশা ভাবছে কি করা যায়। যেকোন উপায়েই ওর গ্রামে থাকতেই হবে।

” আমি না আপনার নতুন একটামাত্রই বউ! নতুন বউয়ের একটা অনুরোধ রাখবেননা? প্লিজ আমি এখানে থাকি? ” করুন গলায় অনুরোধ করল নিলাশা।

” একটু আগের ঝগড়া শুনে তো মনে হলোনা তুমি নতুন বউ। মনে হলো, তুমি বহু বছরের পুরোনো বউ। ” রিফাতও নাছোড়বান্দা। ও কিছুতেই নিলাশাকে এখানে রাখবেনা।

” আমি ঝগড়া করিনি, শুধু প্রতিবাদ করেছি। আর সেটা নিজের জন্যও করিনি। আপনার জন্য করেছি। ” নিলাশার এবার মনে মনে ভিষণ রাগ হচ্ছে। ও চিবিয়ে চিবিয়ে বলল।

” আমি কি একবারও বলেছি, আমার জন্য প্রতিবাদী নারী হয়ে ওঠ? ” রিফাতের গলায় বিস্ময়।

” স্বামীর জন্য এতটুকু করতেই পারি। আপনার বলে দিতে হবে কেন? আমারই চোখের সামনে আমার স্বামীকে অবহেলা করবে, খেতে দিবেনা আমি সেসব মুখ বুঁজে সহ্য করব? প্রতিবাদ করতে গেলে আমার বাবা-মা তুলে অপমান করবে, এটা মেনে নিব আমি! কখনোই নয়। এই বাড়িতে আমার স্বামী আর ননদের সম্মান আর অধিকার প্রতিষ্ঠা আমি করবই। আপনি আমাকে এখানে রেখে গেলেও করব, না রেখে গেলেও করব। ” নিলাশা যেন এ মুহূর্তে অন্য নারীতে পরিনত হয়েছে। ও রিফাতের অধিকার ফিরিয়ে দিতে যেন মুখিয়ে আছে।

রিফাত বিস্মিত নয়নে চেয়ে আছে নিলাশার দিকে। মেয়েটা যে চারদিনেই ওর আর আশফির জন্য এতকিছু ভেবেছে, সেটা ওর বিস্ময় বাড়িয়ে দিয়েছে।

” ভবিষ্যতে যে বাড়িতে আমি আর আশফি এসে দুইদিন বাস করবনা, সেই বাড়িতে আমাদের সম্মান আর অধিকার প্রতিষ্ঠার কোনই দরকার নেই। এমনকি তোমারও বছরে একবারও আসা হবেনা আর দুই-চার বছর পর। তাই এত প্রতিবাদী হয়ে কাজ নেই। তুমি বরং কাপড় গুছিয়ে নাও। ”

” কেন আসবনা এখানে? এটা আপনার বাপ-দাদার ভিটা, আমার শ্বশুর বাড়ি, আমার সন্তানদের বাপ-দাদার বাড়ি, ওদের বংশের সবার বসবাস এখানে। আর ওরা আসবেনা এখানে? ওরা বছরে তিনবার গ্রামে আসবে। ওরা বাগানময় ছুটোছুটি করবে, পুকুরে ঝাঁপাঝাঁপি করবে, বাহিরের উঠানের ধুলোয় গড়াগড়ি খাবে। ওদের দাদুর কাঁধে উঠে হাটে যাবে। আপনি ওদের পুরো এলাকা ঘুরিয়ে দেখাবেন। কত মজা হবে বুঝতে পারছেন? আমরা অবশ্যই এখানে আসব। ” নিলাশা দু কদম এগিয়ে আসল রিফাতের দিকে। রিফাতের চোখে চোখ রেখে বলল।

নিলাশার কথায় রিফাত বুকে হাত দিয়ে চেয়ারে ধপ করে বসে পরল। ও জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিচ্ছে। ওর মাথা বনবন করে ঘুরছে। রিফাতকে হঠাৎই এমন করতে ভয় পেয়ে গেছে নিলাশা। ও মেঝেতে রিফাতের পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসল।

” কি হয়েছে আপনার? এমন করছেন কেন? কোথায় কষ্ট হচ্ছে আপনার, আমাকে বলুন? ” কান্নায় ভেঙে গেল নিলাশার গলা।

কিছু সময় পর রিফাত স্বাভাবিক হয়ে নিলাশার দিকে তাকাল। অনেক কষ্টে কথা বলল সে।

” তুমি মুখ বন্ধ রাখতে পারোনা? যেখানে তুমি মুখ খুললেই ফুটন্ত লাভা বের হয়, সেখানে মুখ বন্ধ রাখাই শ্রেয়। এরপর থেকে কথা বলতে চাইলে আমার কাছ থেকে শুনে তবেই কথা বলবে। ”

” আমি আবার কি করলাম! এভাবে বলছেন কেন? বাচ্চারা যদি শোনে ওদের পাপা ওদের মামনিকে খোঁচা দিয়ে কথা বলে, তবে তারা আপনার সম্পর্কে কেমন ধারনা পোষন করবে সেটা জানেন? ” মুখ কালো করে বলল নিলাশা। ও হতাশ হয়েছে রিফাতের কথা শুনে।

” আবারও সন্তানের কথা বলছে! বিয়ের চারদিনের মাথায় কেমন সন্তানের চিন্তা করছে দেখ! যারা এখনো দুনিয়ার আশেপাশেই নেই, অথচ তাদের নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করছে এই মেয়ে! কি সাংঘাতিক! ” আবারও একহাতে বুক চেপে ধরল রিফাত।

রিফাতের কথা শুনে এতক্ষণে নিলাশার বোধগম্য হল সে কি বলেছে। লজ্জায় দাঁত দিয়ে জিভ কেটে দু’হাতে মুখ ঢাকল। ওর কথা শুনেই রিফাত হাঁসফাঁস করছিল ভেবে গালদুটো লালাভ বর্ন ধারন করল। ওকে লজ্জা থেকে উদ্ধার করতেই দরজার বাহিরে থেকে ডাক দিলেন আফজাল হোসেন।

” বউমা, ভেতরে আছ? ”

শ্বশুরের গলা পেয়ে তড়িঘড়ি করে দরজা খুলে দেয় নিলাশা।

” জ্বি বাবা, কিছু লাগবে আপনার? ”

” তোমাদের সাথে কথা বলতে এসেছি, মা। ”

” ভেতরে আসেন, বাবা। ” নিলাশা দরজা ছেড়ে দাঁড়ায়।

আফজাল হোসেন ভেতরে আসলে রিফাত তাকে একটা চেয়ার এগিয়ে দেয়। আফজাল হোসেন চেয়ারে বসে রিফাতের দিকে তাকালেন। রিফাত অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। আজকাল তিনি বুঝতে পারেন, ছেলেটার সাথে তার দূরত্ব বেড়ে গেছে। রিফাত তাকে খুব একটা ডাকেনা। এমনকি প্রয়োজন ছাড়া কথাও বলেনা। অবশ্য এসব নিয়ে তিনি আফসোসও করেননা। সবটাই হয়েছে তার জন্য। রাবেয়া আক্তার মানে রিফাতের মা’য়ের মৃত্যুর পর রিনা আক্তারকে তিনি এ বাড়িতে এনেছিলেন। এরপর থেকেই ছেলেমেয়েদের দিকে নজর দেননি। আদর করে তাদের কাছে ডাকেননি কখনোই, দু ভাইবোনের মাথায় মমতায় হাত বুলিয়ে দেননি। তিনি যখন পৃথা, পিয়াসকে নিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন, তখন আশফি তার আশেপাশে ঘুরঘুর করেছে একটু আদর পেতে। অথচ তিনি মেয়েটার দিকে তাকিয়েও দেখেননি। রিফাতের যখন পড়াশোনার জন্য বাবা’র সাপোর্টের ভিষণ রকমের প্রয়োজন ছিল, তখন তিনি তার দ্বায়িত্ব পালনে উদাসীনতা দেখিয়েছেন। ফলে ছেলেটা অল্প বয়সেই টাকা রোজগারের পথ খুঁজে নিয়েছিল। জ্বরে কাতর ছেলেকে একলা রেখে তিনি পিয়াসকে বুকে নিয়ে ঘুমিয়েছেন। কতশত অন্যায় করেছেন মা মরা ছেলেমেয়ে দুটোর ওপর। সেসব কথা ভাবলেই তার দম বন্ধ হয়ে আসে, বুকে ব্যথা করে। রাতের পর রাত নির্ঘুম কাটান। অতীত রোমন্থন করতে গিয়ে তার আঁখি ছলছল করছে। তিনি চোখ মুছে তাকালেন রিফাতের দিকে। রিফাত তখনও জানালার বাহিরে তাকিয়ে আছে।

” তুমি নাকি ঢাকা যাচ্ছ, রিফাত? কবে যাচ্ছ? ”

” কাল বিকেলে। ”

” বউমাকে নিয়ে যাবে? ”

” হুম। ”

” না বাবা, আমি যাবনা। উনি আমাকে নিতে চাচ্ছেন কিন্তু আমি যেতে চাচ্ছিনা। আমি সাতটা দিন আপনাদের সাথে থাকতে চাই। ” সুযোগ বুঝে নিলাশা কথাটা বলে ফেলল।

” তুমি আমার সাথেই যাবে। এ নিয়ে কোন কথাই শুনতে চাইনা আমি। ” রিফাত তীক্ষ্ণ গলায় বলল।

” বউমা যখন যেতে চাইছেনা, তখন তুমি তাকে জোর করছে কেন, রিফাত? তুমি ঢাকা যাচ্ছ যাও, কিন্তু বউমা তোমার সাথে যাবেনা। আগামী পরশু বড় পুকুরে জাল ফেলা হবে, বড় পুকুরে অনেক মাছ আছে। বউমাকে আমি টাটকা মাছ খাওয়াব। অবশ্য তুমি থাকলে আরও ভালো হত। কিন্তু সেটাতো বোধহয় হবেনা। আবার তিনদিন পর গ্রামে একটা ষাঁড় জবাই হবে। রতনের বাড়ির ষাঁড়। দেশি ষাঁড়। আমি সেখান থেকে বিশ কেজি মাংস নিব। তাই বউমা না থাকলে হবেনা। ”

” আপনি বুঝতে পারছেননা, ও এখানে থাকলে সমস্যা হবে। আমি চাইনা ওকে অকারনে কথা শুনতে হোক। আর এটা ভালোও দেখায়না। ” রিফাত ধীর গলায় বলল।

” সেটা বউমা আর রিনার ব্যাপার। বউমা নিশ্চয়ই ছোট মানুষ নয়? সে সবই বোঝে। কোথায় কি বলতে হবে, কখন কি করতে হবে সেটা বউমা জানে। আমি আবারও বলছি, বউমা বাড়িতেই থাকবে। ”

” ঠিক বলেছেন, বাবা। আমি খুব ভালো করেই জানি কাকে কখন কি বলতে হয়। পড়াশোনা তো এমনি এমনিই করছিনা। এতটুকু যদি না জানি তবে পড়াশোনা শিখে কি লাভ বলুন? ” নিলাশা রিফাতের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলল। রিফাত ওর দিকে তাকাতেই আফজাল হোসেনের অগচরে ওকে চোখ মারল নিলাশা। রিফাত নিলাশার এমন কাণ্ডে খুকখুক করে কাশতে থাকে।

” বউমা, রাতে হাঁস রান্না হবে বুঝলে? আমি বড় ভাবীর কাজের মেয়েকে হাঁস কেটে রান্না করতে বলেছি। রান্না হলে সবাই একসাথে খাব। ঠিক আছে, মা? ”

” ওক্কে, বাবা। কিন্তু একটা কথা, আগামী কয়েকদিন বাড়িতে যে এত আয়োজন আছে ভাবীকে ডাকলে হতোনা? ভাবী আসলে মজা হতো। ”

” আমি জামাই বাবাকে ফোন দিয়েছিলাম। আগামীকাল আশফিকে নিয়ে আসতে বলেছি। কিন্তু সে নাকি আসতে পারবেনা। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ষাঁড়ের মাংস দশ কেজি, আর বড় পুকুরের মাছ ওদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেব। বাড়িতে মাছ আনলে তুমি বেছে বেছে বড় মাছ আমাকে দেবে, আমি সেগুলো আমার মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে পাঠিয়ে দেব। ”

” ঠিক আছে, বাবা। আমি এসব বিষয়ে এক্সপার্ট। আমি সব থেকে বড় মাছটাই ভাবীর জন্য সিলেক্ট করব। ”

” এই তো আমার মা’য়ের মত কথা বললে। সারাজীবন এমনই থেকো, মা। দোয়া করি সুখী হও। আর রিফাত শোন, রাতে আমরা একসাথে খাব। তুমি আমার জন্য অপেক্ষা কর। ”

” জ্বি, করব। ”

আফজাল হোসেন রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই নিলাশা আনন্দে লাফিয়ে উঠল।

” শ্বশুর বাবা, জিন্দাবাদ। ও জামাই, আপনি ফেইল মেরে গেলেন। আমি থাকছি এখানে। ”

নিলাশার লাফালাফি দেখে রিফাত শুকনো মুখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকল।

***

” আমার বোকা পাখি কি ঘুমিয়েছে? মুখটা শুকনা লাগছে কেন, বোকা পাখি? শরীর খারাপ লাগছে তোমার? ” আশফির মাথায় হাত রেখে ওর কপালে ঠোঁট ছোঁয়াল পুলক। পুলকের স্পর্শ পেয়ে চোখ খুলল আশফি।

” এত দেরি করে বাসায় আসেন কেন? আপনার অপেক্ষা করতে করতে আমি হাঁপিয়ে যাই, সেটা আপনি জানেননা? ” আশফি অভিযোগের সুরে বলল।

” আমার অনেক কাজ থাকে, পাখি৷ সব কাজ শেষ করেই তবে তোমার কাছে আসতে হয়। ” পুলক আশফির পুরো মুখে চুমোয় ভরিয়ে দিচ্ছে।

” এতরাত পর্যন্ত আমি না খেয়ে থাকি সেটাকি আপনি জানেন? মা-ও আপনার জন্য অপেক্ষা করে। পুষ্পিতা আজকে না খেয়েই ঘুমিয়েছে। ”

” আর এমন হবেনা। দশটার মধ্যেই বাসায় ফিরব কথা দিচ্ছি। এক কাজ কর, সার্ভেন্টকে রুমে খাবার দিতে বল। আম্মুকেও এখানেই ডাক, একসাথে খাই। ”

” মা’কে আমি জোর করে খাইয়ে দিয়েছি। আমি বরং পুষ্পিতাকে ডেকে আনি। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন। ”

পুলক ওয়াশরুমে ঢুকলে আশফি নিচে গিয়ে সার্ভেন্টকে ওদের রুমে খাবার দিতে বলল। এরপর ও পুষ্পিতাকে ডাকতে গেল। কিন্তু পুষ্পিতা ঘুমিয়ে গেছে। তারপরও আশফি ওকে ডাকল। কি ও জানাল, খাবেনা।

আশফি কিছুই খেতে পারলনা। পুলক জোর করে ওকে দুই লোকমা খাইয়ে দিল। ও প্রতিটা খাবার দেখেই নাক সিটকাল। আশফি খেতে পারলনা, তাই পুলকেরও খাওয়া হলোনা। ও সার্ভেন্টকে ডেকে সবকিছু নিয়ে যেতে বলল।

” বউ, তোমার শরীর কি খুবই খারাপ লাগছে? আমি কি ডক্টরকে ফোন করব? ” পুলক উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করল।

” খুবই খারাপ কিনা জানিনা, তবে খারাপ লাগছে। এত রাতে ডক্টরকে ফোন করতে হবেনা। ”

” কবে থেকে? আমাকে জানাওনি কেন? ” পুলকের গলায় শঙ্কা চাপা থাকলনা।

” বেশ কয়েকদিন থেকেই খুব ক্লান্ত লাগে, কিছুই খেতে ইচ্ছে করেনা। শুধু শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। উঠতে গেলেই মাথা ঘুরায়। ”

” আমি কাল সকালেই ডক্টরকে আসতে বলব। ডক্টর তোমাকে চেক-আপ করলেই তবে আমি বাহিরে যাব। আর একটা রাত কষ্ট কর, জান পাখি। কাল থেকে তোমাকে আর কষ্ট পেতে দেবনা। ” পুলক জড়িয়ে ধরল ওর বোকা পাখিকে। আশফি কোন প্রতিবাদ করলনা। চুপটি মেরে শুয়ে থাকল পুলকের বুকে।

***

শাহেদের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে তিয়াসা। মনযোগ দিয়ে শাহেদের হৃৎস্পন্দনের আওয়াজ শুনছে। শাহেদের হৃৎস্পন্দনের দ্রিম দ্রিম শব্দ শুনতে বেশ লাগছে।

” আমার বউ এত চুপচাপ কেন? ”

” শুনছি। ”

” কি! ”

” হৃৎস্পন্দনের আওয়াজ। ”

” শুধুই আওয়াজ শুনছ! আর কিছু শুনতে পাচ্ছনা? ”

” কি শুনব! ”

” এই যে, আমার হৃদস্পন্দনেরা প্রতিটি বিটেই তোমার নাম নিচ্ছে। তারা বলছে, শাহেদের প্রতিটি হৃদস্পন্দন , প্রতিটি নিঃশ্বাসেই উচ্চারিত হয় তিয়াসার নাম। এমনকি আমার রক্তকণিকায় খুঁজলেও তোমার নাম পাওয়া যাবে। ” ঘোর লাগা গলায় বলল শাহেদ।

” কিছু কিছু জিনিস দেখতে হয়না, শুনতেও হয়না। সেগুলো একটু গোপনে থাকলেই সম্পর্কের গভীরতা বাড়ে। তেমনই আপনার সীমাহীন ভালোবাসাও একটু গোপনেই থাকুক। আমি শুধু সেই ভালোবাসা অনুভব করব। ” তিয়াসা শাহেদের লোমশ বুকে চুমু দিয়ে বলল।

” আমার বউ দেখছি বেশ কথা জানে ! অথচ আমি তাকে একটু চুপচাপ বলেই জানতাম। চুপচাপ অথচ বুদ্ধিমতি। কিন্তু আমার ধারনা ভুল। আমার বউও কথা বলে। ” শাহেদ শক্ত করে ধরে রেখেছে তিয়াসাকে।

” বাসায় আমি প্রচুর বকবক করতাম। তবে বাহিরে গেলেই একদম চুপচাপ থাকতাম। আসলে আমার সাথে একটা বোকা মেয়ে থাকত, তাকে সামলাতেই ব্যস্ত থাকতে হত। তাই কথা বলার সময় হতোনা। ”

তিয়াসার কথায় হাসল শাহেদ। তিয়াসা মুগ্ধ হয়ে দেখছে মানুষটার হাসি। হাসলে তাকে বেশ লাগে। পুরুষের হাসি এত সুন্দর হয়, সেটা শাহেদকে দেখেই বুঝেছে তিয়াসা। রিফাতকে ও কমই হাসতে দেখেছে। সে সব সময়ই ব্যস্ত থাকত জীবনের সাথে যুদ্ধ করতে। তাই হাসার সময় পায়নি সে। কিন্তু সে যে কয়বারই হেসেছে, তিয়াসা তাকিয়ে থেকেছে তার দিকে। দু-চোখ ভরে উপভোগ করেছে সেই হাসি। শান্তিও পেয়েছে তাকে হাসতে দেখে। কিন্তু এই মানুষটার হাসি ওকে মুগ্ধ করে। তার হাসির শব্দে বুকের ভেতর উথালপাথাল করে। এই হাসিতে সে সুখ খুঁজে পায়, খুঁজে পায় নিজেকে। মানুষটার জীবনের সব হাসিই তাকে ঘিরে, এটা বোঝে তিয়াসা। দুটো মানুষ। তাদের ভিন্ন ধরনের হাসি, হাসির কারনও ভিন্ন। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে এই মানুষদুটো ওকে নিয়েই স্বপ্ন দেখেছে, ওর জন্য হেসেছে, এটা ভেবে আনমনা হয়ে যায় তিয়াসা। নিয়তির খেলায় একজন ওকে পেয়েছে, আরেকজন ভাঙাচোরা বুক নিয়ে অন্যের সাথে ঘর বেঁধেছে। তিয়াসা চায় সেই মানুষটাও সুখী হোক। তার জীবনের সকল অপ্রাপ্তি ঘুচে গিয়ে, জীবনের খাতা পূর্ণ হোক প্রাপ্তিতে।

চলবে…