#রাজনীতির_রংমহল
#সিমরান_মিমি
#পর্বসংখ্যা_৩২
★★★
গলগল করে কপাল চুইয়ে চুইয়ে সারা চুল রক্তে মেখে গেছে আর্শির।রাহুল সাময়িকভাবে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল।হুশ আসতেই দ্রুত কোলে নিয়ে নিচে নামলো।
ওমা,আর্শির কপাল ফেটে গেছে।আমি হস্পিটালে যাচ্ছি।
শুনতেই হতভম্ব হয়ে গেলেন বিপাশা ।দ্রুত মাথায় শাড়ির আচল দিয়ে নিজেও ছুটলেন রাহুলের পিছু।
বিকাল সাড়ে তিনটা।চারদিকের দোকান-পাট প্রায়ই বন্ধ।দুপুরের খাবার খেয়ে সবাই নিজ নিজ আবাসস্থলে বিশ্রাম নিচ্ছে।হস্পিটাল অনেকটা দূরে।পাশেই একটা ফার্মেসী খোলা।দ্রুত আর্শিকে নিয়ে সেখানে ঢুকলো রাহুল।মুখ থুবড়ে পড়ার কারনে কপালের এক পাশ ফেটে গেছে।ব্রুর উপর টাও থেতলে গেছে অনেকটা।
বিকাল চারটা।খাটের উপর শুয়ে আছে আর্শি।কতক্ষণ পর পর হুহু করে কেদে উঠছে।ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কাদতে।হাত-পা ছড়িয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে।তার পাভেল ভাই আর নেই।এটা কি করে বিশ্বাস করবে সে?মাথা যন্ত্রনায় ছিড়ে যাচ্ছে।কান্নাগুলো উগড়ে এসে গলা পর্যন্ত দলা পাকিয়ে আছে।কন্ঠনালি ভেদ করে বের হতে পারছে না।
দুচোখ দিয়ে গরম জল টুকু বের করে করুন কন্ঠে বললো-
আমি যাব।পাভেল ভাইয়ের কাছে যাব।আমি ওনাকে দেখবো।
পাশেই বসা ছিলো রাহুল।পাভেলের নাম শুনতেই চকিতে আর্শির দিকে তাকালো।দ্রুতপায়ে আর্শির পাশে বসে আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।শান্ত কন্ঠে বললো-
আর্শি,পাভেলের দাফন হয়ে গেছে।কিভাবে দেখবে তুমি?
হুহু করে কেদে দিল আর্শি।মুহুর্তে ই কপালের দু পাশের শিরা টা ব্যাথায় টনটন করে উঠলো।রাহুলের হাত ধরে মিনতি করে বললো-
আমি ওনার কবর দেখবো। আমাকে নিয়ে যাবেন রাহুল ভাইয়া।একটু নিয়ে চলুন।ও বাড়ির কাউকে বলবেন না প্লিজ।
কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো রাহুল।তারপর কিছু না বলেই বের হয়ে গেল রুম থেকে।মায়ের রুমে যেতেই দেখলো ব্যাগ গোজগাজ করছে।জিজ্ঞেস করতেই বললো-
স্পর্শীটা আমার ওখানে একা আছে।এতকিছু কিভাবে সামলাবে ও।তাছাড়া,এই পরিস্থিতিতে ওর বাপের বাড়ি থেকে তো কারো একটু যাওয়া উচিত।আমি তো ওর মা ই।আমি ছাড়া আর কে যাবে।
রাহুল চিন্তিত ভঙ্গিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো-
কিন্তু যেতে যেতে তো রাত হয়ে যাবে।আমি ও যাই তোমার সাথে।
বিপাশা ঘনঘন মাথা নাড়িয়ে বললো-
হ্যা হ্যা,তোর তো যাওয়াই উচিত।মেয়েটার সাথে কত মনমালিন্য তা।তুই বিয়ে করেছিস শুনে অনেক খুশি হয়েছে।বলেছিলো জাফলং থেকে আসার পরেই এখানে আসবে।কিন্তু তা তো আর হলো না।এখান থেকে প্রথমে ভাইজান দের বাড়িতে যাবো।তারপর রাত টা থেকে সকালে স্পর্শীদের বাড়িতে যাব।তুই গেলে অনেক খুশি হবে সে।
মাথা নাড়িয়ে ধীর ভঙ্গিতে রুমের সামনে এলো রাহুল।মুহুর্তেই শিরদারা বেয়ে ঠান্ডা হিমশীতল ধারা বয়ে গেল।সামনেই ফ্যানের সাথে আর্শি ঝুলছে।চলন্ত ফ্যানের সাথে ঘুর্ণায়মান ওড়না’টা ধীরে ধীরে পেচিয়ে ছোট হয়ে যাচ্ছে।ছুটে গিয়ে ফ্যান অফ করলো রাহুল।মুহুর্তে’ই ঘোরা বন্ধ হয়ে পেচানো ওড়না’টা খুলতে খুলতে ঠা’স করে বিছানা’র উপর পড়ে গেল আর্শি।সামনে’ই অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাহুল।সারা শরীর’টা রাগে গিজগিজ করছে।দাতে দাত চেপে রাহুল বললো-
প্রেমিকের জন্য স্বামী’র রুমে বসেই গলায় দড়ি দিচ্ছিলে।আমাকে ফাসানো’র খুব শখ না।
এতো ভালোবাসা যখন,তখন বিয়েতে বসেছিলে কেন?আমি ছিলাম না,কিন্তু আরাফ তো ছিলো।তার সাথে বিয়ে করার জন্য লাফাতে লাফাতে পিড়িতে বসেছিলে কেন?প্রেমিকের সাথে পালিয়ে যেতে পারো নি?
পালাতে পারো নি ভালো কথা,এত যখন দরদ বিয়ের আগে গলায় দড়ি দিয়ে মরে যেতে।এখন আমাকে ফাসাচ্ছো কেন?
ঢুকরে কেদে উঠলো আর্শি।অস্ফুট স্বরে বললো-
আমাকে একটু নিয়ে চলুন না পিরোজপুরে।দেখেই চলে আসবো।আপনার পায়ে পড়ি ভাইয়া।
নাক ছেটালো রাহুল।এই যে আর্শি সেই থেকে পাভেলে’র জন্য কাদছে সেটা মোটেও সহ্য হচ্ছে না।একটা অজানা হিংসা মনের মধ্যে বাসা বাধছে।নেহাত লোকটা মৃত বলে সহ্য করে যাচ্ছে।অন্য দিকে তাকিয়ে ত্যাড়া কন্ঠে বললো-
তো তুমি কি ভেবেছো?তোমাকে এখানে একা রেখে চলে যাব।আর তুমি গলায় দড়ি দিয়ে সোজা হয়ে থাকবে,পুলিশ আসবে, আমাকে ফাসাবে?
থেমে,
এক্ষুনি ব্যাগ গোছাও।বিকেল পাচ টার বাসে যাচ্ছি আমরা পিরোজপুর।তবে হ্যা,পিরোজপুর থেকে এসে একদম পড়ায় মন দিবে।সামনেই তোমার এক্সাম।মনে থাকে যেন।
★★★
রুমের ভেতর দিয়ে দরজা আটকে ভেতরে শুয়ে আছে শামসুল সরদার। চোখ তার হিংস্র বাঘের ন্যায় লাল হয়ে আছে।সারাজীবনের আদর্শ/শিক্ষা/অহংকার সবকিছুকে ধুলোয় মিশিয়ে ছেলে তার এমন জঘন্য হয়ে যাবে তা ভাবনার অতীত ছিলো।কই তার চরিত্র নিয়ে তো কখনো কেউ টু শব্দটাও করতে পারেনি।যতটা সময় রাজনীতি’তে ছিলো লোকজন তাকে মাথায় তুলে রাখতো।তার আদর্শকে সম্মান করে তাকে দাপটের সাথে রাজনীতিতে একজন সৎ ব্যাক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করতো।অথচ তার নিজের ছেলে এমন…..কিভাবে?চোখের কোন গড়িয়ে অশ্রুকণা পড়ার সাথে সাথে সে তা মুছে ফেললো।
তার’ই ভুল।রাজনীতির জন্য ছেলেকে সময় দিতে পারেনি।কারো দিকে নজর দিতে পারেনি।যার ফলস্বরূপ আজ রাস্তায় নামতেও ঘেন্না হচ্ছে। লজ্জায়,ঘেন্নায়,অপমানে অতি আদরের ছেলের লাশটা আনতেও যেতে কুন্ঠা বোধ করছে।
আবার ও দরজার ওপাশ থেকে মেঝো ভাইয়ের তেজী কন্ঠের আওয়াজ পাওয়া গেল।
ভাইজান, আপনি যাবেন কি না?আমি অলরেডি ওই জানোয়ার টার বিরুদ্ধে থানায় মামলা করে দিয়েছি।এতো বড় সাহস ওর।সরদার বাড়ির ছেলের গায়ে আঘাত দেয়।ওকে সারাজীবন জেলের ঘানি টানাবো।
আমার ছেলেটা তো তাও বেচে আছে।আপনি নিজেকে কি করে সামলাচ্ছেন ভাইজান।
আবার ও ছোট ভাইয়ের নরম কন্ঠের আওয়াজ এলো ওপাশ থেকে।
-ভাইজান,লাশ তো আনতে হবে।দাফনের ব্যাবস্থা কি করবো।
এরইমধ্যে ভেতর থেকে হুঙ্কার এলো।
-যা ইচ্ছে তাই করো।আমার কোনো সন্তান নেই।লাশ পচে গলে যাক।কাক/শেয়ালে ঠুকরে ঠুকরে খাক ওর মাংস।আমার সম্মানের কথা যে ভাবে নি তার……
আর বলতে পারলেন না শামসুল।কান্নায় ভেঙে পড়লেন।নুয়ে যাওয়া কন্ঠে বারবার বলতে লাগলেন-
আমার কোনো সন্তান নেই।আমার কোনো সন্তান নেই।
.
.
.
.
★★★★
বিকেল পাচ টা।চারদিকে নানা মানুষের আনাগোনা।বিতৃষ্ণায় ছেয়ে গেছে স্পর্শীর মুখ।এম্বুলেন্সের সিটে প্রেমাকে শুইয়ে তার হাত ধরে পাশেই বসে আছে স্পর্শী।সামনেই ড্রাইভারের পেছনে আলতাফ শিকদার বসে আছেন।একটু আগেই হস্পিটালের সব ফরমালিটি পূরণ করে প্রেমাকে নিয়ে বরিশালের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে স্পর্শী।শশুর-শাশুড়ীকে বাড়িতে চাচী শাশুড়ী এবং অন্যান্য আত্নীয় দের হেফাজতে রেখে নিজে প্রেমাকে নিয়ে রওনা হয়েছে সে।যদিও মহীউদ্দীন শিকদার আসতে চেয়েছিলেন কিন্তু আলতাফের রিকোয়েস্টে আসেন নি।
ভাবতে ভাবতেই এম্বুলেন্স চলতে শুরু করলো।পিরোজপুর ছাড়িয়ে যেতেই স্পর্শীর দু-গাল বেয়ে চলতে লাগলো অশ্রুর ধারা।নেতামশাই তো এখানেই থানায় রয়েছে।খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছে তার।ওই পুরুষালি প্রশস্ত শক্ত বুকটার উপর বারকয়েক চুমু দিয়ে সেই জায়গায় মাথা রেখে শান্তির ঘুম ঘুমাতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু পরিস্থিতি যে তাকে এতটা সুখ দেবে না।বাস্তবতা যে বড় কঠিন।বাস্তবতা যে তাকে কখনো এতটা সুখী করেনি।ধীরে ধীরে বোবাকান্নায় মেতে উঠলো স্পর্শী।তার কান্না/দুর্বলতা যে কাউকে দেখাতে চায় না সে।
রাত আটটার মধ্যেই তারা বরিশাল পৌছালো।কিছুক্ষণ আগেই ডক্টর প্রেমাকে দেখে গেছে।তাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল।পরশের ফোন’টা তার কাছেই রয়েছে।কাপা কাপা হাতে কল লিস্টে ঢুকে সুমনের নাম্বার বের করে ফোন দিল।দুবার রিং পড়তেই ওপাশ থেকে রিসিভড হলো।
রাত সাড়ে দশটা।ওপাশ থেকে কিছু বলার আগে কন্ঠে কাঠিন্যতা এনে স্পর্শী বললো-
সুমন ভাইয়া,আমি স্পর্শী শিকদার বলছি।আপনাদের এমপি সাহেবের স্ত্রী।
ওপাশ থেকে তড়িঘড়ি কন্ঠে সুমন বললো-
হ্যা ভাবি।আমি আপনাকে চিনতে পেরেছি।ভাইয়ের ফোনটা আপনার কাছে ছিলো।আমি আরো অনেক খুজেছি।
স্পর্শী চোখ বন্ধ করে নিজেকে ধাতস্থ করলো।তারপর ত্রস্ত কন্ঠে বললো-
ভাইয়া আপনার ভাই কি এখনো থানায় আছে?নাকি ওনাকে চালান করে দিয়েছে?
-না ভাবি।এখনো চালান করা হয়নি।থানায়’ই আছে।মনে হয় কাল -পরশুর মধ্যে চালান করে দিবে।আপনি চিন্তা করবেন না ভাবি।আমরা ভালো একজন উকিল অলরেডি হায়ার করে ছি।আমরা দলের লোকেরা সব সময় ভাইয়ের পাশে আছি।আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।ভাইয়ের কিচ্ছু হবে না।আদলতে কেস টা উঠুক।মুক্তি পেয়ে যাবে ভাই।
চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস নিলো স্পর্শী।আলতো হেসে বললো-
ভাইয়া, আমি কিন্তু”ল” নিয়েই পড়ছি।পাবলিক প্লেসে শত শত মানুষের মধ্যে দাঁড়িয়ে খুন করেছে আপনার ভাই।অফিসের ভেতর দু-দুটো সিসি ক্যামেরা ছিলো।আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।তার থেকে আপনি বরং যখন যা হয় সেটা যত খারাপ খবর’ই হোক না কেন।আমাকে প্লিজ ইনফরম করবেন।রাখছি।
ফোন কেটে দিল স্পর্শী।মুহুর্তে ‘ই বুক ভরে শ্বাস নিলো সুমন।এ যেন পরশ শিকদারের থেকেও ভয়ংকর।ভীষন ঘাবড়ে গিয়ে কথাগুলো পেচিয়ে ফেলছিলো সুমন।
রাত বারো টা।আশেপাশে ভয়াবহ অন্ধকার।রাস্তার মধ্যে বেশ দূরত্ব রাখার পর একটা করে ল্যাম্পটা রাখা।সেই অন্ধকার চিরেই বেরিয়ে এলো বিপাশা আর রাহুল।আর্শি রাহুলের কোলেই রয়েছে।একে তো আগে থেকে মাথা ফেটেছে তার উপর সারা রাস্তায় বমি করতে করতে কাহিল হয়ে পড়েছে সে।শেষে বাধ্য হয়েই মায়ের সামনে কোলে নিয়েছে।সরদার বাড়ির সামনে এসে গেটে টোকা দিতেই ভেতর থেকে দরজা খুলে দেয় দারোয়ান।বাস থেকে নেমেই সোনালী কে ফোন দিয়েছিলো বিপাশা।দ্রুতপায়ে ভেতরে ঢুকতেই মেয়ের /মাথায় ব্যান্ডেজ দেখে আতকে উঠলেন সোনালী।আর্শির রুম দেখাতেই দ্রুতপায়ে সেদিকে চললো রাহুল।আর্শি বমি করে পুরো পোশাক নষ্ট করে ফেলেছে।
গা ঘিনঘিন করছে রাহুলের।বাথ্রুমে ঢুকে গোসল করে বের হতেই কপালে চিন্তার ভাজ পড়লো।আর্শির ও পুরো পোশাক বমিতে মাখামাখি হয়ে গেছে।এতো রাতে কাকে ডাকবে সে।এরই মধ্যে দরজায় টোকা পড়তেই সেদিকে তাকালো রাহুল।সোনালী হালকা নাস্তা নিয়্র এসেছেন।সামান্য হেসে ভেতরে আসতে বলল রাহুল।কিছুক্ষন ঠোট কামড়ে ইনিয়ে বিনিয়ে বললো-
আন্টি,ওর পোশাক টা একটু চেঞ্জ করে দিবেন প্লিজ।না মানে,বমি করে নষ্ট করে ফেলেছে একদম।
পরক্ষণেই লজ্জা লাগলো ভীষণ। তার স্ত্রীর পোশাক অন্যকাউকে চেঞ্জ করতে বলাতে কেমন অসস্তি বোধ হচ্ছে।দ্রুতকন্ঠে বললো-
না থাক।আপনার কষ্ট করতে হবে না। আমিই চেঞ্জ করে দিচ্ছি।
“সে চেঞ্জ করে দিবে একটা মেয়েমানুষের পোশাক।ভাবতেই কি বা’জে একটা ইঙ্গিত করা হয়।পুনরায় অসস্তিতে ভেসে গেল রাহুল।করুন চোখে আর্শির দিকে তাকিয়ে রইলো।
চলবে?