#রাজনীতির_রংমহল
#সিমরান_মিমি
#পর্বসংখ্যা_৩৫
বিকেল তিনটা।চারদিকে এখনো ভ্যাবসা গরম।সূর্য নিজের তেজ কে খানিকটা কমিয়ে দিক পরিবর্তন করে পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে।ক্লান্ত পায়ে স্পর্শী এগিয়ে গেল পরিচিত কেবিনের দিকে।পিয়াশা বেগম প্রেমার সাথে কথা বলছেন।স্পর্শী ধীর পায়ে তাদের দিকে এগিয়ে গেলেন।টুলের উপর ধপ করে বসে পড়তেই পিয়াশা বেগম চাইলেন।উত্তেজিত কন্ঠে জানতে চাইলেন পরশের কথা।মাথা তুললো স্পর্শী।অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ।তারপর ধীর কন্ঠে বললো-
ওনার বাইশ বছর সাজা হয়েছে মা।
আঁতকে উঠলেন পিয়াশা।হাউমাউ করে কেদে দিলেন।প্রেমা ও কেদে মাকে জড়িয়ে ধরলো।স্পর্শী উঠে প্রেমার পাশে গেল।মাথায় হাত দিতেই চোখ তুলে চাইলো। স্পর্শী কাদতে বারন করলো।তারপর শাশুড়ীর দিকে তাকিয়ে বললো-
মা,আব্বু আর চাচ্চু ও এসেছে। ওরা বাইরে আছে।আমি একটু ঢাকায় যাচ্ছি। ক-দিনের মধ্যে ফিরে আসবো।আপনি এভাবে কাদবেন না। তাহলে প্রেমাকে কে সামলাবে?
অশ্রুসিক্ত চোখ নিয়ে অবাক চোখে স্পর্শীর দিকে তাকালো পিয়াশা।অবাকের সুরেই বললো-
তুমি ঢাকায় কেন যাবে?
জিহবা দিয়ে গলা ভেজালো স্পর্শী।ভীষণ খিদে পেয়েছে তার।হস্পিটালে বসে কোনো কালেই সে খেতে পারে না। বমি পায়।শান্ত কন্ঠে বললো-
আমার একটু ভার্সিটিতে যেতে হবে মা।এক্সামের নোটিশ দিয়ে দিয়েছে।
তাচ্ছিল্য করে হাসলেন পিয়াশা।কড়া গলায় বললেন-
আমার পরিবারের এই অবস্থা। ছেলেটা জেলে।এরমধ্যেও তোমার লেখাপড়ার কথা ভাবছো।ভালো,যাও তুমি।তোমাকে কে আটকাবে?
স্পর্শী অবাক হয়ে শাশুড়ীর দিকে চাইলো।এই যে প্রতিদিন পিরোজ পুর থেকে বরিশাল, আবার বরিশাল থেকে পিরোজপুরে দৌড়ের উপর থেকেছে।যেখানে সেখানে পাগলিনীর মতো ছুটে বেরিয়েছে সেটা কারো চোখে পড়লো না।অথচ লেখাপড়াটাই পড়লো। না খেয়ে,না নেয়ে দিনের পর দিন ছুটছে। চোখ গুলো টলমল করে উঠলো স্পর্শীর।ত্রস্ত কন্ঠে আলতো চিৎকার করে বললো-
মায়ায়া,আপনি ভুল ভাবছেন।যদিও ভার্সিটিতেও যাচ্ছি আমি।কিন্তু তার থেকে ও আপনার ছেলের জন্য ঢাকায় যেতে হচ্ছে আমায়।হাই কোর্টে আপিল করতে হবে।বাইশ টা বছর কম নয়।উনি এতোটা বছর কি করে জেলে থাকবে।আমি আবার ওনার কেসটা আদালতে উঠাবো।আর সে জন্যই একজন উকিলের প্রয়োজন।ঢাকায় আমার পরিচিত একজন ভালো উকিল রয়েছে।ওনার কাছেই যাচ্ছি আমি।
কিছুটা শান্ত হলেন পিয়াশা।অভিমানী কন্ঠে বললেন-
এই যে সুমন রা যে উকিল কে হায়ার করেছে সেও তো অনেক নামকরা উকিল।আবার কার কাছে যাবা তুমি?
ঠোট দুটো গোল করে গরম নিঃশ্বাস ফেললো স্পর্শী।তারপর শান্ত কন্ঠে বললো-
উচ্চ আদালতে যে কেউ কেস লড়তে পারে না মা।বাংলাদেশ বার কাউন্সিল কর্তৃক যেসব আইনজীবী উচ্চ আদালতে মামলা পরিচালনার জন্য তালিকাভুক্ত হয়েছেন, শুধু তাঁরাই উচ্চ আদালতে মামলা পরিচালনা করতে পারেন।এছাড়া অন্য কোনো আইনজীবী মামলা লড়তে পারবেন না।
অভিমানী কন্ঠে পিয়াশা ইনিয়েবিনিয়ে বললেন-
তো আমি অতোসব বুঝি নাকি।তুমি তো উকিলি পড়ো বলে জানো।আচ্ছা,তুমিও তো ওর কেসটা লড়তে পারতা।
আলতো হাসলো স্পর্শী।তারপর বললো-
মা আমার কোর্স এখনো কম্পিলিট হয়নি।সবে তো তৃতীয় বর্ষে পড়ছি আমি।
স্পর্শী আর কিছু না বলেই সুটকেস হাতে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলেন।এরই মধ্যে মহীউদ্দীন শিকদার তার সামনে এলেন।পাচ হাজার টাকা বের করে স্পর্শীর হাতে দিয়ে বললেন-
এটা লাগতে পারে।রেখে দাও।
কিছুটা অসস্তিতে পড়লো স্পর্শী।এই মুহুর্তে টাকা টা খুব দরকার।বাবা তো আর টাকা দিবে না।একমুহূর্তে তার হাতে ভাড়া টাকা ছাড়া তেমন টাকা ও নেই।মহীউদ্দীন শিকদার গাড়ি দিতে চাইলে স্পর্শী আপত্তি করলো না।বাসে চড়লে রীতিমতো বমি করে অজ্ঞান হয়ে যায় সে।পরবর্তী দু-তিন দিনে আর সুস্থ থাকে না।এই মুহুর্তে অসুস্থ হওয়াটা মোটেও কাম্য নয় তার।
.
.
★★★★
হোস্টেলে পৌছাতেই ড্রাইভারকে পিরোজপুরের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দিল স্পর্শী।এখানে বেশ কিছুদিন থাকতে হবে তাকে।ত্রস্ত পায়ে হোস্টেলে ঢুকতেই অনন্দা হামলে পড়লো ওর উপর।তাকে বুঝিয়ে সোজা বাথরুমে চলে গেল স্পর্শী।টানা এক ঘন্টা ধরে গোসল করে রুমে ফিরলো।আসার সময় দোকান থেকে খাবার নিয়ে এসেছে।রাত নটায় হোস্টেলে খাবার পাওয়া যাবে।এখন বাজে আটটা।খাবার খেয়ে সোজা হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।এইমুহুর্তে একটা লম্বা ঘুমের প্রয়োজন।কিন্তু ঘুম এলো না।বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠলো পুরনো স্মৃতি গুলো। দমবন্ধ হয়ে পড়ে রইলো বিছানায়।দুচোখ ভেসে যাচ্ছে স্মৃতির টানে।
সকাল হতেই বই নিয়ে পড়তে বসলো স্পর্শী।পুরনো পড়াগুলো মাথায় পুনরায় সেট করে নিলো।সাড়ে টটা বাজতেই নাস্তা খেয়ে রেডি হয়ে সাড়ে নটার দিকে চলে গেল ভার্সিটিতে।
বিকেল চারটা।আটতলা ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে স্পর্শী।থার্ড ফ্লোরেই রয়েছে কাঙ্ক্ষিত লোকটির অফিস।আদোও সে স্পর্শীকে চিনবে তো।নাকি অচেনা ভেবে তাদের মতোই আচরণ করবে।এরকমই আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে লিফটে উঠে পড়লো স্পর্শী। থার্ড ফ্লোরে নেমে কাঙ্ক্ষিত রুমটির দরজায় টোকা দিতেই ভেতর থেকে সহায়ক ছেলেটি দরজা খুলে দিলো। ধীর পায়ে ভেতরে ঢুকে শান্ত কন্ঠে সালাম দিলো স্পর্শী।সাথে সাথেই অবাক হয়ে তাকালেন প্রসেনজিৎ মণ্ডল। ঠোট এলিয়ে হেসে বললেন-
আরে আমার রাগীনি যে।এমা আজ এতো শান্ত কেন?তোমাকে তো এমন মানায় না।
সামান্য অসস্তি তে পড়লো স্পর্শী।লোকটা তাহলে তাকে চিনতে পেরেছে।নবীনগরের রাস্তায় বশেই একবার কোমর বেধে ঝগড়া করে ছিলো স্পর্শী।লোকটাও কম না।তিনি যে একজন উকিল সেটা ঝগড়া করেই বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন।তখন থেকেই খুটিনাটি পরিচয় ছিলো।স্পর্শী আলতো হাসলো।ইতস্তত ভাবে বললো-
আংকেল, একটা দরকারে এসেছিলাম।আপনার সাহায্য প্রয়োজন।
স্পর্শীকে এমন নরম, ভেঙে পড়া কন্ঠে কথা বলতে দেখে সিরিয়াস হলেন প্রসেনজিৎ মণ্ডল। শান্ত কন্ঠে বললেন-
কি হয়েছে মা?
ঠোট ভেঙে আসলো স্পর্শীর।উফফ এ কেমন যন্ত্রনা।কেউ একটু ভালোবেসে কথা বললেই আজকাল কেদে ফেলে স্পর্শী।বিয়ের পর বেশ ছিচকাদুনে হয়ে গেছে সে।নিজেকে সংযত করে বললো-
আংকেল,আমার হাসবেন্ড পিরোজপুরের এমপি।রিসেন্টলি রাজনৈতিক শত্রুতা আর পারিবারিক ক্রোধের বশবর্তী হয়ে তার বিপক্ষ দল ওনার ভাইকে খুন আর বোনকে ধর্ষন করছিলো।উনি সহ্য করতে পারে নি।তাদেরকে কুপিয়ে খুন করেছে।তিনটা মার্ডার আর দুটো হস্পিটালে এডমিট আছে।
–আরে এটাতো আমি জানি।এই তো সেদিনকে পত্রিকায় পড়লাম।পরশ শিকদার তোমার হাসবেন্ড।
–জ্বী আংকেল।জেলা জজ কোর্টে ওনাকে বাইশ বছরের সাজা দিয়েছে।আমি এখন হাইকোর্টে আপিল করতে চাইছি।আপনি প্লিজ আমাকে সাহায্য করুন।প্লিজ আংকেল।
শান্ত ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ ভাবলেন প্রসেনজিৎ মণ্ডল। তারপর বললেন-
দেখো,হয়তো প্রতিশোধের বশবর্তী হয়ে তোমার হাসবেন্ড খুন করেছে।ওনার ফ্যামিলির সাথে যা হয়েছে সেটা অনেক খারাপ হয়েছে।কিন্তু অপরাধ তো অপরাধই।সাজা তো পেতেই হবে।শুনেছি সেখানে হাজার হাজার লোক উপস্থিত ছিলো। ভিডিও ফুটেজ ও আছে।অপরাধ তো প্রমাণিত হয়ে গেছে।এখানে আমার কি করার?
আশাহত হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লো স্পর্শী।মাত্র পাচটা দিন সংসার করতে পেরেছে লোকটার সাথে। এরইমধ্যে সেই সং সার টা ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো।
স্পর্শীর কান্না দেখে প্রসেনজিৎ মণ্ডল অস্থির হয়ে পড়লেন।উত্তেজিত কন্ঠে বললেন-
তুমি কান্নাকাটি করো না মা।আমি দেখছি কি করা যায়।মুক্তি না দিতে পারি কিছুটা সাজা অবশ্যই কমাতে পারবো।তার আগে আমি উচ্চ আদালতে আবেদন করার ব্যাবস্থা টা করি। এই দু-দিন সময় দাও আমাকে।
কিছুটা আশার আলো পেলো স্পর্শী।সেখান থেকে বিদায় নিয়ে ভার্সিটিতে চলে গেলো।বাড়িতে ফোন দিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলে পড়ায় মনোযোগ দিলো।
প্রায় দু-দিন পরে আবারো সেই অফিসে উপস্থিত হলো স্পর্শী।প্রসেনজিৎ মন্ডল একটা ফর্ম স্পর্শীর হাতে দিয়ে বললো-
এখানে আসামীর সিগনেচার লাগবে।উনি যে বিগত বিচারে সন্তুষ্ট নয় এবং ন্যায় বিচার চেয়ে হাইকোর্টে আপিল করছে সে জন্যই এই সিগনেচার টা লাগবে।যত দ্রুত পারো সইটার ব্যাবস্থা করো।এটা যত তাড়াতাড়ি জমা দিব তত তাড়াতাড়িই কোর্টে শুনানি পড়বে।
স্পর্শী সেখান থেকে সোজা ভার্সিটিতে এলো।হলসুপার কে বলে আবারো পিরোজপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।
★
★
★
পিরোজপুর কেন্দ্রীয় কারাগার:
বিরক্ত হয়ে পড়েছে জেলার হামিদুর রহমান।স্থানীয় পুলিশ বারবার ব্যার্থ হচ্ছে বর্তমান সমস্যাকে সমাধান করতে।বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা সহ দলের সবাই এবং সাধারণ জনগণ প্রতিনিয়ত মিছিল,মিটিং,ধর্মঘট, মানববন্ধন করেই যাচ্ছে।তাদের নেতার এমন করুন সাজা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না।দিন দিন সাধারণ জনগণ ক্রুদ্ধ হয়ে পড়ছে আইনের প্রতি।স্থানীয় পুলিশদের সাথে নানা সংঘর্ষে মেতে উঠেছে তারা।
স্পর্শী কারাগারের সামনে এসেই অবাক হয়ে গেল।আজকে সারাদিন এখানে মানব বন্ধন চলেছে।জেল সুপার বিরক্ত হয়ে তাকে ঢুকতে দিতে নারাজ।আশ্চর্য হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো স্পর্শী।নেতামশাইয়ের সই না পেলে এতো পরিশ্রম যে বৃথা যাবে।টানা আধঘন্টা কারাগারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার পর এক হাবিলদারের থেকে আসল কথা শুনতে পারলো স্পর্শী।বাকরুদ্ধ হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো।
“আজ রাতের মধ্যেই পরশ শিকদারকে অন্য জেলে ট্রান্সফার করা হবে।পিরোজপুরের বর্তমান পরিস্থিতি সামলে উঠতে পুলিশ হিমশিম খাচ্ছে।”
আতকে উঠলো স্পর্শী।নেতামশাইকে সবার থেকে লুকিয়ে কোন জেলে শিফট করা হবে?কিচ্ছু জানে না সে।অনেক বাকবিতন্ডা করার পরে জেলার দেখা করার অনুমতি দিলো।মুহুর্তেই ছুটে গেল কাঙ্ক্ষিত সেলের সামনে।দ্রুত কোনো কথা না বলেই কাগজ আর কলম টা এগিয়ে দিলো তার দিকে।উত্তেজিত কন্ঠে বললো-
নেতামশাই দ্রুত এখানে সই করুন।আমি হাইকোর্টে আপিল করবো।আপনি একদম চিন্তা করবেন না।
পরশ কিছু বলতে গিয়েই থামলো।ত্রস্ত হাতে সই করে দিয়ে বললো-
এতে কোনো লাভ হবে না সোনা।শুধু শুধু এতো কষ্ট করার কোনো দরকার নেই।
স্পর্শী শুনলো না।দ্রুত বলল-
নেতামশাই,আপনি কি কিছু জানেন?না মানে কোন জেলে নেওয়া হচ্ছে আপনাকে?
পরশ লোহার শিকের মধ্যে হাত গলিয়ে স্পর্শীর গাল ধরলো।পরিস্থিতি কতটা খারাপ হলে সে এই পাখিটার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো।নানা কষ্টে, যন্ত্রনায় তখন মাথা ঠিক ছিলো না তার।শান্ত কন্ঠে বললো-
শুনলাম তো ঢাকায় নিবে।
একগাল হাসলো স্পর্শী।মুখ দিয়ে উৎফুল্ল কন্ঠে বললো-
ঢাকায়?
চলবে?……