#রাজনীতির_রংমহল
#সিমরান_মিমি
#পর্বসংখ্যা_৩৬
★★
সকালের শুভ্র আলোয় ছটফট করতে করতে ছাদে উঠলো আর্শি।হাতের চেয়ারটা সেখানে রেখে বাটি’টা নিচে রাখলো।পুনরায় ছুটে রুমে গেল।রাহুল বই পড়ছিলো।এই মাসের ১ তারিখ থেকে ভার্সিটিতে জয়েন্ট হওয়ার কথা তার।আর্শি ছুটে তার কাছে যেতেই হাতের বইটা ছিনিয়ে নিয়ে টেবিলে রাখলো।রাহুলের হাত ধরে টেনে ছাদের উদ্দেশ্যে চলতে চলতে বললো-
চলুন,চলুন।ছাদে চলুন।আমার হেয়ার প্যাক বানানো শেষ। এখন এটাকে মাথায় লাগিয়ে টানা আধঘন্টা বসে থাকবেন।তার পর স্যাম্পু করে নিবেন।রাতে আবার তেল দিয়ে দিবো।
নাক ছেটকালো রাহুল।কোন দুঃখে যে এই মেয়ের সাথে বাজি ধরতে গেছিলো কে জানে।আজ চারদিন ধরে এমন করছে।পাকা চুল নিয়ে আর্শির সাথে সামান্য কাটাকাটি লাগতেই রাহুল বলেছিলো-
আর্শি যদি তার চুল কালো করতে পারে তাহলে সে তার এক্সামের পরেই জাফলং ঘুরতে নিয়ে যাবে।
ব্যাস সেদিন থেকেই এখন পর্যন্ত রাহুলের উপর একপ্রকার হামলে পড়েছে।কোনো দিন তেল দিতে মিস হলে রাত দুইটা’র সময় হলেও তাকে ঘুম থেকে টেনে তুলবে আর্শি।থমথমে কন্ঠে বললো-
আর্শি এসব বাদ দাও। পড়তে বসো।
বিরক্ত হলো আর্শি।সেই পাভেল ভাইয়ে’র মতোই সারাক্ষণ একইভাবে পড়া নিয়ে ঘ্যান ঘ্যান করতে থাকে কানের কাছে।বিরক্তির সাথে বললো-
উফফফ!আর মাত্র তিনটা পরিক্ষা আছে তো।আরো চারদিন বাকি আছে পরবর্তী পরিক্ষায়। এমন ঘ্যানর ঘ্যানর করবেন নাতো কানের কাছে। আসুন এখানে বসুন।
অবশেষে বাধ্য হয়ে রাহুল চেয়ারে বসলো।আর আর্শি আলতো হাতে তার চুলের সেবা করতে ব্যাস্ত।
★
গত একমাসে স্পর্শীর এক্সাম ও শেষ। এই একমাসে এক-বার দেখা করতে পেরেছে পরশের সাথে।যেহেতু কেস টা নতুন ভাবে আদালতে উঠানোর জন্য তারা চেষ্টা করছে সেহেতু উকিল ছাড়া অন্যকাউকে অভিযুক্তর সাথে দেখা করতে দিতে তারা নারাজ।যদিও অন্য আসামীদের প্রতি সপ্তাহের শুক্রবার এক ঘন্টার জন্য নিজ পরিবারের যেকোনো একজনের সাথে দেখা করার সুযোগ দেওয়া হয়।কিন্তু পরশের ক্ষেত্রে সেটা আলাদা।কেননা তার মামলা আবার ও আদালতে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে।
নিরব হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো স্পর্শী।কালকেই খালামনির বাসা থেকে ঘুরে এসেছে।কিন্তু এতো আনন্দ তাকে একটুও ছুতে পারেনি।সেই একমাস আগে আবেদন করেছে অথচ এখনো কোনো ফিরতি মেসেজ আসে নি।আদোও তারা আবেদন মঞ্জুর করবে কি না কে জানে?চোখ থেকে এক ফোটা গরম জল বের হলো।মাটিতে পড়ার আগ মুহুর্তেই স্পর্শীর ফোন বেজে উঠলো।”প্রসেনজিৎ মন্ডল”ফোন দিয়েছেন।ক্ষানিকটা আশার আলো দেখতে পেল স্পর্শী।রিসিভড করতেই ওপাশ থেকে তিনি বললেন-
স্পর্শী মা,আবেদন তো মঞ্জুর হয়েছে তোমার।আমি তো ভেবেছিলাম আরো দু-তিনমাস ঘুরবে।এতো তাড়াতাড়ি মঞ্জুর হবে ভাবতেই পারি নি।তোমার লাক খুব ভালো।
উৎফুল্ল হয়ে স্পর্শী বললো-
আংকেল, কেস টা কবে আদালতে উঠছে?
মিইয়ে গেলেন প্রসেনজিৎ। শান্ত গলায় বললেন-
তা তো বলা যায় না মা।অনেক দৌড়াদৌড়ি করতে হবে আবেদনের ফর্ম টা নিয়ে।কবে নাগাদ কেস টা আদালতে উঠবে কে জানে?তবে আমি চেষ্টায় কোনো ত্রুটি রাখবো না।
আবারো চিন্তায় মগ্ন হলোয়া স্পর্শী।আজ প্রায় এক মাস ধরে জেলখানায় নেতামশাই।কে জানে কতটা কষ্ট হচ্ছে।ঠোট ভেঙে কেদে দিলো।
কেটে গেল প্রায় আরো পনেরো দিন।এরমধ্যেই স্পর্শী শুনতে পেল খুব শীঘ্রই পরশের কেস টা কোর্টে উঠছে।মামলা শুনানির দিন আর দুই দিন পরে।উৎফুল্ল হয়ে কিছুক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে নিরব হয়ে তাকিয়ে রইলো।হয়তো খোদাকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে সে।ফোন হাতে মহীউদ্দীন কে ফোন দিলেন।সবটা জানাতেই ব্যাস্ত কন্ঠে বললেন-
আমি শীঘ্রই আসছি মা।কোনো সাক্ষি বা প্রেমার কোনো রিপোর্ট লাগলে জানিও আমায়।
স্পর্শী শান্ত কন্ঠে বললো-
না আব্বু।আপাতত কিছু লাগবে না।জেলা জজ কোর্টে তো সকল প্রমাণ’ই দেওয়া হয়েছে।তারপরেও যদি কিছু লাগে তো আমি আপনাকে জানাবো।তবে…
থেমে আবার নুইয়ে যাওয়া কন্ঠে বললো-
কিছু টাকা লাগবে আব্বু।এডভোকেট কে তো এখনো কিছু দেওয়াই হয়নি।
—আমি নিয়ে আসবো।তুমি চিন্তা করো না মা।
.
.
.
.
.
★★★★
সুপ্রিম কোর্ট:
আদালতের সামনে দাঁড়িয়ে আছে স্পর্শী।সামনেই পরশ আলতো হেসে দাঁড়িয়ে আছে।হাতে হ্যান্ডকাফ। দুটো হাতকেই আলতো উপরে তুলে স্পর্শীর গাল ধরলো।বললো-
বলেছিলাম না শুধু শুধু কষ্ট করো না।কিচ্ছু হবে না।
ছলছল চোখে পরশের দিকে তাকালো স্পর্শী।এবারের রায় ও তার পছন্দ হয় নি।একটুও পছন্দ হয় নি।বাইশ বছর থেকে মাত্র দু-বছর কমিয়ে বিশ বছরের সাজা দিয়েছে।নেতামশাই এতটা বছর কি করে থাকবে ওখানে। আচমকাই চোয়াল শক্ত করলো স্পর্শী। কন্ঠে কাঠিন্যতা এনে বললো-
আমি আবারো মামলা’টা আদালতে উঠাবো।হয়তো তাতে আরো দুটো মাস আপনাকে জেলে অপেক্ষা করতে হবে।কিন্তু তাও আমি হারবো না।একদম চিন্তা করবেন না আপনি।আমি আছি তো।
★★★
হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের মধ্যবর্তী সেতু হলো চেম্বার জজ আদালত। কোনো মামলা হাইকোর্টে নিষ্পত্তি হওয়ার পর আপিল করতে হলে প্রথমে চেম্বার জজ আদালতে আবেদন করতে হয় । এ ছাড়া আপিল বিভাগ ছুটিতে থাকাকালীন জরুরি বিষয়ে নিষ্পত্তির জন্য প্রধান বিচারপতি আপিল বিভাগের একজন বিচারককে চেম্বার জজ হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন। তিনি আবেদনকারীর আবেদন বিবেচনা করে প্রয়োজনে নির্দেশ দেন, কিংবা নিয়মিত বেঞ্চে শুনানির জন্য বিষয়টি পাঠিয়ে দেন। তিনি অফিস সময়ের বাইরেও আবেদন শুনতে পারেন, এমকি বাসায়ও আবেদন বিবেচনা করে রায় দিতে পারেন। তবে দেরি করলে আবেদনকারীর ক্ষতি হতে পারে কেবল এমন আবেদনই তিনি বিবেচনা করেন।
আপিল বিভাগ:
হাইকোর্ট বিভাগে মামলা নিষ্পত্তির পর কোনো পক্ষ অসন্তোষ্ট হলে তিনি আপিল বিভাগে আবেদন করতে পারবেন। বাংলাদেশে আপিল বিভাগের রায় চূড়ান্ত রায়। তবে কোনো ব্যক্তি আপিল বিভাগের রায়ে অসন্তোষ্ট হলে একই বিভাগে পুনরায় রায়টি পুনর্বিবেচনার আবেদন করতে পারেন। যাকে আমরা রিভিউ হিসেবে জানি। বর্তমানে আপিল বিভাগে দুটি বেঞ্চ রয়েছে।টানা দেড় মাস ছোটাছুটি করার পরে আপিল বিভাগ থেকে রায় এসেছে বারো বছরের জেল।যদিও স্পর্শী এতেও সন্তুষ্ট নয়।সে চেয়েছিলো আবারো পুনর্বিবেচনা অর্থাৎ রিভিউয়ের জন্য আবেদন করতে কিন্তু প্রসেনজিৎ মণ্ডল তাকে বাধা দিয়েছেন।শান্ত কন্ঠে বুঝিয়েছেন-
দেখো এমনটা নয় যে তোমার হাসবেন্ড অপরাধ করেনি বা তাকে ফাসানো হয়েছে।দেখো স্পর্শী,কেস টা যে পর্যন্ত এসেছে এ পর্যন্তই থাকুক।এর পরে যদি তুমি আবারো রিভিউএর জন্য আবেদন করো হতেও পারে জজ বিবেচনা করে এর থেকেও সাজা পুনরায় বাড়াতে পারে।এ পর্যন্ত লাখ টাকা খরচ করা শেষ। আর এগিয়ো না।শুধু শুধু টাকা নষ্ট করার কোনো প্রয়োজন নেই।
সেদিন কে হোস্টেলে এসে বইয়ের পর বই,পাতার পর পাতা ওল্টালেও আইনি কোনো সমধান পায় নি স্পর্শী।হতাশ হয়ে ঝিম মেরে টানা তিন দিন বসে ছিল। যেন এ যাবৎ সকল শক্তি তার হারিয়ে গিয়েছে।
পরশ জেলে যাওয়ার প্রথম সপ্তাহের শুক্রবার।ধীর পায়ে টিফিনের বক্স হাতে কারাগারে গেল স্পর্শী।এখন আর কেউ তাকে বাধা দিবে না।প্রতি সপ্তাহের শুক্রবার একঘন্টার জন্য আসামীর সাথে দেখা করার সুযোগ রয়েছে।স্পর্শী থানায় উপস্থিতির স্বাক্ষর দিতেই হাবিলদার পরশ কে নিয়ে এলো। বেঞ্চিতে বসিয়ে নিজ হাতে খাইয়ে দিলো স্পর্শী।কারো তোয়াক্কা করলো না।খাওয়া শেষে মুখ মুছিয়ে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বললো-
একদম চিন্তা করবেন না নেতামশাই।বারোটা বছর এমন কিছু না।বলতে বলতে চলে যাবে।আমি মানিয়ে নিতে পারবো।ওকে।আর আপনি একদম ভেঙে পড়বেন না। আমি প্রতি শুক্রবার এসে আপনাকে দেখে যাবো।পরবর্তী শুক্রবার হয়তো আব্বু মা কে নিয়ে আসবে।আমি না হয় তার পরের শুক্রবারে আসব।
স্থির হয়ে স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে রইল পরশ।প্রায় অনেকক্ষণ চুপ থাকার পরে শান্ত কন্ঠে বললো-
নিজের জীবন’টা সাজিয়ে নিয়ো স্পর্শীয়া। আমার জন্য অপেক্ষা করে তোমার লাইফটা নষ্ট করো না।ভালো কাউকে দেখে আবারো মুভ অন করো।
স্পর্শী স্তব্ধ হয়ে পরশের দিকে তাকিয়ে রইলো।সেদিনের পরশ আর আজকের পরশের মধ্যে যেন কোনো মিল’ই পাচ্ছে না।পরক্ষণেই ঠোট কামড়ে নিচের দিকে তাকিয়ে বললো-
আচ্ছা।
হতভম্ব হয়ে গেল পরশ। স্পর্শীর হাত দুটো জোরে চেপে ধরে নিজের দিকে এনে চোখ পাকিয়ে দাতে দাত পিষে বললো-
কি বললি তুই?
আর নিজেকে সামলাতে পারলো না স্পর্শী।আশেপাশের দেয়াল ফাটিয়ে অট্টহাসিতে মেতে উঠলো।পরশ ও হেসে দিলো।হাসতে হাসতেই একপর্যায়ে হাউমাউ করে কেদে দিয়ে পরশকে জড়িয়ে ধরলো স্পর্শী।মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে আলতো স্বরে পরশ বলতে লাগলো-
এভাবে কাদে না ময়না পাখি।মাত্র বারোটা বছর’ই তো।হুট করে কেটে যাবে।তারপর আবারো আমি
আবারো তোমার কাছে ফিরে আসবো।ওকেহ!!!
বলতে বলতেই আলতো হেসে দিলো পরশ।হাবিলদার ও হেসে উঠলো।ঘাড় ঘুড়িয়ে পেছনে তাকাতেই দুম করে দাড়ালো।দ্রুত কন্ঠে পরশকে বললো-
এমপি সাহেব,ম্যাডাম তো আবারো আইছে।
চমকে জেলের সামনে তাকালো পরশ।দুরেই সাদা শাড়ির উপর কালো কোর্ট পড়া এক পরিপূর্ণ যুবতী এগিয়ে আসছে তার দিকে।পাশেই এই কারাগারের জেলসুপার তীব্র শেখ।মুহুর্তে’ই চোয়াল শক্ত হয়ে গেল পরশের।রক্তরাঙা চোখ দুটো অন্য দিকে ফিরিয়ে নিরব হয়ে তাকিয়ে রইলো।
চলবে?…….