রাজনীতির রংমহল পর্ব-৩৯

0
600

#রাজনীতির_রংমহল
#সিমরান_মিমি
#পর্বসংখ্যা_৩৯

★★
বেলা বারোটা।এই রৌদ্রতপ্ত দুপুরে ছাদের এক কার্ণিশে আকাশের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর্শি।চোখ দুটো পানিতে টইটম্বুর। বিগত চার বছরের সংসার জীবনে যতই মনমালিন্যতা হোক না কেন রাহুল কখনো তার গায়ে হাত তোলে নি।অথচ আজ প্রথমবারের মতো তাকে মেরেছে।কিই বা দোষ ছিলো তার।

নিত্যদিনের অভ্যাস মতোই কাপড়ের ভাজের মধ্যে রাখা পাভেলের ছবিটা দেখছিলো।দেয়ালে লাগানো পোস্টার ছিড়েই বহু বছর আগে এই ছবিটা কেটে রেখেছিলো আর্শি।এর আগে লুকিয়ে দেখলেও আজ প্রথমবারের মতো ধরা পড়ে যায় রাহুলের কাছে।যার দরুন ঠাস করে এক দাবাং মার্কা চড়ের সম্মুখীন হয় সে।

সেও তো একজন রক্তমাংসের গড়া মানুষ। কিশোরী জীবনের প্রথম ভালোবাসা কিভাবে ভুলবে।যদিও লোকটা মারা গেছে,যদিও বাস্তবতার সম্মুখীন হয়ে আর্শিকে অন্য কারো সংসার করতে হচ্ছে তাও তো সেই লোকটাকে ভোলা যাচ্ছে না।সুখে দুখে বরাবরই প্রথম তার কথা মনে পড়ে তার।এটা তো সে ইচ্ছে করে করে না।

নিজের ভাবনায় মশগুল থাকা কালীন নিচ থেকে কর্কশ কন্ঠে রাহুলের স্বর ভেসে আসলো।

–আর্শি,,,,ইশি কাদছে।দ্রুত আসো।

মেয়ের কথা মাথায় আসতেই দ্রুত সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো।রুমের সামনে আসতেই পা দুটো আটকে গেল।ভেতরে রাহুল ও আছে।ইশি কে কোলে নিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে।ধীর পায়ে ভেতরে ঢুকে দেড় বছরের মেয়ে ইশি কে রাহুলের কোল থেকে একপ্রকার টেনেই নিয়ে গেল।রাহুল প্রথমে থমকালেও পরবর্তীতে নিজেকে সামলিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।আলতো হাতে বিছানায় শুইয়ে মেয়ে খাওয়াতে লাগলো।মন অন্যকোথাও পড়ে থাকলেও বাস্তবতার সম্মুখীন হয়ে আজ প্রথম কিশোরী জীবনের প্রেমকে ভুলে সংসার করতে হচ্ছে।

সবই তো ঠিক ছিলো। এখানে বিয়ে হওয়ার পর রাহুলের শাসনে বেশ ভালোভাবেই লেখাপড়ায় মনযোগ হয়েছিলো।এদিকে আর্শির পরিক্ষা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই ভার্সিটিতে জয়েন্ট করে রাহুল।রেজাল্টের দিন এমন রেজাল্টে বেশ অবাকই হয়েছিলো আর্শি।সে আর পাশ।পাশ তো দুরের কথা তার থেকেও খুব ভালো রেজাল্ট করেছে সে।৩.১৩ জিপিএ তার।এটা ভাবা যায়।নিজের রেজাল্টে নিজেই যখন মাতোয়ারা ঠিক তখনই আর্শির এমন রেজাল্ট শুনে নাক ছেটকালো রাহুল।এরকম রেজাল্ট তার চৌদ্দ পুরুষের ও কেউ করেনি।গায়ে মাখে নি আর্শি।নিজের মতোই থাকতে রইলো।এরই মধ্যে রাহুলের একমাত্র ফুপি এসে চিৎকার চেচামেচি করে কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন।তার একমাত্র ভাইপো র বিয়ে হয়েছে তাতে তিনি উপস্থিতই থাকতে পারে নি।এমনকি কেউ জানায়ই নি।এই চেচামেচির রেশ ধরেই পাড়া-প্রতিবেশী নিয়ে পুনরায় বিয়ে হয় রাহুল আর্শির। প্রথমে রাজি না হলেও পরবর্তীতে এই ঝামেলার অবসান ঘটাতে মুখ বুঝে বিয়ে করে নিলো সে সজ্ঞানেই।

বাড়ি না যাওয়ার জেদে সেখানেই থাকতে লাগলো বেশ স্বাধীনভাবে।এভাবেই থাকতে থাকতে একটা ভালো বন্ধুত্ব সৃষ্টি হলো তাদের মাঝে।এই যেমন প্রতিদিন একসাথে খাওয়া,মাঝে মধ্যে ঘুরতে যাওয়া,জ্বর বা কোনো কারনে অসুস্থ হলে দুজন দুজনকে সেবাযত্ন করা,রাহুলের চুলের যত্ন নেওয়া ইত্যাদি।এরকম ভাবেই দিন দিন চলতে চলতে এক অজানা মায়া সৃষ্টি হয় দুজনার মধ্যে।রাহুল বুঝতে পারলেও আর্শি বুঝেও সেটাকে অস্বীকার করেছিল।
তবে বুঝতে পারলো সেইদিন।

সদ্য ভার্সিটিতে পা রেখেছে আর্শি। যাওয়া-আসার সুবিধার কারনেই রাহুলের ভার্সিটিতেই আর্শিকে ভর্তি করিয়েছিলো।বেশ ভালোই চলছিলো জীবন।কিন্তু বাধ সাধলো ভার্সিটির মেয়েগুলো।আজকাল কার মেয়ে গুলো বেশিরভাগ’ই হ্যান্ডসাম টিচারদের নিয়ে কল্পনায় ভেসে চলে।তেমনই হলো রাহুলের ক্ষেত্রে।ক্লাসে আসলে তারই সহপাঠী গুলো একে অন্যের সাথে রাহুলকে নিয়ে মেতে উঠতো।কোন শার্ট পড়লে ভালো লাগে, কোন ঘড়ি পড়লে চোখে হারায় তারা এসবই নিয়ে দিনকে দিন মেতে উঠলো।রাহুল আর্শিকে নিয়ে কেন আসে জিজ্ঞেস করাতে একদিন আর্শি বলেছিলো তার খালাতো ভাই।ব্যাস সেদিন থেকে তার সামনে বসেই অশোভন আচরণ করে তারা।এই যেমন লুকিয়ে লুকিয়ে ফ্লাইং কিস,তাকে নিয়ে করা কল্পনার বহিপ্রকাশ ইত্যাদি তার সামনে বসেই করতো।

কোনো এক অজানা কারনেই জন্যই বেশ হিংসে লাগতো আর্শির।রাহুলের যে শার্টের প্রশংসা তারা করতো বাড়ি ফিরে সেই শার্টটাকেই লুকিয়ে ছিড়ে পুড়িয়ে ফেলতো আর্শি। এমনই করতে করতে হঠাৎ একদিন ধরা পড়ে গেল সে।

মাথায় হাত দিয়ে ছাদে উঠে অবাকের চোখে ছাদের ফ্লোরে অর্ধপোড়া শার্ট টার দিকে তাকিয়ে রইল রাহুল।আলতো ধমকের সাথে বললো-

আর্শি,এটা কি করছো তুমি?মাই গড আমার এত্তো পছন্দের শার্ট টা পুড়িয়ে ফেলেছো।এই এই আমার আগের লাপাত্তা হওয়া শার্ট গুলোও তুমি পুড়েছো?

ভয়ে বাকহারা হয়ে গেল আর্শি।এভাবে হাতে নাতে ধরা খাবে তা কস্মিন কালেও ভাবতে পারে নি আর্শি।ফুপিয়ে ভয়ের চোটে কেদে উঠলো।আমতা আমতা করে বললো-

ও ওই এই শার্ট টাতে তেলাপোকা ছিলো।

জোরে ধমক দিলো রাহুল।চেচিয়ে বললো-

তেলাপোকা ছিলো মানে?তোমাকে কি কামড়ে দিতো।আমার এত পছন্দের শার্ট টা কেন নষ্ট করলে?

ফুপিয়ে কান্না করে উঠলো স্পর্শী।ভয়ের চোটে অস্পষ্ট গলায় বললো-

আপনি এই শার্ট পড়ে গেলে ক্লাসের মেয়েরা বাজে কথা বলে।

সোজাসাপ্টা গলায় রাহুল বললো-

কি বলেছে?

ঢেকুর দিয়ে আর্শি বললো-

বলে আপনার ফিগার সুন্দর,চোখ কাড়ার মতো।আপনি সুন্দর,আপনার ঠোট সুন্দর আর…

বিস্ময়ে বাকহারা হয়ে গেল রাহুল।আর্শির পুরো কথা শেষ হওয়ার আগেই ধমক দিয়ে চুপ করে থাকতে বলল।তারপর বলল-

তুমি বলো নি আমি বিবাহিত।

এবারে চোরের মতো মুখ টাকে লুকালো আর্শি।যেটা দেখেই রাহুলের মেজাজ গরম হয়ে গেল।ধমক মেরে চেচিয়ে বলল-

শোনো আর্শি,তোমার বাবার কাড়ি কাড়ি টাকা থাকলেও আমার নেই।এভাবে আমার পছন্দের শার্ট গুলো নিত্যদিন নতুন ভাবে পুড়িয়ে ফেলবে এটা একদম বরদাস্ত করবো না আমি।সেকেন্ড টাইম আমার শার্টে হাত দিবে না।পোড়াতে ইচ্ছে হলে তোমার ড্রেস পুড়িয়ো।

বলেই হনহন করে হাটতে হাটতে নিচে চলে গেলো।

রাত সাড়ে এগারোটা।ঘরে কোনো আলোর ছিটেফোঁটা ও নেই।প্রায় পাচ মিনিট হয়ে গেছে বিদ্যুৎ নেই।আর্শি বিছানায় বসে ছটফট করছে।পাশেই রাহুল কপালে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে আছে।

রাহুল স্যারের ঠোট দেখেছিস আর্শি।কি সুন্দর।ঠোটের কালার টা একদম স্ট্রবেরি র মতো।ওই ঠোটে চুমু খেতে পারলে একদম ধন্য হয়ে যেতাম।

আলোর বলা কথাগুলোই সেই সন্ধ্যা থেকে মাথাচারা দিয়ে উঠেছে।সত্যিই তো রাহুল ভাইয়ের ঠোট দুটো অনেক সুন্দর।আচ্ছা,সে তো তার স্বামী।তাহলে ওই ঠোটে চুমু খেয়ে আর্শি নিজে কেন ধন্য হচ্ছে না।এরকম টা ভেবেই সারাটা রাত সুযোগের অপেক্ষা করেছে আর্শি।কারেন্ট নেই,রাহুল ও ঘুমে।এই সুযোগ টা কাজে লাগানোর জন্যই উঠে বসলো।রাহুলের শরীরের উপর ঝুকে ঠোট দুটোকে আলতো ছোয়ালো রাহুলের ঠোটে।কেবল হালকা ঘুমের রেশ ধরেছিলো রাহুলের।এরইমধ্যে এমন ঠান্ডা ছোয়ায় অবাকের রেশ ধরে চোখের উপর থেকে হাত সরালো।অন্ধকার ঘরে এরইমধ্যে আলোর উপস্থিতি হয়ে কারেন্ট চলে আসলো।

হতভম্ব হয়ে গেল আর্শি।এটা কি হলো?আল্লাহ তার উপর এতো নারাজ কেন?কেন?ভয়ের চোটে চোখ দুটো বড় বড় করে সেভাবেই রাহুলের দিকে তাকিয়ে রইলো।নিজের সমস্ত ইচ্ছা,আকাঙ্খা, উত্তেজনাকে সামলে নিয়ে সারারাত আর্শির পাশে শক্ত হয়ে পড়ে থাকে।কিন্তু আজ নিজে থেকেই যে ছুয়ে দিল তাকে কিভাবে সে অবজ্ঞা করবে।দুহাত দিয়ে আর্শিকে বিছানায় ফেলে হামলে পড়লো তার উপর।প্রথম দিকে বাধা দিলেও নিমিষেই শান্ত হয়ে যায় আর্শি।এই মুহুর্তে তার মন ও চাইছে এই স্বামী নামক পুরুষ টার সান্নিধ্যে আসতে।

আচমকা ইশির কান্নার আওয়াজেই ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো আর্শি।মেয়েকে নিয়ে বিপাশার রুমে এনে তার কাছে দিয়ে রান্না করতে বসলো।নাতনিকে কোলে নিয়ে ত্রস্ত পায়ে রান্নাঘরে ঢুকলো বিপাশা।শান্ত স্বরে বললো-

দেখো মা,তুমি একদম ছোট না।পর্যাপ্ত বয়স হয়েছে তোমার,মেয়েও হয়েছে।এখনও কেন এমন ছেলে মানুষী করো।রাহুল ও তো স্পর্শীকে পছন্দ করতো,ও তো কখনো তোমার সামনে ওকে নিয়ে কিছু বলেনি।তাহলে তুমি কেন বারবার তোমার প্রেমিকের নাম তোলো। রাহুল তোমার স্বামী,তোমাদের মেয়েও আছে একটা। সংসার টাকে টেকাও।আর ভুলেও নিজের স্বামীর সামনে পর পুরুষের নাম নিও না।এটা কেউই সহ্য করতে পারবে না।

বিকাল তিনটা।খাটের এক পাশে চুপচাপ সিলিং য়ের দিকে তাকিয়ে আছে রাহুল।মাঝখানেই আর্শি শুয়ে বাম দিকে শোয়া মেয়ের গায়ে হাত রেখে ঘুম পাড়াচ্ছে।হঠাৎই রাহুল বললো-

আমি মারা গেলে কখনো কি এতটা কাদবে যতটা পাভেলের জন্য কাদছো?

চমকে উঠল আর্শি।হঠাৎ ই যেন নিজেকে খুব অসহায় মনে করলো।এই মানুষ টা না থাকলে সে কিভাবে থাকবে।না না, এমনটা যেন না হয়।চোখ দুটো ভরে উঠলো।পাশ ফিরে রাহুলকে জড়িয়ে ধরে বলল-

আপনি এসব কেন বলছেন?

শুনলো না রাহুল।শান্ত কন্ঠে বললো-

আমার প্রতি কি গত চার বছরে একটুও মায়া জন্মায় নি তোমার?

হাউমাউ করে কেদে উঠলো আর্শি।আজকে সারাদিন শাশুড়ির বলা কথা গুলো ভেবেছে সে।বারবার নিজের কাছে ছোট লেগেছে নিজেকে।আরো গভীর ভাবে রাহুলকে জড়িয়ে ধরে সেভাবেই পড়ে রইলো।কান্নারত কন্ঠে বললো-

আমি আর কখনো এমন করবো না।আপনি প্লিজ এমন কথা বলবেন না।আমার কষ্ট হয় ভীষণ।

রাহুল কিচ্ছু বললো না।ওভাবেই চোখ বন্ধ করে পড়ে রইল।তার জীবন টা এমন কেন?সে কি কারো ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য নয়।কত কষ্ট করে স্পর্শীকে ভুলছে সে।মেয়ে,আর্শিকে নিয়ে একটা সুন্দর সংসার করার চেষ্টা করছে।অথচ বার বার ই মুখ থুবড়ে পড়ছে।

★★

জানালার কাছের সিটে বসে মাথা হেলিয়ে পরশের বুকের উপর পড়ে রইলো স্পর্শী।এ যাবৎ চার বার বমি করেছে।লোকাল বাসে চড়ার অভ্যাস থাকলেও এভাবে লং জার্নি কখনো করা হয় নি। ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছে সে।এভাবেই থাকতে থাকত একসময় ঘুমিয়ে পড়লো পরশের বুকে।

এরই মধ্যে আরো একবার সামনের বাসের সাথে ধাক্কা লাগতে লাগতে বেচে গেল তাদের বাস।যাত্রীরা চিৎকার করে উঠলো।টানা তিন দিন ঘুমহীন বাস চালাচ্ছে ড্রাইভার।চোখ তার গুলিয়ে যাচ্ছে।যাত্রীদের কথা দিয়েছে সামনের বাজারেই চা খাবে এবং বরিশাল পর্যন্ত যেয়েই ড্রাইভার চেঞ্জ করবে।সামান্য সন্তুষ্ট হলো যাত্রীগন।এ যাবৎ তিনবার এক্সসিডেন্ট করতে করতে বেচেছে।

বাসের স্পিড বারিয়ে দিলো ড্রাইভার।যত দ্রুত সম্ভব বরিশাল যাবে সে।এরইমধ্যে সামনে একটা হলুদ বাস পড়লো।একপাশে বিশাল গভীর খাল।অন্যপাশে ধান ক্ষেত, মাঝখানে রাস্তা।দুটো বাস দুদিকে ব্রেক কষতে গিয়ে এক বিশাল সংঘর্ষের সৃষ্টি হলো।অন্য বাসটা ব্রেক সামলাতে না পেরে কাত হয়ে পাশের ধানক্ষেতের মধ্যে পড়লো।আর পরশদের বাসটা ব্রেক কষতে গিয়ে রাস্তার পাশের বড় গাছটার সাথে ধাক্কা খেল।মুহুর্তেই উলটো হয়ে ছিটকে পড়লো গভীর খালে।ইতোমধ্যে বাসের দুই তৃতীয়াংশ অলরেডি ডুবে গিয়েছে।

সেকেন্ড না গড়াতেই দূর থেকে কিছু লোক চিৎকার করতে করতে এগিয়ে এলো এক্সসিডেন্ট স্পটে।

চলবে?