#রিক্ত_শহরে_আমার_তুমি
ফাহমিদা তানিশা
পর্ব ০৪
_ফোনে কথা বলছেন? শেষ বারের মতো বলে নিন।
আপনার এগেইনস্টে যা এভিডেন্স এসেছে তাতে
মনে হয় না আর বাইরের মুখ দেখতে পারবেন বা
ফোনে কথা বলতে পারবেন।সো বলে নিই কথা।
এএসপি আয়ানের কথা শুনে অরুনিমা যেন আকাশ থেকে পড়লো।কি এমন এভিডেন্স আছে তার বিরুদ্ধে!যেখানে সে কিছুই করেনি সেখানে এসব এভিডেন্স আসলো কোথা থেকে।এদিকে অরুনিমার মা ব্যস্ত থাকায় ফোন রিসিভ করেননি।তাই তার আর কথা বলা হলো না।
_কথা বলা শেষ? তাহলে প্রশ্ন করা যাক?
_জি স্যার বলুন।
_প্রথমে সত্যি করে বলুন এটা আপনার ঘড়ি কিনা?
_জি স্যার আমার ঘড়ি।
_তাহলে এটা রিস্তার রুমে কি করে গেলো?আমি জানি না বা আমি বুজতে পারছি না এসব ছাড়া বলবেন।
অরুনিমা খানিকক্ষণ ভাবলো। হঠাৎ অনেকটা উচ্চস্বরে বললো:স্যার একটা কথা আপনাকে বলা হয়নি।
_কি বলুন।
_আমরা চারজনকে টিচার্স ডে তে একই রকম ঘড়ি গিফট করা হয়েছিল।তার মধ্যে আমার ঘড়িটি দিন দশেক আগে ভেঙে যায়।আমি সেটা ডাস্টবিনে ফেলে দিই। কিন্তু সেই ঘড়ি এতো দিন পর এখানে কি করে আসলো আমি জানি না স্যার।
_ধরুন আমি আপনার কথা বিশ্বাস করলাম। কিন্তু আদালতে তো আপনার বিরুদ্ধে ঘড়িটা প্রমাণ স্বরূপ দেখানো হবে।
_স্যার আপনি একবার বিশ্বাস করুন আমার কথাগুলো। তাছাড়া আমার ঘড়িটা আমি ক্রাইম স্পটে কেনো ফেলবো? আমিও তো জানি এই ঘড়িটা দিয়ে সহজেই আমাকে চিহ্নিত করা যাবে। তাহলে আমি সেটা ওখানে কেন রাখবো?
_জি আমি বুঝতে পারছি বিষয়টি।বাই দ্যা ওয়ে আপনার কি কলেজের কারো সাথে কোনো মনোমালিন্য হয়েছে?
_না স্যার। আমি জয়েন করেছি তিন মাস হতে চলেছে মাত্র।বাসার সবাইকে রেখে প্রথমবারের মতো দূরে এসেছিলাম তাই অনেকটা একাকিত্ব আর ডিপ্রেশনে আমি কারো সাথে খুব একটা মিশতে পারিনি।
_মিস তরীর সাথে তো এক বাসায় থাকেন।তার সাথে কি কিছু হয়েছে?
_না স্যার।ওর সাথে আমার কিছু হয়নি। তাছাড়া স্যার আমার এই ঘড়ির মতো একটা ঘড়ি তার কাছেও আছে। হতে পারে ঘড়িটা তার।তাই আমাকে ফাঁসাতে চাইছে সে।
এএসপি আয়ান বুঝতে পারছে না কিভাবে এই কেসটা সমাপ্ত হবে। কিন্তু এই অরুনিমা মেয়েটার প্রতি তার মনে বিশ্বাস জমে আছে।সে এই খুনের সাথে সম্পৃক্ত নয় তা তাকে দেখেই বোঝা যায়। অনেকটা শান্ত আর নিশ্চুপ প্রকৃতির মেয়ে সে। তাছাড়া তিনমাস আগে একটা নতুন শহরে এসে একা মানুষ খুনের মতো এতোটা জটিল কাজ করতে পারবে না।সব ভাবলে মন বলে সে নির্দোষ কিন্তু প্রমাণ গুলো তার মনের কথাটা বাস্তব হতে দিচ্ছে না।
হঠাৎ অরুনিমার ফোন বেজে উঠলো।তার মা ফোন করেছে। অরুনিমা ফোন রিসিভ করবে কিনা অনুমতি নিতে এএসপি আয়ানের দিকে চেয়ে আছে।তিনি ইশারায় ফোনটা রিসিভ করতে বললেন।সেও তার কথামতো ফোনটা রিসিভ করলো।
_কি হয়েছে তোর? তোকে নাকি থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে কিসের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য? আমি এসব কি শুনেছি?
_তেমন কিছু নয়।
_তেমন কিছু নয় মানে? আমাকে রাফিদের মা সব বলেছে।কি হয়েছে খুলে বল আমাকে।
_কিছু হয়নি তো। টেনশন করতে হবে না।
_বললেই হলো টেনশন না করতে।একা একটা মেয়ে আছিস সেখানে।তার মধ্যে খুনের মামলা।তোর বড় আপু বলছে তার দেবর ছোটটা ওই থানায় আছে। নাকি ওর সাথে কথা বলবো? নতুন আত্নীয়তা হচ্ছে। যদি এসব শুনে বিয়েটা ভেঙে দেয় তাহলে তো সমস্যা।কি করবো বল তো।
_কে আছে?
_আরে তোর আপুর দেবর।
_এসব এখন বলতে হবে না। বুঝতে পেরেছো?আমি পরে কথা বলবো।
একথা বলেই অরুনিমা ফোন কেটে দিলো।মাকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ দিলো না সে।
_স্যার
_জি বলুন।
_এখন কি আমি আসতে পারি?
_না। আপনি এই রুমে বসুন। আমরা মিস তরীকে থানায় ডেকে পাঠিয়েছি।তার সাথে কথা বলার পর সিদ্ধান্ত নিবো।
অরুনিমা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল।সে কথাটা বলতে ইতস্তত বোধ করছে। এএসপি আয়ান বিষয়টি বুঝতে পেরে বললেন: কিছু বলবেন?
_যদি এক গ্লাস পানি পেতাম তাহলে ভালো হতো।
_ওকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
একটু পর ইমন এসে এক গ্লাস পানি আনলো।খালি পেটে দ্রুত পানি খাওয়ায় অরুনিমার গলায় আটকে যায়।এর মাঝে তার হাঁপানির টানটাও বেড়েছিল বলে অনেকটা নাজেহাল অবস্থা হয়ে গেছে তার।এই বুঝি নিঃশ্বাস আটকে যাচ্ছে! অনেকক্ষন ধরে চেষ্টা করছে সে নিঃশ্বাস ফেলার কিন্তু পারছে না। এদিকে রুমে কেউ নেই যে তাকে একটু সাহায্য করবে। মিনিট দশেক চেষ্টা করতে করতে সে নিস্তেজ হয়ে গেল।চেয়ার থেকে ধুম করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। এদিকে এএসপি আয়ান তরীর সাথে পাশের রুমে বসে কথা বলছিল। হঠাৎ আওয়াজ পেয়ে সে দ্রুত ছুটে আসে।এসে দেখে অরুনিমা মাটিতে পড়ে আছে। মাথাটা একটু ফেটে গেছে জোরে পড়ায়।অজ্ঞান হয়ে গেছে সে। এএসপি আয়ান আর কিছু না ভেবে দ্রুত কোলে তুলে নিলো আর ইমনকে হাঁক ছাড়লো। অনেকটা দ্রুত সে অরুনিমাকে কোলে নিয়ে রুম থেকে বের হলো সে। তরী দাঁড়িয়ে ছিল দরজার বাইরে। অরুনিমাকে এএসপি আয়ানের কোলে দেখে অনেকটা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো সে। এদিকে এএসপি আয়ান ভাবছে অরুনিমাকে চিনে এমন একজন মহিলা মানুষ সাথে থাকা প্রয়োজন।তাই তরীকে তাদের সাথে আসতে বললো সে।
_মিস অরুনিমার অবস্থা খারাপ। আমরা হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। আপনি আমাদের সাথে আসুন।
কিন্তু তরী এএসপি আয়ানের মুখের উপর নাকোচ করে দিলো। সাথে গমগমে গলায় জবাব দিলো:
_দেখুন স্যার এমন খুনিকে আমি কখনো হেল্প করতে পারবো না। আমি এসব পছন্দ করি না। আপনি আমাকে রিকোয়েস্ট করলেও আমি যাবো না ওর সাথে হাসপাতালে।
_আপনাকে রিকোয়েস্ট কে করেছিল? আরদিদ আয়ান কখনো কাউকে রিকোয়েস্ট করে না।অর্ডার করেছি।
_দেখুন স্যার,আ’ম এ লেকচারার এজ ওয়েল এজ এ ক্যাডার।ইউ কান্ট অর্ডার মি।(আমি একজন প্রভাষক এবং সেই সাথে একজন ক্যাডার। আপনি আমাকে অর্ডার করতে পারেন না)
তরী অনেকটা ভাব নিয়ে বললো কথাটা। এএসপি আয়ানের গাঁ জ্বলে ওঠে কথাটা শুনে। অনেকটা রাগ কন্ট্রোল করে সে হাঁটা দিলো।কারণ এখন এখানে দাঁড়িয়ে তরীকে তার পাওয়ার দেখাতে গেলে অরুনিমা বিদায় হয়ে যাবে দুনিয়া থেকে।তার এখন অক্সিজেন খুব প্রয়োজন।তা এএসপি আয়ান খুব ভালো করে বুঝতে পারছে।তাই দ্রুত অরুনিমাকে গাড়িতে তুলে বসিয়ে দিলো। ড্রাইভারকে অর্ডার দিলো জোরে চালাতে।একহাত দিয়ে সে অরুনিমাকে শক্ত করে ধরে আছে।যদি আবার ছিটকে পড়ে তাহলে মাথাটা আরো ফাটবে আবার। বেচারির এমনেই অবস্থা খারাপ। এএসপি আয়ান অনেকটা চিন্তিত হয়ে ভাবছে।কি হবে আল্লাহ জানেন। বারবার অরুনিমার মুখের দিকে তাকাচ্ছে সে। চোখ বন্ধ অবস্থায় মানুষকে খুব ভালো করে দেখা যায়।তাই সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।মেয়েটার মুখে একটা মায়াবী ভাব আছে। খুব সুন্দর এমন নয় কিন্তু শান্তশিষ্ট একটা ছাপ তার মুখে ছেয়ে আছে। মাথার একপাশে ফেটে যাওয়ায় রক্ত পড়ছে ভীষণ। রক্ত দেখে সে হিজাবটা খুলতে চাইলো কিন্তু কি ভেবে আবার হাতটা সরিয়ে নিলো। একটু ভেবে ইমনকে বললো কয়েকজন মহিলা পুলিশকে হাসপাতালে যেতে যেহেতু অরুনিমা এই শহরে একা।
হাসপাতালে নিয়ে অরুনিমাকে ভর্তি করা হয়েছে। ইমারজেন্সি রুমে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাকে। এএসপি আয়ানের কেন জানি অনেকটা কষ্ট লাগছে। মেয়েটাকে দেখে মনে হয় না খুন করতে পারে। রিস্তা আত্মহত্যা করেনি। তাকে খুন করা হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। একজনের দ্বারা এতো বড় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। তিন বা চারজন কমপক্ষে প্রয়োজন। কিন্তু অরুনিমা তো একা!তার সাথে কারো তেমন পরিচয় নেই শহরে নতুন এসেছে বলে। তাহলে সে এসব করতেই পারে না কিন্তু কেউ তাকে ফাঁসাতে চায় খুব জটিলভাবে।তাই সে খুব সুক্ষ্মভাবে প্ল্যান করেছে এবং তার বিরুদ্ধে এভিডেন্স রেখেছে। কিভাবে আসল খুনিদের ধরবে আর কিভাবে অরুনিমাকে বাঁচাবে তা এএসপি আয়ানের জানা নেই।তবে চেষ্টা করছে সফল হওয়ার জন্য।এসব ভেবে ভেবে সে হাসপাতালের লম্বা গলিটা পায়চারি করছে।তার চাকরি জীবনে এতোটা জটিলতায় পড়েনি কোনো কেস নিয়ে। কাউকে মন থেকে সাহায্যও করতে চায়নি ।প্রথম অরুনিমাকে সাহায্য করতে চাইছে।এটা কি সততা নাকি পক্ষপাতিত্ব সে বুঝতে পারছে না।হুট করে সে দেখলো তার শার্টে রক্ত যা অনেকটা শুকিয়ে গেছে। অরুনিমাকে কোলে নিয়েছিল তখন তার মাথা থেকে রক্ত লেগেছে।সে কিছুক্ষণ রক্তের দিকে তাকিয়ে থাকলো। তারপর কি ভেবে ইমন বলে হাঁক ছাড়লো।
চলবে….