রিটেক পর্ব-২৬+২৭

0
155

#রিটেক
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:২৬

আসমা এবং নীরবের বিয়ের দিন ধার্য করা হয়েছে। আগামী পরশু কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ে হবে। আসমার অনুরোধে এঙ্গেজমেন্ট বা এই জাতীয় কোনো আয়োজন করা থেকে বিরত থাকলেন দুই পক্ষই। তবে হোসনে আরা আসমাকে ফোন দিয়েছিলেন। হবু শাশুড়ির সাথে যথা সম্ভব আদব বজায় রেখে কথা বলার চেষ্টা করেছে আসমা।
– শুনলাম তুমি কোনো অনুষ্ঠান করতে চাও না?
– অনুষ্ঠান করতে চাই না বিষয়টা আসলে এমন না। এঙ্গেজমেন্ট বা এই জাতীয় যেসব প্রোগ্রামের চল হয়েছে সেটা কোনোটাই আমাদের ধর্মের সাথে যায় না। আপনিই বলুন। আপনাদের সময়ে আংটি বদল, গায়ে হলুদ এসব নিয়ে এত বাড়াবাড়ি হয়েছে?
– না। যা করতাম নিজেরা নিজেরা।
– জি সেটাই বলতে চাচ্ছি। আর এসব করলে মূলত বিয়ের বরকত কমে যায়। আপনারা কি চাইবেন নতুন জীবনের শুরুটাই আমরা বরকত ছাড়া করি?
আসমা মেপে মেপে কথা বলল। চাইলে এই বিষয় নিয়ে আরো অনেক কিছু বলা যায়। কিন্তু হোসনে আরা যেনো মনে না করেন আসমা তাকে জ্ঞান দিচ্ছে বা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছে। সে জন্যই এভাবে বলা।

গম্ভীর মুখে হলেও হোসনে আরা সায় দিয়েছেন। আত্মীয় মহলের শুভাকাঙ্খীরা তার চোখ খুলে দিতে ভোলেনি। মুখ ঝামটা দিয়ে বলে গেছে,
– বুঝি না? মেয়ে মাগনা পার করার ধান্দা। তুমি আংটি দিসো। ওরা তোমার ছেলেরে কি দিসে? দেখবা বিয়ার সময়ও কিছু দিবে না।
হোসনে আরা কিছু বলেন না। মুখ ভার করে বসে থাকেন।
তবে বিয়ের দিন সকলের চটক ভাঙলো। কমিউনিটি সেন্টারে কনের জন্য বরাদ্দ করা রুমে বউয়ের সাজে বসে আছে আসমা। তার গায়ের দিকে তাকিয়ে যেনো মহিলা সমিতির চোখ ধাঁধিয়ে গেলো। গা ভর্তি গহনা। আলিমা বেগম ছোটো ছোটো করে যা জমিয়েছিলেন সবটা মেয়ের জন্য দিয়ে দিয়েছেন। দশটা না পাঁচটা না তার একটা মাত্র মেয়ে বলে কথা। একটু পর যখন নীরব মায়ের কাছে এলো তখন তিনি নিশ্চিত হলেন মেয়ের বাবা মা নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী সব করার চেষ্টা করেছে। এরপর আর মুখ ভার করে থাকা চলে না।
– মা এটা রাখো তো।
– কই থেকে পাইলি?
আংটিটা নেড়েচেড়ে দেখলেন হোসনে আরা।
– আসমার বাবা দিলো। ছেলেদের তো সোনা পড়া নিষেধ তাই এই রিং দিলো।
– কিসের রে এটা?
– ডায়মন্ডের।
– হীরা! তা তুই পড়ছিস না কেনো?
– কেমন মেয়েদের জিনিসের মত। আমি পড়বো না। তুমি রেখে দাও তো।

চলে গেলো নীরব। হোসনে আরার বুকের পাথর নামলো।
আসরের একটু আগে বিয়ে পড়ানো হয় গেলো। বাবা মায়ের বুক ফাঁকা করে দিয়ে আসমা পাড়ি জমালো নতুন জীবনে।

কমিউনিটি সেন্টার থেকে বেরিয়ে এলো রূপা। তার পড়নে গাঢ় সবুজ রঙের নতুন একটা বোরখা। প্লেইন বোরখার সাথে একই রঙের হিজাব। কেয়া আজ তাকে দেখে যারপরনাই অবাক হয়েছে।
– কি রে রূপা! আজও তুই সাজলি না?
– আমার সাজ বলতে কাজল আর লিপস্টিক। তো সাজবো কার জন্য? কাকে দেখাবো? নাকি দাওয়াত খেতে আসা সবাইকে ফ্রিতে নিজের সৌন্দর্য বিলিয়ে দেবো?
কেয়া কথা বলার ভাষা খুঁজে পায়নি। তবে অর্পি রূপার ঘাড়ে হাত রেখে বলেছিলো,
– তুই তো পুরাই চেঞ্জড রূপা! আর এত ঝাক্কাস উত্তর পাস কই থেকে? আমারও সেই খনির সন্ধান দে।
কিছু বলেনি রূপা। মুচকি হেসেছিলো শুধু।

রূপার পুরো পরিবার এসেছিল আজকের দাওয়াতে। কামরুন্নাহারের শরীর খারাপ লাগছিল তাই খাওয়ার পরপরই তিনি তমাকে নিয়ে ফিরে গেছেন। রিমন আশঙ্কা করছিলো কামরুন্নাহারের শরীর বেশি খারাপ হতে পারে। তাই একটু পরে সেও ফিরে গেছে। এই পড়ন্ত বিকেলে রূপা একা। একটা রিকশার আশায় দাঁড়িয়ে আছে। তখনই রাস্তার অপর দিকে চোখ পড়ল। শেলী চা বিক্রি করছে। একটা ঝুড়িতে কিছু পানির বোতলও দেখা যাচ্ছে। খুশিতে চনমনিয়ে উঠলো রূপার মন। তখনই খেয়াল করলো এটা সেদিনের সেই রাস্তা। এপাশ থেকেই হাঁক ছাড়লো রূপা।
– শেলী!
চট করে মুখ তুলে তাকালো শেলী। রূপাকে দেখতে পেয়ে খদ্দের ভুলে ছুটে এলো। তবে অসতর্কতার ফল হাতেনাতে পেলো। এপাশ থেকে আসতে থাকা চলন্ত এক মোটরসাইকেলের সাথে ধাক্কা খেল শেলী। হতভম্ব হয়ে গেলো রূপা। মানুষের চিৎকারে রূপার ধ্যান ভাঙলো। দৌড়ে গেলো সে। ততক্ষণে শেলী অজ্ঞান হয়ে গেছে। মাথার আঘাতপ্রাপ্ত স্থান থেকে গলগল করে র-ক্ত পড়ছে। মুহূর্তের জন্য রূপার মাথা শূন্য হয়ে গেলো। কি করবে বুঝতে পারল না রূপা। সেই ক্ষণে হাল ধরলো ফাহাদ। নীরবের সাথে তার যাওয়ার কথা থাকলেও জরুরী কাজে আটকা পড়ে গিয়েছিল সে। রাস্তায় এমন ভিড় দেখে এগিয়ে এসে রূপাকে সেখানে পেল।
– কি হয়েছে?
ফাহাদের কণ্ঠে তার দিকে তাকালো রূপা। শেলীর দিকে তাকিয়ে খুব কষ্টে বলল,
– শে..শেলী!
ঘটনা বুঝতে ফাহাদের দুই সেকেন্ড লাগলো। তারপর ঝট করে শেলীকে কোলে তুলে নিলো সে। দ্রুত উঠে বলল,
– ভাই সাহেব! এই মেয়েটি আমার পরিচিত। আমি ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। রূপা দ্রুত আসুন।
পথচারীরা তেমন কৌতূহল দেখালো না। একজন পথশিশুর প্রতি কারো বাড়তি কৌতূহল নেই। রূপা উঠে আগে শেলীর চায়ের বাক্সের কাছে গেলো। সেটা নিয়ে তাকে আসতে দেখে ফাহাদ বলল,
– এটা এনেছেন কেনো?
– এটা শেলীর। রেখে গেলে চুরি হয়ে যাবে না?
– আচ্ছা উঠুন।
ঠিক করা সি এন জিতে উঠলো দুজনেই। ফাহাদের কোলে শেলী। শেলীর মাথার র-ক্তে ফাহাদের বুকের কাছে শার্ট ভিজে চপচপ করছে। রূপা কাঁদতে পারছে না। তার শ্বাস আটকে আটকে আসছে। পরিবেশ হালকা করার জন্য ফাহাদ বলল,
– এই সাহস নিয়ে আপনি মেডিকেলে ভর্তি হয়েছেন কেনো?
রূপা লজ্জিত হলো। কোনো উত্তর দিলো না। কিন্তু রূপাকে স্বাভাবিক করতে কথা চালিয়ে যাওয়া দরকার।
– আপনার কি ব্লা-ডফোবিয়া আছে?
– না।
– ওকে দেখে থম মে-রে গেছিলেন কেনো? আপনার তো চটপট সিদ্ধান্তে পৌঁছানো উচিৎ ছিল।
– ক্রিটিকাল মোমেন্টে আমার ব্রেন দ্রুত কাজ করতে পারে না। স্বাভাবিকের থেকে তখন আরো বেশি স্লো হয়ে যাই আমি।
ব্যাগে থাকা অতিরিক্ত ওড়না দিয়ে শেলীর মাথা পেঁচিয়ে দিয়েছে রূপা। বিড়বিড় করে চলেছে সে,
– কত র-ক্ত পড়ে গেলো! আল্লাহ। হাসপাতাল আর কত দূরে?
ফাহাদ কোনো কথা বলল না। রূপা মানসিক চাপে এমন ব্যবহার করছে। হাসপাতালের সামনে গাড়ি থামতেই দুজনে নেমে দাঁড়ালো। ফাহাদ বলল,
– ভাড়াটা দিন। আমি তো টাকা বের করতে পারছি না।
তটস্থ হলো রূপা। তড়িঘড়ি করে ব্যাগ থেকে টাকা বের করে দিলো। ইমারজেন্সি ইউনিটে ছুটতেই কর্মরত ডাক্তার তাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেলেন। মিনিট পনেরোর মাঝে বের হয়ে বললেন,
– এবি পজেটিভ র-ক্ত লাগবে। আধা ঘণ্টার ভেতরে ম্যানেজ করুন।
ব্লাড ব্যাংকে যোগাযোগ করলো রূপা। সেখানে পাওয়া গেলো না। ফোন হাতে দাঁড়িয়ে থাকলো সে। ফাহাদ দেখলো রূপার হাত থরথর করে কাঁপছে। অনবরত কথা বলে চলেছে সে,
– আশ্চর্য! এতো কমন একটা গ্রুপ কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। কি অদ্ভুত!
ডাক্তার এসে আরেকবার তাগাদা দিয়ে গেলো। ফাহাদ নিজেও চেষ্টা করেছে। তেমন কাউকে পায়নি। কি মনে হতেই অস্থিরভাবে পায়চারি করতে থাকা রূপাকে বলল,
– আপনার ব্লা-ড গ্রুপ কি রূপা?
হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে পড়ল রূপা। চোখ বড় বড় করে বলল,
– আমার..আমার এবি পজেটিভ। আশ্চর্য!
বলে আর এক সেকেন্ডও দাঁড়ালো না সে। দরজা খুলে অপারেশন থিয়েটারের ভেতরে ঢুকে গেলো। ফাহাদ হাঁফ ছেড়ে বেঞ্চে বসলো। হাত ঘড়িতে সময় দেখলো এবং কি মনে হতেই হাসপাতাল থেকে বের হয়ে গেলো।
প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরে বের হলো রূপা। ডাক্তার তাকে আশ্বস্ত করেছে। শেলীর জ্ঞান কিছুক্ষণের মাঝে ফিরবে আশা করা যায়। শান্ত হয়েছে রূপা। বাইরে এসে বেঞ্চে বসে পড়ল সে। চোখ বন্ধ করে হেলান দিয়ে পড়ে রইলো। কিছুক্ষণ পর ফাহাদের কথা মনে হতেই চারপাশে তাকালো। তাকে দেখতে না পেয়ে আবার চোখ বন্ধ করলো সে।
ঘুমিয়ে গিয়েছিলো রূপা। মাথায় কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে চোখ খুলল সে। শরীরটা বেশ দুর্বল লাগছে। চোখ খুলে পাশে তাকিয়ে দেখলো কামরুন্নাহারের কাছাকাছি বয়সী একজন মহিলা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সোজা হয়ে বসলো সে। বিব্রত বোধ করলো কিছুটা।
– এখন কেমন লাগছে মা?
– আলহামদুলিল্লাহ ভালো।
– আমাকে তো তুমি চেনো না। আমি ফাহাদের মা।
হাসিমুখে বললেন মহিলা।
– ওহ। কেমন আছেন আন্টি?
– আল্লাহ বেশ রেখেছে। তুমি যখন র-ক্ত দিতে গিয়েছিলে ফাহাদ তখন আমাকে আনতে কমিউনিটি সেন্টারে গিয়েছিল। আমি তো আর এদিকের খবর জানিনা। ও নিচে নেমে হঠাৎ উধাও হয়ে গেলো। ফোন করেও পাই না। পরে ওখানে যেয়ে আমাকে সব বলল।
হালকা হাসি দেখা গেলো রূপার ঠোঁটে। কি বলা উচিত বুঝতে পারলো না সে।
– তুমি তো ডাক্তার। ডাক্তারদের এত দুর্বল হলে চলে?
আনোয়ারা বেগম তখনও রূপার মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছে।
– শেলী কেমন আছে আন্টি?
– ভালো আছে। জ্ঞান ফিরেছে ওর। তোমাকে খুঁজছিল। আমি বললাম তোমার আপা ঘুমুচ্ছে। আর কিছু বলেনি। যাও দেখা করে এসো।
শেলীর খবর পেয়ে যেনো রূপার দুর্বলতা অর্ধেক কমে গেলো। উঠতে গেলে আনোয়ারা বেগম বললেন,
– যেতে পারবে মা?
– জি আন্টি পারবো।
ভেতরে ঢুকতেই ফাহাদকে দেখা গেলো। সে গুরুগম্ভীর ভঙ্গিতে শেলীর সাথে গল্প করছে। রূপাকে দেখতেই শেলী বলল,
– আপা কেমুন আছেন?
– এটা আমার শোনার কথা। আর তুই শুনছিস।
ফাহাদ উঠে দাঁড়িয়ে রূপাকে বসার জায়গা দিলো। সেই চেয়ারেই বসলো রূপা।
– আমি একসিডেন কইরাও ফিট আছি। আর আপনেরে দেখেন। আদ আঙ্গুল হইয়া গ্যাছেন।
রূপা হাসলো। মেয়েটাকে কথা বলতে দেখে তার ভালো লাগছে।
– দ্যাখেন কাম। আমার ব্যবসার লাল বাত্তি জইলা গেলো।
– কেনো?
– চা-র বাক্স তো রাস্তায় পইড়া আছে। কুন ছেড়ায় নিসেগা।
– কেউই নিতে পারেনি। তোমার আপা নিয়ে এসেছে।
– সত্য! আপনে তো দেখা যায় জাতে মাতাল তালে ঠিক। আমারে দেইখা অর্ধেক হুশ হারাইলেন। বাকি অর্ধেক হুশ দিয়ে চা-র বাক্স নিয়া আইলেন। কি মগজ আপনের!
ফাহাদ হো হো করে হেসে উঠলো। রূপা দুর্বল শরীর নিয়ে সেই হাসিতে যোগ দিতে না পারলেও তার লজ্জিত মুখশ্রী দৃষ্টিগোচর হলো।

চলমান।

#রিটেক
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:২৭

শেলীকে বাড়িতে দিয়ে এসেছে রূপা। সাথে ফাহাদ এবং তার মা-ও আছে। শেলীকে ওভাবে দেখে তার মা যতোটা না অবাক হয়েছে তার চেয়ে বেশি অবাক হয়েছে রূপা এবং ফাহাদকে দেখে। তার অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে কেউ তার বাড়ি পর্যন্ত যেতে পারে এটা সম্ভবত মহিলার ভাবনার সমুদ্রের বালিতেও ছিল না। বিস্ময়ে কিছুক্ষণ কথাই বলতে পারেননি। কিন্তু যখন বলা শুরু করলেন তখন রূপা এমনকি শেলীও থামাতে পারলো না।
– সর্বনাশ! কারা আইসে আমার বাইত! সর্বনাশ! আপনেরে শেলী আপা কয়। আমি কি কমু? আমারও তো আপা কইতে মন চায়। না না আমি আপাই কমু। শেলী! তুই আইজ থিকা আপারে খালা ডাকবি।
শেলীর মায়ের বয়স রূপার আশপাশে। অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ায় আজ সে দুই সন্তানের জননী। শেলী মুখ কালো করে বলল,
– আমি আগে আপা ডাকছি। আমি ডাক পাল্টামু না।
– আচ্ছা আপনি আমার নাম ধরে ডাকবেন তাহলে হলো।
মধ্যস্থতা করতে বলল রূপা। মহিলা মাথা নাড়লেন।
– ছি ছি! আস্তাগফিরুল্লাহ! আপনেরে নাম ধইরা কেমনে কমু? আপনে জানেন? শেলী ঐ দিন দুইশ ট্যাকার চা বেঁচছে। আমারে আইনা পুরা ট্যাকা দিলো। অর বাপ ম-রা-র পর এই পরথম কুনু লাত্থি গুতা ছাড়া ট্যাকা পাইসি। আল্লাহ আপনের উসিলায় এই রিযিক দিসে। আমার অসনমান আমি কেমনে করি?
চোখ মুছলেন শেলীর মা। রূপা বিব্রত হলো। তার চোখেও পানি।
– আপনি এভাবে ভাবছেন কেনো? এটা ওর ভাগ্যে ছিলো। যেকোনো ভাবে ওর কাছে আসতো।
– কিন্তুক যেকুনু ভাবে আসে নাই। আল্লাহ আপনেরে পাডাইসে। একটু বন। আমি একটু লেবুর শরবত বানাই।

আনোয়ারা বেগম ঘটনা জানতেন না। ফাহাদের মুখে বিস্তারিত শুনলেন। মুগ্ধ চোখে রূপাকে দেখলেন। মেয়েটা লজ্জা পাচ্ছে। ফিরে আসার সময় রূপা শেলীর মায়ের হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিলে তিনি আপত্তি জানানোর সময় পেলেন না।
– না করবেন না। শেলী দুই দিন বিশ্রাম নিক। মাথার আঘাতটা সেরে গেলে তারপর আবার কাজ করবে। ততদিন তো আপনাদের চলতে হবে তাই না? আমার অনুরোধ থাকবে আপনি আর ভিক্ষা করবেন না।
চোখে জল নিয়ে মাথা নাড়েন শেলীর মা। এবার ফাহাদের মা-ও যোগ দিলেন। মুঠো করে তিনিও কিছু টাকা শেলীর মায়ের কাছে দিলেন। সাথে নিজের ফোন নাম্বার।
– যেকোনো দরকারে ফোন দিবা কেমন? সাধ্যমত সাহায্য করার চেষ্টা করবো।
শেলীর মায়ের মন কৃতজ্ঞতায় নুয়ে আসে। আল্লাহ কতগুলো ভালো মানুষের সাথে তার দেখা করিয়ে দিয়েছেন। রূপা লজ্জা পেলো। নাম্বার দেওয়ার কথাটা তার মাথাতেই আসেনি।
তিনজনে একই সি এন জিতে এলো। পথে রূপাকে নামিয়ে দিয়ে গেলো ফাহাদ। আনোয়ারা বেগম রূপার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলেন। কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। বলা ভালো বলতে পারলেন না।

বাড়ির সামনেই নেমেছিল রূপা। বাড়িতে ঢুকেই বুঝতে পারল আসমার বিয়ের বাতাস এখানেও সুগন্ধ ছড়িয়েছে। কিন্তু সেই সুগন্ধটুকু বুক ভরে গ্রহণ করার মতো অবস্থায় সে নেই। আর পাঁচটা মেয়ে মত সে স্বামী সংসারের স্বপ্ন দেখতে পারে না। পারবে না। কিভাবে পারবে? নিজেকে ভ্রষ্টা মনে করে রূপা। এই ভ্রষ্টা মেয়ের সাথে কে ঘর বাঁধবে? চোখ বন্ধ করে বিছানায় পিঠ ছোঁয়ালো রূপা। এ জীবনে সে না পাবে একটা ভরসার কাঁধ আর নাই বা মা ডাকতে পারার মত একটা ছোট্ট মুখ। রূপার বন্ধ চোখের কার্নিশ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। নিজের করা কাজ নিয়ে সে অনুতপ্ত। ভীষণভাবে অনুতপ্ত।

ফাহিমার ডেলিভারি করা হবে। রেগুলার চেকআপে এসেছে সে। সাথে তার স্বামী রাসেল। দুজনে ভেতরে ঢুকতেই ডাক্তার বেশ কিছু টেস্ট করলেন। জানালেন আগামী এক সপ্তাহ পর ডেলিভারি করা হবে। নরমাল হওয়া সম্ভব সে আশ্বাস দিলেন। ফাহিমা ঘামতে লাগলো। বের হতেই তার চোখে জল দেখা গেলো। রাসেল উৎকণ্ঠিত হলো।
– কি হয়েছে ফাহিমা? খারাপ লাগছে?
ফাহিমা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।
– আমার অনেক ভয় লাগছে।
ফাহিমার হাত শক্ত করে ধরলো রাসেল।
– আল্লহ ভরসা। কোনো ভয় নেই।
ভয় নেই এই কথা মুখে বললেও রাসেলের বুকটা দুরুদুরু করে কাঁপছে। আরেকদিকে মুখ ফিরিয়ে চোখ মুছলো সে। ফাহিমা তো ভয়ের কথা তাকে বলেছে সে বলবে কাকে?
চোখ ভিজে উঠলো রূপার। চোখের সামনে এমন ঘটনা প্রত্যহ দেখে সে। তবুও অশ্রু নামবেই। চলে যাওয়া দম্পতির দিকে তাকিয়ে তাদের সুস্থ জীবন এবং একটা সুস্থ শিশুর জন্য দুআ করলো রূপা। কেবিনের ভেতরে গেলো ম্যামের থেকে পরবর্তী ক্লাসের শিডিউল জানতে। কিন্তু রূপা কি জানে কারো জন্য দুআ করলে দুআকারীর জন্যও ফেরেশতাগণ একই দুআ করেন?

তিন দিনের মাথায় ফাহিমার প্রসব বেদনা হলো। আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে আর্তনাদ করতে করতে সে হাসপাতালে এলো। সাথে রাসেল, ফাহাদ এবং আনোয়ারা বেগম। ফাহাদ এবং আনোয়ারা বেগমকে চিনতে অসুবিধা হলো না রূপার। এগিয়ে যেতেই ঘটনা বুঝতে পারল। ফাহিমাকে যে ডাক্তার পুরোটা সময় গাইড করেছেন তিনি দ্রুত ওটি তৈরি করতে বললেন। ফাহিমার কাছে গেলো রূপা। সে বিড়বিড় করছে,
– আমি সিজার করবো। নরমালের শক্তি আমার নেই।
বারবার একই কথা বলছে সে। রূপা আনোয়ারা বেগমের কাছে গেলো। তিনি বারবার আঁচলে চোখ মুছছেন। চাপা কণ্ঠে রূপা বলল,
– আন্টি আপুকে বোঝান। নরমাল ডেলিভারির স্কোপ থাকতে সি সেকশনে যাওয়া বোকামি।
রূপাকে চিনতে আনোয়ারা বেগমকে বেগ পেতে হলো না। ডুবন্ত সাঁতারু যেনো খড়কুটো পেলো এমনভাবে খপ করে রূপার হাত ধরলেন তিনি। বললেন,
– তুমি একটু বলো মা। আমি ওর সামনে গেলেই তো কেঁদে ফেলবো।
কয়েক পলক ভাবনা চিন্তা করে ফাহিমার কাছে গেলো সে। মুখ নিচু করে ফিসফিসিয়ে কিছু বলল। ফাহিমার কান্নার গড়ি শ্লথ হলো। একসময় তার মুখে যু-দ্ধে প্রস্তুত সৈনিকের মত শক্তি দেখা গেলো। সর এলো রূপা। ফাহাদ বলল,
– আপাকে আপনি কি বললেন?
রহস্য হেসে রূপা বলল,
– বলা যাবে না। সিক্রেট!
পরের দুই ঘণ্টা নির্বিঘ্নে কেঁটে গেলো। ফাহিমার ছেলে হলো। আবার আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ পাওয়া গেলো। এবার শব্দ করে কেঁদে ফেলল রাসেল। ফাহাদ হাসতে হাসতে তার ঘাড়ে চাপড় দিলো।
– আপনারা একটা ফ্যমিলি বটে। প্রথমে মা কান্নাকাটি করে হাসপাতাল কাঁপিয়ে দিলো। তারপর বাচ্চা। এবার বাচ্চার বাবা। দারুন!
চোখে অশ্রু নিয়ে রাসেল হাসলো। কি চমৎকার দেখালো সেই হাসি!

ক্লাস দেরিতে হলেও বেশ সকাল সকালই হাসপাতালে এসেছে রূপা। সোজা রোগীদের কেবিনের দিকে চলে গেলো সে। দরজায় নক করলে আনোয়ারা বেগম খুলে দিলেন। রূপাকে দেখে খুশির সাথে সাথে অবাকও হলেন।
– আসসালামু আলাইকুম আন্টি। কেমন আছেন?
– ওয়ালাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ মা ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?
– আমিও ভালো আছি আলহামদুলিল্লাহ। বাবু আর বাবুর আম্মুর কি অবস্থা?
– এসো ভেতরে এসে দেখে যাও।
ভেতরে ঢুকে হাতের টিফিন ক্যারিয়ার আনোয়ারা বেগমের হাতে দিলো রূপা। আনোয়ারা বেগম যারপরনাই বিস্মিত হলেন।
– এসব কি মা?
– আপনাদের জন্য অল্প কিছু খাবার এনেছি আন্টি।
– এসবের কোনো দরকার ছিল না মা। তুমি শুধু শুধু কষ্ট করলা।
– দরকার ছিল। আমি আসমার থেকে জেনেছি ফাহিমা আপুর শ্বশুর শাশুড়ি নেই। আপনিও এখানে। তাহলে খাবার দাবার কে আনবে? আসমাই আমার আগে চলে আসতো। কিন্তু ও তো নীরব ভাইয়ের সাথে ঘুরতে গেছে। আপনারা আসমার আত্মীয়। সেই হিসেবে আমারও। আবার ফাহাদ ভাই সেদিন আমার যেই উপকার করলেন সেটা তো মেটানোর ক্ষমতা আমার নেই।
আনোয়ারা বেগমের চোখ ভেজা ভেজা লাগছে। রূপার মাথায় হাত দিয়ে তিনি বললেন,
– উপকারের ঋণ মিটাইতে চাও মা?
– না না আন্টি। পুরোপুরি মেটানোর সামর্থ্য আমার নেই। শুধু ঋণের বোঝা হালকা করলাম। বাদ দিন এসব কথা। খেয়ে নিন আপনার দুজনে। আমি বাবুকে কোলে নেই।
ফাহিমা ঘুমিয়ে ছিল। আনোয়ারা বেগম তাকে উঠিয়ে খাইয়ে দিলেন। রূপা বলল,
– আজকেই রিলিজ করে দিতে পারে। আপু আপনার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো?
– না।
হাসিমুখে উত্তর দিলো ফাহিমা।
– রাসেল ভাই বাড়ি গেছে নাকি?
– আর বলো না মা। ও সারারাত এখানেই ছিলো। সকালে ফজর পড়ে ওকে ঠেলেঠুলে পাঠালাম। বললাম গোসল করে একটু খেয়েদেয়ে আসো।
রূপা ছোট্ট প্রাণটার দিকে তাকিয়ে আছে। আনোয়ারা বেগম এবং ফাহিমা ইশারায় কত কথা বলে ফেললেন। রূপা কিছুই বুঝল না।
– আপু বাবুর কি নাম রাখলেন?
– এখনও তো রাখিনি রূপা।
– এখনও রাখেননি? কবে রাখবেন?
– জানিনা গো। ওর বাবা তো মন হয় আধাপাগল হয়ে গেছে। বাড়ি গেলে পুরো পাগল হবে। তুমিই একটা নাম রেখে দাও না।
চমকে উঠলো রূপা। খুশি তার চোখেমুখে দেখা গেলো।
– সত্যি আপু! আমি রাখবো?
– রাখো।
– আচ্ছা আজকে বাসায় যেয়ে নাম খুজবো তারপর আপনাকে জানাবো। ইয়ে আপনার নাম্বারটা দিবেন আপু?
ইতঃস্তত স্বরে বলল রূপা। ফাহিমা নাম্বার দিলো এবং তাকিয়ে তাকিয়ে রূপার খুশি দেখলো। অল্পতেই কি খুশি মেয়েটা!

চলমান।