রূপসাগরে মনের মানুষ পর্ব-০২

0
72

#রূপসাগরে_মনের_মানুষ
লেখিকাঃইশা_আহমেদ
পর্ব_২

মফস্বলের মেয়ে অবনী। ভালো কলেজে মেয়েকে পড়ানোর জন্য শওকত হোসেন গ্রামের জমিজামা বিক্রি করে শহরে পাকা টিনশেডের বাড়ি করেন। এখানেই ছোটখাটো কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেন। চারপাশে দেওয়াল থাকলেও উপরে টিন দেওয়া অবনীদের বাড়িতে। তার শৈশব কেটেছে মফস্বলে। এখন অবশ্য শহুরে জীবন যাবনে অভ্যস্থ হয়ে গিয়েছে। অবনী যখন শহরে আসে তখন তার বয়স মাত্র ষোলো। সেই বয়সেও অবনী ভীষণ ম্যাচিউর। কলেজ জীবন ভীষণ ব্যস্ততায় কাটলো তার। পড়াশোনা, টিউশনি সব মিলিয়ে বসার সময়ও পেতো না। এরপর যখন অনার্সে উঠলো তখনই তার জীবনে ঝড়ো হাওয়ার মতো উদয় হলো মাহাদ। ছেলেটা তাকে ভীষণ ভালোবাসত নাকি, লোক মুখে অনেক পাগলামির কথা শুনেছে অবনী। সে পাত্তা দেয়নি। দীর্ঘ তিন বছর একই কলেজে একই ক্লাসে পড়াশোনা করেছে তারা। মাহাদকে সে ব্যতিত অন্য কেনো মেয়ের দিকে তাকাতেও দেখেনি অবনী। সেই থেকে অনুভূতির জন্ম। সেই অনূভুতি যে আজ এতো গাঢ় রূপ নিবে তা কখনো ভাবেনি অবনী। প্রথম প্রেম কি না! ভীষণ ভালোবাসে কি না মাহাদকে।

অবনী সারাঘর হাতড়ে বাটন ফোনখানা খোঁজার চেষ্টা করলো। একটা বাটন ফোন আছে তার। যদিও সে কথা এতো সময় মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলো তবে এখন মনে পরেছে। অবনী দৌড়ে গিয়ে প্রথমে দরজার ছিটকিনি তুললো। এরপর পাগলের মতো আবারও খোঁজা শুরু করলো। খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেলো এক পর্যায়ে বাটন ফোন খানা। ফোনটা কয়েক বছর আগের। চলে কি না তাতে সন্দেহ আছে। দ্রুত চার্জার খুঁজে চার্জে লাগালো অবনী। বেশ কিছুক্ষণ পর ফোনটা খুললো। ফোনটা খুলতে দেখে অবনীর হৃদয় কিছুটা শান্ত হলো। মাহাদের নাম্বার খানা তুললো, কল করলো নাম্বারে। বুক কাঁপছে ভীষণ তার, ঠোঁট জোড়াও তিরতির করে কাঁপছে। ওপাশ থেকে বেশ কিছুক্ষণ পর রিসিভ হলো। প্রিয় পুরুষের ভাঙা কন্ঠস্বর যেনো তাকে ভেতর থেকে আবারো গভীর ভাবে দুমড়ে মুচড়ে ফেললো। কান্নারা সব বেরিয়ে আসতে চাইলো। অবনী ফোঁপাতে থাকলো। অপর পাশ থেকে মাহাদ বুঝে ফেললো এটা তার প্রিয় নারী। মাহাদ অস্থির কন্ঠে শুধালো,,,

”অবনী তুমি ঠিক আছো? তুমি ঠিক আছো তো পাখি? কথা বলছো না কেনো? কথা বলো সোনা, একটু কথা বলো। তোমার কান্নার আওয়াজ যে আমায় ভেঙে চুড়মার করে দিচ্ছে”

অবনী নিজেকে শান্ত করার প্রচেষ্টা করলো। এরপর ভাঙা ভাঙা গলায় বললো,,,
“তুমি ঠিক আছো তো মাহাদ? নিজের কোনো ক্ষতি করোনি তো? শোনো তুমি ভাইবো না এই অবনী তোমারে ছাইড়া দিবো। আমি তোমারে ভালো যখন বাসছি ছাড়বো না মৃত্যুর আগ অব্দি। তুমি নিজের খেয়াল রাইখো”

“তুমি ঠিক আছো পাখি? কও না ক্যান? আমি চিন্তায় মইরা যাচ্ছিলাম। তুমি ঠিক থাকলেই হইলো। শোনো না আমি তোমারে বিয়া করমু আমি আসি তোমাদের বাড়ি। তোমার আব্বুর সঙ্গে কথা কই? তুমি শোন চিন্তা করবা না। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। তুমি কাঁদতেছো কেনো বোকাপাখি। আমি আছি তো না? কিছু হবে না তো। তুমি শুধু পাশে থাইকো আমার। তাইলেই হবে”

“আমি ঠিক নাই মাহাদ। তোমারে আমার ভীষণ প্রয়োজন। আম্মা একটু আগে আইসাও ঝামেলা কইরা গেছে। মাহাদ চলো পালায় যাই।”

“হুস এমন কথা বলে না পাখি। পালাবো ক্যান! তোমার আব্বু আম্মুরে রাজি কইরা তারপর তোমারে আমার ঘরের বউ করবো। তুমি একটু ধৈর্য ধরো। শোন তুমি ঠিক মতো থাকো। আন্টি যা বলে শোনো। আমি আসমু তোমারে নিতে। একটু অপেক্ষা করো”

“আমার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে মাহাদ। তুমি প্লিজ তাড়াতাড়ি কিছু করো।”

“আচ্ছা পাখি আমি দেখছি কি করা যায়। তুমি খাইছো?”

অবনী সত্যি বলার সাহস পেলো না। সে নিচু কন্ঠে বলল,,“খাইছি আমি। তুমি খাইছো?”

“তুমি মিথ্যা ক্যান বলতিছো পাখি। তুমি জানো না তোমার মিথ্যা আমার কাছে চলে না। শোনো পাখি যাও খাইয়া নাও। একটু অপেক্ষা করো তোমারে আমি আমার করবোই। এখন ফোন লুকাইয়া যাও খেয়ে আসো”

“আচ্ছা তুমি ঠিক মতো থাইকো। আমি এখন রাখছি।”

অবনী কল কেটে ফোন খানা লুকিয়ে ফেললো। দরজা খুলে সোজা খাবার টেবিলে গিয়ে একটা প্লেটে ভাত আর তরকারি নিয়ে নিজের রুমে চলে আসলো। দরজা আবারও ভেতর থেকে বন্ধ করে দিলো। তার মা হয়তো রাগের যাতনায় ভুলে দরজা খুলে গিয়েছিলো। তা বেশ ভালোই হয়েছে। ক্ষিদেটা খাবার দেখে আরও চওড়া হলো। অবনী কোনো কিছু না ভেবে খাওয়া শুরু করলো। মিনিট দশকের মাঝে খাওয়া শেষ করলো সে। এখন একটু ঘুমানো প্রয়োজন। ঘড়ির দিকে চোখ পরতেই দেখলো সবে সাড়ে আটটা বাজে। সে বিছানায় টান টান হয়ে শুয়ে পরলো। গতকাল থেকে ঠিকমতো ঘুমায়নি সে। এখন ঘুমানো প্রয়োজন।

ঘনকালো মেঘে ছেয়ে গিয়েছে রাতের আকাশ। দমকা হাওয়া বইছে। আকাশে কিছুক্ষণ পর পর আলোর রশ্মির দেখা মিলছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। টং দোকানের বেঞ্চিতে বসে আছে ছয় বন্ধু। সবার হাতেই এক কাপ চা। সবাই অজানা উদ্দেশ্যে হারিয়ে গেলেও তার মাঝে ফোন আসে অবনীর। অবনীর সাথে কথা বলার পর মাহাদের মনটা আবারও খারাপ হয়ে গিয়েছে। একদিকে ভালো ও লাগছে, আবার খারাপ ও লাগছে। তবুও কিছু সময় তো কথা বলেছে সে, এই কি অনেক নয়? আপাতত এটাই অনেক তার জন্য। হঠাৎ করেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হলো। কেউ কেউ দ্রুত নিজেদের গন্তব্যতে ছুটতে লাগলো, তো কেউ বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে ছাউনি খুঁজতে লাগলো। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হঠাৎই পরিনত হলো ঝুম বৃষ্টিতে। মাহাদ আনমনে হেঁটে রাস্তার মাঝে চলে গেলো। ছন্নছাড়ার মতো দাঁড়িয়ে রইলো। কিছুক্ষণের মাঝেই ভিজে একাকার হলো। বেশ কিছুক্ষণ কাটলো সেভাবে। ইমাদ এবার এগিয়ে আসলো। ঘন্টা দেড়েকের মতো ভিজছে মাহাদ। খুব বেশিক্ষণ ভিজলে জ্বর আসবে নির্ঘাত।

ইমাদ টেনে এনে বাইকের পেছনে বসালো মাহাদকে। বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে বললো,,,
“বাড়িতে যা। ঝামেলা করিস না আর। অবনী এবার খুব রেগে যাবে তোর এই কান্ড গুলোর কথা শুনলে। নিজেকে সুস্থ রাখ। মেয়েটা তোর জন্য লড়ছে ওর পুরো পরিবারের সাথে, তোর কি উচিত না ওর জন্য হলেও ভালো থাকা?”

মাহাদ শুনলো বোধ হয়। ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে ঢুলতে ঢুলতে এগিয়ে গেলো। দোতলা বেয়ে নিজ ফ্ল্যাটের সামনে এসে কাঁপা কাঁপা হাতে কলিংবেল বাজালো। মিনিট দু’য়েক পর দরজা খুললো মাহাদের মা নাহিদা সুলতানা দরজা খুললেন। ছেলের অবস্থা দেখে তিনি থমকে গেলেন। একমাত্র ছেলে তাদের। নাহিদা সুলতানা অস্থির হয়ে পরলেন। ছেলেকে ধরে ভেতরে নিয়ে আসেন।

“মাহাদ এই অবস্থা ক্যান তোর? তুই ওই মেয়ের জন্য নিজের ক্ষতি কেনো করছিস? এমন করিস না বাপ”

“আম্মা দয়া করে এখন চুপ করো। ওরে আমি যখন ভালোবাসি ওর জন্য সব করতে রাজি আমি। দরকার হয় ওর বাপের পায় ধরবো তবুও ওরেই আমার লাগবে”

“মাহাদ এই রকম করিস না। ওর বাপ মানবে না। তুই আর ও এক বয়সই, কি করে খাওয়াবি ওরে? বাপের টাকায় বউ খাওয়াবি?”

“নাহ। আমার বউরে আমি চালাইতে পারবো। তোমাদের সমস্যা থাকলে বইলো চইলে যাবো আমি আমার বউরে নিয়ে”

নাহিদা বেগম কিছুটা রাগ হলেন। রাগান্বিত কন্ঠে বললেন,,,
“থাপ্পড় দিবো বেয়াদব। মা বাবাকে ছাড়বে তুমি। দেখ মাহাদ এমন করে নিজের ক্ষতি করিস না আব্বা। তোর জন্য আমরা আরো সুন্দরী মেয়ে খুঁজে আনবো”

“আম্মা তুমি যদি বিশ্বের সব থেকে সুন্দরী মেয়েকেও এনে দাও না তবুও আমি অবনীরেই বেছে নিবো। আমি ওরে ভালোবাসি আম্মা। ভালোবাসা সবার প্রতি আসে না আর যার প্রতি আসে তারে ছাড়া যায় না। ওরে ছাড়া যে আমার দিবস কাটে বিবশ হয়ে।”

“মাহাদ আব্বু একটু বোঝ অবনীর পরিবার মানবে না”

“না মানুক। ওরে নিয়ে আসবো আমি আমার কাছে। তুইলে আনবো দরকার হয়। তবুও আমার ওরেই লাগবে। আম্মা তুমি বলো না আমার সাথে কেনো এমন হচ্ছে, আমি তো ভীষণ ভালোবাসি অবনীরে তবুও কেনো ওরে পাওয়ার লাইগা আমার এমন ছটফট করতে হচ্ছে। আমার মধ্যে কিসের কমতি আম্মা? যে ওর বাপ মা এমন করছে?”

“আব্বা তুই এখন এই সব ছাড়। চল গোসল করবি। ভেজা কাপড়ে বেশিক্ষণ থাকলে ঠান্ডা লাগবে। অবনীর কথা বাদ দে এখন”

মাহাদ হাঁটু গেঁড়ে নিচে বসে পরলো। যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে বলল,,,“আম্মা ও আম্মা আমার না খুব কষ্ট হচ্ছে। ক্যান হচ্ছে কও না। অবনীরে ছাড়া আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আম্মা। ওরে আইনে দেও আম্মা দয়া কইরে। ও অন্য কারো হইলে আমি সহ্য করতে পারবো না আম্মা। মইরা যাবো আমি”

#চলবে~