লাল নীল সংসার পর্ব-১৫+১৬

0
213

#_লাল_নীল_সংসার_
#_মারিয়া_রশিদ_
#_পর্ব_১৫_

চারিদিকে অন্ধকার হলেও রাস্তার পাশে ল্যাম্পপোস্ট থাকায় চারিদিকে আলোকিত হয়ে আছে। ছোয়া আর শিশির দাঁড়িয়ে আছে সামনের দিকে তাকিয়ে। একটা মাঠে দাঁড়িয়ে আছে দুইজনে। ছোয়ার বাসার পাশেই একটা বড় মাঠ। সেই মাঠে দাড়িয়ে আছে দুইজন।

মাঠ বড় হওয়ায় রাস্তার আলো সম্পুর্ন আলোকিত করতে পারে নি। মাঠের যে পাশে হালকা আলোকিত সেই পাশে দাড়িয়ে আছে ছোয়া আর শিশির। সামনের জমাট বাঁধা অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছে দুইজনে। ছোয়ার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়েই যাচ্ছে। শিশির একভাবে তাকিয়ে আছে অন্ধকারের দিকে। ছোয়া চোখ মুছে নিজেকে একটু স্বাভাবিক করে শিশিরের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–” আমাকে এভাবে আটকিয়ে রাখার মানে কি? বাসায় মাকে বলে আসিনি, চিন্তা করবে।”

শিশির ছোয়ার দিকে ঘুরে দাড়ায়। ছোয়া শিশিরের দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নিচু করে ফেলে। শিশির ছোয়ার দিকে তাকিয়ে জোর গলায় বলে ওঠে,
–” ছোয়া! আজ আমাকে সব টাহ ক্লিয়ার নাহ করা পর্যন্ত তোমাকে আমি এখান থেকে যেতে দিবো নাহ।”

ছোয়া একপলক শিশিরের দিকে তাকিয়ে আবার অন্য দিকে তাকায়। তারপর বলে ওঠে,
–” কিসের ক্লিয়ার? আপনি আমাকে ভালোবেসেছেন জন্য কি আমাকেও আপনাকে ভালোবাসতে হবে?”

–” একদমই নাহ! যদি ব্যাপার টাহ এমন হতো, যে তুমি আমাকে ভালোবাসো নাহ,, তাহলে আমি কিছু বলতাম নাহ। কিন্তু,, তুমি তো আমাকে ভালোবাসো।”

–” ভালোবাসি নাহ আমি আপনাকে,, কেন বুঝছেন নাহ?”

শিশির ছোয়ার কাধে হাত দিয়ে ঝাকিয়ে রাগী গলায় বলে ওঠে,
–” সেইদিনও তোমার একই কথা শুনেছি ছোয়া! কেন করছো এমন? কি অন্যায় করেছি আমি? আমাকে এরকম ভাবে কষ্ট দিচ্ছো কেন? নিজেও কষ্ট পাচ্ছো আর আমাকেও কষ্ট দিচ্ছো, কেন? ছোয়া! তুমি নিজেও জানো, তুমি আমাকে ভালোবাসো। তাহলে,, কেন দুরে সরে যাচ্ছো আমার থেকে? আমি কি তোমার যোগ্য নাহ? আমি কি তোমাকে একটুও ভালো রাখতে পারবো নাহ? তোমার মনে কি আমার জন্য একটুও জায়গা নেই, ছোয়া? বলো না প্লিজ!”

শিশিরের চোখ বেয়ে কয়েক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ে। ছোয়া কাঁধ থেকে শিশিরের হাত সরিয়ে একটু দুরে সরে গিয়ে মুখ চেপে কান্না করতে থাকে। শিশিরের যেন সহ্য হচ্ছে নাহ ছোয়ার এই কান্না। ছোয়ার কান্না যেন শিশিরের মনে তীব্র যন্ত্রণার সৃষ্টি করছে।

শিশির ছোয়ার দিকে এগিয়ে যেতেই ছোয়া কয়েক পা পিছিয়ে যায়,, থেমে যায় শিশির। অবাক হয়ে ছোয়ার দিকে তাকিয়ে আছে শিশির। ছোয়া শিশিরের দিকে তাকিয়ে কান্নারত অবস্থায় বলে ওঠে,
–” কেন আমার জীবনের সাথে নিজেকে জড়াচ্ছেন? আমার সাথে নিজেকে জড়াবেন নাহ প্লিজ। তাহলে আপনার ক্ষতি হয়ে যাবে। আমার সাথে যে নিজেকে জড়াবে তার ক্ষতি হয়ে যাবে। কারন,, আমি বিষকন্যা!”

শিশির ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে ছোয়ার দিকে। ছোয়ার কথার কোনো মানেই সে বুঝছে নাহ। ছোয়ার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–” বিষকন্যা মানে?”

ছোয়া চোখ মুছে শিশিরের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–” হ্যা! আরও একটা কথা জেনে রাখুন মি. শিশির! আমার বিয়ে আরও তিনবছর আগে হয়ে গেছে।”

ছোয়ার কথা শুনে শিশির এক পা পিছিয়ে আসে। তার মায়াবী কন্যা বিবাহিত? সে অন্য একজনের? শিশির থমথমে গলায় বলে ওঠে,
–” ছো ছোয়া! কিক কি বলছো তুমি এইসব?”

ছোয়া একইভাবে বলে ওঠে,
–” ঠিকই বলছি। আমার বিয়ে হয়ে গেছে।”

শিশিরের মনে হচ্ছে পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। ছোয়া অন্য কারো ভাবতেই শিশিরের দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শিশির থমথমে গলায় বলে ওঠে,
–” তোমার হাসবেন্ড কোথায়?”

ছোয়া এক পলক শিশিরের দিকে তাকিয়ে আবার অন্যদিকে তাকায়। তারপর ছলছল চোখে নিয়ে বলে ওঠে,
–” মারা গেছে।”

শিশির ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে ছোয়ার দিকে। ছোয়ার কোনো কথায় যেন তার মাথায় আটছে নাহ। ছোয়ার সব কথায় যেন তার মাথায় তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। শিশির কিছু সময় চুপ করে থেকে বলে ওঠে,
–” ছোয়া আমি তোমার কথা কিছুই বুঝছি নাহ। কি বলছো তুমি এইসব? আমি কিছুই বুঝতে পারছি নাহ। আমার মাথায় আটছে নাহ কিছু।”

ছোয়া নিজের চোখ মুছে বলে ওঠে,
–” আমি যখন ইন্টার ফাস্ট ইয়ারে পড়ি, তখন আমার বিয়ে হয়। আমার বাবার বন্ধুর ছেলের সাথে। আমার বাবা একটু অসুস্থ ছিলেন, তাই ভালো ছেলে পেয়ে হাত ছাড়া করেন নি। আর আমিও আমার বাবার সিদ্ধান্তের বাইরে কোনো কথা বলতে পারি নি। তাই ছোট্ট বয়স হলেও বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলাম। তারাও বলেছিলো,, আমাকে পড়াশোনা করাবে। তাই বাবা আরও বেশি রাজি ছিলো। কিন্তু,, যেদিন আমার বিয়ে হয়,, নবদম্পতির গাড়ি রাতের আধার দিয়ে ছুটে চলছে। এমন সময় সেই নবদম্পতির গাড়ির এক্সিডেন্ট হয়। আর তাতে মারা যায় সদ্য বিয়ে করা স্বামী।”

কথা গুলো বলতে বলতে কান্না করে ফেলে ছোয়া। শিশিরের যেন বিশ্বাসই হচ্ছে নাহ। সব কিছু স্তব্ধ লাগছে তার। ছোয়া কান্নারত অবস্থায় আবার বলে ওঠে,
–” সেই এক্সিডেন্টে আমার স্বামীর মৃত্যু হলেও, আমি ছিলাম সুস্থ। একদম ঠিক ছিলাম। তাই আমি মানুষের চোখে হয়ে গেলাম বিষকন্যা। যে শুধু মানুষের ক্ষতি বয়ে আনে। আমাকে বিয়ে করলেই আমার স্বামী মারা যাবে,, এমনটাই ধারনা সবার। আমার সাথে কেউ মিশতে চাইতো নাহ। রাস্তা দিয়ে আমার পরিবারের কেউ চলাচল করতে পারতো নাহ। আমার বাবাকে বিষকন্যার জন্মদাতা পিতা বলে অপমান করতো। আমার মা, ভাই কাউকে বাদ দিতো নাহ অপমান করতে। তার একমাসের মাথায় আমার বাবা স্টোক করে মারা যায়।”

অঝোরে কান্না করছে ছোয়া৷ শিশির নিজের চোখ বন্ধ করে ফেলে। শিশিরের চোখের কোণা বেয়ে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। ছোয়া আবার বলে ওঠে,
–” আমার বাবা মারা যাওয়ার পর,, গ্রামের মানুষজন আরও চাপিয়ে দিতে শুরু করলো আমাদের। নিজের সদ্য বিয়ে করা স্বামীর মৃত্যু,, এক মাসের মাথায় বাবার মৃত্যু,, শেষ করে দিয়েছে আমাকে। আমি পাগল পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। তারপরে আমার আম্মা,, গ্রামে আমাদের যা যা ছিলো সব বিক্রি করে দেয়। আর ঢাকায় এই বাড়ি টাহ কিনে নেয়। বাবার পেনশিয়ানের টাকা ব্যাংকে জমা করে। এইটাই আমার জীবন।”

শিশির যেন কোনো কিছু বলার শক্তি পাচ্ছে নাহ। কি বলবে সে? এই মেয়েটা তার ছোট্ট জীবনে কতো কি ভোগ করেছে। ছোয়া চোখ মুছে শিশিরের সামনে দাড়িয়ে হেঁচকি তুলতে তুলতে বলে ওঠে,
–” আমি আপনাকে আমার জীবনে জড়িয়ে,, আপনাকে বিপদে ফেলতে পারবো নাহ। সবাই বলে,, আমার সাথে যার বিয়ে হবে,, সেই নাকি মারা যাবে। আমি আর সহ্য করতে পারবো নাহ। আর আপনার ক্ষতি হবে,, এইটা তো আমার কল্পনাতেও আসে নাহ। আমি সহ্য করতে পারবো নাহ। দয়া করে আমার এই বিষাক্ত জীবনের সাথে নিজের ফুলের মতো জীবনকে জড়িয়ে বিষিয়ে তুলবেন নাহ প্লিজ। আমি হাত জোর করছি,, ভুলে যান আমাকে। আমি সহ্য করতে পারবো নাহ আপনার ক্ষতি। আমার অনুভুতি কে চাপিয়ে রাখতে দেন প্লিজ! আমি সব সময় আল্লাহর কাছে দোয়া করি,, আপনি যেন ভালো থাকেন। সুস্থ থাকেন। সেখানে নিজের এই বিষাক্ত জীবনের সাথে,, আপনার এতো সুন্দর জীবনকে জড়িয়ে নষ্ট হতে দেই কিভাবে? পারবো নাহ আমি। চলে যান প্লিজ! ভুলে যান আমাকে। চলে যান। প্লিজ চলে যান।”

কথাগুলে বলে কান্না করতে করতে দৌড়ে চলে যায় ছোয়া। শিশির ছোয়ার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। শিশির নিজের চোখ মুছে নেয়। চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস নেয় কয়েকবার। তারপর চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে চলে যাওয়ার জন্য হাঁটতে থাকে। কিছুদুর গিয়ে,, আবার পিছন ফিরে ছোয়ার বাসার দিকে তাকায় শিশির। তারপর আবার সামনে ঘুরে তাড়াতাড়ি হেঁটে চলে যায়।

এইদিকে…..
ছোয়া নিজের ঘরে ঢুকতেই থমকে দাঁড়িয়ে যায়। কারন,, তার সামনে দাড়িয়ে আছে তার মা মিসেস. কেয়া। ছোয়া তাড়াতাড়ি নিজের চোখ মুছে নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। মিসেস. কেয়া ছোয়ার দিকে এগিয়ে আসে। মাকে এরকম ভাবে নিজের সামনে দেখে ছোয়া একটু নার্ভাস ফিল করে। মিসেস. কেয়া ছোয়ার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলে ওঠে,
–” ছেলেটা কে ছিলো ছোয়া?”

মায়ের কথা শুনে চমকে উঠে ছোয়া। তাহলে কি তার মা শিশিরকে দেখে ফেলেছে। ছোয়া মিসেস. কেয়ার দিকে তাকিয়ে হালকা কম্পিতে কন্ঠে বলে ওঠে,
–” কোন ছেলে আম্মা?”

–” তুই নিজেও জানিস আমি কার কথা বলছি।”

ছোয়া একটু আমতা আমতা করে বলে ওঠে,
–” বন্ধু ছিলো আম্মা!”

মিসেস. কেয়া হালকা ভ্রু কুচকিয়ে বলে ওঠে,
–” বন্ধু? তাহলে,, এইভাবে কান্না করতে করতে ঘরে আসলি কেন? কি লুকাতে চাইছিস তুই?”

ছোয়া ছলছল চোখে মায়ের দিকে তাকায়। মিসেস. কেয়া ছোয়ার কাছ এগিয়ে আসে। তারপর ছোয়ার মুখে হাত রেখে বলে ওঠে,
–” কি হয়েছে মা তোর? কয়েকদিন ধরেই দেখছি,, তুই ভালো নেই। আর আজ…। কি হয়েছে? বল মা। আম্মাকে বলবি নাহ।”

মায়ের এমন দরদ ভরা কন্ঠে নিজেকে সামলাতে পারে নাহ ছোয়া। মিসেস. কেয়া কে জড়িয়ে ধরে কান্না করে উঠে ছোয়া। মিসেস. কেয়া নিজের মেয়ে কে শক্ত করে নিজের সাথে চেপে ধরে। এই দুনিয়ায় যে তার এই দুই সন্তান ছাড়া আর কেউ নেই। আর সন্তানের কষ্ট কোনো মা যে সহ্য করতে পারে নাহ। আর মিসেস. কেয়ার ব্যাপার তো আরও আলাদা।

মিসেস. কেয়া ছোয়াকে সোফার উপর বসায়। এ গ্লাস পানি এনে ছোয়াকে খাইয়ে দেয়। ছোয়াকে শান্ত করতে থাকে। ছোয়া একটু স্বাভাবিক হয়ে আসে। তারপর মিসেস. কেয়া বলে ওঠে,
–” এখন বলতো সোনা,, কি হয়েছে তোর?”

ছোয়া মিসেস. কেয়াকে শিশিরের সাথে প্রথম দিন থেকে দেখা হওয়া শুরু করে আজ পর্যন্ত হওয়া সবকিছু বলে দেয়। মিসেস. কেয়া ছলছল চোখ নিয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। কতাে কষ্ট পাচ্ছে তার মেয়েটা। আর তিনি কি নাহ বুঝতেই পারলো নাহ। মিসেস. কেয়া ছোয়াকে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে বলে ওঠে,
–” একটা সত্যি কথা বলতো সোনা,, তুই কি শিশিরকে ভালোবাসিস?”

ছোয়া ছলছল চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–” হ্যা! আম্মা! খুব ভালোবাসি শিশিরকে। কিন্তু,, আমি যে তার ক্ষতি করতে পারবো নাহ। আমার জন্য শিশিরের কোনো ক্ষতি হলে,, আমি নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবো নাহ। শেষ হয়ে যাবো আমি। সহ্য করতে পারবো নাহ।”

আহিয়া রহমানও ছলছল চোখে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–” আমি জানি,, মা,, তোর অতিত টাহ অনেক ভয়ংকর ছিলো। অনেক ছোট্ট বয়সে অনেক ধকল নিতে হয়েছে তোকে। কিন্তু,, সোনা,, তোর তো একটা জীবন আছে। তুই কি সারাজীবন…….”

কথা শেষ করতে পারেন নাহ মিসেস. কেয়া। তার আগেই ছোয়া বলে ওঠে,
–” কখনো নাহ আম্মা! আমার জীবন বিষাক্ত। আর আমি আমার জীবনে,, কাউকে আনতে চাই নাহ। আমার জন্য কারোর জীবন বিপদাপন্ন হোক,, আমি চাই নাহ। আর আমি শিশিরকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবো,, এইটা কল্পনাও করতে পারি নাহ। আবার শিশিরের জীবনকে রিস্কেও ফেলতে পারবো নাহ। আমি শুধু শিশিরের স্মৃতি গুলো নিয়ে বাঁচতে চাই আম্মা! আর কিছু নাহ।”

কথাগুলো বলে ছোয়া কান্না করতে করতে নিজের রুমে চলে যায়। মিসেস. কেয়া মেয়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চোখ দিয়েও পানি গড়িয়ে পড়ছে। মিসেস. কেয়ার এখন একটাই ভাবনা,, এইভাবেই কি শেষ হয়ে যাবে তার মেয়ের জীবন? কেউ কি তার মেয়ের এই অন্ধকার জীবনে একটু আলো দিবে নাহ? মিসেস. কেয়া শাড়ির আচলে মুখ ঢেকে কান্না করে দেয়। তার যে আর সহ্য হচ্ছে নাহ,, নিজের মেয়ের এমন জীবন।


আদনান নিজের রুমে পায়চারী করছে আর স্নেহাকে ফোন দিচ্ছে। কিন্তু,, গত দেড় ঘন্টা যাবত স্নেহার ফোন বিজি আসছে। কার সাথে এতো কথা বলছে স্নেহা? বিরক্ত লাগছে আদনানের। ফোন বিছানার উপর রেখে বারান্দায় গিয়ে রাতের আকাশের দিকে তাকায় আদনান।

আজ চাঁদের উপর কয়েক কণা মেঘ ঘোরাঘুরি করছে। দেখতে বেশ ভালোই লাগছে। ইশশশ…যদি এমন হতো,, স্নেহার সাথে এরকম আকাশ উপভোগ করতে পারতো। কিন্তু,, সেইটা কি আদোও সম্ভব? কিছু সময় পর ফোন বাজতেই আদনান দৌড়ে রুমে এসে ফোন হাতে নেয়। স্নেহা ফোন করেছে। আদনান রিসিভ করে বলে ওঠে,
–” এই তুই এতো কার সাথে কথা বলছিলি? সেই কখন থেকে তোকে কল দিচ্ছি। শুধু বিজি দেখাচ্ছে।”

স্নেহা একটু হেসে বলে ওঠে,
–” আরে! বলিস নাহ। ইয়াশের সাথে কথা বলছিলাম।”

কথাটাহ শুনতেই আদনানের রাগ উঠে যায়। মেজাজ গরম হতে থাকে তার। মন চাচ্ছে এই ইয়াশকে ধরে উত্তম মধ্যম দিতে। কিন্তু,, সেইটা তো সম্ভব নাহ। তাই নিজেকে সামলিয়ে বলে ওঠে,
–” ওহ! এতো সময় ধরে?”

–” কিছু প্লানিং করছিলাম,, তাই।”

–” কি প্লানিং?”

–” আমরা কোথায় কোথায় ঘুরতে যাবো,, সেই প্লানিং।”

আদনান কিছুটাহ বিরক্ত হয়ে বলে ওঠে,
–” এতো ঘোরাঘুরির কি দরকার?”

স্নেহা কিছুটাহ অবাক হয়ে বলে ওঠে,
–” এতো ঘুরাঘুরির কি দরকার মানে? কোথায় এতো ঘুরলাম? কতোদিন পর একটু ঘুরবো,, আর তুইও ঘুরবি আমাদের সাথে।”

–” আমি যাবো নাহ।”

স্নেহা কিছুটাহ রেগে বলে ওঠে,
–” যাবি নাহ মানে? তোকে যেতে হবে।”

আদনানও কিছুটাহ যিদ নিয়ে বলে ওঠে,
–” আমি যাবো কেন? আমার এতো ঘুরতে ভালো লাগে নাহ। তোরা যা।”

স্নেহাও কিছুটাহ যেদ নিয়ে বলে ওঠে,
–” আমি গেলে তুইও যাবি শেষ।”

কথাটাহ বলে স্নেহা আদনানকে আর কিছু বলার সুযোগ নাহ দিয়ে ফোন কেটে দেয়। আদনান ফোনে কয়েকবার ” হ্যালো! হ্যালো!” করে ফোন সামনে এনে দেখে স্নেহা ফোন কেটে দিছে। আদনান ফোন টাহ বিছানার উপর ছুড়ে ফেলে।

মাথার চুল মুঠি করে বিছানার উপর বসে আদনান। ভাবতে থাকে,, স্নেহা যখন ইয়াশের হাত জড়িয়ে ধরলো,, দুইজনের একসাথে গল্প করতে করতে চলে যাওয়া,, ইয়াশ স্নেহাকে আগলে নেওয়া,, সহ্য হচ্ছে নাহ আদনানের। কিন্তু,, সহ্য করা ছাড়া যে আর কোনো উপায়ও নেই। তার বার্বিডল কে পাওয়া যে তার সাধ্যের বাইরে। ছলছল করে উঠে আদনানের চোখ।


শিশিরের মন মেজাজ ভালো নেই। গত তিন দিন সে নিজেকে নিয়ে,, নিজের ভালোবাসাকে নিয়ে ভেবেছে। নিজেকে নিয়ে সে কতটা নিশ্চয়তা রাখে সেইসব নিয়ে ভেবেছে। গত তিন দিন ছোয়ার সাথে কোনো দেখা বা কথা সে বলে নি,, শুধু নিজেকে সময় দিয়েছে। নিজেকে বোঝার চেষ্টা করেছে। আর একটা সিদ্ধান্তেও পৌঁছে গেছে। এখন শুধু বাস্তবায়ন করা বাকি।

স্নেহা আর ইয়াশ অনেক ঘুরেছে,, স্নেহা আদনানকে জোর করে নিয়ে গেছে। চোখের সামনে ভালেবাসার মানুষ অন্য একটা ছেলের সাথে হাসি মস্কারা করছে,, ব্যপার টাহ একদমই সহ্য করতে পারছে নাহ আদনান। কিন্তু,, তাও নিজেকে সামলিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করেছে।

………..আজ ভোর থেকেই সাঝ নিজের রুমে সমানে পায়চারি করছে আর হাতের আঙুল মোচড়ামুচড়ি করছে। খুব চিন্তা হচ্ছে তার। আর কিছু সময়ের মাঝেই এইচএসসি রেজাল্ট দিবে। চিন্তায় হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তার।

এমন সময় শিশির সাঝের দরজার সামনে দাড়িয়ে দেখে তার আদরের বোন,, সমানে পায়চারি করে যাচ্ছে। সে এতোটাই চিন্তিত যে তাকে খেয়ালই করে নি। হালকা হাসে শিশির।

শিশির সাঝের দিকে এগিয়ে আসলে সাঝ শিশিরকে খেয়াল করে। সাঝ তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে শিশিরকে জড়িয়ে ধরে। শিশির অনুভব করে তার বোন কাঁপছে। শিশির বোনের মাথায় হাত রেখে বলে ওঠে,
–” এতো চিন্তা করছিস কেন? এতো ভয় পাওয়ারই বা কি আছে? সব ভালো হবে ইনশাআল্লাহ!”

–” ভাইয়া! আমার খুব চিন্তা হচ্ছে। যদি…..”

কথা শেষ করতে পারে নাহ সাঝ। তার আগেই শিশির বলে ওঠে,
–” কোনো যদি নেই। সব ভালো হবে ইনশাআল্লাহ!”

–” তুমি আজ অফিস যাবে নাহ?”

–” নাহ! আজ ছুটি নিয়েছি চল ড্রইংরুমে চল।”

কথাটাহ বলে শিশির সাঝকে নিয়ে ড্রইংরুমে চলে আসে। আদনান শিশিরের অফিসের ল্যাপটপ নিয়ে সোফায় বসে সাঝের রেজাল্ট জানার চেষ্টা করছে। আজিজ রহমান একটা সোফায় বসে আছে,, তানার পাশেই আহিয়া রহমান বসে আছে।

শিশির সাঝকে নিয়ে একটা সোফায় বসে। সাঝ শিশিরের হাত চেপে ধরে বসে আছে। শিশিরও বোনকে আগলে রেখেছে। কিছু সময় পর আদনান তীক্ষ্ণ চোখে সাঝের দিকে তাকায়। আদনানের তাকানো দেখে সাঝ কিছুটা কেঁপে উঠে। চোখ ছলছল করে উঠে সাঝের। শিশিরকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়। শিশির বোনকে আগলে নিয়ে আদনানের দিকে তাকিয়ে কিছুটা ভীত কন্ঠে বলে ওঠে,
–” আদনান! কি হয়েছে?”

আদনান গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,
–” ভাইয়া! সাঝ কখনো এমন করবে আমি ভাবতেও পারি নি। সারাদিন তো বই নিয়ে বসে থাকে,, সে এরকম রেজাল্ট করে কিভাবে?”

সাঝ শিশিরকে আকড়ে ধরে আরও জোরে কান্না করে দেয়। শিশিরেরও মনে ভয় ঢুকে যায়। সাঝের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে শিশির। আহিয়া রহমানেরও চোখ ছলছল করে উঠে,, আজিজ রহমান থম ধরে বসে আছেন। শিশির কম্পিত গলায় বলে ওঠে,
–” আদনান! কি বলছিস তুই এইসব? ক্লিয়ার করে বল।”

আদনান কিছু টাহ চাপা কন্ঠে বলে ওঠে,
–” ক্লিয়ারের কি আছে ভাইয়া? বুঝতে পারছিস নাহ কি বলতে চাচ্ছি? এখন কান্না করে কি হবে? শুধু শুধু এতো টাকা নষ্ট।”

শিশির কিছুটাহ রাগী গলায় বলে ওঠে,
–” আদনান! কি বলছিস,, ভেবে বলছিস? আমার বোন যা করেছে তাতেই আলহামদুলিল্লাহ!”

আদনান একটু হেসে বলে ওঠে,
–” আসলেই আলহামদুলিল্লাহ! কারন।”

আদনান উঠে এসে সাঝের পাশে বসে। সাঝকে শিশিরের থেকে নিজের কাছে এনে চোখ মুছিয়ে দিয়ে কপালে একটা চুমু দিয়ে বলে ওঠে,
–” কারন,, আমার বোন,, জিপিএ ফাইভ পেয়েছে।”

সাঝ কান্না থামিয়ে আদনানের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। শিশির,, আজিজ রহমান,, আহিয়া রহমান সবাই উৎফুল্ল হয়ে তাকিয়ে আছে আদনানের দিকে। সাঝ কম্পিত কণ্ঠে বলে ওঠে,
–” দাদ দা দাভাই! স সত সত্যি?”

আদনান হেসে বলে ওঠে,
–” ইয়েস!”

সাঝ আবার আদনানকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়। এ যে সুখের কান্না। অনেক আনন্দের কান্না। তার স্বপ্ন পুরনের এক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার কান্না। শিশিরও এগিয়ে এসে বোন কে জড়িয়ে ধরে। আজ রহমান পরিবারে এক আনন্দ অশ্রু ঝরে পড়ছে। বাড়ির আদরের মেয়ে তাদের স্বপ্ন পুরনের লক্ষ্যে এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছে।

শিশির বাইরে গিয়ে মিষ্টি কিনে নিয়ে এসেছে। তার বোন ডাক্তার হবে,, সবার জন্য উপযুক্ত জবাব তৈরি করে দিবে তার বোন,, তার জীবনের শ্রেষ্ঠ এক সুখ হলো তার ভাইবোন। আর বোনের ডাক্তার হওয়া তার স্বপ্ন। তার বোন ডাক্তারি এপ্রোন পরে,, গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলিয়ে তার সামনে এসে যেদিন দাড়াবে সেই দিন শিশিরেরে সব থেকে বড় স্বপ্ন পূরণ হবে। আর শিশিরও সেই দিনটার জন্য মারাত্মক ভাবে অপেক্ষা করে আছে। শিশির দেখতে চায়,, তার সামনে সাঝ দাঁড়িয়ে আছে,, যার পরনে আছে ডাক্তারি এপ্রোন আর গলায় ঝুলে আছে স্টেথোস্কোপ!!!

#_চলবে………….🌹

#_লাল_নীল_সংসার_
#_মারিয়া_রশিদ_
#_পর্ব_১৬_

ছোয়া মাত্র বাস থেকে নেমেছে। দিনকাল তার একদমই ভালো যাচ্ছে নাহ। সব সময় শিশিরকে মনে পড়ে। সেই রাতের পর আর শিশির দেখা তো দুরের কথা একটা কলও দেয় নি। তাহলে,, শিশিরও কি তার অতীত জেনে ভয় পেয়ে চলে গেলো,, তাকে ছেড়ে? শিশির নাকি তাকে ভালোবাসে,, এই তার ভালোবাসা? আসলেই,, এ কেমন জীবন ছোয়ার? তাচ্ছিল্যের হাসি দেয় ছোয়া।

এইসব ভাবতে হাঁটছে ছোয়া। চারিদিকে ব্যাস্ত সব লোকজন। এতো মানুষ তার পাশে চলাচল করছে তাও এক শূন্যতা তাকে ঘিরে ধরে আছে। মনে হচ্ছে,, এক বিশাল মাঠের প্রান্তরে সে একা। একটা দীর্ঘশ্বাস নেয় ছোয়া।

ছোয়া হাটতে হাটতে হঠাৎ সামনে কারো অস্তিত্ব পেয়ে কিছুটাহ চমকে উঠে সে। আস্তে আস্তে সামনে তাকাতেই যাকে দেখে তাকে দেখে মন টাহ শান্তি পেলেও,, একদমই এখানে আশা করে নি।

শিশির,, ছোয়ার সামনে শিশির দাঁড়িয়ে আছে। ছোয়ার চোখ ছলছল করে উঠে। ছোয়া কিছু বলতে পারছে নাহ। কান্না যেন দলা পাকিয়ে আসছে। শিশির কোনো কথা নাহ বলে ছোয়ার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। ছোয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে শিশিরের দিকে। কিন্তু,, তাও কোনো কথা নাহ বলে,, শিশিরের সাথে চুপচাপ যাচ্ছে।

একটু দুর আসতেই শিশির থেমে যায়। ছেড়ে দেয় ছোয়ার হাত। ছোয়া চারপাশে তাকিয়ে দেখে একটা ফাকা জায়গা। পাশেই একটা লেক। লেকের অপর পাশে অনেক মানুষজন আছে,, কিন্তু এই পাশে একদম ফাঁকা,, কেউ নেই। লেক টাহ বেশ বড়।

শিশির ছোয়ার থেকে কিছুটাহ দুরে দাঁড়িয়ে লেকের উল্টো পাশের লোকজন দেখছে। ছোয়ার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। ছোয়া নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। ছোয়া নিজেকে কোনো রকম ভাবে সামলিয়ে বলে ওঠে,
–” আমাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছেন?”

শিশির একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছোয়ার সামনে এসে দাড়ায়। ছোয়ার মুখ অশ্রুতে ভরে আছে। শিশির আরও একটু এগিয়ে আসে। শিশির এতো কাছে আসায় কিছুটাহ কেঁপে উঠে ছোয়া। তাও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে সে। শিশির ছোয়ার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে ছোয়ার কপালে একটা ভালোবাসার পরশ একে দেয়। ছোয়া কেঁপে উঠে,, অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে শিশিরের দিকে। শিশিরের এই ছোট্ট চুমু যেন ছোয়ার শরীরকে ঠান্ডা করে দিয়েছে। এক অদ্ভুত অনুভুতি তাকে ঘিরে ধরেছে। মনে হচ্ছে,, দুনিয়ার সব শান্তি এসে জড়ো হয়ে পড়েছে তার কাছে। শিশির ছোয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–” কি ভেবেছিলে,, আমি তোমাকে ছেড়ে চলে গেছি? তোমার অতীত শুনে পালিয়ে গেছি আমি?”

ছোয়া ছলছল চোখ নিয়ে শিশিরের দিকে তাকিয়ে আছে। শিশির আবার বলে ওঠে,
–” ছোয়া! আমি জানি,, তোমার অতীত টাহ খুব ভয়ংকর। অনেক কষ্টের। তোমার ছোট্ট জীবনে সব থেকে কষ্টকর মুহুর্ত,, ছোট্ট বয়সে অধিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছো। কিন্তু,, তুমি যে ধারনা নিয়ে আছো এইটা তো সম্পুর্ন কুসংস্কার। গ্রামের যারা অশিক্ষিত,, তাদের মুখে মানায়। তোমার মতো একজন শিক্ষিত মেয়ের মুখে মানায় নাহ ছোয়া! একবার তোমার স্বামী মারা গেছে জন্য,, তুমি দ্বিতীয়বার বিয়ে করলে একই কাহিনি ঘটবে এইটা একটা মিথ্যা বিশ্বাস। ছোয়া এইটা কি কখনো সম্ভব?”

ছোয়ার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। শিশির ছোয়ার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে শান্ত কন্ঠে বলে ওঠে,
–” ছোয়া! তোমার মনে একটা ভয় ঢুকে আছে। আর এই ভয়কে তুমি খুটি আকড়ে ধরার মতো আকড়ে ধরে আছো। কেন ছোয়া? একটা অতীতের জন্য নিজেকে গুটিয়ে কেন রাখছো? নিজের জীবনকে এরকম ভাবে শেষ করে দিচ্ছো কেন? ছোয়া! যখন তোমার সাথে ঐ ঘটনা ঘটেছিলো তখন,, তোমার জীবনের কিছুই শুরু হয় নি। ইনফ্যাক্ট ধরতে গেলে,, তোমার সম্পূর্ন জীবন এখনও পড়ে আছে। আর তুমি,, সেই মূল্যবান জীবনকে এইভাবে নষ্ট করছো,, কেন?”

ছোয়া চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই শিশির ছোয়ার হাত ধরে ফেলে। ছোয়া থেমে যায়। শিশির ছোয়ার হাত ধরে টান দিতেই ছোয়া শিশিরের একদম কাছে চলে আসে। ছোয়া শিশিরের এতো কাছে এসে যেন কাঁপতে থাকে। শিশির ছোয়ার দিকে আরও একটু এগিয়ে এসে বলে ওঠে,
–” দেখো, ছোয়া! আমি সোজা একটা কথা বলছি,, তোমার অতীতে কি হয়েছিলো,, তার প্রভাব আমার উপর কেমন পড়বে,, আমার কিছুই জানার দরকার নেই। আমি শুধু এইটুকুই জানি,, তুমি শুধু আমার হবে। ছোয়াকে শিশিরের হতেই হবে। তুমি অন্য সবার কাছে বিষকন্যা হতে পারো,, কিন্তু আমার কাছে তুমি মায়াবী কন্যা। যার মায়ায় আমি জড়িয়ে গেছি। যার ভাবনা ছাড়া আমার এক মিনিটও ভালো যায় নাহ।”

ছোয়া শিশিরের কাছের থেকে একটু সরে আসে। শক্ত গলায় বলে ওঠে,
–” আপনি যায়ই বলুন নাহ কেন,, আমি আপানকে বিয়ে করবো নাহ। সম্ভব নাহ আমার দ্বারা।”

শিশির যেদি কন্ঠে বলে ওঠে,
–” তুমি যাই বলো নাহ কেন ছোয়া,, আমি তোমার অনুমতির অপেক্ষা রাখছি নাহ। আমার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে। অপেক্ষা করো,, আসছি তোমাকে নিজের করে নিতে,, তোমাকে বিয়ে করতে। আসছি আমি খুব শিঘ্রই,, তোমাকে ছোয়া এহমাদ থেকে ছোয়া শিশির রহমান বানাতে। জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ।”

ছোয়া শিশিরের দিকে থম ধরে তাকিয়ে আছে। আজ শিশিরের এই গম্ভীর কন্ঠ যেন তাকে কাঁপিয়ে তুলছে। কিছু বলার শক্তি পাচ্ছে নাহ সে। শিশির এগিয়ে এসে ছোয়ার হাত ধরে নিয়ে যেতে থাকে। ছোয়া শিশিরের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে থাকে। শিশির একবারের জন্যও ছোয়ার দিকে তাকাচ্ছে নাহ। ছোয়া শিশিরের দিক থেকে একবারও চোখ সরায় নাহ। শিশির একটা রিকশা ঠিক করে ছোয়ার দিকে তাকায়। ছোয়া এখনো শিশিরের দিকে তাকিয়ে আছে। শিশির আবার অন্য দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–” রিকশায় উঠো।”

শিশিরের কথায় ধ্যান ভাঙে ছোয়ার। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে ওরা মেইন রোডে। এতো সময় টেরই পায় নি ছোয়া। এখন টের পেতেই নিজেই নিজের কাছে অবাক হয়ে যায় ছোয়া। এতো সময় শিশিরকে দেখছিলো সে,, কেমন যেন একটা ঘোরের মাঝে ছিলো,, এতোটাই ঘোরের মাঝে ছিলো যে কখন মেইন রাস্তায় এসেছে টেরই পেলো নাহ। শিশির আবার বলে ওঠে,
–” অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে,, রিকশাও অনেক সময় ধরে দাঁড়িয়ে আছে,, উঠো।”

শিশিরের কথা শুনে ছোয়ার ভাবনা কেটে যায়। শিশিরের দিকে একপলক তাকিয়ে রিকশায় উঠে বসে ছোয়া। শিশির মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে রিকশাওয়ালা কে দিয়ে বলে ওঠে,
–” মামা! যেখানে বললাম সাবধানে পৌঁছে দিয়েন।”

তারপর ছোয়ার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–” আল্লাহ হাফিজ!”

রিকশা চলতে শুরু করে। ছোয়া শিশিরের দিকে তাকিয়ে আছে। ছোয়ার রিকশা দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেলে, শিশির একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে,, তারপর বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।


সাঝ আদনানের রুমে এসেছে। চারিদিকে চোখ বুলিয়ে দেখে আদনান নেই। কিন্তু মা যে বললো, দাভাই বাসায়,, তাহলে কোথায়? তারপর বাথরুম থেকে পানির আওয়াজ পেতেই সাঝ বুঝে যায় আদনান বাথরুমে। এতো রাতে গোসল করছে কেন দাভাই? সাঝ আদনানের রুমে এসে বিছানার উপর বসে,, আদনানের একটা বই টেনে নিয়ে চোখ বুলাতে থাকে।

এমন সময় টেবিলের উপর আদনানের ফোন বেজে উঠতেই সাঝ এগিয়ে যায়। ফোন হাতে নিতেই দেখে ” বার্বিডল ” নামে সেভ করা একটা নাম্বার থেকে কল আসছে। সাঝ কিছুটাহ অবাক হয়ে যায়। একবার বাথরুমের দিকে তাকিয়ে আবার ফোনের দিকে তাকায়।

কল কেটে যায়। আবার কিছু সময় পর কল আসে। সাঝের একটু কৌতুহল জাগে,, বার্বিডল লেখা ব্যাক্তি টাহ আসলে কে? কল রিসিভ করে কানে নিতেই ওপাশ থেকে একটি মিষ্টি মেয়েলি কন্ঠ ভেসে আসে। ফোনের ওপাশ থেকে বলে ওঠে,
–” আদনান! কালকের জন্য একটা ধামাকা প্লান আছে।”

সাঝ কিছুটাহ অপ্রস্তুত হয়ে বলে ওঠে,
–” আসসালামু আলাইকুম!”

সাঝের কন্ঠ শুনে ফোন কলের এইপাশে স্নেহা কিছুটাহ ভেবাচেকা খেয়ে যায়। স্নেহা আমতা আমতা করে বলে ওঠে,
–” ওয়ালাইকুম আসসালাম! আপনি কে? আর আদনান কোথায়?”

–” আমি সাঝ!……”

সাঝ আর কিছু বলার আগেই স্নেহা আনন্দিত গলায় বলে ওঠে,
–” তুমিই সাঝ? ওয়াও! আদনানের বোন, রাইট?”

–” জি!!”

–” তোমার সাথে আমি অনেকবার দেখা করতে চেয়েছি,, কথাও বলতে চেয়েছি,, বদ আদনান কখনো করায় নি। ভালোই হলো,, তুমি কল রিসিভ করলে।”

–” ভাইয়া মেইবি গোসল করে।”

–” সমস্যা নেই। তো আমাকে মনে হয় তুমি চিনো নি। আমি স্নেহা! আদনানের ফ্রেন্ড!”

সাঝ মুচকি হেসে বলে ওঠে,
–” ওহ! কেমন আছেন?”

সাঝ আর স্নেহা দুইজনে কথা বলছে। সাঝের বেশ ভালোই লাগছে,, স্নেহার সাথে কথা বলতে। স্নেহাও অনেক মজা পাচ্ছে,, সাঝের সাথে কথা বলতে। এমন সময় আদনান বাথরুম থেকে মাথা মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসে। সাঝকে তার নিজের ফোনে কারো সাথে হেসে হেসে কথা বলতে দেখে ভ্রু কুচকিয়ে তাকিয়ে থাকে আদনান।

সাঝ কথা বলতে বলতে সামনে তাকিয়ে দেখে আদনান বেরিয়ে এসেছে বাথরুম থেকে। সাঝ ফোন কানে নিয়ে বলে ওঠে,
–” ভাইয়া বের হয়েছে। দিবো?”

স্নেহা হেসে বলে ওঠে,
–” হ্যা! দাও। আর তোমার সাথে কথা বলেও আমার অনেক ভালো লেগেছে। তোমার তো পরশুদিন মেডিকেল এ্যাডমিশন এক্সাম তাই নাহ?”

–” হ্যা!”

–” মন দিয়ে পড়ো। ইনশাআল্লাহ চান্স হয়ে যাবে।”

–” দোয়া করবেন আপু! আল্লাহ হাফিজ!”

–” আল্লাহ হাফিজ!”

সাঝ আদনানের দিকে ফোন এগিয়ে দিয়ে বলে ওঠে,
–” স্নেহা আপু কল করেছে।”

আদনান চোখ বড় বড় করে অবাক হয়ে সাঝের দিকে তাকিয়ে ফোন টাহ হাতে নেয়। সাঝ মুচকি হাসি দিয়ে চলে যায়। আদনান ফোন কানে রেখে বলে ওঠে,
–” হ্যালো!”

–” হেই! তোর থেকে তোর বোন অনেক ভালো বুঝলি?”

–” হ্যা! হয়েছে। কল দিলি কেন?”

স্নেহা একটু ভ্রু কুঁচকে বলে ওঠে,
–” কেন? আমি কি তোকে কল দিতে পারি নাহ?”

–” নাহ মানে,, সব সময় তো ইয়াশের সাথে ব্যাস্ত থাকিস। তাই বললাম।”

–” এমন করে বলছিস কেন তুই?”

–” কেমন করে বললাম?”

–” আচ্ছা! বাদ দে,, শোন,, আগামীকাল ইয়াশের বার্থডে। পার্ক সেন্টারে ওর বার্থডে সেলিব্রেট করা হবে। তোকেও ইনভাইট করেছে। সো,, তুই সন্ধ্যায় চলে আসবি।”

–” সরি! পারবো নাহ। এই বার্থডে ফার্থডে আমরা নিজেরাও করি নাহ। আর কারো বার্থডেতে এটেন্ডও করি নাহ।”

–” এমন করছিস কেন? আই প্লিজ অনেক মজা হবে। আমাদের পুরে ফ্রেন্ডস সার্কেল আসবে।”

–” তো,, আমি কি করবো? যার যার ইচ্ছে হবে সে সে যাবে। আমি যাবো নাহ।”

–” তুই নাহ গেলে কিন্তু আমিও যাবো নাহ।”

–” তাহলে তো আরও ভালো।”

–” কি? আদনান! প্লিজ!”

–” স্নেহা!”

স্নেহা হালকা জোর কন্ঠে বলে ওঠে,
–” আমি কিছু শুনতে চাই নাহ। তুই আসবি মানে আসবি,, ব্যাস। আর কোনো কথা নাই। রাখলাম।”

–” আরে! শোন,, হ্যালো,, স্নেহা,, হ্যালো!”

আদনান ফোন সামনে এনে দেখে স্নেহা কল কেটে দিছে। আদনানের প্রচন্ড রাগ লাগছে। এই ইয়াশকে একদমই সহ্য করতে পারছে নাহ আদনান। এই কয়েকদিন ধরে ইয়াশ আর স্নেহাকে একসাথে দেখে নিজের রাগ যেন সপ্তমে উঠে রয়েছে। পচন্ড মেজাজ খারাপ হয়ে আছে তার। অসহ্য!!!

#_চলবে…………🌹

{{ ভুল,, ত্রুটি সবাই ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন বলে আশা করি।।। 😇 }}