#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৬৪
আফনান লারা
.
সবচেয়ে দুঃখজনক কিছু ভাবনা ভাববার সময় হঠাৎ করে মুখে নরম কাপড়ের ছোঁয়া লাগায় দুঃখজনকটা মিষ্টিজনক হয়ে দাঁড়ালো।চোখ বুজে আবেশে অর্ণব বললো’ঘাম গালে নয়,গলায়’
কুসুম হাতটা সরিয়ে এবার গলা মুছে দিচ্ছে।
এত ভাললাগা কাজ করছিল অর্ণব ভাষায় প্রকাশ করতে পারছেনা।কুসুম ভালভাবে ওর গলা মুছিয়ে দিয়ে বাহিরের দিকে নজর দিতেই দেখলো কতগুলো স্বরবর্ণ বড় বড় করে লেখা দেয়ালে।
তখন জ্যাম ছিল।সে ভাল করে দেখে বললো,’অ তে অর্ণব,আ তে আমি,ই তে ইলিশ…
‘এ্যাই! তোমাকে এসব শিখিয়েছি আমি?অ তে অজগর শিখিয়েছিলাম, অর্ণব না’
‘অ তে দুটোই হয়।একটা বললে কি সমস্যা? ‘
‘সমস্যা আছে।তুমি অ তে অজগর বলবে’
কুসুম ভেংচি মেরে পড়াই বন্ধ করে দিয়েছে।
—-
সিঙ্গাপুরের Bedok-এ জুথির নানুর বাসা।বাসাতে আসার পর মাকে এখনও দেখেনি সে।মা নানুর সাথে সুপারমার্কেটে গেছেন।চাবি রেখে গেছে প্রতিবেশীর কাছে।জুথিদের প্রতিবেশীও মুসলিম পরিবার।তবে তারা এই দেশের।যা বলে সিঙ্গাপুরের ভাষায় বলে।
জুথিকে দেখে ছুটে এসে চাবি দেওয়ার আগে জড়িয়ে ধরলেন বাসার মালিক মিসেস জুনমি।
উনি আশ্চর্য হয়ে গেছিলেন জুথিকে দেখে।অনেক বছর আগে দেখেছিলেন।এখন জুথিকে প্রায় চেনাই যাচ্ছিলো না।জুথি চাবি নিয়ে সবার কথা জিজ্ঞেস করলো এক এক করে।উনি বললেন তার সাথে তার বাড়ি যেতে ব্রেকফাস্ট করতে।
আপাতত না করে দিয়ে চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঢুললো জুথি।মৃদুলের সাথে কথা বলেছিল ট্রেনে বসে।
বাসায় ঢুকে মায়ের গায়ের গন্ধ নাকে আস্তেই চোখ বুজে ফেললো সে।
কতটাদিন পর মাকে জড়িয়ে ধরবে আজ।ব্যাগ রেখে সোফায় বসে টিভিটা অন করে ওখানেই শুয়ে পড়লো লম্বা হয়ে।তখনই সামনে এসে হাজির হলো মোরকো।
মোরকো হলো জুনমির বড় ছেলে।জুথির ছোটবেলার বন্ধু। জুথি ওকে দেখে সোফা থেকে উঠিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে।এরপর দুজনে হাত মিলিয়ে কিছুক্ষণ লাফালাফি করলো খুশিতে।মোরকো তো অবাক।জুথি যখন বাংলাদেশে গেছিল তখন সে চিকন, টিনেজ ছিল।আর এখন একেবারে মোটাসোটা ম্যাচিউর হয়ে ফিরে এসেছে।
—–
অর্ণব পকেটের সব টাকা গুনছিল রুমের এক কোণায় বসে। কুসুম সবসময়কার মতন দরজার ফটক ধরে দেখছিল ওকে অনেকক্ষণ যাবত।
অর্ণব টাকা গুনতে গুনতে বললো,’কিছু বলবে?’
‘আমি কি আর বাঁচবোনা?’
‘কে বলেছে এসব তোমায়?অবশ্যই বাঁচবে’
“তাহলে ডাক্তার যে বললেন দেরি হয়ে গেছে’
“ও কিছুনা।ডাক্তার তো কত কিছুই বলে।খাবে কিছু?আমি বাহিরে থেকে খাবার নিয়ে আসবো।আজ আর কারোর রান্নার ঝামেলা মাথায় নিতে হবেনা’
“খেতে ইচ্ছে করেনা।পানির তৃষ্ণা পেয়েছিল সেটা চলে গেছে।আর…
‘আর কি?’
‘নাক দিয়ে আবারও রক্ত গেলো’
অর্ণবের হাত থেকে টাকাগুলো পড়ে গেলো সেসময়ে।ওগুলো গুছিয়ে না তুলে সে পকেটে হাত দিয়ে টিস্যু একটা নিয়ে এগিয়ে আসতেই কুসুম বললো,’মুছে ফেলেছি’
‘কখন হয়েছে এমন?’
‘কিছু সময় আগে’
অর্ণব হাত দিয়ে ওর চুলগুলোকে পিঠের উপর নিয়ে ওর মুখটা ধরে মুছে দিলো।তারপর একটা দোয়া পড়ে ফু দিয়ে একটু বেড রেস্ট নিতে বলেছে।
সকাল থেকে শুয়ে থাকায় কুসুমের এখন বিছানা দেখলেই অস্বস্তি বোধ হয়।তাই বিছানায় বসে রইলো শুধু।অর্ণব তার আগের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।টাকা সব গুনে পকেটে পুরে কুসুমকে বলে চলে গেছে রাতের জন্য খাবার কিনে আনতে।আজ তাদের দুপুরের খাওয়া হয়নি।অথচ তার খিধে নেই একটুও।কুসুম খায়না বলে তারও খাওয়ার ইচ্ছা জাগেনা।
একা একা ওকে নিয়ে বেঁচে থাকতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে ওকে।নিজেকে অনেক অসহায় মনে হয়।
কুসুমের মতন একটা মেয়ের এমন একটা রোগ হয়েছে মেনে নিতে পারছেনা সে।এখনও বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।
খাবারের অর্ডার দিয়ে হাতের ঘড়িটা উল্টেপাল্টে দেখছিল সে।হঠাৎ মনে হলো কুসুম বুঝি বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে?
আন্দাজে একবার দেখার জন্য পেছনে ফিরলো সে।
আন্দাজ যে এতটা সত্যি হবে সে জানতোনা।কুসুম সত্যিই বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওকে দেখছিল।
ও তাকাতেই সরে গেছে।কিন্তু অর্ণব ততক্ষণে ওকে দেখে ফেলে।
খাবার হাতে দোতলায় এসে টেবিলে সেগুলোকে রেখে অর্ণব আজ জবা ফুল গাছটা একবার দেখতে বারান্দায় পা রেখেছে।এমনিতে সে কখনওই বারান্দায় কেবল জবা দেখতে আসেনা।কিন্তু আজ আসলো।
শুধু তাই নয়।একটা জবা ফুল ও ছিঁড়েছে ।ওটাকে হাতে নিয়ে এগিয়ে গেলো বেডরুমের দিকে।
অনেকদিন আগে দেখা স্বপ্নটা সিনেমার পর্দার মতন চোখের সামনে ভাসতেছে।
এক পা দু পা করে রুমে এসে দাঁড়িয়ে কুসুমকে সেই জায়গাতেই দেখলো।ওয়ারড্রবের কাছে।সে জানালার গ্রিল ধরে বাহিরে দেখছিল।অর্ণব আরও কাছে এসে ওর হাত ধরে নিজের দিকে ফিরালো এক টানে।কুসুম অবাক হয়ে আছে।ওর অবাক হওয়াটাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে অর্ণব।লাল টুকটুকে ফুলটা ওর কানে গুজে দিয়ে বললো,’লীলাবালি’
‘কে লীলাবালি?’
‘সেই মেয়েটা।যার কোঁকড়ানো চুল,রুপ তার মোহে ভরা,ঠোঁটজোড়া জানান দেয় জবা ফুলের কলির কথা,যার কানেই কেবল রক্তজবা সাজে!যার চোখের সরলতা বলে দেয় তার শুদ্ধতার পরিমাণ।সে হলো লীলাবালি।আমার লীলাবালি’
‘আপনার?’
‘হ্যাঁ।’
দীর্ঘ উক্তি ছাড়ার পর অর্ণবের যখন হুশ আসলো তখন সে কুসুমের হাতটা ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে গেলো।তারপর মাথায় হাত দিয়ে বিছানায় বসে পড়ে বললো,’ভুলে যাও!জানিনা কি বললাম।’
কুসুম কানে হাত দিয়ে ফুলটাকে ছুঁয়ে ওর সামনে থেকে চলে গেলো।অর্ণব কপাল টিপতে টিপতে ভাবছে সেই স্বপ্নের কথা।
কেন সে ফুলটা ধরলো আর কোনো সে ওটা আবার ওর কানে গুজতে গেলো।সেই নামটা লীলাবালি ছিল?
এর মানে তো আমি নিজেও জানতাম না!অথচ গড়গড় করে সবেমাত্র বিশাল সংজ্ঞা দিয়ে ফেললাম।মেয়েটার চোখে কোনো নেশা দ্রব্য আছে, তাকালে ঘোরে পড়ে যেতে হয়।অদ্ভুত এক মায়া কাজ করে!বাবা বুঝি এই কারণে বলেছিল আমি একদিন না একদিন ওর এই মায়ায় পড়তে বাধ্য হবো!
এমন বাধ্য হয়েছি যে, যেই স্বপ্ন দেখে হাঁপিয়ে পড়েছিলাম সেই স্বপ্নটা নিজের হাতে পূর্ণ করে দিয়েছি।যেন কেউ আমাকে দিয়ে কাজটা করিয়ে নিলো।কিন্তু!আমার লীলাবালি এটা কেন বললাম?
ধুর!কি হলো আমার!এমন ব্যবহার কেন করছি!এই মেয়েটাকে তো আমি সহ্য করতে পারিনা।তাহলে এতক্ষণ ওগুলা কি করলাম!কেন করলাম!’
কুসুম কানে হাত দিয়ে মুচকি হাসছিল বারান্দায় এসে।অর্ণবের আজকের করা এই ব্যবহার তার সবসময় মনে থাকবে।একটা ফুল দিয়ে যেন এত বিরাট একটা অনুভূতি উপহার দেওয়া যায় তা কেউ উনার থেকে শিখুক।
উনি এত সুন্দর করে কি করে আমার মনটা ভাল করে দিলেন!আমার মন খারাপ তা জানলেন কি করে?’
এক রাশ ভাললাগা নিয়ে কুসুম ফেরত আসতেই দেখলো অর্ণব বসে বসে আফসোস করছে ফুল দেওয়া নিয়ে।মূহুর্তেই তার মন খারাপ হয়ে গেলো।কান থেকে ফুলটা ছুটিয়ে সরে গেলো সে।বারান্দা দিয়ে ফুলটাকে ফেলে দিলো নিচে।এত খারাপ লাগছে যার কারণে ফুলটা তার কাছে থাকাটাই অপরাধ হয়ে দাঁড়িয়েছে।ফুলটা ফেলে দরজা খুলে বেরিয়ে গেছে সে।
যা ভেবেছিল তাই হচ্ছে।
‘উনি আমার অসুখ দেখে আমাকে দয়া দেখাচ্ছেন।আর আমি ভাবছি উনি আমায় বুঝি সত্যিকারের ভালোবাসেন!মিননয়ী আপুর আর আমার মাঝে আকাশ পাতাল তফাৎ।
ঠিক তো!আমাকে কেন ভালোবাসবেন!কি আছে আমার মধ্যে!এখন আবার রোগ পাতিয়েছি।
এখন তো আমার থেকে উনার আরও দূরে দূরে থাকার কথা।
শুধু শুধু কেন স্বপ্ন দেখিস তুই কুসুম?উনি তোকে আগেও পছন্দ করতেন না।এখনও করেননা।এখন যা করেন তার সব তোর রোগ বলে করেন।নাহলে তোর দিকে ফিরেও তাকাতোনা জীবনে।বুঝেছিস?’
‘এ্যাই মিজুয়ানা!দেখো ওটা কুসুম মা না?’
মিজুয়ানা আর সুলতান শাহ বাগানে বসে চা খাচ্ছিলেন।কুসুমকে হনহনিয়ে বাসা থেকে চলে যেতে দেখলেন দুজনে।মিজুয়ানা চশমা ঠিক করে বললেন,’হ্যাঁ তাই তো।মেয়েটা কই চলে যায়?’
“মনে হয় ওদের রাগারাগি হয়েছে”
‘ঠিক।আচ্ছা ও কি রাস্তাঘাট চেনে?আরে আটকান ওকে।পরে তো হারিয়ে যাবে’
“আমার লাঠিটা পাচ্ছিনা।ও হ্যাঁ মনে পড়েছে,মাত্রই তো জাহানকে দিয়েছিলাম সাবান দিয়ে ধুয়ে আনতে।সে মনে হয় ধুতে গিয়ে কাজল লাগাচ্ছে চোখে।তুমি গিয়ে আটকাও’
‘আমার গায়ে মেক্সি।এটা পরা অবস্থায় রাস্তায় নামবো কি করে?’
——
‘আম্মু দেখো তো!এই ছেলেটা কেমন?’
জুথির মা ওর হাত থেকে ফোন নিয়ে ভাল করে দেখে বললেন,’পাশেরটা কে?পাশের জন বেশ দেখতে।অবশ্য এটাও সুন্দর।দুজনেই সুন্দর’
‘পাশের জন অর্ণব ভাইয়া।উনি বিবাহিত ‘
‘ওহ!তাহলে এটাও সুন্দর।কেন তোর কি পছন্দ নাকি?’
‘না!মোটেও না।এমনি দেখিয়েছি।বাংলাদেশের ছেলে দেখোনা কত দিন হলো মনে আছে?’
‘আমি দেখে কি হবে?বিয়ের বয়স তো তোর।তা ছেলে কিসে পড়ে?’
‘আমি এত জলদি বিয়ে করছিনা।ছেলে কিসে পড়ে জেনে কি করবে?’
“জেনে রাখি।আমার মেয়ে সচরাচর কোনো ছেলের ছবি আমায় দেখায়না।
এ প্রথম দেখালো।ঘাপলা আছে’
‘উনি আমার ভাইয়া হোন।এমনি দেখাতে পারিনা বুঝি?যাও তোমাকে আর কারোর ছবি দেখাবোনা’
চলবে♥
#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৬৫
আফনান লারা
.
‘শুনছো অর্ণব বাবা!’
অর্ণব তার রুমে বসে মাথার চুল টানছিল।মিজুয়ানা আন্টির আওয়াজ শুনতে পেয়ে ছুটে এসে দরজা খুলে দিয়েছে।
“তোমার বউ তো একা একা কোথায় যেন চলে গেছে’
‘কই গেছে?’
‘জানিনা।রাস্তায় নেমে চলে গেলো।জলদি আটকাও।পথঘাট কি চেনে সে?’
অর্ণব ছুটলো নিচে।বাগানে দেখা হয়েছে সুলতান শাহের সাথে।জাহানকে দিয়ে কাপড় আনিয়ে লাঠি শুকাচ্ছেন।
শুকানো শেষে লাঠি ধরে দাঁড়িয়ে বললেন,’পশ্চিম দিকে গেছে বাবা।ধরো জবা ফুল একটা নিয়ে যাও’
—-
কিছুদূর গেলেই একটা দিঘি পড়ে।কুসুম সেখানে ঘাটে বসেছিল।সন্ধ্যা নেমে এসেছে।দিঘির পানি থই থই করছে।কি ভেবে পা ডুবিয়ে বসলো সে।বাড়ির নদীটার কথা মনে পড়ে গেলো।কত সুন্দর ছিল সেই দিনগুলো।হেসে খেলে দিন যেতো।
‘আচ্ছা!মানুষ কেন কাউকে ভালবাসে?কেন বাসে?ভালবাসে কষ্ট পেতে?আমি কেন ভালবাসলাম!যাকে বাসলাম তিনি অন্য কাউকে ভালবাসেন।হাহ!আমার জীবন!
তরীর মতন।একদিন নিশ্চিত ডুববে।
তাহলে কেন আমার জীবন?কেন আমার জীবনে অল্প সময়ের জন্য সুখ আসলো!যে সুখ আমার নামে লেখাই ছিলনা।এই সুখ মিননয়ি আপুর।আমি কেড়ে নিয়েছি।
নিজের অজান্তে দুটো মানুষের জীবন নষ্ট করে দিয়েছি।
আমি ভীষণ স্বার্থপর।আমি কেন মরিনা!!’
চোখের পানি দিঘির পানিতে ফেলে তাতে পা দুলাতে দুলাতে গান ধরলো সে।
চুকিয়ে দেব বেচা কেনা
মিটিয়ে দেব গো, মিটিয়ে দেব লেনা দেনা
বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে
তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে
তারার পানে চেয়ে চেয়ে
নাইবা আমায় ডাকলে
যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে
আমি বাইব না
আমি বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে গো
যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে।
গলা শুকিয়ে আসায় গান থেমে গেলে মাঝ পথেই।হাত দিয়ে গলা চুলকে পানিতে এক পা এক পা করে নামলো সে।হাতে ক্যানোলো গাঁথার ব্যাথা আছে তাও সিঁড়ি বেয়ে পানির মাঝখানে গেলো সে।দুহাত দিয়ে চুল ধরে পানিতে ডুব দিলো।অর্ণব কিণারায় থেকে দেখে ভাবলো কুসুম আত্নহত্যা করতে পানিতে নেমেছে।
তা ভেবে সঙ্গে সঙ্গে সে একটা ঝাঁপ দিলো পুকুরে।সাঁতরে ওর কাছে এসে ওকে পানি থেকে তুলে ধরলো।আচমকা চোখের সামনে অর্ণবকে দেখে কুসুম ভয় পেয়ে গেছিল।অর্ণব ওর গালে একটা চড় মেরে দিয়েছে ততক্ষণে।গালে হাত দিয়ে কুসুম বললো,’আমি কি করলাম?’
‘পানিতে ডুবে মরতে চাইতেছো!এত সাহস তোমার!আমি কি করেছিলাম তোমায়?বকেছি নাকি মেরেছি?কি কারণে তুমি এই সন্ধ্যাবেলা একা একা এতদূর চলে এলে?কত খুঁজেছি জানো?তোমার না শরীর খারাপ?পানির মাঝখানে আসার সাহস করলে কি করে? আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি তোমার সব কিছুতে’
কুুসুম হাত দিয়ে মুখ থেকে চুল সরিয়ে বললো,’আমি গোসল করতে নেমেছি।নিজ থেকে মরতে চাইবো কেন?’
অর্ণব ওর হাত ধরে কিণারায় নিয়ে আসলো কোনো জবাব না দিয়ে।
এরপর সিঁড়িতে বসিয়ে দিয়ে বললো,’আমি তোমার এই কথা বিশ্বাস করতে পারলাম না।তুমি নির্ঘাত মরার জন্য পানির মাঝখানে গিয়েছিলে।তা নাহলে এই সময়ে কেউ গোসল করে?’
‘আমার মন ভাল না থাকলে আমি গোসল করি।মাথার ভেতরের জঞ্জাল ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে যায়।নিজেকে হালকা লাগে তখন’
অর্ণব খেয়াল করলো রাস্তা দিয়ে যে এক দু জন মানুষ যাচ্ছে তারা কুসুমকে দেখতে দেখতে যাচ্ছে।সিরিয়ালের নায়কদের মতন তার কাছে জ্যাকেট নেই নায়িকাকে পরিয়ে দেয়ার জন্য।তাই গায়ের সুতির ভেজা পাঞ্জাবিটাই খুলে ওর গায়ে লেপটে দিয়ে বললো,”চলো এখন।বাসায় গিয়ে বাকি বকা বকবো’
কুসুম অর্ণবকে উদম দেখে চোখ নামিয়ে হাঁটা ধরেছে।অর্ণব ওর পিছু পিছু আসতে আসতে বললো,’মানুষ কি বলবে একবার ভেবে দেখেছো?কেন করলে এমন?আমি কি করেছিলাম অন্তত কারণটা দেখাও’
‘আপনি কিছু করেননি।সব আমার কপালের দোষ’
‘আবারও কথা ঘুরাচ্ছো!বলো,কেন বেরিয়ে আসলে?’
কুসুম মাঝ পথে থেমে গেলো।অর্ণবের মুখের দিকো দু মিনিট তাকিয়ে থেকে মুখটা আবারও ফিরিয়ে নিয়ে হাঁটা ধরেছে।
এর মানে মতলবের কিছুই সে বুঝতে পারেনি।কুসুম কেন এমন করছে তার কারণ সে কল্পনাও করতে পারেনা।
বাসায় আসার পর থেকে কুসুম যে রুমে ঢুকেছে ঐ রুম থেকে বের হয়নি।
অর্ণব গা মুছে শুকনো পাঞ্জাবি পরে দরজার বাহিরে ঘুরঘুর করছে।
ওর যে অসুখ তাতে যেকোনো সময় দূর্বল হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারে।এভাবে দরজা বন্ধ করে বসে থাকার মানেটা কি দাঁড়ায়।
কি দোষ করেছি অন্তত সেটা বলুক।কানে ধরে সেই বিষয়টাকে উপড়ে ফেলে দেবো নাহয়।কারণ না বলে রাগ করে থাকলে এটার কোনো বিহিতই হবেনা।
কুসুম!দরজা খোলো!অনেক হয়েছে রাগারাগি।আমাকে বলবে কি হয়েছে?’
দরজা ধাক্কাধাক্কির পর কুসুম এসে দরজা খুলেছে এবার।অর্ণব ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে গাল ফুলিয়ে।কুসুম মাথা নিচু করে সোজা হেঁটে অর্ণবের রুমের দিকে চললো।অর্ণব ওর পিছু এসে পথ আটকে দাঁড়িয়ে দেয়ালে হাত রেখে বললো,’কি হয়েছে বলবা নাকি??’
‘কিছু হয়নি।আমি একটু একা থাকতে চাই’
‘অনেকক্ষণ একা থাকা হয়েছে। আর নয়,এইবার বলবে কি কারণে বাসা থেকে বেরিয়ে গেছিলে। যদি না বলো তো আমি এখন তোমার বাবাকে কল করে বলবো তুমি এরকম উদ্ভট আচরণ করে বেড়াও আমার সাথে।’
কুসুম চোখ বড় করে বললো,’কি শুনতে চাইছেন?’
‘যেটা সত্যি’
“আমার বারবার মনে হয় আপনি আমাকে দয়া দেখাচ্ছেন।আমার অসুখ বলে সেবার খাতিরে আপ্যায়ন করেন। এর বাহিরে কিছুইনা।ফুল দেওয়াটাও ঐ কারণেই। যার কারণে তখন আফসোস করছিলেন।
আমি চাইনা আপনি জোর করে আমাকে পছন্দ করেন।পছন্দ করেন না এটা খারাপ কিছুনা আমার কাছে।কিন্তু কেন মুখোশ দিয়ে থাকবেন?একটা মানুষ যখন জানে তার সাথে ভাল আচরণ করা ব্যাক্তি গোপনে সেই ব্যবহারে আফসোস করে তখন তার কাছে কেমন লাগে সেটা?
আপনি আমায় আর কোনো দয়া দেখাবেননা।যেমন ঘৃনা করতেন তেমন ঘৃনা করেন অন্তত মনকে বলতে পারবো মিথ্যের মাঝে বেঁচে নেই।’
‘এসব কি বলো তুমি!আমি কোনো নাটক করিনা।তোমার সাথে যে আচরণ করেছি আজ পর্যন্ত সেসব আমি মন থেকে করেছি।রীতিমতে তুমি আমার স্ত্রী। এসব আমি তোমার সাথে করবোনা তো কার সাথে করবো?
এসব তোমার কেন অভিনয় মনে হলো বুঝতেছিনা।
‘অভিনয় না হলে আফসোস কেন করলেন?’
অর্ণবের কাছে এর জবাব ছিলনা বলে সে চুপ হয়ে গেলো।কুসুম ওকে পেরিয়ে রুমের ভেতর চলে গেছে।বাবা বারবার ভিডিও কল দিচ্ছিলেন বলে ফোন নিয়ে নিচে বিছানো তোষকে বসলো অর্ণব।
বাবার পাশে মা ও ছিলেন।অর্ণবকে দেখে মা বললেন,’কিরে বাবা?মুখ ওমন শুকিয়ে আছে লেন?খাস না ঠিকমত?’
বাবা উনাকে থামিয়ে বললেন,”কুসুমের এমন অবস্থায় ও কি করে নিজের খেয়াল রাখবে বলোতো?আচ্ছা অর্ণব কুসুমকে একটু দেখা তো।দেখি মেয়েটাকে’
অর্ণব উঠে দাঁড়িয়ে রুমের দিকে গেছে।কুসুম সেসময়ে গাল ফুলিয়ে চুলের পানি মুছছিল গামছা দিয়ে।অর্ণব হালকা কাশি দিয়ে ফোন ওর দিকে ধরেছে।কুসুম শাড়ীর আঁচল মাথায় দিয়ে সালাম দিলো দুজনকে।কিছুক্ষণ কথা বলার পর তারা ফোন রেখে দিয়েছেন।কুসুম আবার আগের মতন গাল ফুলিয়ে চুল মুছতে মন দিলো।অর্ণবের ও রাগ হচ্ছিল তাই সে চলে গেছে রুম থেকে।
দুজনে দু রুমে বসে গাল ফুলিয়ে যে যার কাজ করছে।
ঘন্টাখানেক পর কুসুম হঠাৎ মেইন দরজার কাছে এসে দরজা খোলা ধরতেই অর্ণব এগিয়ে এসে দাঁড়ালো সামনে।জিজ্ঞেস করলো এই রাতে কোথায় যাচ্ছে।
“যেখানেই যাই।আপনার কি?বললাম না আমাকে যেমন ঘৃনা করতেন তেমন করেন।’
‘তুমি বেশি করতেছো!কথা শুনবে নাকি সকাল বিকাল থাপড়ানো শুরু করতাম?আমার কথা না শুনলে মানুষটা যদি বয়সে ছোট হয় তবে আমি খুব মারি।তুমি কি বলো?’
‘আমি বাসা থেকে যাচ্ছিনা।মম আপুকে ছেলেপক্ষ দেখতে আসবে।আমায় যেতে বলেছে।আর আপনি আমায় মারবেন?মারেন!তখন ও তো মেরেছিলেন।আপনার আঘাতে আমার ব্যাথা লাগবেনা।কিন্তু জোর করে দয়া দেখানোটা ক্ষতের সৃষ্টি করে।’
—–
মৃদুল বারবার ভিডিও কল দিচ্ছিলো।জুথি বাসার ছাদে এসে শুকনো গাছের পাতা জমিয়ে সেগুলোকে হাওয়ায় ভাসিয়ে একটা স্লোমো ভিডিও করছিল কিন্তু মৃদুলের কলের কারণে ভিডিওটা বারবার নষ্ট হচ্ছে।শেষে ছাদে বসে ওর কলটা রিসিভ করলো সে।
‘কি সমস্যা তোমার!!কতবার কল করেছি!দেখো আমি কিন্তু তোমায় কিছুতেই আমায় ভুলতে দেবোনা!!আমি খুব খারাও কিন্তু!!’
‘দিয়েন না ভুলতে।দেশে থেকে কি আর করবেন।কলে এসে দাপট দেখানো ছাড়া আপনার আর কিছু করার নাই’
‘বলো বলো!একবার শুধু দেশে আসার সাহস দেখাও।তোমায় আর যেতে দেবোনা।বেঁধে রাখবো”
‘আমাকে আপনি বাঁধতে জানলে আজ আমি এখানে আসতে পারতাম না।’
‘জানো কুসুমের অসুখ’
কুসুমের নাম শুনে জুথির মুখের ভাবগতি বদলে গেলো।মূলত কুসুমের নামটা অর্ণবের নাম মনে করিয়ে দেয়।দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে সে বললো,’কি হয়েছে ওর?’
‘ব্রেইন টিউমার!”
জুথি চোখ বড় করে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ তারপর চিন্তিত হয়ে বললো,’কি অবস্থা এখন?ভাইয়ার কি খবর?’
‘ও তো প্রায় বেহুশ।এত দৌড়াদৌড়ি ওকে আমি জীবনে করতে দেখিনি।অনেক টায়ার্ড লাগছিল,তবে রেস্ট নেওয়ার সময় ও পাচ্ছেনা।হঠাৎ করে কুসুমের এমন রোগ দেখা দিলো।কত হাসিখুশি ছিল মেয়েটা,কে জানতো তার এমন কঠিন রোগ হবে’
জুথির মন খারাপ হলো।সে কখনও কুসুমের খারাপ চায়নি।মেয়েটার মুখে এত মায়া।সেবার অর্ণবদের বাড়ি থেকে চলে আসার সময় শেষবার ওর মুখ দেখে ইচ্ছে করছিল একবার জড়িয়ে ধরে কাঁদতে।এত সুন্দর মেয়েটার এমন কঠিন রোগ কেন হলো।দোয়া করি যেন সে সুস্থ হয়ে ওঠে।
অর্ণব ভাইয়াকে আমি পাইনি বলে সে পাবেনা এমনটা আমি চাই না।সে তো অর্ণবকে পেয়েছে তবে যাতে সারাজীবনের জন্য ওর পাশে থাকতে পারে সেটাই চাই আমি।
ও ভাল থাকুক, তাতে করে অর্ণব ভাইয়াও ভাল থাকবেন।
চলবে♥
#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৬৬
আফনান লারা
.
খান্দানি বংশের ছেলে জিসান রহমান দেখতে এসেছে মমকে।শুধু দেখতে আসবে বলে এত্ত এত্ত ডালা সাথে করে নিয়ে এসেছে তারা।ছেলে,ছেলের মা- বাবা আর দাদি,ফুফু এসেছেন।কুসুমকে মিজুয়ানা আন্টি দায়িত্ব দিয়ে গেলেন মমকে শাড়ীটা সুন্দর করে পরিয়ে দিতে।কুসুম পড়লো মহা বিপদে।
সে তো নিজেই নিজের শাড়ীটুকু পরতে জানেনা,কোনোমতে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে নিজেরটা পরে।মমকে শাড়ী পরাতে গিয়ে ভুল হলে মান ইজ্জত আর থাকবেনা কারোর।সাহস করে সে মমকে বলে দিলো সে শাড়ী পরাতে জানেনা।মম ওর কথা শুনে হপসে বললো,’আমি নিজের শাড়ী নিজেই পরতে জানি।মা তারপরেও তোমায় দায়িত্ব দিয়ে গেলো।ভেবোনা,আমি পরে ফেলছি।তুমি বরং বসে বসে দেখো’
কুসুম মাথা নাড়িয়ে বিছানায় বসে থাকলো।মমর রুমের বারান্দা দিয়ে বাগানের জবা ফুল গাছটা একদম কাছ থেকে দেখা যায়।কুুসুম উঠে বারান্দায় এসে গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে জবা গাছটা দেখছিল অন্ধকারের মাঝে।অবশ্য বাগানে একটা আলো জ্বলছিল গাছের ঢালে ঝুলানো।
সেটা থেকে চাঁদের আলোর মতন আলো আসছে।
হঠাৎ গ্রিলের সামনে অর্ণব এসে দাঁড়াতেই কুসুম ভয় পেয়ে দূরে সরতে গেলো তখনই সে কুসুমের হাত ধরে বললো,’আরে আমি আমি’
‘আপনি এখানে কি করেন?’
‘দেখতে এলাম তুমি সত্যি মমকে সাজাচ্ছিলা নাকি আমার সাথে রাগ করে বসে আছো,আমার থেকে দূরে থাকতে হয়ত এখানে আসলে।সেসব দেখতে এলাম’
‘হাত ছাড়ুন।মম আপু দেখলে কি বলবে?’
“অন্ধকারে ও তোমাকে দেখলেও আমার মতন কালো মানুষকে দেখবেনা।শোনো!যদি পিঠা খেতে দেয় আমার জন্য দুইটা রেখে দিও।অনেকদিন ধরে পিঠা খেতে ইচ্ছে হয়,তুমি তো বানাতে পারোনা,আর আমিও পারিনা।তাছাড়া পিঠা বানাতে কতশত উপকরণ লাগে,আসবাব লাগে।’
কুসুম তখন নিজের আঁচলের গিট্টু খুলে তিনটে শুকনো পিঠা বাড়িয়ে দিলো ওর দিকে।
অর্ণব চমকে ছোঁ মেরে পিঠাগুলো হাতে নিয়ে বললো,’আমার জন্য রেখেছো?’
কুসুম মাথা নাড়ালো।মুখে পিঠা দিয়ে খেতে খেতে চলে গেছে অর্ণব।কুসুম আবারও মমর কাছে এসে বসে আছে।সে খুব সাদামাটা সেজে পাত্র পক্ষের সামনে গেছে।
এখানে কুসুমের একটুও ভাল লাগছিলনা।ইচ্ছে করে বাসায় ফিরে যেতে।অর্ণবকে ছাড়া থাকতে নিজেকে কেমন একলা একলা মনে হয়।বেশি করে একাকিনী লাগে।
দরজার ফাঁক দিয়ে একবার তাকিয়ে খেয়াল করলো সবাই গল্পগুজবে মেতে আছে।
তাই মাথায় বড় করে ঘোমটা টেনে সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেলে সে।অর্ণব বাগানে হেঁটে হেঁটে পিঠা খাচ্ছিল।কয়েকটা সিঁড়ি উঠে আবারও নেমে গেলো কুসুম।বাগানে এসে অর্ণবের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো।অর্ণব এখনও ওকে খেয়াল করেনি।গাপুসগুপুস করে পিঠা খেতে ব্যস্ত।
অর্ণবের হাতের ঘড়িটা লাইটের আলোয় ঝিলিক মারছিল বারবার।কুসুম এক চাহনিতে সেই ঝলকানোটা দেখছে চুপ করে।
অর্ণব মুখ মুছে পেছনে ফিরে ওকে দেখে জিজ্ঞেস করলো ও এখানে কেন।
‘ভাল লাগেনা ওখানে।চলেন বাসায় ফিরি’
‘নাহ।এখানে ভাল লাগছে।বসো চেয়ারে।’
কুসুম তাই চেয়ারে বসেছে।অর্ণব ও বসলো পাশে।দুজনে চুপ করে বাগানের নিচে বেড়ে ওঠা ঘন ঘাসের উপর পা রেখে নিরবতা পালন করছে।
কুসুম হাতে ক্যানোলার ক্ষতটা চেপে ধরে দেখলো ব্যাথা হয় কিনা তারপর অর্ণবের দিকে ফিরে বললো,’ডাক্তার বলেছিলেননা সারাদিনের ঔষুধ ধরেনি?’
‘হুম’
‘তার মানে আমার দিন গুনতে হয়’
‘তোমার সাথে এ ব্যাপারে কোনো কথা বলতে চাইনা’
কুসুম মুচকি হেসে গালে হাত রেখে বললো,’আমি যদি মরে যাই মিননয়ি আপুকে বিয়ে করে নিয়েন।উনি অনেক সুন্দর আর ভাল মনের মানুষ ‘
কথাটা শুনার জন্য অর্ণব প্রস্তুত ছিলনা।এখন হা করে কুসুমের দিকে তাকিয়ে আছে শুধু।কুসুম আবার বললো,”জানেন আমি কত গুলো বর্ণ শিখে ফেলেছি।আস্তে আস্তে চিঠিও লেখা শিখে যাব।আমার লেখা প্রথম চিঠিটা হবে আপনার জন্য।আমার লেখাপড়া শিখিয়ে দিচ্ছেন তো আপনি।আপনি যখন চিঠিটা পড়বেন তখন আপনার মুখের ভাবটা দেখার খুব ইচ্ছে আমার।জানিনা পূরণ হবে কিনা তবে আমি দেখতে চাই।আমি কখনও চাইনি আমার মতন মূর্খ একটা মেয়েকে আপনি বিয়ে করেন।আপনিও হয়ত চাননি।
তবে আমি চেয়েছি আপনার স্ত্রী হয়ে থাকতে।তবে সেটা পৃথিবীর সবাইকে না জানিয়ে,আপনাকে না জানিয়ে।
কিন্তু তা আর হইলো কৈ!
একটা অশিক্ষিত মেয়েকে বিয়ে করতে বাধ্য হলেন।আমার নিজেকে সব চাইতে বড় অপরাধী মনে হয় জানেন!
আমার দোষে আপনাকে কত কষ্ট করতে হচ্ছে। তবে আপনার কপালে নিশ্চয় সুখ আছে।আমাকে দিয়ে তো সুখ পাবেননা।আপনার সুখ অন্য কারোতে নিহিত।
আমি দোয়া করবো আপনি যেন সুখী হোন।আমার সাথে নাহোক!যার সাথেই হোক তাতেই আমি অনেক খুশি।অন্তত আপনার সুখ হবে এটা ভেবেই আমি সুখী।
মাঝে মাঝে মনে হয় এখন চোখ বুজলে আর কোনোদিন খুলবেনা।কিন্তু আমার ভুল ধারণা গুলো সকাল হলে ভেঙ্গে যায়।তবে আমার যে রোগ!একদিন হয়ত এই ভুল ধারণা বাস্তবিক রুপ নেবে।’
কথা শেষ করে কুসুম মাথা তুলে দেখলো অর্ণব নেই।দূরে জবা ফুল গাছটাকে গভীর মনযোগ দিয়ে দেখছে।কুুসুম চেয়ার থেকে উঠে ওর পাশে এসে দাঁড়াতেই সে বললো,’জবা ফুল তোমার অনেক পছন্দ?’
“হুম’
‘ওহ আচ্ছা ভাল।মৃন্ময়ী কে সেটা জানো?আমার কে হয় সেটা জানো?বউ তো তুমি’
কুসুম অর্ণবের কথায় হাসলো।হাসি থামিয়ে বললো,’বউ হলেই কি স্বামীর সব কিছু হওয়া যায়?
যায় না।একজন নারী একজন পুরুষের সবকিছু তখন হয় যখন ঐ পুরুষ তাকে পাগলের মতন ভালবাসে।এ ক্ষেত্রে আপনি আমায় পাগল তো দূর থাক স্বাভাবিক মানুষের মতন করেও ভালবাসেননা।আমি আপনার কিছু হইনা, নামে স্ত্রী এই আর কি’
‘দুনিয়ার সব কিছু মোহে ভর্তি।ভালবাসা একটা আলাদা শব্দ আর মোহ আলাদা শব্দ।অথচ আমরা মোহ আর ভালবাসার তফাৎ ভুলে দুটোকে এক ভাবি’
“মোহ হোক,অথবা ভালবাসা।যার ছোঁয়ায় শরীরের বিচরণ ঘটে সেই তো ভালবাসার মানুষ।’
অর্ণব কুসুমের দিকে ফিরে বললো,’তোমাকে এসব কে শিখিয়েছে সত্যি করে বলবে?’
‘লীলাবালি শিখিয়েছে।’
‘সে তো তুমিই।তোমায় কে শেখালো?’
“লীলাবালিকে কুসুম শিখিয়েছে।তারপর লীলাবালি কুুসুমকে শিখিয়েছে।এগুলা আবার শেখানোর কি আছে?বয়স বাড়ার সাথে সাথে আপনা আপনি মাথায় এসে যায়’
‘কেউ মাায় না ঢোকালে আসার কথানা।তো আমি তোমায় ছুঁইনি তাহলে কি করে জানলে তোমায় ভালবাসিনা?’
কুসুম শাড়ীর আঁচল টেনে কাঁধ ঢেকে বাসার ভেতর যেতে যেতে বললো,’ঐ তো!!ভালবাসেননা বলে ছুঁয়ে দেখেননি।’
—
অর্ণব বুঝতে পেরেছে কুুসুম কোনো ভাবে ওর আর মৃন্ময়ীর কথা জেনেছে।আর সেই কারণে মুখটা এমন ভার করে রেখেছে ।ও কি চায়!
কুুসুমের পিছু পিছু সিঁড়ি দিয়ে আসতে আসতে অর্ণব বললো,’কি চাও তুমি একটু বলো’
‘আমি মরতে চাই’
অর্ণবের অনেক রাগ হলো।রাগ করে কুসুমের আঁচল টান দিলো সে।কুসুম থেমে আঁচল টেনে আনতে আনতে বললো, এটা কেমন আচরণ?’
‘না বিচরণ’
‘মানেহ!’
‘তোমার আঁচল ধরেছি বলে এমন করতেছো।তোমার শরীর ছুঁলে কি করবে?’
‘ছুঁবেন ও না।জানি।তাই ভয় পাচ্ছিনা।’
অর্ণব আঁচল ছেড়ে ওর পিছু পিছু চললো।বাসায় ঢুকে কুসুম আবারও সেই রুমটাতে যাওয়া ধরছিল যেটাতে সে সারা বিকাল কাটিয়েছে।
অর্ণব চট করে এবার ওর হাতটাই ধরে ফেলেছে।
‘তুমি এই রুমে যাওয়া মানে আজকে রাতে আর কিছু খাবেনা।তোমাকে তাই যেতে দিচ্ছিনা’
‘আমাকে একা থাকতে দিচ্ছেননা কেন বলুন তো!’
‘তুমি আগে আমার কাছে কাছে থাকতে চাইতে তাহলে এখন দূরে থাকতে চাও কেন?’
‘কারণ আমি ভাবতাম…..’
‘কি ভাবতে?’
‘কিছুনা।হাত ছাড়ুন।আপনি আজ বেশি জ্বালাচ্ছেন আমায়।আপনাকে না বললাম আগে যেমন ঘৃনা করতেন তেমন ঘৃনা করুন।তাহলে এত এত কেন?”
‘আমি অভিনয় করতেছিনা।
তুমি জানো???তুমি আমায় ঘৃনা করো।আর দোষ দেও আমায়।আমি তোমায় কখনও ঘৃনা করিনি।
এটা ঠিক যে আমি পছন্দ করতাম না।কিন্তু এখন করি।
না করার করার তো পথ বাকি নেই।’
‘ওই তো!বাধ্য হয়ে করতেছেন।যেটা আমি চাইনা।হাত ছাড়েন।আমি একটু শান্তিতে ঘুমাবো এখন”
‘না আমি তোমায় ঘুমাতে দেবোনা।চলো আমার সাথে শেয়াল দেখবে’
কুসুম চোখ বড় করে বললো,’না যাবনা’
‘তোমার ভাবের ভার বেড়ে গেছে একেবারে আকাশ ছোঁয়া।
তাই একটু ভয় দেখিয়ে ভাব কমাবো’
কুসুম হাত মোচড়াতে মোচড়াতে এক পর্যায়ে ফ্লোরে বসে গেছে তাও অর্ণব ওর হাত ছাড়ছেনা।
সেসময়ে জাহান এসেছিল ওদের দুজনকে ডাকতে,সন্ধ্যার নাস্তা করতে যেতে।
এসে ওদের এমন অবস্থায় দেখে সে চোখে হাত দিয়ে বললো,’চিচিচিচি!!তোমরা দরজা খুইলা রাখি এসব কি করতাছো!’
অর্ণব কুুসুমের হাত ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।কুসুম ফ্লোর থেকে উঠে বললো, জাহান আপু!কি হয়েছে?’
‘দাদি তোমাদের ডাকে।খাইতে আহো।চিচিচিচি’
অর্ণব কুুসুমের হাত আবারও ধরে মজা করে বললো,’চিচিচিচি’
‘ওটা চিচিচি না ছিঃ ছিঃ’
‘আমি ইচ্ছে করেই ব্যঙ্গ করেছি।চলো শেয়াল দেখাবো তোমায়।আজ তোমার একদিন কি আমার সারাজীবন লাগে’
চলবে♥