লেবু পর্ব-০৫

0
2

#লেবু

লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে শাফকাতের চোখদুটো আটকে গেল সোফার ওপরে দু পা তুলে বসে থাকা সাবার দিকে। মেঝের দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ রেখে ফোনে কথা বলছে সাবা। চোখ ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেও পারলো না শাফকাত। এই মেয়েটাকে একেক সময়ে একেক রকম সুন্দর লাগে। শাড়িতে মারাত্মক সুন্দর, স্যুটে অন্যরকম সুন্দর আবার এখন হালকা সবুজ রঙয়ের সালোয়ার কামিজে লাগছে স্নিগ্ধ সুন্দর।

শাফকাত বেশ বুঝতে পারছে বদরাগী এই মেয়েটার প্রতি একটু একটু করে দুর্বল হতে শুরু করেছে সে। আত্মোপলব্ধির সঙ্গে সঙ্গে মাথা ঝেড়ে অন্য দিকে চোখ সরালো। দেশের সবথেকে বড় ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট শাফকাত আলম। একের পর এক অর্থের পাহাড় গড়ে তোলা যার নেশা। এমন একটা মানুষের জীবনে প্রেম-ভালোবাসা নামক তুচ্ছ জিনিস কী করে জায়গা দখল করে নিচ্ছে? এ তো কিছুতেই হতে দেওয়া যায় না।

নিচে নেমে আসতেই সাবার কথাগুলো স্পষ্ট কানে ভেসে এলো।

সাবা ক্ষীণ হাসি হেসে বলল, “ঠিক আছে অরুণ। আমি একটু পরেই রওনা দিচ্ছি।”

গা বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল শাফকাতের। এই মেয়ের সাহস কী করে হয় তার উপস্থিতি টের পেয়েও অন্য ছেলের সঙ্গে কথা বলার? হাতদুটো মুষ্টিবদ্ধ করে রাগটা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলো শাফকাত। মেয়েটার প্রতি নিজের দুর্বলতাকে সে প্রশয় না দিলেও এই সত্যি অস্বীকার করে না যে সাবা তার। বিয়ে শব্দটা থেকে প্রাপ্ত অধিকারের বলেই হোক, কিংবা মনের জোরাজুরিতেই হোক – বিয়ের প্রথম দিন থেকে সাবাকে নিজের একান্ত আমানত মনে করে শাফকাত।

দৃপ্ত পায়ে হেঁটে শাফকাত দাঁড়ালো সাবার সামনে। ফোন রাখতেই নিজের সামনে তার উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ তুলে তাকালো সাবা। আরেকদফা প্রবল স্রোত এসে এলোমেলো করে দিয়ে গেল শাফকাতের ভেতরটা। এতক্ষণ খেয়াল করেনি, কপালে অতি সূক্ষ্ম একটা কালো টিপ পড়েছে সাবা। এই টিপে তার স্নিগ্ধ সৌন্দর্য যেন কয়েকগুণ বেড়ে যাচ্ছে। সুপ্ত এক ইচ্ছা জেগে উঠলো শাফকাতের মনে। ইচ্ছে হলো ঠিক সেদিনের মতো মেয়েটাকে সোফার সঙ্গে চেপে ধরে তার চুলে মুখ ডোবাতে।

নিজের চিন্তাভাবনায় নিজেই অবাক হয়ে উঠছে শাফকাত। এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে তার চিন্তাগুলো? এমন তো না যে জীবনে কখনো সুন্দরী মেয়ে দেখেনি সে। সিনেব্লাস্ট মিডিয়ার কর্ণধার হওয়ার সুবাদে সুন্দরী নায়িকারা মাছির মতো ঘুরঘুর করে তার আশেপাশে। সুযোগ দেওয়ার চেষ্টা করে। শাফকাতই বরং সুযোগ এড়িয়ে যায়। মেয়েমানুষকে জীবনে জড়ানো তার কাছে সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। কোনো লাভ তো এদের দিয়ে হয়ই না, বরং অযথা বিরক্ত করে জীবনটাকেই বিষিয়ে ফেলবে এরা। এই যেমন এই মেয়েটা করছে তার সঙ্গে।

সাবা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শাফকাতের দিকে।

শাফকাত থমথমে গলায় বলল, “তোমার দুঃসাহস দেখি দিন দিন বেড়েই চলেছে।”

সাবা বিভ্রান্ত ভঙ্গিতে বলল, “মানে কী?”

শাফকাত দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “আমার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আরেকটা ছেলের সাথে কথা বলছো, আবার আমাকেই মানে জিজ্ঞেস করছো?”

সাবা অবাক হয়ে বলল, “আমি আবার কোন ছেলের সাথে কথা বললাম?”

শাফকাত তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “তুমি কি আসলেই এতটা ইনোসেন্ট না-কি ইনোসেন্ট হওয়ার ভাব ধরো বলো তো?”

শাফকাতের এমন গায়ে বিরক্তির আগুন ধরিয়ে দেওয়ার মতো একটা প্রশ্নেও চুপ করে রইলো সাবা। তার মস্তিষ্ক ব্যস্ত অন্য গবেষণায়। কেন শাফকাতের মনে হলো সে কোনো ছেলের সাথে কথা বলছে? পরমুহূর্তেই উত্তরটা পেয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সাবার সমস্ত শরীরে খেলে গেল রাগের প্রবল তরঙ্গ।

লম্বা শ্বাস নিয়ে রাগটা নিয়ন্ত্রণ করার বৃথা চেষ্টা করে সাবা বলল, “অরুণ একটা মেয়ে! ওর পুরো নাম অরুন্ধতী।”

শাফকাত ভ্রু কুঁচকে বলল, “এটা আবার কেমন নাম?”

সাবা কঠিন গলায় বলল, “সরি। ওর জন্মের সময় আমার হুশ-জ্ঞান থাকলে ওর বাবা-মাকে আপনার কাছে পাঠাতাম নাম সিলেক্ট করে দেওয়ার জন্যে।”

মনে মনে ভালোই বিরক্ত হলো শাফকাত। এদেশের সবথেকে বড় ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম ‘পড়াশোনা ডট কম’-এর কর্ণধার সে। দীর্ঘ সময় নিয়ে নিজের হাতে এই ব্যবসাটা তৈরি করেছে। তারই ফলস্বরূপ আজ ক্লাস ওয়ান থেকে একেবারে বিসিএস পরীক্ষার্থী পর্যন্ত তার অ্যাপে পড়াশোনা করে ভালো ফলাফল করছে।

শিক্ষার্থীদের ‘পড়াশোনা ডট কম’কে পড়াশোনার সঙ্গী হিসেবে বেছে নেওয়ার কারণ হলো এতে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হয় না, দিনব্যাপী লাইভ ক্লাস থাকায় নিজের সময় মতো যেকোনো লাইভে অংশ নিয়ে ক্লাস করা যায়। এছাড়াও ‘পড়াশোনা ডট কম’-এর চব্বিশ ঘন্টা সেবা চালুর পর থেকে রাত তিনটার সময় কোনো শিক্ষার্থী পড়তে বসে আটকে গেলেও ফোন করে শিক্ষকের সহায়তা নিতে পারে।

গত দু বছর যাবত ‘পড়াশোনা ডট কম’ সাফল্যের চূড়ায় অবস্থান করেছে। সাফল্যকে আরেক ধাপ এগিয়ে নেওয়ার জন্যে সম্প্রতি শাফকাত অ্যাপে চালু করেছে বিভিন্ন স্কিল ডেভেলপমেন্ট কোর্স। এখন মনে হচ্ছে নতুন বাবা-মায়েদের জন্যে বাচ্চার নাম রাখা সংক্রান্ত একটা কোর্স যুক্ত করতে হবে। মেয়েদের নাম কেন ছেলেদের মতো হবে? হোক গিয়ে সেটা ডাকনাম!

সাবার চোখদুটো আবারও ফিরে গেছে তার ফোনের দিকে।

শাফকাত হঠাৎ কী যেন মনে করে বলল, “তুমি আজ অফিসে যাবে না?”

শাফকাতের এমন প্রশ্নে চমকে না উঠে পারলো না সাবা। তাকে সাধারণত সাধারণ সব প্রশ্ন করে না শাফকাত। আজ করছে কী মনে করে?

সাবা থমথমে ভঙ্গিতে বলল, “তাতে আপনার কী?”

শাফকাত ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল,“আমার কী তা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। যা জিজ্ঞেস করেছি উত্তর দাও।”

“না যাবো না। আমি অরুণের বাসায় যাবো।”

শাফকাত আদেশের সুরে বলল, “গাড়িতে ওঠো।”

সাবা অবাক গলায় বলল, “আপনার গাড়িতে?”

“তোমার নিজের গাড়িতে নিশ্চয়ই উঠতে বলবো না।”

সাবা সোজাসাপ্টা জানিয়ে দিলো, “আমি আপনার সাথে কোথাও যাবো না।”

শাফকাত অগ্নিকণ্ঠে বলল, “তাহলে এ বাড়ির বাইরে বেরও হতে হবে না।”

সাবা ধৈর্যহারা কণ্ঠে বলল, “উফ! আপনার সমস্যা কী বলুন তো? আমাকে হাতের পুতুল বানিয়ে কী মজা পান আপনি?”

সাবা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। থেমে গেল বসার ঘরে শাশুড়ির আগমনে। তার এবং শাফকাতের মধ্যকার তিক্ততা এ বাড়ির কারোর অজানা নয়। তবুও মানুষের সামনে তো আর তিক্ততা ছড়ানোর কোনো মানে হয় না। চুপ করে গেল সাবা।

আতিয়া আলম অবাক গলায় বললেন, “কী রে? বের হোসনি এখনো তোরা?”

শাফকাত শান্ত গলায় বলল, “এই তো যাচ্ছি মা। ওঠো সাবা!”

সাবা আর কথা বাড়ালো না। বাধ্য মেয়ের মতো উঠে দাঁড়ালো। বাড়ির ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে আছে শাফকাতের প্রিয় বিএমডাব্লিউ।
গাড়ির কাছে গিয়েও গাড়িতে উঠলো না শাফকাত।

সাবার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, “তোমার গাড়ির চাবিটা দাও!”

সাবা বিভ্রান্ত গলায় বলল, “কেন?”

শাফকাত ধমকের সুরে বলল, “এই মেয়ে! জীবনে একবারও কি প্রশ্ন না করে কথা শোনা যায় না?”

কথার পিঠে আর কোনো কথাই বলল না সাবা। হ্যান্ডব্যাগ থেকে গাড়ির চাবিটা বের করে দিলো শাফকাতের হাতে।

শাফকাত উঁচু স্বরে ডাকলো, “খালেক!”

তৎক্ষণাৎ বাগানের অপরপ্রান্ত থেকে ছুটে এলো শাফকাতের বডিগার্ড খালেক। সুদূর রাশিয়া থেকে ট্রেনিং নিয়ে এসেছে সে। সর্বক্ষণ তার কাঁধে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে শাফকাতের সুরক্ষার্থে লাইসেন্স করা বন্দুক।

খালেক ভদ্রভাবে বলল, “জি স্যার।”

শাফকাত গম্ভীর গলায় বলল, “ম্যামের গাড়িটা নিয়ে তুমি তার অফিসে যাবে।”

“কিছু আনতে হবেস্যার?”

শাফকাত ভাবলেশহীন গলায় বলল, “না। গিয়ে আবার ফিরে আসবে।”

সাবা ভেবে পেলো না একটা মানুষ শুধু শুধু কাউকে অফিসে গিয়ে আবার ফিরে আসতে বলবে কেন? তার থেকেও বড় কথা এমন উদ্ভট নির্দেশ পেয়েও নির্বিকার খালেক। নিশ্চয়ই শাফকাতের আজগুবি কর্মকান্ডে আগেভাগেই অভ্যস্ত সে।

সাবার বিভ্রান্ত দৃষ্টি উপেক্ষা করে শাফকাত খালেকের উদ্দেশ্যে বলল, “গ্যারেজের ঘরে তোমার জন্যে একটা পার্সেল আছে। ওখানে যা যা আছে সব পরে যাবে।”

খালেক ঘাড় কাত করে, “আচ্ছা স্যার” বলে বিদায় নিলো।

শাফকাত গাড়ি স্টার্ট দিতেই সাবা ভ্রু কুঁচকে বলল, “একটা প্রশ্ন করবো?”

“কী?”

সাবা বিরক্ত গলায় বলল, “আপনার মাথায় কি কোনো সমস্যা আছে? থাকলে তো দোষের কিছু নেই, ডক্টর দেখান।”

শাফকাত সূক্ষ্ম হাসি হেসে বলল, “আমার জীবনের সবথেকে বড় সমস্যা তুমি। কোন ডক্টরের কাছে গেলে তোমাকে শুধরে দেবে বলো তো!”

কোনমতে অরুণের বাড়ির ঠিকানা শাফকাতকে বলেই কানে ইয়ারপড গুজল সাবা। এই লোকের আর একটা কথা কানে এলেও রাগে-বিরক্তিতে পাগল হয়ে যাবে সে।

ফেসবুকজুড়ে আলোচনার শীর্ষে রাজধানীর প্রভাবশালী চাঁদাবাজদের নাম। যারা অস্থায়ী হকারদের চাঁদার বিনিময়ে সাধারণ মানুষের ফুটপাত দখল করে রাখার অধিকার দিয়েছে। এই নামগুলো উঠে এসেছে সাবার রিপোর্টে।

সাবার রিপোর্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক ভাইরাল হয়েছে। প্রভাবশালী কিছু মানুষের নাম রিপোর্টে উঠে আসার পর রীতিমত হইচই পড়ে গেছে চারিদিকে। জনতার চাপের সম্মুখীন হয়ে পুলিশ বাধ্য হয়েছে কয়েকজন চাঁদাবাজকে গ্রেফতার করতে।

ঝড় তবুও শান্ত হচ্ছে না। সাবার রিপোর্ট প্রচারের পর থেকে মানুষ নিজের অধিকার নিয়ে সচেতন হয়েছে। আগে ফুটপাত দখল করে রাখা হকারদের দাপটে একপাশ ঘেঁষে ফুটপাত দিয়ে হাঁটা পথচারীরাও এখন নেমেছে আন্দোলনে।

রিপোর্টটা করার সময়ে একবার সামান্য খারাপ লাগা কাজ করেছিল সাবার মাঝে। যারা ফুটপাত দখল করে রাখে তারা নিতান্তই দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ। তার রিপোর্ট প্রচারের পর তাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তবুও খারাপ লাগাকে প্রাধান্য দিয়ে রিপোর্ট করতে পিছপা হয়নি সাবা। ব্যবসায়ীদের জন্যে মার্কেট আছে। ফুটপাত তো কারও ব্যবসা করার জায়গা হতে পারে না।

গাড়ি থামলো অরুণের বাড়ির সামনে। সাবা কান থেকে ইয়ারপড খুলে সেটা কেসে রাখলো।

কেসটা পুনরায় ব্যাগের ভেতরে ঢুকিয়ে রাখতে রাখতে ব্যস্ততামাখা গলায় বলল, “মাকে বলে দেবেন আমি আজ রাতে এখানেই থাকবো।”

শাফকাত ভ্রু কুঁচকে অবাক গলায় বলল “মানে?”

সাবা শীতল গলায় বলল, “মানে বুঝতে না পারার তো কিছু হয়নি।”

“এখানে থাকবে কোন দুঃখে?”

“অরুণের বাবা-মা একদিনের জন্যে ঢাকার বাইরে গেছে। তাই আমি আজ ওর সঙ্গে থাকবো। মেয়েটা একা একা থাকবে না-কি?”

শাফকাত রীতিমত আক্ষেপের সুরে বলল, “এই মেয়েটার বাবা-মায়ের তো দেখি কোনোই কমন সেন্স নেই। প্রথমে মেয়ের ছেলেদের মতো একটা নাম রাখলো, এখন আবার তাকে ফেলে ঢাকার বাইরেও চলে গেছে।”

সাবা কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকিয়ে রইলো শাফকাতের দিকে।

তার কঠিন দৃষ্টি উপেক্ষা করে শাফকাত বলল,
“তুমি রাতে বাড়ির বাইরে থাকতে পারবে না সাবা।”

সাবা জোর গলায় বলল, “আপনি বললেই হলো! আমি এখানেই থাকবো।”

“দরকার হলে তোমার বান্ধবীকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে চলে যাবে। কিন্তু বাইরে থাকতে পারবে না।”

সাবা হুমকির সুরে বলল, “এই শুনুন! খবরদার আমাকে কন্ট্রোল করবেন না। আপনার কথামতো আমি চলবো না।”

শাফকাত তার হুমকি গায়ে না মেখে বলল, “রাতে খালেক তোমাকে পিক করতে আসবে। মনে থাকে যেন।”

(চলবে)