লেবু পর্ব-১৭+১৮

0
2

#লেবু
১৭
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

শূন্য হাইওয়েতে দাঁড়িয়ে আছে একটি মাত্র গাড়ি। গাড়ির দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাবা। ভাইয়ার মৃত্যুর ছয় মাস পেরিয়ে গেছে, অথচ আজও স্বাভাবিক হতে পারেনি মেয়েটা। হঠাৎ হঠাৎ যখন সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত আহনাফের মলিন মুখটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে, হৃদয়টা কয়েক দফায় মোচড় দিয়ে ওঠে। ইন্দ্রিয়গুলো সব এলোমেলো হয়ে যায়।

আহনাফ বাস্তবতার সঙ্গে লড়াই করার সাহস করে উঠতে পারেনি বলেই বিদায় নিয়েছে পৃথিবী থেকে। বদলে দিয়ে গেছে সাবাকেও। আগের সেই প্রাণবন্ত মেয়েটি সে আর নেই। আগের মতো বান্ধবীদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে বেড়ায় না, ঘুরে বেড়ায় না।

মানসিকভাবে প্রচন্ড ভেঙে পড়ে সাবা। বাবা-মায়ের সঙ্গে নিজের বাড়িতে থাকাও তার কাছে হয়ে উঠেছে অসহনীয়। বাড়ির প্রত্যেকটা ঘরে যেন আহনাফের স্মৃতি লেগে আছে। আহনাফের ঘরটার পাশ দিয়ে হেটে গেলেও সাবা স্পষ্ট দেখতে পায় সেই ভয়ানক দৃশ্য।

পরিবারে এর আগেও মৃত্যু দেখেছে সাবা। নানা-নানির মৃত্যু, বড় চাচার মৃত্যু। তবে আহনাফের মৃত্যুটা তো আর দশটা মৃত্যুর মতো নয়। যে মানুষটার এত তাড়াতাড়ি পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ছিল না, সে চলে গেল। সিলিংয়ে ঝুলে পড়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত কতটা তীব্র কষ্ট পেতে হয়েছে আহনাফকে, ভাবলেই শিউরে ওঠে সাবা।

আহনাফের চলে যাওয়ার পর তার বাবা-মাও নেহায়েত কম ভেঙে পড়েননি। এক সন্তানকে হারিয়ে বুকের মাঝে যে শূণ্যতার সৃষ্টি হয়েছে তা কখনোই পূরণ হবার নয়। তবে যে আছে, তাকেই যথাসাধ্য আগলে রাখতে শুরু করেন দুজনে। ভেঙে পড়া সাবাকে সামলাতে আহনাফের নামটা উচ্চারণ করাও বন্ধ করে দেন তারা। বাড়ি থেকে তার সমস্ত ছবি, স্মৃতিচিহ্ন সরিয়ে ফেলেন। ভাইয়ার কথা মনে পড়লেই যে তার আদরের বোনটা উদভ্রান্ত হয়ে যায়।

কিছুতেই কাজ হলো না। অফিস থেকে ফিরে যতটা সময় সাবা বাড়িতে থাকে, ততক্ষণ যেন ডুবে থাকে তীব্র হাহাকারে। হঠাৎ আমির সাহেব সংস্পর্শে এলেন বাল্যবন্ধু শাহজাহান সাহেবের সঙ্গে। লোকটা মৃত্যু পথযাত্রী। তার শেষ ইচ্ছা ছেলের বিয়ে দিয়ে যাবেন।

বাল্যবন্ধুর শেষ ইচ্ছা পূরণের তাগিদে নয়, বরং মেয়েটাকে নতুন একটা জীবন দেওয়ার উদ্দেশ্যেও আমির সাহেব তড়িঘড়ি করে তার বিয়েটা দিয়ে দেন শাফকাতের সঙ্গে। বিয়ের পর সাবার বিক্ষিপ্ত মনটা একটু হলেও তো শান্তি পেয়েছে। শাফকাতের ওপর বিরক্তির কারণেই হোক, তার চিন্তা-ভাবনার অনেকটা অংশ জুড়েই এখন সে। না হলে সারাক্ষণ ভাইয়ার প্রতি হওয়া অন্যায় নিয়ে মস্তিকে গবেষণা চালাতে চালাতেই পাগল হয়ে যেত সাবা।

হঠাৎ সাবার পাশে এসে দাঁড়ালো শাফকাত। দুজনের মুখেই কোনো কথা নেই। আড়চোখে বারবার সাবাকে দেখছে শাফকাত। মেয়েটা যে কতটা ভেঙে পড়েছে, তা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে তার চোখদুটোতে। সাবা ওপরে ওপরে এমন একটা ভাব করে যেন যথেষ্ট শক্ত-সমর্থ-সাহসী একটা মেয়ে সে। অথচ ভেতরে ভেতরে তার মতো কোমল মনের মানুষ তার দ্বিতীয়টি নেই।

শাফকাতের মনে সুপ্ত এক ইচ্ছা ফুটে উঠলো। ইচ্ছা হলো মেয়েটা আগলে ধরে তার ভেতরকার সমস্ত কষ্টগুলো দূর করে দিতে। ইচ্ছাটা ইচ্ছার মাঝেই সীমাবদ্ধ রইলো। বাস্তবে রূপ পেলো না।

বিয়ের দিনই আমির সাহেব শাফকাতকে সতর্ক করে বলেছিলেন, সাবাকে যেন তার ভাইয়া সমন্ধে কোনো প্রশ্ন না করা হয়। শাফকাতও খেয়াল রেখেছে বিষয়টার প্রতি। সে বা তার পরিবারের কেউই সাবাকে তার জীবনের এই যন্ত্রণাদায়ক অধ্যায় নিয়ে কিছুই জিজ্ঞেস করেনি।

কেন যে এমপি নিয়াজ সাহেবের সঙ্গে কথোপকথনে জড়াতে গেল শাফকাত! লোকটার খেয়েদেয়ে কোনো কাজ নেই। সাবাকে জিজ্ঞেস করে বসেছে, “আপনারা কয় ভাই-বোন?”

যে মানুষটা ভেতরে ভেতরে তীব্র মানসিক যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, ছোট্ট একটা শব্দও যথেষ্ট তাকে সেই যন্ত্রণার স্রোতে ভাসিয়ে দিতে। সাবার ক্ষেত্রে তার ভাইয়ার নামটাই তার সকল যন্ত্রণার সূচনা ঘটায়।

শাফকাত হঠাৎ লক্ষ্য করলো একটু পর পর মৃদু কেঁপে উঠছে সাবা। যেন দাঁড়িয়ে থাকাও কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে তার পক্ষে।

শাফকাত খানিক উদ্বেগ দিয়ে বলল, “তুমি ঠিক আছো?”

সাবা কাঁপা কাঁপা গলাতেই বলল, “হ্যাঁ!”

শাফকাত গম্ভীর গলায় বলল, “কাঁপছো কেন তাহলে গরমের মধ্যে?”

সাবা চুপ করে রইলো কয়েক মুহূর্ত। কিছুক্ষণ আগে তার ভেতরে ভেতরে যে ঝড় বয়ে গেল, তার রেশ এখনো লেগে আছে পুরো শরীরে।

সাবা জড়ানো কন্ঠে বলল, “ভাইয়ার কথা মনে পড়লে আমি ট্রমাটাইজ হয়ে যাই। চোখের সামনে ওর…”

শাফকাত ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “থাক, বলতে হবে না। বুঝেছি।”

বড্ড অসহায় লাগছে সাবার নিজেকে। এতটা অসহায় বোধ হয়নি এর লাগে। আগে কোনো সমস্যায় পড়লেই সাবা যে মানুষটার কাছে ছুটে যেত, সেই মানুষটাই তো আর নেই।

শাফকাত দৃঢ় ভঙ্গিতে বলল, “তোমাকে আরও স্ট্রং হতে হবে সাবা। এরকম পরিস্থিতি জীবনে আরও বহুবার আসবে। প্রত্যেকবার তোমাকে সামলানোর জন্যে আমি পাশে থাকবো না।”

সাবা চমকে উঠে তাকালো শাফকাতের দিকে। কেন চমকালো সে নিজেও বুঝতে পারলো না। তবে চমকে তার চোখদুটোতে জল এসে ছলছল করতে শুরু করলো। আজ, ঠিক এই মুহূর্তে তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে আর একটুও বিরক্তিকর, অসহ্যকর বলে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেন সাবার সবথেকে আপন মানুষটা সে।

আসলেই তো! বিয়ে নামক পবিত্র শব্দটায় একে অপরের সঙ্গে জড়ানোর পর থেকে তো শাফকাতই তার সবথেকে আপন মানুষটা। সাবাই বুঝে উঠতে পারেনি কেবল। অরুণ ঠিকই বলছিল। আজ পর্যন্ত সে শাফকাতকে বোঝার চেষ্টাই করেনি।

কেন যেন আজ সাবার মনে হচ্ছে এই মানুষটাই পারবে তার সমস্ত যন্ত্রণাগুলো দূর করে তাকে ভরসার আশ্রয় দিতে।

শাফকাত হঠাৎ কৌতূহলী গলায় বলল, “ওই মেয়েটার কী হয়েছিল?”

সাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “পালিয়ে গেছে।”

শাফকাত ভ্রু কুঁচকে বলল, “পালিয়ে গেছে মানে? কোথায় পালাবে?”

সাবা কম্পিত স্বরে বলল, “আমরা পুলিশের কাছে ওর নামে কমপ্লেইন করেছিলাম। পুলিশ ওকে খুঁজতে গিয়েছিল। কিন্তু বাসায় ওকে পায়নি। ভাইয়া চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার অ্যাকাউন্টের সব টাকা তুলে উধাও হয়ে যায়।”

শাফকাত লক্ষ্য করলো আবারও ঘোলাটে হয়ে আসছে সাবার দৃষ্টি। আবারও ভারী হয়ে উঠছে তার নিঃশ্বাস।

শাফকাত তাকে সামলানোর জন্যে বলল, “চলো বাসায় যাই।”

ড্রাইভিং সিটে বসে শাফকাত লক্ষ্য করলো, সাবার চোখেমুখে স্পষ্ট ক্লান্তির ছাপ। দিনভর দৌড়ঝাঁপ করেছে মেয়েটা। তাকে পার্টিতে নিয়ে যাওয়াটাই ভুল হয়েছে। সাবা চোখদুটো বুজে গা এলিয়ে দিলো প্যাসেঞ্জার সিটে।

শাফকাত ক্ষীণ নরম স্বরে ডাকলো, “সাবা?”

সাবা চোখদুটো বুজে রেখেই ক্লান্ত সুরে বলল,
“হুঁ?”

বড্ড মায়া লাগলো শাফকাতের। ক্লান্তিতে-কষ্টে কেমন নিস্তেজ হয়ে পড়েছে মেয়েটা। এমন সাবাকে দেখে তো অভ্যস্ত নয় সে। তার চোখে রাগী-ঝগড়াটে সাবাই মানানসই।

সূক্ষ্ম হাসি ফুটে উঠলো শাফকাতের ঠোঁটের কোণে। হাসিটা দ্রুত মুছে ফেলে শাফকাত বলল, “সিটবেল্টটা বাঁধো।”

সাবা তৎক্ষণাৎ চোখদুটো মেলে কম্পিত হাতদুটো বাড়িয়ে দিলো সিটবেল্টের দিকে। সিটবেল্টর বাঁধার সময়ও তার হাতদুটো অনবরত কাঁপছে। তাকে এমন বিপাকে দেখে শাফকাত নিজেই এগিয়ে গেল। সাবার ওপর ঝুঁকে পড়ে যত্ন নিয়ে বেঁধে দিলো সিটবেল্ট।
অবাককর বিষয় হলো, বিন্দুমাত্র অস্বস্তি লাগলো না সাবার। বরং শাফকাতের শরীর থেকে ভেসে আসা কড়া পারফিউমের ঘ্রাণে মাতোয়ারা হয়ে চোখদুটোতে ঘুম এসে জায়গা করে নিলো।

শাফকাত গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল সাবা। শাফকাতের একবার ইচ্ছা হলো গাড়িটা কোনো সুবিধাজনক জায়গায় পার্ক করে দীর্ঘক্ষণ মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে। ঘুমন্ত সাবাকে এর আগে কখনো দেখেনি শাফকাত। মেয়েটার ঘুমন্ত মুখটার মাঝে এত মায়া কে জানত?

ইচ্ছাটা দমিয়ে রেখেই ড্রাইভ করে এসে বাড়ির সামনে গাড়িটা থামালো শাফকাত। সাবার চোখেমুখে গাঢ় ঘুম। গাড়ি থেমে যাওয়ার পরেও ঘুম ভাঙলো না তার।

শাফকাত ডাকলো কয়েকবার, “সাবা! সাবা!”

তবুও কোনপ্রকার হেলদোল নেই সাবার মাঝে।

শাফকাত এবার সাবার বাহুতে হাত রেখে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল, “সাবা! এই সাবা!”

ঘুমের ঘোরেই সাবা অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো, “উঁ!”

“ওঠো। চলে এসেছি তো।”

“হুঁ।”

মুখে “হুঁ” বলেও ঠিক একই ভঙ্গিতে ঘুমিয়ে রইলো সাবা। শাফকাতের হাসি পেয়ে গেল রীতিমত। সর্বক্ষণ যে মেয়েটা ঝগড়া করার জন্যে নতুন নতুন অজুহাত খোঁজে, সে ভেতরে ভেতরে আস্ত একটা বাচ্চা!

ডাকাডাকি করেও যখন কোনো লাভ হলো না, শাফকাত গাড়ি থেকে নেমে পড়লো। সাবার দিকের দরজাটা খুলে, তার সিটবেল্টটা খুলে দিলো। এরপর যত্ন নিয়ে সাবধানে কোলে তুলে নিলো তাকে।

শাফকাত ভেবেছিল তার কোলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভেঙে যাবে সাবার। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে সে অগ্নিকণ্ঠে বলে উঠবে, “কোন সাহসে আমাকে কোলে নিয়েছেন আপনি? নামান এক্ষুনি!”

কিন্তু সেসবের কিছুই হলো না। সাবার ঘুম তো ভাঙলোই না। বরং আরামে ঘুমের ঘরেই শাফকাতের গলা জড়িয়ে ধরলো সে। কয়েক মুহূর্তের জন্যে যেন এলোমেলো হয়ে গেল শাফকাতের সবটা। স্বাভাবিকভাবে পা ফেলতেও ভুলে গেল সে। একটা মেয়ে এভাবে আষ্টেপৃষ্টে কোনো পুরুষের গায়ে লেপ্টে থাকলে, সেই পুরুষের পক্ষে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখা বেশ কঠিন।

তবুও কঠিন কাজটা করে শাফকাত সাবাকে কোলে নিয়ে পা বাড়ালো তার ঘরের দিকে। সাবাকে বিছানায় নামিয়ে রাখতেই সে বাচ্চাদের মতো দুদিকে হাত ছড়িয়ে দিলো। শাফকাত তৎক্ষণাৎ বেরিয়েই যেত। নিজেই অজান্তেই আটকা পড়ে গেল।

তার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো সাবার মায়ামাখা ঘুমন্ত মুখটা। শাফকাত বিছানায় সাবার পাশে বসলো। ঘোরগ্রস্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। কতক্ষণ? তার হিসাব নেই কারো কাছেই।

হঠাৎই শাফকাতের মনে যে ইচ্ছাটা জেগে উঠলো, তা নিতান্তই ভয়ঙ্কর। সাবা কোনো মতে টের পেলে নির্ঘাত রেগে অগ্নিমূর্তি ধারণ করবে। করুক গিয়ে! শাফকাত আলম কাউকে ভয় পায় না-কি?

নিজেই অজান্তেই শাফকাত তার শীতল ঠোঁটদুটো ছোঁয়ালো সাবার কপালে। তার স্পর্শে মৃদু কেঁপে উঠলো সাবা। তবে তার ঘুম ভাঙলো না। একবারে লোভ বেড়ে গেল শাফকাতের। আরও একবার ঠিক একই কাজটা করলো। তবে এবারের চুমুটা আরেকটু গাঢ়।

এবারও ঘুম ভাঙলো না সাবার। শাফকাতের সাহস-লোভ দুটোই বেড়ে আকাশচুম্বী। একটা একটা করে না জানি কতগুলো গাঢ় চুমুতে সে ভরিয়ে দিলো সাবার মুখটা। তবুও যেন তৃষ্ণা মিটছে না। শাফকাত বুঝি এবার প্রেমে পড়েই গেল?

(চলবে)

#লেবু
১৮
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

সকাল সকাল বাগানে পা রাখতেই এক খন্ড স্নিগ্ধতা এসে স্পর্শ করলো শাফকাতকে। সাবা বাগানে দাঁড়িয়ে তার হাতে পানির পাইপ। পানির পাইপ নলে আটকে গাছগুলোতে পানি দিচ্ছে। সূর্যের আলো সরাসরি এসে পড়েছে তার মুখের ওপরে। ঝলমল করছে তার মুখটা।

সকালবেলা কখনো এ রূপে সাবাকে দেখেনি শাফকাত। রোজ রোজ ঘুম থেকে উঠেই অফিসের জন্যে তৈরি হয়ে ঘর থেকে বের হয়। ব্রেকফাস্ট করেই ছোটে অফিসের উদ্দেশ্যে। আজ তার মাঝে কোনো ব্যস্ততা নেই। পরনে সাধারণ ঢিলেঢালা সালোয়ার কামিজ, চুলগুলো এলোমেলো।

নিজেকে শাফকাত দেখতে পারছে না ঠিকই, তবে সে নিশ্চিত তার চোখদুটোতে ঘোর লেগে গেছে। যে ঘোর থেকে বের হবার রাস্তা তার জানা নেই। সাবার থেকে মাত্র কয়েক মিটার দূরে দাঁড়িয়ে আছে সে। মেয়েটা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেই দেখতে পাবে তাকে। দেখবে তার ঘোরলাগা দৃষ্টি। তাতেও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই শাফকাতের।

শাফকাত ভেবে পায় না কী মনে করে এই মেয়েটার থেকে দূরে দূরে রয়েছে সে। বিয়েটা জোরপূর্বক হয়েছিল বলে? জীবনে সাবার আগমনের জন্যে সে প্রস্তুত ছিল না বলে? হতে পারে। তবে জীবনের সে পর্যায় পাড় করে বিচিত্র নাম না জানা এক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে শাফকাত। যে পর্যায়ে ভালো লাগা ছাড়া আর কিছুই নেই।

যান্ত্রিকতাময় এই জীবনটা জুড়ে শাফকাত এর আগে প্রেমে পড়লেও প্রেম করেনি কখনো। কত জ্ঞান তার। দেশের কত বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তার বুদ্ধিতে চলছে। অথচ মেয়েটাকে কী করে প্রেমের কথাটা বলবে সে বুঝতে পারছে না। তাও আবার মেয়েটা তারই বিয়ে করা বউ।

সাত-পাঁচ ভাবনা রেখে শাফকাত এগিয়ে গেল সাবার দিকে। এতক্ষণে তার উপস্থিতি টের পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো সাবা। গত রাতে তার মধ্যেকার সেই অস্থিরতা এখন আর নেই। যথেষ্ট স্বাভাবিক সে।

বরাবরের মতো তাকে দেখেই ভ্রু কুঁচকে ফেলল না সাবা। আবার এক চিলতে হাসিও ছুঁড়ে দিলো না। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। শাফকাতের মুখেও কোনো কথা নেই। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে সে সাবাকে। বোঝার চেষ্টা করেছে তার ভেতরটা। কাল রাতের ছোট্ট ওই ঘটনায় না জানি কোন অদৃশ্য যাদুর শক্তি ছিল। যা দুটো মানুষের মাঝেই সৃষ্টি করেছে ভিন্নতার এক অনুভূতি।

যে ভিন্নতার কোনো সংজ্ঞা নেই। তবুও শাফকাত মনে মনে টের পাচ্ছে মেয়েটাকে এতকাল যে দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে এসেছে সে, সে দৃষ্টিকোণ পাল্টে গেছে। সাবাও টের পাচ্ছে, এই মানুষটার জন্যে এতকাল ধরে তার মনে যে রাগ আর বিরক্তি জমে ছিল, তা নিমিষেই অদৃশ্য হয়ে গেছে।

সাবা নীরবতা ভঙ্গ করে সংযত গলায় বলল, ““আমার কাছে আপনার একটা থ্যাংক ইউ পাওনা আছে।”

শাফকাত সাবার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে ভ্রু কুঁচকে বলল, “থ্যাংক ইউ কেন?”

সাবা মলিন কণ্ঠে বলল, “কাল রাতে আমাকে ওখান থেকে নিয়ে আসার জন্যে।”

শাফকাত লক্ষ্য করলো কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই কেমন ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে মেয়েটার চোখমুখ। ছোটখাটো একটা ধাক্কার মতো লাগলো শাফকাতের বুকের মাঝে। এমন সাবাকে তো সে দেখতে চায় না আর কখনো। কাল রাতে ভাগ্যে জুটেছিল তার হাসির এক ঝলক দেখা।

হেসে ওঠা সাবার প্রশস্ত ঠোঁটদুটো, দু গালে লাল আভা, চোখদুটো চকচকে এক আলোর খেলা – সবটাই স্থায়ী হয়ে লেগে আছে বুকের মাঝে। চোখ বুজলেই সেই দৃশ্যটা স্পষ্ট দেখতে পায় শাফকাত। কাল থেকে এখন পর্যন্ত কতবার যে সেই দৃশ্য কল্পনায় দেখে আসছে তার কোনো হিসাব নেই।

যে মেয়েটার হাসি এতটা মোহনীয়, এতটা ঘোর লাগানো – তার তো উচিত সর্বক্ষণ ঠোঁটের সঙ্গে হাসি জুড়ে রাখা। তার মুখটা কেন সর্বক্ষণ মলিন হয়ে থাকবে?

শাফকাত ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “কাল রাতের কথা আর মনে করতে হবে না।”

সাবা দুর্বল কণ্ঠে বলল, “করছি না তো!”

সাবার চোখদুটো আবারও ফিরে গেল গাছের দিকে। অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে পাইপটা হাতে নিয়ে গাছে পানি দিয়ে যাচ্ছে সে। একদৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলো শাফকাত। ভেতরে ভেতরে এক আকাশ সমান কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছে সে প্রতিনিয়ত। একে তো কষ্টগুলোর ভার অকল্পনীয়, তার ওপরে কষ্টগুলো ভাগাভাগি করে নেওয়ার কোনো মানুষ তার নেই।

শাফকাত হঠাৎ কী যেন মনে করে ডাকলো, “সাবা?”

সাবা তার দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে বলল, “হুঁ?”

শাফকাত ক্ষীণ নরম সুরে বলল, “প্রত্যেকটা মানুষের জীবনের কষ্ট থাকে। একেক জনের কষ্ট একেক রকম। তোমার কষ্টটা ভয়ঙ্কর। এই কষ্ট কখনোই মিটে যাবে না। হয়তো আজীবন থেকে যাবে তোমার সাথে। তবে এই কষ্ট নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে। তুমি বারবার ভেঙে পড়লে সবথেকে বেশি ডিসঅ্যাপয়েন্টেড কে হবে জানো?”

সাবা অবাক আগ্রহ নিয়ে বলল, “কে?”

“তোমার ভাইয়া। সে নিশ্চয়ই কখনো তোমাকে এভাবে দেখতে চায়নি।”

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলো সাবা। আসলেই এভাবে কোনোদিন ভেবে দেখেনি সে। ভাইয়া তো সবসময় বলতো, “তুই সবসময় হাসবি সাবা। তোর গোমড়া মুখ দেখলে আমার গা জ্বলে যায়।”

মানুষটা না জানি কোথায় আছে। যেখানেই আছে, সাবাকে দেখতে পাচ্ছে নির্ঘাত। তার ভেঙে পড়াটাও নিশ্চয়ই কাম্য নয় তার। আজও কি সাবার গম্ভীর মলিনতা মাখা মুখটা দেখে আহনাফের গা জ্বলে যায়? হয়তো যায়।

কেন জানি আজ নিজেকে অনেকটা নির্ভার লাগছে সাবার। ভাইয়ার মৃত্যুর পর থেকে প্রতিনিয়ত প্রতি মুহূর্তে মনে হয় কেউ তার বুকে ভারী পাথর চেপে ধরেছে। সে পাথরটা শ্বাস নিতে দিচ্ছে না তাকে। কত মানুষ কতভাবে সান্ত্বনা দিয়েছে তাকে। কিছুতেই নেমে যায়নি পাথরটা। অথচ আজ, বিরস, কাঠিন্য ভরপুর এই মানুষটার সামান্য একটা কথাতেই যেন পাথরটা অদৃশ্য হয়ে গেল।

সাবা চাপা কৌতুহল নিয়ে বলল, “আপনি এত সুন্দর করে কথা বলতে শুরু করলেন কবে থেকে?”

শাফকাত নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “অনেক আগে থেকেই।”

“তাহলে আমি টের পেলাম না কেন?”

“ঝগড়া ছাড়া আর কোনো কথা বলেছো আমার সাথে যে টের পাবে?”

খিলখিল করে হেসে উঠলো সাবা। কয়েক সেকেন্ডের জন্যে মাত্র। তবে এই কয়েক সেকেন্ডই যথেষ্ট শাফকাত আলমকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্যে। মনটা গত রাত থেকে দ্বিধায় ডুবে ছিল। এই মুহূর্তে পাকাপোক্তভাবে নিশ্চিত হলো, আসলেই সে প্রেমে পড়ে গেছে মেয়েটার।

চিরকাল প্রেম নামক জিনিসটা যে তুচ্ছ মনে করে এসেছে, সময় অপচয়ের কারণ মনে করে এসেছে – সেই কিনা শেষমেশ এতটা তীব্রভাবে প্রেমের জালে বাঁধা পড়লো? তবুও আক্ষেপ নেই বিন্দুমাত্র। এবার আর কোনো ভুল মানুষের প্রেমে পড়েনি সে।

নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না আর শাফকাত। সাবার হাসিটা তাকে এতটাই পথভ্রষ্ট করে ছাড়লো যে মৃদু ধমক দিয়ে সে বলল, “এই মেয়ে! এত কম হাসো কেন তুমি? কোনো ধারণা আছে তোমার হাসিটা কত সুন্দর? এখন থেকে বেশি বেশি হাসবে আমার সামনে।”

ধমকে বিন্দুমাত্র দমে গেল না সাবা। উল্টো মজার ছলে বলল “আপনি এমনভাবে বলছেন যেন আমি আপনার গার্লফ্রেন্ড। আপনার সামনে বেশি বেশি হাসতে আমি বাধ্য।”

শাফকাত থমথমে গলায় বলল, “গার্লফ্রেন্ডরা কিসে বাধ্য-অবাধ্য হয় জানি না। কিন্তু গার্লফ্রেন্ডের ওপরে যারা, তারা সবকিছুতেই বাধ্য।”

হঠাৎ লজ্জা পেয়ে সাবা দৃষ্টি সরিয়ে নিলো অন্য দিকে। বাস্তবতাটাকে বিশ্বাস হচ্ছে না তার। যে মানুষটা কয়েকদিন আগেও তার কাছে ছিল পৃথিবীর সবথেকে বিরক্তিকর অসহ্যকর একজন, আজ তার সামনেই অবাধে হাসছে, লজ্জা পাচ্ছে সাবা। এসবের কিছুই সাবা ইচ্ছা করে করছে না। মন নিজের অজান্তেই করে বসছে। শাফকাতের আশেপাশে শান্তি লাগছে বড্ড। আচমকাই ছেলেটাকে খুব আপন মনে হচ্ছে বলেই কী এ শান্তি শান্তি অনুভূতির আনাগোনা?

সাবা কী যেন মনে করে বলল, “আজ আপনি আমাকে অফিসে ড্রপ করে দেবেন?”

শাফকাত ভ্রু ওপরে তুলে বলল, “সারাপথ ঝগড়া করার প্ল্যান আছে?”

আবারও হেসে উঠলো সাবা। বহুদিন হলো এমন কম সময়ের ব্যবধানে এতবার হাসেনি সাবা। হাসতে তো ভুলেই গিয়েছিল সে। ভাইয়ার চলে যাওয়ার পর থেকে মনে হতো হাসলেও অস্বস্তিতে ডুবে যাবে সে। তবে আজ কোনপ্রকার অস্বস্তিই কাজ করছে না তার মাঝে।

সাবা অফিসের জন্যে তৈরি হয়ে নিচে নেমে আসতেই তার সামনে পড়লো শামা।

শামা তাকে দেখতেই উৎফুল্ল গলায় বলল, “ভাবি! আজ কিন্তু তোমার কোনো অজুহাত শুনবো না।”

সাবা বিভ্রান্ত গলায় বলল, “আমি আবার কীসের অজুহাত দিলাম?”

শামা বাচ্চাদের মতো গাল ফুলিয়ে বলল, “সেদিন ক্রাইম নাইটের আসর বসাতে চাইলাম, তুমি রাজি হলে না। আজ কিন্তু রাজি না হলে চলবে না। আমি অরুণদিকেও আসতে বলেছি।”

সাবা অবাক গলায় বলল, “তোমরা দুজনে দুজনে প্ল্যান করে ফেললে? আমি তো কিছুই জানলাম না। অরুণও তো কিছু বলল না!”

শামা অভিমানী সুরে বলল, “তোমাকে আগেভাগে বললে একটা না একটা অজুহাত ঠিকই বের করতে। বললাম না, আজ কোনো অজুহাত শুনবো না। আমি আর অরুণদি মিলে সব প্ল্যান করে তাই লাস্ট মোমেন্টে জানাচ্ছি তোমাকে।”

সাবা আক্ষেপজড়িত বিস্ময় নিয়ে বলল, “বাহ্! আমার ফ্রেন্ড দেখি এখন আমার থেকে তোমারই বেশি!”

ক্রাইম নাইট ব্যাপারটা বেশ লাগে সাবার। শামা দেশ-বিদেশের অপরাধ নিয়ে গল্প বলে, সাবা আর অরুণ আগ্রহ নিয়ে শোনে। এমনিতেই অপরাধ ব্যাপারটায় তার আগ্রহের কমতি নেই। অপরাধ নিয়ে তাই যেকোনো ধরনের ঘাটাঘাটি তার ভালো লাগে।

শাফকাত ড্রাইভ করছে ‘বাংলার বাতাসের’ অফিসের উদ্দেশ্যে। সাবাকে ড্রপ করে যে যাবে তার চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘সিনেব্লাস্ট মিডিয়ার’ অফিসে। বেশ অনেকদিন ধরে মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে না এই ব্যবসাটাকে। গতকাল কোম্পানির অ্যানুয়াল রিপোর্ট সে কারণেই চমকে উঠেছে শাফকাত।

সাবা প্যাসেঞ্জার সিটে বসে তাকিয়ে আছে জানালার বাইরে। শাফকাত আড়চোখে তাকে দেখছে বারবার। কাল রাতে ঠিক এই সিটে বসেই গভীর ঘুমে তলিয়ে পড়েছিল মেয়েটা। তার ঘুমন্ত মুখটায় যেন আস্ত একটা মায়ার রাজ্য। ইশ! সাবা যদি এই মুহূর্তে আবার ঘুমিয়ে পড়তো! আবারও দেখা যেত তার ঘুমন্ত মুখটা। আবারও তার অনেকটা কাছাকাছি দিয়ে গভীরভাবে স্পর্শ করা যেত তাকে। নাহ্! দিন দিন লোভ বাড়িয়ে দিচ্ছে মেয়েটা।

শাফকাত হঠাৎ নীরবতা ভঙ্গ করে বলল, “সাবা?”

সাবা জানালার বাইরে থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “হুঁ?”

“I’m sorry.”

“কেন?”

শাফকাত নির্দ্বিধায় নিঃসংকোচে নিজের ভুলটা স্বীকার করে বলল, “শুরু থেকেই আমি তোমাকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করে আসছি। যদিও আমি যা যা করেছি, সবটাই তোমার ভালোর জন্যে করেছি। কিন্তু তার ধরনটা ভুল ছিল। আমার কারণেই আমাদের মধ্যে এত মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং।”

সাবা চোখ বড় বড় করে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো শাফকাতের দিকে। যে মানুষটার এত ইগো, সে কিনা নিজ থেকে সরি বলছে তাকে? এও বিশ্বাসযোগ্য?

সাবা বিস্ময়ে খাবি খেয়ে বলল, “আমার না বিশ্বাস হচ্ছে না।”

শাফকাত ভ্রু কুঁচকে বলল, “কী?”

“আপনি কি সত্যিই আমাকে সরি বলছেন? না-কি আমি স্বপ্ন দেখছি?”

শাফকাত ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম হাসির রেখা নিয়ে বলল, “তার মানে তুমি স্বপ্নেও আমাকে দেখো।”

(চলবে)