লেবু পর্ব-২০+২১

0
3

#লেবু
২০
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

“তুই ওই বদটার সাথে কথা বলতে গেলি কেন?” তীক্ষ্ণ স্বরে বলল অরুণ।

ফাহিম ছেলেটার সঙ্গে সাবার পরিচয় ইউনিভার্সিটির দ্বিতীয় সেমিস্টারে। সাবা সাংবাদিকতার ছাত্রী আর ফাহিম রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র। সাবার ছোটবেলা কেটেছে চিটাগংয়ে। সেখানকার স্কুল এবং কলেজেই দীর্ঘ সময়ে একসঙ্গে পড়ে এসেছে সাবা এবং অরুণ। এইচএসসি দিয়ে সাবা ঢাকায় চলে আসার পর দুজনের আবাস যেমন বদলে গেছে, তেমনই বদলেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তবুও যোগাযোগ ফুরিয়ে যায়নি বিন্দুমাত্র। রোজই দুয়েকবার কথা হতো ফোনে। মাঝেমধ্যে সাবা চিটাগংয়ে চলে যেতে কয়েকটা দিন অরুণের বাড়ি থাকবে বলে। অরুণও ঢাকায় এসে পড়তো সুযোগ পেলেই।

তেমনই একবার সাবা তাকে পরিচয় করিয়ে দেয় ফাহিমের সঙ্গে। প্রথম সাক্ষাতেই ভ্রু কুঁচকে অরুণ তাকিয়ে থাকে ছেলেটার দিকে। কেমন হ্যাংলা-পাতলা, নিজেকে অতিরিক্ত স্মার্ট মনে করা একটা বেকুব ছেলে। এমন একটা ছেলের সাথে সাবা প্রেম করছে কোন দুঃখে?

অরুণ সাবার মনটাকে আহত করতে চায়নি কোনোকালে। মেয়ে তখন প্রেমে অন্ধ। ফাহিমের সমন্ধে একটা বাজে কথা বলার অর্থ সাবাকে কষ্ট দেওয়া। অরুণ চুপ করেই রইলো। ফাহিমের প্রতি তার সকল রাগ উপচে পড়লো সম্পর্কটা ভেঙে যাওয়ার পর।

সাবা আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলল, “তো কী করতাম?”

অরুণ কঠিন গলায় বলল, “এড়িয়ে চলে আসতি!”

সাবা শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “আমি কী ছোট বাচ্চা অরুণ? তাছাড়া ফাহিমের সাথে তো আমার মারামারি-কাটাকাটি হয়নি যে এড়িয়ে চলে আসবো।”

সাবা কথাগুলো যতটা শান্ত ভঙ্গিতে বলল, ঠিক ততটাই অশান্ত ভঙ্গিতে অরুণ বলল, “তুই খুব ভালো করেই জানিস, এই ছেলেকে শুরু থেকেই আমি দেখতে পারি না। আমি অকারণে কাউকে অপছন্দ করি না। প্রমাণ তো নিজের হাতেই পেয়েছিস।”

মনে মনে ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলল সাবা। একটা মানুষ জীবনে কত-শত ভুলই না করে। কোনো ভুল করে তার মধ্যে আক্ষেপ থাকে, কোনো ভুল করে থাকে না। এই ভুলটা নিয়ে সাবার মাঝে আক্ষেপের শেষ নেই। মানুষের জীবন যদি কোনো ড্রইং খাতা হতো, আর একেকটা ঘটনা যদি পেন্সিলে আঁকা একেকটা ছবি হতো, সাবা ইরেজার দিয়ে সবার আগে ফাহিমের সঙ্গে নিজের ছবিটা মুছে ফেলতো।

সাবা তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল, “বাদ দে তো অরুণ! ফাহিম আমার জীবনে একটা ভুল ছাড়া আর কিছুই না। তখন বয়স কম ছিল, ওর মিষ্টি মিষ্টি কথায় গলে পড়েছিলাম।”

অরুণ হঠাৎ সতর্ক হয়ে বলল, “আচ্ছা সাবা?”

“হুঁ?”

“ভালোবেসেছিস ফাহিমকে কখনো?”

অরুণ ভেবেছিল প্রশ্নটা শুনে খানিকক্ষণ চুপ করে থাকবে সাবা। মনে মনে গবেষণা চালাতে ব্যস্ত হয়ে যাবে এই প্রশ্ন নিয়ে। তবে সেসবের কিছুই হলো না।

সাবা তড়িৎ গতিতে উত্তর দিলো, “তখন মনে হতো প্রচন্ড ভালোবাসি। একটা মানুষের পক্ষে আরেকটা মানুষকে এতটা ভালোবাসা অসম্ভব। কিন্তু এখন বুঝতে পারি, ওগুলো শুধুই আমার অল্প বয়সের আবেগ। প্রেমে পড়েছিলাম, অস্বীকার করছি না। কিন্তু ওর প্রতি যে অনুভুতিটা কাজ করতো, সেটা ভালোবাসা নয়। ভালোবাসা অন্য জিনিস।”

মানুষ কি এক জীবনে একাধিক মানুষকে ভালোবাসতে পারে? পারে হয়তো। তবে সাবার সে সাধ্য নেই। তার মতে জীবনে একটা মাত্র মানুষকেই ভালোবাসা যায়। সেই মানুষটা আর যেই হোক ফাহিম নয়।

ভালো যদি বেসেই থাকতো, তবে আজ এতগুলো বছর পর ফাহিমকে দেখে তার মধ্যে কোনপ্রকার অনুভূতি কাজ করলো না কেন। পথে-ঘাটে, কর্মক্ষেত্রে কোনো ছেলেকে দেখলে মনে যেমন নির্লিপ্ততা কাজ করে, ফাহিমকে দেখার পরও তা বজায় থাকলো কেন?

অরুণ হঠাৎ অন্যরকম গলায় বলল, “তাই না-কি? তা ভালোবাসা যে অন্য জিনিস বুঝলি কী করে?”

সাবা চমকে উঠে তাকালো অরুণের দিকে। আসলেই তো! সে তো আর কাউকে ভালোবাসেনি। তাহলে সে কি করে বুঝলো, ওই জিনিসের গভীরতা কতখানি!

অরুণ আবারও হাসি হাসি মুখে বলল, “না মানে, এটা বোঝার জন্যে তো কাউকে না কাউকে ভালোবাসা প্রয়োজন। তা তুই বুঝি ভালোবেসে ফেলেছিস শাফকাত ভাইয়াকে?”

সাবা আবারও চমকে উঠে বলল, “আরে ধুর! তেমন কিছুই না। কথার কথা বললাম আর কী।”

অরুণ সাবাকে আরেকটু চমকে দিতেই হয়তো বলল, “হুঁ! বুঝি, বুঝি!”

সাবা কম্পিত স্বরে বলল, “কী বুঝিস?”

“এই যে শাফকাত ভাইয়ার নাম শুনেই লজ্জা পাচ্ছিস! কী ভেবেছিস, এর কারণ আমি বুঝি না?”

নিজেকে সাবা দেখতে পাচ্ছে না ঠিকই, তবে সে নিশ্চিত হলো ওই মানুষটার নাম কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই তার গালদুটোয় রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়েছে। কী অদ্ভুত! ওই গম্ভীর-কঠোর ছেলেটা এতটা এলোমেলো করে দিচ্ছে কেন সাবাকে?

সাবা লজ্জাটা ঢাকবার বৃথা চেষ্টা করে বলল, “কোথায় লজ্জা পাচ্ছি?”

“লজ্জা না পেলে তোর গাল দুটো লাল হয়ে গেল কেন?”

সাবা আর কোনো উত্তর খুঁজে না পেয়ে বলল “আমার গাল এমনিতেই লাল!”

সাবার এমন নাজেহাল অবস্থা দেখে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো অরুণ। সাবাও হাসলো, তবে তার মনটা আচ্ছন্ন হয়ে গেল শাফকাতের চিন্তায়। ইদানিং তার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলে আর কোনো রাগ কাজ করে না তার মাঝে। উল্টো একটা প্রশান্তির হাওয়া বয়ে যায় গা বেয়ে। যে হাওয়ার সংস্পর্শে এসে সাবার মনে হয়, এতেই গা ভাসিয়ে থাকতে চায় সে আজীবন।

সাবা হঠাৎ কী যেন মনে করে বলল, “তুই ঠিকই বলেছিলি অরুণ। আমি না উনাকে বোঝার চেষ্টাই করিনি। সেই বিয়ের পর থেকে শুধু রাগই দেখিয়ে যাচ্ছি। বাইরে থেকে যতই কঠোর হোক না কেন, ভেতরে ভেতরে একদমই অন্যরকম উনি।”

অরুণ আবারও সাবার লজ্জারাঙা মুখটা দেখার উদ্দেশ্যে বলল, “বাব্বাহ! উনি!”

সাবা হাসিমুখে কিন্তু ভ্রু কুঁচকে বলল, “যাহ! তোর সাথে কথাই বলবো না।”

অরুণ হেসে ফেলে বলল, “আচ্ছা সরি, সরি। বল না, কেন মনে হলো ভাইয়া অন্যরকম?”

“কাল উনি আমাকে একটা পার্টিতে নিয়ে গিয়েছিল বুঝলি?”

“কীসের পার্টি?”

“আরে বাবা, উনার হোটেলে তো একটা না একটা পার্টি লেগেই থাকে। তুই গল্পটা শোন!”

“বল, বল!”

“ওখানে এক গেস্ট কথায় কথায় আমাকে
ভাইয়ার কথা জিজ্ঞেস করে বসে।”

ভাইয়ার কথাটা বলতে বলতেই সাবার গলা কেঁপে ওঠে। নিঃশ্বাস আটকে আসে। তবুও নিজেকে সামলায় সে। মনে পড়ে যায় আজ সকালে শাফকাতের বলা ওই কথাটা। তাকে এভাবে ভেঙে পড়তে দেখে সবথেকে কষ্ট তো তার ভাইয়াই পাবে।

এই প্রথম ভাইয়ার প্রসঙ্গ তুলে ভেঙে না পড়ে নিজেকে শক্ত হাতে সামলে সাবা বলল,
“সাথে সাথে আমার প্যানিক আট্যাক শুরু হয়। উনি বুঝতে পারলেন আমার অসুবিধা হচ্ছে। এক সেকেন্ডও দেরি না করে আমাকে নিয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি কিন্তু তাকে কখনো বলিনি যে প্যানিক আট্যাক হলে খোলা হাওয়া শ্বাস নিলে আমার ভালো লাগে। তাও কীভাবে যেন বুঝে গেলেন। গাড়িতে উঠিয়ে, জানালাগুলো খুলে দিয়ে অনেকক্ষণ হাইওয়েতে গাড়ি চালালেন।”

শাফকাতের কথা বলতে বলতে কোথায় যেন হারিয়ে গেল সাবা। চোখের সামনে অনবরত ভেসে উঠতে শুরু করলো গত রাতের দৃশ্য। প্যাসেঞ্জার সিটে বসে একটু পর পর সাবা আড়চোখে দেখছিল ছেলেটাকে। উদ্বেগে-উৎকন্ঠায় তার খোঁচা খোঁচা দাঁড়িগুলো খাড়া হয়ে ছিল। ড্রাইভ করতে করতে হঠাৎ যখন কতগুলো চুল এসে পড়ছিল তার কপালের ওপর, এক হাতে সেই চুলগুলো সরাচ্ছিল শাফকাত। সাবার মনে হলো, সেই দৃশ্য কম করে হলেও সহস্রবার দেখতে পারবে সে।

সাবা আবারও অন্যমনস্ক সুরে বলল, “যেই আমি শান্ত হলাম, উনি বললেন আমাকে আরও স্ট্রং হতে হবে। সব সময় আমাকে সামলানোর জন্যে উনি পাশে থাকবেন না। এই একই কথা কত মানুষের মুখে শুনেছি। কিন্তু উনার কণ্ঠে কী জানি ছিল। আমার মনে হলো সত্যিই আমাকে স্ট্রং হতে হবে। আজ সকালেও কত সুন্দর করে বোঝালেন। তুই বিশ্বাস করবি না অরুণ! আমাকে অফিসে ড্রপ করে দেওয়ার পথে সরিও বলেছে। বিয়ের পর পর অমন কন্ট্রোলিং বিহেভ করার জন্যে।”

সাবার চোখেমুখে প্রচ্ছন্ন হাসি ফুটে উঠেছে। যে হাসি কেবল ওই মানুষটার চিন্তায় ডুবে থাকার ফল।

অরুণ গালে হাত দিয়ে বলল, “সাবা আমির! তুমি তো গেছো!”

সাবা হেসে ফেলে হঠাৎ কী যেন মনে করে সতর্ক কণ্ঠে বলল, “কাল রাতে আরও একটা ঘটনা ঘটেছে জানিস।”

অরুণ আগ্রহ নিয়ে বলল, “কী?”

সাবা ঠোঁটে হাসিটা বজায় রেখেই বলল, “উনি আমাকে নিয়ে যখন বাড়ি ফিরছিলেন, আমি এতটাই টায়ার্ড ছিলাম যে গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়ি। বাড়ি সামনে এসে গাড়ি থামিয়ে উনি কতক্ষণ ডাকলেন আমাকে। আমার ঘুমও ভাঙলো। কিন্তু এতটাই আলসেমি লাগছিল যে ভাবলাম, আরেকটু ডাকুক তারপর উঠবো।”

“তারপর?”

সাবা কতক্ষণ ইতস্তত করে বলল, “উনি আমাকে আর ডাকলেনই না। সোজা কোলে তুলে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেলেন।”

অরুণ চমকে উঠে বলল, “বলিস কী!”

সাবা লজ্জামাখা কণ্ঠে বলল, “আমি এদিকে ঘুমের ভান করে পড়ে আছি। উনি কোলে নিয়েই আমাকে আমার ঘরে নিয়ে আসলেন।”

অরুণ বিরক্ত গলায় বলল, “ধুর! আমি তো ভাবলাম নিজের ঘরে নিয়ে গেল।”

সাবা চমকে উঠে বলল, “নিজের ঘরে নিয়ে যাবে কেন?”

“একটা পুরুষ কেন একটা মেয়েকে নিজের ঘরে নিয়ে যায়?”

সাবা আবারও লজ্জা পেয়ে বলল, “উফ অরুণ! অসভ্যের মতো কথা বলবি না তো।”

অরুণ তীক্ষ্ণ গলায় বলল, “মোটেও অসভ্যের মতো কথা বলছি না। উচিত কথাটাই বললাম। পরে কী হলো বল!”

সাবা হাসি হাসি মুখে বলল, “উনি আমাকে বিছানায় শুইয়ে দিলেন। আমি তো ভাবলাম এখনই চলে যাবে। কিন্তু গেল না। আমার পাশে বসে কতক্ষণ তাকিয়ে রইলো আমার মুখের দিকে। তারপর…”

অরুণ চোখ বড় বড় করে বলল, “তারপর কী?”

সাবা কীভাবে বলবে ভেবে না পেয়ে কতক্ষণ ইতস্তত করলো। অবশেষে বলেই ফেলল, “আমার কপালে কিস করলেন। তারপর আবার। সবশেষে দুই গালে, গুণে গুণে আটবার।”

অরুণ এতটাই চমকে গেল যে চমকে তার মুখ থ হয়ে গেছে। এদিকে সে কথা মনে করে সাবার ভেতরে যেন চলছে কালবৈশাখীর তুফান! ছেলেটা হয়তো ভেবেছিল সাবা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। জেগে থাকতে তো ভালো করে তাকিয়েই দেখে না। অমন অসভ্য আদর তো দূরের কথা!

অরুণ বিস্মিত গলায় বলল, “আর তুই কী করলি?”

সাবা সঙ্গে সঙ্গে বলল, “আমি আবার কী করবো? ঘুমের ভান করে পড়ে রইলাম।”

অরুণ ধমকের সুরে বলল, “ধুর গাধা! তুইও উঠে দুটো কিস করে দিতি!”

সাবা আরেকদফা লজ্জায় লাল হয়ে বলল, “পাগল হয়ে গেছিস অরুণ? আমি জীবনের এমন অসভ্যের মতো কাজ করতে পারবো না।”

অরুণ জোর গলায় বলল, “পারবি। শাফকাত ভাইয়াই একদিন তোকে দুনিয়ার সবথেকে বড় অসভ্য হতে বাধ্য করবে।”

“থামবি তুই?”

অরুণ অন্যমনস্ক হয়ে দেখছে সাবাকে। এ যেন সেই আগের সাবা। আহনাফের মৃত্যুর আগে ঠিক এমনি প্রাণচাঞ্চল্য আর একরাশ উচ্ছলতায় ভরপুর ছিল মেয়েটা। এতদিন বাদে আজ আবারও তা ফিরে এসেছে তার মাঝে। সাবার মাঝে একটু হলেও আগের ছিল উচ্ছ্বাস ফিরিয়ে এনেছে যে মানুষটা, সে নির্ঘাত একটু একটু করে জায়গা দখল করতে শুরু করেছে তার মনেও।

অরুণ হঠাৎ থমথমে গলায় বলল, “সাবা? তোরা দুজন এভাবে আলাদা ঘরে থাকার ঢংটা আর কতদিন চালিয়ে যাবি?”

“ঢংয়ের কী হলো? একটা পুরুষমানুষের সাথে এক ঘরে থাকতে আমার প্রচন্ড অস্বস্তি লাগবে।”

“কিন্তু শাফকাত ভাইয়া তো আর যেমন তেমন পুরুষমানুষ নয়। তোর হাসবেন্ড। যার কথা ভাবলে এখন তুই লজ্জা-টজ্জাও পাস।”

সাবার মুখে হাসি ফুটলো ঠিকই। তবে মন-মস্তিষ্ক আচ্ছন্ন হলো গভীর এক চিন্তায়। আসলেই তো! এভাবে আলাদা ঘরে থেকে নিজেদের মধ্যকার সমস্যাগুলো কী করে মেটাবে তারা?

অরুণ বলল, “দুজনের আলাদা ঘরে থাকার ব্যাপারটা তো তুই-ই শুরু করেছিলি তাই না?”

“হ্যাঁ। আমি এ বাড়িতে এসেই বলে দিই উনার সাথে এক ঘরে থাকতে পারবো না।”

অরুণ বিজ্ঞ গলায় বলল, “তাহলে এটা তোকেই শেষ করতে হবে। এই দূরত্বের কারণেই তোদের মধ্যে মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং এতটা বেশি।”

সাবা চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, “তোর তাই মনে হয়?”

“হুঁ! এখন যেহেতু মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং একটু একটু করে দূর হতে শুরু করেছে, আমার মনে হয় তোর ভাইয়ার ঘরে গিয়ে থাকা উচিত। একে অপরকে আরও ভালো করে জানতে পারবি।”

সাবা শঙ্কিত গলায় বলল, “কিন্তু, নিজ থেকে উনার ঘরে গিয়ে থাকার কথা বলি কী করে?”

অরুণ দুশ্চিন্তগ্রস্থ গলায় বলল, “তাও ঠিক!”

কিছুক্ষণ ভাবনা-চিন্তায় ডুবে রইলো দুজনে। আচমকা অরুণ উজ্জ্বল গলায় বলল, “এক কাজ কর! মাঝ রাতে হুট করে ভাইয়ার ঘরের দরজায় টোকা দিয়ে বল একা একা ঘুমাতে তোর ভয় লাগছে। উনার ঘরে ঘুমাবি।”

অরুণের এমন বুদ্ধি শুনে সাবা খিলখিল করে হেসে উঠলো

অরুণ ভ্রু কুঁচকে বলল, “হাসছিস কেন?”

সাবা হাসিমুখেই বলল, “উনি আমাকে ভালো করেই চেনেন। উনি জানেন এরকম আহ্লাদী মেয়ে আমি না।”

আবারও ভাবনাও ডুবে গেল অরুণ। উফ! তার বান্ধবীটা একটু আহ্লাদী হলে কী এমন ক্ষতি হতো?

কিছুক্ষণ ভেবে অরুণ বলল, “তোদের মধ্যে সম্পর্কটা এখন তো একটু স্বাভাবিক তাই না?”

“হ্যাঁ।”

“আজ রাতে ভাইয়ার দরজায় টোকা দিয়ে বলবি, ঘুম আসছিল না তাই গল্প করতে এসেছিস। গল্প করতে করতে ওখানেই ঘুমিয়ে পড়বি। ঘুম না এলেও ঘুমের ভান করে পড়ে থাকবি। সেই অভ্যাস তো ভালোই আছে! এরপর থেকে প্রত্যেকদিনই তার ঘরে গল্প করতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়বি। একটা সময়ে দেখবি ভাইয়ার ঘর আর তোর ঘর বলতে আলাদা কিছুই নেই।”

অরুণের এই বুদ্ধিটা পছন্দ হলো সাবারও। নিজের কাছে নিজেকে কেমন অচেনা লাগছে আজ। বিয়ের পর থেকে যে মানুষটা সে এড়িয়ে চলেছে, আজ তারই কাছাকাছি যাওয়ার জন্যে অজুহাত খুঁজে বেড়াচ্ছে।

ইতোমধ্যে শামা এসে ঢুকলো ঘরে। এতক্ষণ তার ঘরে বসেই আড্ডা দিচ্ছিল সাবা আর অরুণ। শামার হাতে তার ল্যাপটপ। ল্যাপটপটা বিছানার ওপর রেখে, বাতিগুলো নিভিয়ে দিয়ে লালাভ একটা ডিম লাইট ধরালো।

সাবা বলল, “এই ভূতুড়ে লাইটিংয়ের কী দরকার শামা?”

শামা উৎফুল্ল গলায় বলল, “কারণ আজ একটা ভূতুড়ে গল্পই শোনাবো ভাবি!”

অরুণ প্রতিবাদের সুরে বলল, “ক্রাইম নাইটে
ভূতের গল্প বলতে শুরু করলে কবে থেকে শামা? ভূত-টূতে আমার এমনিতেও ভয় লাগে না। ট্রু ক্রাইম শোনালে আছি, না হলে আমি ঘুমালাম!”

শামা আহত গলায় বলল, “আহা অরুণদি! আমি কি একবারও বলেছি আজকের গল্পটা ট্রু ক্রাইম স্টোরি না? ট্রু ক্রাইমই, কিন্তু ভূতুড়ে।”

সাবা কৌতূহলী গলায় বলল, “সেটা কী রকম?”

শামা আগ্রহ নিয়ে বলল, “একটা মহিলা মরে যাওয়ার পর ভূত হয়ে এসে নিজেই নিজের খুনের কেস সলভ করে!”

অরুণ ভ্রু কুঁচকে বলল, “এটা সত্যি ঘটনা?”

“অবশ্যই সত্যি ঘটনা!”

সাবা এবং অরুণ একরাশ কৌতুহল আর আগ্রহ নিয়ে তাকালো শামার দিকে। আজ বোধ জমে উঠবে ক্রাইম নাইটের আসর!

(চলবে)

#লেবু
২১
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

সাবা এবং অরুণ দুজনেই তাকিয়ে আছে শামার দিকে। অপরাধমূলক ডকুমেন্টারি সাবাও প্রচুর দেখে। না দেখলেও, অপরাধ নিয়েই তো তার যাবতীয় যত কাজ! তবুও ক্রাইম নাইটে সব সময় শামাই গল্প বলে। মেয়েটা যেকোনো সাধারণ গল্পকেও চমৎকারভাবে উপস্থাপন করে। মনে হয় যেন সত্যি ঘটনা নয়, কোনো সিনেমার গল্প বলছে সে।

শামা আগ্রহ নিয়ে বলছে, “অ্যালেন শাওরি নামের এক লোকের বাড়ির দরজায় পুলিশ টোকা দেয়। লোকটা হসপিটালের টেকনিশিয়ান। শিকাগোর মতো ব্যয়বহুল একটা শহরে তার পক্ষে এই সামান্য চাকরি দিয়ে বেঁচে থাকা সম্ভব হতো না। পাশপাশি তার একটা গার্লফ্রেন্ডও ছিল। তাই সে ছোটখাটো অড জব করতো বাড়তি ইনকামের জন্যে।”

অরুণ অধৈর্য কণ্ঠে বলল, “এ কি খুনি না-কি ভিক্টিম?”

সাবা ভ্রু কুঁচকে বলল, “আহ্ অরুণ! এখনই অধৈর্য হয়ে গেছিস? মেয়েটাকে বলতে দে তো! শামা তুমি বলো!”

শামা আবারও হাসিমুখে বলতে শুরু করলো, “অ্যালেন যে হসপিটালে কাজ করে সেখানকার এক ফিজিও থেরাপিস্ট কয়েকদিন আগে নিজ বাড়িতে খু/ন হয়। পুলিশ তার ব্যাপারেই জিজ্ঞাসাবাদ করতে এসেছে। যে মহিলা খু/ন হয় তার নাম তেরেসিতা বাসা। বয়স প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি। কিন্তু সে আমেরিকান নয়। ফিলিপাইন থেকে হয়তো বেটার অপরচুনিটির জন্যে কিংবা জীবনে একটা চেঞ্জের জন্যে সে আমেরিকায় এসেছে। একদিকে তেরেসিতা হসপিটালে কাজ করতো, আরেকদিকে ছুটির দিনে বাচ্চাদের মিউজিক শেখাতো। দাঁড়াও! তোমাদের দেখাই ভদ্রমহিলাকে।”

শামা তার ল্যাপটপে গুগলে সার্চ দিয়ে বের করলো তেরেসিতার ছবি। সাধারণ চেহারা তার। লম্বা চুল, টানা টানা চোখ, ঠোঁটে চওড়া হাসি। তবে এই সাধারণের ফাঁকেও লুকিয়ে আছে বিচিত্র একটা সৌর্ন্দয। যে সৌন্দর্য সহজে লোকের চোখে ধরা দেয় না। তবে যার চোখে ধরা দেয়, সেই বুঝতে পারে এই মাহাত্ম্য।

সাবা জিজ্ঞাসু গলায় বলল, “আমেরিকায় কেউ তার পরিচিত ছিল না?”

শামা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, “পরিচিত বলতে কলিগরা ছিল। কিন্তু সেভাবে কোনো আত্মীয়-স্বজন ছিল না। বাবা-মা, পরিবারের অন্যরা ফিলিপাইনেই থাকতো।”

“বিয়েও করেননি?”

“না। একাই থাকতো। সে কেমন যেন, ইন্ট্রোভার্ট টাইপের ছিল।”

সাবা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, “আচ্ছা, এই মহিলা খুন হলো কী করে?”

সাবার প্রশ্নের ভঙ্গি শুনে মনে হচ্ছে যেন এলাকায় কোনো অপরাধ ঘটেছে, আর সে রিপোর্ট তৈরি করার জন্যে অনুসন্ধানে এসেছে। এলাকার মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে।

শামা উৎফুল্ল গলায় বলল, “সেটাই তো কাহিনী ভাবি! উনিশশো সাতাত্তর সালের একুশে ফেব্রুয়ারি, তেরেসিতার প্রতিবেশীরা ফায়ার সার্ভিসকে ফোন দিয়ে জানায় তার বাড়িতে আগুন ধরেছে।”

অরুণ বিস্মিত গলায় বলল, “সে কী!”

“তারপর ফায়ার সার্ভিসের লোকজন দ্রুত এসে বাড়ির আগুন নেভায়। কিন্তু ভেতরে ঢুকে কাউকে দেখে না। কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে পায় একটা কার্পেট। কার্পেটের ভেতরে আরও কিছু জামাকাপড়সহ সেটা মুড়িয়ে রাখা একজনের লা/শে।”

সাবা সঙ্গে সঙ্গে আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “তেরেসিতার লা/শ?”

শামা উজ্জ্বল গলায় বলল, “ঠিক ধরেছো ভাবি! তার গায়ে কোনো কাপড়-চোপড় ছিল না, বুকের মধ্যে একটা
ছু/রি ঢোকানো।”

লা/শের বিবরণ শুনে রীতিমত শিউরে উঠলো অরুণ। তবে অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো সাবা ঠিক আগের মতোই নির্বিকার। ঘটনার বিবরণেই আটকে আছে তার সমস্ত মনোযোগ। অপরাধ নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে করতে মেয়েটার মন থেকে ভয়-ভীতি সব থেকে উড়ে গেছে।

সাবা শুকনো গলায় বলল, “অ্যাসল্ট করা হয়েছিল?”

“না। পুলিশ পরবর্তী পোস্ট মর্টাম করে কোনো অ্যাসল্টের চিহ্ন পায়নি।”

সাবা কী যেন ভেবে জিজ্ঞেস করলো “আচ্ছা শামা, কোনো ব্রেক ইনের আলামত ছিল? মানে, জোর করে দরজা ভেঙে ঘরে ঢোকার লক্ষণ ছিল?”

“না।”

সাবা কিছুক্ষণ চিন্তা-ভাবনা করে বলল,“তার মানে যে খু/ন করেছে সে তেরেসিতাকে খুব ভালো করেই চেনে! দরজা ভেঙে ঘরে ঢোকার কোনো লক্ষণ নেই কারণ তেরেসিতা নিজেই তাকে ঘরে ঢুকিয়েছে। কিন্তু বুঝতে পারেনি এই মানুষটার হাতে সে খু/ন হতে যাচ্ছে। আর যে খু/ন করেছে, সেও খু/নটাকে চাপা দেওয়ার জন্যেই ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। উনার কাপড়-চোপড় খুলে ফেলে যাতে পুলিশ এটাকে অ্যাসল্টের কেস ভেবে কনফিউজড হয়ে যায়। তাই না?”

সংবাদিকতা সাবার মাঝে এমনই অভ্যাস ছড়িয়ে দিয়েছে যে কোনো অপরাধের বিবরণ শুনলে তার মস্তিষ্ক আপনা-আপনি তদন্তে নেমে যায়। অপরাধের কারণ উদঘাটনে ব্যস্ত হয়ে যায়।

অরুণ থমথমে গলায় বলল, “এই! শুরু হয়ে গেল সাংবাদিকতার জ্ঞান!”

শামা হেসে ফেলে বলল,“অর্ধেক কাহিনী তো তুমিই বলে দিলে ভাবি। কিন্তু যা বলেছো, তা হান্ড্রেড পার্সেন্ট ঠিক।”

সাবা কৌতুহল নিয়ে বলল, “তারপর কী হলো?”

শামা দম নিয়ে আবারও বলতে শুরু করলো, “পুলিশ ইনভেস্টিগেট করতে শুরু করে, কিন্তু কিছুই পায় না। তেরেসিতার বাসায় খোঁজাখুঁজি করে তারা একটা ডায়েরি পায়। ডায়েরিতে একটা জায়গায় লেখা, Get tickets for A.S. লেখাটা তাদের কাছে সন্দেহজনক লাগে, কিন্তু এর কোনো অর্থ তারা উদ্ধার করতে পারে না। মহিলা যেহেতু কারোর সঙ্গে তেমন মিশতো না, তাই সন্দেহ করার মতোও কেউ ছিল না। পুলিশ এটাকে সাধারণ ডাকাতির কেস ভেবে কেস ক্লোজ করে দেয়। কিন্তু, মাস ছয়েক পর তাদের কাছে আসে তেরেসিতার এক কলিগ রেনে আর তার হাসবেন্ড হোসে। এই কেসের জন্যে একটা লিড নিয়ে।”

“কী সেই লিড?”

“ওই যে, ডায়েরিতে লেখা ছিল এ এস – এ এসের অর্থ অ্যালেন শাওরি!”

অরুণ তৎক্ষণাৎ বলল, “এই লোকটার কথাই তো প্রথমে বলেছিলে!”

শামা বলল, “হ্যাঁ অরুণদি! ওরা দুজন জানায় তেরেসিতার অ্যালেনের জন্যে কী একটা টিকেট কেটে দেওয়ার কথা ছিল, এজন্যেই সে এটা ডায়েরিতে লিখেছিল। যাই হোক আগেই বলেছিলাম অ্যালেন ছোটখাটো অড জব করতো, এটা হসপিটালের সবাই জানতো। তাই তেরেসিতা একদিন তাকে ডেকে বলে আমার বাড়ির টিভিটা নষ্ট হয়ে গেছে। তুমি কি সারিয়ে দিতে পারবে?”

শামা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। সাবা তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল, “এক সেকেন্ড! এক সেকেন্ড! এই গল্প তেরেসিতার ওই কলিগ আর তার হাসবেন্ড পুলিশকে বলেছে?”

“হ্যাঁ।”

“কিন্তু তারা জানলো কী করে?”

“সেটা পরে বলছি ভাবি। আগে গল্পটা শোনো!”

“আচ্ছা।”

“তো অ্যালেন বলল সে চেষ্টা করে দেখবে। ওইদিন দুপুরে তেরেসিতার বাড়িতে যায় অ্যালেন। কিন্তু তার টিভিটা ঠিক করে ব্যর্থ হয়। অ্যালেন চলেই যাচ্ছিল, হঠাৎ তার চোখ যায় তেরেসিতার গায়ের গয়নার দিকে। অ্যানেল এমনিতেই অভাবী ছিল। আর তেরেসিতার গয়নাগুলোও ছিল বেশ দামী। অ্যালেন দ্রুত তেরেসিতার গলা চেপে ধরে। তেরেসিতা ছাড়া পাওয়ার জন্যে ছটফট করতে থাকে, তখনই অ্যালেন আর কিছু না ভেবে রান্নাঘরের ছুরি বসিয়ে দেয় তার বুকে। তেরেসিতা সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। অ্যালেন আসলেই খু/নটা করতে চায়নি। কিন্তু তার ভয় হচ্ছিল, তেরেসিতা সকলকে গিয়ে বলে দেবে সে তার গয়না চুরি করতে চেয়েছিল। তাই অ্যালেন সবার আগে তেরেসিতার গয়নাগুলো খুলে নেয়। তারপর ছুরিটা বের করতে চেয়েছিল, কিন্তু ভয়ে তার হাত কাঁপছিল। তাই ছুরিটা সেভাবেই রেখে দিয়ে অ্যালেন তেরেসিতার জামা-কাপড় খুলে ফেলে।”

অরুণ ঘৃণাভরা কণ্ঠে বলল, “ছু/রি বের করতে হাত কাঁপছিল কিন্তু একটা মৃ/ত মানুষের জামা-কাপড় খুলতে হাত কাঁপলো না! জানোয়ার কোথাকার!”

শামা তার ঘৃণা সমর্থন করে বলল, “ভাবি ঠিকই বলেছিল। পুলিশকে কনফিউজড করাই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য। তেরেসিতার লা/শের ওপর অন্য কাপড় ছড়িয়ে দিয়েছিল, যাতে কার্পেটসহ ওগুলো গলে গিয়ে ছু/রিটা আপনা-আপনিই বের হয়ে আসে। কিন্তু সেটা হয়নি। অ্যালেন তো সরাসরি অস্বীকার করে এই অভিযোগ! সে তো এমন একটা ভাব করে, তেরেসিতাকে সে চিনতোই না। তার বাসায় যাওয়া তো দূরের কথা। পরে ওই হোসে আর রেনে আবারও বলে অ্যালেনের তেরেসিতার গয়নাগুলো তার গার্লফ্রেন্ডকে গিফট করেছে।”

সাবা চমকে উঠে বলল, “খুন করে চুরি করা গয়না গার্লফ্রেন্ডকে গিফট করেছে?”

“হ্যাঁ! পুলিশ অ্যালেনের গার্লফ্রেন্ডের কাছে গিয়ে দেখে আসলেই তার কাছে তেরেসিতার গয়না!”

অরুণ উৎফুল্ল ভঙ্গিতে বলল, “তার মানে অ্যালেনই খুনি?”

শামা বলল,“হ্যাঁ অরুণদি। অ্যালেন পরবর্তীতে স্বীকার করে, তার দারিদ্রের কারণে ক্রিসমাসে গার্লফ্রেন্ডকে কিছুই গিফট দিতে পারেনি। তেরেসিতার ওই গয়নাগুলো দেখে তার খুব লোভ হচ্ছিল। সে ওগুলো চুরি করে নিয়েই চলে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ তার মনে পড়ে, এই চুরির কথা তেরেসিতা হসপিটালে জানিয়ে দিলে তার মান-সম্মান তো যাবেই চাকরিটাও আর থাকবে না। তার কী করবে বুঝতে না পেরে ওর বুকে ছু/রি বসিয়ে দেয়।”

কয়েক মুহূর্তের নীরবতা বয়ে গেল এ ঘরের ভেতর দিয়ে। কাউকে ক্রিসমাসের উপহার দেওয়া কি একটা মানুষের জীবনের থেকে বেশি জরুরি হতে পারে। এই যে সামান্যতম কারণে একটা মানুষ সহজেই আরেকটা মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে, তাদের কী একবারের জন্যেও অনুশোচনা বোধ হয় না? কাউকে হ/ত্যা করার আগে তারা কি একবারের জন্যেও নিজেকে প্রশ্ন করে না, কাজটা ঠিক হবে না-কি ভুল?

সাবা অবশেষে নীরবতা ভঙ্গ করে বলল, “কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে শামা।”

“কী ভাবি?”

“পুলিশ তো নিজে থেকে খুঁজে বের করেনি যে অ্যালেনই খুনি। এমনকি তাকে সন্দেহও করেনি। তুমি বললে ওই রেনে আর হোসে এসেই তার তথ্য দিলো। কিন্তু তারা এতকিছু জানলো কী করে?”

শামা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে রহস্যের ভঙ্গিতে বলল, “তেরেসিতা বলেছে!”

সাবা হকচকিয়ে গিয়ে বলল, “কী?”

অরুণ বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে বলল, “যে মারা গেছে, সেই তেরেসিতা?”

শামা তাদের বিস্ময় দেখে হাসি হাসি মুখে বলল, “হ্যাঁ অরুণদি। মৃত তেরেসিতাই তাদের বলেছে এসব।”

সাবা ভ্রু কুঁচকে চোখেমুখে বিস্ময় নিয়ে বলল, “কী করে সম্ভব?”

শামা আবারও শান্ত ভঙ্গিতে বলতে শুরু করলো, “হসপিটালে তেরেসিতার সবথেকে ভালো বন্ধু ছিল রেনে। তারা বেশির ভাগ সময়েই একে অপরের সঙ্গে গল্প করতো। একে অপরের মনে কথা শুনতো। তেরেসিতার মৃত্যুতে রেনে তাই প্রচন্ড ভেঙে পড়ে। দিনভর শুধু তার কথাই ভাবতে থাকে। একদিন সে হসপিটালের সোফার ওপরে ঘুমিয়ে আছে, উঠে দেখে তার সামনে তেরেসিতা দাঁড়িয়ে।”

সাবা দৃঢ় ভঙ্গিতে বলল, “এটা তো হ্যালুসিনেশন!”

“এরকম হ্যালুসিনেশন রেনের সঙ্গে প্রায়ই হতে থাকে। যে যেখানেই যায়, সেখানেই তেরেসিতাকে দেখে।”

অরুণ গম্ভীর স্বরে বলল, “স্বাভাবিক। কাছের মানুষের মৃত্যুর পর অনেকের ক্ষেত্রেই এমনটা হয়।”

“কিন্তু রেনের সঙ্গে যা হচ্ছিল তা অস্বাভাবিক অরুণদি! একদিন তার হাসবেন্ড হোসে নিচ থেকে শুনতে তার বউয়ের চিৎকার আওয়াজ শুনতে পায়। ডক্টর হোসে এক দৌড়ে ওপরে যায়, কিন্তু দেখে তার বউ ঘুমিয়ে! ঘুমের মধ্যেই রেনে কাঁপছে আর বিড়বিড় করছে!”

সাবা এবং অরুণ দুজনের চোখেমুখেই নতুন করে ফুটে উঠলো বিস্ময়ের ঝলক।

শামা আবারও বলল,“এমনকি রেনের ভয়েসও পাল্টে গেছে। হোসে যেহেতু তেরেসিতাকে সেভাবে চিনতো না, তাই বুঝতে পারেনি। কিন্তু ওটা তেরেসিতার কণ্ঠ।”

অরুণ বলল, “তেরেসিতার আত্মা তাহলে রেনের ওপর ভর করেছিল?”

“তা বলতে পারবো না। কিন্তু তেরেসিতা রেনের মাধ্যমে হোসেকে বলে, This is not your wife. This is Teresita Basa. আমি আপনার স্ত্রীয়ের শরীর ছেড়ে চলে যাবো। আপনি শুধু আমাকে জাস্টিস পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিন। তারপর তেরেসিতা পুরো ঘটনার বর্ণনা দেয় হোসের কাছে। বলে সবকিছু পুলিশকে গিয়ে জানাতে।”

সাবা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অবিশ্বাসের সুরে বলল, “ধুর! আমার বিশ্বাস হয় না। হয়তো রেনে হ্যালুসিনেট করতে করতে এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে তার মনে হয় তেরেসিতা তার ওপরে ভর করেছে। হ্যালুসিনেশনের কারণেই সে তেরেসিতার কণ্ঠে কথা বলতে শুরু করে।”

“বুঝলাম। কিন্তু ভাবি, তেরেসিতা যে হোসেকে তার খুনের সমস্ত ডিটেইলস দিয়েছে। কোন সময়ে অ্যালেন তার ঘরে ঢুকেছিল, কোন সময়ে সে বেরিয়েছে সব! সবটা মিলেও গেছে। এমনকি ওই ডায়েরিতে লেখার কথাটাও তো তেরেসিতা বলে। এগুলো তো রেনে বা হোসে কারোরই জানার কথা না। এমনকি তাদের তো এটাও জানার কথা না যে ওইদিন তেরেসিতার বাসায় টিভি ঠিক করতে অ্যালেন গিয়েছিল।”

সাবা কয়েক মুহূর্ত ভেবে বলল, “আমার মনে হয় রেনে সবই জানতো। হয়তো দেখে ফেলেছিল বান্ধবীকে খুন হতে। নিজে সরাসরি পুলিশকে কিছু বলতে পারেনি কটাক্ষের ভয়ে। তাহলে তো মানুষ বলবে, তুমি বান্ধবীকে বাঁচাতে পারলে না? তেরেসিতাকে জাস্টিস পাইয়ে দিয়েই সে এই নাটকটা সাজায়।”

শামা ঠোঁট উল্টে বলল, “হতে পারে।”

অরুণ হঠাৎ কী যেন মনে করে বলল, “ভালো কথা, অ্যালেনের কী শাস্তি হয়েছিল?”

“ওকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কীভাবে কীভাবে যেন চার বছর জেল খেটেই বেরিয়ে আসে।”

সাড়ে বারোটা অবধি গবেষণা চলল কেসটা নিয়ে। সাবাও আগ্রহ নিয়ে গবেষণায় অংশ নিচ্ছিল। তবে তার সমস্ত আগ্রহ উড়ে গেল বাগান থেকে হর্ণের আওয়াজ ভেসে আসার সঙ্গে সঙ্গে। শাফকাত তার মানে বাড়ি ফিরলো অবশেষে। ছেলেটা যে কী মারাত্মক পরিশ্রম করতে পারে! সাবা ভেবে পায় না, এত অর্থ-বিত্ত আর সাফল্যের মালিক যে তাকে এই প্রবল পরিশ্রম করতে হবে কেন? শাফকাতের প্রত্যেকটা ব্যবসাই এই মুহূর্তে সফলতার অবস্থানে আছে। সে চাইলেই তো দায়িত্ব অধীনস্থদের মধ্যে বণ্টন করে নিজে আয়েশি জীবন-যাপন করতে পারে।

তবে সাফল্যের তৃষ্ণা তার মধ্যে বড্ড বেশি। এত সফলতার মুখ দেখার পর আজও অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে নতুন রূপে সাফল্যের মুখোমুখি হওয়ার জন্যে। সাফল্যের এই তৃষ্ণাটা প্রত্যেকের জীবনেই থাকা উচিত। সাংবাদিক হিসেবে বহুদূর এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন সাবা শুরু থেকেই দেখে আসছে। তবে শাফকাতের সাফল্যের তৃষ্ণা দেখে এই স্বপ্নের তেজ যেন আরেকটু বেড়ে গেল।

আনমনেই হেসে উঠলো সাবা। দুদিন আগে যে মানুষটাকে সহ্য হতো না, আজ তার দ্বারাই অনুপ্রাণিত হচ্ছে? তবে কি সত্যিই সে একটু একটু করে কাঠিন্যের চাদরে আবৃত ছেলেটাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে?

গল্প করতে করতেই শামা আর অরুণ ঘুমিয়ে পড়লো। জেগে রইলো সাবা। সে জানে গভীর রাত পর্যন্ত শাফকাত জেগে থাকে। মাঝেমধ্যে আগেভাগে ঘুমিয়ে পড়লেও আজ সে আশঙ্কা নেই। একটু আগে পায়চারি করতে করতে তার ঘরের সামনে থেকে হেঁটে এসেছে সাবা।ভেতরে বাতি জ্বলছে।

অরুণের শিখিয়ে দেওয়া বুদ্ধিটা আজ থেকেই কাজে লাগাতে হবে। ঘুমের ভান করে ওই ঘরে
থেকে যাওয়াটা একটু বেশিই বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। তাছাড়া শাফকাতের বেডে ঘুমের ভান করে পরে থাকতে তার লজ্জাও লাগবে। আজ বরং কেবল গল্প করেই চলে আসা যাক। তবে একদিন সত্যি সত্যিই সাহস করে ওই ঘরে থেকে যাবে সাবা। একদিন এভাবেই দুজনের মধ্যকার দেয়ালটা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবে সাবা।

শামার ঘর থেকে ছোট ছোট পা ফেলে বেরিয়ে যাওয়ার আগে নিজের অজান্তেই একবার আয়নার সামনে দাঁড়ালো সাবা। সাজগোজ করতে সে ভালোবাসে বটে, তবে বাড়িতে সচরাচর এক বিন্দুও প্রসাধনী থাকে না তার মুখে। এই মুহূর্তেও যেমন নেই। তার চুলগুলো এলোমেলোভাবে বাঁধা। তবুও ঠিক করে আঁচড়ে নিলো না সাবা। থাকুক না এলোমেলো। শাফকাত তাকে ভালোবেসে থাকলে তার সাজসজ্জায় অপরূপ রূপটাকে যেমন আপন করে নেবে, তেমনি আপন করে নেমে তার এই এলোমেলো রূপটাকে।

নিঃশব্দে পা ফেলে শাফকাতের ঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সাবা। মানুষটাকে কাছ থেকে এতবার দেখেছে, এত এত ঝগড়া করেছে, অথচ আজ তার মুখোমুখি হওয়ার চিত্র কল্পনায় ভেসে উঠতেই বুক টিপটিপ করতে শুরু করে দিয়েছে। অথচ সাবা কী জানতো, তার এই ধীরগতিতে বাড়ন্ত হৃদস্পন্দন একলাফে বেড়ে যাবে কিছুক্ষণের মধ্যে?

দরজায় কয়েকবার টোকা দিতেই দরজা খুলে গেল ভেতর থেকে। শাফকাতকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে মুগ্ধতার শীতল হাওয়া বয়ে গেল সাবার গা বেয়ে। বাদামি টি-শার্ট আর ধূসর ট্রাউজারে তাকে মারাত্মক হ্যান্ডসাম লাগছে। কিছুক্ষণ আগে গোসল করেছে বলে তার ভিজে চুলগুলো সুপ্ত এক স্নিগ্ধতার আভাস দিচ্ছে। পুরুষমানুষকে এতটা স্নিগ্ধ লাগলে তো মুশকিল!

সাবা মনে মনে সাহস সঞ্চয় করে বলল, “ঘুমিয়ে পড়েছিলেন?”

“না।”

শাফকাতের কণ্ঠে ক্ষীণ এক গাম্ভীর্যের আভাস পেলো সাবা।

তবুও গাম্ভীর্যটা এড়িয়ে গিয়ে ঘরের ভেতরে পা রেখে বলল, “আমি ভাবলাম একা একা বড় হচ্ছেন। তাই গল্প করতে এলাম।”

প্রচন্ড শব্দে ঘরের দরজাটা বন্ধ করলো শাফকাত। সাবা আঁতকে উঠে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। ঘরের বাইরের দিকটা অন্ধকারে ছেয়ে থাকায় এতক্ষণ খেয়াল করেনি, তবে এখন উজ্জ্বল আলোয় সাবা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে শাফকাতের রক্তিম বর্ণ ধারণ করা চোখদুটি।

শাফকাত শীতল কণ্ঠে বলল, “কেন? আমার সাথে গল্প করতে হবে কেন? পুরনো প্রেমিকের সাথে গল্প করে মন ভরেনি?”

তার কণ্ঠের শীতলতা যেন সাবার শিরদাঁড়া প্রকম্পিত করে দিয়ে গেল। শাফকাত তার মানে জেনে গেছে ফাহিমের আকস্মিক আগমনের কথা? তা না হয় জানতেই পারে। সাবা এতদিনে খুব ভালো করে বুঝে গেছে তার ওপর সার্বক্ষণিক নজর আছে ছেলেটার। তবে ফাহিম যে সাবার প্রাক্তন প্রেমিক, এ কথা সে জানলো কী করে?

লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলো সাবা। এই ছেলের পক্ষে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। এত ক্ষমতা তার। সেই ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে যে মেয়েটাকে সে বিয়ে করেছে, তার অতীত নিয়ে ঘাটাঘাটি তো করতেই পারে।

ভুল-বোঝাবুঝি এড়ানোর জন্যে সাবা মুখ খুলতে যাবে তার আগেই শাফকাত দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “তুমি কী মনে করো? আমার পেছনে কী কী করে বেড়াও আমি কিছুই টের পাই না? তোমার প্রত্যেকটা প্রদক্ষেপের ওপর নজর থাকে আমার।”

সাবা শান্ত কিন্তু কম্পিত স্বরে বলল, “দেখুন ওই ছেলেটা…”

সাবাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে শাফকাত বলল, “বয়ফ্রেন্ড ছিল না তোমার? বলো! না-কি অস্বীকার করবে?”

সাবা আরেকদফা নিজেকে শান্ত করে বলল, “ছিল, সেটা অনেক আগে। ইউনিভার্সিটির শুরুর দিকে। ব্যাপারটা তখনই শেষ হয়ে যায়। আজ অনেক বছর পর ওর সাথে দেখা হয়েছে, তাই আমি জাস্ট ভদ্রতার খাতিরে কথা বলেছি। এর বেশি কিছুই না।”

শাফকাত অগ্নিকণ্ঠে বলল, “তাই না? সাবা আমি বোকা না! এখন বুঝতে পারছি কেন, কয়েকদিন ধরে আমার সাথে ভালো ব্যবহার করছো! কারণ আমার আড়ালে তুমি আরেকজনের সাথে প্রেম করে বেড়াচ্ছো!”

অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে সাবা তাকিয়ে রইলো শাফকাতের দিকে। এত বাজে একটা দোষ কী করে তুলে দিতে পারলো সে সাবার কাঁধের ওপরে? সাবা তো ভেবেছিল তাদের মধ্যকার সব ভুল-বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে নতুন করে সম্পর্কটার সূচনা ঘটাবে। সেও বুঝতে শুরু করেছিল শাফকাতকে। অথচ সে কিনা ভাবলো অন্য কিছুকে আড়াল করার জন্যে সাবার এই বদলে যাওয়া?

সাবা নিজেকে আর ধরে রাখতে না পেরে বলল, “বাজে কথা বলবেন না তো! আমি মোটেও এতটা চিপ মেন্টালিটির মানুষ না। তাছাড়া প্রেম করে বেড়ানোর সময় কোথায় আমার?”

শাফকাত সাবার দিকে এগিয়ে এসে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, “এসব কথা বলে দোষটা ঢাকবে ভেবেছো? অভিনয় তুমি ভালোই করো সাবা।”

সাবা দৃঢ় ভঙ্গিতে বলল, “আমি অভিনয় করছি না।”

শাফকাত এমন একটা ভাব করলো যেন সবার এই কথাটা তার কানেই যায়নি। কণ্ঠে পূর্বের সেই তীক্ষ্ণতা বজায় রেখে সে বলল, “কিন্তু এসব অভিনয় আমার সঙ্গে চলবে না। আমাদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক নেই তোমার কারণে। স্বাভাবিক করার কোনো ইচ্ছাও আমার নেই। কিন্তু সারা পৃথিবীর মানুষ জানে তুমি আমার ওয়াইফ! আর সেখানে তুমি সবার সামনে আরেকটা ছেলের হাত ধরে ঘুরে বেড়াবে, সেটা তো হতে দেওয়া যায় না!”

সাবা বিরক্ত গলায় বলল, “এতই যখন গোয়েন্দাগিরি করেন, তখন এতটুকু জানতে পারলেন না যে ও দেশের বাইরে ছিল এত দিন! আজই দেশে ফিরেছে। যে মানুষ দেশেই ছিল না, তার সঙ্গে প্রেমের প্রশ্ন উঠছে কী করে?”

শাফকাত ভ্রু কুঁচকে বলল, “প্রেম কি শুধু সামনাসামনিই হয়? ফোনে ফোনেও তো হতে পারে। আলাদা ঘরে তার মানে এজন্যেই থাকতে চেয়েছিলে, তাই না?”

সাবার বিশ্বাস হচ্ছে না এই মানুষটার জন্যে কিছুক্ষণ আগেও দূর্বলতা কাজ করছিল তার মনে। ভালোলাগা কাজ করছিল তার জন্যে। অথচ এই মানুষটা যে ভালোলাগার যোগ্যই না, এ কথা বারবার ভুলে যায় সে। এমন বিশ্রীভাবে একটা মানুষ কাউকে সন্দেহ করে কী করে?

শাফকাত সাবার একেবারে কাছাকাছি এগিয়ে এসে হুমকির সুরে বলল, “মনে রেখো সাবা, তুমি যেটাকে প্রেম মনে করো সেটা এক্সট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার। আর আই প্রমিজ, তোমার এই এক্সট্রা ম্যারিটাল যদি কোনোদিন নিজের হাতে ধরতে পারি, তোমার প্রেমিক পুরুষের জান তো যাবেই। আর তোমার যে কী হাল করবো সেটা আমি নিজেও জানি না। So you better be careful!”

তার হুমকিতে দমে গেল না সাবা। তবে ভয়ানক রাগ হলো নিজের ওপরে। কী করে সে ভাবতে পারলো শাফকাতকে প্রথম প্রথম সে যেমনটা ভেবেছিল, সে তেমনটা নয়? প্রকৃতপক্ষে সে তো তার ভাবনার চাইতেও বেশি খারাপ। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে সাবা লম্বা লম্বা পা ফেলে বেরিয়ে গেল শাফকাতের ঘর থেকে। মেয়েটা কি ভুলক্রমেও একবার টের পেয়েছিল, এমন তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে আজ তাকে এ ঘরের বাইরে পা রাখতে হবে?

(চলবে)