লেবু পর্ব-২৮+২৯+৩০

0
3

#লেবু
২৮
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

পুরো দিনটা যে যার ঘরেই কাটিয়ে দিলো। ব্রেকফাস্ট সেরে বিকেল পর্যন্ত ঘুমালো সাবা। অফিসে যাওয়ার শক্তি তার মাঝে আর অবশিষ্ট নেই। ফোন করে ছুটিও নেয়নি। কেন জানি কাজের প্রতি বিচিত্র এক অনীহা সৃষ্টি হয়েছে তার মাঝে। মানুষের কাছে সত্য পৌঁছে দেওয়ার ব্রত নিয়েছে সাংবাদিকতাকে আপন করে নিয়েছিল সে। পড়াশোনা করতে করতেই স্বপ্ন দেখেছিল মানুষকে ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত সে করবে না। অন্যায়কারীদের মুখোশ টেনে ছুঁড়ে ফেলতে দ্বিধা বোধ করবে না। কাজটা নিয়ে হাজারো স্বপ্ন ছিল তার। সত্যিকার সাংবাদিক সাবা হয়েও গেল। তবে চকচকে ওই স্বপ্নগুলো এখন আর কাজ করে না তার মাঝে।

সাবা ব্যক্তিগত টানাপোড়েনে জর্জরিত হয়ে আছে চাকরির শুরু থেকে। আহনাফ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার পরপরই সাংবাদিক হিসেবে পথচলা শুরু হয় তার। একটু একটু করে শোক কাটিয়ে উঠে কাজে মনোযোগী হয়ে ওঠার চেষ্টায় ছিল সাবা।

তবে প্রকৃতি বোধ হয় তার স্বাভাবিকতায় ঈর্ষান্বিত। তাই তো আবারও প্রবল ঝড়ের মুখে এনে ফেলল তাকে। কাল রাত থেকে মাথায় কেবল একটাই চিন্তা। কী করে মুক্তি মিলবে শাফকাতের হাত থেকে? মস্তিষ্ক কেবল মুক্তির পথ খোঁজায় ব্যস্ত। কাজে মনোনিবেশ করার আর অবকাশ কোথায়?

এদিকে শাফকাতও ঘরবন্দি হয়ে কাটালো পুরোটা দিন। অসম্ভব ক্লান্ত সে। ভালোবাসা প্রকাশ করতে হয়তো সে জানে না। তাই বলে তো আর মিথ্যে হয়ে যেতে পারে না তার ভালোবাসা। বেশ বুঝতে পারছে শাফকাত, মেয়েটাকে অসম্ভব ভালোবেসে ফেলেছে সে। ভালোবাসে বলেই হয়তো তাকে ঘিরে মনের এই কসরত।

সেই সকালে সাবাকে দেখার পর থেকে বুকের মধ্যে যে ধাক্কাটা লেগেছিল, সেই ধাক্কার রেশ এখনো চলমান। মেয়েটা বড় চেষ্টা করছে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে। তবে ভেতরে ভেতরে সেও নির্ঘাত শাফকাতের মতোই এলোমেলো।

বারবার শাফকাত প্রস্তুতি নিচ্ছে সাবার কাছে ক্ষমা চাওয়ার। ক্ষমা সে এর আগেও চেয়েছে মেয়েটার কাছে। এ নিয়ে কোনো জড়তা নেই। জড়তা অপরাধ নিয়ে। আগেরবার যে অপরাধে ক্ষমা চেয়েছিল তার তুলনায় এবারের অপরাধটা অধিক গুরুতর। তবুও ক্ষমা চাইবে শাফকাত। একটা মেয়ের গায়ে হাত তোলা মোটেও বীরপুরুষস্বরূপ কোনো কাজ নয়।

সন্ধ্যার পর পর বাড়িতে এলো সিনেব্লাস্ট মিডিয়ার সিইও রাশেদ সাহেব। সঙ্গে হ্যাংলা-পাতলা একটা ছেলে। ছেলেটার নাম মাহমুদ। এই ছেলেকেই আরশাদ হকের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান কে ফিল্মসের অফিসে গুপ্তচর হিসেবে পাঠানো হয়েছে। কে ফিল্মসের ক্রিয়েটিভ টিমের একজন সদস্য হিসেবে চাকরি নিয়ে ঢুকেছে সে ওই অফিসে।

শাফকাত সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে বলল, “কী হয় কে ফিল্মসে?”

শাফকাতের হিমশীতল কণ্ঠ কিংবা দৃঢ় বাক্য, কোনো একটাতে ভয়ে জমে গেল মাহমুদ। মুখটা তার ধারণ করলো পাংশুবর্ণ। গলা দিয়ে যেন স্বরই বের হতে চাইছে না।

শাফকাত বিরক্ত গলায় বলল, “এই ছেলেকে দিয়ে কাজ হবে না রাশেদ সাহেব! একে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে পাঠান।”

আরো কয়েকগুণ ফ্যাকাশে হয়ে উঠলো মাহমুদের চোখমুখ। অসহায় দৃষ্টিতে সে তাকালো রাশেদ সাহেবের দিকে।

রাশেদ সাহেব তাকে রক্ষায় এগিয়ে এলেন। বিনয়ী গলায় বললেন, “ছেলেটা কাজের কাছে স্যার। প্রথম দিনেই আরশাদের হকের ওয়াইফের চামচামি করে তার পছন্দের তালিকায় চলে গেছে।”

ভ্র যুগল ওপরে তুলে আবারও মাহমুদের দিকে তাকালো শাফকাত। আরশাদের স্ত্রী অরা কে ফিল্মসের সিইও। কে ফিল্মসের ছোট-বড় সকল সিদ্ধান্ত সে-ই নিয়ে থাকে। অরার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে তার কাছাকাছি যেতে পারলে প্রতিষ্ঠান সম্বন্ধে খুঁটিনাটি অনেক তথ্যই পাওয়া যাবে।

মাহমুদ কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বলল, “স্যার মাত্র এক সপ্তাহ হয়েছে আমি জয়েন করেছি। খুব বেশি কিছু জানতে পারিনি। তবে যতটুকু জেনেছি, তা হলো তাদের মূল লক্ষ্য কম বাজেটে কোয়ালিটিফুল সিনেমা তৈরি করা। আর মার্কেটিং দিয়ে সেই সিনেমাগুলোকেই হিট করানো।”

শাফকাত রাশেদ সাহেবের দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, “আর আপনারা কী করেন? একেকটা সিনেমার বাজেট রাখেন এক কোটি, দুই কোটি। প্রপার মার্কেটিংও করেন না। রিলিজের আগের দিন ট্রেইলার রিলিজ করেন। সিনেমা ব্যবসা করবে কী করে?”

রাশেদ সাহেব ভীত ভঙ্গিতে মেঝের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বসে রইলেন।

শাফকাত মাহমুদের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, “রাশেদ সাহেব নিশ্চয়ই তোমাকে ঠিকঠাক পেমেন্ট দিচ্ছে।”

মাহমুদ তৎক্ষণাৎ হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়িয়ে বলল, “জি স্যার।”

“ওখান থেকে ছোট-বড় যা ইনফরমেশন পাও, সব উনাকে জানাবে।”

মাহমুদ বাধ্য গলায় বলল, “অবশ্যই স্যার।”

শাফকাত আবারও বিরক্তিভরা দৃষ্টিতে রাশেদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল, “আর রাশেদ সাহেব! আমি কিন্তু এসব নিয়ে আর মাথা ঘামাচ্ছি না। এই ছেলে কে ফিল্মসের সব ট্যাকটিকস আপনাকে এসে জানাবে। ওদের ট্যাকটিকস ব্যবহার করে ওদেরই হারাবেন। কী করে সেই ট্যাকটিকস ব্যবহার করতে হবে, এটাও যেন আমাকে বলে দিতে না হয়।”

কে ফিল্মসকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্র রচনা করা নিয়ে বিন্দুমাত্র অপরাধবোধ নেই শাফকাতের মাঝে। ব্যবসায় টিকে থাকতে হলে প্রতিদ্বন্দ্বীর গতিবিধি নজরে রাখা দোষের কিছু নয়। এ দেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি শাফকাতের গড়ে তোলা সাম্রাজ্য। তার একক সাম্রাজ্যে অকস্মাৎ বহিরাগতর অনুপ্রবেশ তো সে সহ্য করবে না।

বিকেলে সাবার ঘুম ভাঙার পর আতিয়া আলম আদরের পুত্রবধূর যত্নে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। নিজ হাতে খাইয়ে দিলেন, চুলে তেল দিয়ে বেণী করে দিলেন। তাকে সঙ্গে নিয়ে দীর্ঘ সময় গল্প করলেন। ফলে সাবাকে আর একা পাওয়া গেল না। এদিকে শাফকাতও স্টাডি রুমে অন্যান্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

রাত এগারোটার নাগাদ কাজ করতে করতে হাঁপিয়ে উঠলো শাফকাত। মনে সুপ্ত ইচ্ছা জেগে উঠলো ছাদের খোলা হাওয়ায় ধুম্রজালে ঠোঁট কালো করার।

ইচ্ছা পূরণ করতেই ছাদে উঠে গেল শাফকাত। তবে সিগারেট তার মনোযোগ আর পেলো কই?সমস্ত মনোযোগ নিজের টিকে টেনে নিয়ে গেল তার অন্তরাত্মাকে নির্দ্বিধায় এলোমেলো করে দেওয়া মেয়েটা।

ছাদে পা রাখতেই অস্পষ্ট আলোয় সাবাকে দেখলো শাফকাত। রেলিং ঘেঁষে আকাশের পানে তাকিয়ে আছে মেয়েটা। তার পরনে কালো রঙের একটা টপস আর মেরুন স্কার্ট। চুলগুলো খোঁপা করে রেখেছে বলে শাফকাত স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে তার নেশায় ডুবিয়ে দেওয়ার মতো ঘাড়।

নেশায় আসক্ত শাফকাতের চোখ দুটো বিচরণ করে বেড়াচ্ছে সাবার ঘাড় জুড়ে। ইচ্ছা তো করছে এই মুহূর্তে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে মেয়েটার ওই ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে দিতে। কিংবা তার থেকেও ভয়ংকর ইচ্ছা, মেয়েটাকে কোলে তুলে নিয়ে ঘরের দিকে পা বাড়াতে।

অস্পষ্ট ইচ্ছাগুলো মুহূর্তেই দমিয়ে ফেলল শাফকাত। সেই ইচ্ছা পূরণের পরিস্থিতি আজ নেই। তার কারণেই নেই।

ধীর পায়ে এগিয়ে গেল শাফকাত। নিঃশব্দে সাবার পাশে এসে দাঁড়ালো। তার উপস্থিতি টের পেয়েই চমকে উঠে চোখ দুটো তার দিকে নিক্ষেপ করলো সাবা। মেয়েটা বড়ই অদ্ভুত। কাল রাতে অমন তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়ার পরেও কোনোপ্রকার অভিমান নেই তার মাঝে। তার জায়গায় অন্য কোনো মেয়ে হলে তো পদে পদে মুখ ফিরিয়ে নিতো শাফকাতের ওপর থেকে।

নীরবতা ভঙ্গের উদ্দেশ্যে শাফকাত ভারী গলায় বলল, “এত রাতে এখানে কী করছো?”

“এত রাতে এখানে আসতে নিষেধ আছে না-কি?”

সাবার কণ্ঠে কোনো রাগ নেই, অভিমান নেই। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নটা করলো সে। উত্তরে কিছুই খুঁজে পেলো না শাফকাত। তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যে মানুষটা কোনোকিছুতেই বিভ্রান্ত হয় না, মেয়েটার সামান্য এই প্রশ্নে বিভ্রান্তিতে জড়িয়ে গেল সে। কী উত্তর দেবে? ভেবে পেলো না।

উত্তরের প্রতীক্ষায় কয়েক মুহূর্ত সাবা শাফকাতের দিকেই তাকিয়ে রইলো। উত্তর না পেয়ে আবারও দৃষ্টি ফিরিয়ে দিলো আকাশের পানে। সেই দৃষ্টি অনুসরণ করে এবার শাফকাতও তাকালো সেদিকে।

বাঁকা চাঁদ আলো ছড়াচ্ছে চারিদিকে। অদ্ভুত সুন্দর লাগছে আজ চাঁদটাকে। চাঁদ-তারায় মুগ্ধতাযাপনের অবকাশ শাফকাত এ জীবনে পায়নি। তার মতো নিতান্ত অনুভূতিহীন একটা মানুষের কাছেও আজ চাঁদটাকে মোহনীয় লাগছে। কারণ শুধু এই মেয়েটা। সাবা চাঁদের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বলেই তো চাঁদটা এত সুন্দর। উফ! পদে পদে শাফকাতের সর্বনাশ ডেকে আনছে এই মেয়ে।

আরও একবার নীরবতা ভঙ্গ করে শাফকাত ডাকলো, “সাবা?”

সাবা আবারও ঠিক তার চোখের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল, “হুঁ।”

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে শাফকাত বলল, “I’m sorry. আমি…”

শাফকাত আর কিছু বলতে পারে, তার আগেই তাকে থামিয়ে দিয়ে সাবা অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় বলল, “It’s okay. সমস্যা নেই।”

শাফকাত দৃঢ় ভঙ্গিতে বলল, “না, সমস্যা আছে। তোমার গায়ে হাত তোলার কোনো অধিকার আমার নেই। আমি চাইওনি। নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পেরে…”

সাবা ক্ষীণ হেসে বলল, “কোনো সমস্যা নেই, বললাম তো। ঠিকই করেছেন আপনি। আপনার বউ আমি। একটা সোশ্যাল স্ট্যাটস তো আমারও আছে। যার তার কথা বলা কি আমাকে মানায়?”

সাবা শাফকাতের সঙ্গে স্বাভাবিক গলায় কথা বললেও ভেতরে ভেতরে রাগে ফুঁসছে। সমস্যা কী এই ছেলের? এই কষ্ট দেবে, রাগ দেখাবে। এই ক্ষমা চাইবে!

মাফ করবে না এবার আর তাকে সাবা। উচিত শিক্ষা দিয়েই ছাড়বে। শাফকাতের কোনো ক্ষোভ যাতে তার ওপর না থাকে, তাই এই স্বাভাবিক থাকার অভিনয়। যত বেশি ছেলেটা রাগ করবে, তত বেশি নজরদারি বাড়িয়ে দেবে সাবার ওপরে।

হঠাৎ সাবার চোখ গেল ব্যান্ডেজে মোড়ানো শাফকাতের হাতটার দিকে।

উদ্বিগ্ন গলায় সাবা বলল, “আপনার হাতে কী হয়েছে?”

শাফকাত বরাবরই মতো থমথমে গলায় বলল, “কিছু না।”

“দেখি!”

নির্দ্বিধায় হাত বাড়িয়ে শাফকাতের হাতটা স্পর্শ করলো সাবা। এই প্রথম নিজ থেকে তাকে স্পর্শ করলো সাবা। এই স্পর্শ যে তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটির মনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, এই খবর যদিও তার জানা নেই।

সাবার নরম দুহাতের মুঠোয় শাফকাতের শক্ত-পোক্ত হাতটা। সাবা বেশ বুঝলো নিজেকে আঘাত করেই এই ক্ষতের সৃষ্টি করেছে শাফকাত।

সাবা হতভম্ব গলায় বলল, “আপনি কি পাগল?”

মনে মনে মুচকি হাসলো শাফকাত। পাগল সে বটেই। আগে ছিল না। আগে তার বিবেক সর্বক্ষণ সঙ্গ দিত। আজ বিবেক ছুটে পালিয়েছে। সাবার আসক্তিতে পাগল হয়ে গেছে সে।

(চলবে)

#লেবু
২৯
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

চাপা অস্থিরতার মাঝেই একটা মাস পাড় করে দিলো সাবা। পৃথিবীর সামনে সে যথেষ্ট স্বাভাবিক। স্বাভাবিকভাবে অফিসে যাচ্ছে, রিপোর্টের জন্যে ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে। তবে ভেতরে ভেতরে যে কী ভয়ানক গুমোট পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে সে যাচ্ছে, তা কেবল সেই জানে।

শাফকাতের সঙ্গে তার সম্পর্কে আবারও জায়গা করে নিয়েছে শীতলতা। আগে তারা প্রয়োজন ছাড়া একে অপরের সঙ্গে কথা বলতো না। এখন প্রয়োজনেও বলে না। একে অপরের সামনে পড়লে স্বাভাবিকভাবেই এড়িয়ে যায়। আগে তাও দুজনে মুখোমুখি হলে ঝগড়া বেঁধে যেত। এখন তাও হয় না।

দুজনের মধ্যকার এই শীতলতা দেখে আতিয়া আলম যথেষ্ট চিন্তিত। কিছুদিন আগেও দুজনের সম্পর্কটা উন্নতির দিকে এগোচ্ছিল। মাঝখানে কী এমন হলো কে জানে? আবারও সেই আগে শীতলতা! সাবার ওপর মনে মনে এবার একটু বিরক্তই তিনি। তার আলাদা ঘরে থাকা, শাফকাতের সঙ্গে ঝাঁঝালো কণ্ঠে কথা বলা এসব মেনে নিয়েছিলেন তিনি। ভেবেছিলেন অতীত নিয়ে মেয়েটার যন্ত্রণার শেষ নেই। স্বাভাবিক হোক সে! তাই বলে আট মাসেও স্বাভাবিক হবে না? ছেলেটাকে তো আর এমনি এমনি বিয়ে দেননি তিনি।

সেদিন সাবাকে নিজের ঘরে ডেকে আদুরে গলাতেই কতগুলো উপদেশ দিলেন। সে সকল উপদেশের সারমর্ম, স্বামীর প্রতি দায়দায়িত্ব পালন করতে না পারলেও প্রত্যেকটা মেয়ের উচিত তাকে সম্মান করে চলা। সাবাও সতর্ক হয়ে গেল। এই মুহূর্তে এমন কিছু করা যাবে না যাতে এ বাড়ির কেউ তাকে সন্দেহ করে, তার ওপরে অসন্তুষ্ট থাকে।

এরপর থেকে মাঝেমধ্যেই নিজ থেকে শাফকাতকে বলে তাকে অফিসে নামিয়ে দিতে। পুরোটা পথ দুজনে টু শব্দ পর্যন্ত করে না। একসঙ্গে যায়, এই যা।

এদিকে ফাহিমের বদৌলতে কাজ বহুদূর এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশিদের পক্ষে অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ী চাকরি পাওয়া সহজ কথা নয়। তবে ফাহিম তার চেনাজানা কাজে লাগিয়ে যোগাযোগ করলো ক্যানবেরার পরিচিত একটা পত্রিকার সঙ্গে। সাবার সিভি দেখে তারা মুগ্ধ না হয়ে পারলো না। তাদের সাবার তৈরি করা কতগুলো রিপোর্টও পাঠানো হলো, সাবটাইটেল জুড়ে দিয়ে। সব মিলিয়ে প্রাথমিকভাবে তারা সন্তুষ্ট হলে সাবাকে ইন্টারভিউয়ের জন্যে ডাকা হলো।

ইন্টারভিউ হবে অনলাইনে। সেদিন যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করলো সাবা। বাড়িতে বসে ইন্টারভিউ দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। অফিসের ওপরেও রয়েছে শাফকাতের জহুরি দৃষ্টি। অগত্যা অরুণের বাড়িতে গিয়ে ইন্টারভিউটা দিলো সাবা।

অরুণকে তার প্ল্যান সম্বন্ধে কিছুই জানায়নি সাবা। এই মুহূর্তে কাউকেই বিশ্বাস করতে পারছে না সে। যদিও অরুণকে অবিশ্বাসের কোনো কারণ নেই। তবুও ভয় হয়। কোনো না কোনোভাবে যদি শাফকাত জেনে যায়!
সাবা অরুণকে আরেকটা গল্প বানিয়ে বলেছে। বলেছে, বিদেশি এক ব্যবসায়ীর অনলাইন ইন্টারভিউ নিতে এসেছে। ব্যাকরাউন্ড হিসেবে অরুণের ঘরটা সুন্দর লাগবে বলে এ বাড়িতে আসা। একটা মিথ্যা বললে, তার পরপর অনেকগুলো মিথ্যা বলে যেতে হয়। পদে পদে এত মিথ্যা বলতে অসম্ভব খারাপ লাগছে সাবার। কিন্তু কিছুই করার নেই। মুক্তির জন্যে এতটুকু খারাপ লাগা তো সহ্য করতেই হয়।

তবে কি সাবা ভয় পাচ্ছে শাফকাতকে? না, না। ভয় সে কাউকেই পায় না। ভয় হচ্ছ নিজের বন্দী দশার কথা ভেবে, কোনোক্রমে শাফকাতের কাছে ধরা পড়ে গেলে নিজের পরিণতির কথা ভেবে।

বিদেশি পত্রিকার সম্পাদক হাজার মাইল দূর থেকেও বুঝতে পারলেন যে মেয়েটি তার পত্রিকায় চাকরির প্রত্যাশা করছে, সে তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন। একজন সাংবাদিকের বুদ্ধিমত্তা তার সব থেকে বড় হাতিয়ার।

ইন্টারভিউয়ের সপ্তাহখানেকের পরই কনফারমেশন লেটার পেয়ে গেল সাবা। তাদেরকে সম্পূর্ণ নতুন একটা ই-মেইল অ্যাড্রেস দিয়েছিল সে। যা কিছুদিন আগেই অফিসে বসে ফাহিমের ল্যাপটপ থেকে খুলেছিল। যা কোনোভাবেই শাফকাতের জানার কথা নয়। কনফারমেশন লেটার পাওয়ার পর ফাহিমের প্রতি বিশ্বাস বেড়ে গেল সাবার। ছেলেটা কাজের আছে তাহলে!

শাফকাত হঠাৎ মালয়েশিয়ায় গেল একটা বিজনেস ডিলের জন্যে। সে দেশে না থাকলে সাবার নিরাপত্তায় এতটাও কড়াকড়ি থাকে না। বিদেশে বসে কাজের চাপে শাফকাত তার ওপরে নজরদারি করারও অবকাশ পায় না। সুযোগের সদ্ব্যবহার করে সাবা ভিসার আনুষ্ঠানিকতায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

এ দেশে অস্ট্রেলিয়ার কোনো দূতাবাস নেই। ভিএফএসের অফিসে তাকে যেতে হলো ইন্টারভিউয়ের জন্যে। কাগজ-পত্রের হাজারটা ঝুঁট-ঝামেলা। সব ঝামেলা ফাহিম নিজেই সামাল দিলো। এ মাসে তার অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। সাবাকে সাহায্য করবে বলে নিজের ফিরে যাওয়াও পিছিয়ে দিলো।

ভিসার আনুষ্ঠানিকতার জন্যে পাসপোর্ট সাবার কাছে নেই। যদিও অষ্ট্রেলিয়া থেকে ই-ভিসা পাঠানো হবে তাকে। তবুও অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতার জন্যে পাসপোর্টটা সেখানেই জমা রাখা হয়েছে।

শাফকাত মালয়েশিয়া থেকে ফেরার কিছুদিন পরের ঘটনা। ছাদের ওই কথোপকথনের পর সেদিনই প্রথম নিজ থেকে কথা বলতে এলো।

ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলল, “সাবা, তোমার পাসপোর্টটা লাগবে।”

মনে মনে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো সাবা। শাফকাত হঠাৎ তার পাসপোর্ট চাচ্ছে কেন? কিছু টের পেয়ে গেল কি তাহলে?

মনে মনে চমকে উঠলো বাইরে যথেষ্ট স্বাভাবিক থেকেই সাবা বলল, “কেন?”

শাফকাত গম্ভীর গলায় বলল, “মা আর শামার আমেরিকার ভিসার জন্য অ্যাপ্লাই করবো। ওরা বছরে একবার ওখানে খালার কাছে যায়। তোমার ইচ্ছা হলে তুমিও যাতে যেতে পারো তাই তোমার ভিসার অ্যাপ্লিকেশনও করবো।”

মনে মনে ঢোক গিললো সাবা। সত্যির মতো করে মিথ্যা বলার মতো কঠিন কাজ এ পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। সেই মিথ্যা যদি বলা হয় শাফকাতের মতো চতুর ব্যক্তির কাছে, তাহলে তো কথাই নেই।

সাবা মুহূর্তেই মনে মনে কথা সাজিয়ে বলল, “আমার ভিসার অ্যাপ্লিকেশন তো করতে পারবেন না। আমার পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ। রিনিউ করানো হয়নি।”

শাফকাত তীক্ষ্ম স্বরে বলল, “তাহলে রিনিউ করিয়ে আনো! আমি পাসপোর্ট অফিসের সাথে কথা বলে রাখছি।”

আবারও ধ্বক করে কেঁপে উঠলো সাবার বুকটা। নিজের চেয়ে হাজারগুণ শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামাটাই তার ভুল হয়েছে।

ভুল হোক আর ঠিক! এবার যখন এই প্রতিযোগিতায় সাবা নেমে গেছে, তখন আর পেছন ফিরে তাকাবার সুযোগ নেই।

সাবা কম্পিত স্বরে স্বাভাবিকতার ছোঁয়া এনে বলল, “আপনাকে অযথা এত ঝামেলা নিতে হবে না। আমি নেক্সট উইকেই বাবা-মায়ের সঙ্গে রিনিউ করতে যেতাম। ওদের পাসপোর্টেরও মেয়াদ শেষ। পাসপোর্ট অফিসে বাবার পরিচিত লোক আছে, একদিনেই কাজ হয়ে যাবে।”

শাফকাতের চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে সাবার কথাগুলো সে বিশ্বাস করছে না। আবার অবিশ্বাসের সুযোগও নেই।

কতক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সাবার গতিবিধি লক্ষ্য করে শাফকাত বলল, “ঠিক আছে। রিনিউ করে পাসপোর্ট হাতে পেলেই আমাকে দেবে।”

সাবা বাধ্য মেয়ের মতো বলল, “জি আচ্ছা।”

শাফকাত চলে যেতেই হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো সাবা। প্রকৃতি পদে পদে বাঁচিয়ে দিচ্ছে তাকে। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? যা করার খুব দ্রুত করতে হবে। উফ! ভিসাটা কবে যে হাতে আসবে!

এই যে হুট করে সাবার বদলে যাওয়া, লক্ষ্মী মেয়ে স্বরূপ আচরণ করা, শাফকাতের হ্যাঁতে হ্যাঁ এবং নাতে না মেলানো – এসবে কী শাফকাত সন্দেহ করছে না? নির্ঘাত করছে। সাবা প্রায়ই চাইছে তার সন্দেহটা বাড়তে না দিতে।

হঠাৎ ফাহিম একদিন জানালো জরুরি প্রয়োজনে তাদের দেখা করা দরকার। সাবার নতুন ওই ফোন নম্বরের মাধ্যমেই যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছিল তারা। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া দেখা করার কথা ফাহিম নিশ্চয়ই বলবে না।

পূর্বের কৌশল মোতাবেক একদিন সাবা মা-বাবার বাড়িতে বেড়াতে গেল। পরদিন ভোরবেলা বেরিয়ে গেল ‘পথপদ্ম’ ফাউন্ডেশনের উদ্দেশ্যে। ফাহিম যথারীতি আগেভাগেই উপস্থিত ছিল এনজিওর ছাদে।

এক কথা দু কথা হতেই সাবা চিন্তিত গলায় বলল, “যদি ভিসা না পাই?”

ফাহিম আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “আরে পাবে, পাবে! ওখান থেকে চাকরির কনফারমেশন লেটার এসে গেছে। তোমার ভিসা ঠেকায় কে?”

সাবার চোখ মুখ থেকে তবুও দূর হলো না চিন্তার রেশ।

ফাহিম সতর্ক কণ্ঠে বলল, “কেন? তোমার হাসবেন্ড কিছু বুঝতে পেরেছে না-কি?”

সাবা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “না। কিন্তু বুঝতে কতক্ষণ?”

“এসব বাদ দাও সাবা। এত দুশ্চিন্তা করে বেঁচে থাকা যায় না-কি? তোমার এই প্ল্যানে মারাত্মক রিস্ক আছে। তবুও তো প্ল্যানটা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছো তুমি। তাই না?”

সাবা অন্যমনস্ক কণ্ঠে বলল, “হুঁ।”

ভুল কিছু বলেনি ফাহিম। অযথাই কারণে-অকারণে আতঙ্কিত হয়ে উঠছে সে। রাতে ঠিকঠাক ঘুম হচ্ছে না আতঙ্কে। ভাঙা ভাঙা স্বপ্ন দেখে উঠে পড়ছে বারবার। মনে একটাই ভয়, একটাই চাপা আতঙ্ক – এই বুঝি শাফকাত সব জেনে গেল। চিরতরে বন্দী করে ফেললো তাকে অদৃশ্য খাঁচায়।

দমবন্ধকর দৃশ্যগুলো কল্পনা থেকে ঝেড়ে ফেলে সাবা বলল, “তুমি হঠাৎ কেন ডাকলে সেটা বলো!”

ফাহিম ইতস্তত করে বলল, “জরুরি একটা বিষয়ে আলাপ করার ছিল সাবা।”

সাবা সাগ্রহে বলল, “কী বিষয়?”

ফাহিম আবারও কতক্ষণ ইতস্তত করলো।
মনে মনে বড্ড বিরক্ত হয়ে উঠলো সাবা। এই ছেলের ভাব-ভঙ্গি দেখলে যেন মনে হয় সাবা তার স্কুলের হেডমিস্ট্রেস। তাকে কোনো কিছু বলতে গেলেই ভয়ে অস্থির হয়ে ঘাম ঝরাতে হবে।

ফাহিম ইনিয়ে বিনিয়ে বলল,“তোমার নিজস্ব সম্পত্তির পরিমাণ কত হবে?”

সাবা ভ্রু কুঁচকে বলল, “আমার সম্পত্তি দিয়ে কী হবে?”

ফাহিম কম্পিত স্বরে বলল, “আহা! অন্য একটা দেশে নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছো। এমনি এমনি তো হবে না। তোমার সব সম্পত্তি ট্রান্সফার করতে হবে তো! সে জন্যেই পরিমাণটা জানতে চাইলাম।”

সাবা খানিকক্ষণ ভেবে বলল, “হবে দুই-তিন কোটির মতো।”

ফাহিম হতাশ গলায় বলল, “মাত্র?”

সাবা তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, “দুই-তিন কোটি মাত্র?”

ফাহিম তার কণ্ঠের তীক্ষ্ণতায় থতোমতো খেয়ে বলল, “না মানে, কিছু মনে কোরো না সাবা। তুমি যে ধরনের ফ্যামিলিতে বিলং করো, আমি ভেবেছিলাম তোমার সম্পত্তি আরও বেশি হবে।”

সাবা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে শুষ্ক গলায় বলল, “আমার বাবা সারাজীবন যা জমিয়েছে সব একটা বাড়ি বানিয়েই শেষ। ওই বাড়িটা আমার নামে আছে। বাড়ি তো অস্ট্রেলিয়ায় নিয়ে যেতে পারবো না। বাড়ি বাদে দুই-তিন কোটি টাকা পেয়েছি কাবিন আর আমার দাদার একটা উইল থেকে।”

ফাহিম কৌতূহলী গলায় বলল, “আর হাসবেন্ডের কাছ থেকে কিছু পাওনি?”

সাবা বিরক্তিভরা কণ্ঠে বলল, “তার কাছ থেকে পাওয়া সম্পত্তি নিয়ে তার বাড়ি থেকেই পালিয়ে যাবো?”

“না ঠিক আছে। যা আছে, তাই মোর দ্যান এনাফ। কিন্তু সাবা, সরাসরি এতগুলো টাকা নিয়ে তুমি বিদেশে যেতে পারবে না। পারমিশন ছাড়া ব্যাংকেও ট্রান্সফার করতে পারবে না। পারমিশন পাওয়ায় আবার অনেক ভেজাল।”

সাবা চিন্তিত গলায় বলল, “তাহলে?”

“তোমাকে সব টাকার জুয়েলারি কিনতে হবে।”

“জুয়েলারি?”

“হ্যাঁ। গোল্ড জুয়েলারি। এগুলো বিদেশে পাড় করে দেওয়া কোনো ব্যাপার না।”

সাবা অবিশ্বাসের সুরে বলল, “কিন্তু ফাহিম, আমি যত দূর জানি অস্ট্রেলিয়া বা অন্য কোনো দেশে এত টাকার গোল্ড নিয়ে যাওয়া যায় না।”

“আমরা তো আর নিয়ে যাবো না সাবা। অন্য কেউ নিয়ে যাবে।”

“মানে?”

ফাহিম দৃঢ় ভঙ্গিতে বলল, “আমার ওপর বিশ্বাস আছে তো না-কি সাবা? তুমি কোনো চিন্তা কোরো না। অস্ট্রেলিয়ায় ল্যান্ড করার সঙ্গে সঙ্গে তোমার জুয়েলারি তুমি বুঝে পাবে।”

সাবার বুঝতে অসুবিধা হলো না, গয়নাগুলো ওই দেশে নিয়ে যাওয়ার জন্যে যে পথ
ফাহিম আপন করে নিতে যাচ্ছে তা মোটেও বৈধ নয়।

সাবা ভ্রু কুঁচকে বলল, “ফাহিম আমি জানি না তুমি কী করতে চাচ্ছো কিন্তু আমি যদি কোনোভাবে ঝামেলায় পড়ি…”

সাবা কথাটা শেষ করার আগেই ফাহিম আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “কোনো ঝামেলায় পড়বে না সাবা। ট্রাস্ট মি।”

সাবার চোখ দুটো থেকে অবিশ্বাসের রেশ এখনো কাটছে না।

ফাহিম আবারও বলল, “জুয়েলারি কিনে তোমার কাছেই রেখে দিও। ফ্লাইটের দিন আমাকে দিলেই হবে।”

মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সাবা। ফাহিমকে
শতভাগ বিশ্বাস সে করে না। তবে এই মুহূর্তে তাকে বিশ্বাসযোগ্য একমাত্র মানুষটিই সে। কী আজব এক গোলকধাঁধায় আটকা পড়ে গেল সাবা!

(চলবে)

#লেবু
৩০
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

ভিসা হাতে পাওয়ার পরই মনোবল বাড়লো সাবা। বেড়ে গেল ফাহিমের প্রতি অগাধ বিশ্বাসও। অফিস থেকে প্রায়ই শপিং মলে যায় সে। একটু একটু করে দামি দামি সব সোনার গয়না কিনে আনে। এই নিয়েও শাফকাতের সন্দেহের মুখোমুখি হতে পারে বলে একদিন ব্রেকফাস্টের টেবিলে সাবা নিজ থেকেই জানালো, আজকাল কত হাই প্রোফাইল পার্টিতে যেতে হয় তাকে। কিন্তু পার্টিতে যাওয়ার মতো গয়না বা পোশাক কোনোটাই তার তেমন নেই। সেজন্যেই প্রায় শপিংয়ে যায়।

শাশুড়ি মায়েরা না-কি পুত্রবধূর বিলাসিতা সহ্য করতে পারেন না। আতিয়া আলম এ ক্ষেত্রে একেবারেই ব্যতিক্রম। সাবার শপিংয়ে যাওয়ার বিষয়ে তিনি ইতিবাচকভাবেই দেখলেন। ভাবলেন মেয়েটা হয়তো নিজ থেকেই নিজের বিক্ষিপ্ত মনটাকে শান্ত করবার চেষ্টা করছে।

সাবার সে কথা শুনে ব্রেকফাস্ট সেরে শাফকাত তার একটা ক্রেডিট কার্ড ধরিয়ে দিলো তার হাতে। এই প্রথম সুপ্ত অপরাধবোধের হাওয়ায় গা ভাসালো সাবা। সে যা বলছে, ছেলেটা তাই বিশ্বাস করছে। তাকে ফাঁকি দিয়ে এত বড় একটা ছক সাজানো কি ঠিক হলো?

আবার পরমুহূর্তেই মনে হলো, অবশ্যই ঠিক হয়েছে। ভয়ংকর এই সিদ্ধান্ত ইচ্ছা করে নেয়নি। নিতান্তই বাধ্য হয়ে নিয়েছে। শাফকাতের মানসিক অত্যাচারের পরিণাম তার এই সিদ্ধান্ত। ক্রেডিট কার্ডটা সামলে রেখে দিলো সাবা নিজের ঘরের ক্লজেটে। সে চলে গেলে যাতে সহজেই খুঁজে পাওয়া যায় এই জিনিস।

আজকাল বড্ড ব্যস্ত থাকে শাফকাত। সকাল বেলা ওই যে বেরিয়ে যায়, ফিরে আসে গভীর রাতে। সাবার প্রতি কড়াকড়ি, নজরদারি একেবারেই কমে এসেছে। হয়ত তার লক্ষ্মী মেয়ে স্বরূপ আচরণের কারণেই এখন আর আগের মতো সন্দেহের স্পৃহা পায় না। সাবার জন্যে অবশ্য ভালোই হয়েছে। শাফকাত যতক্ষণ বাড়িতে থাকে, ততক্ষণ প্রবল আতঙ্ক আর ভয় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকে তাকে। সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেই শান্তি!

এরই মাঝে একদিন সাবা জানতে পারলো আগামী মাসের ১৬ তারিখে শাফকাত ইন্ডিয়ায় যাচ্ছে। বড়সড় একটা বিজনেস ডিল পেতে পারে সে। সেই ডিলের জন্যেই তার এত তোড়জোড়, এত ব্যস্ততা। ধ্বক করে কেঁপে উঠলো সাবার বুকটা। উত্তেজনায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। এই মোক্ষম সুযোগ। শাফকাত ইন্ডিয়ায় পাঁচ দিন থাকবে। এই পাঁচ দিনের মধ্যেই নিজের হারিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হবে।

ফাহিমকেও তারিখটা জানিয়ে দিলো সে। ফাহিম অপরপ্রান্ত থেকে জানালো অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে টিকেটসহ অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতার ব্যবস্থা সে করছে।

‘বাংলার বাতাস’ সাবাকে অনেক দিয়েছে। তার সাংবাদিক হওয়ার স্বপ্নটা পূরণ করেছে এই নিউজ চ্যানেল। তাদেরকে কিছু না জানিয়ে হুট করে পালিয়ে যেতে পারে না সাবা। আজ তাই সে রেজিগনেশন লেটার নিয়ে এসেছে ক্রাইম ডিপার্টমেন্টের প্রধান এডিটর আফসানা করিমের কেবিনে।

আফসানা সাবার রেজিগনেশন লেটার হাতে পেয়ে কয়েক মুহূর্ত স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলেন।
‘বাংলার বাতাস’ এর সব থেকে সম্ভাবনাময়ী সাংবাদিক সাবা। চাকরির বয়স সবে এক বছর হয়েছে, ইতোমধ্যেই ছুঁয়েছে সফলতার উজ্জ্বলতা। এমন একজন সাংবাদিকের আচমকা চাকরি ছেড়ে দেওয়াটা সহজে মেনে নেওয়া যায় না।

আফসানা বিস্ময়ের চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছে বললেন, “এসবের মানে কী সাবা? হুট করে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার মানে কী? You’re one of the brilliant minds we have!”

সাবা ইতস্তত করে বলল, “আপা… চাকরিটা করতে আমার আর ভালো লাগছে না।”

কথাটা পুরোপুরি মিথ্যাও নয়। ইদানীং সত্যিই সাংবাদিকতার প্রতি আগের সে টান অনুভব করে না সে। যদিও এর কারণ তার অজানা নয়। কারণ হলো মনের বিক্ষিপ্ততা।

আফসানা আক্ষেপের সুরে বললেন, “এটা কোনো কথা হলো! তুমি তো টিনেজারদের মতো কথা বলছো। চাকরি করতে ভালো লাগছে না বলে চাকরি ছেড়ে দিতে হবে? একবারও ক্যারিয়ারের কথা ভাববে না?”

সাবা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বিনয়ী গলায় বলল, “আপা শুরুর দিকে চাকরিটা নিয়ে যে থ্রিল আমার মধ্যে ছিল এখন আর সেটা নেই। আগ্রহ ছাড়া কাজ করলে আমি তো চ্যানেলকে আমার সেরাটা দিতে পারবো না। চ্যানেলের প্রতিও এটা অন্যায়। আমি আগ্রহ ছাড়া কাজ করে যাবো, এর থেকে ভালো এমন কেউ আমার জায়গায় আসুক যে আগ্রহ নিয়ে চ্যানেলকে নিজের সেরাটা দিবে।”

সাবার কথাগুলো শুনে আফসানা হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “Just unbelievable!”

সাবা চুপ করে রইলো। ‘বাংলার বাতাস’ যে তাকে সহজে ছাড়বে না, এটা সে আগেই বুঝেছিল।

আফসানা হঠাৎ থমথমে গলায় বললেন, “ফ্যামিলি থেকে কোনো চাপ নেই তো?”

সাবা দৃঢ় গলায় বলল, “না, না আপা। এটা সম্পূর্ণ আমার নিজের সিদ্ধান্ত।”

আফসানা সন্দেহের সুরে বলল, “সত্যি করে একটা কথা বলো তো সাবা।”

“কী?”

“অন্য কোথাও চাকরি খুঁজছো?”

সাবা হাসিমুখে বলল, “একদমই না আপা! বাংলার বাতাসে সাংবাদিকতা করা আমার স্বপ্ন ছিল। স্বপ্নের চাকরি ছেড়ে আর কোথায় যাবো? আমি সত্যিই এই মুহূর্তে কোনো চাকরি করতে চাচ্ছি না।”

আফসানা কোনোভাবেই সাবাকে রাজি করাতে না পেরে ফ্যাকাশে গলায় বললেন, “আমি বলবো কয়েকটা দিন সময় নাও সাবা। চিন্তা-ভাবনা করে দেখো। হুট করে এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া কোনো কাজের কথা নয়।”

সাবা ভদ্রভাবে বলল, “আপনি চাইলে সময় নিতেই পারি আপা। কিন্তু আমার সিদ্ধান্ত বদলাবে না।”

আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আফসানা। এই চ্যানেলে আবার কবে সাবা আমিরের মতো গুণী, দক্ষতাসম্পন্ন সাংবাদিক আসবে কে জানে?

“বেশ। তবে একটা কথা মনে রেখো সাবা, বাংলার বাতাসের দরজা সব সময় তোমার জন্যে খোলা। Wish you all the best!”

সাবার চাকরি ছাড়ার সংবাদে আফসানার মতোই বিস্মিত ও হতাশ হলো চ্যানেলের অন্যান্য সাংবাদিকরা। অফিসে আজই সাবার শেষ দিন নয়। এ মাস শেষ হতে আরও নয়দিন বাকি। এই দিনগুলোতে অফিস করবে সে। তবুও তার কলিগরা এমনভাবে তার সঙ্গে দেখা করতে এলো, যেন আজই তার শেষ দিন।

অফিস শেষে সাবাকে পিক করতে এলো শাফকাত। আগে থেকেই বলে রেখেছিল শাফকাত। আজ অফিসে তার খুব একটা কাজ নেই বলে দ্রুত বাড়ি ফিরবে, ফেরার পথে সাবাকেও নিয়ে যাবে।

সাবা গাড়ি উঠে বসার সঙ্গে সঙ্গে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে তার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো শাফকাত, “তুমি চাকরি ছেড়ে দিয়েছো?”

সাবার গা বেয়ে শীতল হাওয়া বয়ে গেল। এই প্রশ্নের কারণে নয়, অন্য এক চিন্তায়। শাফকাত তার গতিবিধি সর্বক্ষণ নজরে রাখে। তার চাকরি ছাড়ার খবরটাও মুহূর্তেই পৌঁছে গেছে তার কানে। আর ওদিকে বিদেশি এক পত্রিকায় তার চাকরি হলো, ভিসা হলো – শাফকাত কিছুই জানলো না? সত্যিই সাবা যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করেছে বলে? না-কি…?

আর কিছুই ভাবতে পারলো না সাবা। আর কী-ই বা কারণ থাকবে? সত্যিই সে বাড়াবাড়ি রকমের সতর্কতা অবলম্বন করেছে। এজন্যেই কিছুই টের পায়নি শাফকাত।

অন্যমনস্ক সাবাকে দেখে শাফকাত জিজ্ঞাসু গলায় বলল, “সাবা?”

সাবা সংবিৎ ফিরে পেয়ে বলল, “হ্যাঁ?”

“চাকরি ছেড়ে দিয়েছো তুমি?”

সাবা ক্ষীণ দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, “হ্যাঁ।”

শাফকাত গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে ভ্রু কুঁচকে বলল, “কেন?”

সাবা মলিন কণ্ঠে বলল, “এমনিই, ভালো লাগছিল না।”

শাফকাত ক্ষীণ সন্দেহের সুরে বলল, “কিন্তু তুমি তো তোমার কাজ নিয়ে অনেক এন্থুসিয়াস্টিক
ছিলে।”

সাবা শুকনো গলায় বলল, “এখন সব এন্থুসিয়াসম শেষ। ঠিক করেছি এখন থেকে সারাদিন বাড়িতে পায়ের ওপর পা তুলে বসে থাকবো। আপনার কোনো সমস্যা আছে?”

শাফকাত ভাবলেশহীন কণ্ঠে বলল, “না, আমার আবার কী সমস্যা থাকবে?”

দেখতে দেখতে পরের মাসটাও এসে গেল। আজ ১৬ তারিখ। সকালের ফ্লাইটে কলকাতায় যাচ্ছে শাফকাত। দু দিন পরই মধ্যরাতের ফ্লাইটে অচেনা শহরে পাড়ি জমাতে যাচ্ছে সাবা, নতুন জীবনের আকাঙ্ক্ষায়। যে জীবনে কোন প্রকার ভয় থাকবে না, আতঙ্ক থাকবে না, দীর্ঘশ্বাস থাকবে না।

ফ্লাইটের উদ্দেশে বের হওয়ার আগ মুহূর্তে শাফকাত পা রাখলো বাড়ির লাইব্রেরিতে। চাকরিবিহীন জীবনের অলস সময়গুলো সাবা এখানেই কাটায়। আচমকা শাফকাতকে দেখে চমকে উঠলো সাবা।

শাফকাত দৃপ্ত পায়ে তার দিকে এগিয়ে এসে বলল, “নিজের খেয়াল রাখবে সাবা।”

সাবা অবাক গলায় বলল, “প্রায়ই তো বিদেশে যান। কখনো তো এ কথা বলেন না।”

শাফকাত পূর্বের গাম্ভীর্য গলায় ধরে রেখেই বলল, “কখনো বলি না বলে কি আজও বলা যাবে না?”

সাবা কয়েক মুহূর্ত ঘোরগ্রস্থ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো শাফকাতের দিকে। এই মানুষটাকে আজও বুঝে উঠতে পারলো না। যে বাইরে যেমন কঠোর-গম্ভীর, ভেতরেও কি ঠিক তেমন? মনে মনে সাবাকে সে ঘৃণা করে? না-কি…? নাহ্! ভালোবাসার কোনো সুযোগ নেই।

সাবা মলিন হাসি হেসে বলল, “যাবে! রাখবো নিজের খেয়াল। আপনিও নিজের খেয়াল রাখবেন।”

এটাই দুজনের শেষ কথোপকথন। শেষবারের মতো যেন একে অপরকে বিদায় জানাচ্ছে।

মনে মনে সাবা বলল, “আজকের পর যেন আপনার সঙ্গে কোনোদিনও আমার দেখা না হয় শাফকাত আলম।”

শাফকাত বেরিয়ে যাওয়ার পর ধীরে সুস্থে বাড়ি থেকে বের হলো সাবা। প্ল্যান বাস্তবায়নের কোনো কাজে নয়। গেল সে তার ভাইয়ার কাছে। এই জায়গাটায় যতবারই এসেছে, ততবারই হৃদয়টা দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না।

কাঁদতে পারলো না সাবা। কাঁদতে সেদিনও পারেনি, যেদিন অভিমানী ছেলেটা পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছিল। আহনাফের কবরের পাশে দীর্ঘক্ষণ নিঃশব্দে বসে রইলো সাবা।

মনে মনে কেবল একটা কথাই বলল, “আমি
তোমার কাছ থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছি ভাইয়া। কিন্তু তুমি আমার সঙ্গে সবসময় থাকবে, সবসময়!”

(চলবে)