#লেবু
৩৪
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
ফাহিমের পিস্তল থেকে নিক্ষেপ করা দ্বিতীয় গুলিটা সাবার শরীর থেকে বের করতে ডক্টরদের কোন প্রকার সমস্যাই হয়নি। সমস্যা বাঁধিয়েছে প্রথম গুলিটা। সেই গুলি লেগেছে একদম সাবার ফুসফুস ঘেঁষে। গুলির অবস্থান অপারেশনকে ক্রমেই জটিলতর করে তুলছে।
এছাড়াও উপরি সমস্যা হিসেবে যোগ দিয়েছে
নিউমোথোরাক্স। আঘাতের কারণে ফুসফুসের প্লুরাল গহ্বরে বাতাস প্রবেশ করছে। যার কারণে ফুসফুস ভেতরের দিকে চুপসে গেছে এবং সাবা স্বাভাবিকভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারছে না।
সফলতা যে মানুষটার জীবনে আচ্ছন্ন সেই শাফকাত আলমের আজ মনে হচ্ছে তার থেকে ব্যর্থ মানুষ এই পৃথিবী আর দ্বিতীয়টি নেই। আরেকটু কড়াকড়ির মধ্যে যদি সাবাকে রাখতো সে! কিংবা একেবারেই কড়াকড়ির মধ্যে না রাখতো, তাহলেই বোধ হয় ভালো হতো।
দুহাতে মাথাটা শক্ত করে চেপে ধরে অপারেশন থিয়েটারের বাইরের চেয়ারগুলোর একটায় বসে আছে শাফকাত। তার অন্তরাত্মায় আজ কেবলই হাহাকার। কেন সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না? ফাহিমকে সাবার অফিসে দেখার পর তার মধ্যে জেগে ওঠা সেই মারাত্মক রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে আজ এই দিন দেখতে হতো না।
ফাহিমকে নিয়ে শাফকাতের আশঙ্কাটা সাবাকে বুঝিয়ে বললেই তো হতো! নিতান্তই অবুঝ মেয়ে তো সাবা নয়। সে ঠিকই বুঝতো। তার থেকেও বড় কথা, শাফকাতের সেই আশঙ্কাই তো দিনশেষে সত্যি হলো।
মনে মনে ঘটনাগুলো পরপর সাজাতে ব্যস্ত হয়ে গেল শাফকাত। সাবা তার কাছ থেকে বহুদূরে পালিয়ে যেতে চেয়েছে। সাহায্য নিয়েছে ফাহিমের। ফাহিমও গোপনে তাকে সাহায্য করে গেছে। কিন্তু তার সাহায্যের পুরাটাই ছিল ধূর্ততা। ভেতরে ভেতরে ভিন্ন পরিকল্পনা ছিল তার। নকল কাগজ-পত্র দেখিয়ে সাবাকে আশ্বাস দেওয়ায় যে সে সত্যিই মুক্তি পাবে। সাবার সম্পত্তিগুলো গয়নায় রূপান্তর করায়। সাবা মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় এতটাই উন্মাদ বনে গিয়েছিল সে নিজের বিবেককে কাজে না লাগিয়ে ফাহিম যা বলেছে তাই করে গেছে। এরপর কাঙ্ক্ষিত মুক্তির দিনে সাবাকে গুলি করে তার কাছ থেকে গয়নাগুলো হাতিয়ে নেয়। এর কারণ অবশ্যই তার পুরোনো রাগ। এক কালে সাবার কারণে স্থবির হয়ে পড়েছিল ফাহিমের জীবনটা। এ নির্ঘাত তারই প্রতিশোধ।
শাফকাত আগেভাগেই আঁচ করতে পেরেছিল, প্রতিশোধের সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা নিয়েই ফাহিম ছেলেটা আবারও ফিরে এসেছে সাবার জীবনে। কেন যে তখন তাকে সাবধান না করে, অহেতুক সন্দেহের প্রকাশ ঘটাতে গেল। লাভ তো কিছু হলোই না। উল্টো সাবার দৃষ্টিতে ঘৃণার পাত্র বনে গেল সে।
ফাহিম সাবাকে গুলি করছে, এ দৃশ্য আরেকবার কল্পনায় ভেসে উঠতেই আরেকদফা টগবগ করে ফুটতে শুরু করলো শাফকাতের শরীরের সমস্ত র/ক্ত। বুকের ভেতর প্রচন্ড গতিতে ধড়ফড় শুরু হলো। মেয়েটা কি খুব কষ্ট পেয়েছিল? তা তো বটেই!
আচ্ছা গুলি লাগার পর কি একবারের জন্যেও শাফকাতের কথা মনে পড়েছিল তার? মনে মনে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে উঠলো শাফকাত। যার কাছ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে এত আয়োজন, তার কথা কেন মনে করতে যাবে সাবা?
ডক্টর আফরোজা আরেকবার বেরিয়ে এলেন অপারেশন থিয়েটার থেকে। গম্ভীর গলায় বললেন, “আমরা গুলিটা বের করতে সক্ষম হয়েছি।”
তার কথায় পরিবারের মানুষগুলোর চোখে মুখে সবে আশার আলো ফুটে উঠতে শুরু করেছিল। সঙ্গে সঙ্গে আবারও তা নিভে গেল তার পরবর্তী কথাটায়।
“কিন্তু পেশেন্ট এখনো শঙ্কামুক্ত নন।”
শাফকাত নিষ্প্রভ গলায় বলল, “কেন?”
“আপনাদের আগেই সাবার লাঙ্গসে নিউমোথোরাক্সের কথা জানানো হয়েছে। উনার শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে খুবই অসুবিধা হচ্ছে। আমরা খুব শীঘ্রই একটা চেস্ট-টিউব প্রবেশ করিয়ে লাঙ্গসকে রি-এক্সপ্যান্ড করার চেষ্টা করছে।”
আবারও তপ্ত দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো শাফকাতের বুক থেকে। যখন থেকে সে জানতে পেরেছে সাবার এ অবস্থার কথা, ঠিক সেই মুহূর্ত থেকে এই মুহূর্ত পর্যন্ত বিন্দুমাত্র কমেনি তার বুকের ধড়ফড়। বরং ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
অদ্ভুত এক উপলব্ধি জেগে উঠলো শাফকাতের মাঝে। যদিও সে উপলব্ধির উপযুক্ত সময় এটা নয়, তবুও জেগে উঠলো। শাফকাত জানতো ঝগড়াটে, কাঠিন্যের চাদরে ঘেরা মেয়েটাকে সে ভালোবেসে ফেলেছে। তবে সেই ভালোবাসার গভীরতা যে এতটা তীব্র, তা আগে বুঝতে পারেনি। আজই বুঝলো।
ফোনের রিংটোনের শব্দে ধ্যানভঙ্গ হলো শাফকাতের। স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে রাজীবের নাম।
ফোনটা রিসিভ করে শাফকাত হিমশীতল গলায় বলল, “রাজীব, আমি ব্যাড নিউজ শুনতে চাচ্ছি না।”
রাজীব কম্পিত গলায় বলল, “গুড নিউজই আছে বস। ম্যামের ওই মোবাইলের কল লিস্ট বের করা গেছে। সম্ভবত দুই মাস আগে সিমটা কেনা হয়েছিল। কিন্তু রেজিস্টার করা হয়নি।”
রেজিস্টার যে করা হয়নি এটা শাফকাত আগেই আন্দাজ করতে পেরেছিল। সাবা তার নামে নতুন কোনো সিমে রেজিস্টার করলে তড়িৎ গতিতে খবর চলে আসতো তার কাছে।
রাজীব আবারও বলল, “এই দুই মাস ধরে একটা নম্বরের সাথেই কেবল যোগাযোগ হয়েছে। কিন্তু বস…”
শাফকাত বিরক্ত গলায় বলল, “কিন্তু কী?”
“সেই নম্বরের সাথে ফাহিমের নম্বরের কোনো মিল নেই।”
শাফকাত গম্ভীর গলায় বলল, “মিল না থাকাটাই স্বাভাবিক। সাবা ঝুঁকি এড়ানোর জন্যে আনরেজিস্টার্ড সিম ব্যবহার করেছে। ফাহিমও নিশ্চয়ই করবে।”
রাজীব উজ্জ্বল গলায় বলল, “আমিও সেটাই মনে করেছি বস। আমি অলরেডি ওই নম্বরের ট্র্যাকিং শুরু করে দিয়েছি।”
‘Infinite Safety’ এর কর্মীদের এজন্যেই ভালো লাগে। এদের এমনভাবে গড়ে তোলা হয়েছে যেন কোনো নির্দেশের জন্যে অপেক্ষা না করতে হয়। নির্দেশ পাওয়ার আগেই বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করার ক্ষমতা তাদের আছে।
শাফকাত বলল, “ভেরি গুড। তোমার নেক্সট কলে যেন ফাহিমের লোকেশন জানতে পারি।”
রাত সাড়ে চারটা। পূর্বের ক্লান্তিরা কোথায় যে হারিয়ে গেছে! তীব্র উৎকণ্ঠার মধ্যে রাতটা পাড় করছে অপারেশন থিয়েটারের বাইরে অবস্থান করা সকলে। সাবার বাবা-মা, শাশুড়ি একে অপরকে সান্ত্বনা দিতে ব্যস্ত। তারা কেউই পুলিশের সাথে কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। তাদের হয়ে কথা বলছে শামা।
ওসি মিরাজ সাবার ব্যাপারে খুঁটিনাটি প্রশ্ন করছে তাকে। সাবা কখন বাড়ি থেকে বের হয়, বাইরে কতক্ষণ থাকে – এসব। রাগে-বিরক্তিতে গা জ্বলে যাচ্ছে শাফকাতের। এসব অহেতুক প্রশ্ন করে সময় অপচয় ছাড়া আদৌ আর কোনো কাজ কী হচ্ছে?
এক পর্যায়ে নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে শাফকাত তীক্ষ্ণ গলায় বলল, “আপনারা কি এয়ারপোর্টে খোঁজ নিয়েছেন?”
ওসি সাহেব আলগোছে হেসে বললেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ! ব্যাটা কিছুতেই দেশ ছেড়ে পালাতে পারবে না।”
লোকটার হাসি দেখে রাগের দমকা হাওয়া আরও একবার এসে স্পর্শ করলো শাফকাতকে।
ওসি সাহেব আবারও বললেন, “তাছাড়া অতগুলো গয়না নিয়ে এয়ারপোর্ট দিয়ে পালানোর চেষ্টাও করবে না। ব্যাটা বহুত শেয়ানা! আমার ধারণা বেনাপোলের আশেপাশে লুকিয়ে আছে। সুযোগ বুঝে বর্ডার পার করবে। আমি ওখানকার পুলিশকে জানিয়ে রেখেছি…”
ওসি সাহেবের বাকি কথাগুলো পৌঁছালো না শাফকাতের কর্ণকুহরে। ভিন্ন এক চিন্তায় ব্যস্ত তার মস্তিষ্ক। পুলিশের খোঁজাখুঁজির ওপর বিন্দুমাত্র ভরসা তার নেই। সেই ভরসায় থাকলে এ জীবনে হাতের নাগালে পেতে হবে না ফাহিমকে।
শাফকাত আর কিছু ভেবে পাওয়ার আগেই আবারও রাজীবের ফোন এলো। তবে এলো না কাঙ্ক্ষিত সুখবর। রাজীব জানালো ফাহিমের এই নম্বরটা ট্র্যাক করা সম্ভব হয়নি। অবশ্য এটাই তো স্বাভাবিক। সাবাকে গুলি করার পর ফাহিম তার সঙ্গে যে নম্বর দিয়ে যোগাযোগ করতো, সেটা নিশ্চয়ই ভেঙে ফেলেছে।
আরও একবার উত্তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলল শাফকাত। হতাশার দীর্ঘশ্বাস নয়, রাগের। নিয়মের গণ্ডির ভেতরে থেকে এতক্ষণ ফাহিমকে ধরার চেষ্টা করলো। লাভের লাভ কিছুই হয়েছে, হয়েছে কেবলই সময়ের অপচয়। নিয়মের গণ্ডির বাইরে এবার তাকে যেতেই হবে।
যখনই নিয়মের বাইরে যাওয়ার প্রশ্ন আসে, ততবারই মনে ভেসে ওঠে রাব্বির নাম। ছেলেটা শাফকাতের বড় ভক্ত। সেবার সাবার ওপর যে প্রভাবশালী নেতা হামলা করার চেষ্টা করেছিল, তার বাড়িতে পাল্টা হামলার সমস্ত ব্যবস্থা তো রাব্বিই করেছিল।
রাত গভীর হওয়া সত্ত্বেও একটা রিং বাজার সঙ্গে সঙ্গে কল রিসিভ করলো রাব্বি।
তাকে কোন প্রকার কথা বলার সুযোগ না দিয়ে শাফকাত সরাসরি প্রসঙ্গে চলে গেল, “রাব্বি? বেনাপোলের আশেপাশের আমাদের ছেলেরা আছে না?”
রাব্বি তড়িৎ গতিতে উত্তর দিলো, “হ্যাঁ স্যার আছে। কোনো দরকার?”
শাফকাত শীতল গলায় বলল, “একজনের ডিটেইলস পাঠাচ্ছি। এক ঘণ্টার মধ্যে আমার তাকে লাগবে। যেখান থেকে পারো খুঁজে বের করো।”
“অবশ্যই স্যার!”
রাব্বিকে ডিটেইলসগুলো পাঠানোর মধ্যেই অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে এলেন ডক্টর আফরোজা। ফোনটা রেখেই উঠে দাঁড়ালো শাফাকাত। তার চোখে মুখে একরাশ উৎকণ্ঠা আর উদ্বেগ।
ডক্টর আফরোজা হাসিমুখে বললেন, “আমাদের অপারেশন সাকসেসফুল। কিছুক্ষণের মধ্যেই পেশেন্টকে আইসিইউতে দেওয়া হবে।”
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল শাফকাত। মেয়েটার প্রতি তার অভিমানের শেষ নেই। যেমন শেষ নেই ভালোবাসার। তাকে চিরতরে হারানোর আর কোনো আশঙ্কা নেই! বেঁচে থাকার জন্যে আর কী লাগে?
(চলবে)
#লেবু
৩৫
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
এসির হিমশীতল হাওয়া, আবছা নীলাভ আলো, অ্যান্টিসেপটিক আর ডিসইনফেক্টের কড়া গন্ধ – আইসিইউতে প্রথম পদক্ষেপের সাথে সাথে এসবই টের পেলো শাফকাত। আরও একটা জিনিস টের পেলো, তার শিরদাঁড়া বেয়ে বয়ে যাওয়া – দুশ্চিন্তা আর উৎকণ্ঠার থমথমে হওয়া। এ ঘরে আজ পর্যন্ত যতগুলো সুস্থ মানুষ পা রেখেছে, তারা সকলেই বোধ হয় এই একই অনুভূতির সম্মুখীন হয়েছে।
হৃদয়টা এতটাই ভারী হয়ে আছে যে নিজের অস্তিত্বে নিজেই অবাক হয়ে উঠছে শাফকাত। এমন ভারী একটা হৃদয় নিয়ে মানুষ বেঁচে থাকে কী করে? এক পা এক পা করে এগিয়ে যাচ্ছে শাফকাত। তার পরনে প্রোটেকটিভ গিয়ার, গাঢ় নীল রঙের সার্জিক্যাল গাউন, ক্যাপ, মাস্ক। এমনিতে আইসিইউতে কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। সেই কেউটা শাফকাতের মতো হাই প্রোফাইল ভিআইপি হলে অবশ্য ভিন্ন কথা। কিন্তু ভিআইপি হলেও তাকে এই প্রোটেকটিভ গিয়ার পরেই আইসিউতে প্রবেশ করতে হবে। এতে রোগীর ইনফেকশনের ঝুঁকি থাকে না।
ঠিক মাঝামাঝির একটা বেডে হয়েছে সাবা। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ যেন আটকে গেল শাফকাতের পা দুটো। দূর থেকেই যতটুকু দেখা যাচ্ছে তাকে, ততটুকুই যথেষ্ট তার ভারী হৃদয়টাকে পুরোপুরি নিশ্চল করে দেওয়ার জন্যে।
শাফকাত আলম কোনোকিছুই দমে যায় না, ঘাবড়ে যায় না, পিছিয়ে যায় না। তবে ঠিক এই মুহূর্তে জীবনে প্রথমবারের মতো এ সকল ইচ্ছাই জেগে উঠছে তার মনে।
শাফকাত ভেবেছিল সাবাকে গুলি করার সংবাদে তার হৃদয়টাকে কয়েক খণ্ডে ভেঙে গেছে। তাহলে তো এই মুহূর্তে সেই ভেঙে যায় হৃদয়ের গুঁড়িয়ে যাওয়ার কথা। যে শাফকাত কোনোকিছুই ভেঙে পড়ে না, আজ ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়লো সে। কেঁপে উঠলো তার অন্তরাত্মা।
ভারী হৃদয়টা নিয়েই আরও একটু এগিয়ে গেল শাফকাত। একেবারে সাবার বেডের কাছে। হৃদস্পন্দন থমকে গেল তার। কর্মচাঞ্চল্যে ভরপুর যে মেয়েটা সারাক্ষণ একটা না একটা অজুহাত খুঁজে বেড়ায় তার সঙ্গে ঝগড়ায় মেতে উঠার জন্যে, আজ সে নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে আইসিউর বেডে।
মেয়েটার মুখজুড়ে বিশাল একটা ভেন্টিলেটর মাস্ক। মাস্কের দুটো বেল্ট তার মুখের পাশ দিয়ে আর বাকি দুটো কপালের ওপর। শাফকাতের হৃদয়টা যে ইতোমধ্যে কতবার মোচড় দিয়ে উঠেছে, সে নিজেও জানে না। এতটুকু একটা মুখ মেয়েটার, এই বিশাল মাস্কের আড়ালে তো দেখাই যাচ্ছে না তাকে। তবুও দেখলো শাফকাত। চোখ দুটো বুজে রাখা। তার চোখে মুখে প্রবল যন্ত্রণার ছাপ। জ্ঞান হারানোর আগে কী প্রবল যন্ত্রণা মেয়েটা পেয়েছিল, কল্পনা করতেই শিউরে উঠলো শাফকাত।
দৃষ্টি নিচের দিকে নামাতেই আরেকদফা শিউরে উঠলো শাফকাত। মেয়েটার বুকের সঙ্গে একাধিক তার জুড়ে দেওয়া। গাঢ় সবুজ রঙের একটা গাউন আলগোছে পরিয়ে দেওয়া হয়েছে তাকে। তবে ক্ষ/তস্থানে যাতে চাপ না পড়ে তাই পেছনের বাঁধনগুলো বাঁধা হয়নি। গাউনের ফাঁক দিয়েই শাফকাতের চোখে পড়লো বুকের ওপর দিকের ব্যান্ডেজ। র/ক্ত শুকিয়ে ব্যান্ডেজের আশেপাশে ছড়িয়ে আছে।
শাফকাতের চোখদুটোর মাঝে অদ্ভুত এক জ্বালাপোড়া শুরু হলো। সাবার এই অবস্থার জন্যে নিজের থেকে বেশি দোষী কাউকে মনে হচ্ছে না। কেন সে এত কড়াকড়ি করতে গেল মেয়েটার সঙ্গে? সে কড়াকড়ি না করলেই তো সাবা কখনো পালানোর চেষ্টা করতো না। পালানোর চেষ্টা না করলে আজ এ দৃশ্য দেখতেও হতো না। আবার মনে হলো, কেন সে আরেকটু বেশি কড়াকড়ি করলো না? সাবাকে প্রতিমুহূর্তে চোখে চোখে রাখলে, সে বারণ করা সত্ত্বেও তাকে নিজের কাছাকাছি রাখলেই বোধ হয় সব থেকে ভালো হতো।
সাবার বুকের নিচে ডানপাশে গাউন ইচ্ছে করে ফেঁড়ে দেওয়া হয়েছে। এখানেই প্রবেশ করানো হয়েছে চেষ্ট টিউব। সঙ্গে আরেকটা ব্যান্ডেজ। আরও কয়েক ছোপ শুকিয়ে যাওয়া র/ক্ত।
মনিটর থেকে একটু পর পর ছন্দের তালে তার হৃদস্পন্দনের প্রতীকী শব্দ ভেসে আছে। ওই শব্দটুকু না এলে মনেই হতো না মেয়েটার ভেতরে প্রাণ এখনো বহমান। দুটো বু/লেট, অপারেশনের এত জটিলতা, এত ধকল – মেয়েটা সহ্য করলো কী করে?
বেডের বামপাশে ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো শাফকাত। সাবাকে এত কাছ থেকে এত কষ্টের মাঝে দেখে তার হৃদয়ের র/ক্তক্ষরণ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এই মেয়েটা সে এত ভালোবাসে, মেয়েটা কি কোনোদিনও বুঝবে না? এই প্রথম শাফকাতের মনে হলো, না বুঝলেও চলবে। সাবার কাছে আজীবন সে একটা খারাপ মানুষ হয়েই না হয় থাকুক। তবুও মেয়েটা সুস্থ হয়ে আবারও ফিরে যাক তার পুরোনো রূপে।
সাবার বাম হাতটা সাবধানে বেডের ওপর রাখা। তর্জনীতে পালস অক্সিমিটার। আলতোভাবে নরম সেই হাতটা ধরলো শাফকাত। আজ পর্যন্ত যতবারই সাবাকে সে স্পর্শ করেছে, ততবারই কেঁপে উঠেছে মেয়েটা। কখনো প্রকাশ্যে, কখনো গোপনে। তবে প্রত্যেকবারই নিজের দৃঢ় স্পর্শের নিচে সেই কম্পন টের পেয়েছে শাফকাত। আজ পেলো না।
আনমনেই শাফকাতের মনে পড়ে গেল সেই রাতের ঘটনা। যে রাতে মারাত্মক প্যানিক অ্যাটাক আষ্টেপৃষ্টে ধরেছিল সাবাকে। যে রাতে গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। যে রাতে শাফকাত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে চুমুতে ভরিয়ে দিয়েছিল সাবার মুখটা। আজকের রাতটা তো তেমনই হতে পারতো।
আবার পরমুহূর্তেই মনে ভেসে উঠলো সাবার আহত চোখ দুটো। শাফকাত তার গালে চড় মারার পর আহত দৃষ্টিতে একরাশ অবিশ্বাস নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিল। আজকের রাতটা সে রাতের মতো হবে কী করে? শাফকাত নিজের হাতেই তো শেষ করে দিয়েছিল সবটা।
শাফকাত এগিয়ে সাবার কানের কাছে নিজেকে নিয়ে গেল। ফিসফিস করে বলল, “তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যাও সাবা। আমার সাথে ঝগড়া করবে না?”
মেয়েটা শুনলো কিনা কে জানে? তার কোনো কথায় সম্মত না হলে হয় সাবা তীক্ষ্ণ গলায় কিছু বলে, না হয় চুপ করে থাকে। তবে এই কথাটায় যে তাকে সম্মত হতেই হবে। শাফকাত এই পৃথিবীর সমস্ত প্রবল যন্ত্রণাগুলো সহ্য করতে রাজি। তবে এই মেয়েটার সকল যন্ত্রণা বাদে।
সাবার কপালে নিঃশব্দে ঠোঁটের স্পর্শ দিলো শাফকাত। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো তার নিস্তেজ হয়ে পড়া মুখটার দিকে। শাফকাত জানে, এই মুখে আবারও উজ্জ্বলতা এসে জায়গা করে নেবে। আবারও সাবা তার হাসি দিয়ে হাসিয়ে তুলবে চারপাশকে। সে হাসি শাফকাতের উদ্দেশ্যে নিক্ষেপ না করলেও চলবে। তবুও হাসিটা যেন সে হাসে।
আইসিইউ থেকে বের হয়েই ফোনে জমে থাকা রাব্বির মিসড কলগুলো চোখে পড়লো শাফকাতের। সঙ্গে সঙ্গে কল ব্যাক করলো শাফকাত।
রাব্বি উৎফুল্ল গলায় বলল, “স্যার! ছেলেটাকে পাওয়া গেছে, বেনাপোল বর্ডারের আশেপাশেই ঘুরঘুর করছে। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই দালালদের সাহায্য নিয়ে বর্ডার পাড় হবে।”
বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো শাফকাতের ঠোঁটের কোণে। এক মুহূর্তটার জন্যে সেই কখন থেকে অপেক্ষা করে আছে সে!
শাফকাত শীতল গলায় বলল, “ছেলেদের বলো আটকে ফেলতে!”
কলটা কেটে বহুক্ষণ পর যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল শাফকাত। তার জায়গায় অন্য কেউ হলে এতক্ষণে ফাহিমের ঠিকানা দিয়ে দিতো পুলিশকে। কিন্তু শাফকাত আলমের ফুটন্ত র/ক্ত এত সহজে ঠান্ডা হবে না। সাবাকে যে কষ্ট দিয়েছে তার নিশ্চয়ই সামান্য আটক, জেল-হাজতের শাস্তি প্রাপ্য নয়।
শাফকাত তার মায়ের কাছে গিয়ে বলল, “মা আমি একটা জরুরি কাজে বাইরে যাচ্ছি। সাবার খেয়াল রাখবে।”
আতিয়া আলম চিন্তিত গলায় বলল, “এই ভোর বেলা কোথায় যাবি?”
শাফকাত যথাসম্ভব শান্ত গলায় বলল, “বললাম তো জরুরি মা। জরুরি না হলে তো সাবাকে এই অবস্থায় রেখে যেতাম না।”
শাফকাত এবার বোনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ডক্টরদের সাথে সব কমিউনিকেশন তুই করবি। কোনো দরকারে আমাকে কল করবি।”
শামা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়তেই শাফকাত হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গেল। হসপিটালের বাইরে তার সিকিউরিটি টিমের কড়া নিরাপত্তা। শাফকাতের নির্দেশ অনুযায়ী ইমার্জেন্সি রোগী ছাড়া কাউকেই প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না এখানে।
গাড়ি নিয়ে ড্রাইভ করে সবার আগে শাফকাত গেলো বাড়িতে। তার ঘরে ক্লজেটের আড়ালে সাবধানে লুকিয়ে রাখা কয়েকটা পি/স্তল। শাফকাতের পি/স্তলের এই কালেকশন খুব শখের। একেকটা একেক দেশের, একেকটার একেক গুণ।
ধূসর রঙের জার্মান পি/স্তলটা বের করে আনল শাফকাত। এই পি/স্তল আজ পর্যন্ত কারও রক্ত ঝরার কারণ হয়নি। তাই বলে কখনো যে হবে না, এমনটা ভাবাও কারণ নেই।
(চলবে)
#লেবু
৩৬
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
ঘুমিয়েই পড়েছিল শাফকাত। কম ধকল তো গেল না শরীরের ওপর দিয়ে! আট ঘণ্টা পর আবারও হসপিটালের সামনে এসে থামলো তার গাড়িটা। ঘড়িতে বাজছে বেলা একটার একটু বেশি। ভোরের মতোই কড়া নিরাপত্তা হসপিটালের বাইরে। শাফকাত দৃপ্ত পায়ে গাড়ি থেকে নেমে হসপিটালের ভেতরে প্রবেশ করলো।
তাকে দেখেই কোত্থেকে যেন ছুটে এলেন ওসি মিরাজ সাহেব। ওসি সাহেবকে ছুটে আসতে দেখেও সৌজন্যের খাতিরে থমকে দাঁড়ালো না শাফকাত। ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে এগিয়ে গেল হসপিটালের রিসিপশনের দিকে।
রিসিপশনিস্টকে উদ্দেশ্য করে শাফকাত গম্ভীর গলায় বলল, “আমি সাবা আমিরকে অন্য হসপিটালে শিফট করতে চাচ্ছি। ডক্টরদের সাথে কথা বলা হয়েছে, আপনারা ডিসচার্জের ব্যবস্থা করুন।”
রিসিপশনিস্টকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ওসি সাহেব শাফকাতের পাশে এসে দাঁড়িয়ে ব্যস্ত গলায় বললেন, “আপনি কোথায় ছিলেন শাফকাত সাহেব? কতবার আপনার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম!”
শাফকাত তার কণ্ঠের ব্যস্ততায় মোটেও বিচলিত না হয়ে বলল, “কী ব্যাপার?”
ওসি সাহেব কিছু বলতে যাবেন তার আগেই শাফকাত আবারও রিসিপশনিস্টকে উদ্দেশ্য করে বলল, “একটু পর আমার ম্যানেজার আসবে, তাকে সব ফর্মালিটিস বুঝিয়ে দেবেন।”
রিসিপশনিস্ট হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়তেই শাফকাত পা বাড়ালো সিঁড়ির দিকে। ওসি সাহেবও আসছেন তার পিছু পিছু।
“এদিকে তো সর্বনাশ হয়ে গেছে!”
শাফকাত সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে বলল, “সাসপেন্স ক্রিয়েট না করে বলবেন কী হয়েছে?”
ওসি সাহেব থতমত খেয়ে আবার মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “ফাহিম ছেলেটা ধরা পড়েছে।”
শাফকাত মোটেও অবাক না হয়ে বলল, “তাই না-কি?”
“হ্যাঁ! তাও আবার কোথায় জানেন?”
শাফকাত শীতল গলায় বলল, “না।”
“কাল রাতে ম্যাডামকে যেখান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে, ঠিক সেখান থেকে!”
শাফকাত ভাবলেশহীন কণ্ঠে বলল, “ও।”
ওসি সাহেব নিশ্চয়ই মনে মনে অবাক হয়ে উঠছেন। যে ফাহিমকে ধরার জন্যে কাল রাত অবধি শাফকাতের ব্যস্ততার শেষ ছিল না, অথচ তার ধরা পড়ায় কোনো প্রকার প্রতিক্রিয়াই দেখালো না?
ওসি সাহেব বিস্মিত ভঙ্গিতে বলল, “তার থেকেও ভয়ঙ্কর কথা এই ছেলেটার গায়েও গুলি!”
শাফকাত অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় বলল, “সে কি?”
“হ্যাঁ! একটা না দুইটা না চারটা গুলি!”
তারা পৌঁছে গেছে চার তলায়। এখানেই সাবার আইসিইউ। করিডোর ধরে ব্যস্ত পায়ে হাঁটতে শুরু করলো শাফকাত। ওসি সাহেবও হাঁটছেন কিন্তু শাফকাতের গতির সঙ্গে পেরে উঠছেন না বলে বারবার পিছিয়ে যাচ্ছেন।
শাফকাত জিজ্ঞাসু গলায় বলল, “চারটা?”
“হ্যাঁ। তার মধ্যে তিনটাই পায়ে। একই পায়ে। ছেলেটা আবারও হাঁটতে পারলে হয়।”
শাফকাত তার কথায় কর্ণপাত না করে এগিয়ে গেল আইসিইউর সামনে। সাবা বাবা-মা আর আতিয়া আলমকে বিশ্রামের জন্যে জোর করে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে শামা। শাফকাতের অনুপস্থিতিতে সে-ই সামলেছে সবটা। মনে মনে অবাক না হয়ে পারে না শাফকাত। বাড়ির বাচ্চা মেয়েটা যে বড় হয়ে গেছে, বিপদের দিন না এলে কখনো বোঝাই যেত না। আইসিইউর বাইরে ওয়েটিং এরিয়ায় পাওয়া গেল শামাকে।
শাফকাত তাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “তুই বাসায় যা। আমি আছি।”
শামা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে চিন্তিত গলায় বলল, “ভাবিকে আজই অন্য হসপিটালে শিফট করবে ভাইয়া? ভাবির অবস্থা তো এখনো ভালো না।”
শাফকাত গম্ভীর গলায় বলল, “এ ছাড়া উপায় নেই। এখানে তো ওর সর্বোচ্চ নিরাপত্তা এনসিউর করতে পারছি না। তাছাড়া ডক্টরের সাথে কথা হয়েছে আমার, কোনো সমস্যা হবে না।”
শামা পাশের চেয়ার থেকে তার হ্যান্ডব্যাগটা নিয়ে কাঁধে ঝুলিয়ে বলল, “ভাবি খেয়াল রেখো ভাইয়া। আমি একটু পরেই আবার চলে আসবো।”
“এখানে আর আসতে হবে না। একেবারে ওই হসপিটালে যাস।”
ওসি সাহেবের চোখে-মুখে বিস্ময় দিনের আলোর মতো উজ্জ্বল হয়ে ধরা দিচ্ছে। এত বড় একটা সংবাদ তিনি দিলেন শাফকাতকে? কোথায় ব্যস্ত ভঙ্গিমায় লয়ারকে ফোন করে মামলা-টামলার ব্যবস্থা করবে। তা না! ছোট বোনের সঙ্গে খোশগল্প জুড়ে দিয়েছে সে।
শামা লিফটের দিকে পা বাড়াতেই ওসি সাহেব চিন্তিত গলায় বললেন, “আমার কী মনে হয় জানেন শাফকাত সাহেব?”
“কী?”
“সাবা ম্যাডাম, ফাহিম – দুজনকে ঘিরেই কেউ ষড়যন্ত্র করছে।”
শাফকাত হালকা গলায় বলল, “দেখুন শেষমেশ ইনভেস্টিগেশন করে কী পান? এসব ব্যাপারে তো আপনারাই ভালো বুঝবেন।”
ওসি সাহেব হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে বললেন, “তবে ম্যাডামকে যে এই ছেলেটাই গুলি করেছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। ম্যাডামের গয়নার ব্যাকপ্যাকটা ওর কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। ফর্মালিটিস শেষ করে এখানে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।”
শাফকাত নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে বলল, “তাহলে তো হয়েই গেল। সাবাকে যে গুলি করেছে সে ধরা পড়েছে। এখন ওকে আবার কে গুলি করলো সেটা নিয়ে আমার মাথা ঘামানোর কিছু নেই। ধরা পড়েছে এতেই আমি খুশি। আমার তরফ থেকে কেস অবশ্যই ফাইল করা হবে, কিন্তু বাড়তি কোনো পুলিশি ঝামেলায় আমি জড়াতে চাচ্ছি না।”
ফাহিমকে কে গুলি করেছে এ নিয়ে শাফকাতের আগ্রহ না থাকাটাই স্বাভাবিক। জানা বিষয়ে কারই বা আগ্রহ থাকে? জার্মান পি/স্তলটা দিয়ে সে নিজেই যে গুলি করেছে ফাহিমকে। তিনটা গুলি পায়ে। আরেকটা ফুসফুসের খুব কাছাকাছি। ঠিক যেখানে সাবাকে গুলি করেছিল সে। সাবাকে র/ক্তের স্রোতে ফেলে রেখে ফাহিম যেমন চলে গিয়েছিল ওই নির্জন জায়গাটা থেকে, শাফকাতও ঠিক তাই করেছে।
রাব্বির নির্দেশে ছেলেপেলেরা আগেই ধরে ফেলেছিল ফাহিমকে। ফাহিম চুলগুলো গুঁড়ো গুঁড়ো করে কেটে চেহারা বদলে ফেলার চেষ্টা করেও তা বিফলে গেছে। ছেলেপেলেরা ঠিকই চিনে ফেলেছে তাকে। তার সঙ্গে নকল পাসপোর্ট আর ব্যাগভর্তি গয়না।
তাকে গাড়ি উঠিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা করে ছেলেরা। ফাহিম যদিও দমে যায় না। রীতিমত চেঁচামেচি শুরু করে দেয়। ভাবটা এমন করছিল যেন সে সাধারণ যাত্রী। দুষ্কৃতিকারীরা ভুলবশত তাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে শাফকাতও রওনা বেনাপোলের উদ্দেশ্যে। দুই গাড়ির দেখা হয় মাঝপথে। মাঝপথ থেকেই ফাহিমকে তুলে নেয় শাফকাত।
শাফকাতকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে যেন শুকিয়ে যায় ফাহিমের অন্তরটা। ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে সে। পূর্বের তেজ মিলিয়ে যায় শূন্যে। তাকে কোনো প্রশ্ন করেনি শাফকাত। কেন সাবাকে গুলি করলো? কোন সাহসে করলো? – কিছুই না। প্রশ্নের জবাবের প্রয়োজন নেই তার। তার প্রয়োজন ফাহিমের সারা শরীরটা র/ক্তে রাঙিয়ে দেওয়া। সাবা যতটা যন্ত্রণা পেয়েছে, তার থেকেও তীব্রতর যন্ত্রণা তাকে দেওয়া।
কাল রাতে সাবাকে যেখান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ঠিক সেই জায়গাটায় নিয়ে গেল ফাহিমকে। পূরণ করলো মনের সেই আশাটা। শাফকাত চাইলে এক নিমিষে তার প্রাণটা ছিনিয়ে নিতে পারতো। এক ফোঁটাও অনুতাপ হতো না তার। তবুও বাঁচিয়ে রাখলো। যাতে বেঁচে থেকে প্রতিনিয়ত ফাহিম যন্ত্রণা পায়।
এখন তার জেল হলো কি হলো না? হলেও কত বছরের জন্যে হলো? – এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনো ইচ্ছা তার নেই। কারাদণ্ড ফাহিমের জন্যে অতি নগণ্য শাস্তি। যে শাস্তি প্রকৃতপক্ষেই তার প্রাপ্য ছিল, তা সে পেয়ে গেছে।
সাবাকে অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হয়েছে। তার পাশে বসে আছে শাফকাত। অ্যাম্বুলেন্স চলতে শুরু করেছে। কালো কাঁচে ঘেরা জানালা থেকে আসা আবছা আলোতেও পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে মেয়েটাকে। কিছুক্ষণ আগে শাফকাত যখন ফাহিমকে তুলে আনল, গুলি করলো – ওই পরিস্থিতিতে তাকে দেখলে মনে হবে বিশ্বের দৃঢ়তম পুরুষ। হয়ত আসলেই দৃঢ়তার অভাব নেই তার মাঝে। তবে এই একটা জায়গাতেই দৃঢ়তা হেরে যায়। তার সবথেকে বড় দুর্বলতা সাবা।
সাবার হাতটা ধরে তার নিস্তেজ মুখটার দিকে ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো শাফকাত। মনে মনে কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। যে সিদ্ধান্ত মুহূর্তেই ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলেছে তার হৃদয়টাকে। তবুও সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার কোনো সুযোগ নেই। সাবার খুশির জন্যে সে সব করতে রাজি।
দেশের সব থেকে বড় হসপিটালে নিয়ে আসা হলো সাবাকে। এখানকার চিকিৎসা পদ্ধতি যেমন উন্নত, তেমনি নিরাপত্তা ব্যবস্থাও। শাফকাতের নিজস্ব সিকিউরিটি টিমও রয়েছে সঙ্গে।
সাত তলায় ভিআইপি এরিয়া। সেখানকার আইসিউতেই রয়েছে সাবা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভিড়ও বাড়তে শুরু করলা হাসপিটালের ভিআইপি লাউঞ্জে। সাবার দিকের আত্মীয়-স্বজন, শাফকাতের দিকের আত্মীয়-স্বজন। বিরক্তিতে শিউরে উঠলো শাফকাত। আইসিউতে থাকা রোগীকে দেখতে আসার কী হয়েছে?
যদিও দেখতে তারা কেউই আসেনি। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে সাবা পালানোর চেষ্টা করেছিল। কার সঙ্গে পালাতে চেয়েছিল, কেন পালাতে চেয়েছিল – এসব চটকদার খবর শুনতেই তাদের ছুটে আসা।
বাড়ন্ত ভিড় দেখে আতিয়া আলম এক এক করে অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনদের ফোন করতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। ইনিয়ে-বিনিয়ে বুঝিয়ে দিলেন এই মুহূর্তে হসপিটালে ছুটে না আসার জন্যে।
সন্ধ্যার দিকে এলো অরুণ। খবর পেয়ে আজ সকলেই কক্সবাজার থেকে ঢাকার বাসে ওঠে সে। বাস থেকে নেমে বাড়িতে না গিয়ে আগে এসেছে হসপিটালে।
শামার কাছ থেকে সবটা শুনে অরুণ নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। রাগে ফুঁসে উঠে বলল, “আমি সাবাকে বলেছিলাম এই ফাহিম বদের সাথে না মিশতে। শুনলো আমার কথা?”
ফাহমিদা বেগমের কানে এলো কথাটা। ফাহিমকে কখনোই চিনতেন না তিনি।
এগিয়ে এসে অসহায় গলায় বললেন, “ফাহিমটা কে অরুণ?”
অরুণ এখনো রাগে গজগজ করছে। তবুও কোনমতে বলল, “চিনবেন না আন্টি। সাবার ইউনিভার্সিটিতে পড়তো!”
ফাহমিদা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলল লাউঞ্জের আরেক প্রান্তে এসে স্বামীর পাশে বসলেন।
শুকনো গলায় বললেন, “সাবা না-কি পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল।”
আমির সাহেব ভারী গলায় বললেন, “শুনলাম।”
ফাহমিদা বেগম আর্দ্র গলায় বললেন, “মেয়েটা আমাদের কাছে এসেছিল ডিভোর্সের আবদার নিয়ে। কেন যে শুনলাম না? বিয়ে না হয় ভেঙে যেত কিন্তু মেয়েটার এত বড় ক্ষতি তো হতো না।”
“আমি অসুস্থ মেয়েটাকে নিয়ে বেশি কিছু বলবো না ফাহমিদা। কিন্তু সাবা যা করেছে, ঠিক করেনি।”
ফাহিমিদা বেগম বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে তাকালেন স্বামীর দিকে।
আমির সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, “শাফকাত কি ওকে মেরে ফেলছিল? কড়াকড়ির মধ্যে রাখছিল। ছোটবেলায় তো আমরাও কড়াকড়ির মধ্যে রাখতাম। আমাদের কাছ থেকে তো কখনো পালানোর চেষ্টা করেনি! আজকালকার মেয়েদের এই এক সমস্যা। স্বামী শাসন করলেই আত্মসম্মানে আঘাত লাগে। সাবা হয়তো কোনো ভুল করেছিল, সেজন্যেই তো শাসন করেছিল শাফকাত। শাফকাত ভুল করলে ও নিজেও শাসন করে দেখতো! তাতে শাফকাত মোটেও কিছু মনে করতো না।”
ফাহমিদা বেগম কতক্ষণ চিন্তা করে বললেন, “এটা অবশ্য ঠিক বলেছো। ছেলেটাকে তো দেখছি কাছ থেকে। কাল থেকে এক ফোঁটাও বসতে দেখলাম না। তুমি শাফকাতের মুখটা দেখেছো? যখন ওই হসপিটালে প্রথম এলো? কিংবা সাবাকে দেখে আইসিইউ থেকে বেরিয়ে এলো? সাবাকে নিয়ে যে ছেলেটা কত চিন্তা করে, তার চোখে মুখেই পরিষ্কার। তবুও বোকা মেয়েটা দেখতে পেলো না।”
আমির সাহেব অভিমানী কণ্ঠে বললেন, “শুধু মেয়েকে বোকা বলছো কেন? ছেলে-মেয়ে দুটোই বোকা!”
ধক কেঁপে উঠলো ফাহমিদা বেগমের বুকের ভেতরটা। মা হওয়ার থেকে বড় যন্ত্রণা এ পৃথিবীতে বুঝি আর নেই। সন্তানকে হারানোর আজ কতগুলো দিন হয়ে গেল। তবুও সে সর্বক্ষণ হৃদয়ে বিরাজমান। আনমনেই তাকে খুঁজে বেড়ান ফাহমিদা বেগম। তার নামটা শুনলেই যেন মনে হয় আশে-পাশেই কোথাও সে আছে।
আমির সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “একজন ভুল মানুষের জন্যে নিজের জীবনটা নিজেই কেড়ে নিলো। আরেকজন সঠিক মানুষকে পেয়েও তার কাছ থেকে পালাতে গিয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এলো।”
মানুষের জীবনটা এত জটিল কেন?
কে ভুল মানুষ আর কে সঠিক মানুষ, এই সমীকরণের সমাধান করতে করতেই যে শেষ দিনটা ঘনিয়ে আসে, তারা বুঝতেই পারে না।
(চলবে)