লেবু পর্ব-৪০+৪১+৪২

0
2

#লেবু
৪০ (বোনাস পর্ব)
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেল। সাবা সেরে উঠছে। প্রতিদিন একটু একটু করে হলেও তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। কথা বলতে যদিও তার কষ্ট হয়, তবুও প্রয়োজনের কথাটা মুখ ফুটে বলতে পারছে। যে দ্রুত গতিতে তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি ঘটছে, আরও একটা সপ্তাহ পর্যবেক্ষণে রেখেই ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছেন ডক্টররা।

তবে বাড়িতে ফিরেও তাকে সম্পূর্ণভাবে বেড রেস্টে থাকতে হবে। ডক্টর প্রতিদিন দুবার গিয়ে চেকআপ করবেন। দুজন নার্স সর্বক্ষণ বাড়িতে তার দেখাশোনা করবে।

এই দু সপ্তাহে হসপিটালেই গোটা অফিস বসিয়ে দিয়েছে শাফকাত। জরুরি কোনো মিটিং থাকলে ভিআইপি লাউঞ্জে সারছে। অন্যান্য জরুরি কাজ সাবার কেবিনে থাকা সোফাটায় গা এলিয়ে দিয়ে ল্যাপটপে কোলে রেখে করছে। কিন্তু সাবার পাশ থেকে এক মুহূর্তের জন্যেও নড়েনি।

সাবার বাবা-মা বারবার তাকে বলেছেন বাড়ি ফিরে কিছুক্ষণের জন্যে বিশ্রাম নিতে। কিন্তু শাফকাত যায়নি। সাবা এক মুহূর্তের জন্যেও তার দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেলে বিচিত্র গতিতে ধড়ফড় করে ওঠে তার বুকটা। মেয়েটা একেবারেই যখন তার জীবন থেকে বিদায় নেবে, তখন যে তার কী হাল হবে করে জানে?

আতিয়া আলম অবশ্য ছেলেকে বাড়ি যাওয়া নিয়ে খুব একটা জোরাজুরি করেননি। দীর্ঘদিন ধরে শাফকাত এবং সাবার মধ্যে চলে আসা রেষারেষি স্বচক্ষে দেখছেন তিনি। প্রথম প্রথম মনে হয়েছিল হুট করে সাবাকে বিয়ে করে শাফকাত খুশি না। তবে এখন তার চোখে-মুখে সর্বক্ষণ লেগে থাকা উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা স্পষ্ট জানান দেয়, মেয়েটার জন্যে সে কতটা চিন্তিত। মেয়েটাকে নিয়ে সে কতটুকু ভাবে! এই সংকটকালে দুজনে কাছাকাছি থাকলে যদি দূরত্বটা একেবারেই ঘুচে যায়! এই আশায় অতিয়া আলম ছেলেকে সর্বক্ষণ হসপিটালে থাকতে বাঁধা দিচ্ছেন না। অথচ আতিয়া আলম কী জানেন? দূরত্বটাকেই পাকাপোক্ত করে তোলার পথ ইতোমধ্যে শাফকাত সাজিয়ে ফেলেছে।

আজ সকাল থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। সাবার কেবিনের উত্তর দিকে ফ্লোর টু সিলিং বিশাল জানালা। যখন সে গুরুতর অসুস্থ ছিল তখন এই পর্দা টেনেই রাখা হতো। তবে আজকাল শাফকাত পর্দাটা সরিয়ে রাখে। সাবা বিছানায় শুয়ে শুয়ে মলিন চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। যদিও মেয়েটা কখনো বলেনি, তার আকাশ দেখতে ভালো লাগে। তবুও তা বুঝে নিয়েছে শাফকাত।

বৃষ্টির কারণেই বোধ হয় কেমন শীত শীত অনুভূত হচ্ছে। গলা পর্যন্ত চাদর জড়িয়ে গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে সাবা। কিছুক্ষণ আগে তার মা চুলগুলোতে সুন্দর করে বিনুনী পাকিয়ে দিয়ে গেছেন। তবুও কয়েকটা চুল এলোমেলোভাবে পড়ে আছে মুখের ওপরে।

জানালায় আলগোছে কাঁধ ঠেকিয়ে, হাতে উষ্ণ কফির কাপ হাতে শাফকাত একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সাবার দিকে। তার চোখ দুটো আজ মেঘলা আকাশের পানে নেই বলে দেখতে পাচ্ছে না শাফকাতের ঘোরলাগা নজরকে। চোখ দুটো বন্ধ তার করে আলস্যের ভঙ্গিতে শুয়ে আছে সাবা।

শাফফাত বুঝতে পারে না এই মেয়েটা তাকে ঘৃণা করে না-কি করে না! সকালে কী সব টেস্ট করানোর জন্যে তাকে আরেকটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। শাফকাত নিজেই তাকে হুইল চেয়ারে বসালো। সাবাকে ওই ঘরে রেখে সে বাইরে এসে দাঁড়াতেই ভেতর থেকে ছুটে এলো একজন নার্স। সাবা না-কি অসম্ভব ভয় পাচ্ছে। অগত্যা ব্যস্ত পায়ে আবারও তাকে ফিরে গেলো সাবার কাছে। তার শরীর থেকে রক্ত নেওয়ার সময় তার পাশেই বসে রইলো শাফকাত। এনজিওগ্রাম করার সময়ে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে থেকে বলছিল, “ভয় নেই সাবা। আমি আছি।”

শাফকাত আজ বুঝতে পারলো কেন সে এই হসপিটালের বাইরে পা রাখতে পারছে না। কারণ তার অবচেতন মন বারবার তাতে বাঁধা প্রয়োগ করছে। সে সাবার চোখের আড়াল হলেই মেয়েটা ভয় পাচ্ছে।

যার প্রতি মেয়েটার এত আস্থা, এত ভরসা – তার কাছ থেকে পালাতে গিয়েই তো আজ এই অবস্থা। হয়ত সংকটকালে শাফকাতকে পাশে পেয়ে নতুন করে আস্থাটা জন্মেছে। কিন্তু ঘৃণা কি ফুরিয়ে গেছে? না-কি এখনো বেঁচে আছে তার মনের কোণে?

সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ শাফকাতের মনে পড়ে গেল আজ সকালে ডক্টর আফরোজার বলা কথাগুলো। সাবাকে এখন একটু হাঁটাহাঁটি করতে হবে। তার শরীরটা আবারও সক্রিয় করে তুলতে হলে তাকে এভাবে দিনের পর দিন হসপিটাল বেডে ফেলে রাখা ঠিক হবে না।

শাফকাত কফির কাপটা রেখে একটু একটু করে এগিয়ে গেল সাবার কাছে। তার পায়ের শব্দ পৌঁছালো সাবার কর্ণকুহরে, তবুও চোখ খুললো না সে।

শাফকাত বেডের পাশে এসে দাঁড়িয়ে তার দিকে খানিকটা ঝুঁকে নরম স্বরে ডাকলো,“সাবা?”

সাবা চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে অস্পষ্ট গলায় বলল, “উঁ?”

শাফকাত যথাসম্ভব কোমল স্বরে বলল, “ওঠো! আজ তুমি হাঁটবে।”

সাবা ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “না!”

বড্ড মায়া হলো শাফকাতের। দিনভর দৌড়ঝাঁপ করে বেড়ানো মেয়েটা আজ কয়েক পা হাঁটতেই চাইছে না।

শাফকাত সাবার কাঁধে হাত রেখে তাকে সাহস দেওয়ার উদ্দেশ্যে বলল, “একটু চেষ্টা করো সাবা। তুমি একা একা উঠে বসতে না পারলে, হাঁটতে না পারলে ডক্টররা তো তোমাকে বাসায় যেতে দিবে না।”

সাবা বাসায় যাওয়ার প্রসঙ্গে খানিক অবাক হয়ে ক্ষীণ স্বরে জিজ্ঞেস করলো, “কবে যাবো?”

শাফকাত মৃদু হেসে সাবার মুখের ওপর পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দিতে দিতে বলল, “যাবো তো! তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠলেই আমরা বাসায় ফিরে যাবো!”

সাবা তাকিয়ে রইলো শাফকাতের দিকে। শাফকাতও সাবার দিকে। মেয়েটা একসময় অসম্ভব বিরক্তি নিয়ে তাকাতো তার দিকে। তারপরে এলো রাগ, সবশেষে ঘৃণা। তবে আজকের এই দৃষ্টিতে সেসব কিছুই দেখছে না শাফকাত। দেখছে কেবল ভরসা আবছা একটা ছায়া।

শাফকাত হঠাৎ সোজা হয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, “একটু ওঠো? আমি হেল্প করছি।”

সাবার দুই বাহু সযত্নে আঁকড়ে ধরে তাকে উঠে বসতে সাহায্য করলো শাফকাত। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে সাবা নিজেই শাফকাতের হাত দুটো ধরলো। আবারও মেয়েটার কর্মকাণ্ডে ভরসার আবছা ওই ছায়ার আভাস পেলো শাফকাত।

সাবাকে এক হাতে বুকের মাঝে জড়িয়ে, আরেকটা হাতে তার হাত ধরে রেখেছে শাফকাত। মেয়েটা এক পা এক পা করে হাঁটছে কেবিন জুড়ে। একেকটা কদম ফেলতে যেন খুব কষ্ট হচ্ছে তার।

শাফকাত উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “কষ্ট হচ্ছে সাবা?”

কিন্তু সাবা তো সাবাই। হাজার কষ্ট হলেও মুখ ফুটে বলবে না কখনো।

অস্ফুটস্বরে কেবল বলে উঠলো, “উঁহুঁ।”

শাফকাত সুপ্ত একটা আদর মেশানো গলায় বলল, “কষ্ট হলে বলবে আমাকে। আচ্ছা?”

সাবা ঘাড় কাত করে সায় জানালো। কয়েক মিনিট পর ক্লান্ত হয়ে আবার বলল, “আর না।”

শাফকাতও আর জোরাজুরি করলো না। বেডের কাছে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিলো তাকে।

সন্ধ্যায় হসপিটালে অরুণ এলো। সে আশেপাশে থাকলেই সাবার মনটা ভালো হয়ে যায়। মাথায় বিলি কেটে দিতে দিতে অরুণ এমন সব মজার মজার গল্প বলে যে সাবা মন দিয়ে শোনে। কখনও তো সাবার তার ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠে এক চিলতে হাসির সূক্ষ্ম রেখা।

শাফকাত দূর থেকে লক্ষ্য করেছে একটা ব্যাপার। একমাত্র অরুণ আশেপাশে থাকলেই সাবা স্বাভাবিক থাকে। এমন না যে অন্যান্য সময়ে স্বাভাবিক থাকে না। কিন্তু অন্য সময়ে তার চোখে-মুখে ফুটে ওঠে অনুতাপ। নিজের বাবা-মায়ের সামনেও কেমন জড়িয়ে যায়। লজ্জায় শাশুড়ির চোখের দিকে তাকাতে পারে না।

আর সব থেকে বেশি অপরাধবোধে ভোগে শাফকাতের সামনে। কে জানে হয়ত পরিবারের মানুষগুলোর উপস্থিতি বারবার তাকে মনে করিয়ে দেয়, সকলকে ফাঁকি দিয়ে তার পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টার কথা। এ জীবনে করা সবথেকে বড় ভুলটার কথা।

সাবা পালিয়ে যেতে চেয়েছিল বলে তার প্রতি বিন্দুমাত্র রাগ জমে নেই শাফকাতের মনে। রাগ তো সব তার নিজের ওপর। সেই তো পারেনি ভালোবাসা দিয়ে মেয়েটার মনকে জয় করে নিতে।

যাক গিয়ে ওসব আফসোসের কথা! শাফকাত চিন্তিত সাবার বর্তমান অবস্থা নিয়ে। যে মেয়ের চোখে সর্বক্ষণ বাঘিনীর তেজ লেগে থাকে, সেই মেয়েটাই কিনা আজ লজ্জায়-সংকোচে বারবার চোখ নামিয়ে ফেলছে?

শাফকাত অরুণকে গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে ফিরে এলো সাবার কাছে। মেয়েটা টিভিতে কার্টুন দেখছিল। শাফকাতকে দেখতেই কেমন জড়িয়ে গিয়ে এদিক-ওদিক তাকালো।

শাফকাত আর কোনো প্রকার ভনিতা না করে সরাসরি জিজ্ঞেস করলো, “কী ব্যাপার? আমাকে দেখলেই চোখ নামিয়ে ফেলো কেন?”

সাবা আর কোনো উত্তর খুঁজে না পেয়ে বলল, “কই না তো!”

শাফকাত সন্দেহের সুরে জিজ্ঞেস করলো, “সত্যি?”

“হুঁ।”

“হুঁ”- টাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার তাগিদেই হয়ত সাবা আবারও চোখ তুলে তাকালো শাফকাতের দিকে। কিন্তু তাকিয়ে থাকতে পারলো না বেশিক্ষণ। ভেতর থেকে কী যেন একটা এসে দমিয়ে দিয়ে গেল তাকে। আবারও চোখ নামিয়ে ফেলল সাবা।

শাফকাত ধীর পায়ে এগিয়ে এলো। শান্ত ভঙ্গিতে বসলো সাবার বেডের পাশে থাকা চেয়ারে। সাবা হয়ত অস্বস্তিটা কাটিয়ে ওঠার জন্যেই দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো টিভির ওপরে।

তবুও শাফকাত একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “সাবা শোনো, তোমার এমন ভয়ে ভয়ে থাকার কোনো কারণ নেই। সংকোচ করারও কোনো কারণ নেই। তুমি এমন কোনো অপরাধ করোনি যে সারাক্ষণ মাথা নিচু করে থাকবে। আগে যেভাবে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে সাহস নিয়ে কথা বলতে, সেভাবেই বলবে।”

সাবা চোখ তুলে কম্পিত দৃষ্টিতে তাকালো শাফকাতের দিকে। কেন জানি আজকাল এই মানুষটাকে বড্ড অচেনা লাগে। এই শাফকাত কোথায় লুকিয়ে ছিল এতদিন?

(চলবে)

#লেবু
৪১
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

আজ দেড় মাস পর বাড়ি ফিরছে সাবা। হসপিটালের চার দেয়াল থেকে মুক্তি পেতে যাচ্ছে বলে তার মনে উচ্ছ্বাসের কমতি নেই। বাড়ি থেকে দুজন স্টাফ এসেছিল তার জিনিসপত্র সব গোছগাছ করবে বলে। তাদের বাধা দিয়ে শাফকাত একাই সব গোছাচ্ছে। সাবা বেডের ওপর বসে অবাক চোখে দেখছে তার কর্মকাণ্ড। কে বলবে এই ছেলেটাকে সর্বক্ষণ গাম্ভীর্য ঘিরে রাখে?

শাফকাতের সঙ্গে টুকটাক অনেক কথাই হয় তার। সেদিন তার আশ্বাস পেয়ে সত্যিই সাবার সংকোচ কেটে গেছে। একটু একটু করে সুস্থ হয়ে ওঠার পর থেকেই প্রগাঢ় অপরাধবোধ আঁকড়ে ধরেছিল তাকে। কিছুতেই সেই অপরাধবোধ থেকে বের হতে পারছিল না সাবা। মা-বাবা, শাশুড়ি-ননদ, শাফকাত কারোর চোখেই চোখ মেলাতে পারছিল না।

তবে সে রাতে শাফকাতের বলা কথাগুলোর পর থেকে মনের চাপা ওই অস্বস্তিটা কেটে গেছে। তবে কাটেনি অপরাধবোধ। নিজের বোকামির কথা মনে পড়লেই অস্বস্তিতে, লজ্জায় একাকার হয়ে যায় সে। তবে তার পলায়ন চেষ্টার প্রসঙ্গে কোনো কথাই হয়নি। আশেপাশের মানুষগুলো তাকে এতটাই ভালোবাসে যে কেউই ওই বিস্মৃতি মনে করিয়ে কষ্ট দেয়নি তাকে। শাফকাতও না। তাদের কথোপকথনে কখনোই উঠে আসেনি সে প্রসঙ্গ।

সাবা অবাক চোখে শাফকাতের দিকে তাকিয়ে কণ্ঠে দ্বিগুণ বিস্ময় নিয়ে বলল, “আপনার বিজনেসগুলো কি সব উচ্ছন্নে গেছে?”

শাফকাত সাবার কাপড়ের ব্যাগটা গোছাচ্ছিল। হঠাৎ থমকে দিয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, “কেন?”

“না মানে, যেভাবে দেড় মাস হসপিটালে পড়ে রইলেন। আমার তো মনে হয় না একটাও বিজনেস এখনো টিকে আছে।”

বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো শাফকাতের ঠোঁটের কোণে। ব্যাগ গোছানো শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো উত্তর এলো না তার কাছ থেকে। গোছানো ব্যাগটা সোফার ওপরে রেখে শাফকাত এক পা এক পা করে এগিয়ে এলো সাবার দিকে। তার মুখোমুখি বসে চোখের ওপরে পড়া কতগুলো চুল গুঁজে দিলো কানের পেছনে।

গাঢ় স্বরে বলল, “সাবা, আমি আমার বিজনেসগুলোকে এমনভাবে গড়ে তুলেছি যে কয়েকটা দিন আমাকে ছাড়া তারা উচ্ছন্নে যাবে না। কিন্তু তোমাকে তো সেভাবে গড়ে তুলতে পারিনি।”

সাবা বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল, “আপনার ধারণা আপনাকে ছাড়া আমি উচ্ছন্নে যাবো?”

“আমার ধারণা না, সত্যি। প্রমাণ তোমার বুকের এই ক্ষতচিহ্ন দুটো।”

জামার ওপর দিয়েই সাবার কাঁধের কিছুটা নিচে ব্যান্ডেজ করে রাখা ক্ষতচিহ্নে আঙুল বোলালো শাফকাত। সাবা অচিরেই কেমন কাঁচুমাচু হয়ে গেল। শাফকাতের চোখে আর চোখ মেলাতে পারলো না।

সাবার বাবা-মা চাইছিলেন মেয়েকে নিজেদের কাছে রাখতে। তবে শাফকাত থাকতে তা কি সম্ভব কখনো? উল্টো তাদেরকেই নিজে এসেছে এই বাড়িতে। মেয়ের কাছাকাছি রাখার জন্যে।

সাবাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে শাফকাত সোজা নিয়ে এলো তার ঘরে। তাকে বিছানার ওপর বসিয়ে রেখে ক্লজেট থেকে সাবার ঘরের পোশাক বের করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। হসপিটালে থাকাকালীন দমবন্ধকর সময়গুলোতে সাবাকে একটু স্বস্তি দিতে শাফকাত প্রায়ই ল্যাপটপ নিয়ে বসে যেত তার পাশে অনলাইন শপিং করতে। সাবা একটা একটা জিনিস আঙুল তাক করে দেখায়, আর শাফকাত তার রিভিউ পড়ে শোনায়, সাবাকে ছবি দেখায়। ভালো লাগলে কার্টে অ্যাড করে নেয়। এই জামাগুলোও সেভাবেই কেনা। সাবার সুবিধার জন্যে লম্বা লম্বা কতগুলো শার্ট অর্ডার দিয়েছিল সে।

সাবার অন্যান্য জামা-কাপড় পাশের ঘর থেকে এনে তার ক্লজেটে রাখা হয়েছে। তার প্রিয় বইপত্রগুলো এ ঘরের বুকশেলফটায় রাখা হয়েছে। তার ঘরের সঙ্গে লাগোয়া ব্যালকনির ফুল গাছগুলো এ ঘরের ব্যালকনিতে রাখা হয়েছে।

তার ওষুধ-পত্র রাখা হয়েছে এ ঘরের বেডসাইড টেবিলে। এসব আয়োজনের নির্দেশনা সে দিনকয়েক আগেই হসপিটালে বসে দিয়ে রেখেছিল।

শাফকাত ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলল, “শোনো সাবা! আমাদের ডিভোর্স না হওয়া পর্যন্ত তোমাকে এই বাড়িতেই থাকতে হবে। যতই হোক, আইনত এখনো তুমি আমার বউ। বউকে তো আর অন্য বাড়িয়ে রাখতে পারি না।”

সাবার বুকটা ধ্বক করে কেঁপে উঠলো। হসপিটালের চার দেয়ালে বন্দী থেকে থেকে হাঁপিয়ে উঠেছিল সে। বাড়ি ফেরার জন্যে ছটফট করছিল। কিন্তু প্রত্যেকবারই তার মনে ভেসে উঠেছিল এই বাড়ির কথা। এই বাড়িটাকে কি তবে আপন করে নিয়েছে তার অবচেতন মন?

সাবা কম্পিত স্বরে বলল, “কিন্তু…”

শাফকাত সাবার দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ গলায় বলল, “কী? কিন্তু কী?”

সাবা আমতা আমতা করে বলল, “আমাকে এ ঘরে নিয়ে এলেন কেন?”

শাফকাত উত্তর দিলো না সাবার প্রশ্নের। তার চোখে-মুখে রহস্যের আভা। যেন সাবার এই বিভ্রান্তি বড্ড উপভোগ্য তার কাছে। সাবার মুখোমুখি এসে বসলো শাফকাত। এখনো কিন্তু উত্তর আসেনি তার কাছ থেকে।

সাবা অমন রহস্যময় চাহনিতে কিছুটা হলেও ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “না মানে, আমি তো সবসময় পাশের ঘরটাতেই থাকতাম।”

শাফকাত হালকা গলায় বলল, “ওই ঘরে থাকতে চাচ্ছো? আবারও পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা আছে না-কি?”

লজ্জায় লাল হয়ে গেল সাবার গাল দুটো। এর আগে শাফকাত তার পালিয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গ টেনে আনেনি তাদের কথোপকথনের মাঝে। আজ আনল। লজ্জার সঙ্গে ভাবনার সূক্ষ্ম রেখা ফুটে উঠেছে সাবার কপালে। দৃষ্টি নামিয়ে দেখে কীসের যেন চিন্তায় মগ্ন সে।

শাফকাত শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো, “কী ভাবছো সাবা?”

সাবা অস্পষ্ট গলায় বলল, “কিছু না।”

শাফকাত আবারও সেই রহস্যময় হাসিটা হেসে বলল, “আমি জানি তুমি কী ভাবছো।”

সাবা চমকে উঠে তাকালো ঠিক তার চোখের দিকে।

শাফকাত হাসিটা ধরে রেখেই বলল, “ভাবছো, এই ছেলের সন্দেহের বাতিক জীবনেও যাবে না। তাই না?”

সাবা আবারও ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “না আসলে…”

সাবাকে কোনো অজুহাত খুঁজে বের করার সুযোগ শাফকাত দিলো না।

কিঞ্চিৎ তাড়া দিয়ে শার্টটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “যাও ফ্রেশ হয়ে এসো। তোমার খিদে পেয়েছে?”

“না।”

শাফকাত সোজাসাপ্টা জানিয়ে দিলো, “না পেলেও খেতে হবে। তোমার সারাজীবনের অনিয়ম এখন আর চলবে না।”

সাবা ফ্রেশ হতে চলে গেল। শাফকাতও গেল তার খাবার আনতে। আদরের পুত্রবধূর গৃহ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষ্যে আতিয়া আলম আজ তার পছন্দের সব আইটেম রেঁধেছেন। সর্ষে বাটা দিয়ে মুরগি, আলু পটলের দোলমা, রুই মাছের কোপ্তা, চিনিগুঁড়া চালের ভাত। বেশি একটা সাবা খেতে পারবে না বলেই তিনি অল্প আইটেম রেঁধেছেন। প্লেটে সবকিছু সুন্দর করে সাজিয়ে ছেলের হাতে তুলে দিলেন আতিয়া আলম।

শাফকাত খাবার নিয়ে ফিরে এসে দেখলো ইতোমধ্যেই সাবা ফ্রেশ হয়ে বেরিয়েছে। হালকা গোলাপি লম্বা শার্টে অসম্ভব স্নিগ্ধ লাগছে তাকে। ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে চোখ ফিরিয়ে নিলো শাফকাত। একটু একটু করে এই মেয়েটার প্রতি সকল প্রকার দুর্বলতা কমিয়ে আনতে হবে। মেয়েটা তো আর চিরকাল থাকছে না তার কাছে। শুধু শুধু এই দুর্বলতার কোনোই অর্থ নেই।

সাবা বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই শাফকাত প্লেট নিয়ে বসলো তার পাশে। যত্ন নিয়ে ভাত মাখতে শুরু করলো।

সাবা বিস্ময়ের চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছে বলল, “আপনি আমাকে খাইয়ে দেবেন?

শাফকাত সহজ গলায় বলল, “এখন নিশ্চয়ই বলবে না সে অধিকার আমার নেই। তাছাড়া আমাদের ডিভোর্স তো হয়েই যাচ্ছে। তোমার সাথে ভালো কিছু তো কখনোই করলাম না। অন্তত এই শেষ কয়েকটা দিন তোমার সেবা করে পুণ্য কামাতে দাও।”

শাফকাত কথাগুলো বলতে বলতেই খাবার তুলে নিলো সাবার মুখে। মুখে নিয়েই কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলো সাবা।

শাফকাত চিন্তিত স্বরে বলল, “গরম?”

“না।”

শাফকাত আবছা আক্ষেপের সুরে বলল, “তুমি আমাকে সত্যি বলো না কেন বলো তো সাবা? সত্যি বললে কি আমি তোমাকে গিলে খাবো?”

সাবা সরল গলায় বলল, “সত্যিই তেমন গরম না।”

শাফকাত সূক্ষ্ম হাসি হেসে বলল, “তুমি খুব ভালো করেই জানো আমি গরমের কথা বলছি না।”

সাবা দুর্বলভাবে বলল, “আমি কখন আপনাকে মিথ্যা বললাম?”

“সত্যিও তো বলোনি। সত্যি গোপন করা আর মিথ্যা বলা কী এক নয়?”

“আমার…”

সাবাকে থামিয়ে দিয়ে শাফকাত স্বাভাবিকভাবেই বলল, “আর কোনো উপায় ছিল না, না? আমি জানি।”

সাবার মনের মাঝে দ্বিধার আনাগোনা শেষ হতেই চাইছে না। অথচ এ বাড়ি থেকে, শাফকাতের কাছ থেকে পালিয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত মনে হচ্ছিল সে যা করেছে ঠিক করছে। তবে সমস্ত ধারণা পাল্টে যায়, ফাহিমের পিস্তল থেকে নিক্ষেপ করা প্রথম গুলিটা গায়ে এসে লাগার পর।

আজকাল প্রায়ই প্রবল অপরাধবোধ এসে তাড়া করে সাবাকে। যদি ফাহিম তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা না করতো, যদি সত্যিই সাবা বহু দূরে পালিয়ে যেতে সক্ষম হতো তাহলে কি এই অপরাধবোধ কাজ করতো তার মাঝে? নিজেকে করা প্রশ্নের উত্তর নিজেই খুঁজে পায় না সাবা। বড্ড ঘৃণা হয় নিজের ওপর। যে মানুষগুলোকে না জানিয়ে অমন ভয়ংকর একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল সে, দুর্দিনে সেই মানুষগুলোই সব থেকে বেশি আগলে রাখলো তাকে।

শাফকাত সাবাকে খাইয়ে দিতে দিতে বলল, “আমাকে আগেও তো বেশ কয়েকবার বলেছিলে, এই বিয়েটা করে তুমি ভালো নেই। দমবন্ধ লাগে তোমার। আমিই উল্টো রেগে গিয়ে কত কাণ্ড করলাম!”

শাফকাতের একেকটা কথায় যেন একটু একটু করে দমে পড়ছে সাবা। উত্তর দেবার কোনো ভাষাই তার নেই। শাফকাতের প্রতি তার অনুভূতিগুলো গিরগিটির থেকেও দ্রুত রং বদলায়। বিয়ের পর পর অসহ্য লাগতো এই পুরুষকে। মাঝে একবার ভালো লাগার অনুভূতি জাগলো। তা ভালোবাসায় মোড় নেওয়ার আগেই আবার ঘৃণায় পরিণত হলো।

সেই ঘৃণাও আজ ফুরিয়ে গেছে। হসপিটাল বেডে যখন সে নিস্তেজ হয়ে পড়ে ছিল, আশেপাশে চোখ বুলিয়েই যাকে খুঁজে পেয়েছিল সে শাফকাত। হঠাৎ হঠাৎ যখন দমবন্ধকর ভয় এসে গলা চেপে ধরতো শাফকাত, যে মানুষটা তাকে পরম মমতায় আগলে রেখেছে সে শাফকাত।

শাফকাতের প্রতি সাবার সকল অনুভূতি ছাপিয়ে যে অনুভূতি মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে তার নাম কৃতজ্ঞতা। মানুষটার চোখে ধুলো দিয়ে সাবা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো, তবুও তার বিন্দুমাত্র রাগ নেই, ক্ষোভ নেই। কিংবা আছে হয়ত, তার বহিঃপ্রকাশ নেই। কী নিদারুণ যত্নে রাখছে সে সাবাকে। এই মানুষটাকে কেউ ঘৃণা করে কী করে?

নিজের মনের গতিবিধিতে নিজেই বিস্মিত সাবা। সমস্যাটা আসলে কার? তার নিজের? না-কি শাফকাতের? হয়ত সাবা নিজেই নিজের অনুভূতিগুলো নিজে বিভ্রান্ত। সে বুঝতে পারছে না আদৌ এই মানুষটাকে জীবনে সে চায় না-কি না। কিংবা হয়ত শাফকাতই এমন। ‘এই ভালো এই খারাপ’ জাতীয় স্বভাব তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে।

শাফকাত পুনরায় সেই হালকা গলায় বলে উঠলো, “অবশ্য তুমি মুখ ফুটে কোনোদিন না বললেও আমার বোঝা উচিত ছিল। তুমি আমার বউ! নামেই শুধু বউ। বিয়ের পর থেকে আমার সঙ্গে কোনোদিন সে একঘরে থাকেনি, মন খুলে কথা বলেনি, এমনকি চোখের দিকে ভালো করে তাকায়নি। অথচ আমিই শুধু বিয়ের খাতিরে জোর করে তাকে আটকে রাখলাম। দোষটা তো আমারই।”

অনেকটা সময় চুপ করে রইলো সাবা। কোনো উত্তর সাজাতে পারলো না মস্তিষ্কে। তাই বৃথা চেষ্টাও করলো না। আড়চোখে তাকালো কয়েকবার শাফকাতের দিকে। ছেলেটার চোখ দুটো শান্ত নদীর মতো। কোনো উত্তেজনা নেই, তেজ নেই। শান্ত ভঙ্গিতেই হৃদয় কাঁপিয়ে তোলার মতো কথাগুলো বলে গেল সে।

সাবা অবশেষে নীরবতা ভঙ্গ করে কম্পিত স্বরে বলল, “আপনি আমার ওপর অনেক রেগে আছেন তাই না?”

শাফকাত শান্ত ভঙ্গিতেই বলল, “আমাকে কম রাগতে তো দেখোনি সাবা। ভালো করে তাকিয়ে দেখো তো! আমাকে দেখে মনে হচ্ছে আমি রেগে আছি?”

সাবা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো শাফকাতের দিকে। আসলেই তো! রাগলে তার চোখ দুটো রক্তিম বর্ণ ধারণ করে, ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে। কই সেসব লক্ষণ তো আজ প্রকাশ পাচ্ছে না তার মাঝে।

শাফকাত ক্ষীণ হাসি হেসে বলল, “আমার দিকে তাকিয়ে থাকলে চলবে? খাও!”

লজ্জা পেয়ে চোখ সরিয়ে নিলো সাবা। মুখে তুলে নিলো খাবার। সাবাকে খাইয়ে দিয়ে শাফকাত প্লেট রেখে হাত ধুয়ে এলো। এরপর বসলো তার একগাদা ওষুধপত্র নিয়ে। প্রেসক্রিপশন মিলিয়ে একেকটা ওষুধ মোড়ক থেকে বের করে তুলে দিচ্ছে সাবার হাতে। সবটাই নীরবতায়।

সবশেষ ওষুধটা সাবার হাতে দিয়ে শাফকাত বলল, “সাবা?”

ওষুধটা পানি দিয়ে গিলে সাবা বলল, “হুঁ?”

শাফকাত অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল, “বিয়ের পর থেকেই দেখে আসছো আমি কতটা কন্ট্রোলিং। তোমার ফোন ট্র্যাক করি, তোমার অফিসের সিসিটিভির খোঁজ রাখি। তোমাকে অন্য কোনো ছেলের সাথে দেখলে রাগে পাগল হয়ে যাই। তোমার মনে একবারও প্রশ্ন জাগেনি আমি কেন এসব করি? আমি কেন প্রতিনিয়ত তোমাকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করি?”

বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো সাবার। আসলেই তো! শাফকাত কন্ট্রোলিং বলে তার মনের মাঝে হাহাকারের শেষ নেই। কিন্তু সে যে কেন এরকম – সেই প্রশ্ন তো কখনো করে দেখেনি নিজেকে।

কাঁপা কাঁপা গলায় সাবা বলল, “কেন?”

শাফকাত তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “তোমার হয়ত মনে হতে পারে, আমি এসব করি আমার মেল ইগোকে সন্তুষ্ট করার জন্য। ভাবতেই পারো তোমাকে হাতের মুঠোয় রেখে আমি পৈশাচিক আনন্দ পাই। ভাবো না?”

সাবা চুপ করে রইলো। শাফকাত কি কোনোভাবে ঢু মেরে এসেছে তার মস্তিষ্কের ভেতর থেকে? বিয়ের প্রথম দিকে সাবার আসলেই মনে হতো শাফকাত তাকে কন্ট্রোল করে পৈশাচিক আনন্দ পায়।

শাফকাত সাবার গালের ওপরে আলতোভাবে একটা হাত রাখলো। পুরুষালি দৃপ্ত স্পর্শে রীতিমতো কেঁপে উঠলো সাবা।

শাফকাত গাঢ় স্বরে বলল, “তাকাও আমার দিকে সাবা!”

বাড়ন্ত হৃদস্পন্দন আর কম্পিত দৃষ্টি নিয়ে সাবা তাকালো শাফকাতের চোখের দিকে।

“বলো! ভাবো কিনা?”

সাবা হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। সে কি ভয় পাচ্ছে শাফকাতকে? সাবা তো জানতো সে কাউকে ভয় পায় না। সেই ধারণা কি ভুল ছিল তবে?

সাবা ইতস্তত করে বলল, “আমি…”

শাফকাত আদরমাখা এক ধমক দিয়ে বলল, “এই মেয়ে! এতটুকু প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে হাত-পা কাঁপার কী হলো? এদিকে এসো!”

নিঃসঙ্কোচে সাবাকে বুকের মাঝে টেনে নিলো শাফকাত। দুহাতে জড়িয়ে ধরলো তাকে। শাফকাতের অশান্ত হৃদয়ের ধুকপুক শান্ত করতে পারলো না সাবাকে। তার হাত-পায়ের কম্পন তীব্রতর হলো।

সাবা অস্থির কণ্ঠে বলল, “আমি জানি না। কিচ্ছু জানি না।”

শাফকাত সাবার চুলের মাঝে হাত বুলিয়ে বলল, “থাক! বেশি কিছু ভাবতে হবে না। বেশি ভাবলেই কষ্ট পাবে। তুমি তো শুধু তোমার নিজের কথাটাই ভাবো, তাই জানো না তুমি কষ্ট পেলে তোমার আশেপাশের মানুষগুলোও কষ্ট পায়।”

অসম্ভব কান্না পাচ্ছে সাবার। অদ্ভুত ব্যাপার! জীবনে এত কিছু ঘটে গেল। ভাইয়া চলে গেল, বিয়ের কারণে দমবন্ধকর একটা পরিবেশের সৃষ্টি হলো। তবুও কখনো কাঁদতে ইচ্ছা করেনি। অথচ আজ আহ্লাদে বুক ফেটে কান্না পাচ্ছে।

তার জীবনটাকেই কেন এত বিশৃঙ্খলাময় হতে হলো? তার জীবনটা কি আর দশটা মেয়ের মতো স্বাভাবিক হতে পারতো না?

(চলবে)

#লেবু
৪২
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

ফুলে ঘেরা বিশাল এক বাগান। যতদূর চোখ যায় ততদূর পর্যন্ত কেবল ফুল আর ফুল। ফুলগুলোর রং কেবলই গাঢ় নীল আর বেগুনি। ফাঁকে ফাঁকে দুয়েকটা আকাশি ফুলের গাছও রয়েছে। সবগুলো ফুল ঠিক একই আকারের।এই ফুলগুলোর নাম কী কে জানে? নাম যেমন অজানা, ঘ্রাণটাও ঠিক তাই। ফুলের নিজস্ব একটা সৌরভ রয়েছে। এমন ফুলের বাগানে তো সেই সৌরভ ভেসে বেড়ানোর কথা। অথচ কোনো ঘ্রাণই পেলো না সাবা।

একটু একটু করে উঠে বসলো সে। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে কে জানে। বাগানের ঠিক মধ্যখানে প্রকাণ্ড শুভ্র বিছানায় ঘুমিয়ে ছিল সে এতক্ষণ। নিজের অজান্তেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো সাবার। চারদিকে এত ফুল! নিমিষেই মনটা ভালো হয়ে গেল তার।

ব্যস্ত পায়ে সাবা নেমে পড়লো বিছানা থেকে। একরাশ উচ্ছ্বাস নিয়ে ছুটে বেড়ালো বাগান জুড়ে। আকাশি রঙের একটা ফুল ছিঁড়ে গুঁজে রাখলো চুলে। ঠোঁট জুড়ে হাসির ছড়াছড়ি আর হৃদয়জুড়ে। অজানা এক আনন্দের সুর নিয়ে ছুটে বেড়ালো অনেকটা সময়। ক্লান্ত হলো না কিছুতেই।

একটা সময়ে ছুটতে ছুটতেই সাবা খেয়াল করলো বাগানের একপাশে আচমকা আগুন লেগেছে। ভোস ভোস করে কালো ধোঁয়া উড়ছে। আগুনের হাত থেকে ফুলগুলোকে বাঁচানোর জন্যে সাবা সেদিকেই ছুটে যাচ্ছিল। মাঝপথে আবার থেমে গেল হঠাৎ।

এ আগুনের সাধারণ আগুন নয়। সমুদ্রের স্রোতের মতো আগ্রাসী গতিতে আগুনের স্রোত ছুটে আসছে তার দিকে। আগুনের মধ্যে যতগুলো ফুলের গাছ পড়ছে, সবই তাতে ভস্ম হচ্ছে। তবুও খিদে মিটছে না আগুনের, সাবাকে ভস্মের আকাঙ্ক্ষায়।

সাবার হৃদস্পন্দন একলাফে বেড়ে গেল। কিছুক্ষণ ভয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েই রইল ঠিক একটা জায়গায়। যখন মনে হলো জীবনটা নিয়ে এবার ছুটতেই হবে, তখন দ্রুত পা চালালো। উল্টো ঘুরে প্রাণের সবটুকু জোর দিয়ে ছুটতে শুরু করলো।

ছুটতে ছুটতে আচমকা হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল সাবা। ব্যথাও পেল প্রচুর। তবুও তাতে ভ্রুক্ষেপ করার সময় হলো না। তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়িয়ে একবার পেছনে ঘুরে তাকালো। তেজি গতিতে আগুনের স্রোত ক্রমশ ছুটে আসছে তার দিকে। আবারও সবেগে ছুটতে শুরু করলো সাবা।

ছুটতে ছুটতেই হঠাৎ তার চোখে পড়লো বিশাল একটা সোনালি রঙের দরজা। দরজার ওপরে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম কারুকাজ। ওই দরজা পর্যন্ত পৌঁছতে পারলেই নিরাপদ সে। আগুনের আগ্রাসী স্রোত আর তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। প্রাণপণ সেদিকেই ছুটছে সাবা। তবে তার থেকেও ভয়ংকর গতিতে ছুটছে আগুনের ওই স্রোত।

অবশেষে সাবা প্রাণটা নিয়ে ওই দরজা পর্যন্ত পৌঁছতে সক্ষম হলো। দ্রুত গতিতে ভেতরে প্রবেশ করে পুনরায় দরজাটা বন্ধ করে নিলো। চোখ দুটো বুজে হাঁপাচ্ছে সাবা। আরেকটু হলেই জীবনটা কেড়ে নিচ্ছিলো ওই ভয়ংকরী আগুনের স্রোত।

এবার সে চোখটা খুলে নিজের অবস্থান বুঝতে চেষ্টা করলো। এটা কোনো বাগান নয়। বদ্ধ একটা ঘর। ঘরে কোনো আসবাব নেই, ক্ষীণ নীলচে একটা আলো। ঘরটা এতটাই প্রকাণ্ড যে এর একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আরেকপ্রান্তের দেখা মিলছে না।

ছোট ছোট পা ফেলে হাঁটতে শুরু করলো সাবা। সে জানে না পা দুটো তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, তবুও কোথাও তো একটা যেতেই হবে তাকে। আবারও থমকে দাঁড়ালো সাবা। তার চোখ দুটো বড়বড় হয়ে গেল। আত্মা কেঁপে উঠলো আরও একবার।

কাঠের চেয়ারের ওপর দাঁড়িয়ে আছে আহনাফ। হাসিমুখে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে একটা দড়ি বাঁধছে। সাবার হাত-পা প্রবল গতিতে কাঁপছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো ভাইয়ার কর্মকাণ্ড। কিছুই বলতে পারলো না। কিছুই করতে পারলো না। স্বর বেরিয়ে এলো না তার গলা থেকে।

অবশেষে বহুকষ্টে অস্ফুটস্বরে ডাকলো, “ভাইয়া?”

আহনাফ ঘুরে তাকালো সাবার দিকে। তার ঠোঁট জুড়ে হাসির ছড়াছড়ি। বোনের ভীত মুখটাও সেই হাসিতে কোনো ছাপ ফেলতে পারছে না।

আহনাফ হাসিমুখেই বলল, “এতক্ষণে এলি সাবা? যা! তাড়াতাড়ি তোর চেয়ার আর দড়ি নিয়ে আয়।”
আহনাফ আঙুল তাকে করলো ডান দিকে। সেদিকে তাকাতেই আরেকদফা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো সাবার। সারি দিয়ে পরপর অসংখ্য কাঠের চেয়ার। সবগুলোই দেখতে অবিকল একরকম। সবগুলোর ওপরেই একটা করে মোটা দড়ি রাখা।

সাবা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “ভাইয়া তুমি নেমে এসো! প্লিজ এটা কোরো না! প্লিজ ভাইয়া!”

সাবা কাঁদছে। তার চোখ দুটো বেয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরছে আর কণ্ঠে মিনতির সুর। তবুও সেই সুর স্পর্শ করতে পারলো না আহনাফকে।

হালকা ভঙ্গিতে সে বলল, “মৃত্যু তো আমাদের চারপাশে গিজগিজ করছে রে বোকা! সাপের মতো ফণা তুলে আছে। তুই পা বাড়ালেই ছোবল মারবে। মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা থেকে নিজেই মরে যাওয়া ভালো না?”

সিলিং ফ্যানের সঙ্গে বেঁধে রাখা গোলাকার দড়িটা গলায় পড়ে নিলো আহনাফ। বিদ্যুতের গতিতে মাথা নাড়ছে সাবা। তবে ভাইয়াকে আটকাতে পারছে না। ভেতর থেকে কী যেন একটা এসে আটকে দিয়েছে তার সমস্ত শরীর। পাথরের ন্যায় জমে গেছে সাবা।

আহনাফ হাসিমুখে হাত নাড়তে নাড়তে পায়ের নীচ থেকে চেয়ারটা ফেলে দিলো। ভাইয়ার ঝুলে পড়ার দৃশ্যটা দেখতে পারলো না সাবা। তাকে বাঁচানোর তাগিদও অনুভব করলো না। তাকে বাঁচানোর থেকে নিজেকে বাঁচানোটা জরুরি মনে করলো। ওই দৃশ্য দেখলে সে সত্যিই মরে যাবে।

সাবা বিকট শব্দে চিৎকার করে আবারও ঘুরে দাঁড়ালো। ছুটতে ছুটতে আবারও পৌঁছে গেল ওই দরজাটার কাছে। তাকে পালাতে হবে, যে করেই হোক এই মৃত্যুপুরী থেকে পালিয়ে যেতে হবে। ব্যস্ত হাতে দরজাটা খুলতেই আর কিছু দেখলো না সাবা।

অস্পষ্ট এক ছায়া তার সামনে দাঁড়িয়ে। তার হাতে পিস্তল। সাবা কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেই পিস্তল থেকে গুলি বেরিয়ে এসে স্পর্শ করলো তাকে।

চিৎকার করে উঠে বসলো সাবা। মানুষের স্বপ্ন এতটাও ভয়ানক হয়? ভয়ে তার শরীরের প্রতিটি কোষে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। ভয়ে নিজের জামা হাতের মুঠোয় শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছে সে।

সাবার চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেছে শাফকাতের। তাকে বসে থাকতে দেখে তড়িৎ গতিতে উঠে পড়লো নিজেও।

শাফকাত তার মাথায় হাত রেখে বলল, “সাবা! সাবা কী হয়েছে?”

সাবা চোখ তুলে তাকালো শাফকাতের দিকে। কিন্তু কিছুই বলতে পারলো না। গলার স্বরই যেন নিভে গেছে তার। চোখ দুটোতে স্পষ্ট ভয়ের আনাগোনা।

শাফকাত উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “স্বপ্ন দেখেছো?”

সাবা কাঁপতে কাঁপতে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লো। ক্ষণিকের জন্য হলেও মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল শাফকাত। ওই ঘটনার পর মস্তিষ্কে বড় ধরনের শক পেয়েছে সাবা। আগের সেই দৃঢ় ব্যক্তিত্বের মানুষটা সে আর নেই। একটুতেই ভয় পেয়ে অস্থির হয়ে উঠছে। ভয়টা যদিও স্বাভাবিক, তবুও দুশ্চিন্তার শেষ নেই শাফকাতের মাঝে।

শাফকাত বেডসাইড টেবিল থেকে পানির গ্লাস এনে সাবার মুখের সামনে ধরে বলল, “পানিটা খাও।”

সাবা শাফকাতের হাত থেকেই পানি খেলো। তবুও থামলো না তার সর্বাঙ্গের কম্পন। নিঃশ্বাস ফেলতেও প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে তার। দুশ্চিন্তা ক্রমেই বেড়ে গেল শাফকাতের মাঝে। এই পৃথিবীর সমস্ত যন্ত্রণা সহ্য করতে প্রস্তুত সে, সাবাকে কষ্ট পেতে দেখা বাদে।

শাফকাত নরম স্বরে তাকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে বলল, “কিচ্ছু হয়নি। সব ঠিক আছে। এদিকে এসো।”

শাফকাত আলতোভাবে সাবাকে জড়িয়ে ধরলো। তাকে অবাক করে দিয়ে সাবাও জড়িয়ে ধরলো তাকে। এমনটা তো কখনো হয় না। অসুস্থতার দিনগুলোতে সাবাকে ভরসা দেওয়ার জন্যে প্রায়ই শাফকাত জড়িয়ে ধরেছে তাকে। তবে আজই প্রথম সাবাও ধরলো।

শাফকাতের বুকে মুখ লুকিয়েই একটু একটু করে শান্ত হওয়ার চেষ্টা করছে সাবা। তার হৃদয়ের একেকটা স্পন্দন যেন একটু একটু করে শান্তির বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে তার মাঝে।

শাফকাত সাবার চুলের মাঝে হাত বুলিয়ে বলল, “অনেক ভয়ের ছিল স্বপ্নটা?”

সাবা দুর্বলভাবে বলল, “অনেক! আমি…”

মেয়েটার কণ্ঠই স্পষ্ট জানান দিচ্ছে কতটা ভয় পেয়েছে মেয়েটা। কথা বলতেও যেন ভারী কষ্ট হচ্ছে। একেকটা শব্দের পর কয়েক মুহূর্তের জন্যে থামছে সাবা।

শাফকাত তাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে বলল, “থাক, কথা বলতে হবে না। শান্ত হও আগে।”

শাফকাতকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সাবা। চোখ দুটো বন্ধ করে তার বুকের মাঝে মুখ ডুবিয়ে পড়ে রইলো। সাবার ঠোঁটজোড়া অবাধে টিশার্টের ওপর দিয়ে তার বুকে স্পর্শ করছে। শাফকাতের সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল নিমিষেই। কতটা কড়া শাসনের মাঝে যে নিজেকে সামলে নিলো শাফকাত, তা কেবল তারই জানা।

সাবা ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “কিছুক্ষণ এভাবেই থাকি?”

আনমনেই হেসে উঠলো শাফকাত। তৎক্ষণাৎ জবাবও দিতে পারলো না। বিস্ময়ের সঙ্গে বিচিত্র এক ভালো লাগায় গা ভাসালো। যে মেয়েটা তার কাছ থেকে চির তরে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল, সে-ই আজ তার বুকে থাকতে চাইছে। এটা সাবার ব্যর্থতা না হলেও শাফকাতের সাফল্য বটে। একটু হলেও কি তবে মেয়েটার বিশ্বাস অর্জন করতে পারলো সে?

শাফকাত আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “থাকো! কে মানা করেছে? যতক্ষণ খুশি থাকো।”

সাবা কম্পিত গলায় বলল, “আমার খুব ভয় করছে শাফকাত। খুব ভয় করছে।”

ফের ভালো লাগায় গা ভাসালো শাফকাত। মেয়েটা আজই প্রথম তাকে জড়িয়ে ধরলো। আবার আজই প্রথম নাম ধরে ডাকলো তাকে। ঝগড়া করতে করতে হয়ত মাঝে মধ্যে দুয়েকবার পুরো নামে ডেকেছে, কিন্তু এত সুন্দর করে কখনো ডাকেনি।

শাফকাত দৃঢ় কিন্তু নরম স্বরে বলল, “কোনো ভয় নেই তো সাবা। তাকিয়ে দেখো তুমি কোথাও আছো! আমার বুকের মধ্যে। এই মুহূর্তে পৃথিবীতে কার সাধ্য আছে তোমার ক্ষতি করার?”

সাবা এবার মুখ তুলে তাকালো শাফকাতের দিকে। এতক্ষণ খেয়াল করেনি, তার চোখ দুটোতে জল ছলছল করছে। যখন তখন গড়িয়ে পড়বে।

সাবা অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল, “আমি না… আমি না খুব শীঘ্রই মরে যাবো। বেশ বুঝতে পারছি আমি।”

ধ্বক করে কেঁপে উঠলো শাফকাতের বুকের ভেতরটা। সে জানে সাবার কিছুই হবে না। তবুও মেয়েটার মুখ থেকে কথাটা শুনে হৃদয়টা অদ্ভুতভাবে মোচড় দিয়ে উঠলো।

মৃদু ধমকের সুরে শাফকাত বলল, “এসব কী ধরনের কথা সাবা? খবরদার এই কথা আর কখনো বলবে না তুমি।”

সাবা শুনলো না সেই নির্দেশ। নিজের মনে বলেই গেল, “আমি যদি সেদিনই মরে যেতাম, তাহলেই বোধ হয় ভালো হতো। ভয়ে ভয়ে তো আর বেঁচে থাকতে হতো না।”

এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না শাফকাত। ধৈর্য হারিয়ে কঠিন গলায় বলল,

“এই মেয়ে! কথা কানে যায় না তোমার? আর একবার এই কথা বললে এক চড় দিয়ে সবগুলো দাঁত ফেলে দেবো।”

সাবা ভীত-আহত দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিলো শাফকাত। উফ এই রগচটা স্বভাবই একদিন তার কাল হয়ে দাঁড়াবে।

শাফকাত আবারও সাবাকে বুকের মাঝে চেপে ধরে অস্থির কণ্ঠে বলল, “সরি, সরি, সরি! সরি সাবা।”

শাফকাতের হঠাৎ উদয় হয়ে হঠাৎই নিভে যাওয়া রাগে কোনো ভাবান্তর হলো না সাবার মাঝে। কীসের যেন একটা অস্থিরতা এখনো তার মাঝে খেলে বেড়াচ্ছে।

সাবা শাফকাতের বুক থেকে মুখটা তুলে তার দিকে তাকিয়ে ভাঙা ভাঙা গলায় বলল,“আমার স্বপ্নটা খুব ভয়ংকর ছিল জানেন? আমি যেখানেই যাই, সেখানেই মৃত্যু আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছিল। কোনো কারণ ছাড়া এমন স্বপ্ন কেউ দেখে?”

শাফকাত সাবার গালে একটা হাত রেখে শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “কারণ আছে তো। ওই ঘটনায় তুমি অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলে। তোমার অবচেতন মনে এখন শুধুই আতঙ্ক। আমরা তো অবচেতন মনের ভাবনাগুলোকেই স্বপ্নে দেখি। তুমিও তোমার ভয় আর আতঙ্কটাকে স্বপ্নে দেখেছো। এর থেকে বেশি কিছু নয়।”

সাবার চোখ দুটো বেয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। সে জল শাফকাত মুছে দিলেও কোনো লাভ হচ্ছে না। ভয়ের থেকেও তার মধ্যে যে জিনিসটা বেশি দৃশ্যমান, তার নাম কষ্ট।

সাবা অসহায় ভঙ্গিতে বলল, “আপনার কাছে একটা জিনিস চাইতে পারি?”

শাফকাত ক্ষীণ হাসি হেসে বলল, “চেয়েই দেখো!”

সাবা থেমে থেমে বলল, “আপনি তো কত কিছুই করলেন আমার জন্যে। শরীরে দুটো গুলির আঘাতের জন্যে দিনের পর দিন আমার পাশে হসপিটালে কাটালেন। ডক্টর, অপারেশন, ওষুধপত্র, নার্স, টেস্ট – সব মিলিয়ে হুলস্থূল কাণ্ড বাঁধিয়ে দিলেন। কিন্তু আমার আরও একটা আঘাত আছে জানেন? ক্ষতচিহ্নটা আজও শুকিয়ে যায়নি। নতুনের মতো তরতাজা রয়ে গেছে।”

শাফকাত উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “কীসের আঘাত সাবা?”

সাবা অস্থির কণ্ঠে বলল, “আমার মনের আঘাত। দমবন্ধ লাগে আমার প্রতি মুহূর্তে। মনে হয় আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। তবুও কাউকে বুঝতে দিই না আমার ভেতরের যন্ত্রণাগুলোর কথা। আজ আপনাকে সরাসরি বলেই দিলাম। শরীরটাকে যেভাবে একটু একটু করে সারিয়ে তুললেন, মনটাকেও সারিয়ে দেবেন প্লিজ?”

শাফকাত সাবার কপালে চুমু খেয়ে বলল, “অবশ্যই দেবো। আমি না দিলে কে দেবে?”

সাবা একটু বোধ হয় শান্ত হলো। নিজ থেকে থেকেই শাফকাতকে ছেড়ে কেমন জড়োসড়ো হয়ে বসে রইলো।

শাফকাত সাবার লম্বা শার্টের ওপরের
বোতামটা খুলতে খুলতে বলল, “তুমি একটু রিল্যাক্স করো। আমার কোলের ওপরে শুয়ে পড়ো। এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিচ্ছি।”

সাবা বাধ্য মেয়ের মতো তার কোলে মাথা রেখে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে রইলো। শাফকাত শান্ত ভঙ্গিতে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে তার মাথায়। মনটা আর মস্তিষ্ক দুটোই ডুবে আছে সাবার মাঝে। শাফকাত বহু আগে থেকেই জানে, মেয়েটা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। আর দশটা মানুষের মতো স্বাভাবিক সে নয়। ভাইয়ার মৃত্যু তার মাঝে গভীর ট্রমার সৃষ্টি করেছে। যে ট্রমা সে আজও কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

তবুও বাইরে থেকে একটা দম্ভ নিয়ে চলতো সাবা। যে দম্ভ তাকে কারও সামনে নিজের দুর্বলতা প্রকাশে বাঁধা দিতো প্রতিনিয়ত। সাবা কখনো কাউকে মুখ ফুটে বলতে পারেনি তার কষ্টগুলোর কথা, তার মানসিক যন্ত্রণার কথা। আজ পারছে। ভেতরে ভেতরে না জানি কতটা অসহনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ওই কষ্টগুলো।

শাফকাত নীরবতা ভঙ্গ করে শান্ত গলায় বলল, “কীসের এত যন্ত্রণা তোমার সাবা?”

সাবা বিড়বিড় করে বলল, “আমি নিজেকে বুঝতে পারি না। মানুষ যখন নিজেকে নিজেই বুঝতে পারে না, তখন তার থেকে বড় অসহায় আর কেউ হয় না।”

“নিজেকে বুঝতে না পারার কী হলো?”

“জানি না তো! আমার এই মনে হয়…”

মনের কথাটা মনেই রয়ে গেল। সাবা বলতে চেয়েছিল, “এই মনে হয় আপনাকে ভালোবাসি এই মনে হয় বাসি না।”

বলতে পারলো না। শাফকাতের কোল থেকে মাথা তুলে তার মুখোমুখি বসলো সাবা।

কম্পিত গলায় বলল, “এই মনে হয় আমি এই বাড়িটাতে থেকে যেতে চাই। আবার এই মনে এখান থেকে ছুটে পালিয়ে যাই। এই মনে হয় সব ভুলে আবার আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে যায়। এই মনে হয় যন্ত্রণার জীবনটাকেই আপন করে নিই। সমস্যা কী আমার?”

সাবা কাঁদছে। এক হাতে মাথার চুল মুঠো করে খামচে ধরে কাঁদছে। কান্নায় তার সারা শরীর কেঁপে উঠছে।

দৃশ্যটা গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করলো শাফকাতের হৃদয়ে। মেয়েটা এভাবে কষ্ট পাচ্ছে! কিংবা বলা ভালো, এভাবে কষ্ট পেয়ে আসছে এতগুলো দিন ধরে?

শাফকাত সাবার কাঁধে হাত রেখে বলল, “সাবা! পাগলামি করে না সাবা। শান্ত হও।”

সাবা কাঁদতে কাঁদতে বলল, “শুনুন না প্লিজ! আমার কথাগুলো কেউ শোনে না। কাউকে বলতেই পারি না। আজ সাহস করে আপনাকে বলছি। আপনিও শুনবেন না?”

শাফকাতের হৃদয়টা এবার স্পন্দিত হতে যেন ভুলে গেল। একটা মানুষ ভেতরে ভেতরে কতটা অসহায় হলে কেবল তার কথা শোনার জন্যে কাউকে এভাবে অনুরোধ করতে পারে?

শাফকাত সাবার চোখের জল মুছে দিয়ে ভরসামাখা গলায় বলল, “শুনবো তো। অবশ্যই শুনবো। বলো, শান্ত হয়ে বলো।”

সাবা অশান্ত স্বরেই বলল, “আমি নিজেকে খুব ঘৃণা করি জানেন? খুব! আমার কাছের মানুষগুলোকে আমি প্রতিনিয়ত হতাশ করে চলছি। আমার ভাইয়া… ভাইয়া চোখের সামনে মারা গেল। ওর মৃত্যু যদি স্বাভাবিকভাবে হতো তাহলে হয়ত এতটা ভেঙে পড়তাম না কিন্তু…”

সাবা বলতে পারলো না কিছুই। চোখ দুটো বেয়ে অঝোরে জল গড়িয়ে পড়ছে। চোখের সামনে ভেসে উঠলো সিলিং ফ্যানের সঙ্গে আহনাফের ঝুলন্ত দেহটা। আবারও দুহাতে মাথার চুল চেপে ধরলো সাবা। অসহ্য লাগছে তার, এই মুহূর্তে অসহ্য লাগছে জীবনটাকে।

সাবা বিলাপের সুরে বলল, “ওর তো চলে যাওয়ার কথা ছিল না। একটা মানুষ অন্যায়ভাবে ওকে ফাঁসিয়ে চলে যেতে বাধ্য করলো! আর আমি কী করলাম? হাত গুটিয়ে বসে থাকলাম। যার কারণে ভাইয়া আজ পৃথিবীতে নেই, সেই মেয়েটা এখনো ওপেনলি ঘোরাফেরা করছে। অথচ আমি কিছুই করতে পারছি না।”

শাফকাত অবাক চোখে দেখছে সাবাকে। সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা তো হারিয়ে ফেলেছে বহু আগেই। এই তাহলে প্রকৃত সাবা? কাঠিন্যের চাদরে এই মানুষটাকেই আড়াল করে রেখেছিল সে এতদিন? যে কাঁদতে জানে, যার মনের মাঝে কষ্টের শেষ নেই।

সাবা আক্ষেপের সুরে বলল, “আমি আমার ভাইয়াকে হতাশ করলাম। বাবা-মাকে হতাশ করলাম। বিয়ে করে এ বাড়িতে এসে শাশুড়িকে হতাশ করলাম। উনি কি কোনোদিনও আমার মতো ছেলেদের বউ চেয়েছিলেন। যে মেয়েটা তার ছেলেকে রেসপেক্টই করতে জানে না!”

শাফকাত এক নিঃশ্বাসে বলল, “সাবা তোমাকে এসব নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।”

সাবা আঁতকে উঠে বলল, “না আপনি আমার কথা শুনুন!”

এই প্রথম মনের গভীরতম স্তরে জমিয়ে রাখা কথাগুলো কাউকে বলছে। বারবার মনে হচ্ছে, এই কথা শাফকাতের কর্ণকুহরে না পৌঁছালে যেন অতল গহ্বরে তলিয়ে যাবে সে। শাফকাতও তাকে বলার সুযোগ করে দিয়ে চুপ করে রইলো।

সাবা অনুতপ্ত গলায় বলল, “আমি আপনাকেও হতাশ করেছি। শুরু থেকেই আমি আপনার সাথে মানিয়ে চলার চেষ্টা করিনি। আপনাকে বোঝার চেষ্টা করিনি। আপনার স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও আপনার কাছ থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। ওই দুটো বুলেট আমার চোখ খুলে দিয়েছে জানেন? আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে যে… That’s what I deserved!”

শাফকাত গম্ভীর গলায় বলল, “শেষ কথা? আর কিছু বলবে?”

সাবা অসহায় গলায় বলল, “আপনি আমাকে খুব ঘৃণা করেন না?”

শাফকাত তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “ঘৃণা!”

মানুষ যাকে নিজের চাইতেও বেশি ভালোবাসে, যাকে কেন্দ্র করে তার পুরো পৃথিবীটা ঘোরে – তাকেই ঘৃণা করে কী করে?
শাফকাতের জানা নেই।

মনের কথাটা মনেই চেপে রেখে শাফকাত বলল, “কেন মনে হলো আমি তোমাকে ঘৃণা করি?”

সাবা আহত গলায় বলল, “না হলে ডিভোর্স দিচ্ছেন কেন? যে মেয়েটা বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার দুঃসাহস দেখায় তার সঙ্গে নিশ্চয়ই সংসার করা যায় না।”

শাফকাত দুহাতে সাবার দুচোখের জল মুছে দিয়ে বলল, “নিজের ঘাড়ে সব দোষ নিলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়? আহনাফের মৃত্যুর জন্যে যে মেয়েটা দায়ী, তাকে খোঁজার দায়িত্ব তোমার একার?”

“কর্তব্য তো! ভাইয়া আমাকে কত ভালোবাসতো। অথচ ওর মরে যেতে যে মেয়েটা বাধ্য করলো তাকে আমি খুঁজে বের করতে পারলাম না। শাস্তির মুখোমুখি করতে পারলাম না। কেমন বোন আমি?”

“খুঁজে পাওনি কারণ খোঁজার চেষ্টাই কখনো করোনি। এটা নিয়ে কোনো অপরাধবোধে ভুগবে না সাবা। ডিভোর্স হোক আর যাই হোক, আমি কথা দিচ্ছি ওই মেয়েটাকে খুঁজে বের করতে তোমাকে সব ধরনের সাহায্য করবো।”

সাবা বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলো শাফকাতের দিকে। ইতিকে খুঁজে বের করতে শাফকাত তাকে সাহায্য করবে? আসলেই?

শাফকাত আবারও দৃঢ় ভঙ্গিতে বলল, “তুমি কাউকে হতাশ করোনি সাবা। মা বুঝতে পারে তুমি কতটা ডিপ্রেসড। তোমার বাবা-মাও জানে। আর তুমি কখনো আমাকে ডিসরেসপেক্ট করোনি সাবা। হ্যাঁ, দুয়েকবার ঝগড়া করেছো হয়ত। কিন্তু সেটাও আমার কারণে।

তুমি আমাকে বুঝতে পারোনি কারণ আমি তোমাকে সেই সুযোগ দিইনি। তুমি আমার সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারোনি কারণ আমার বিহেভিয়ার তোমাকে সেই সুযোগ দেয়নি।”

শাফকাতের কাছে আজ যেমন নতুন এক সাবা প্রকাশ পেয়েছে, সাবার কাছেও যেন নতুন এক শাফায়েত প্রকাশ পেলো। এই মানুষটার মধ্যে তো কোনো ডমিনেন্সের ভাব-লক্ষণ নেই। এই শাফকাত তাকে বুঝতে পারে, তার ভয়গুলোকে নিমিষেই দূর করে দিতে পারে, তাকে ভালো থাকার আশ্বাস দিতে পারে।

শাফকাত নরম স্বরে বলল, “হ্যাঁ পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তুমি ভুল করেছো। কিন্তু তার মানে এই না যে তোমার সাথে যা হয়েছে তা তোমার প্রাপ্য ছিল। You never deserved it. নিজেকে ঘৃণা করাটা বন্ধ করো সাবা। নিজেও জানো না কত ভালো একটা মেয়ে তুমি।”

সাবার নিজের প্রতি ঘৃণা কমলো তো না-ই, একটু যেন বেড়ে গেল। এই মানুষটাকে কেন বুঝতে চেষ্টা করলো না সে? এই মানুষটাকে ভালোবাসতে গিয়েও কেন ভালোবাসলো না সে? শাফকাত তো আগেও একবার তাকে কষ্টগুলো দূরে ঠেলে বেঁচে থাকতে শিখিয়েছিল। তবুও কেন মানুষটাকে ভুল বুঝে এত বড় অন্যায় করলো সে?

শাফকাত সাবার এলোমেলো চুলগুলোকে কানের পেছনে গুঁজে দিতে দিতে বলল, “আর ভয় পাবে?”

সাবা না-সূচক মাথা নাড়লো।

“আর কষ্ট পাবে?”

আবারও না-সূচক মাথা নাড়ালো।

“তাহলে শুয়ে পড়ো। অনেক রাত হয়ে গেছে।”

শাফকাতের বুকে মাথা রেখেই শুয়ে পড়লো সাবা। শাফকাতও শক্ত করে ধরে রেখেছে তাকে। একবিন্দু ছেড়ে দিলেও যেন দূর রাজ্যে হারিয়ে যাবে মেয়েটা।

সাবার চোখে একটু একটু করে ঘুম নেমেই আসছিল আবার। আচমকা চেতনা সজাগ হলো শাফকাতের একটা কথায়।

“সাবা শোনো! আমি তোমাকে ঘৃণা করি না। আমার এত ক্ষমতা! তবুও তোমাকে ঘৃণা করার মতো এই সামান্য ক্ষমতাটুকু আমার নেই।”

সাবা শীতল গলায় বলল, “তাও তো ডিভোর্স দিচ্ছেন।”

শাফকাত গম্ভীর গলায় বলল, “হুঁ, দিচ্ছি। তোমার ভালোর জন্যেই।”

সাবা চাপা কৌতূহল নিয়ে বলল, “ডিভোর্সে আমার ভালো হবে? কী করে?”

“এত কথা এখন মাথায় ঢুকবে না। ঘুমাও তো।”

বেশি কিছু ভাবতেও গেল না সাবা। শাফকাতের বুকে মাথা রেখে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেল। বহুদিন পর আজ কোনো অনুতাপ, কোনো হতাশা, চাপা কোনো দীর্ঘশ্বাস ছাড়াই ঘুমিয়ে পড়লো সে। আজ থেকে আর প্রকৃত নিজেকে নিজের কাছে বন্দী রাখতে হবে না। ভালো থাকার মিথ্যা অভিনয়ও করতে হবে না। আসল সাবাকে তো আজ দেখেই নিলো শাফকাত।

(চলবে)