লেবু পর্ব-৪৬+৪৭+৪৮

0
1

#লেবু
৪৬
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

[সতর্কতা : আজকের পর্বটিতে রোম্যান্টিসিজম আছে। শুধুমাত্র প্রাপ্তমনষ্করাই পড়বেন। হ্যাপি রিডিং!]

আরো মাস দুয়েক লাগলো সাবার পুরোপুরি সুস্থ হতে। এই দুটো মাসও তাকে কাটাতে হলো কড়া নিয়মের মাঝে। সময়মতো ঘুম থেকে ওঠা, সময়মতো ঘুমাতে যাওয়া। ডক্টরের পরামর্শের বাইরে কোনো খাবার না খাওয়া। দুই সপ্তাহ পর পর চেকআপে যাওয়া। আর শাফকাতের বুকে লেপ্টে ঘুমিয়ে থাকা। এভাবেই চলছিল জীবনটা।

গত সপ্তাহে ডক্টর আফরোজা অপ্রত্যাশিতভাবে ঘোষণা করলেন সাবা এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। চাইলেই পূর্বের ন্যায় সাধারণ জীবনে সে ফিরে যেতে পারে।

সেদিন হসপিটাল থেকে ফেরার সময়ে গাড়িতে বসে সাবা কোমল গলায় ডাকলো, “শাফকাত?”

শাফকাত ড্রাইভ করতে করতে একবার তার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আবারও সামনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, “বলো।”

সাবা ইতস্তত করে বলল, “আমি যদি আবারও চাকরিতে জয়েন করতে চাই, আপনার কি তাতে কোনো আপত্তি থাকবে?”

শাফকাত ভ্রু কুঁচকে কিন্তু ঠোঁটে সূক্ষ্ম হাসি হেসে বলল, “তোমার কাজ নিয়ে কোনো দিন আমার কোনো আপত্তি ছিল?”

সাবা থতোমতো খেয়ে বলল, “না মানে…”

শাফকাত তাকে কোনোকিছু বলার সুযোগ না দিয়ে একহাত দিয়ে আলতোভাবে তার চোখের সামনে পড়ে থাকা কয়েকটা চুল কানের পেছনে গুঁজে দিলো। তার এতটুকু কাণ্ডেই শিউরে উঠলো সাবা। দম বন্ধ হয়ে এলো রীতিমত। অস্বস্তিতে নয়, ভালোলাগায়। শাফকাতের এই স্পর্শগুলো আজকাল বড্ড বিরক্ত করে। বরফের ন্যায় জমিয়ে দেয় তার স্বাভাবিক-সচল হৃৎপিণ্ডকে।

সাবাকে দ্রুত স্বাভাবিকতায় ফিরিয়ে এনে শাফকাত স্পষ্ট গলায় বলল, “তোমাকে কতবার বলেছি? আগে যেমন ছিলে ঠিক তেমনটাই থাকবে। জীবনটা তোমার, ডিসিশনগুলোও তুমিই নেবে। আর কারও অনুমতি চাওয়ার কোনো দরকার নেই।”

মনে মনে অবাক না হয়ে পারলো না সাবা। কোথায় গেল সেই কন্ট্রোল-ফ্রিক শাফকাত আলম? যে সাবার প্রতিটা সিদ্ধান্তে নিজের প্রভাব খাটিতে আনন্দ পায়!

সেদিন আরও একটা উপলব্ধি আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে ধরলো সাবাকে। শাফকাত তার খুঁটিনাটি যেকোনো সিদ্ধান্তেই নিজের মতামত জোর করে চাপিয়ে দিতে চাইতো না। বরং সাবার যেসব সিদ্ধান্ত তার কাছে ভুল বলে মনে হয়েছে, যেসব কর্মকাণ্ডে সে সাবার ক্ষতির আশঙ্কা করেছে, সেসব ক্ষেত্রেই কেবল তার ওই কন্ট্রোল-ফ্রিক রূপটা প্রযোজ্য।

সাবার মনে ভেসে উঠলো শাফকাতের সেদিনের সেই প্রশ্নটা, “তোমার মনে একবারও প্রশ্ন জাগেনি আমি কেন এসব করি? আমি কেন প্রতিনিয়ত তোমাকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করি?”

আসলেই কোনোদিন সাবা ভেবে দেখেনি, কেন শাফকাত তার ওপর এতটা ডমিনেন্ট। সেই শুরু থেকে কেবল এই একটা অভিযোগই করে এসেছে তাকে নিয়ে। বুঝতে চেষ্টা করেনি। আজ বুঝতেই সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ধারণা জন্মে গেল তার প্রতি। যে ধারণায় কোনো রাগ নেই, বিরক্তি নেই। আছে কেবলই ভালোলাগা।

সাংবাদিকতায় ফেরার প্রক্রিয়াটা খুব একটা কঠিন হলো না সাবার জন্যে। পুরোনো বস আফসানা করিমকে একটা ফোন কল করতেই, তিনি একগাল হেসে বললেন, “এত ফর্মালিটির কী আছে সাবা? আমি তো আগেই বলেছিলাম বাংলার বাতাসের দরজা সবসময় তোমার জন্যে খোলা। You were born to be a journalist!”

সাবা সাংবাদিক হওয়ার জন্যেই জন্মেছিল কিনা সে জানে না। তবে সেই উনিশ বছর বয়স থেকে এটাই তার ধ্যানজ্ঞান। সাবা কখনোই জনপ্রিয়তার জন্যে এই পেশাকে বেছে নেয়নি। সে চায়নি, লোকে রিপোর্টে তার কণ্ঠ শুনেই তাকে চিনে ফেলে। চায়নি, তার একেকটা রিপোর্ট আলোড়ন সৃষ্টি করে তুলুক সোশ্যাল মিডিয়ায়। সে শুধু চেয়েছে, মানুষের কাছে সত্যকে তুলে ধরতে। অন্যান্য কতিপয় সাংবাদিকদের মতো জনসাধারণকে মিথ্যার ধোঁয়াশায় রাখার বিরুদ্ধে ছিল সে চিরকাল।

না চাইতেও জনপ্রিয়তা তাকে ঘিরে ধরেছে। গত চার মাস বাংলার বাতাসের সোশ্যাল মিডিয়ায় অসংখ্য দর্শক তার খোঁজ করেছে। কেউ নাম ধরে খোঁজ করেছে। কেউ আবার জিজ্ঞেস করেছে, “ওই স্পষ্টবাদী, সাহসী মেয়েটা কোথায় গেল?”

অফিসে জয়েন করার আগের দিনগুলো সাবা কাটালো গত কয়েক মাসে দেশে-বিদেশে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো নিয়ে গবেষণা করে। তখনই জানতে পারলো ফাহিমের বিষয়ে। এই কয়েকদিনে বাড়ির কাউকে ফাহিমের ব্যাপারে কিছুই জিজ্ঞেস করেনি সে। তাকে কেউ কিছু বলেওনি।

সাবা ভেবেছিল ফাহিম হয়ত ধরা পড়েনি। সে কারণেই তার নিউজটা দেখে পিলে চমকে উঠলো। ফাহিমকে গত মাসে কোর্টে তোলা হয়েছে। ধরা সে আগেই পড়েছিল। তবে দু মাস তার কাটে হসপিটালে। কেন হসপিটালে ছিল এ নিয়ে কোনো তথ্য নেই।

সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে – সাবাকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় যেখান থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল, ঠিক সেই একই জায়গা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ফাহিমকে। তার গায়েও ছিল গুলি। মানুষের এমনটা মনে করার কারণ, ফাহিমকে যেদিন কোর্টে তোলা হয় সেদিন সে ছিল উইল চেয়ারে। ধারণা করা হচ্ছে, তার পায়ে গুলি করা হয়েছিল বলেই হাঁটার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে সে।

পুরো ব্যাপারটাকেই অত্যন্ত নাটকীয় বলে মনে হলো সাবার কাছে। গুজব ভেবে তাই উড়িয়েই দিলো। এসব নিয়ে আর সে ভাববে না! শাফকাতের সঙ্গে এ নিয়ে আলাপ করতে গেলে সে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে, “ধরা যখন পড়েছে তখন আইন অনুযায়ীই শাস্তি পাবে। তোমাকে এসব নয় চিন্তা করে আর শরীর খারাপ করতে হবে না। তবে নিশ্চিন্ত থাক, ছেলেটা শাস্তি পাবেই!”

সাবার অফিসে ফিরে আসা নিয়ে কলিগদের একাংশের বিরক্তির শেষ নেই। যদিও বিরক্তিটা তারা চোখে মুখে প্রকাশ করছে না। তবুও বুঝতে পারে সাবা। এমনিতেই এরা শুরু থেকে সাবার সফলতায় ঈর্ষান্বিত ছিল। এডিটর ম্যাডাম যেকোনো পরিস্থিতিতে উদাহরণ হিসেবে তাকে টেনে আনেন। তার মতো করে রিপোর্ট করতে বলেন। বয়সে ছোট একটা মেয়েকে আদর্শ হিসেবে মানতে বেশির ভাগ সিনিয়র সাংবাদিকই ছিলেন নারাজ। সাবার অকস্মাৎ চাকরি ছেড়ে চলে যাওয়ায় এই মানুষগুলো যেন হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিলেন।

অফিসের একাংশ আবার আড়ালে আবডালে তাকে নিয়ে ফিসফাস শুরু করলো। সাবা কেন বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল? যে ছেলেটা তাকে গুলি করলো, তার সঙ্গে সাবার সম্পর্ক কী? – এসবই ফিসফাসের মূল বিষয়।

সাবা এসব নিয়েও মাথা ঘামাল না। এ জীবনের সব থেকে বড় ভুলটা সে করেছে। সেই ভুলের জন্যে কাছের মানুষগুলোর তাকে বুঝেছে, ক্ষমা করে দিয়েছে। দূরের মানুষেরা কী ভাবলো কিংবা ভাবলো না, তাতে অযথা দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়ার কোনো মানে হয় না।

অফিসে জয়েন করতেই সাবা তার প্রথম রিপোর্ট নিয়ে দৌড়ঝাঁপে নেমে পড়লো। রাজধানীর বেশ কয়েকটা এলাকায় দিন দিন বেনামি কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত বেড়েই চলেছে। যদিও এদের বেশির ভাগ সদস্যের দেখলে কিশোর মনে হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

আবাসিক এলাকা জুড়ে এদের আধিপত্য। দিনের বেলা এরা জোট বেঁধে রাস্তায় ধারে দাঁড়িয়ে ইভটিজিং করে, আর রাতে নেশা করে চুরি-ছিনতাই। কিছু কিছু অসৎ বাড়িওয়ালার নির্দেশে এরা ছোটখাটো কারণেই ভাড়াটিয়াদের ঘর ছাড়া করে রাস্তায় নামিয়ে দেয়। মূলত এসব প্রভাবশালী বাড়িওয়ালারা একত্রিত হয়েই এদের এতটা সাহস দিয়ে আসছে।

সাবা আজ তার টিম নিয়ে অনুসন্ধানে বের হলো। দিনভর কতগুলো আবাসিক এলাকা ঘুরে ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলল। গাড়ি থেকে গোপনে এসব গ্যাংয়ের সদস্যদের কার্যকলাপ ক্যামেরায় ধারণ করে আনল।

অফিসে ফিরে আজ সংগ্রহ করা সবগুলো তথ্য পরপর সাজিয়ে রিপোর্ট লিখতে বসে গেল সাবা। এই কাজটা আজ না করলেও হতো। তবে অনুসন্ধানের সাথে সাথে রিপোর্ট লেখাটাই তার অভ্যাস। নিজ চোখে যা দেখে এসেছে, মস্তিষ্কে তা তাজা থাকতে থাকতেই রিপোর্টে তুলে ধরতে এই ব্যবস্থা।

কাজের ফাঁকে নিজের প্রতি সুপ্ত একটা গর্ববোধ কাজ করলো সাবার। সে ভেবেছিল, প্রথম কয়েকটি দিন কাজের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে বেশ অসুবিধা হবে। তবে আজ অসুবিধার লেশমাত্র টের পেলো না সে। এতগুলো দিন কাজ থেকে দূরে থাকার পরও সাংবাদিকতা তাহলে সে ভুলে যায়নি সাবা আমির।

গভীর মনোযোগ দিয়ে ল্যাপটপে রিপোর্টের বাকি অংশ টাইপ করছে সাবা। আচমকা তার মনোযোগ কেড়ে নিলো মোবাইলে নোটিফিকেশনের শব্দ। বিরক্তিতে গা জ্বলে উঠলো সাবার। কেন যে মোবাইলটা সাইলেন্ট করে কাজে বসেনি সে!

অনিচ্ছা সত্ত্বেও মোবাইল স্ক্রিনের দিকে তাকালো সাবা এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কেটে গেল তার সকল বিরক্তি। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো মিষ্টি একটা হাসি।

শাফকাত ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। এর আগে তাদের মধ্যে কখনো ম্যাসেজ আদান-প্রদান হয়েছে কিনা মনে করতে পারলো না সাবা। হলেও সেই ম্যাসেজ এতটা প্রশান্তিদায়ক হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

শাফকাত লিখেছে, “আজ কি কাজ শেষ হবে আপনার?”

সাবা হাসিমুখে টাইপ করলো, “হবে তো। আপনি চলে আসতে আসতেই শেষ হবে।”

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে রিপ্লাই এলো অপরপ্রান্ত থেকে, “সেই কখন থেকে এসে বসে আছি। আপনার দেখা পেলে হয়!”

চমকে উঠে মোবাইল স্ক্রিনের উপরিভাগে ভেসে ওঠা সময়ের দিকে তাকালো সাবা। ৭ টা ২৪ বাজছে। অথচ সে শাফকাত বলেছিল ঠিক ৭ টায় তাকে নিতে আসতে। কাজে এতটাই ডুবে গিয়েছিল সাবা, যে সময় কখন পেরিয়ে গেছে।

সাবা তড়িঘড়ি করে টাইপ করলো, “সরি, সরি। আমি এক্ষুনি নামছি।”

“তাড়াহুড়ো করতে হবে না। কাজ শেষ করে নামো।”

কাজ শেষ করতে গেলে রাত দশটা বেজে যাবে। সাবা কোনমতে ল্যাপটপটা বন্ধ করে, হ্যান্ডব্যাগটা নিয়ে নেমে এলো। গ্যারেজে পা রাখতেই দেখা মিলল শাফকাতের। আয়েশি ভঙ্গিতে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি তার আবদ্ধ মোবাইলের ওপর। অফিসের গ্যারেজে এমনিতেই আলোর স্বল্পতা। তবুও শাফকাতের ফোনের আলো তার মুখের ওপরে এসে পড়ায় মুখটা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে সাবা।

মুহূর্তেই মুগ্ধতা ছড়িয়ে গেল তার সর্বাঙ্গে। পুরুষ মানুষ এতটা আকর্ষণীয় হবে কেন? তার খয়েরি স্যুট সাদা শার্ট আর কালো জিন্স, পরিপাটি চুল, খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি আর নেশালো চোখ দুটো একটু একটু করে এলোমেলো করে দিচ্ছে সাবাকে। দুপায়ে দাঁড়িয়ে থাকতেও যেন কষ্ট হচ্ছে তার।

সাবার মুখ থেকে টু শব্দ পর্যন্ত বের হয়নি। তবুও কীভাবে যেন তার উপস্থিতি টের পেয়ে গেল শাফকাত। মোবাইল থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সরাসরি তাকালো তার দিকে। সাবা থতোমতো খেয়ে মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে এগিয়ে গেলো তার দিকে।

বহুদিন পর আজ সাবাকে ফরমাল সাজে দেখছে শাফকাত। কালো লেডিস কোট আর প্যান্ট, সাদা শার্ট, হালকা লাল লিপস্টিক – মনে হলো যেন সেই পুরোনো সাবাকে দেখছে সে। এক্ষুনি গাড়িতে উঠে ঝগড়ায় মেতে উঠবে তার সঙ্গে। তবে সাবা সেসবের কিছুই করলো না।

ভদ্র মেয়ের মতো তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “অনেকক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখলাম না?”

সাবার এই ভদ্রতা শাফকাতের মধ্যকার অভদ্রতার স্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়ে দিলো। হুট করে তার দৃঢ় হাতে সাবার কোমর ছুঁয়ে তাকে নিজের বুকের মাঝে এনে ফেলল।

শাফকাত অন্যরকম গলায় বলল, “হ্যাঁ! এখন শাস্তি পাওয়ার জন্য তৈরি হও।”

শাফকাত ঘোরলাগা দৃষ্টিতে কতক্ষণ তাকিয়ে রইলো সাবার লিপস্টিকে রাঙা ঠোঁটজোড়ার দিকে। একটু একটু করে সেদিকেই অগ্রসর হচ্ছে সে।

সাবা চোখ বড় বড় করে বলল, “কী করছেন? কেউ দেখে ফেলবে তো!”

শাফকাত পাত্তা না দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “দেখুক! কী শর্তে রাজি হয়েছিল মনে নেই?”

শাফকাত আবারও অগ্রসর হলো সাবার ঠোঁটের দিকে।

সাবা খিলখিল করে হেসে উঠে শাফকাতের বুকে হাত রেখে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আছে তো। কিন্তু এখানে না, প্লিজ।”

শাফকাত সাবাকে ছেড়ে থমথমে গলায় বলল, “তোমার মতো নিরামিষকে আমিষ বানাতে যে কয় হাজার বছর লাগে কে জানে!”

সাবার মোটেও রাগ হলো না। খিলখিল করে হেসেই প্যাসেঞ্জার সিটে বসে পড়লো সে। সারা পথে থমথমে ভাবটা ধরে রাখলো শাফকাত। সাবা এটা ওটা বলে তাকে হাসানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো।

বাড়ি ফিরেই তারা ঘরে পা ফ্রেশ হওয়ার জন্যে। তবে সেই সুযোগ আর পেলো কই সাবা? তার আগেই হাতটা ধরে তাকে আটকে দিলো শাফকাত।

সাবাকে নিজের খুব কাছাকাছি এনে তার কানে মুখ ডুবিয়ে বলল, “এখন?”

মুহূর্তেই বেড়ে গেল সাবার হৃৎস্পন্দন। নিঃশ্বাস আটকে গেল। ভয়ে নয়, ভালো লাগায়।

সাবা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “কী এখন?”

শাফকাত সাবার কানের লতিতে চুমু খেয়ে বলল, “এখন তোমাকে কে বাঁচাবে?”

সাবা লজ্জায় লাল হয়ে কম্পিত গলায় বলল, “কাউকে বাঁচাতে হবেই বা কেন?”

শাফকাত ভ্রু ওপরে তুলে বিস্ময়ে কয়েক পলক তাকালো সাবার লজ্জায় লাল হওয়া গাল দুটো দেখে। শাফকাতের চোখ দুটো দুষ্টুমিরা লুকোচুরি খেলে বেড়াচ্ছে। দুষ্টুমি পুরোপুরি ভর করেছে তার মাঝে। নিজের মধ্যে আর নেই শাফকাত এ মুহূর্তে।

সাবার দু কাধে হাত রেখে তাকে এক পা এক পা পিছিয়ে একদম বিছানার কাছে নিয়ে গেল শাফকাত। সাবার একেবারে কাছাকাছি এসে গেছে সে। দুজনের নিঃশ্বাস মিলে মিশে একাকার।

সাবা নিঃশ্বাস আটকে রেখে বলল, “কী করছেন?”

সাবা হয়ত আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে তার ঠোঁটে আঙুল রেখে শাফকাত ফিসফিস করে বলল, “এত কথা বললে দেখবে কীভাবে?”

সাবা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার কানের নিচ দিয়ে চুলের মাঝে হাত রেখে শাফকাত তার ঠোঁটে ঠোঁট মিশিয়ে দিলো। এমনভাবে সাবাকে সে চুমু খাচ্ছে যেন যেকোনো মুহূর্তে গভীর সমুদ্রে তলিয়ে যাচ্ছে সে আর সাবা তার একমাত্র ছোট্ট একখণ্ড কোনো বস্তু যাকে প্রাণপণ আঁকড়ে ধরে টিকে আছে সে। সাবার হৃৎস্পন্দন এতটাই বেড়ে গেছে, যেন নিজেই শুনতে পাচ্ছে নিজের বাড়ন্ত হৃদয়ের ধ্বনি।

চুমু খেতে খেতেই সাবাকে বিছানায় শুইয়ে দিলো শাফকাত। কিছুক্ষণের জন্যে ছাড়লো ঠোঁট দুটো, স্যুটটা খুলে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলার জন্য। তবে এক মুহূর্তের জন্যও দৃষ্টি সরাতে পারলো না সাবার ওপর থেকে। তার অবাধ্য ঠোঁট দুটো এলোমেলো করে দিয়েছে সাবার লিপস্টিক। লাল লিপস্টিক ছড়িয়ে গেছে তার ঠোঁটের আশেপাশে। ঠোঁটজোড়া সামান্য ফাঁক করে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে সাবা। এই দৃশ্য শাফকাতের বিগড়ে যাওয়া মস্তিষ্ককে আরেকটু বিগড়ে দিলো।

সাবার ওপর ঝুঁকে পড়ে সে আবারও ব্যস্ত হয়ে গেল তার ঠোঁট দুটো নিয়ে। সাবা উষ্ণ সুখে অতিষ্ঠ হয়ে হাত ডুবিয়ে দিলো শাফকাতের চুলের মাঝে। তার এতটুকু সাড়ায় আরেকদফা পাগল হয়ে গেল শাফকাত। সাবার ঠোঁট ছেড়ে মুখ ডুবিয়ে দিলো সাবার ঘাড়ে, গলায়। সাবার মনে হলো যেন এই মুহূর্তে মূর্ছা যাবে সে। শক্ত করে খামচে ধরলো শাফকাতের শার্ট।

তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে শাফকাত সাবার শার্টের ওপরের দুটো বোতাম খুলে ফেলল। চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিলো গলার নিচটা। চোখ দুটো বুজে শাফকাতের অবাধ্য আদরে ভাসছে সাবা।

আচমকা দুজনকে বিরক্ত করে দিয়ে দরজায় টোকা পড়লো। বাইরে থেকে ভেসে এলো শামার কণ্ঠ, “তোমরা খেতে এসো! মা ডাকছে তো!”

সাবার গলা থেকে মুখ তুলে বিরক্ত দৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকালো শাফকাত। সাবা কোন মতে নিজেকে সামলে নিয়ে কণ্ঠস্বর প্রাণপণ স্বাভাবিক করে উঁচু স্বরে বলল, “আসছি শামা।”

ঘরের ভেতর থেকেই শামার ফিরে যাওয়ার শব্দ পাওয়া গেল। সাবার চোখ দুটো ফিরে গেল শাফকাতের দিকে। তার বিরক্ত চোখ দুটো দেখে খিলখিল করে হেসে উঠলো সাবা।

শাফকাত গম্ভীর গলায় বলল, “খুব খুশি হয়েছ না?”

সাবা হাসতে হাসতেই বলল, “মারাত্মক!”

শাফকাত ভ্রু কুঁচকে বলল, “হুম! যেভাবে আমার শার্ট খামচে ধরেছিলে, বোঝাই যাচ্ছে কতটা খুশি হয়েছ।”

সাবা লজ্জা পেয়ে বলল, “সরুন তো। ফ্রেশ হবো।”

“না, ছাড়বো না।”

“শাফকাত! দেরি করলে মা কী ভাববে?”

“যা খুশি তাই ভাবুক। তোমার সঙ্গে আমার বোঝা পড়া আছে। আগে সেটা সারতে দাও।”

সাবা অবাক গলায় বলল, “কীসের বোঝা পড়া?”

শাফকাত সাবার চোখের সামনে পড়ে থাকা কতগুলো চুল কানে পেছনে গুঁজে দিয়ে বলল, “এই যে তুমি এতটা নিরামিষ…”

সাবা হাসিমুখে কিন্তু প্রতিবাদী সুরে বলল, “আমি মোটেও নিরামিষ না।”

শাফকাত তীক্ষ্ম সুরে কিন্তু নরম গলায় বলল, “অযথা চেঁচামেচি করবে না। অবশ্যই তুমি নিরামিষ। নিরামিষ না হলে বিয়ের পর হাসবেন্ডের ঘরেই থাকতে, পাশের ঘরে থাকতে না।”

সাবা লজ্জা পেয়ে চুপ করে রইলো।

শাফকাত বলল, “তোমাকে আমিষ বানাতে হলে আমার সাথে ঢাকার বাইরে যেতে হবে।”

সাবা ছেলেমানুষের ছেলেমানুষি প্রশ্রয় দেওয়ার ভঙ্গিতে হেসে বলল, “আচ্ছা? তা কোথায় যেতে হবে?”

“গাজীপুরে।”

“গাজীপুরে? আর কোনো জায়গা পেলেন না দুনিয়ায়?”

“Don’t underestimate the place before seeing it! ওখানে আমাদের অনেক সুন্দর একটা ভিলা আছে। এই শুক্রবার যাচ্ছি।”

সাবা চিন্তিত গলায় বলল, “একদিনেই ফিরে আসবো?”

“না, তিনদিন থাকবো।”

“কিন্তু আমার অফিস?”

শাফকাত ভ্রু কুঁচকে বলল, “এই মেয়ে! এত দুশ্চিন্তা করো কেন? তোমার বসকে বলে রেখেছি, সময়মতো ছুটি দিয়ে দেবে।”

অজানা আনন্দে নেচে উঠলো সাবার মনটা। এই প্রথম শাফকাতের সঙ্গে বেড়াতে যাচ্ছে সে। মনের মাঝে হাজারো প্রজাপতি আকুলিবিকুলি করছে।

আতিয়া আলম আর শামার সঙ্গে ডিনার করলো তারা। ডিনারের এই সময়টা আগেও একসঙ্গে কাটাতো তারা। কিন্তু তখন গোটা ডাইনিং রুমজুড়ে বিরাজ করতো থমথমে নীরবতা। আর এখন সেখানে জায়গা করে নিয়েছে হাসাহাসি আর আড্ডা।

ডিনার সেরে ঘরে ফিরে এলো শাফকাত-সাবা। সাবা ক্লজেটে তার জামা-কাপড় গোছাচ্ছে। শাফকাত কোনো কাজ না পেয়ে ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে গেল তাদের ঘরের শেষ প্রান্তে থাকা মিনি ফ্রিজটার দিকে। এই ফ্রিজটা আগে শাফকাত ব্যবহার করতো না বললেই চলে। কিন্তু এ ঘরটা সাবার হওয়ার পর থেকে,
বিশেষ করে তার সেরে ওঠার পর থেকে ফ্রিজটা ব্যস্ত দিন পাড় করছে।

সাবা চকলেট, কোল্ড ড্রিঙ্কসের ক্যান, ড্রাই ফুড সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে এখানে। সেদিন গল্পের ছলে সাবা বলছিল, কিছুতেই তার চকলেটের ভাগ সে কাউকে দেয় না। এসএসসি পরীক্ষার আগ দিয়ে একবার মামাবাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল সাবা। মামী তাকে একটা চকলেট দিয়েছে। আরেক মামার পরিবারও সেদিন ওই বাড়িতে গিয়েছিল। তার দুটো ছোট ছোট ছেলেকে ভাগ দিতে হবে বলে সেই চকলেট সে ব্যাগে লুকিয়ে রেখেছিল। খেয়েছে বাড়িতে এসে।

সাবাকে রাগিয়ে দেওয়ার জন্যেই শাফকাত ফ্রিজ খুলে একটা কোকোনাট চকলেট নিয়ে
র‍্যাপার খুলতে শুরু করলো।

সাবা হঠাৎ তার কাজ ফেলে শাফকাতের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, “আপনি আমার চকলেট নিলেন কেন?”

শাফকাত হালকা গলায় বলল, “তোমার নাম লেখা আছে চকলেটের ওপরে?”

সাবা লম্বা লম্বা পা ফেলে শাফকাতের দিকে এগিয়ে এসে র‍্যাপারটা দেখিয়ে দৃঢ় গলায় বলল, “হ্যাঁ! এই দেখুন!”

শাফকাত বিস্মিত দৃষ্টিতে দেখলো চকলেটের র‍্যাপারের ওপর হলুদ একটা স্টিকি নোট আটকে রাখা। তাতে লেখা, ‘Saba’s property. Do not touch!’

প্রচ্ছন্ন হাসি হেসে উঠলো শাফকাত মেয়েটার ছেলেমানুষি দেখে।

হাসিটা ধরে রেখেই শাফকাত বলল, “বাহ্! তাহলে তো হয়েই গেল। আমি যদি হুট করে মরে-টরে যাই তাহলে আমার প্রপার্টির একটা বড় অংশ তো তুমিই পাবে। সেই হিসেবে তোমার সব প্রপার্টিরও অংশও আমার পাওয়া উচিত।”

সাবা ভ্রু কুঁচকে বলল, “বাজে কথা বলবেন না তো! ফিফটি ফিফটি করুন!”

আবারও হেসে উঠলো শাফকাত।

“হাসছেন কেন?”

“তোমাকে দেখে।”

“আমাকে দেখে?”

শাফকাত দুহাতে চকলেটের বার সমান দুভাগে ভাগ করে এক ভাগ সাবার হাতে দিয়ে বলল, “হ্যাঁ! দি রাফেস্ট এন্ড টাফেস্ট সাবা আমির! আমার সাথে চকলেটের ভাগ নিয়ে ঝগড়া করছে।”

সাবা চকলেট মুখে পুড়ে বলল, “আমি মোটেও রাফেস্ট এন্ড টাফেস্ট না।”

শাফকাত দুষ্টুমিমাখা কণ্ঠে বলল, “জানি তো। তুমি মনে করো তুমি খুব শক্তপোক্ত কিন্তু ভেতরে পুরোই একটা বাচ্চা! তুমি কীসের মতো জানো?”

সাবা কৌতূহলী গলায় বলল, “কীসের মতো?”

শাফকাত মুহূর্ত খানিক ভেবে বলল, “লেবু! তুমি ঠিক লেবুর মতো।”

সাবা ভ্রু কুঁচকে বলল, “লেবু? সিরিয়ালি? দুনিয়ায় আর কিছু পেলেন না? লেবুর সাথে তুলনা করছেন আমাকে?”

শাফকাত আগ্রহ নিয়ে বলল, “ক্রিয়েটিভলি চিন্তা করে দেখো। লেবুর বাইরেটা গাঢ় সবুজ, ভেতরটা হালকা সবুজ। তোমারও বাইরে এক রঙ, ভেতরে আরেক।”

সাবা গম্ভীর গলায় বলল, “আমার বাইরে এক রং, ভেতরে আরেক রং?”

“হ্যাঁ! তুমি বাইরে বাইরে ভাব দেখাও খুব কঠোর তুমি। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তোমার থেকে সরল আর কেউ হয় না। লেবুর মতো প্রত্যেকটা তোমার কথায় ছিল অতিরিক্ত টক। কিন্তু এখন মনে হয় সেই টক ছাড়া জীবনটাই বৃথা।”

সাবা হতাশ গলায় বলল, “আপনার মতো আনরোমান্টিক মানুষ আমি জীবনেও দেখিনি। মানুষ তার বউকে কত সুন্দর সুন্দর নামে ডাকে। আর আপনি আমাকে কী
ডাকছেন? লেবু?”

শাফকাত চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “আমার থেকেও বড় আনরোমান্টিক কাউকে দেখতে চাও?”

সাবা জোর গলায় বলল, “হ্যাঁ চাই। পারলে দেখান তো।”

“আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াও। দেখতে পাবে।”

“ফাজলামি হচ্ছে?”

শাফকাত বহুকষ্টে তার ঠোঁটের কোণে লুকোচুরি খেলতে থাকা হাসিটা চাপা দিয়ে বলল, “একদমই না! I’m damn serious! আগের কথা না হয় বাদই দিলাম। এই যে এতদিন ধরে একসাথে ঘুমাচ্ছি, একদিনও দেখলাম না ঘুমের ঘোরে আমাকে একটা কিস করলে।”

নিমিষেই সব রাগ উড়ে গেল সাবার। লজ্জায় চোখ দুটো বড় বড় করে তাকালো শাফকাতের দিকে। রাগী ভাবটা ধরে রাখার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পারলো না। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো লাজুক একটা হাসি।

শাফকাত দুষ্টু গলায় বলল, “আচ্ছা ঘুমের ঘোরে না হোক, ইচ্ছা করেই তো কিস করতে পারো। করেছো?”

সাবা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল, “উফ! আপনাকে নিয়ে আর পারা যায় না।”

“পারবেও না। অযথা তর্ক না করে চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ো লেবু!”

সাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আবারও লেবু?”

শাফকাত ঘোষণা করলো, “যতদিন আনরোমান্টিক থাকবে ততদিন লেবুই ডাকবো। যা করার করো!”

(চলবে)

#লেবু
৪৭
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

“শুধু শুধু এই মেয়েটাকে আনরোমান্টিক ডাকি?”

হুড়মুড়িয়ে সোজা হয়ে বসলো সাবা। কাল রিপোর্টের কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে দেরি হয়ে যায়। গোছগাছ করতে করতে ঘুমোতেও যায় দেরিতে। ভোর বেলা অ্যালার্মের শব্দেও চোখ দুটো যেন খুলতেই চাইলো না। শাফকাত তাকে টেনেহিঁচড়ে ডেকে না তুললে আজ আর ঘুরতে যেতে হতো না। গাড়িতে বসেও তাই বুজে এলো চোখ দুটো।

সাবা হাই তুলতে তুলতে বলল, “সরি! সরি!”

শাফকাত ড্রাইভ করতে করতে দৃষ্টি সামনের দিকে আবদ্ধ রেখেই আক্ষেপের সুরে বলল, “না থাক, ঘুমাও তুমি। আমাকে কোম্পানি দেওয়ার দরকার নেই।”

সাবা ভ্রু কুঁচকে বলল, “কোটি কোটি টাকার কোম্পানি থাকতে আমার কোম্পানি লাগবে কেন আপনার?”

“চমৎকার জোক! কিন্তু খুব চেষ্টা করেও হাসতেও পারলাম না।”

শাফকাত না হাসলে সাবা হেসে ফেলল। আড়চোখে একবার সেই হাসিটা দেখে নিল শাফকাত। এই মেয়েটার হাসি এতটাই মোহনীয় যে একবারও তা দেখার সুযোগ হাতছাড়া করা নিতান্তই বোকামি। সাবাকে কেউ কোনোদিন বোঝালো না কেন, যে হাসিতে তাকে কত সুন্দর লাগে? যে করেই হোক, সাবাকে আর এই হাসিটা মুছে ফেলতে দেওয়া যাবে না ঠোঁট থেকে।

জানালার বাইরে তাকালো সাবা। ঢাকা ছড়িয়ে টঙ্গীতে পৌঁছেছে তারা। রাস্তার দুপাশে আপাতত দোকানপাট ছাড়া আর কিছুই নেই। এখানকার দোকানগুলো ঢাকার মতো নয়। আকারে-উচ্চতায় কেমন ছোট ছোট।

সাবা ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “আর কতক্ষণ লাগবে?”

“আরও ঘণ্টাখানেক তো লাগবেই।”

সাবা ভ্রু কুঁচকে বলল, “এতদূরে ভিলা বানাতে কে বলেছিল আপনাকে?”

শাফকাত সূক্ষ্ম হাসি হেসে বলল, “আমি বানাইনি তো। বাবা বানিয়েছিল। বছরে দুয়েকবার মা আর শামাকে নিয়ে বেড়াতে আসতো।”

সুপ্ত আগ্রহের ঢেউ খেলে গেল সাবার গা বেয়ে। শাফকাত কখনো তার ছোটবেলার গল্প করে না। তার ছোটবেলাটা না-কি এতটাই বিরস ছিল যে তা নিয়ে কোনো গল্প করার মতো কিছু নেই। অথচ আজ নিজ থেকেই গল্প খুঁজে বের করেছে। এই মুহূর্তটা নষ্ট করতে চায় না সাবা।

সাবা কয়েক মুহূর্ত ভাবনা-চিন্তা করলো এরপর কী বলবে। এমন কিছু বলতে সে চায় না যাতে শাফকাত গল্পটা বলা থামিয়ে দিক।

সাবা আরও কিছুক্ষণ চিন্তা-ভাবনা করে বলল, “আপনি আসতেন না?”

শাফকাত কী যেন ভেবে বলল, “এইচএসসি পর্যন্ত আসতাম। পরে আর সময় পাইনি। ইউনিভার্সিটিতে উঠেই তো পড়াশোনা আর অ্যাপ ডেভেলপ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম।”

মলিন একটা হাসি হেসে সাবা বলল, “কাজ ছাড়া কি জগতের কিছু বোঝেন আপনি?”

“আগে বুঝতাম না।”

“এখন বোঝেন?”

শাফকাত এক মুহূর্তের জন্যে সাবার ওপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, “না বুঝলে এত বছর পর তোমাকে নিয়ে জায়গাটায় যাচ্ছি কী করে?”

ওই একটা মুহূর্তই যথেষ্ট সাবার সারা শরীরে কম্পন জাগিয়ে তোলার জন্যে। শাফকাতের দৃষ্টিতে কী যেন একটা ছিল। তাকে ভাষার বেড়াজালে আটকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। শুধু এতটুকু সাবা নিশ্চিত ওই দৃষ্টি তাকে পাগল করে দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট।

আচমকা সেদিন রাতের দৃশ্য ফুটে উঠলো তার চোখের সামনে। অবাধ্য আদরে তাকে ভাসিয়ে দিয়ে শাফকাত তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে যখন স্যুটটা খুলছিল, তখন ঠিক এই চাহনিতেই তাকিয়ে ছিল তার দিকে।

চোখ দুটো খিচে বন্ধ করে নিজেকে সামলে নিলো সাবা। শাফকাতের ওই ভয়ংকর চাহনির কথা যতবারই সে মনে করে, ততবারই গা বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায়। হাত-পা বরফের ন্যায় জমে যায়।

না, না। এই মুহূর্তে ওসব ভাববে না সাবা। মন আর মস্তিষ্কে ব্যস্ত রাখার জন্যেই সে ভাবতে শুরু করলো ভিন্ন কিছু। শাফকাতকে তার ছোটবেলা নিয়ে আর কী প্রশ্ন করা যায়!

সঠিক প্রশ্নটা খুঁজে পেতেই উজ্জ্বল গলায় বলল, “আচ্ছা? আপনার ছোটবেলায় কী হওয়ার স্বপ্ন ছিল?”

শাফকাত হালকা গলায় বলল, “বললে বিশ্বাস করবে না।”

“বলুন না!”

“ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল, একদিন আমার অনেক টাকা হবে।”

সাবা বিস্ময়ের হাসি হেসে বলল, “সত্যি?”

শাফকাত স্মৃতি রোমন্থন করে বলল, “হ্যাঁ। জানি উইয়ার্ড একটা স্বপ্ন। তখন আমাদের বাসার সামনে একটা কুলফিওয়ালা আসতো। দুই টাকা না কত জানি দাম। আমি প্রতিদিন মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে কুলফি কিনতাম। একদিন চাইলাম, মা দিলো না। বলল, এত কুলফি খেলে ঠান্ডা লেগে যাবে। ব্যস! সেই থেকে আমার জেদ। একদিন আমার এত টাকা হবে সে প্রতিদিন নিজের জন্যে কুলফি কিনতে পারবো।”

সাবা অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো শাফকাতের দিকে। এতগুলো শব্দ এ সঙ্গে কী আছে কখনো বলতে শুনেছে তাকে? সাবা মনে করতে পারলো না।

তার বিস্মিত চোখদুটি দেখে শাফকাত ক্ষীণ হেসে বলল, “কী?”

সাবা হাসিমুখেই বলল, “নাহ্! আপনার সাথে বুঝে শুনে কথা বলতে হবে।”

হেসে ফেলল শাফকাত। লোক দেখানো, ভদ্রতার খাতিরে হাসা হাসি নয়, সত্যিকারের হাসি। ছেলেটার হাসিও ঠিক তার মতোই আকর্ষণীয়।

কতক্ষণ চুপ করে থেকে সাবা আবারও ইতস্তত করে বলল, “তবে একটা সত্যি কথা বলবো?”

শাফকাত ড্রাইভ করতে করতে সামনের দিকে তাকিয়ে থেকেই আগ্রহ নিয়ে বলল, “কী?”

“এই টাকা কামানোর স্বপ্নটা আমারও ছিল। ছোটবেলা থেকেই।”

শাফকাত অবাক গলায় বলল, “তাই না-কি?”

সাবা হাসি হাসি মুখে বলল, “হ্যাঁ। জার্নালিজমের স্বপ্ন তো অনেক পরে দেখেছি। তবে এই একটা স্বপ্ন ছোটবেলা থেকেই ছিল। নিজের পায়ে দাঁড়াবো। কারও ওপর ডিপেন্ড করে চলবো না। ছোটবেলা থেকেই একটা মেয়ের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয় বিয়ের আগ পর্যন্ত সে বাবার ওপর ডিপেন্ডেন্ট, বিয়ের পর স্বামীর ওপর ডিপেন্ডেন্ট আর বৃদ্ধ বয়সে ছেলের ওপর। অতটুকু বয়সেই আমার মনে হতো এসব নিতান্তই বাজে কথা। বেঁচে থাকার জন্যে একটা মেয়ের কারোর ওপর ফাইন্যান্সিয়ালি নির্ভর করতে হবে কেন? That’s why I wanted to make a difference.”

শাফকাত তার মোহনীয় কণ্ঠে বলল, “And that’s why I’m proud of you!”

সাবার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। এই কথাটা সচরাচর কেউ তাকে বলে না। সাবা তো ধরেই নিয়েছিল এ জীবনে কাউকে সে গর্বিত করতে পারেনি। তবুও সে গর্বিত করেছে। তাও আবার কাকে? যেই মানুষটা তাকে সহ্যই করতে পারতো না, সেই শাফকাত আলমকে।

চোখে জল আসার আগেই নিজেকে সামলে নিয়ে সাবা মিষ্টি গলায় বলল, “তবে আরেকটা সত্যি কথা কী জানেন?”

শাফকাত মজার ছলে বলল, “তুমি তো আজ সত্যি কথার দোকান খুলে বসলে।”

“উফ! শুনবেন আপনি?”

“বলো।”

“ফাইন্যান্সিয়ালি ইন্ডিপেন্ডেন্ট হলেও আমি ইমোশনালি ইন্ডিপেন্ডেন্ট নই। আপনার ওপর ডিপেন্ডেন্ট।”

এবার চমকে ওঠার পালা শাফকাতের। সাবা যেমন চাপা স্বভাবের মেয়ে, মনের কথাটা এমন নির্দ্বিধায় কখনোই বলে না। অথচ আজ বলল। শাফকাতের ভেতরটাকে কয়েক দফা এলোমেলো করে দিয়েই বলল।

শাফকাতের ভিলাটা সত্যিই অসাধারণ। যদিও শাফকাতের ভিলা বলা ঠিক হচ্ছে না। এটা তো সাবারও। কাঠের দোতলা বাড়ি, টিনের ছাদ, মূল দরজা থেকে একটা পাথরের রাস্তা পাড় করে বাড়িতে প্রবেশ করতে হয়।

বাড়ির সামনের দিকটায় কৃষ্ণচূড়া, কাঠগোলাপ, জুঁই, শিউলি গাছের সমারোহ। মাটিতে অনেকগুলো লাল কাঠগোলাপ পড়ে আছে। সাবা উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিতে একটা ফুল তুলে গুঁজে নিলো তার চুলে। সাবা ঘুরে ঘুরে বাড়ির আশপাশটা দেখতে ব্যস্ত, আর শাফকাত ব্যস্ত তার উচ্ছ্বাস দেখতে।

সাবা ঠিকই বলেছিল। তার মধ্যে আসলেই বাচ্চা একটা মেয়ে লুকিয়ে আছে। সে সচরাচর দেখা দেয় না। মাঝেমধ্যে ভাগ্যক্রমে তার দেখা মেলে।

বাড়ির ডান দিকে বিশাল এক পুকুর। বাঁধনো পুকুরঘাট পেরিয়ে পুকুরের সামনে দাঁড়াতেই চমকে উঠলো সাবা। জলের ওপর টলমল করছে টকটকে গোলাপি রঙের পদ্ম। দূরে একঝাঁক ধবধবে সাদা হাসেরও দেখা পেলো তারা। পদ্মের ফাঁকে ফাঁকে নিজেদের চলার পথ করে নিয়ে সারিবদ্ধ সাঁতার কাটছে তারা।

সাবা এখনো দাঁড়িয়েই আছে অবাক ভঙ্গিতে। শাফকাত তার কাছে গিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো তাকে। প্রবলভাবে কেঁপে উঠলো সাবা। এই মানুষটার স্পর্শ যতবারই সে পায়, ততবারই অজানা-অচেনা এক সুখের জোয়ারে ভেসে যায়।

সাবা কোনক্রমে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “এত সুন্দর একটা জায়গায় আপনি এতদিন আমাকে নিয়ে আসেননি কেন?”

শাফকাত সাবার ঘাড়ে মাথা ঠেকিয়ে বলল, “এতদিন ঘুরতে আসার মতো অবস্থা রেখেছিলে?”

নিমিষেই উচ্ছলতা উড়ে গিয়ে সাবার চোখে মুখে জায়গা করে নিলো একরাশ মলিনতা। কে সে শুরু থেকেই এই বিয়েটাকে মেনে নেয়নি? আপন করে নেয়নি শাফকাতকে? তাহলে তো আর কষ্ট পেতে হতো না। আজকের এই সুন্দর মুহূর্তটা উপহার পেতো বেশ আগেই।

সাবার দীর্ঘ নীরবতায় নিজের ওপর নিজেই বিরক্ত হয়ে উঠলো শাফকাত। মেয়েটা কী সুন্দর হাসিখুশি ছিল। কী দরকার ছিল ওসব মনে করিয়ে তার মনটা খারাপ করিয়ে দেওয়ার?

শাফকাত নীচু গলায় বলল, “সরি, আমি ইচ্ছা করে ওসব মনে করাইনি তোমাকে। বেশি কষ্ট পেয়েছ?”

সাবা মলিনভাবে হেসে বলল, “না, কষ্ট পাইনি। খারাপ লাগে, এই আর কী?”

শাফকাত আলতোভাবে নিজের দিকে ফেরালো সাবাকে। সাবার হাত দুটো রাখলো তার কাঁধের ওপর। আর নিজের হাতদুটো দিয়ে জড়িয়ে ধরলো তার কোমর।

নরম স্বরে বলল, “সরি, লেবু। আর কখনো এমন কিছু বলবো না যাতে তোমার খারাপ লাগে।”

সাবা ভ্রু কুঁচকে বলল, “এই লেবু লেবু করা বন্ধ করুন তো! লেবু বেশি কচলালে কিন্তু তিতা হয়ে যায়।”

“কিন্তু তোমাকে কচলালাম কোথায়?”

সঙ্গে সঙ্গে রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো সাবার গাল দুটো। অথচ শাফকাত এমনভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে যেন খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রশ্ন সে সাবাকে করেছে। এই মুহূর্তে উত্তর না পেলে বিরাট বিপদের সম্মুখীন হতে হবে।

সাবা হেসে ফেলে মুখ লুকিয়ে রাখলো শাফকাতের বুকে। শাফকাত তার চুলে হাত বুলিয়ে বলল, “এভাবেই হাসবে বুঝেছো লেবু? হাসলেই তোমাকে সব থেকে সুন্দর লাগে।”

সাবার মনের মাঝে যেন হাজারো প্রজাপতি আকুলি-বিকুলী করে বেড়াচ্ছে। এত সুন্দর করে শাফকাত কি আগে কখনো তার প্রশংসা করেছে। মনে করতে পারলো না সাবা।

সাবা তার বুক থেকে মুখ তুলে কৌতূহলী গলায় বলল, “আচ্ছা এই বাড়িতে কেউ থাকে না?”

“থাকে তো। দুজন কেয়ারটেকার, মালি, কুক সবাই থাকে।”

সাবা আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বলল, “তারা কোথায়?”

শাফকাত সাবার নাকে নাক ঘষে বলল, “এখন এখানে কেউই নেই। সবাইকে ছুটি দিয়ে দিয়েছি। মেইন গেটে শুধু কয়েকজন সিকিউরিটি গার্ড থাকবে। আর পুরো বাড়িতে, শুধু আমি আর তুমি।”

ভিলার ভেতরটাও ছিমছাম গোছানো। দেয়ালে দেয়ালে সুন্দর সব পেইন্টিং, আর সবগুলো ঘর জুড়েই দামী শোপিস। শাফকাত দোতলার একটা ঘরে নিয়ে এলো সাবাকে। আগামী তিন দিনের জন্যে, এটাই তাদের ঘর।

স্টাফরা এখানে না থাকলে কাছেই তাদের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। যাতে যেকোনো প্রয়োজনে ছুটে আসতে পারে। শাফকাত আর সাবা যখন বাইরে ঘুরতে যাবে তখন যাতে ভিলার দেখাশোনা করতে পারে, রান্নাবান্না করতে পারে।

শাফকাতের নির্দেশে আগে থেকেই ভিলার বাবুর্চি তাদের জন্যে বানিয়ে রেখেছিল সাবার প্রিয় লবস্টার রোল। সাবার ইচ্ছা ছিল, জায়গাটা ঘুরে দেখবে। কাছেই না-কি সুন্দর একটা রিসোর্ট আছে। শাফকাত বলেছিল সেখানে নিয়ে যাবে।

কিন্তু ক্লান্তিতে শরীর রীতিমতো ভেঙে আসছে। একে তো গত রাতের ঘুমের স্বল্পতা তার ওপরে আবার জার্নির ধকল। ফ্রেশ হয়ে, লবস্টার রোল খেয়েই বিছানায় গা এলিয়ে দিলো সাবা। মিনিট খানেকও লাগলো না ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে যেতে।

ঘুম ভাঙলো সন্ধ্যার পর শাফকাতের ডাকাডাকিতে।

“সাবা! সাবা ওঠো।”

বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে গেল সাবার। সবে নতুন একটা স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল সে। যদিও ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে সে স্বপ্নের কোনো স্মৃতিই রইলো না তার মস্তিষ্কে।

সাবা ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বলল, “উফ! আরেকটু ঘুমাই না!”

শাফকাত ব্যস্ত গলায় বলল, “না। আর ঘুমানো যাবে না। ওঠো। ঘুমানোর জন্যে বেড়াতে নিয়ে এসেছি তোমাকে?”

সাবা বিরক্ত ভঙ্গিতে উঠে বসতে বসতে বলল, “তো কেন নিয়ে এসেছেন।”

শাফকাত অন্যরকম গলায় বলল, “তোমাকে ডেটে নিয়ে যেতে।”

সঙ্গে সঙ্গে ঘুম উড়ে গেল সাবা চোখ দুটো থেকে। চোখ বড়বড় করে সে বলল, “ডেট?”

শাফকাত বেডসাইড টেবিল থেকে একটা ডিজাইনার শাড়ির বক্স এনে সাবার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “হ্যাঁ ডেট! এটা পড়ে বাইরে এসো।”

সাবা হেসে ফেলে বলল, “আপনি কী জানেন? ইতিহাসের সব থেকে বাজে ডেটের প্রস্তাবের জন্যে কোনো অ্যাওয়ার্ড থাকলে, সেটা আপনিই পেতেন।”

শাফকাত ভ্রু কুঁচকে বলল, “কেন? যেতে চাও না?”

“চাই না বললাম কখন? একটু আগেভাগে বললে কী হতো? একটা প্রিপারেশনের ব্যাপার আছে না?”

“প্রিপারেশন নিতে হবে না, ওটা আমার কাজ।

এখন ওঠো!”

শাফকাত সাবাকে একা রেখে কোথায় যেন গেল। ঘরের দরজাটা লক করে এসে আগ্রহ নিয়ে বক্সটা নিয়ে বসলো সাবা। বক্সের উপরিভাগ খুলতেই হাসি ফুটে উঠলো তার ঠোঁট জুড়ে। গাঢ় সবুজ পাড়ে হালকা সবুজ জমিনের শাড়ি। পাড়টা সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম সাদা ফুলে সাজানো। ঠিক লেবুর রং। যতই দিন যাচ্ছে, শাফকাত ঠিক ততটাই পাগল হয়ে যাচ্ছে।

যেহেতু ডিজাইনার শাড়ি, সঙ্গেই ব্লাউজ ছিল। তাও আবার কালো রঙের। সাবা মনে ক্ষীণ সন্দেহ জাগলো সবুজ শাড়িটার সঙ্গে কালো ব্লাউজ মানাবে কিনা। শাড়িটা পরে নিজেকে আয়নার সামনে এক পলক দেখতেই সকল সন্দেহ দূর হয়ে গেল।

ড্রেসিং টেবিলের ওপর আরও দুটো গাঢ় নীল রঙের বক্স। একটাতে সোনার চুড়ি। সাবা কখনোই দুহাতে চুড়ি পরে না। সবসময় ডান হাতেই পরে। তবে আজ কী যেন মনে করে দুহাতেই চুড়ি পরলো। অদ্ভুত সুন্দর লাগলো তাকে।

আরেকটা বক্সে হালকা একটা সোনার নেকলেস। নেকলেস জিনিসটাতে সাবাকে খুব একটা মানায় না বলে সমসময় দূরে দূরেই থেকেছে। তবে আজ এটাও মানালো খুব।

কপালে ছোট্ট একটা কালো টিপ। টিপে তাকে অন্যরকম সুন্দর লাগে। চুলগুলো ছেড়েই রাখলো।

আয়নায় নিজেকে দেখছে আর একটু একটু করে শঙ্কিত হয়ে উঠছে সাবা। শাফকাত তাকে এভাবে পছন্দ করবে তো?

দরজা খুলেই সামনে দেখতে পেলো শাফকাতকে। চমকে উঠলো সাবা। মুগ্ধতার প্রবল স্রোত নিমিষেই এলোমেলো করে দিয়ে গেলো তাকে।

শাফকাতের পরনে গাঢ় নীল একটা পাঞ্জাবি। এর আগে কি কখনো তাকে পাঞ্জাবিতে দেখেছে সাবা? কিছুতেই মনে করতে পারলো না।

শাফকাত ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সাবার দিকে। একটু একটু করে তার খুব কাছাকাছি এগিয়ে আসছে। লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেলল সাবা।

শাফকাত সাবার কাছাকাছি এসে আচমকা তোলে তুলে নিলো তাকে।

সাবা চমকে উঠে শাফকাতের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, “এটা কী হলো?”

শাফকাত সাবাকে কোলে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে বলল, “এমন ভাব করছো যেন, এর আগে কখনো আমার কোলে ওঠোনি।”

সাবা থতমত খেয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করে বলল, “তখন তো আমি অসুস্থ ছিলাম।”

শাফকাত সাবার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, “তুমি খুব ভালো করেই জানো আমি অসুস্থতার দিনগুলোর কথা বলছি না।”

লজ্জায় জড়সড় হয়ে সাবা মুখ লুকিয়ে ফেলল শাফকাতের বুকে। আজ রাতটা যে কোন রূপে নেমে আসতে চলেছে তার জীবনে, কে জানে?

(চলবে)

#লেবু
৪৮
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

[সতর্কতা : পর্বটি অতিমাত্রায় রোমান্টিক। শুধুমাত্র প্রাপ্তমনষ্করাই পড়বেন। হ্যাপি রিডিং!]

বিস্ময়ে সাবার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। সে ভাবতেও পারেনি এত সুন্দর একটা মুহূর্ত অপেক্ষা করে আছে তার জন্যে। বাড়ির সামনের বড় বড় সব গাছগুলো ছোট-বড় লাইট বলে মুড়ে দেওয়া। সোনালি আলোয় চকচক করছে গোটা জায়গাটা। শাফকাত তাকে কোলে নিয়ে আরেকটু এগিয়ে যেতেই আরেকদফা চমকে উঠলো সাবা।

মাটিতে বিশাল একটা চাদর বিছিয়ে রাখা। তার একপাশে বড় বড় অনেকগুলো কুশন পাশপাশি রাখা হয়েছে। সেগুলোর পাশেই একটা ল্যাপটপ। চাদরটার আশেপাশে না জানি কতগুলো সুগন্ধিযুক্ত মোমবাতি জ্বলছে। চাদরের ওপরে স্টিলের ঢাকনা দিয়ে কী যেন ঢাকা।

এবার একটু সামনে চোখ গেল সাবার। চাদরের ওপরে যে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে তার ঠিক সামনেই গাছের সঙ্গে কাগজের স্ক্রিন বেঁধে রাখা হয়েছে। একটু দূরেই প্রজেক্টর। স্ক্রিনটা এমনভাবে বেঁধে রাখা হয়েছে যাতে চাদরের ওপরে বসে থেকে সহজেই দেখা যায়।”

শাফকাত সাবাকে নামিয়ে দিতে দিতে বলল, “আমাদের ডেটিং স্পট। পছন্দ হয়েছে?”

সাবা দুষ্টুমির ছলে বলল, “পছন্দ না হলে কী করবেন? সবকিছু উপড়ে ফেলবেন?”

শাফকাতের ভাবভঙ্গি গম্ভীর আকার ধারণ করলো। চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, “একবার বলেই দেখো।”

সাবা হেসে ফেলে বলল, “প্লিজ উপড়ে ফেলবেন না। অনেক সুন্দর হয়েছে!”

সাবার হাসি শাফকাতের মধ্যে স্বস্তির থেকেও বেশি যে জিনিসের সঞ্চার করলো, তার নাম ঘোর। এই মেয়েটার হাসি বারবার তাকে ঘোরের জগতে ডুবিয়ে নিয়ে যায়। আজ তার হাসি, বিস্ময়ভরা চোখে সোনালি আলোর প্রতিফলন, সবুজ শাড়ি আর কালো টিপ – সবটাই দিশেহারা করে তুলছে শাফকাতকে।

শাফকাত ঘোরলাগা দৃষ্টিটা ধরে রেখে সাবার একেবারে কাছাকাছি চলে গেল। তার উন্মুক্ত কোমড়ে হাত রেখে এক নিমিষে বুকের কাছাকাছি নিয়ে এলো তাকে। শাফকাতের অতর্কিত এই গাঢ় স্পর্শে যেন শিউরে উঠলো সাবা। দৃষ্টি মাটির দিকে নামিয়ে রেখে লম্বা লম্বা শ্বাস নিচ্ছে। তার এই শ্বাস নেওয়ার ভঙ্গিতেই পাগল হয়ে গেল শাফকাত। একটা মানুষের শ্বাস নেওয়ারও এত সুন্দর হতে পারে?

শাফকাত সাবার কানের সঙ্গে ঠোঁট মিশিয়ে বলল, “কিন্তু তোমার মতো সুন্দর হয়নি। হতে পারবেও না।”

সাবা মুখ তুলে অবাক চোখে তাকালো। শাফকাতের চোখে যে মুগ্ধতা এই মুহূর্তে সে দেখতে পাচ্ছে, তার পুরোটাই যে কেবল তার জন্যে ভাবতেই অবাক লাগছে।

শাফকাত সাবাকে নিয়ে বসালো তাদের ‘ডেটিং স্পট’ এ। তার পাশে বসে কুশনের আড়াল থেকে বের করে আনলো একটা কালো গোলাপের তোড়া। মোহনীয় ভঙ্গিতে সেটা বাড়িয়ে দিলো সাবার হাতে।

ফুলের তোড়া হাতে নিয়ে কতক্ষণ থ হয়ে বসে রইলো সাবা। কালো গোলাপ তার ভীষণ পছন্দের। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, পছন্দের জিনিসটা আজই প্রথম চোখের সামনে দেখছে। ইন্টারনেটে প্রায়ই কালো গোলাপের সুন্দর সব ছবি চোখে পড়ে। সেই থেকেই ভালো লাগার জন্ম। তবুও কখনো নিজ থেকে এই ফুল কেনেনি সাবা। ভালোবেসে কেউ দেবে সেই আশায়।

সাবা অবাক গলায় বলল, “আপনি কীভাবে জানলেন কালো গোলাপ আমার পছন্দের?”

শাফকাত হালকা গলায় বলল, “তোমার নাড়ি-নক্ষত্র আমার মুখস্থ। ভুলে যাও কেন বারবার?”

শাফকাত পাশ থেকে তার ল্যাপটপটা তুলে নিয়ে বলল, “কোন সিনেমা দেখবে?”

সাবা কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “Interstellar?”

শাফকাত থমথমে গলায় বলল, “তুমি আসলেই একটা আনরোমান্টিক। এত রোমান্টিক একটা ডেটে তুমি আমাকে সায়েন্স ফিকশন দেখাবে?”

সাবা হেসে ফেলে বলল, “আচ্ছা, আচ্ছা! রোমান্টিক সিনেমার নামই ভেবে বলছি।”

সাবা আরেকদফা ভেবে বলল, “La La Land!”

সূক্ষ্ম হেসে সিনেমাটা প্লে করলো শাফকাত। প্রথম টাইটেল ভেসে উঠতে উঠতে সে তুলে দিলো তাদের সামনে থাকা প্লেটগুলোর স্টিলের ঢাকনা।

আরেকদফা বিস্মিত হয়ে মুচকি হেসে উঠলো সাবা। তাদের সামনে দুটো হার্ট শেপের পিজ্জা। একটা পেপারোনি আরেকটা ক্লাসিক কিন্তু ওপরে আনারসের টুকরো।

সাবা হাসিটা ধরে রেখে বলল, “আপনি এটাও জানেন আমি পিজ্জার ওপরে পাইন্যাপেল পছন্দ করি?”

সাবার চোখ দুটোর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে শাফকাত বলল, “তোমার সম্বন্ধে তুমি নিজেও যা জানো না, আমি তাও জানি।”

অবাক চোখে তাকালো সাবা শাফকাতের দিকে। কথাটার গভীরতা বোঝার চেষ্টা করলো। কিন্তু আনন্দে আর মুগ্ধতায় তার মাথাটাই কাজ করছে না।

এক স্লাইস পিজ্জা তুলে নিতে নিতে জড়সড় কণ্ঠে বলল, “কী করে এই অসাধ্য সাধন করলেন?”

শাফকাত পেপারোনি পিজ্জার এক স্লাইস তুলে বলল, “তোমার ফেসবুক থেকে। ছয়-সাত বছর আগে তুমি একবার পোস্ট করেছিল পিজ্জার ওপর পাইন্যাপেল পছন্দ করো। যারা তোমাকে নিয়ে কমেন্টে হাসাহাসি করেছিল তাদেরকে ধরে ধরে আনফ্রেন্ড করে দিয়েছিলে।”

সেই পোস্টের কথা মনেও নেই সাবা। ছোটবেলায় এমন শিশুসুলভ পোস্ট প্রায়ই দিয়ে বেড়াতো। কারও সঙ্গে মতের অমিল হলেই আনফ্রেন্ড করে দেওয়া ছিল তার আরেক শিশুসুলভ অভ্যাস।

সাবা বিস্ময়ে খাবি খেয়ে বলল, “এই তাহলে আপনার গোয়েন্দাগিরি? ফেসবুক থেকে আমার পছন্দ-অপছন্দগুলোর খোঁজ নিয়েছেন? আমি তো ভেবেছিলাম, আমার নাড়ি-নক্ষত্র জানার জন্যে সিক্রেট এজেন্ট দিয়ে না জানি কত গোয়েন্দাগিরি করেছেন!”

“নিজেকে ফেসবুকে এভাবে তুলে ধরে আর সিক্রেট এজেন্টের আর কী প্রয়োজন?”

সাবা অযথা তর্কে না জড়িয়ে বলল, “আপনি ওটা খাচ্ছেন কেন? একবার পাইন্যাপেল পিজ্জা খেয়েই দেখুন।”

শাফকাত থমথমে গলায় বলল, “সাবা, ওই জিনিস খাওয়ার থেকে আমি এসিডে গোসল করতে বেশি পছন্দ করবো।”

সাবা আহত গলায় বলল, “আমার সামনে এই কথা বলছেন? আনফ্রেন্ড হওয়ার ভয় নেই?”

শাফকাত ভ্রু ওপরে তুলে বলল, “তার মানে আমার সাথে তুমি ফ্রেন্ডশিপ করেছো?”

“না! ফেসবুকে তো…”

“আমি ফেসবুকের কথা বলছি না।”

সাবা চমকে উঠে কতক্ষণ তাকিয়ে রইলো শাফকাতের দিকে। ছেলেটার চোখ দুটো উত্তরের প্রত্যাশায় চকচক করছে।

লাজুক হাসি হেসে সাবা কম্পিত স্বরে বলল, “হয়ত।”

নিঃসঙ্কোচে সাবা মাথা রাখলো শাফকাতের কাঁধে। শাফকাতও একহাতে জড়িয়ে ধরলো তাকে। স্ক্রিনে সিনেমা শুরু হয়েছে, তবে নিশ্চিত তাতে কারোই মন নেই। সাবার মনের আধিপত্যে এই সুন্দর মুহূর্তটা। আজ কতগুলো দিন পর তার মনে প্রশান্তি ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনো অনুভূতির জায়গা নেই। কোনো আক্ষেপ নেই, হতাশা নেই – কেবলই সুপ্ত একটা আনন্দ। আশেপাশের সোনালি আলো, তাদের ডেটিং স্পট, শাফকাতের কাঁধে মাথা রাখা, তার স্পর্শে গা ভাসানো – সবটাকেই যেন স্বপ্ন দৃশ্য বলে মনে হচ্ছে।

সাবা হঠাৎ খেয়াল করলো তাদের ঠিক ওপরে পূর্ণিমার চাঁদটা আলো ছড়াচ্ছে। আনমনেই তার ঠোঁট জুড়ে ফুটে উঠলো প্রচ্ছন্ন একটা হাসি। আবার পরমুহূর্তেই চোখ ভিজে গেল জলে। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো রীতিমতো।

থেমে থেমে শাফকাতকে আর্দ্র গলায় সে বলল, “শাফকাত?”

শাফকাত সাবার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, “হুঁ?”

সাবা থেমে থেমে বলল, “আজকের শেষ সত্যি কথাটা বলি?”

শাফকাত ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “আবার?”

সাবা হাসিমুখে বলল, “এটাই শেষ। বললাম তো!”

“আচ্ছা বলো।”

বলার অনুমতি পাওয়া সত্ত্বেও দীর্ঘ সময় চুপ করে রইলো সাবা। হয়ত মনে মনে কথা গোছানোর জন্যে। কিংবা মনটাকে সেই কথাগুলো বলার বলে প্রস্তুত করার জন্যে।

অবশেষে নীরবতা ভঙ্গ করে সাবা বলল, “যখন বয়স কম ছিল, তখন স্বপ্ন দেখতাম যার সঙ্গে আমার বিয়ে হবে সে আমাকে রাজরানীর মতো রাখবে। আমি চাইলে আকাশের চাঁদটা ছিনিয়ে আনার ক্ষমতা যার থাকবে। পৃথিবীর সমস্ত সুখ ফুলের তোড়ার মতো সাজিয়ে আমার হাতে তুলে দেওয়ার ক্ষমতা যার থাকবে। তারপর, একটু একটু করে যখন বয়স বাড়লো, ম্যাচিউরিটি এলো তখন বুঝলাম এত ক্ষমতা সাধারণ মানুষের থাকে না। রাজা-মহারাজাদের থাকে। আমিও কোনো রাজরানী নই, সাধারণ একটা মেয়ে। বড় বড় স্বপ্ন আমাকে মানায় না। স্বপ্নগুলো ছোট হলেও আরও সুন্দর হয়ে গেল। মনে হলো, যার সঙ্গে আমার বিয়ে হবে তাকে আকাশের চাঁদটা ছিনিয়ে আনতে হবে না। আমার পাশে বসে চাঁদ দেখলেই চলবে। পৃথিবীর সব সুখ ফুলের তোড়ার মতো করে সাজিয়ে দিতে হবে না। একটা কালো গোলাপের তোড়া দিলেই চলবে। আপনি তো আমার দুটো স্বপ্নই পূরণ করে দিলেন।”

শাফকাতের কাঁধ থেকে মাথা তুলে তার চোখদুটোর দিকে তাকালো সাবা। শাফকাতের চোখে বিস্ময়ের সাথে সাথে যে জিনিসটা চকচক করছে তার নাম মুগ্ধতা।

শাফকাত অন্যরকম গলায় বলল, “কীভাবে? ফুলের তোড়া দিয়েছি, পৃথিবীর সব সুখ তো দিইনি।”

“আপনি আমার পাশে, এটাই পৃথিবীর সব থেকে বড় সুখ।”

“আকাশের চাঁদ তো এনে দিইনি।”

“আপনিই তো চাঁদ!”

সাবার চোখ দুটোতে জল এসে গেল। আনন্দে না-কি আহ্লাদে সে জানে না। শুধু জানে, যে করেই হোক এই মানুষটাকে সে হারাতে চায় না। কিছুতেই না। সাবা কখনোই ভাবতে পারেনি, বিয়ের পর থেকে যে মানুষটাকে এক মুহূর্তের জন্যে সহ্য করতে পারেনি সেই মানুষটাই তার যন্ত্রণাগুলো দূর করে দেবে। সেই মানুষটাই তার স্বপ্নগুলো পূরণ করে দেবে। তবে আমরা যা ভাবি, তার সঙ্গে বাস্তবের বিস্তর ফারাক। যে মানুষটার কাছ থেকে একদিন সাবা পালিয়ে যেতে চেয়েছিল, সেই আজ তার মনের মাঝে শত শত প্রজাপতি উড়ে বেড়ানোর কারণ।

শাফকাত তীক্ষ্ণ হাসি হেসে বলল, “ফ্লার্ট করছো লেবু?”

“সত্যি বলছি।”

সাবার ঠোঁট জুড়ে হাসি ফুটে ওঠা সত্ত্বেও চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে ডান হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে সে অশ্রু মুছে দিলো শাফকাত।

সাবা আর্দ্র গলায় বলল, “আমি সত্যিই বউ হিসেবে অনেক বাজে।”

সাবা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে শাফকাত বলল, “এই কথাটা আর কখনো বলবে না সাবা। বললে ওই পুকুরের পানিতে ফেলে দেবো তোমাকে।”

“ভুল কিছু বলেছি? আমার মতো বাজে বউ আর একটা হয়? তবুও তো আপনি আমাকে সহ্য করলেন। বিয়ের দিন বাড়িতে পা রেখেই বললাম, আমি আপনার সঙ্গে এক ঘরে থাকবো না। মেনে নিলেন। দিনের পর দিন আপনাকে ডিসরেসপেক্ট করে গেলাম। সহ্য করে গেলেন। আপনার জায়গায় অন্য কেউ হলে অনেক আগেই আমাকে ডিভোর্স দিয়ে ফেলতো। সত্যিই আমাকে রাজরানীর মতো রেখেছেন আপনি।”

“সব দোষ নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিলে না? আর আমি যে তোমাকে এত কষ্ট দিলাম? শুরু থেকেই তোমার ওপরে নিজের ডমিনেন্স দেখানোর চেষ্টা করলাম। তার বেলায়?”

“ওসব তো আমার ভালোর জন্যে করেছেন।”

“না সাবা। দোষ আমারও ছিল। তোমার ভালোর জন্যে সবটা করলেও আমার উপায়টা ভুল ছিল। তোমার ভালোর জন্যে যাই করেছি, করেছি তোমার অমতে, তোমাকে রাগিয়ে দিয়ে। কখনো তোমাকে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করিনি।”

“বুঝিয়ে বললেও লাভ হতো না। আমি তো আপনাকে বুঝতেই চাইতাম না।”

শাফকাত কী বলবে ভেবে পেলো না।

সাবা আবারও হাসিমুখে কিন্তু আর্দ্র গলায় বলল, “কিন্তু এখন বুঝি। নিজের থেকেও ভালো করে বুঝি। তার থেকেও বড় কথা আপনার বাইরে আর কিছুই বুঝি না।”

শেষের কথাটা শাফকাতের চোখদুটোর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল সাবা। বিস্ময় ক্রমশ ছড়িয়ে গেল শাফকাতের অন্তরাত্মায়।

হৃদস্পন্দন একটু একটু করে বেড়ে যাচ্ছে তার। এতগুলো দিন ধরে দূর থেকে ভালোবেসে যাচ্ছে মেয়েটাকে। তবে আজ তার চোখে নিজের জন্যে যে ঔজ্জ্বল্য দেখছে, তা আগে কখনো দেখেনি। আজ তার ঠোঁটে নিজের জন্যে যে রঙিন হাসির আভা দেখতে পাচ্ছে, তা আগে কখনো দেখেনি।

অবিশ্বাস নিয়ে শাফকাত বলল, “তাই?”

সাবা আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “হ্যাঁ তাই! আপনার গায়ের গন্ধ, আপনার কণ্ঠস্বর, আপনার হাসি, আপনার রাগ সবটা আমার অস্তিত্বে মিশে গেছে। আমি ভেবেছিলাম আপনাকে কোনোদিনও আপন ভাবতে পারবো না। অথচ এই মুহূর্তে আপনার থেকে আপন আমার কাছে কেউ নেই।”

শাফকাতের হৃদয়টা এবার যেন স্পন্দিত হতেই ভুলে গেল। নিঃশ্বাস ফেলতে ভুলে গেল

তার বুকটা। তার সমস্ত পৃথিবীটা নিমিষেই এলোমেলো করে দিয়ে আর্দ্র ভঙ্গিতে হাসছে মেয়েটা। যদিও এভাবেই এলোমেলো হওয়ার জন্যে দিনের পর দিন উদগ্রীব হয়ে ছিল সে।

সাবা শাফকাতের একটা হাত দুহাতে জড়িয়ে ধরে নিজের কোলের ওপর রাখলো। ছোট্ট এই কাজটুকুতে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল শাফকাতের সারা শরীরে। কতটা কড়া শাসনের মাঝে নিজেকে যে সামলে নিলো সে, তা শুধু তারই জানা।

সাবা নিজের দুহাতে আটকে পড়া শাফকাতের হাতটার দিকে দৃষ্টি রেখে বলল, “আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন, এটা যে আমার জন্যে কত বড় পাওয়া। বোঝাই কী করে আপনাকে?”

শাফকাত থমথমে গলায় বলল, “আবারও শুরু করলে?”

সাবা মিনতির সুরে বলল, “শুনুন না প্লিজ!”

আর বাঁধা দেওয়ার অবকাশ পেলো না শাফকাত। দিনের পর দিন নিজের সকল অনুভূতিগুলো হৃদ্‌যন্ত্রের ভেতরে অদৃশ্য একটা খাঁচায় বন্দী করে রেখেছিল সাবা। অবশেষে আজ নিজ থেকে যখন সেই খাঁচার দরজাটা খুলে দিয়েছে, তখন আর তা পুনরায় বন্ধ করে দিতে চায় না শাফকাত।

“আমি একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। আমার ট্রমা, আমার ডিপ্রেশন আমাকে ধোঁয়াশার মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। আমি ভাবতে শুরু করলাম আপনিই আমার সব থেকে বড় শত্রু। আপনার কাছ থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠলাম। সেদিন… সেদিন…”

আরও কিছু বলার চেষ্টা করেও পারছে না সাবা। কথাগুলো ক্রমেই জড়িয়ে যাচ্ছে। গুলিবিদ্ধ হওয়ার সেই স্মৃতি মনে ভেসে উঠলেই শুরু হয়ে যায় তীব্র প্যানিক অ্যাটাক।

শাফকাত তাকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে নরম স্বরে বলল, “থাক না সাবা।”

তবে শান্ত কিছুতেই হলো না সাবা। আজকের এই সুন্দর মুহূর্ত, আকাশের উজ্জ্বল চাঁদ আর পাশে বসে থাকা মানুষটা একটু একটু করে অশান্ত করে তুলেছে তাকে।

সাবা তড়িৎ গতিতে বলল, “না থাকবে কেন? সেদিন ফাহিমের কথাবার্তায় যখন বুঝে ফেলেছিলাম, ও আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে যাচ্ছে – তখনও ঘোরের মধ্যেই ছিলাম জানেন? মনে হচ্ছিল, ইশ! আবারও আপনার কাছে বন্দী হয়ে থাকতে হবে। আমি ভেবেছিলাম ফাহিম গয়নাগুলো ছিনিয়ে নিয়ে আমাকে ওখানেই ফেলে রেখে চলে যাবে। ভুলেও ভাবিনি ও আমাকে… আমাকে গুলি করবে।”

সাবার হাত-পা প্রবলভাবে কাঁপছে। তবুও সত্যিটা স্বীকার করতে পিছিয়ে পড়লো না সে। আচমকা সুপ্ত একটা গর্ববোধ এসে স্পর্শ করলো শাফকাতকে। দু-দিন আগেও মানসিক যন্ত্রণার ছটফট করছিল মেয়েটা। পৃথিবী থেকে গুটিয়ে নিয়েছিল নিজেকে। অথচ আজ সেই সাবাই অকপটে নিজের ভুলগুলো স্বীকার করার সাহস রাখে।

সাবা কম্পিত স্বরে বলল, “যখন প্রথম গুলিটা আমার গায়ে লাগলো, তখন প্রথম চোখের সামনে যার মুখটা ভেসে উঠলো সে আপনি শাফকাত। ওই প্রথম আমি বুঝতে পারলাম, আপনিই আমার একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়। আমার একমাত্র ভরসার জায়গা।”

শাফকাত একটা হাত সাবা গালের ওপরে রেখে বলল, “সাবা তোমাকে বলেছি না? এসব নিয়ে কখনোই অনুতপ্ত হতে হবে না তোমাকে। একটা ভুল করে ফেলেছো তো কী হয়েছে। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

“জানি তো। সব ঠিক হয়ে যাবে। আপনিই সব ঠিক করে দেবেন। তবুও খুব ভয় হয়।”

“কেন সাবা?”

সাবা ভীত কণ্ঠে বলল, “বারবার মনে হয় আমি আপনাকে হারিয়ে ফেলবো। আপনি আমাকে ছেড়ে দেবেন। জানেন? মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে আপনাকে পাশে না আমি চমকে উঠি। আপনার মুখটা দেখেই আমার শান্তি মেলে।”

শাফকাত ক্ষীণ হাসি হেসে সাবার কপালে চুমু খেয়ে বলল, “কোথাও যাবো না আমি। সবসময় তোমার কাছেই থাকবো। প্রমিজ!”

আচমকা শাফকাতকে বিস্ময়ের চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছে দিয়ে সাবা ঝড়ের গতিতে বলল, “I love you Shafkat.”

থ বনে গেল শাফকাত। তার পুরো শরীরটা বরফের ন্যায় জমে গেল। চোখের পলক ফেলতেও ভুলে গেল। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে সাবার অশ্রুভেজা চোখ দুটোর দিকে। সাবাও নিঃশ্বাস আটকে রেখে দেখছে তার ভালোবাসায় শাফকাতের প্রতিক্রিয়া।

অবশেষে নিঃশ্বাস ফেলে সাবা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “আমি ভেবেছিলাম এই কথাটা কখনো আপনাকে বলতে পারবো না। কিন্তু বলছি। আমি আপনাকে ভালোবাসি, অনেক ভালোবাসি। আমার স্বপ্নগুলো যতটা উঁচু, তার থেকেই বেশি ভালোবাসি। আমার ভয়গুলো যতটা তীব্র তার থেকেও বেশি ভালোবাসি। আমাকে ভালোবাসবেন প্লিজ?”

সাবার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে লম্বা লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলো শাফকাত। তবে কিছুতেই সামলাতে পারলো না। মেয়েটা সামান্য কয়েকটা বাক্যে তার যে পরিমাণ ক্ষতি করেছে, তা থেকে সেরে ওঠা এ জীবনে অন্তত সম্ভব নয়।

শাফকাত তো দূর থেকেই ভালোবাসে গেছে সাবাকে। তাকে হারানোর দ্বারপ্রান্তেও ভালোবেসে গেছে। ভেবেছিল জীবনটা বুঝি গোপনে ভালোবেসেই কেটে যাবে। সাবার ভালোবাসা যেহেতু পাবে না, তাই নিজের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশও নেহায়েত বোকামি।

তার ধারণা ছিল, সাবার ভালোবাসা না পেয়েও কেবল তাকে ভালোবেসে যাওয়া নিতান্তই সহজ। তবে সে সব ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো আজ। সাবার মুখ থেকে “ভালোবাসি” শব্দটা শোনার পর তার অন্তরাত্মা দৃঢ় কন্ঠে জানান দিলো, এই শব্দটা শোনার জন্যেই এতকাল ছটফট করছিল সে। তার অর্থহীন জীবনটা যেন আজ পূর্ণতা পেলো ওই একটা মাত্র শব্দে।

সাবা একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে বলল, “কিছু বলবেন না?”

এখনো নিজেকে সামলে উঠতে ব্যর্থ হয়ে শাফকাত বলল, “কী বলবো?”

“একটা প্রশ্ন করলাম, উত্তর দেবেন না?”

শাফকাত দুষ্টুমির ছলে বলল, “ভেবে বলছি।”

সাবা আহত গলায় বলল, “মেয়ে হয়ে আগে ভালোবাসার কথা বললাম বলে ভাব নিচ্ছেন?”

শাফকাত সাবার কপালে কপাল ঠেকিয়ে তার গালে আলতোভাবে হাত রেখে বলল, “এসব ব্যাপারে ছেলে-মেয়ে ম্যাটার করে না। আমার রাগটা অন্য দুটো কারণে?”

সাবা কৌতূহলী কণ্ঠে বলল, “আর সেই দুটো
কারণ কী?”

“দ্বিতীয়টা হলো…”

“দ্বিতীয়টা?”

শাফকাত দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “হ্যাঁ। প্রথমটা পরে বলছি। দ্বিতীয় কারণ হলো, তুমি ভুলে গেছ যে আজকের এই দিনে ঠিক এক বছর আগে আমার জীবনে একটা ঝামেলা হয়ে এসেছিলে।”

সাবা চমকে উঠে বলল, “আজ?”

“হ্যাঁ। আজ।”

সাবার কাছে এখন পরিষ্কার হলো, কেন তড়িঘড়ি করে ঘুরতে আসার পরিকল্পনাটা করেছিল শাফকাত। তড়িঘড়ি করেই তো আজকের এই দিনে গত বছর বিয়েটা হয়েছিল তাদের।

সাবা অনুতপ্ত স্বরে বলল, “সরি শাফকাত, আমার একদমই মনে ছিল…”

শাফকাত তার ঠোঁটে আঙুল রেখে ফিসফিস করে বলল, “হুস! প্রথম কারণটা শোনো।”

নিমিষেই দমে গেল সাবা। তার ঠোঁটের ওপর থেকে এখনো আঙুলটা সরায়নি শাফকাত। শাফকাত কি বুঝতে পারছে না এই স্পর্শ তাকে ছারখার করে দিচ্ছে? উৎকণ্ঠা আর আগ্রহভরা চোখে সাবা তাকিয়ে আছে শাফকাতের দিকে।

সেই চোখ দুটোতে ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে শাফকাত তার মোহনীয় কণ্ঠে বলল, “গত ছয়টা মাস ধরে যে অনুভূতিতে আমি মরে যাচ্ছি, যে অনুভূতি আমাকে রাতে ঘুমাতে দিচ্ছে না, কাজের ফাঁকে বারবার তোমার ভাবনাতেই ডুবিয়ে দিচ্ছে – সেই অনুভূতি তুমি আজ টের পেলে?”

সাবার সর্বাঙ্গে কাঁটা দিয়ে উঠলো। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল মুহূর্তেই। বারবার নিজেকে বোঝাতে চাইলো, সে যা শুনছে তা বাস্তব নয়, স্বপ্নের অংশ। তবে মনটা কিছুতেই বুঝ মানলো না। কারণ এটা স্বপ্নদৃশ্যের অংশ নয়। শাফকাতও স্বপ্নের কোনো চরিত্র নয়। তার একান্ত বাস্তব।

শাফকাত ঘোরগ্রস্ত গলায় বলল, “প্রথম প্রথম মনে হতো তুমি আমার ডিস্ট্র্যাকশন। কাজের বাঁধা। তোমার কথা ভেবে ভেবে কাজে মনোযোগ হারাচ্ছি বলে তোমার চিন্তায় ইস্তফা দিলাম। লাভ হয়নি। আমার মনটা সারাক্ষণ তোমার কাছেই পড়ে থাকে সাবা। ভালোবাসা শব্দটায় কখনোই আমার বিশ্বাস ছিল না। বারবার মনে মনে উপহাস করে নিজেকে প্রশ্ন করতাম, একটা মানুষ আরেকটা মানুষের বেঁচে থাকার কারণ কীভাবে হতে পারে? এখন বুঝি কীভাবে পারে। যেভাবে তুমি পারো, আমার বেঁচে থাকার কারণ হয়ে থাকতে।”

আবারও ভিজে গেল সাবার চোখ দুটো। শাফকাতের ভালোবাসার টের সে পায়নি বললে ভুল হবে। যে মানুষটা বাইরের জগৎ ভুলে তার সঙ্গে দেড় মাস হসপিটালে পড়ে রইলো, সযত্নে তার যন্ত্রণাগুলোকে দূর করে দিলো, তার মাঝে নতুন করে বেঁচে থাকার আগ্রহ জাগিয়ে তুলল – সে সাবাকে ভালোবাসে না তো কাকে বাসে?

তবুও মনের এক কোণে লেগেই ছিল সার্বক্ষণিক দ্বিধা। সে তো যোগ্য নয় শাফকাতের ভালোবাসার। ভালোবাসা পাওয়ার কোনো পথই খোলা রাখেনি সাবা। তবুও কেন মানুষটা ভালোবাসবে তাকে?সেই মানুষটাই কী অবলীলায় ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলো সাবার সমস্ত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব!

শাফকাত আবারও সাবার অশ্রুভেজা চোখ দুটো মুছে দিয়ে। তবে এবার আঙুল দিয়ে নয়, ঠোঁট দিয়ে।

সাবার দুটো চোখে দুটো গাঢ় চুমু খেয়ে শাফকাত বলল, “আমার সাদাকালো জীবনটাকে রঙিন করে দিয়ে, আমার অনুভূতিহীন হৃদযন্ত্রকে অনুভূতিতে ধড়ফড় করিয়ে এখন আমাকেই বলছো ভালোবাসতে? এটাই আমার রাগের প্রথম কারণ। যাকে এতদিন ধরে ভালোবেসে আসছি, তাকে নতুন করে ভালবাসবো কী করে? সাবা তুমি কি বোঝো না আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি? টের পাও না।

সাবা হঠাৎ জড়িয়ে ধরলো শাফকাতকে। তার কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে অস্থির কণ্ঠে বলল, “পাই তো।”

সাবার চুলের মাঝে হাত বুলিয়ে তাকে বুকে জড়িয়ে রাখলো শাফকাত। সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর দুটো মানুষ আজ কত কাছাকাছি, নির্দ্বিধায় একে অপরের হৃদস্পন্দন শুনতে ব্যস্ত তারা।

গত বছর ঠিক এই দিনে সাবা যখন প্রথম দেখেছিল শাফকাতকে, তখন মনে হয়েছিল দুঃস্বপ্নেও এই মানুষটাকে কখনো আপন করে নিতে পারবে না সে। শাফকাত ভেবেছিল তার যান্ত্রিক জীবনে আচমকা উড়ে এসে জুড়ে বসা মেয়েটাকে যত পারবে এড়িয়ে চলবে। কোনোদিন ভাবতেও পারেনি একদিন তার প্রতিটা হৃদস্পন্দনে কেবল এই রাগী মেয়েটার নামই লেখা থাকবে।

বেশ অনেকটা সময় শাফকাতের বুকের মাঝে মুখ লুকিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরেই কাটালো সাবা। মাঝে মাঝে একটা মিষ্টি হাওয়া গায়ে লাগছে, কানে বাজছে স্ক্রিনে প্রদর্শিত সিনেমার অস্পষ্ট আওয়াজ। কোনো কিছুই পেলো না সাবার মনোযোগ। তার সকল ব্যস্ততা কেবল শাফকাতের হৃদয়ের ধুকপুক শোনায়।

নীরবতা ভঙ্গ করে শাফকাত তার বুকের মাঝ থেকে সাবার মুখটা তুলে ধরে হালকা গলায় বলল, “হয়েছে। অনেক কান্নাকাটি হয়েছে। কাজল লেপ্টে কী অবস্থা! হরর সিনেমার ভূতের মতো লাগছে তোমাকে।”

সাবা হেসে ফেলে বলল, “ভালো হয়েছে। এই ভূতের সাথেই আপনাকে থাকতে হবে সারাটা জীবন।”

শাফকাত আশ্বাস দিয়ে বলল, “থাকবো তো। আমার লেবুর সাথে।”

মিষ্টি হেসে সাবা আবারও মুখ লুকিয়ে রাখলো শাফকাতের বুকে। মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করলো, আর কিছুতেই এই মানুষটার চোখের আড়াল হবে না। জীবনে যত ঝড়-ঝাপটাই আসুক না কেন শাফকাতের পাশে থাকবে সে, তার একান্ত লেবু হয়ে।

শাফকাত হঠাৎ ব্যস্ত গলায় বলল, “ভেতরে চলো!”

“সিনেমাটা শেষ করবো না?”

“শুরু থেকে দেখতেই তো দিলে না! এখন চলো অন্য সিনেমা দেখবে।”

ভিলার বাইরের অংশে কাঠের বারান্দা। বারান্দার ওপরে টিনের ছাদ। বারান্দার শেষপ্রান্তে সাবাকে নিয়ে এলো শাফকাত। বারান্দার অন্যান্য প্রান্তে সোনালি আলো থাকলেও এখানে একেবারেই অন্ধকার। পাঞ্জাবির পকেট থেকে লাইটার বের করলো শাফকাত। অন্ধকারেই পা ফেলে এগিয়ে গেল। আগে থেকেই পুরো জায়গাটার নানা প্রান্তে সুগন্ধিযুক্ত মোমবাতি সাজিয়ে রাখা ছিল। এগুলোই একটা একটা করে জ্বালিয়ে দিলো শাফকাত।

একটু একটু করে মোমের আলোয় বারান্দা ছেয়ে গেল, আর প্রশস্ত হয়ে উঠলো সাবার ঠোঁটের হাসি।

একটা গোলাকার কাঁচের টেবিলে গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে রাখা। তার পেছনে দুটো বেতের সোফা। একটাতে সাবাকে বসিয়ে রেখে শাফকাত কোথায় যেন চলে গেল। মিনিট খানেকের মাঝেই ফিরে এলো একটা কেক নিয়ে।

কেকটা একটা মেয়ের আকৃতির। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। তার পরনে বেগুনি শার্ট আর জিন্স। চুলগুলো ঝুঁটি করে রাখা। হাতে মাইক্রোফোন। সাবা হেসে ফেলল আনমনেই। তাকে মাথায় রেখেই যে কেকটা তৈরি করা হয়েছে, এতে কোনোই সন্দেহ নেই।

শাফকাত কেকটা টেবিলে নামিয়ে রাখতেই সাবা বলল, “এটা তো শুধু আমি। অ্যানিভার্সেরি কি আমার একার?”

শাফকাত শান্ত ভঙ্গিমায় বলল, “তুমি থাকলেই আমার চলবে।”

দুজনে পাশাপাশি বসে কেকটা কাটলো। শাফকাত আগে কেক খাইয়ে দিলো সাবাকে। সাবারও এক টুকরো কেক তাকে খাইয়ে দিয়ে মিষ্টি গলায় বলল, “Happy Anniversary Shafkat.”

শাফকাত অন্যরকম সুরে বলল, “আর হ্যাপি! বিয়ের পর পেরিয়ে গেল অথচ বউকে কাছে পেলাম না, আদর করতে পারলাম না।”

আচমকা লজ্জায় জমে গেল সাবা। তার গাল দুটো রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। ঘোরলাগা দৃষ্টিতে শাফকাত তাকিয়েই আছে তার দিকে। এক মুহূর্তের জন্যেও অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নিচ্ছে না। সে কি জানে না, ওই চাহনি সাবাকে অতিষ্ঠ করে দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট?

সাবা চোখ নামিয়ে কম্পিত স্বরে বলল, “তো কেউ কি নিষেধ করেছে?”

শাফকাত ভ্রু ওপরে তুলে বলল, “বউ নিজেই তো বলেছে। কী যেন বলেছিলে? আমি এসবের জন্য প্রস্তুত নই।”

সাবা থতোমতো খেয়ে কোনোমতে বলল, “ওটা তো এমনিই বলেছিলাম। আমি…”

“তুমি কী? প্রস্তুত?”

চোখ নামিয়ে রাখা সত্ত্বেও সাবা বেশ টের পেলো শাফকাতের তৃষ্ণার্ত চোখ দুটো এখনো তাকিয়ে আছে তার দিকে।

খুব ইচ্ছে হলো একবার চোখ তুলে তাকিয়ে সেই সর্বনাশা চাহনিতে ডুব দিতে। এবার আর পিছিয়ে গেল না সাবা। চোখ তুলে তাকালো শাফকাতের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে ধ্বক করে কেঁপে উঠলো তার বুকটা।

শাফকাত এমনভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে, যেন বহু বছর অন্ধত্বের দাসত্বে ছিল। এই মাত্র দৃষ্টি ফিরে পেয়েছ। সাবার নিঃশ্বাস ঘন হয়ে এলো। নিজেকে সামলানোর ব্যর্থ চেষ্টা স্বরূপ শক্ত করে খামচে ধরলো নিজেরই শাড়ির আঁচল।

শাফকাত একটু একটু এগিয়ে আসছে তার দিকে। দৃষ্টি আটকে আছে তার ঠোঁট দুটোর দিকে। আজ রাতে এতটা দীর্ঘ সময়ে কথা না বলে কাটায়নি তারা। তবে এখন মনে হচ্ছে এই নীরবতার মাঝেই গোটা একটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া দুঃসাধ্য কিছু নয়।

শাফকাতের ঠোঁট দুটো নির্দ্বিধায় নিজের দখলে নিয়ে গেল সাবার ঠোঁট দুটোকে। একহাতে সাবার উন্মুক্ত কোমড় জড়িয়ে ধরলো শাফকাত। আরেকটা হাতে সাবার কানের নিচ দিয়ে ঘাড় স্পর্শ করলো। সাবারও তার কাঁপা কাঁপা হাত দুটো দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো শাফকাতের গলা।

প্রাণের সবটুকু উচ্ছ্বাস দিয়ে সাবাকে চুমু খাচ্ছে শাফকাত। ভালোবাসা পাবার উচ্ছ্বাস, ভালোবাসা প্রকাশের উচ্ছ্বাস, ভালোবাসার মানুষটাকে অবশেষে বাহুডোরে পাবার উচ্ছ্বাস। সবটাই প্রকাশ পাচ্ছে তার ঠোঁট দুটোর সাবার ঠোঁটে বিচরণে।

সাবার পাগলপ্রায় অবস্থা। হঠাৎ তার ঠোঁট ছেড়ে দিলো শাফকাত। তার কোমড় থেকে হাতও সরিয়ে ফেলল। সাবা প্রশ্নসূচক বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে।

শাফকাত অস্থির কণ্ঠে বলল, “উঠে দাঁড়াও।”

সাবা অবাক গলায় বলল, “মানে?”

বেশি কিছু ব্যাখ্যা করার অবস্থায় শাফকাত নেই। পুনরায় নির্দেশের সুরে বলল, “উঠে দাঁড়াও!”

এই প্রথম বোধ হয় শাফকাতের কোনো নির্দেশ বিনা বাক্য ব্যয়ে, প্রফুল্ল চিত্তে মেনে নিলো সাবা। বেতের সোফাটা ছেড়ে সে উঠে দাঁড়াতেই শাফকাত হ্যাঁচকা টানে তাকে বসিয়ে দিলো কোলের ওপরে। টাল সামলাতে ব্যর্থ হয়ে সাবা আঁকড়ে ধরলো তার কাঁধ।

বেচারিকে দম নেবার ফুরসতটুকু না দিয়ে শাফকাত আবারও ব্যস্ত হয়ে গেল তার ঠোঁট দুটো নিয়ে। সাবার চুলে হাত ডুবিয়ে তৃষ্ণার্তের ন্যায় চুমু খাচ্ছে শাফকাত। যেন ডুবে যাচ্ছে সে, আর সাবাই অক্সিজেনের একমাত্র উৎস।

ঠোঁট ছেড়ে এবার শাফকাত মুখ ডুবিয়ে দিলো সাবার ঘাড়ে। নিমিষেই চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিলো গোটা ঘাড়। শিহরণে পাগল হয়ে সাবা শক্ত করে খামচে ধরলো তার পাঞ্জাবি।

ঘাড়ে ঠোঁটের রাজত্ব চালাতে চালাতেই শাফকাতের হাত চলে শাড়ির আঁচলে। এক টানে আঁচলটা সরিয়ে ফেলে দিলো শাফকাত। সাবা লজ্জায় জড়সড় হয়ে যে নিজেকে গুটিয়ে নেবে, সেই উপায়ও পেলো না। আবারও তার ঠোঁটে গাঢ় স্পর্শ দিলো শাফকাত। সাবার ঠোঁটে আশপাশ, গলার নীচ, কাঁধ – কোনো অংশই বঞ্চিত হলো না শাফকাতের ঠোঁটের আদর থেকে।

সাবার গলার নীচ থেকে মুখ তুলে এক দফা তাকে দেখে নিলো শাফকাত। চোখ বন্ধ করে কম্পিত ভঙ্গিতে নিঃশ্বাস ফেলছে মেয়েটা। একটা মানুষের নিঃশ্বাস ফেলার ভঙ্গি এতটা আকর্ষণীয় হয় কী করে?

সাবার কানের লতিতে আলতো কামড় দিতে দিতে শাফকাত তার ব্লাউজের পেছনের হুকগুলো একটা একটা করে খুলছে। ওদিকে সাবা যে লজ্জায় একেবারে শেষ হয়ে গেল, সেই খবরই তার অজানা রইলো না।

হঠাৎ সাবার দিকে তাকিয়ে শাফকাত তার দুটো হাত ধরে এনে রাখলো পাঞ্জাবির বোতামের সামনে।

ফিসফিস করে বলল, “খোলো!”

লজ্জায় ডুবে যাওয়া সত্বেও এবারও তার নির্দেশ পালনে কমতি রাখলো না সাবা। সাবা একটা একটা করে পাঞ্জাবির বোতাম খুলছে, আর একটু একটু করে প্রবল তরঙ্গে গা ভাসাচ্ছে শাফকাত।

শাফকাতের উন্মুক্ত বুক চোখের সামনে ভেসে উঠতেই সারা গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো সাবার। বাকি দুনিয়াটা যেন ঘোলাটে হয়ে গেল। শাফকাত ছাড়া আর দ্বিতীয় কিছু আকর্ষণ পেলো না তার।

উত্তেজনায় পাগল হয়ে সাবা এগিয়ে গিয়ে নির্লজ্জের মতো চুমু খেলো শাফকাতের বুকে। এতটুকুই দিশেহারা শাফকাতের দিশাহীন করে দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট। সাবাকে কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে। সাবার শাড়ির আঁচল মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ রইলো না তার।

আবারও ঠোঁট দিয়ে সাবার ঠোঁটে বিচরণ করতে করতে দোতলায় নিজেদের ঘরে এসে পৌঁছালো শাফকাত। পা দিয়ে দরজাটাকে কোনোক্রমে ঠেলে সাবাকে বিছানায় নামিয়ে দিলো।

লজ্জায় উপুড় হয়ে শুয়ে বিছানায় মুখ লুকিয়ে রাখলো সাবা। একটু আগে সে কী করেছে ভাবতেই কান দুটো গরম হয়ে গেল।

কাছে এসে তাকে চিৎ করে শুইয়ে দিলো শাফকাত। তার খোঁচা খোঁচা দাড়ি ঘষে দিলো সাবার ঘাড়ে। এবার আর কিছুই নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না সাবা।

অস্ফুট স্বরে করলো মিষ্টি আর্তনাদ, “শাফকাত!”

শাফকাত তার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, “তোমাকে আজ আমি শেষ করে ফেলবো লেবু। জাস্ট শেষ করে ফেলবো।”

সাবা কাঁপা কাঁপা কয়েকটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “ফেলো।”

সাবাকে শেষ করার সংকল্পবদ্ধ হয়েও তার কণ্ঠে সামান্য এই একটা বাক্যে নিজেই শেষ হয়ে গেল শাফকাত।

(চলবে)