#লেবু
৬০
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
আজ অমাবস্যা কিনা কে জানে? মাথার ওপরে চাঁদটাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এই এলাকার মানুষেরা একটু আগেভাগেই ঘুমিয়ে পড়ে। রাত দশটার পরই নেমে এলো পিনপতন নীরবতা।
যূথীদের বাড়ির পেছনের দিকে সাবার গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। সাবার হাতে ক্যামেরা। ওই বাড়ির সামনে কেউ এলেই শুরু করবে ভিডিও ধারণ। যদিও ভয়ের কোনো কারণ নেই। গাড়ির সামনেই লাইসেন্স করা বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে আছে তার বডিগার্ড জহুরুল। তবুও ভয়ের মৃদু একটা স্রোত স্পর্শ করলো সাবাকে। তার দুঃসাহসের কারণেই তো সেবার অমন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হলো।
তবুও মনের অদৃশ্য একটা জোর বারবার তার ভয়টাকে দূর করে দিচ্ছে। সেবার তার উদ্দেশ্যে দোষ ছিল বলেই হয়তো প্রকৃতি শাস্তিস্বরূপ অমন সংকটের মুখে ঠেলে দিয়েছিল তাকে। কিন্তু এবার তো কোনো দোষ নেই তার উদ্দেশ্যে। তার একটাই উদ্দেশ্য, শাফকাতকে জেল থেকে বের করে আনা। যে মানুষটা এই ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে রয়েছে তাকে খুঁজে বের করা।
অরুণ হাই তুলতে তুলতে বলল, “তোর সত্যিই মনে হয় এতে কোনো কাজ হবে? তোর কী ধারণা? রাতে চারিদিকে নীরব হয়ে গেলে যূথী এখানে আসে?”
সাবা জানালা দিয়ে একদৃষ্টিতে যূথীদের বাড়িটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “আসতেও তো পারে।”
অরুণ দৃঢ় গলায় বলল, “পারে না সাবা।”
“কেন?”
“তোর ধারণা মেয়েটা নিজে লুকিয়ে থেকে ওই রাব্বির সাথে হাত মিলিয়ে শাফকাত ভাইয়াকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে। তাই তো?”
“হ্যাঁ।”
অরুণ বিজ্ঞ গলায় বলল, “তাই যদি হয়, তাহলে তো এখন তার লুকিয়ে থাকার কথা। নিজেকে একটা ঘরের মধ্যে বন্দী করে ফেলা। সে কেন শুধু শুধু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঘুরে বেড়াবে?”
সাবা পাল্টা যুক্তি দেখিয়ে বলল, “বাবা-মায়ের টানে আসলে তো আসতেও পারে।”
অরুণ হতাশ গলায় বলল, “আসবে না। তুই শুধু শুধু সময় নষ্ট করছিস।”
সাবা ভ্রু কুঁচকে বলল, “বিরক্ত করিস না অরুণ। তোর ভালো না লাগলে ঘুম দে। আমাকে আমার কাজটা করতে দে!”
অরুণ সত্যি সত্যিই মিনিট কয়েকের মাথায় ঘুমিয়ে পড়লো। জেগে রইলো সাবা একা। উদগ্রীব দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ওই বাড়িটার দিকে। বাড়ির সামনের উঠানে জিরো পাওয়ারের একটা বাল্ব জ্বলছে। সাবার ক্যামেরা সেদিকেই ফোকাস করে রাখা। গাড়িটা এমনভাবে পার্ক করে রাখা হয়েছে, যাতে বাড়ির সামনে কেউ এসে দাঁড়ালেই সে দেখতে পায়।
দু ঘন্টা পেরিয়ে গেল। এখনো ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে একই ভঙ্গিতে বসে আছে সাবা। ক্লান্তিতে তার শরীর ভেঙে আসছে। এমনিতেই শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। প্রেগন্যান্সির কারণে দিনভর বমি বমি ভাব তো লেগেই আছে। তার ওপরে আবার আজ সকাল থেকে ছোটাছুটি করছে সে। শেষ কখন একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বিশ্রাম নিয়েছিল, সাবা মনেই করতে পারলো না।
এক পর্যায়ে সাবার চোখদুটোও লেগে এলো। তবুও অস্পষ্ট ক্লান্তিমাখা চোখে একদৃষ্টিতে সেই বাড়িটার দিকেই তাকিয়ে রইলো সে। আচমকা ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো সাবা। চোখদুটোতে ঘুমেরা যেন ছুটে পালালো। ব্যস্ত হাতে ক্যামেরায় রেকর্ড বাটনে চাপ দিলো সাবা।
যূথী আসেনি, তবে বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে একটা লোক। তার মাথা কালো হুডিতে ঢাকা। আর মুখ ঢাকা সার্জিক্যাল মাস্কে। দরজার কড়া সে নাড়লো না। বরং পকেট থেকে মোবাইল বের করে কার যেন নম্বরে ডায়াল করলো।
খানিকক্ষণের মাঝেই ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো যূথীর বৃদ্ধ বাবা। কালো হুডি পরিহিত লোকটা তার হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিলো। বৃদ্ধ প্যাকেট থেকে বের করলো এক বান্ডিল টাকা! জিরো পাওয়ারের বাল্বের ক্ষীণ আলোতেই একের পর এক নোটে থুতু দিয়ে গুনছে সে।
একটা মানুষের মস্তিষ্কে যে একই সঙ্গে এত চিন্তা ঘুরপাক খেতে পারে, নিজেকে না দেখলে কখনো জানতেই পারতো না সাবা। ওই লোকটা কে? ওই লোকটাই কি যূথীকে আটকে রেখেছে? টাকার বিনিময়ে তার বাবা-মায়ের মুখ বন্ধ রাখছে? আচ্ছা তার মানে কি শাফকাতের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে রয়েছে ওই লোকটাই? একেকটা প্রশ্ন একটু একটু করে উত্তপ্ত করে তুলছে সাবার মস্তিষ্ককে।
যেমন চুপিসারে কালো হুডি পরিহিতর আগমন ঘটেছিল, ঠিক সেভাবেই বিদায় নিলো সে। তার পিছু নেবে ভেবেও শেষমেশ গাড়ির ভেতরেই বসে রইলো। লোকটা একা না-কি আশেপাশে দলবল লুকিয়ে রেখেছে সে জানে না। তার কাছে গোপন অস্ত্রশস্ত্র আছে কিনা তাও জানে না। আরও একবার নিজেকে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে চায় না সাবা। এখন আর সে একা নয়। সে বিপদে পড়লে, বিপদে পড়বে তার ভেতর লুকিয়ে থাকা ছোট্ট প্রাণটাও।
তবে হাত গুটিয়ে বসে থাকার পাত্রী সাবা নয়। লোকটা চোখের আড়াল হতেই অরুণকে ডেকে তুললো সাবা। অরুণ হুড়মুড়িয়ে উঠে বসতেই তার ক্যামেরায় ধারণ করা দৃশ্য দেখে চমকে উঠলো। সাবা অরুণ আর জহুরুলকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে গেল বাড়িটার দিকে।
বাড়ির কাঠের দরজায় সজোরে ধাক্কা দিতেই বিকট শব্দে কেঁপে উঠলো চারিপাশ। একবার ধাক্কা দিতেই ভেতর থেকে দরজাটা খুলে গেল।
সাবা দেখতে পেলো যূথীর বৃদ্ধ বাবার বিভ্রান্ত মুখটা।
সাবার ধৈর্যের সমস্ত বাঁধ ভেঙে গেছে। এই মুহূর্তে ওই মেয়েটাকে তার চাই।
ধৈর্যহারা তেজি কণ্ঠে সাবা বলল, “ওই লোকটা এইমাত্র আপনাদের টাকা দিয়ে গেল কেন?
বৃদ্ধ থতমত খেয়ে বললেন, “কই না তো!”
বৃদ্ধের অস্বীকারে সাবার রাগের সকল মাত্রা ছাড়িয়ে গেল। ক্রব্ধ ভঙ্গিতে ক্যামেরায় একটু আগে ধারণ করা ভিডিওটা বৃদ্ধের দিকে ফিরিয়ে বলল, “মিথ্যা বলার চেষ্টা করবেন না। আমার কাছে ভিডিও আছে! ভিডিওতে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে আপনি টাকা গুনছেন।”
আরেকদফা থতমত খেলেন বৃদ্ধ। এতক্ষণে দেখা গেল যূথীর মাকে। জীর্ণশীর্ণ শরীর নিয়ে বৃদ্ধের পাশে এসে দাঁড়িয়ে চোখ পিটপিট করে ভিডিওটা দেখলেন তিনি।
সাবা হুমকির সুরে বলল, “বেশি চালাকি করার চেষ্টা করলে কিন্তু এই ভিডিও পুলিশের কাছে চলে যাবে। আপনাদের সব নাটক ধরা পড়ে যাবে।”
পুলিশের নাম শুনতেই যূথীর মা আঁতকে উঠে বললেন, “মা! আমরা গরীব মানুষ মা!
আমাগো এত বড় ক্ষতি কইরো না।”
সাবা কঠিন গলায় বলল, “ওই লোকটা কে?”
বৃদ্ধ অনেকটা সময় চুপ করে থেকে অসহায় ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বললেন, “চিনি না।”
সাবা রাগে ফেটে পড়ে বললেন, “চেনেন না মানে? যে লোক আপনাদের এতগুলো টাকা দিয়ে গেল তাকেই চেনেন না?”
“না মানে…”
“ওই লোকটাই আপনাদের মেয়েকে লুকিয়ে রেখেছে তাই না?”
বৃদ্ধা শুকনো মুখে বললেন, “না মা।”
“তাহলে কে সে?”
বৃদ্ধা স্বামীর দিকে কতক্ষণ অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলেন। তার কাছ থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে নিজেই চাপা স্বরে বললেন, “ওই ছেমরারে যূথী পাঠাইছে।”
সাবা হকচকিয়ে গিয়ে বলল, “কে পাঠিয়েছে?”
“যূথী।”
সাবা আর অরুণ ঘরে এসে বসলো। এসব গোপন কথা বাইরের মানুষ শুনলো বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বিপদে পড়তে পারেন। জহুরুল বাইরেই বন্দুক হাতে অপেক্ষা করছে।
সাবার মনটা ক্রমশ উশখুশ করছে। শাফকাতের গ্রেফতারের পর থেকেই তার মন বলছিল যূথী মেয়েটা নিজ থেকে লুকিয়ে আছে। তবে মনের ধারণাকে সত্য করার কোনো প্রমাণ ছিল না। এখন তো প্রমাণ হাতে না হাতে পেয়ে গেল!
সাবা অধৈর্য কণ্ঠে বলল, “কোথায় আপনাদের মেয়ে? কোথায় লুকিয়ে আছে? তাড়াতাড়ি বলে দিন না হলে মেয়ের সাথে আপনাদের দুইজনকেও জেলে যেতে হবে।”
বৃদ্ধ পুলিশের হুমকি পেয়ে গোমড়া মুখে বললেন “আমরা জানি না যূথী কই।”
সাবা বিরক্ত গলায় বলল, “আপনারা কী বুঝতে পারছেন না আমার কাছে মিথ্যা বলে কোনো লাভ নেই?”
বৃদ্ধা আর্দ্র গলায় বললেন, “সত্যি বলতেছি গো মা, আমরা জানি না”
“মানে?”
বৃদ্ধা আঁচলে চোখ মুছে বললেন, “যূথী কই আমরা কেমনে জানতাম? ওই মাইয়া তো আমাগো না।”
সাবা আকাশ থেকে পড়ে বলল, “হ্যাঁ?”
বৃদ্ধা এক দফা স্বামীর গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে বললেন, “ওর আসল নামও যূথী না। ওর নাম ফারহানা।”
সাবার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। হচ্ছে কী এসব তার সঙ্গে? শাফকাতের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী তাহলে সাধারণ কর্মচারী নয়। ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে রয়েছে বড় কোনো উদ্দেশ্য।
বৃদ্ধা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “আমাগো একটাই পুলা আছিলো। বই বৎসর আগে…”
কথাটা শেষ করার আগেই তিনি কেঁদে ফেললেন। কাঁদতে কাঁদতে আবারও আঁচলে চোখ মুছলেন। অরুণ তার পাশে গিয়ে বসে সান্ত্বনাস্বরূপ তার হাতটা ধরলো।
নিজেকে সামলে নিয়ে বৃদ্ধা আবারও বললেন,
“বসে নিচে চাপা পইড়া মইরা গেল। আমরা বুড়া মানুষ। পুলা মরার পর দেখার আর কেউ নাই। উনার বয়স হইছে। আগের মতো আর কাম-কাজ করতে পারে না। উনি ফারহানাগো বাড়ির কেয়ারটেকার আছিলো। অভাবের কথা মাইয়ারে বলছে পরে মাইয়া বলছে এই গাজীপুরে একটা ঘর ভাড়া নিয়া দিবো। মাসে মাসে খরচ পাঠাইবো। খালি এইখানের মাইনসেরে কওন লাগবো, যূথী আমাগো মাইয়া আর হেয় ফ্যাক্টরিতে কাম করে।”
অরুণ বিভ্রান্ত গলায় বলল, “ফারহানাদের বাড়ি মানে? ওদের নিজেদের বাড়ি আছে?”
“ওই ফেলাট আর কি।”
“তার মানে তো ভালো ফ্যামিলির মেয়ে।”
সাবা দীর্ঘ নীরবতা ভঙ্গ করে অন্যমনস্ক সুরে বলল, “এখানে আপনাদেরকে ঘর ভাড়া নিয়ে দেওয়া, নকল নাম দিয়ে আপনাদের মেয়ে সাজা সবটাই তার ছিল তার প্ল্যান? এমনকি ওই ফ্যাক্টরিতে কাজ নেওয়াও প্ল্যানের অংশ ছিল?”
বৃদ্ধা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন।
অরুণ চিন্তিত গলায় বলল, “তার মানে তো অনেকদিন ধরে শাফকাত ভাইয়াকে ফাঁসানোর প্ল্যান করছে।”
“হুঁ, যে প্ল্যানে রাব্বিও ইনভলভড। আমার ধারণা আরশাদ হক ওকে পুলিশের কাছে যেতে বাধ্য না করলেও কিছুদিন পর নিজ থেকেই পুলিশের কাছে ধরা দিয়ে শাফকাতের নামে মিথ্যা স্বীকারোক্তি দিতো।”
অরুণ বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে বলল, “আচ্ছা এই যূথী… মানে ফারহানার বাড়ির ঠিকানা আছে আপনাদের কাছে?”
“আছে তয় ওইখানে এখন আর কেউ নাই।”
“মানে?”
“আমরা এইখানে আসার পর পরই না-কি পুরান ফেলাট বেচাইচা নতুন ফেলাটে উঠছে।”
“তাহলে কীভাবে খুঁজে পাই?”
হঠাৎ মনে মনে চমকে উঠলো সাবা। তার চিন্তা-ভাবনা সব আটকে গেল ওই একটা শব্দে। ফারহানা। এই নামটা আগেও সে বেশ কয়েকবার শুনেছে। যার মুখে শুনেছে, যার নামটা মনে ভেসে উঠতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। সাবা মনেপ্রাণে প্রার্থনা করছে, তার আশঙ্কা যেন সত্য না হয়।
তবুও ভয়ে ভয়ে বৃদ্ধাকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলো, “ফারহানার পুরো নাম কী ফারহানা চৌধুরী?”
বৃদ্ধা হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে বললেন, “হ।”
“বাবার গার্মেন্টসের ব্যবসা আছে আর মা ছোটবেলাতেই মারা গেছে?”
“হ।”
“বড় ভাই আছে?”
“হ।”
“এই ভাইটা কি দীর্ঘদিন বিদেশে ছিল? ফিরে আসার কিছুদিনের পরেই পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যায়?”
বৃদ্ধ চমকে উঠে বললেন, “হ, হ! তয় পুলিশ ধইরা নিয়া যায় নাই। ওরে কেডা জানি গুলি কইরা রাস্তায় ফেলায় রাখছিল। পুলিশ রাস্তা থেইকা তুইলা জেলে নিয়া গেছিল। ওই পুলা আবার জানি কোন মাইয়ারে গুলি করছিল। একবার ফারহানার লগে জেলে গেসিলাম। পুলাডা আর হাঁটতে পারে না। তয় আপনে এত কথা কেমনে জানলেন?”
সাবার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এলো। শাফকাতের এত এত শত্রু, ভেবেছিল তাদের মধ্যেই কেউ একজন এই ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে রয়েছে। ঘূর্ণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি, ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে থাকা শত্রুর সকল শত্রুতা তার প্রতি।
সাবা বিড়বিড় করে বলল, “কারণ যে মেয়েটাকে ফারহানার ভাই গুলি করেছিল, সে আমি।”
(চলবে)
#লেবু
৬১
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
জঙ্গলের ঠিক মাঝখানে পরিত্যক্ত কুড়ে ঘর। এই জায়গাটার ঠিকানাই দিয়েছে রাব্বি। আজ সকাল সকাল কারাগারে উপস্থিত হয় সাবা। সকলেরই ধারণা ছিল সে দেখা করতে এসেছিল শাফকাতের সঙ্গে। কিন্তু সেই ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে সাবা দেখা করেছে রাব্বির সঙ্গে।
যদিও শাফকাতের দেখার জন্যে তার মনটা ছটফট করছে, তবুও তার সঙ্গে দেখা করলো না সাবা। এই মুহুর্তে শাফকাতকে দেখার চাইতেও তাকে কারাগারের বাইরে দেখার আকুলতা খেলে বেড়াচ্ছে সাবার ভেতরটা জুড়ে।
রাব্বি পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তি দিয়েছে, শাফকাতের নির্দেশে যূথী নামক মেয়েটাকে অপহরণ করেছে সে। অপহরণের দায়ে তাকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। সাবাকে দেখে রাব্বি থতমত খেয়ে কতটা সময় বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইলো তার দিকে।
তবে সাবা ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বলল, “কত টাকা দিয়ে কিনেছে তোমাকে ফারহানা?”
প্রবলভাবে হকচকিয়ে গেল। নিজেকে সামলানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেও পাড় পেলো না। তীব্র চমকে তার চোখদুটো চকচক করছে।
কাঁপা কাঁপা গলায় রাব্বি বলল, “কী যে বলেন ম্যাডাম!”
সাবা কঠোর গলায় বলল, “মিথ্যা বলার চেষ্টা করলে এর থেকেও জটিল কেসে ফাঁসিয়ে দেবো তোমাকে। তোমার কুকর্ম নিয়ে আস্ত একটা ফাইল আছে শাফকাতের অফিসে।”
শাফকাতের নিয়মের বেড়াজালে বাইরে গিয়ে প্রতিশোধ নেওয়ার একমাত্র সাক্ষী রাব্বি। সেই প্রভাবশালী নেতা সাবার গাড়িতে হামলা করানোর পর রাব্বিই দলবল নিয়ে মাঝরাতে তার বাড়িতে পাল্টা হামলা চালায়। নিয়মের বেড়াজালের বাইরে গিয়ে বহুবার সে শাফকাতের নির্দেশ পালন করেছে। সেসবের ফাইল যত্ন করেই সংরক্ষণ করেছে শাফকাত।
সাবা আবারও বলল, “আর যদি সত্যি বলো তাহলে ফারহানার থেকেও দ্বিগুণ টাকা আমি তোমাকে দেবো। তোমাকে শুধু বলতে হবে মেয়েটা কোথায়।”
রাব্বি কিছুটা সময় চুপ করে থেকে মিনমিনে স্বরে বলল, “উনি দুই লাখ দিসিলো।”
মনে মনে অবাক না হয়ে পারলো না সাবা। শাফকাতের প্রতি এত বছরের আনুগত্যের জলাঞ্জলি দিয়ে দিলো মাত্র দুই লাখ টাকার বিনিময়ে?
তবুও বিস্ময়টা ঢেকে রেখে সাবা বলল, “বেশ, আমি তোমাকে পাঁচ লাখ দেবো। দ্বিগুণেরও বেশি। ফ্যাক্টরিতে তোমার যে অ্যাকাউন্ট নম্বর দেওয়া আছে সেখানেই পাঠাবো তো?”
রাব্বি হতভম্ব ভঙ্গিতে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লো। সাবা হ্যান্ডব্যাগ খুলে কাকে যেন ফোন করলো।
ফোনালাপ শেষে রাব্বির দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার টাকা কালকের মধ্যে অ্যাকাউন্টে পৌঁছে যাবে। এখন বলো যূথী কোথায়।”
টাকার বিনিময়ে ফারহানা প্রতি আনুগত্যের জলাঞ্জলি দিতেও সময় লাগলো না রাব্বির। বিড়বিড় করে ঠিকানা দিলো গাজীপুরে মাঝ জঙ্গলের এই কুড়ে ঘরটার। গতকালই গাজীপুর থেকে ঘুরে গেল সাবা। অথচ ঘূর্ণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি এখানেই লুকিয়ে আছে ফারহানা।
কুড়ে ঘরের দরজায় কয়েকবার টোকা দিতেই ভেতর থেকে দরজাটা খুলে গেল। ক্ষীণকায় শরীরের একটি মেয়ে বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। মেয়েটার চোখমুখ শুকনো। ঠোঁট ফেটে চৌচির অবস্থা। চুলগুলো উশকো-খুশকো। সে যে ফাহিমের বোন, তা তার চেহারাতেই স্পষ্ট। দুই ভাই-বোনের অবিকল একই চোখ, একই নাক।
সাবাকে দেখে মেয়েটা মোটেও অবাক হলো না। বরং ঠোঁটের কোণে মলিন একটা হাসি টেনে বলল, “সাবা আমির! আমি জানতাম আপনি আসবেন।”
সাবা জানতো মেয়েটা তাকে দেখেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাবে না। বরং ভাবলেশহীনভাবে
শান্ত থাকার চেষ্টা করবে।
ফারহানা ব্যর্থ সুরে বলল, “রাব্বি আপনার কাছেও বিক্রি হয়ে গেল তাই না?”
সাবা তার দিকে তীক্ষ্ম একটা হাসি ছুঁড়ে দিয়ে বলল, “সেটাই কি স্বাভাবিক না? রাব্বির মতো মানুষ টাকার বিনিময়ে সব পারে।”
ফারহানা পেছনে উঁকি-ঝুঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে সাবা সঙ্গে করে কাউকে নিয়ে এনেছে কিনা।
তার দুশ্চিন্তাকে অগ্রাহ্য করে সাবা বলল, “ভেতরে আসতে বলবে না?”
ফারহানা ভ্রু ওপরে তুলে বলল, “আমার পরিচয় নিশ্চয়ই আপনি জেনে গেছেন।”
“হুঁ, জেনেছি।”
“তবুও ভেতরে আসতে চাইছেন?”
সাবা রহস্যের হাসি হেসে বলল, “তুমি নিশ্চয়ই বাঘ বা ভাল্লুক নও যে ভেতরে গেলে আমার প্রাণ কেড়ে নেবে!”
ফারহানা স্বাগত না জানালেও সাবা তাকে পাশ কাটিয়ে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলো।
ফারহানা অনিশ্চিতার সুরে বলল, “আপনি সত্যি কাউকে সঙ্গে করে আনেননি?”
“বিশ্বাস না হলে বাইরে গিয়ে চেক করে এসো যূথী! ওহ সরি, ফারহানা।”
ফারহানা সত্যি সত্যিই ঘরের বাইরে গিয়ে আশপাশটা ঘুরে এলো। খুব স্বাভাবিকভাবেই দেখা পেলো না কারোরই।
ঘরের ভেতরে ভাঙাচোরা একটা কাঠের চেয়ার খুঁজে পেলো সাবা। তারই ওপরে বসতে বসতে হালকা গলায় বলল, “তারপর? কী চলছে?”
ফারহানা তার মুখোমুখি বিছানার ওপর বসতে বসতে বলল, “সেটা তো আপনি বলবেন?”
সাবা বিভ্রান্ত স্বরে বলল, “তাই না-কি? আমার বলার কথা?”
“কেমন লাগছে নিজের স্বামীকে বিনা দোষে কারাগারে বন্দী অবস্থায় দেখে?”
হঠাৎ মলিন হয়ে উঠলো সাবার মুখভঙ্গি। চাপা একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার বুক থেকে।
ফারহানা তার প্রতিক্রিয়া দেখে উৎফুল্ল গলায় বলল, “আমারও ঠিক এমন লাগে আমার ভাইকে জেলের ভেতরে দেখে।”
সাবা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “তোমার ধারণা তোমার ভাইয়ের কোনো দোষ নেই?”
ফারহানা তেজি কণ্ঠে বলল, “না নেই। একদম ঠিক কাজ করেছে ভাইয়া। আপনি একটা স্বার্থপর মানুষ। নিজের স্বার্থের জন্যে সব পারেন। স্বার্থ উদ্ধারে কাছের মানুষগুলো বিপদে পড়লেও আপনার কিছুই যায় আসে না।”
“আমার কোন স্বার্থে তোমার ভাই বিপদে পড়েছিল?”
ফারহানা আক্ষেপের সুরে বলল, “ভাইয়ার সাথে আপনার একটা সম্পর্ক ছিল। যে সম্পর্কটা আপনি আর রাখতে চাইছিলেন না। কিন্তু ভেঙে দেওয়ারও কোনো অজুহাত পাচ্ছিলেন না। তাই সবাইকে জানিয়ে দিলেন আমার ভাই ড্রা/গ অ্যাডিক্ট।”
সাবা তীক্ষ্ম স্বরে বলল, “মিথ্যা কিছু তো বলিনি। সত্যিই সে সময় তোমার ভাইয়ের অ্যাডিকশন ছিল।”
“আপনি যদি সত্যিকার অর্থেই তার কথা ভাবতেন তাহলে ভার্সিটির ভিসিকে না জানিয়ে ভাইয়াকে ডক্টরের কাছে নিয়ে যেতেন। কিন্তু আপনার তো সম্পর্কটা ভেঙে দেওয়ার জন্যে একটা অজুহাতের দরকার ছিল।”
সাবা অগ্রাহ্যের সুরে বলল, “দেখো ফারহানা এ বিষয়ে আমি তোমাকে জবাবদিহি করবো না। আমি আজও বিশ্বাস করি আমি যা করেছি তোমার ভাইয়ের ভালোর জন্যেই করেছি। ডক্টরের কাছে নিয়ে গেলে সে কিছুদের জন্যে শুধরালেও আবারও সেই অ্যাডিকশনের কাছে ফিরে যেত।”
“কিন্তু সবাইকে জানিয়ে আপনি যে ভাইয়ার রেপুটেশন নষ্ট করে দিলেন?”
সাবা ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল, “এটা নিশ্চয়ই একটা মানুষকে মে/রে ফেলার কারণ হতে পারে না। ফাহিম আমাকে মে/রে ফেলতে চেয়েছিল ফারহানা।”
“কিন্তু আপনি তো ঠিকই বেঁচে আছেন, সুস্থ-স্বাভাবিক আছেন। অথচ আপনার স্বামী প্রতিশোধ নিতে গিয়ে আমার ভাইয়ের পায়ে গু/লি করেছে। ভাইয়া আর কোনোদিনও হাঁটতে পারবে না। আমি বুঝি না আপনার মতো স্ত্রীর জন্যে কেউ কেন এতটা করবে। আপনি তো শাফকাত আলমকে ছেড়ে পালিয়েই যাচ্ছিলেন।”
সাবা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “ফাহিমের সাথে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। ভুলের শাস্তিও পেয়েছি। আমার শরীরে দুটো গু/লির দাগ সারাজীবনের জন্যে বসে গেছে। আমি জানি না শাফকাত সত্যিই ফাহিমের পায়ে গু/লি করেছে কিনা। যদি করেও থাকে, তবে সে ভুল কিছু করেনি। ফাহিম তো আমাকে মে/রে ফেলার চেষ্টা করেছিল। শাফকাত তো অন্তত তাকে প্রাণে বাঁচিয়ে রেখেছে।”
ফারহানা বাঁকা হাসি হেসে বলল, “হ্যাঁ সেটাই! খুবই ভালো কাজ করেছে। এই ভালোর কাজের ফলও সে দীর্ঘদিন ধরে পাবে।”
ফারহানা নিজের দিকেই আঙুল তাক করে রহস্যমাখা গলায় বলল, “কারণ যূথীকে পুলিশ কোনোদিনও খুঁজে পাবে না। আর আপনার এখান থেকে যূথীকে নিয়ে ফেরার সম্ভাবনা একেবারেই জিরো!”
সাবা মোটেও বিচলিত না হয়ে শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “তাই?”
আচমকা ঝড়ের গতিতে উঠে দাঁড়ালো ফারহানা। তার পায়জামার পকেট থেকে একটা কালো পি/স্তল বের করে তাক করলো সাবার দিকে।
দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “Your game is over Saba Amir. আর কারোর জীবন ধ্বংস করার সুযোগ আপনি পাবেন না।”
এবারও ঘাবড়ে গেলো না সাবা। নিজের জায়গা থেকে এক চুলও নড়লো না। বরং একটা পায়ের ওপর আরেকটা পা তুলে দিয়ে শীতল কণ্ঠে বলল, “তোমার ভাই আমার শরীরে দুটো গু/লি ছুঁড়ে দিয়ে খুব উপকার করেছে জানো? এখন আর কেউ আমার দিকে পি/স্তল তাক করলে ভয় লাগে না।”
ফারহানা কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রচন্ড ধাক্কায় তার কুড়েঘরের ভঙ্গুর দরজা ভেঙে পড়লো। সেই দরজা দিয়ে একে একে দৃপ্ত পায়ে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলো একেকজন অফিস অফিসার। তাদের সকলের হাতে ব/ন্দুক। সবগুলো ব/ন্দুক তাক করা রয়েছে তারই দিকে।
ফারহানা এতটাই চমকে উঠলো যে তার হাত থেকে পি/স্তলটা মেঝেতে ছিটকে পড়ে গেল। কয়েকজন পুলিশ অফিসার দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে ঘিরে ধরলো তাকে।
সাবা এবার ধীরেসুস্থে উঠে দাঁড়িয়ে ক্লান্তির হাসি হেসে বলল, “জেলে গিয়ে তোমার ভাইকে আমার হ্যালো জানিয়ো ফারহানা।”
ফারহানাকে বিস্মিত দশায় রেখেই লম্বা লম্বা পা ফেলে কুড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো সাবা। যে মানুষটাকে বুকের মাঝে ফিরে পাওয়ার জন্যে এত এত দৌড়ঝাঁপ, এবার তার কাছে যাওয়ার পালা।
(চলবে)