শান্তি সমাবেশ পর্ব-১৩

0
773

#শান্তি_সমাবেশ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১৩

— সামনের মাসে পরিক্ষা শুরু। আপাতত সব থেকে বিরত থাকব। হয়তো দেখা হবে না অনেকদিন। আশা করি আমার জন্য হলেও নিজের খেয়াল রাখবেন৷ অবশ্য আমি জানি আপনার আব্বু আপনার জন্য যথেষ্ট তবুও আমার জন্য নিজের প্রতি যত্ন নিবেন। ভার্সিটি আসবেন। পড়বেন। চলে যাবেন। কারো সাথে কোথাও ঘুরতে যাবেন না। ঠিক আছে? আর হ্যাঁ উজ্জ্বল আর হিমু তো আছেই ওদের সাথে থাকবেন। আমি কি বুঝাতে পারলাম?

মৃত্তিকা’র কান কথাগুলো শুনতেই মস্তিষ্কের নিউরনে উদ্দীপনা সৃষ্টি হলো। এক ঝটকায় বুঝে গেলো একমাস। টানা একমাস পূর্ণ’র দেখা মিলবে না। এটাই শেষ বর্ষ তার। এককথায় বলা যায় ছাত্র জীবনের সমাপ্তি। যদিও মানুষ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছাত্র থাকে। শিক্ষা মানুষ আমৃত্যু গ্রহণ করতে থাকে। কিন্তু ধারাবাহিক শিক্ষার সমাপ্তি এখানেই পূর্ণ’র। মৃত্তিকা’র বেজার হওয়া মুখটা দেখে পূর্ণ গম্ভীর কণ্ঠে শাঁসালো,

— আমি কি আপনার মন খারাপ করতে এসব বলেছি মৃত্ত?

মৃত্তিকা মাথা নাড়লো। পূর্ণ এবার কিছুটা রাগ চাপার চেষ্টা করলো। ঠান্ডা স্বরে বুঝাতে চাইলো,

— বেশি দিনের ব্যাপার না মৃত্ত। আসলে আমি সারাবছর তেমন পড়াশোনা করি না। এত কাজের চাপে হয়ে উঠে না। পরিক্ষার আগে যথেষ্ট সিরিয়াস হয়ে যাই।

— তাতেই এত ভালো সিজিপিএ আসে?

— আসে তো। একেকজন একেকভাবে পড়াশোনা করে মৃত্ত।

— হুম।

— আচ্ছা। আমার পূর্ণময়ীর মন ভালো করতে এই পূর্ণ কি করতে পারে?

— ঘুরতে চলি?

— প্রেম করতে চাইছেন। কিন্তু আমি তো আগেই বলেছি আমার দ্বারা প্রেম হবে না।

মৃত্তিকা থতমত খেলো। সেই ভাব কাটিয়ে উঠতে নিলেই পূর্ণ আবার বলে উঠলো,

— আপনার অনেক সখ প্রেম করার অথচ কপালে জুটলাম কি না আমি। আফসোস হয় মৃত্ত? হলেও লাভ নেই। আমাকে নিয়েই থাকতে হবে। অন্য কোন চিন্তা থাকলে তার দাফন দিন নাহয় আমি দিয়ে দিব৷ কথাটা জানি মনে থাকে।

মৃত্তিকা মুখ হা করে বসে রইলো৷ কি থেকে কি বললো পূর্ণ? প্রথম প্রথম নরম গলায় বললেও পরেরগুলো দিলো ধমক। কিন্তু কেন? কাকেই বা দাফন দিবে? মৃত্তিকা থতমত খেয়েই জিজ্ঞেস করলো,

— ক..কি বলছেন? কে থাকবে আমার মনে?

— কু*ত্তা*র বাচ্চা চিনেন মৃত্ত? ঐ কাব্য ও তেমন। একবার যেমন রুটি খাওয়ালে কুকুর পিছ ছাড়ে না তেমনই কাব্য ও পিছ ছাড়বে না আপনার। কি ভেবেছেন আমি টের পাব না? পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চির এই শরীর নিয়ে আমার থেকে কথা লুকান? কতটা বড় কলিজা আপনার মৃত্ত? কিভাবে বড় করলেন? নিশ্চিত কারো আস্কারা পেয়েই বড় হয়েছে? আস্কারা টা কে দিলো? কে দিলো? কাব্য? ঐ ****বাচ্চা কাব্য! এই কথা বলুন? কথা বলুন বলছি? আমার রাগ কিন্তু মাথায় উঠে যাচ্ছে মৃত্ত। বলুন ওর সাথে আপনার কি?

পূর্ণ ঠান্ডা স্বরে বললো প্রথম টুকু অথচ চেঁচিয়ে উঠলো শেষ দিকে। মৃত্তিকা সেই প্রথম প্রথম পাওয়া ভয়টা আজ পেলো। দীর্ঘদিন পর আবারও পূর্ণ’র সেই চেহারা তার সামনে। আগে অবশ্য তার সামনে গালি দিত না। আজ বিশ্রী দুটো গালিও দিলো তার সামনে। গাছের গুড়ি খামচে ধরলো মৃত্তিকা। বুকের ভিতর ধ্রীম ধ্রীম শব্দ হচ্ছে। উঠার চেষ্টা করলেও লাভ হলো না। শক্তি কুলাচ্ছে না উঠতে। পূর্ণ সজোরে এক আঘাত করে বসলো মোটা গাছটায়। ছাল বাকল উঠানো হওয়াতে হাতে লাগলো বেশ। মৃত্তিকা ঝট করে উঠলো। নিজের দুই হাতে ধরে ফেললো পূর্ণ’র শক্ত সেই হাতটা। ছাড়িয়ে নিতে চাইলো পূর্ণ কিন্তু হলো না। তার মৃত্ত থেকে নিজেকে কিভাবে নিজেকে ছাড়াবে সে? এটা অসম্ভব। মৃত্ত’র এই ছোঁয়া পাওয়ার জন্য তার হাতের আত্নহুতি দিতেও সক্ষম সে। মৃত্তিকা পূর্ণ’র হাতটা চেপে ধরলো। কোন প্রকার জড়তা ছাড়া একটা চুমু খেয়ে নিলো সেই শক্ত হাতে। ঠান্ডা বরফের খন্ড তখন পূর্ণ। রা নেই মুখে। চোখে মুখে তার অন্ধকার হানা দিয়েছে। মাথা নামানো। মস্তিষ্ক বললো, ” দে পূর্ণ ধমকে দে এই মৃত্ত’কে। কত সাহস! যেখানে তুই ছোঁয়া দিস না সেখানে সে চুমু খায়”। মস্তিষ্ক একথা বললেও প্রেম লোভী মন বললো ভিন্ন কথা। সায় দিলো সে মৃত্ত’কে। পূর্ণ’কে বুঝিয়ে বলতে লাগলো, ” থাক না একটু। একটুই তো। তোরই তো। একটা চুমুই তো। খাক। তুই তো ধমকালি বিনিময় হিসেবে চুমুটা রেখে দে পূর্ণ। যত্নে রেখে দে”।
পূর্ণ যখন মন মস্তিষ্কের ঝগরা থামাতে মশগুল তখন মৃত্তিকা ব্যাগ থেকে পানি বের করে তার হাতে ঢালতে ব্যাস্ত। ব্যাস্ত ভঙ্গিতে বলেও যাচ্ছে,

— ভুল ভাবছেন আপনি। ঐ ভাইয়াটা আমাকে নোটস দিতে চাইছিলো। তার সাথে কোথাও যাই নি আমি। কোথাও না। বিশ্বাস করুন। তিনি আমাদের সাথে গিয়েছিলেন। সে সাথে থাকায় আমি ফুচকাও খাই নি। বাসায় চলে গিয়েছিলাম। আমি আব্বুর সাথে ছিলাম। বিশ্বাস না করলে উজ্জ্বল আর হিমু’কে জিজ্ঞেস করুন।

— বিশ্বাস করলাম।

ঠান্ডা স্বরে বললো পূর্ণ।

___________________

মায়ের কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে পূর্ণ। মনোযোগ সম্পূর্ণ তার বইয়ের পাতায়। পাশেই ওর বাবা বসা। ভদ্রলোক টিভির সাউন্ডটা একদম শূণ্যতে দিয়ে খবরের চ্যানেল দেখছেন। পূর্ণ বারকয়েক আওড়ালো বাবা’কে যাতে প্রয়োজন অনুযায়ী সাউন্ড দিয়ে দেখে কিন্তু তিনি তা করেন নি। ছেলে পড়ছে তাই ডিসটার্ব করতে নারাজ তিনি। পূর্ণ’র মা ছেলের মায়াবী মুখটাতে তাকিয়ে রইলেন। পরপর নিজেকে নিজে বলতে লাগলেন, “এভাবে দেখা ঠিক না যদি নজর লাগে তার সোনার টুকরোর”?
পূর্ণ প্রায় আড়াই ঘন্টা ওভাবেই পড়েছে। এটা তার একটা অভ্যাস। এভাবে এতবড় হয়েও বাবা-মায়ের বেড রুমে তাদের খাটে তাদের প্রাইভেসি নষ্ট করে সে পড়ে। যদিও অন্য ছেলেপুলে’রা বাবা-মা’কে প্রাইভেসি দেয় কিন্তু পূর্ণ দেয় না। পরিক্ষা’র সময় তো মোটেই না। বাবা কতবার বলে, এত বড় ছেলে হয়োছো দুই দিন পর বিয়ে করবে এখনও কি না মা-বাবার বেডরুমে শুয়ে থাক? পূর্ণ তখন দুষ্ট হেসে বাবা’কে বলে উঠে, আমার মৃত্ত অনেক আদুরে আব্বু। সে আসলে তোমরাই তখন তাকে আদর করে কুল কিনারা পাবে না।
পূর্ণ বাবা-মা’কে মৃত্তিকা সম্পর্কে জানিয়েছে। জানিয়েছে বললে ভুল হবে। সোজা সোজা বলেছিলো,”আব্বু একটা পূর্ণময়ী পেয়েছি। ভালো একটা কালক্ষণে তাকে বিয়ে করে নিব”। ছেলে তাদের বরাবরই বাবা-মা’কে জানিয়ে কাজ করে। মৃত্তিকা সম্পর্কে ও তারা জানে। পূর্ণ জানায়। রোজ জানায়। কিন্তু দেখা হয় নি চোখের। পূর্ণ’র কাছে কোন ছবি নেই মৃত্তিকা’র।

আড়মোড়া ভেঙে পূর্ণ সোজা হলো। বাবা’র দিকে তাকিয়ে বললো,

— নাও তোমার বউ তোমাকে দিয়ে গেলাম। একটু পরই আসছি আবার।

ওর বাবা ছেলের কথায় হাসলেন। বুঝেন না এমনটা না। ছেলের এমন সব কান্ড তার বরাবরই জানা। পূর্ণ যেতে যেতে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

— আম্মু ক্ষুধা লেগেছে খেতে দাও।

ওর মা তারাতাড়ি বিছানা ছাড়লেন। পেছন থেকে স্পষ্ট শুনা গেলো বাবা’র কন্ঠ,

— কোথায় দিলি আমার বউ? সেই তো তোর কাছেই নিয়ে গেলি।

পূর্ণ’র মা স্বামী’র দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকালেন। মৃদু ধমকের সুরে বলে উঠলেন,

— বুড়া হচ্ছো অথচ পাগলামি ছুটলো না। এতবড় ছেলেকে কিসব বলো তুমি?

— কই কি বললাম। হায় আল্লাহ! এই ছেলে বাসায় থাকলেই আমি বউহীনা ভুগি আর তুমি কি না আমাকেই দোষ দাও?

ওর মা আর স্বামী’র কাছে থাকলো না৷ গটগট পায়ে চলে গেল খাবার গরম করতে।

এতসবের আড়ালে হাসে পূর্ণ। অতিসূক্ষ্ণ হাসিটুকু যা পরিবার বাইকে কাউকে সে দেখায় না। রাখে একদম আড়ালে। আবডালে। বাবা-মায়ের রুমে পড়ার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো তাদের সময় দেয়া। তাদের বুঝানো এখনও তারা অতটাই গুরুত্বপূর্ণ সন্তানের কাছে। তাদের ভূমিকা কমে নি বরং বেড়েছে। মা’কে একটু বেশি আগলে রাখে পূর্ণ। বাবা’কে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখে এতসব উদ্ভব কথা বলে।
.
— আব্বু মায়ের কথা শুনো। এসব ছেড়ে দাও। ভালো না এসব আব্বু। নোংরা এসব।

— কিচ্ছু হবে না আম্মু। তুমি ভয় পাচ্ছো খামাখা। আমি নিজেকে নোংরা হতে দেব না।

পূর্ণ’র মা ছেলের পাতে মাছ বেছে আরেকটু দিলেন। পূর্ণ’টা মাছ বাছতে পারে না। আবারও বললেন,

— ড্রেন দিয়ে ময়লা গেলেও সেটা নোংরা তেমনি দুধ গেলেও নোংরা আব্বু। ছেড়ে দাও। মা ক্লান্ত এসবে।

পূর্ণ নিজের প্লেট থেকে এক লোকমা ভাত তুলে দিলো মায়ের গালে। পরপরই টুপ করে একটা চুমু খেয়ে বললো,

— দেখ আব্বু কিভাবে হিংসাত্মক ভাবে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। হিংসুটে আব্বু।

ওর বাবা মুখ সিটকে বলে উঠলেন,

— আমার বয়েই গেছে।

— গেছেই তো।

বলেই পূর্ণ হাসলো। প্রতিবারের ন্যায় অতিসূক্ষ্ণ ভাবে এরিয়ে গেলো মায়ের কথা। রাজনীতি সে ছাড়তে নারাজ। যেকোনো ভাবেই নারাজ। এই রাজনীতি তার লাগবেই। হোক সেটা নোংরা তবুও চাই। এই নোংরা রাজনীতি করেই দম নিবে পূর্ণ। কিছু মানুষকে দেখিয়ে ছাড়বে নোংরা রাজনীতি করেও কিভাবে নিজেকে শুদ্ধতম রাখা যায়।

________________

শোয়েব মির্জা বরাবরই হতাস হচ্ছেন। কোন দিকেই কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। এভাবে কিভাবে হবে? মাহিন মিয়া তাকে সাহস দিয়ে বলে উঠলো,

— স্যার চিন্তা করবেন না। চাল পাল্টা খেতে কতক্ষণ?

— আমি নিজের উপর অবাক মাহিন। দুই দিনের চিনেপুটি আমাকে চিন্তায় ফেললো? চুল আমি….

— রাজনীতি করে সাদা করেছেন।

মাহিন মিয়া তার স্যারকে থামিয়ে বলে উঠলো। শোয়েব মির্জা মাথা ঝাকিয়ে সম্মতি দিলেন। মানে আসলেই এই চুল সে রাজনীতি করে করেই সাদা করেছেন। এই হাতে হাতড়েছেন প্রিয় জনের র*ক্ত। আর যাই হোক রাজনীতি করতে পিছু পা হবেন না তিনি।
মাথাটা ইজি চেয়ারে রেখে বেশ গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন,

— সাফারাত’কে ডাকো।

— ছোট বাবা তো বাসায় নেই।

শোয়েব মির্জা’র বৃদ্ধ কপালে চিন্তার ভাজটা স্পষ্ট দেখা দিলো।
.
সাফারাত নরম গদিতে গড়াগড়ি খেলো। শরীর বেশ ক্লান্ত তার। পড়নে তার একটা টাউজার শুধু। খালি গায়ে বিছানায় লেপ্টে আছে তার দেহ। এখন একটা নারী হলে মোটেও মন্দ হতো না। তাকে এই বুকে নিয়ে গড়াগড়ি খেতো সে। ফর্সা বুকে তার লোমের আনাগোনা। অতি আকর্ষণীয় তার বলিষ্ঠ দেহখানা৷ নিঃশ্বাসের দরুন পেটটা উচু নিচু হচ্ছে বারংবার। অলস ভাঙ্গিতে পাশ থেকে ফোনটা হাতড়ে নিলো। ডায়াল লিস্টে তিন নাম্বার নামটায় চাপ দিয়ে কল লাগালো। একবার দুইবার তিনবার রিং হতেই শুনা গেলো নারী কন্ঠ। এই কন্ঠ খুবই সুন্দর। অতি সুন্দর। সাফারাত নিজের হাতটা বুকে বুলাতে লাগলো। আওড়ালো গভীর কন্ঠকে খাদে ফেলে,

— বড়ই ভয়ংকর এই কন্ঠ। শক্ত পুরুষকে ঘায়েল করার মতো ভয়ংকর। বুকে খঞ্জর চালানোর মতো ভয়ংকর। ভয়ংকর সুন্দর তোমার কন্ঠ নারী।

#চলবে……