#শান্তিসুধা
১৪.
চার বছর পর বাড়ি ফিরল হেনা। ফিরেই মায়ের বুকে মুখ গুঁজে কাঁদছে। কারো সঙ্গে কথা বলছে না। তানজিনা বেগম মেয়ের দুঃখ বুঝল। চোখের পানি আটকাতে পারল না সেও। কত স্বপ্ন ছিল নুবাইদ আর হেনার বিয়ে দেবে। সব স্বপ্ন তার শশুর ভেঙে চুরমার করে দিল। দ্বিতীয়বারের মতো মন ভাঙল হেনার। তাও ভালো দ্বিতীয়বার ঘর ভাঙেনি৷ মেয়েকে সে কথা বলতেই হেনার কান্না বাড়ল। ভাঙা কণ্ঠে বলল ,
“ ভেঙেছে আম্মু ভেঙেছে। দ্বিতীয়বার স্বপ্নে দেখা ঘর , সংসার ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। ”
তানজিনা বেগম চমকে উঠল। নিজেকে তার অসহায় লাগল খুব। মাত্র সতেরো বছর বয়সে বিয়ে দিয়েছিল মেয়েটার। স্বামী মাদকাসক্ত ছিল বলে দেড় বছরের মাথায় সে বিয়েটা ভেঙে গেল। ডিভোর্স হওয়ার পর হতাশা জেঁকে ধরেছিল হেনাকে। কতবার সুইসাইড করতে গিয়েছে হিসাব নেই। শেষবার ওকে বাঁচাল নুবাইদ। মধ্যরাতে ছাদ থেকে লাফ দিতে গিয়েছিল।
লোডশেডিং থাকায় ছাদে এসেছিল নুবাইদ। আবছা আলোয় হেনার কর্মকাণ্ড আঁচ করতেই পেছন থেকে জাপ্টে ধরে বাঁচায়। প্রথমে ধস্তাধস্তি করে হেনা। কিন্তু নুবাইদ ওকে শক্ত করে জড়িয়ে রাখে। সেই মুহুর্তে কাজিন বোন হিসেবেই আগলেছিল নুবাইদ। কিন্তু ওর বুকে ভালোবাসার আশ্রয় খুঁজে নিয়েছিল হেনা। ডিভোর্সের পর এমন করে কেউ বুকে আগলে ভরসা দেয়নি। নুবাইদ দিয়েছিল। ওর বুকে পরম শান্তিতে চোখ বুঁজে ছিল ঘন্টার পর ঘন্টা। যা চিরস্থায়ী করতে ওর সব কথা মেনে সব শর্ত পালন করেছে। বিদেশে গিয়ে পড়াশোনা করে ক্যারিয়ার গড়া। দেশে এসে নিজেদের বিজনেসের হাল ধরার জন্য নিজেকে সম্পূর্ণভাবে তৈরি করার শর্ত ছিল। শর্ত পূরণ করে ফিরে এসেছে সে। চেয়েছিল দেশে ফিরে স্বপ্ন পূরণ করতে। কিন্তু তার অনুপস্থিতিতে তার মানুষটা এভাবে অন্য কারো হয়ে যাবে বুঝতে পারেনি। মাকে দোষারোপ করছে ,
“ তুমি কেন বিয়েটা আটকালে না আম্মু কেন? খালামুনিকে আগেই কেন জানালে না আমি নাফেরকে ভালোবাসি। এখন কী করে বাঁচব আমি? কী করে সহ্য করব নাফেরের পাশে অন্য মেয়েকে! ”
বাড়ির বড়ো মেয়ে দেশে ফিরেছে। তাই বেশ হৈচৈ পড়ে গেল। দাদুভাই ছোটো ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বাজার করে আনলেন। তাসলিমা বেগম ফোন করলেন ছেলেকে , তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার জন্য। নুবাইদ শান্তিকে নিয়ে ফিরল এক ঘন্টা পরই। শান্তির মাথা অনেকটাই ঠান্ডা। সে ঘরে গিয়ে শাওয়ার নিল। তারপর রান্নাঘরে এসে দেখল , আজ এলাহি আয়োজন হচ্ছে। শাশুড়ির পাশে দাঁড়িয়ে রান্না দেখতে শুরু করল সে। তাসলিমা খুশি হলেন। রান্নার পাশাপাশি শান্তিকে শেখাতেও লাগলেন। সে সময় চোখ, মুখ আঁধার করে রান্নাঘরে এলো তানজিনা। শান্তিকে দেখে মুখটা কঠিন হয়ে গেল। শান্তি হাসি হাসি মুখে চোখ পিটপিট করল। ফলে জ্বলে উঠল তানজিনা। ঠাশঠুশ শব্দে কাজে হাত দিল। তাসলিমা বেগম শান্তিকে বললেন ,
“ শান্তি মা যাও তোমার বড়ো আপার সাথে আলাপ করো গিয়ে।”
তানজিনা ফুঁসে উঠল ,
“ কোনো দরকার নাই আপা। ও আরাম করতেছে। ”
শান্তি ভ্রু কুঁচকে ফেলল। হেনাফেনাকে তার একটুও ভালো লাগেনি। তখন যে দৃশ্য দেখেছে। এতে মাথায় রাগ চড়েই আছে। আলাপ করতে সে এমনিতেই যেত না। কিন্তু যেই শুনল হেনা আরাম করছে। অমনি আরাম ভঙ্গ করতে ওর মনে আকুপাকু শুরু হলো। কাজে ব্যস্ত শাশুড়ি আর খালা শাশুড়িকে রেখে আলগোছে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো সে। উপরে উঠে হেনার ঘরের দরজায় টোকা দিল। ভেতর থেকে শোনা গেল ,
“ দরজা খোলাই আছে। ”
ভেতরে ঢুকে লম্বা করে সালাম দিল শান্তি।
“ আসসালামু আলাইকুম আপা। আমি আপনার ছোটো ভাইয়ের বউ। ”
আকস্মিক শান্তির আগমন। আবার হ্যাংলার মতো আপা ডাকছে , বলছে তার ছোটো ভাইয়ের বউ। এক নিমেষে মাথা গরম হয়ে গেল। রাগে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল ,
“ কীসের আপা! কে আপা? আর ছোটো ভাই কে আমার ছোটো ভাই? ”
আশ্চর্য মুখে এগিয়ে এলো শান্তি। আপাদমস্তক হেনাকে দেখে মনে মনে বলল , “ ওরে বেডি , আমার জামাইকে ছোটো ভাই শুনতে এত জ্বালা ধরে মনে? তার মানে আসলেই তোর মনে গণ্ডগোল আছে। চিন্তা করিস না। তোর জ্বালা বাড়াতে এই শান্তিসুধা একাই একশো। ”
লজ্জা মিশ্রিত হাসল শান্তি। গুটিগুটি পায়ে গিয়ে বসল হেনার পাশে। তারপর পা দুলাতে দুলাতে বলল ,
“ কেন নাফের তো বলল আপনি তার বড়ো আপা। কয়েক মাসের সিনিয়র তার থেকে আপনি। ”
নিমেষে চোখ লাল হয়ে গেল হেনার। হতভম্ব গলায় বলল ,
“ নাফের বলল এটা? ও তো কখনো আমাকে আপা ডাকেনাই। মাত্র ক’টা মাস তো আর ফ্যাক্ট হয়ে দাঁড়ায়নি আমাদের মাঝে। ”
মাথা নাড়াল শান্তি। দুলানো পা দুটো তুলে আয়েশ করে বসে বলল ,
“ হ্যাঁ বলল তো। আমি তো আপনাদের ভুল বুঝেছিলাম। ভেবেছিলাম নাফেরের চরিত্র খারাপ। সে পরকীয়া করছে। কিন্তু নাফেট যখন আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে করে সব বুঝাল। তখন আমার ভুলটা ভেঙে গেল। ”
আচমকা বিছানা থেকে উঠে পড়ল হেনা। রাগে কাঁপতে কাঁপতে চিৎকার করে উঠল৷
“ এই মেয়ে কী বলছ এসব। নাফের তোমাকে আদর করল? ”
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে শান্তিও দাঁড়িয়ে পড়ল। মিটিমিটি হেসে বলল ,
“ বারে আদর করবে না? আমি তার একমাত্র দুষ্টুমিষ্টি , সুন্দরী বউ বলে কথা। ”
হেনা ঘেমে উঠল। তার এত বছরের সাধনা। সব শেষ, সব শেষ। একজন ডিভোর্সী মেয়ে হয়ে বছরের পর বছর সে নিজেকে সংযমে রেখেছে। বিদেশে এত সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কারো সাথে সম্পর্কে যায়নি। গায়ের রঙ চাপা হলেও প্রেমের প্রস্তাব কম পায়নি। শুধুমাত্র নাফেরের জন্য নিজেকে বেঁধে রেখেছে। আর নাফের এই হাঁটুর বয়সী মেয়েটাকে আদর করল! চোখ , মুখ খিঁচে ফেলল হেনা। চিৎকার করে বলল ,
“ বেরিয়ে যাও। যাও বেরিয়ে। ”
চমকে উঠল শান্তি। পাগল নাকি। ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছে কেন? বাবারেহ ধমক। তার জামাই তাকে আদর করেছে। এটা শুনে তোর কেন জ্বলবে রে কুচুটে বুড়ি! বয়স তো কম হয়নি। ঠিক সময়ে বিয়ে করলে আমার বয়সের কাছাকাছি ছেলেমেয়ে থাকতো। মনে মনে ভেবেই বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিল। হেনাফেনাকে স্বাভাবিক লাগছে না। পাগল পাগল বিহেভিয়ার। রাগের মাথায় যদি কামড়ে বসে? সে ভালো হয়েই রাগ উঠলে নাফেরকে কামড়ে দেয়। আর এ তো পাগল। ঢোক গিলল শান্তি। আজকের মতো আর জ্বালাবে না। ভেবেই বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো। হেনা হঠাৎ চিল্লিয়ে উঠল ,
“ এক মিনিট! দেখি…”
বলেই শান্তিকে শক্ত হাতে টেনে ধরল। তারপর ওর গলার দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাত বুলাল লালচে হওয়া দাগটায়। কী ঘটেছে বুঝেই দাঁতে দাঁত পিষে বলল ,
“ নির্লজ্জ , বেহায়া মেয়ে। লাভ বাইট নিয়ে ঘুরে ঘুরে মানুষকে দেখাচ্ছ! ”
হকচকিয়ে গেল শান্তি। হাত দিল গলায়। লাভ বাইট? কই! সে তো দেখেইনি। এবার সত্যি সত্যি লজ্জা পেল সে। গাল দুটো লাল হয়ে একাকার হয়ে গেল। হেনা মৃদু ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল ওকে।
“ গেট আউট। ”
চলবে…
®জান্নাতুল নাঈমা