শান্তিসুধা পর্ব-২১ এবং শেষ পর্ব

0
570

#শান্তিসুধা ( প্রাপ্তমনস্কদের জন্য উন্মুক্ত )
২১. (শেষ পর্ব)
বাতাসে প্রেমের গুঞ্জন। নয়নে পূর্ণতার নেশা। হৃদয়ে মিষ্টি তোলপাড়। নিজেকে আঁটকে রাখা দায়। গোসল শেষ করে ঘরে গিয়ে কাপড় পাল্টে নিল শান্তি। নুবাইদ দরজার বাইরে স্থবির দাঁড়িয়ে ছিল। ভেতর থেকে দরজা আঁটকে দিয়েছে শান্তি। লম্বা সময় পেরুল। তবুও দরজা খোলার নাম করল না। আকস্মিক চুম্বনের কথাটা মনে পড়ল নুবাইদের। মেয়েটাকে একদম নাজেহাল করে ছেড়েছে। ঠোঁটজোড়া রক্তাভ হয়ে ছিল। চোখ দুটো পানিতে ভরপুর। বিড়বিড় করে বকেছে তাকে। শুনেছে দুয়েকটা, ‘ অ’সভ্য বুড়ো। ‘ ‘ লু’চো বুড়ো। ‘ রা’ক্ষস বুড়ো ‘ ইত্যাদি ইত্যাদি। আনমনে ঠোঁট কামড়ে হাসল নুবাইদ। একটুক্ষণ পর দরজায় টোকা দিল,

” শান্তি হলো? ”

ভেতর থেকে রাগত স্বর ভেসে এলো,

” হলে কী হবে? আবার ঠোঁট কা মড়াতে আসবেন? ”

ভড়কে গেল নুবাইদ। হকচকানো কণ্ঠে বলল,

” ওটা কা’মড় ছিল না, কিস ছিল। আর এমন ভাব করছ যেন তোমায় জোর করে এই নির্জন পাহাড়ে তুলে এনে লিপ কিস করেছি। নিজেই তো ফুঁসলালে। ”

প্রতিত্তোর এলো না। নুবাইদের ঠোঁটের কোণে মিটিমিটি হাসির খেলা চলল। বুকের ভেতর ভালো লাগার অদ্ভুত শিহরণ। কিয়ৎক্ষণ পর বলল,

” তুমি না বেরুলে ভেজা কাপড় গুলো দাও৷ ধুয়ে দিই। তুমি বরং ঠোঁট দুটোর যত্ন নাও। আহারে, বেচারি!”

কথাটা বলে শেষ করেছে মাত্র। নিমেষে দরজা খুলে গেল। ভেতর থেকে ভেজা কাপড়ের ঢিল পড়ল নুবাইদের মুখ জুড়ে। অমনি আবার দরজা বন্ধ। লম্বা একটা সময় পর দরজা খুললেও শান্তির অগ্নিদৃষ্টি আর বিড়বিড় করে বকতে থাকা থেকে রক্ষা পেল না নুবাইদ। দুষ্টুমিষ্টি খুনসুটি চলতে চলতে কখন যে দুজনের মনের সব বিরক্তি, তিক্ততা ধূলিসাৎ হয়ে গেল টেরই পেল না। মিষ্টি অনুভূতি, বুকের ভেতর একরাশ প্রশান্তিতে বুঁদ হয়ে রইল। দিন শেষে রাত নামল। এই রাতটাও ওদের দুটো মন এক হওয়ার কারিগর হয়ে দাঁড়াল। মিষ্টি ঝগড়া, রাতের হালকা শীতে কাঁথা নিয়ে টানাটানি আর শেয়ালের হাঁক শুনে শান্তির তীব্র ভয়। সব মিলিয়ে ওরা একে অপরের সঙ্গে সর্বক্ষণ আষ্টেপৃষ্টে রইল। বাড়ল অনুভূতি। তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠল দুজন দুজনকে সম্পূর্ণ রূপে পেতে।

পরেরদিন ওরা সিদ্ধান্ত নিল, আশপাশে একটু ঘুরবে। শান্তি ছবি তুলতে মরিয়া হয়ে উঠল। সাতসকালে ব্রেকফাস্ট করেই সে, সবুজ শাড়িটা পরে তৈরি। নুবাইদের মন বেশ ফুরফুরে। বউকে শাড়িতে দেখে আরো বেশি ফুরফুরে হয়ে গেল। সে নিজেও বেরুনোর প্রস্তুতি নিল। পনেরো মিনিটের ব্যবধান মাত্র। সকাল থেকেই আকাশটা মেঘলা ছিল ভীষণ। হঠাৎ মেঘ গুড়-মুড় করে বৃষ্টি নামল। শান্তির মনের আকাশে জমল মেঘ। তবে কি পাহাড় ঘুরে দেখা হবো না?

পাহাড়ি মাটি দিয়ে তৈরী চার দেয়ালের বড়ো ঘর। আসবাব বলতে, একটা বিছানা। ছোট্ট টেবিল, চেয়ার। আর কাপড় রাখার আলনা। মাথার উপর টিনের চাল। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে শান্তি। কাল থেকে মন বেশ ভালোই ছিল। বুকে সুখ সুখ অনুভূতি ছিল একটুক্ষণ আগ পর্যন্তও। হঠাৎ বৃষ্টি আসাতে মন খারাপ হয়ে গেল। সেই সঙ্গে যে একটা ঘোরে বিভোর ছিল সেই ঘোরটাও কেটে গেল। বিষণ্ণ হয়ে উঠল মন, মুখ। বুকের ভেতর সুক্ষ্ম এক ব্যথা টের পেল। যে ব্যথার কারণ অজানা। কাঠের জানালায় দু-হাত রেখে টিপটিপ বৃষ্টি দেখছে সে। নুবাইদ কখন এসে পেছনে দাঁড়িয়েছে টের পায়নি।

সবুজ শাড়িতে শান্তিকে দেখলে নুবাইদ মুগ্ধ হয়ে যায়। সে রাতেও হয়েছে। আজ আবারও হলো। কিন্তু বিষণ্ন শান্তিকে দেখে ভ্রু কুঁচকাল। রাগি, জেদি, ঝ’গড়াটে, বাঁচাল শান্তিতেই যেন তার সকল শান্তি। বিষণ্ন শান্তিকে একটুও ভালো লাগে না একটুও না। তাছাড়া সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। এখনো কাছে টানা হয়নি মেয়েটাকে। নিশ্চয়তা দেয়নি মনের, সম্পর্কের। অনিশ্চয়তা কেই বা চায়? তবে কি শান্তি অনিশ্চয়তার ভয়েই হঠাৎ চুপসে গেল? বড়ো করে নিঃশ্বাস ফেলল নুবাইদ। বৃষ্টির ঠান্ডা হাওয়া গায়ে লেগে গা ঠান্ডা হয়ে ছিল। আচমকা গরম নিঃশ্বাসের স্পর্শ পেতেই চকিতে ঘাড় ফেরাল শান্তি। ডাগর ডাগর নীল মণির চোখ দুটো স্থবির হয়ে গেল নুবাইদের দৃঢ় চোখে। গোলগাল ফর্সা, মলিন মুখটায় প্রগাঢ় চাউনি নিক্ষেপ করে নুবাইদ বলল,

” মন খারাপ? ”

মাথা নেড়ে পাশ কাটাতে চাইল শান্তি। ত্বরিত বাহুডোরে আবদ্ধ করে ফেলল নুবাইদ। মৃদুস্বরে বলল,

” আর কত? মুখ ফুটে মনের কথা একবার বললে কী হয়? ”

চমকে উঠল শান্তি। শ্বাস-প্রশ্বাস ঘন হতে শুরু করল। বাঁধন থেকে মুক্ত হতে চেষ্টা করে বলল,

” আমার মনে কোনো কথা নেই। যা আছে সব মুখে। আর বলে দেওয়া। ”

” হু ঠিক। ”

বলেই সেদিন জ্বরের ঘোরে বড়ো মামি ভেবে তাকে বলা সব কথা রিপিট করল নুবাইদ। চমকাল শান্তি। বিস্ময়ে মাথা ঘুরল। লজ্জায় মূর্ছা ধরার উপক্রম। নুবাইদের দৃষ্টি, স্পর্শ আরো গভীর হলো। শান্তি তাকাতে পারল না। মস্তক নত রেখে ভারি নিঃশ্বাস ফেলল। তার নরম হওয়া, লজ্জায় আড়ষ্ট ভাব নুবাইদকে পুলকিত করল।

টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ প্রকট। বাতাসের বেগও বেড়েছে। শরীর বরফের ন্যায় ঠান্ডা। উষ্ণতা প্রয়োজন ভীষণ। নুবাইদ মুখ নিচু করল। নতজানু শান্তির কপালে ঠোঁট ছোঁয়াল সন্তর্পণে। চোখ বুঁজে ভারিক্কি নিঃশ্বাস ছাড়ল শান্তি। চনমনে হলো নুবাইদের চিত্ত। নাকে নাক ঘষল বউটির। দুইগালে আলতো করে চুমু খেল। হালকা রক্তাভ গাল গাঢ় রক্তাভে পরিণত হলো। দুষ্টু হাসল নুবাইদ। টকটকে লাল অধরে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলল,

” আরেকটু জ খম করব নাকি? ”

বুকের ভেতর ধক করে উঠল শান্তির। সর্বাঙ্গ জুড়ে উষ্ণ শিহরণ। ত্বরিত দুদিকে মাথা নাড়ল সে। নুবাইদ সেই না টুকু গ্রাহ্য করল না। সযত্নে ঠোঁটজোড়া আঁকড়ে ধরল। প্রথমে ভয় পেো শান্তি। কালকের মতো হলে নিশ্চিত আজ ঠোঁট কে টে রক্তপাত হবে। কিন্তু না। এত যত্ন করে চুমু খেল নুবাইদ। সে শুধু মাখনের মতো নরম হয়ে ধরা দিতে লাগল। অনুভব করল, নারী পুরুষের মিলনে সবচেয়ে চমৎকার হলো ঠোঁটে চুমু খাওয়া। নুবাইদ তার ঠোঁট দুটো ভেজা আদরে ভরিয়ে তুলল। ধীরে ধীরে কখন যে শূন্যে তুলে বিছানা মুখী হয়েছে টেরই পায়নি। পেল তখন। যখন ঠোঁট জোড়া ছেড়ে প্রগাঢ় চোখে আশকারা চাইল গভীর কিছুর। লজ্জায় দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলল সে। বলার মতো কোনো শব্দ খুঁজে পেল না। নুবাইদ অবশ্য বুঝে নিল সবটা। সেই সঙ্গে একটু চিন্তাও হলো। আরো গভীরে যাওয়া কি ঠিক হবে?

বাইরে বৃষ্টি কমে এসেছে। সেদিকে হুঁশ নেই নুবাইদ বা শান্তির। তারা একে অপরকে পাওয়ার নেশায় বদ্ধ উন্মাদ। জীবনে প্রথম কোনো মেয়েকে এভাবে কাছে টানছে নুবাইদ। শান্তিও এ প্রথম কোনো পুরুষের কাছে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দুজনের অনুভূতি টালমাটাল। মৃদু মৃদু কাঁপছে শান্তি। নুবাইদ ওর শাড়ি খুলতে ব্যগ্র। লজ্জায় অসহ্য শান্তি। শাড়ি খোলার পর নুাবইদকে বাঁধা দিল সে। বাঁধা পেয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল নুবাইদ। সারা মুখে আদুরে স্পর্শে ভরিয়ে তুলল। শরীরী সুখ বুঝাতে ঘাড়ে, গলায় অজস্র চুমুর বর্ষণ নামাল। ছটফটিয়ে উঠল শান্তি। ফিসফিস করে বলল,

” নাফেরর! ”

একই সুরে নুবাইদ বলল,

” খারাপ লাগছে? ”

লাল টকটকে চোখে তাকাল শান্তি। সে দৃষ্টিতে এক পলক দেখে ওর বুকে মুখ ডুবাল নুবাইদ। মুহুর্তেই ফোনের ভাইব্রেট শুনতে পেল শান্তি। নুবাইদ ততক্ষণে তার দেহের শেষ বস্ত্র দুটো খুলতে ব্যস্ত। ভারিক্কি নিঃশ্বাসের তোড়ে ভাইব্রেটের শব্দ নুবাইদ শুনতে না পেলেও মাথার কাছে হওয়াতে শান্তি শুনল। আলগোছে একহাত বাড়িয়ে ফোন তুলতেই দেখল, স্ক্রিনে হেনা থ্রি লেখা। অর্থাৎ হেনার সিম তিনটা! দুটো নাম্বার ব্লক করেছে সে। বাকি এটাই৷ তাই এটা আর ব্লক করল না। নাফেরকে বার বার নির্লজ্জের মতো ফোন করা? হানিমুনে আছে জেনেও এত কিসের ফোন দেওয়া? তাও আবার এখন তারা স্বামী স্ত্রী ঘনিষ্ঠ মুহুর্ত কাটাচ্ছে। মাথায় রাগ চড়ে গেল। রাগের বশীভূত হয়েই কলটা রিসিভ করে স্পিকার কমিয়ে বালিশের পাশে রেখে দিল। এরপর তাকিয়ে দেখল নুবাইদকে। মৃদুস্বরে ডাকল,

” নাফের? ”

শান্তিকে সম্পূর্ণ রূপে নিজের আয়ত্তে এনে গভীর স্বরে নুবাইদ বলল,

” বাঁধা দিও না শান্তি! ”

লজ্জা মিশ্রিত হেসে মুখ এগোল শান্তি। বরের কপালে চুমু এঁটে বলল,

” দিলাম না। নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবে সঁপে দিলাম। ”

তৃপ্তিময় হাসল নুবাইদ। ভেঙে ফেলল নিজের আটাশ বছরের কঠিন সংযম। শান্তির চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরল। মুখে অস্ফুট শীৎকার। বালিশের পাশে ফোনের ওপাশের মানুষটা তখনো কল কাটেনি। শান্তিও ভুলে গেল তার কথা। সে কেবল বিভোর রইল স্বামী সোহাগে।

পরিশিষ্টঃ

বৃষ্টিস্নাত সকাল। রতনের মামাবাড়ির পাহাড়ি এলাকা থেকে ফিরে এসে বাড়ির পথে রওনা হলো নুবাইদ, শান্তি। গাড়িতে পাশাপাশি বসে আছে দুজন। টুকিটাকি গল্প করতে করতে হঠাৎ নুবাইদ প্রশ্ন করল,

” তোমার এইম কি শান্তি? ”

খুব আহ্লাদ বেড়েছে শান্তির। তাই আহ্লাদে গদগদ হয়েই উত্তর দিল,

” বিজনেসওম্যান। ”

” গ্রেট! ”

অবাক হয়ে তাকাল শান্তি। বলল,

” তুমি খুশি হয়েছ? ”

এ প্রথম তুমি বলল শান্তি। নুবাইদ অভিভূত হয়ে জবাব দিল,

” বিজনেসম্যানের ওয়াইফের এইম বিজনেসওম্যান হওয়ার বিষয়টা সত্যি চমৎকার। ”

আচমকা মনে পড়েছে এভাবে শান্তি বলল,

” হ্যাঁ তার জন্য আরো অনেক বছর অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু আমি এখন থেকেই কিছু করতে চাই। ”

” যেমন? ”

” নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। ”

আশ্চর্য হয়ে গেল নুবাইদ।

” এই বয়সে কেউ নিজের পায়ে দাঁড়ায় না। সবে ইন্টারমিডিয়েট স্টুডেন্ট। পড়াশোনা আর বরকে ভালোবাসায় মন দাও। ”

বায়না ধরার মতো করে নুবাইদের বাহু চেপে ধরল শান্তি। বলল,

” তোমার পিএ হতে কী অনেক বড়ো ডিগ্রি লাগবে?”

” তুমি এমনিতেই আমার ব্যাক্তিগত, নিজস্ব মানুষ। ”

” না, না আমি আপনার অফিসেও সব সময় আপনার কাছাকাছি থাকতে চাই। ”

বিস্মিত হলো নুবাইদ। সবেমাত্র তার পিএ হিসেবে অফিসে জয়েন করেছে হেনা। বিদেশ থেকে পড়াশোনা করে এসেছে সে। তাকে বাদ দিয়ে ঘরের বউকে নাহ! শান্তি বাচ্চা মেয়ে। ওর এসব কথাকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রশ্নই উঠে না। তাই বলল,

” পাগলামি করো না শান্তি। পড়াশোনা শেষ করো। লাইফ পার্টনার থেকে বিজনেস পার্টনারও বানিয়ে নেব। আপাতত এসব ভূত মাথা থেকে বের করে দাও। ”

মনে মনে ভীষণ রেগে গেল শান্তি। ওই হেনাফেনা অফিসে সর্বক্ষণ নাফেরের কাছাকাছি থাকবে এটা সে সহ্য করতে পারবে না। নুবাইদও রাজি হলো না। বলল,

” পড়াশোনা শেষ করো। তাছাড়া তোমার যা পড়াশোনা এতে আমার পার্সনাল এসিসট্যান্ট করলে অফিসে বাজে প্রভাব পড়বে। সমালোচনা হবে, লেখালেখিও হবে এটা নিয়ে। এরচেয়ে ধৈর্য ধরো কয়েকটা বছর। ইউ ডিজার্ভ ব্যাটার বউ। ”

অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে বসল শান্তি। আলতো হেসে নুবাইদ হাত বাড়াল। জোর করে কাছে টানল। নিশ্চুপ বসে রইল শান্তি। আধঘন্টার ব্যবধানে ঢলে পড়ল গভীর ঘুমে। ঘুমন্ত বউকে বুকে আগলে জার্নি করল নুবাইদ। কানে কানে কেউ যেন এসে গেয়ে উঠল,

” এই পথ যদি না শেষ হয়। তবে কেমন হবে তুমি বলো তো? ”

~ সমাপ্ত ~
® জান্নাতুল নাঈমা