শিরোনাম পর্ব-১৩

0
76

#শিরোনাম
#পর্বসংখ্যা_১৩
#মুসফিরাত_জান্নাত

“জিনাত প্রেগন্যান্ট এটা আমি জানতাম না।যখন জানতে পারলাম ততক্ষণে ওর জেল হয়ে গিয়েছে।আমি নিজে নিজে অনেক চেষ্টা করেছি ওকে ছাড়ানোর। কিন্তু পারিনি।গৃহবধূ নির্যাতনের কেইস অতটা সহজ নয়।একমাত্র আপনি কেইস তুলে নিলে তবেই মুক্তি মিলবে ওর।মাঝের চারটা মাস আমি হন্যে হয়ে আপনাকে খুঁজলাম।পেতে পেতে দেরী হলো।মায়ের গর্ভে আমার সন্তানটা কারাগারে সুবিধাবঞ্চিত হয়ে বেড়ে উঠলো এ চার মাস।এটা আমি মানতে পারছি না।আপনিও তো সন্তানসম্ভবা মা ভাবি।আপনি মানতে পারবেন এটা?আমার চাওয়াটা এজন্যই।আমার সন্তানের তো কোনো দোষ নেই।জিনাতের মুক্তি না মিললে মায়ের আদর ছাড়া বড় হবে ও।ওর মায়ের করা অন্যায়ের ভার ওর কাঁধে চাপবে।আমি এটা চাই না।আশা করছি আপনি বুঝতে পারছেন।”

একদমে কথাগুলো বললো মুরাদ।কনা অসাড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।মুরাদ যেটা চাইছে তা পূরণ করা তার জন্য অধিক শক্ত।সেই তো বলতো অন্যায়কারীকে ছাড় দেওয়া মানে আরেক অন্যায়ের উৎপত্তি করা।তবে এখন কি করবে সে?জিনাত যা করেছে সে ব্যপারটাকে শুধুমাত্র প্রেগন্যান্সির কারণে কি আদৌ প্রশ্রয় দেওয়া যায়?প্রশ্নটা মাথায় আসতেই নিজের অবস্থার কথা মনে হয় তার।সেদিন সন্তান নষ্ট হয়ে গিয়েছে এটা ভেবে নিজের যে কষ্টটা হয়েছিলো তা মাথা চারা দিয়ে ওঠে। শক্ত হয়ে যায় সে।হাত মুঠো করে ধরে।

“অসম্ভব! আপনি অন্য কিছু চান।আমার সন্তানকে প্রায় মৃ’ত করে তোলার অপচেষ্টা যাদের ছিলো তার মুক্তি আমার সাহায্যে হবে না।”

মুরাদ উত্তেজিত হলো,

“এটা করতে আপনি বাধ্য।আপনি কথা দিয়েছেন।”

কনা জেদ ধরে থাকে যাবে না। বলে,

“কথা না রাখার কাফফারা আমি আদায় করে নিবো।তবুও যাবো না।”

মুরাদ কণ্ঠ নামায় তখন।অসহায় বোধ করতে থাকে।মুহুর্তের মধ্যে গলা ধরে আসে।নিস্তেজ হয়ে বলে,

“আপনি না গেলে হয়তো আমার সন্তানটা নষ্ট হয়ে যাবে।জিনাত ভীষণ অসুস্থ হয়ে গিয়েছে।কারাগারের চিকিৎসায় যদি সেড়ে না ওঠে?যদি আমার বাচ্চাটা মা’রাই যায়?খুব শান্তি মিলবে আপনার তাই না?আমি তো আপনার সাথে কোনো অন্যায় করিনি।তবে কেনো আমাকে কথা দিয়ে ধোঁকা দিলেন?জুবায়ের ভাইয়ের সাথে আপনার বিশেষ পার্থক্য রইলো কি?সেও তো জেরিন আপাকে কথা দিয়ে কথা রাখেনি।আপনারা দুজন এক নৌকার মাঝি।দুজনেই ধোঁকাবাজ।প্রতারক!”

“থামুন!আমাকে এসব বলার কোনো অধিকার আপনার নেই।বের হয়ে যান আপনি এখান থেকে।গেট লস্ট!”

রাগে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে নিজের ঘরে ফিরে আসে কনা।মানুষ কতটা স্বার্থপর হলে এরকমটা বলতে পারে ভাবতেই ঘৃনা জাগে তার।রাগে সব চুরমার করে দিতে ইচ্ছে করে।নিজেকে সামলে নেয় সে।এ মুহুর্তে এত রাগ করা বেবির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে ভেবে।

সেদিন ওভাবেই চলে যায়।মুরাদ এই নিয়ে অনেকদিন ঘোরে কনার পিছে।কনা এতটুকুও নরম হয় না।বরং তাকে থ্রেট দিলে মুরাদের বিরুদ্ধে আইনী পদক্ষেপ নিতে পিছ পা হবে না বলে জানিয়ে দেয়।কনার মনোভাব স্পষ্ট মুরাদের নিকট।একসময় পিছিয়ে যায় সে।নিজের করা ভুলে নিজে ফেঁসে গিয়েছে মুরাদ।স্বার্থের নেশা অন্ধ করে দিয়েছিলো তাকে।এজন্য স্ত্রীকে বিপদে ফেলেছিলো।যা এখন তার শখের জিনিসটার বিপদ ডেকে আনলো।মুরাদ সেদিন যে উদ্দেশ্য নিয়েই হোক কনার তরফ থেকে কাজটা ভালো হয়ে গিয়েছিলো।সৃষ্টিকর্তা এজন্য বোধ হয় তাকে নিরাশ করেনি।জিনাতের প্রতি মাসে যৎসামান্য ব্লিডিং হচ্ছিলো বলে বাচ্চা নষ্ট হবে ভাবলেও বাচ্চাটা ভালোভাবেই হয়ে গেলো।জিনাতের মুক্তি মেলেনি।তবে বাচ্চা মিললো মুরাদের।সে বাচ্চাকে নিয়ে নিজের কাছে নিয়ে গেলো।মায়ের আদর দিতে পারলো না ঠিক।তবে আদিম মানুষের ন্যায় দুধ মাতার ব্যবস্থা করে ফেললো।পাশের বাড়ির চাচাতো ভাই বউ জান্নাতুলকে।গত সপ্তাহেই একটা মৃ’ত বাচ্চা জন্মেছিলো সে।মুরাদ তার বাচ্চার কথা বললে সানন্দেই রাজী হয়েছিলো।তার শূন্য কোলটা অন্যের বাচ্চা হলেও একটু পূর্ণতা পাবে ভেবে।
__________
ধীরে ধীরে সময় গড়াতে থাকে।দিনের পর দিন চলে যায় রাতের পর রাত।সপ্তাহ,মাস,বছর ঘুরে সময়ের পালাবদলে সাত বছর অতিক্রম হয়।এই সাত বছরে জেরিনের জীবনে বিরাট পরিবর্তন ঘটে।পরিবর্তন ঘটে তার আশেপাশের মানুষগুলোর।যাদের নিয়ে সে কাজ শুরু করেছিলো তাদের জীবনযাত্রার।তারা এখন ভালো খেতে পায়,ভালো পরতে পায়।ভালোমতো জীবন কাটায়।ফলে আনন্দে ভরে গিয়েছে গ্রামের বাতাস।যদিও গ্রাম খুব একটা আর ঘুরে দেখা হয়না জেরিনের।সে এখন শহরে শিফট করেছে।শুরুতে সেরি কালচার করে রেশম সুতা বোনার যে কাজ শুরু করেছিলো সে তার পরিধি এখন ব্যাপক।লভ্যাংশের বৃদ্ধিতে আস্তেধীরে তার সুতা তৈরি পরিবর্ধিত হয়েছে কাপড় তৈরিতে।কাপড় থেকে পোশাক।এতদিনে বেশ জনপ্রিয় এক গার্মেন্টস এর মালিক হয়ে গিয়েছে সে।এখানে রেশমি পোশাক ছাড়াও এখন অন্য কাপড়ের পোশাক তৈরি হয়।লাভের পরিমাণ বেড়ে চলেছে তাই।বেড়ে চলেছে কর্মীর চাহিদা।এ মাসে নতুন কর্মী নিয়োগের এক বিজ্ঞাপন দিয়েছিলো পত্রিকায়।আজকে তার ইন্টারভিউ হচ্ছে।অর্ধশিক্ষিতা এই নারী এখন অনেক শিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত নারী পুরুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে।যাদের দেখলেই প্রাণ জুড়িয়ে যায় তার।জীবনে কখনো এমন পর্যায়ে আসবে তা কি সে ভেবেছিলো?

একের পর এক লোকের স্বাভাবিকভাবে ইন্টারভিউ নিয়ে শেষজনের কাছে এসে থমকে গেলো জেরিন।জীর্ণ শীর্ণকায় এক নারী তার সামনে অবস্থান করছে।চেহারার আর্ট অনেক পরিবর্তন হয়েছে।তবুও চিনতে এতটুকু ভুল হলো না জেরিনের।মেয়েটা জিনাত।পুরোনো এক বোরকায় মুড়ে রেখেছে দেহকে।মুখশ্রী অনাবৃত।চিন্তিত ও ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে।

জিনাতকে এখানে দেখে বিব্রত বোধ করে জেরিন।সে মুখের খেই হারিয়ে তাকিয়ে থাকলো।যা অস্বস্তি সৃষ্টি করলো জিনাতের মাঝে।কেমন ইতস্তত লাগলো।কিন্তু ফিরে যাওয়ার পথ নেই।গ্রাম থেকে চার ক্রোশ পথ পেরিয়ে শহরে এসে কাজের কথা না বলে ফিরে যাওয়া যায় না।খানিকটা ইতস্তত করে অফিসে পেতে রাখা দামী চেয়ারের দিকে তাকায় জিনাত।জেরিন ততক্ষণে সামলে নেয় নিজেকে।গম্ভীর হয়ে ইশারায় বসতে বলে।জিনাত ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে।জেরিনের পাশের ভদ্র লোক দু’টোকে দেখে কাচুমাচু করে বলে,

“আমি চাকরির ইন্টারভিউ দিতে আসিনি।আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি।”

জেরিন খোঁজ নিয়ে জানে আর কোনো চাকরি প্রার্থী নেই।তার পাশের লোক দু’টো বিদায় নিয়ে চলে যায়।তাদের কথা বলার পরিবেশ তৈরি করে দিয়ে।কিয়ৎপরিমাণ সময় আবারও নিরবতা চলে তাদের মাঝে।অতঃপর জেরিন মুখ খোলে,

“কি প্রয়োজন বলুন।”

জিনাত যে এখন কতটা দূরসম্পর্কের তা বোঝাতে আপনি সম্বোধন তার।জিনাত বুঝতে পারে বিষয়টা।মাথা নত করে ফেলে সে।যা বলতে এসেছে তা কোন মুখে বলবে বুঝতে পারছে না।আমতা আমতা করে কিছু সময় পর বলে,

“আমাকে ক্ষমা করবেন এখানে এসে আপনাকে বিব্রত করার জন্য।আমি জানি আমার ক্ষমা চাওয়ার মুখ নেই।আমি যা করেছি তার শাস্তি ষোলো আনা দুনিয়ার বুকেই পাচ্ছি।ভাইয়া ও আম্মাও পাচ্ছে।কিছু অন্যায়ের ফল আল্লাহ দুনিয়াতেও দেখায়।আপনার সাথে করা অন্যায় তার মধ্যে একটা ছিলো।”

তপ্ত শ্বাস ছাড়লো জিনাত।জেরিন একসময় খুব করে এসব শুনতে চেয়েছিলো।জিনাত, মনোয়ারা ও জুবায়ের-এর পতন দেখতে চেয়েছিলো।তা অনেক আগেই ঘটে গিয়েছে।জিনাতদের অনুতপ্ত চেহারা ও ক্ষমা চাওয়া সে দেখতে চেয়েছিলো।তা আজ দেখছে।অথচ স্বস্তি লাগছে না তার।এসব কেবলই তার অতীত মনে করাচ্ছে।অথচ এ কয় বছরে কাজের ব্যস্ততা নিয়ে অতীত সে ভুলে গিয়েছে।তার ধ্যান জ্ঞানের পুরোটা জুড়ে এখন কেবলই বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বিরাজ করে।সে অতীত নিয়ে জিনাতদের অনুতপ্তত দেখতে চেয়েছিলো ঠিকই কিন্তু সেসব অতীতেই।এই সুন্দর বর্তমানে নয়।এসব শুনতে বিরক্ত লাগছিলো তার।জিনাত আবারও বললো,

“আমরা আমাদের বংশধর রক্ষার জন্য আপনার সংসার ভেঙেছিলাম।অন্য কাওকে এনে আপনার শূন্যস্থান পূরণ করে পূর্ণ সংসার দেখতে তৎপর ছিলাম।কিন্তু ভাগ্যের লেখন অন্য ছিলো।আপনার সংসার ভাঙায় আমাদের পুরো সংসারটাই ভেঙে গেলো।ভাগ্যক্রমে পর পর জেলে গেলাম সবাই। আমার ও মায়ের জেলে যাওয়ার পেছনে মুরাদের হাত ছিলো জানতে পারিনি।আমাদের পুরো সংসার এই কয় বছরে চুষে খেয়েছে সে।নিজের ব্যবসা বাড়িয়েছে ভাইয়ের টাকায়।সব লুটপাট করে নিঃস্ব করে দিয়েছে আমাদের।ভাইয়ার ও আমাদের মুক্তির ব্যবস্থা করবে বলে একের পর এক জমি বেঁচিয়েছে।অর্থগুলো ঢেলেছে নিজের পিছনে।…..

বলতে বলতে নেকাবের কোনা দিয়ে চোখ মুছলো সে।জেরিন এসব শুনতে আগ্রহী নয়।সে তখনই বুঝেছে ওরা সব স্বার্থপর।মুরাদ আজ যা করেছে তা ওদের সাথে থেকেই শিক্ষা পেয়েছে।সে নিজেও তো কত কি করেছিলো ওদের জন্য। ওরা চুষে খাওয়া ছাড়া অন্য কিছু কি করেছে?তাহলে আজ অন্য কারো সেম কাজের ফলে চোষন খোর বলছে কি করে?লজ্জা করছে না?জেরিন স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।জিনাত যোগ করে,

“মুরাদ শেষমেষ বিয়েও করেছে জানেন?ভাগ্য আমাকে আপনার সাথে করা অন্যায়ের পুরোটা ফিরিয়ে দিয়েছে!”

চলবে