#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Turmeric_Special
#Writer_NOVA
সবুজ পাড়ের কাঁচা হলুদ রঙের শাড়ির সাথে কাঁচা ফুলের গহনায় আমাকে বউ, বউ লাগছে। আয়নার সামনে গিয়ে নিজেই অবাক। মেকআপের কি জাদু ভাভা গো ভাভা🥵! নিজেকে নিজেই চিনতে পারছি না। পার্লারের মেয়েটাকে এতো করে বললাম হলুদে একটু কম সাজাবেন। কিন্তু উনি আমাকে কালো পেত্নী থেকে সাদা পরী বানিয়ে দিয়েছে। ভাগ্যিস হাত-পায়েও একটু মেকআপ করে সাদা করে দিয়েছে। নয়তো মুখে লাইট জ্বলতো আর সারা শরীর লোডশেডিং হয়ে থাকতো।
— নোভাপু তোমার হইছে? পার্লারের মেয়ে তো সেই কবে তোমাকে সাজিয়ে বেড়িয়েছে। তাহলে এখনো বের হচ্ছে না কেন?
তন্বী ঝাঁঝালো গলায় চেচিয়ে কথাগুলো বললো। ওর সাথে গলা মিলালো আমার বড় ভাগ্নি অনন্যা। শাড়ির কুঁচিগুলো ঠিক করতে করতে অনন্যা আমাকে বললো,
— খালামণি গো চলো এবার। তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে। এতো আয়না দেখতে হবে না। আঙ্কেল তো আজকে তোমাকে নিতে আসবে না।
অর্থি দুই হাত কোমড়ে রেখে শাসনের সুরে বললো,
— ঐদিকে সব ঠিক হয়ে গেছে। কিন্তু তোমারি হয় না।নানাভাই চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিবে।
আমি সবার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম। ওদের সবার পরনে সবুজ রঙের শাড়ি, হলুদ ব্লাউজ। মাথায়,কানে,গলায় হলুদ রঙের প্লাস্টিকের ফুলের সেট। খোপায় গাজরা। একেকজন মেকআপের জাদুতে পরী হয়ে আছে। ছেলেদের হলুদ পাঞ্জাবী সাথে সবুজ রঙের কোটি। আমাকে হাসতে দেখে তন্বী চেচিয়ে বললো,
— দাঁত পরে কেলিয়ো। এখন দয়া করে রুম থেকে বের হও। সবাই চেচানো শুরু করবে।
আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ফুলের গহনা ঠিক করতে করতে বললাম,
— সব ঠিক তো। গিয়ে কিন্তু বসে থাকতে পারবো না। এমনি আমার শীত করছে। তারপর আজকে চলবে আমার ওপর খাওয়ার অত্যাচার। নূর আপি, ইভা কোথায়? আমার তিন চাচাতো ভাইয়ের বউ কি রেডি হইছে?
অর্থি আমার হাত ধরে রুম থেকে টেনে নিতে নিতে বললো,
— চলো এখন।সবাই রেডি হয়ে গেছে। কিন্তু তুমিই বের হও না। অনেক দেরী হয়ে গেছে খালামণি।
আমি ওর থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম,
— একটু দাঁড়াও তোরা। তোর আঙ্কেল ভিডিও কল দিবে। তাকে দেখিয়ে তারপর বের হবো। এর জন্য দেরী হচ্ছে।
তন্বী,অনন্যা, অর্থি একসাথে চেচিয়ে উঠলো। অনন্যা কাছে এসে আমার গাল টেনে দিয়ে বললো,
— তাহলে এই ঘটনা। তুমি আঙ্কেলের সাথে কথা বলবে বলে এতো দেরী করছো।
আমি লাজুক হাসি দিয়ে মোবাইল নিলাম। আমি ভিডিও কল দেওয়ার আগে এনাজ দিয়ে ফেলছে। আমি রিসিভ করতেই এক হাত মাথায় দিয়ে হা করে রইলো। তাকে এভাবে দেখে আমি মুখ টিপে হেসে উঠলাম। মাথার থেকে হাত সরিয়ে মুখের সামনে দিয়ে চোখ দুটো রসগোল্লা করে বললো,
— মা শা আল্লাহ! আমার বউটাকে তো পরীর মতো লাগছে। আমার তো চোখ সরানো দায় হয়ে পরছে। কাজলের টিপ পরে নিয়ো। কারো নজর লেগে গেলে আমি শেষ।
— আপনার পাঞ্জাবী কোথায়? শুধু পাতলা গেঞ্জি পরে বসে আছেন যে?
— তোমার দেবর আমার আগে তোমাকে হলুদ ছোঁয়াতে গিয়েছে। ওকে ছাড়া কি আমি কিছু করতে পারি।
— তায়াং ভাইয়া কোথায়? ওকে একটু মোবাইলটা দিন তো। ওর সাথে একটু কথা বলি।
— তায়াং তো এখানে নেই।
— কোথায়?
— আমি বলতে পারবো না।
— ইমরান হাশমি ভাইয়া, শাহেদ ভাইয়া, রায়হান, তওহিদ ভাইয়ার বাবা-মা আসার কথা শুনছিলাম। তারা কি আসছে?
— হ্যাঁ, সবাই আসছে।
— তায়াং ভাইয়াকে বলেন ওকে আমাদের বাসার কুকুর তাড়ানোর দায়িত্ব রাখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ও তো এলোই না। আগেই ভয় পেয়ে গেছে।
— তায়াং শুনলে দিবো নে মাইর।
— কিছু করতে পারবো না।
— জানো, আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না আগামীকাল আমাদের বিয়ে। আজ হলুদ। মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি।
— আমারও মনে হচ্ছে।
আমরা কথা বলছি অর্থি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অনন্যা, তন্বী বাইরে চলে গেছে। সদর দরজায় দাঁড়িয়ে ক্যামেরাম্যান চেচিয়ে বললো,
— বউ কই? এবার বের হোন। ভিডিও তো শুরু করতে হবে। মাথায় ওড়না ধরার লোকরা তৈরি থাকেন। বউয়ের মা-বাবা রেডি তো।
ইভা দৌড়ে এসে রুমে ঢুকে বিরক্তি নিয়ে বললো,
— বোইনে তোমার কি হলুদের অনুষ্ঠান করার ইচ্ছে আছে? থাকলে বের হও। ঐদিকে সামাদ ভাইয়া, আব্বু, কাক্কুরা আমারে বকতাছে। আমি আর নূর আপি ডিসপ্লের খাবার সাজাইতে গিয়ে দেরী করে ফেলছি। রেডী হয়ে দেখি তোমার হয় নাই। এবার রুম থেকে বের হও।
আমি মোবাইলের থেকে চোখ সরিয়ে ইভার দিকে তাকিয়ে বললাম,
— এখুনি বের হবো। নূর আপির হইছে?
— সবার সবকিছু হইছে। শুধু তোমার ছাড়া।
— আমি তো রেডি।
— তাহলে বের হও না কেন?
— তোর ভাইয়ার সাথে কথা বলতাছি।
— পরে মন ভরে বলো। এখন ভালোই ভালোই অনুষ্ঠান শেষ করতে দাও।
ইভা একদফা ঝেড়ে বের হয়ে গেলো। আমি অর্থিকে ডেকে বললাম,
— অর্থি শুনে যাও তো খালামণি।
— হ্যাঁ, খালামণি বলো।
— তোমার আঙ্কেল ভিডিও কলে সব দেখবো। তুমি ব্যাক ক্যামেরা দিয়ে মোবাইল ধরে রেখে সব দেখাবা।
— আচ্ছা খালামণি। মোবাইল দাও।
আমি এনাজের থেকে বিদায় নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়ালাম। সামাদ ভাইয়া ধমক দিয়ে বললো,
— তোর কি হয় না? কত সাজিস? এখন শুরু করলে বেশি রাত হয়ে যাবে। তখন আরেক ঝামেলা। শীতের রাতে কি এত দেরী করতে হয়।
— সব মিলে আবার আমাকে বকা শুরু করছিস তোরা। আজকে যে আমার গায়ে হলুদ তাও ভুলে গেছিস। কালকে তো চলে যাবো। এখন একটু রেহাই দে। কোথায় ক্যামেরাম্যান? তাকে এখন আসতে বল।
— এখানেই তো ছিলো। কোথায় গেলো আবার?
— তোর বউ, ভাবীদের সাজ কমপ্লিট তো?
— তুই বের হো। বাকিসব চুলোয় যাক। কাকায় যখন রেগে বলবো কিছু করতে হবে না তখন ভালো হবে।
— কিচ্ছু বলবে না। অনন্যা,ইভা, তন্বী কোথায়? ওদের একটু ডেকে দিস তো।
— তুই এখানে দাঁড়া, আমি দেখছি।
সামাদ ভাইয়া চলে গেল। এই মাসের ১৮ তারিখে ওর প্রবাস যাওয়ার ফ্লাইট ছিলো। আমার বিয়ে উপলক্ষে এক মাস সময় বাড়িয়েছে। সব রেডি হয়ে এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছে। ঐশী, আশা, নাবিলা সব মিলে হুলস্থুল করছে। নূর আপি আমার সামনে এসে বললো,
— দেখ তো কানের দুলটা ঠিক আছে কিনা। ব্যাথা পাচ্ছি কেন?
— দাও আমি ঠিক করে দেই।
— তোর দেবররা কতদূর আছে?
— আমি জানি না। এনাজকে তো এই বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। ওড়না ধরবে কে কে? আমি কিন্তু নাচতে নাচতে স্টেজে উঠবো। আমার সাথে সাথে তোমরাও নাচবা।
— কেন রে আমরা নাচবো কেন? বিয়ে তো তোর। তোর বিয়ে তুই নাচবি।
আমি নূর আপির কানের দুলটা ঠিক করে দিয়ে সোফায় পা ছড়িয়ে বসে রইলাম। এতখন সব মিলে আমাকে বকে এখন হাওয়া। আমার জামাইটার সাথে ভালো করে কথাও বলতে দিলো না। অর্থি মোবাইল নিয়ে স্টেজের দিকে চলে গেছে। আমার বর মহাদোয় হলুদের স্টেজ দেখবে।
💖💖💖
অবশেষে তাদের সবার খেয়াল হলো বউ বেচারি হাত-পা ছড়িয়ে সোফায় বসে আছে।এগিয়ে এসে বাকি কাজগুলো সমাধান করতে লাগলো। আব্বু-আম্মুর সাথে রুমে ভিডিও করলো। তারপর মাথায় ওড়না ধরে স্টেজে নিয়ে যাওয়া হলো। ইভা,তন্বী,অনন্যা,অর্থি এই চারজন ওড়না ধরছে। আমি নাচতে নাচতে স্টেজে উঠছি। সব আমার কান্ড দেখে হাসছে। আমার সাথে ওরা চারজনও নাচছে। একেকজন তো বিয়ে পাগলী খেতাবও দিয়ে দিয়েছে। যে যা খুশি বলুক। আমার কি? প্রিয় মানুষটার সাথে বিয়ে হওয়ার আনন্দ তারা কি বুঝবে। স্টেজের সোফায় বসার আগেও একচোট নাচলাম। পাশে ছোট একটা সাউন্ডবক্সে বলিউডের হিট গান ছাড়া হয়েছে। অনেক কষ্ট করে বক্স ম্যানেজ করতে পেরেছি। আব্বুতো কিছুতেই গান বাজাতে দিবে না। সবাই আব্বুকে অনেকটা ধরে-বেধে রাজী করছে। সামাদ ভাইয়ার বিয়েতে বক্স বাজেনি। তাই আব্বু আরো রাজী হয়নি। অনেক কষ্টে যখন রাজী করালো তখন ছোট বক্স আনার অনুমতি দিলো। যাতে গানের শব্দ আমাদের বাড়ি ছেড়ে অন্য কোন বাড়িতে না যায়। এতেই সব খুশি। গান বাজাতে দিবে এটাই অনেক।
আমার ওপর খাবারের অত্যাচার শুরু হয়ে গেছে। আব্বু-আম্মুর পর একে একে দুই চাচা-চাচী এসেছে। তারপর শাহীনুর আপু ও দুলাভাই। এরপরে তিন চাচাতো ভাই তাদের বউ নিয়ে স্টেজে উঠলো। সবাই খাইয়ে খাইয়ে আমাকে আজ ঢোল বানিয়ে দিবে। সামাদ ভাইয়া এক পিস মিষ্টি বাড়িয়ে দিতেই আমি নাক,মুখ সিটকে বললাম,
— ভাইয়া মিষ্টি খাবো না। অন্য কিছু দে।
— পায়েস খাবি?
— না অন্য কিছু।
— তুই মিষ্টিই খাবি। আমাকেও হলুদের দিন ইচ্ছে মতো খাইয়ে গেছিস।
— প্লেটে পাঁচশত টাকা রেখে যাস।
— তোকে খাইয়ে দিবো আবার টাকাও দিবো। এত শখ নাকি।
— কিপ্টা টাকা দিয়ে যাবি।
— ময়দা মেখে তো ময়দা সুন্দরী হয়ে গেছিস। একেকটা কয়েক কেজি আটা-ময়দা মাখছিস তোরা?
— তোর হলুদে সাজতে পারি নাই। সেই দুঃখে আমি শেষ। তাই নিজের হলুদে সাজছি। ও মারিয়া ভাবি দেখছো কিভাবে অপমান করলো আমাদের? আমরা বলে ময়দা সুন্দরী।
মারিয়া ভাবি চোখ পাকিয়ে সামাদ ভাইয়াকে বললো,
— কি বললেন আপনি?
আমি আস্তে করে সামাদ ভাইয়ার সামনে মুখ নিয়ে বললাম,
— দিয়েছি তোর বউকে রাগিয়ে। এবার সামলা গিয়ে।
মারিয়া ভাবি মুখ ঝামটা মেরে গটগট পায়ে স্টেজ থেকে নেমে গেলো। যাওয়ার আগে আমি ভাবীকে একটা চোখ মারলাম। ভাবী খিলখিল করে হেসে উঠলো। সামাদ ভাইয়া দ্রুত পায়ে তার বউয়ের পেছনে ছুটলো। একে একে বাসার সবাই হলুদের ছোঁয়া দিয়ে গেলো। সাথে খাবারের অত্যাচার। পাক্কা দুই ঘন্টা পর সবার হলুদ দেয়া শেষ হলো।
চুপচাপ স্টেজে বসে আছি। নূর আপির দিকে তাকিয়ে দেখলাম বিষন্ন মনে একটা খালি প্লেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তায়াং ভাইয়া নেই বলে নিশ্চয়ই মন খারাপ তার। সবাই যার যার স্বামীর সাথে এসে আমাকে হলুদ ছুঁয়ে যাচ্ছে। এতে হয়তো তারও খারাপ লাগছে। তার মন ভালো করার জন্যও আমি তাকে ডেকে বললাম,
— ও নূর আপি বিরিয়ানি তো এখনো হয়নি। তুমি প্লেট নিয়ে এখুনি দাঁড়ায় আছো। মাত্র মাংস কষাইতেছে। বিরিয়ানি হতে দেরী আছে। বেশি খুদা লাগলে এদিকে আসো আমার সামনে বহুত খাবার আছে। এগুলোর থেকে খেয়ে আমার ওপর খাবারের অত্যাচার কমিয়ে দাও।
নূর আপি চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে বললো,
— আসতোছি আমি। বিরিয়ানির জন্য দাঁড়ায় আছি তোকে কে বললো?শাহিনুর আপু এটা ধরায় দিলো। তোর মাথায় এই প্লেট ভাঙবো আমি।
— আরে রেগো না। এক প্লেট বিরিয়ানিই তো। তুমি যেভাবে এক দৃষ্টিতে বিরিয়ানির ডেকচির দিকে তাকিয়ে আছো। তাতে তো আমার ভয় করছে। তোমার নজরে আবার বাকি সবার পেট ব্যাথা না করে।
নূর আপি স্টেজে উঠে দুম করে আমার পিঠে একটা কিল বসিয়ে দিলো। আমি পিঠ বাঁকিয়ে আহ করে চিৎকার করে উঠলাম। হাসতে হাসতে বললো,
— আমি বিরিয়ানির ডেকচির দিকে তাকিয়ে আছি?
— তাই তো দেখলাম। তুমি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো সেই বরাবরি বিরিয়ানির ডেকচিতে বিরিয়ানি রান্না হচ্ছে। কে জানে তাকিয়ে তাকিয়ে লালা ফেলছো কিনা। আমি তো দেখি নাই।
নূর আপি আমার কান টেনে ধরে বললো,
— তোকে এখন কিন্তু ইচ্ছে মতো মারবো।
— আহ্, নূর আপি ছাড়ো। ব্যাথা পাচ্ছি তো।
নূর আপি কান ছেড়ে দিয়ে শাসানো গলায় বললো,
— হলুদের স্টেজে বসেও দুষ্টমী করছিস?
— কি করবো গো নূর আপি! বিয়েটা আমার এনজিও সংস্থার সাথে হচ্ছে তাই আমি অনেক খুশি। কিন্তু সবাইকে ছেড়ে যাবো এই কথাটা যখুনি মনে হচ্ছে বুক ফেটে কান্না আসছে। সেগুলো কে দমাতে এখন আমাকে দুষ্টুমিতেই মেতে থাকতে হবে। আব্বু-আম্মুর মুখের দিকে তাকালে আমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হয়।
মুহুর্তে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। চোখের কোণে আসা পানিকে নিচে পরতে দিলাম না। টিস্যু দিয়ে মুছে ফেললাম। ক্যামেরাম্যান জিজ্ঞেস করলো
— আপু, আরো কেউ বাকি আছে?
এদিকে শারমিন আসেনি। আরো মানুষ আছে। এদিক সেদিক তাকিয়ে তাকে বললাম,
— ভাইয়া আরো মানুষ আছে। আমার একমাত্র দেবর আসছে। সাথে বরের বন্ধুরা।
— আচ্ছা আপু সমস্যা নেই।
ওদের জন্য অপেক্ষা করতে বলে আবারও চুপ করে বসলাম। আব্বু রান্নার তদারকি করছে। আম্মু রান্নাঘরে ব্যস্ত হয়ে পরছে। সাউন্ড বক্সে অক্ষয় কুমার ও ক্যাটরিনার নতুন মুভির নাযা গানটা বাজছে। সাউন্ড বক্সে গান বাজানোর দায়িত্বে আছে মুহিন।
— আমাকে ছাড়া হলুদের অনুষ্ঠান শেষ।
তায়াং ভাইয়ার কন্ঠ শুনে চমকে উঠলাম। সামনে তাকিয়ে অবাক। ভাইয়া দুই হাত কোমড়ে রেখে আমার দিকে প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকিয়ে আছে। ভাইয়াকে দেখে ঠিক কতটা খুশি হয়েছি তা বলে বোঝাতে পারবো না। নূর আপির দিকে তাকিয়ে দেখলাম তারও আমার মতো রিয়েকশন। আমি দৌড়ে গিয়ে ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলাম। ভাইয়া আমাকে আশ্বস্ত গলায় বললো,
— আরে কাঁদছিস কেন? আমি তো এসে পরছি তাই না। বেশি কাঁদলে সব মেকআপ নষ্ট হয়ে রিয়েল শাঁকচুন্নিতে পরিণত হবে।
তবুও আমি ওকে ছাড়লাম না। নাক টেনে কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
— আমি ভাবছি তুই আসবি না।
— আমার বোনের গায়ে হলুদে আমি থাকবো না। তা কি হয় বল? তাই তো না এসে পারলাম না। এখন কান্না বন্ধ কর।
— আমি অনেক খুশি হইছি ভাইয়া।
— তোর খুশির জন্যই আসছি আমি।
— আয় আমাকে হলুদ দিবি।
— না তোর বিয়ের কুকুর তাড়াতে আসছি আমি।তোকে হলুদ দিয়ে কি করবো বল? যেই কাজে আসছি তাই করি তাহলে।
আমি ভাইয়াকে ছেড়ে ওর বাহুতে একটা কিল বসিয়ে দিয়ে বললাম,
— এনাজ এই কথাও বলে দিয়েছে।
— হুম। এবার একটু দূরে সর তো। আমাকে একটু হাওয়া-বাতাস খেতে দে। এতখন বিশাল এক হাতি আমাকে জাপ্টে ধরে ছিলো। নড়তে-চড়তেও পারিনি।
আমি চোখ দুটো ছোট ছোট করে চেচিয়ে বললাম,
— তায়াং ভাইয়া।
— হু অনেক ভয় পাইছি। এবার বোন জলদী গিয়ে স্টেজে বস। তোকে হলুদ দিয়ে আবার যেতে হবে আমাদের।
— বাকি সবাই কোথায়?
— আসতেছে।
— তোর জন্য নূর আপিও আমায় হলুদ দেয়নি।
— তাই নাকি। তাহলে আমরা জামাই-বউ একসাথে হলুদ ছোঁয়াই।কোথায় আমার বউ?
— দেখ এদিকেই আছে।ক্যামেরাম্যান কোথায়?
তায়াং ভাইয়া নূর আপির সাথে কথা বলতে চলে গেল। আমি ক্যামেরাম্যানকে ডাকতেই সে হন্তদন্ত হয়ে আমার কাছে এসে বললো,
— জ্বি আপু। কিছু বলবেন?
— মানুষ চলে আসছে। ভিডিও শুরু করেন।
— ওকে আপু।
শারমিন দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো আমাকে।আকস্মিকতায় আমি কিছুটা হকচকিয়ে গেলাম। শারমিনকে ছাড়িয়ে বললাম,
— এই তোদের আসার সময় হলো। দশটা বেজে গেছে প্রায়।
শারমিন ঠোঁট উল্টে বললো,
— আমার কোন দোষ নেই। এরাই দেরী করে বের হয়েছে। বৃহস্পতিবার কি যাম থাকে জানিসই তো।ভাগ্য ভালো আমি পুরো রেডি হয়ে এসেছি। নয়তো আজকে আমার আর শাড়ি পরতে হতো না।
— একটু জিরিয়ে নে।
শারমিনকে চেয়ার টেনে বসিয়ে দিলাম।তওহিদ ভাইয়া, এনাম,রওনক সাথে কুশলাদি বিনিময় করলাম। এনাম চোখ দুটো গোল গোল করে বললো,
— মা শা আল্লাহ। ভাবী আপনাকে আজ যা লাগছে না। ভাইয়া সরাসরি দেখলে সাথে সাথে অজ্ঞান হয়ে যেতো।
— শুকরিয়া ভাইয়া। দাঁড়ায় আছেন কেন? বসেন আপনারা। এই অনন্যা,অর্থি এদিকে একটু আসিস।
রওনকের চোখ দুটো এদিক সেদিক চলমান। বোঝাই যাচ্ছে তন্বীকে খুঁজছে। আমি তাকে বললাম,
— তন্বী, এদিকেই আছে। ভালো করে খুঁজে দেখেন।
— না মানে আমি এমনি দেখছিলাম।
— কাউকে খুঁজছিলেন তা আমি জানি। এত ভনিতা করতে হবে না।
এনাম আমার হাতে বিয়ের শাড়ি,গহনার প্যাকেট তুলে দিয়ে বললো,
— ভাবী, যা করার একটু তাড়াতাড়ি করেন। আমাদের আবার ফিরতে হবে। ঢাকায় গিয়ে আবার ভাইয়াকে হলুদ ছোঁয়াবো।
— তাই বলে আপ্যায়ন করবো না? এটা কোন কথা হলো নাকি। আপনারা বসেন।
আমি ইভাকে ডেকে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতে বলে দিলাম। এর ফাঁকে তারা সবাই হলুদ ছোঁয়াবে।প্রথমে তায়াং ভাইয়া ও নূর আপি তারপর তওহিদ ভাইয়া ও শারমিন। তন্বী রওনকের সাথে আরেকবার হলুদ ছোঁয়াতে এলো। এনাম একা উঠে আমার সাথে বসে আফসোসের সুরে বললো,
— আমার তো কেউ নেই তাই আমি একাই দিয়ে গেলাম। সবাই জোড়া, জোড়া। এদের মাঝখানে নিজেকে অসহায় শিশু মনে হচ্ছে।
আমি ফিক করে হেসে উঠলাম। হলুদের পর্ব অবশেষে শেষ হলো। এখন মেহেদী দেওয়ার পালা। ইভা, তন্বী দুজনে মেহেদী নিয়ে দুই পাশে বসলো। ক্যামেরাম্যান ভিডিও শুরু করছে। তায়াং ভাইয়ারা বিদায় নিয়ে চলে গেল। আধা ঘণ্টার বেশি থাকেনি। ওদের ফিরতে হবে বলে কেউ জোরও করেনি। বসে থাকতে থাকতে পিঠ ধরে গেছে। পেট পুরো ভর্তি। নড়তে-চড়তেও পারছি না। নিজেকে এখন মোটাসোটা হাতি মনে হচ্ছে। এখন আবার মেহেদী নিয়ে বসে থাকতে হবে। বিয়ে তো নয় আমার ওপর অত্যাচার। তার মধ্যে সারারাত জেগে থাকতে হবে। এই কথা মনে আসতেই আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। আমি জানি একটুর জন্যও চোখ লাগাতে পারবো না। এভাবে আমাকে না জ্বালালেও পারতো😖।
#চলবে
#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Part_65
#Writer_NOVA
চোখ দুটো জ্বলতেছে। সারারাত ঘুমাতে দেয়নি পুঁচকেগুলো। সাথে আমার জামাইটা অডিও কল দিয়ে সারারাত জাগিয়ে রেখেছে। ফজরের নামাজের পর চোখ দুটো একটু বন্ধ করেছিলাম। সকালের হুলস্থুলে জেগে গেছি। এই তিনদিন আমার ঘুম চান্দের দেশে যাবে। খিচুড়ি খাওয়ার ধুম পরেছে। চোখে, মুখে পানি দিয়ে মাথায় আধ ঘোমটা টেনে বাইরে চলে গেলাম।আমাকে দেখেই নূর আপি ডাকলো।
— এই নোভি এদিকে আয়। তোকে খাইয়ে দেই।
— না গো, খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না।
— এদিকে আসতে বলছি।
—রাতে জোর করে একগাদা খাইয়ে দিছো।
— কথা কম বলে এদিকে আয়।
চুপচাপ তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। এখন না খেলে রাগ করবে সে। তন্বী, ইভা, অনন্যা,অর্থি এক টেবিলে গোল করে বসেছে। শাহীনুর আপু অনন্যাকে কি জানি বলেছে। যার জন্য অনন্যা রাগ করে খাবে না বলছে। আমি অনন্যাকে জিজ্ঞেস করলাম,
— কি হয়েছে অন্যা? খাবার নিয়ে রাগ কেন?
অনন্যার উত্তর দেওয়ার আগে মুখ টিপে হেসে ইভা বলে উঠলো,
—অন্যার প্লেটে কোন গোশত পরেনি। তাই অন্যা খাবে না বলছে।
অন্যা রেগে ইভার দিকে তাকালো। তারপর চেয়ার থেকে উঠে ইভার গালে জোরে টান দিয়ে বললো,
— তুই আরো মাইর খাবি।
ইভা এসব তোয়াক্কা না করে মুখ ভেংচি কেটে বললো,
— সত্যি কথা বললে সবারি গায়ে লাগে। এক পিস গোশত পরেনি বলে এতো কান্নাকাটি করার কি দরকার? খিচুড়ির বোল থেকে খুঁজে নে।
ইভার সাথে এবার সুর মিলালো অর্থি,
— থাক আপ্পি রাগ করিস না। আমার প্লেটে অনেক গোশত আছে। এখান থেকে দুই পিস নিয়ে যা। তবুও কান্না করিস না।
অনন্যা ফোঁস করে রেগে ওদের দুজনকে বললো,
— তোরা দুজন সত্যি আমার হাতে এখন মার খাবি। নোভা খালামণি ওদের কিছু বলো। নয়তো আমি যে ওদের কি বলবো তা আমি নিজেও জানি না। সকাল থেকে আমার পিছনে লাগছে।
আমি বলবো কি ওদের খুনসুটি দেখে মিটমিট করে হাসছি। তন্বীর দিকে তাকাতেই আমার মুখের হাসি মিইয়ে গেলো। ও মন খারাপ করে প্লেটের খাবার নাড়াচাড়া করছে। নিশ্চয়ই আমার ও তায়াং ভাইয়ার সাথে করা দুষ্টুমির কথা মনে পরে গেছে। আমি নূর আপির পাশ থেকে সরে তন্বীর সামনে চলে এলাম। ওর কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলাম,
— কি রে কি হয়েছে তোর? আমাকে কি খাইয়ে দিবিনা?
তন্বী ছলছল চোখে আমার দিকে তাকালো। প্লেট থেকে এক লোকমা খিচুড়ি আমার মুখে দিয়েই চোখের পানি ছেড়ে দিলো। আমি ওর চোখের পানি মুছে দিয়ে বললাম,
— একদম কান্না করবি না। তোরা কান্না করলে কিন্তু আমিও কান্না করবো। সেটা কি তোরা চাস?
তন্বী ডানে-বামে মাথা নাড়িয়ে না বুঝালো। তারপর কান্না জড়ানো কন্ঠে বললো,
— আমার এখনো মনে হচ্ছে তোমার বিয়ে না। আমরা সবাই মিলে অন্য কারোর বিয়েতে আসছি। বিয়ে শেষ হলে তোমাকে নিয়ে ঢাকা চলে যাবো। কিন্তু এবার তো তা হবে না। তবুও মনটাকে মানাতে পারছি না।
তন্বী আমাকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। আমি খেয়াল করলাম আপনাআপনি আমার চোখ দিয়ে পানি পরছে। টেবিলের সবার মন খারাপ। মোবাইলে কল আসতেই আমি তন্বীকে ছেড়ে মোবাইলের দিকে তাকালাম। আমার জামাই মহাদোয় কল করছে। দুদিন ধরে সে যা শুরু করছে। মনে হচ্ছে অন্য কেউ এসে তার বদলে আমাকে নিয়ে যাবে। একটু সময় পরপর কল করছে। আমি সবার দিকে তাকিয়ে বললাম,
— তোমরা খেতে থাকো। আমার উনি ভিডিও কল দিয়ে ফেলছে। তার সাথে একটু কথা বলে নেই।
তন্বী চোখ মুছে টিপ্পনী কেটে বললো,
— তোমার জামাই তো দেখছি বিয়ের আগেই বউ পাগল হয়ে গেছে।
আমি মুচকি হেসে ওদের সামনে থেকে সরে গেলাম। কল রিসিভ করে তার দিকে একটা রাগী লুক দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
— সমস্যা কি? সারারাত কথা বলে মন ভরেনি? আবার সকাল সকাল কল?
— আমার বউ, আমার যতবার ইচ্ছে হবে তত কল করবো। আমার সাথে কথা বলতে হবে।
— আমার কি আর কোন কাজ নেই? সারাদিন আপনার সাথেই কলে কথা বলবো?
— নতুন বউয়ের আবার কিসের কাজ? তুমি কিছু করবা না। যা করার বাকি সবাই করবে। খবরদার কোন কাজে হাত দিবে না।
— ইস, ভালোবাসা দেখানো হচ্ছে। আমিও দেখবো বিয়ের পর এই ভালোবাসা কোথায় যায়?
এনাজ আমার কথার উত্তর না দিয়ে গানের সুরে বললো,
— আমি তোর ব্লাক কফি, তুই আমার সুগার
আমি তোর কোকাকোলা তুই আমার বার্গার
তোর ঐ হটনেসে জ্বলে আমি ছারখার
পারছি না আর বেবী তোকে খুব দরকার
— এখন গান গাওয়া হচ্ছে?
— তোমাকে রাগলে বেশি সুন্দর লাগে।
— এই আপনার কি কোন কাজ নেই?
— হ্যাঁ, আছে তো। আমি আমার টিডি পোকার সাথে কথা বলছি এটাও একটা কাজ।
— আপনি আমাকে জ্বালাতন করছেন অনেক।
— হুম আমি জানি। সবে তো শুরু। আরো কতকিছু যে সহ্য করতে হবে তোমাকে। এই অগোছালো ছেলেটাকে পুরোটা গুছাতে হবে ম্যাডাম।
— মেরে পিটিয়ে সোজা করার জন্য আসতেছি আমি। একটু অপেক্ষা করেন।
এনাজ আমার কথা শুনে চোখ দুটো ছোট ছোট করে আমার দিকে তাকালো। আমি তার চেহারা দেখে খিলখিল করে হেসে উঠলাম। কথা বলতে বলতে সেই ছোট সবুজ ঘাসের মাঠের সামনে চলে এসেছি। এই মাঠেই ছিলো আমাদের শিশির ভেজা রোদ্দুর উপভোগ করা। একসাথে পাশাপাশি চলা। আমি ব্যাক ক্যামেরা দিয়ে সেই মাঠটাকে দেখিয়ে এনাজকে বললাম,
— দেখেন তো চিনতে পারছেন কিনা?
— এটা ঐ মাঠটা না যেখানে আমরা খালি পায়ে একসাথে হেঁটেছিলাম?
— জ্বি হ্যাঁ। মনে আছে তাহলে?
— আমার মনে আছে। ভুলে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
— আমি এখন একা একা শিশির ভেজা রোদ্দুর উপভোগ করবো।
— একদম না। আমাকে ছাড়া তুমি কিছু করবে না।
— আমি আপনাকে ছাড়াই উপভোগ করবো।
— ভালো হবে না কিন্তু টিডি পোকা।
— আচ্ছা, পরে একসাথে করবোনি।
— এখন বাসায় যাও।
— তায়াং ভাইয়া কোথায়?
— কে জানে। ওর খবর জানি না। বেচারা অনেক ব্যস্ত। সবদিক সামলাচ্ছে।
— আর আপনি বসে বসে বউয়ের সাথে পেচাল পারছেন। ওদের সাথে হেল্প করলেও তো একটু কাজ কমে।
— আমি জামাই না, আমি কাজ করবো কেন?
— হু দুই পা মুড়ে খাটে বসে থাকেন।
— হ্যাঁ তাই তো করছি।হাতের মেহেদী দেখাও।
— এই যে দেখেন।
— আমার নাম লিখোনি?
— জ্বি আপনার শালিকারা লিখে দিয়েছে। দুই হাতেই লিখেছে। আপনার মেহেদী দেখি।
— ইমরানের বোন দিয়ে দিছে। আমার দুই হাতেও তোমার নাম লিখে দিছে।
— খুব সুন্দর হয়েছে।
— সত্যি?
— জ্বি হ্যাঁ। তা সকালের খাবার খেয়েছেন?
— না, ইমরান ডাকছে।
💖💖💖
আমি কথা বলার ফাঁকে এনাজের দৃষ্টির অগোচরে শিশির ভেজা ঘাসে হাত দিয়ে আলতো করে ছুঁয়ে দিচ্ছিলাম। ঠান্ডা শিশিরের স্পর্শে অনেকটা ভালো লাগছিলো। পেছন থেকে ঐশী চেচিয়ে ডেকে উঠলো।
— নোভা খালামণি!
— কি হয়েছে?
— তোমার বন্ধুরা আসছে।
— কোন বন্ধু?
— সবার নাম তো জানি না। একজনের নাম সাদ্দাম। এটাই শুধু জানি। তোমাকে খুজতাছে।
— কয়জন আসছে?
— পাঁচজন। তিনটা ছেলে দুইটা মেয়ে।
—তুমি যাও আমি আসতেছি।
— তাড়াতাড়ি আইসো।
ঐশী এক দৌড়ে আবার বাসার দিকে ছুটলো। আমি মোবাইলের দিকে ফিরতেই এনাজ জিজ্ঞেস করলো,
— কে আসছে?
— আমার কলেজ ফ্রেন্ডরা।
— আচ্ছা তাহলে বাসায় যাও। পরে কথা হবে।
— আপনি গিয়ে খেয়ে নিন।
— আচ্ছা, আর শুনো।
— জ্বি বলুন।
— আই লাভ ইউ 😘।
— লাভ ইউ টু।
— একটা গান পাঠাচ্ছি। শুনতে শুনতে যাও।
— ওকে, আল্লাহ হাফেজ।
— আল্লাহ বাঁচালে দুপুরে এসে নিয়ে যাবো। আরেকবার কল দিবো। ধরো কিন্তু।
— ধরবো না।
— তাহলে মাইর চলবে।
— এত সাহস আছে নাকি।
— হুম আছে তো।
— দেখা যাবেনি। এখন রাখছি।
— ওকে,আল্লাহ হাফেজ।
কল কেটে দিয়ে মুচকি হাসলাম। বিরবির করে বললাম, ‘পাগল”। সে গান পাঠিয়ে দিয়েছে। গানটা মৃদু সাউন্ডে ছেড়ে বাসার পথ ধরলাম।
♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♥♥♥♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪
সব কথার এক কথা এটাই
পৃথিবীতে শুধু তোকে চাই, তোকে চাই
আর কিছু যে নেই ভাবনায়
এই আমি শুধু তোর হতে চাই, হতে চাই
দুটি মনেই প্রেমে মাখা, তবে কেন দূরে থাকা
মন যে চাই তোকে, কাক ডাকা রোজ ভোরে
চলনা যাই এক হয়ে, সব বাধা জয় করে
দুটি মনেই প্রেমে মাখা, তবে কেন দূরে থাকা
সব কথার এক কথা এটাই
পৃথিবীতে শুধু তোকে চাই, তোকে চাই
আর কিছু যে নেই ভাবনায়
এই আমি শুধু তোর হতে চাই, হতে চাই
আর কত দিন যাবে, তুই ছাড়া এভাবে
চলনা যাই এক হয়ে, ভাবুক যে যা ভাবে
দুটি মনেই প্রেমে মাখা, তবে কেন দূরে থাকা
সব কথার এক কথা এটাই
পৃথিবীতে শুধু তোকে চাই, তোকে চাই
আর কিছু যে নেই ভাবনায়
এই আমি শুধু তোর হতে চাই, হতে চাই
♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♥♥♥♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪
গানটা শেষ হতেই সেটা অফ করে রুমে ঢুকলাম। সাফা, ঝুমা, তামিম, সাদ্দাম,শাকিল খাটে বসে আছে। আমাকে দেখেই সাফা, ঝুমা দৌড়ে এসে জাপ্টে ধরলো। আমি ওদের সরিয়ে দিয়ে কপট রাগ দেখিয়ে বললাম,
— কে আপনারা? কাকে চাই?
ঝুমা সামনে এসে কান ধরে অপরাধী ভঙ্গিতে বললো,
— সরি বোন।রাগ করিস না প্লিজ।
— অপরিচিত মানুষের সাথে আমি রাগ করি না।
সাফা এগিয়ে এসে আমার এক হাত জড়িয়ে ধরে মুখটা কুচোমুচো করে বললো,
— প্লিজ বোনু এবারের মতো মাফ করে দে।
তামিম দাঁত কেলিয়ে বললো,
— আমি বলছিলাম নোভা রাগ করবে। তোরা কেউ শুনলি না। এবার ঠিক আছে না?
আমি মুখ ঘুরিয়ে কঠিন গলায় বললাম,
— রাগ করতে অধিকার লাগে। সেই অধিকার পাবো কোথায়? অপরিচিত মানুষের সাথে তো আর অধিকার দেখানো যায় না।
সাদ্দাম বসা থেকে দাঁড়িয়ে এক হাত উঁচু করে থাপ্পড় দেওয়ার ভঙ্গি করে বললো,
— এক থাপ্পড়ে সব দাঁত ফেলে দিবো। তখন সবাই বলবে নতুন বউ বোকরা। বোকরা বউ কথাটা শুনতে তোর নিশ্চয়ই ভালো লাগবে না। কি অপরিচিত মানুষ বলা শুরু করেছিস। আমরা অপরিচিত মানুষ?
আমি দুই হাত গুঁজে দরজার সাথে হেলান দিয়ে বললাম,
— আমার ফ্রেন্ড হলে হলুদের সকালে চলে আসতো। বিয়ের দিন সকালে আসতো না।
সাফা আমার দুই হাত ধরে অনুনয় করে বললো,
— প্লিজ বোইন রাগ করে থাকিস না। আমরা আসতে চাইলে কি আসতে পারি বল?
শাকিল মন খারাপ করে বললো,
— চল আমরা চলে যাই। এতদিন পর দেখা হলো এরপর দেখা হবে কিনা সন্দেহ। নোভা আমাদের না চেনার ভান করছে। বিয়ের আগেই বদলে গেছে। বিয়ের পর কি হবে আল্লাহ জানে।
শাকিল যেতে নিলেই আমি ওর হাত টেনে ধরলাম। চোখ পাকিয়ে বললাম,
—একে তো কালকে আসিসনি। তারপর আবার আমাকেই রাগ দেখানো হচ্ছে? চুপচাপ এখানে বস। এক পা বাইরের দিকে দিলে মার একটাও মাটিতে পরবে না।
সাদ্দাম কপাল কুঁচকে বললো,
— এতদিন পর সবার সাথে দেখা হলো। তোর বিয়ে উপলক্ষে প্রত্যেকটা রাজী করিয়ে একসাথে এলাম। তারপরেও তুই রেগে থাকবি?
আমি মুখ বাঁকিয়ে বললাম,
— আমাকে উদ্ধার করে ফেলছেন। তা কালকে আসেননি কেন? আমি বলে দেইনি যে হলুদের সকালে তোদের কে আমাদের বাসায় দেখতে চাই।
তামিম শাকিলের পিঠে একটা ঘুষি দিয়ে বললো,
— প্রত্যেকটায় নাটক শুরু করছিলো। একটাও আসতে চাইনি। তার এই সমস্যা, কারো বাসায় কেউ নেই বাসা পাহারা দিতে হবে। একেকজন ঢং করছে। আমি বলছি তোরা না গেলে আমি একাই যাবো। এর জন্য আমাকে সব মিলে বকছে। ওদের ছাড়া আমি যদি একা আসি তাহলে আমার সাথে কথা বলবে না। আমার, সাদ্দামের কোন দোষ নেই। সব দোষ এই তিনটার।
তামিম এই কথা বলতেই শাকিল,সাফা,ঝুমা ওকে ঘিরে ধরলো। এখন ওর ওপর ঝড় যাবে। আমি সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বললাম,
— হইছে আর ঝগড়া করতে হবে না। সবাই ফ্রেশ হয়ে খাবার খেয়ে নে। আমি তোদেরকে খাবার দিতে বলে দিচ্ছি। তোরা ফ্রেশ হয়ে সোজা প্যান্ডেলে চলে যাবি।
ওদেরকে রুমে রেখে প্যান্ডেলের দিকে চলে গেলাম। সকালবেলা অনেক আত্মীয়-স্বজন আসছে। তাদের সাথে কুশলাদি বিনিময় শেষে ওদের খাবারের ব্যবস্থা করলাম। খাওয়া শেষ হতেই একসাথে গল্পের আসর জমালাম। কতদিন পর সবার সাথে দেখা। কখন যে বারোটা বেজে গেছে খেয়াল নেই। আম্মু,ফুপ্পির বকা খেয়ে তবেই উঠলাম। আমাদের গল্পের ফাঁকে তন্বী,ইভারা পুকুর থেকে কলসি করে পানি নিয়ে এসেছে। এখন আমাকে হলুদ দিয়ে ভুত বানিয়ে গোসল করাবে। গোসল শেষ হতেই দেখলাম পার্লারের মেয়ে পনের মিনিট ধরে বসে আছে। আমি দ্রুত সাজতে বসে গেলাম। নয়তো আবারো বকা ফ্রী। এখন দুই থেকে তিন ঘন্টা আমাকে বসে থাকতে হবে অন্যের অধীনে। তারপর আবার বউ সেজে বসে থাকতে হবে। আমার পিঠের হাড্ডি আস্ত থাকলেই চলে। বসে থাকতে থাকতে না বেঁকেই যায়।
#চলবে