শিশির ভেজা রোদ্দুর পর্ব-৫০+৫১

0
672

#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Part_50
#Writer_NOVA

জামাই বাজার উপলক্ষে সামাদ ভাইয়ার শ্বশুর বাড়ি এসেছি। আজকে ভাইয়া ও ভাবীকে নিয়ে যাবো বাসায়। খাওয়া-দাওয়ার পর্ব চুকানোর পর একগাদা ফল কেটে দিয়েছি। সবার মুখ চললেও আমি চুপ করে বসে আছি। একটু আগে খেয়ে এখন আবার এসব পেটে ঢুকবে না। অনন্যা, অর্থি,ইভা, তন্বী, নূর আপি বাইরে ঘুরছে।অনেকখন ধরে আরেকটা বিষয় খেয়াল করছি। যার দরুন আমি তাদের সাথে ঘুরতে যাইনি। ভাবীর এক মামাতো বোন কিছু সময় পরপর এনাজের দিকে তাকাচ্ছে। যেটা আমার চোখ এড়ায়নি। কেন জানি আমার এটা সহ্য হচ্ছে না। আমি ধীর পায়ে তার সামনে গিয়ে বসলাম। মেয়েটা তার সমবয়সী এক মেয়ের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে আর আড়চোখে এনাজকে দেখছে। এনাজ ও তায়াং ভাইয়া বাইরের চেয়ারে বসে আছে। আমি মিষ্টিসুরে জিজ্ঞেস করলাম,

— তোমার নাম কি আপু?

মেয়েটা এনাজের দিক থেকে চোখ সরিয়ে কিছুটা বিব্রত হয়ে বললো,

— জেরিন।

— তুমি মারিয়া ভাবির মামাতো বোন?

— জ্বি আপু। আপনি?

— ওর ননদ। আবার অন্য দিক থেকে বড় বোনও হই।

— ওহ আচ্ছা। আপু আপনি কি বিবাহিত?

— না কেন?

— না, আপনার নাকে নাকফুল তাই জিজ্ঞেস করলাম।

— আমার নাকফুল পরতে ভালো লাগে। তাই পরে রাখছি। তবে বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। খুব শীঘ্রই হয়ে যাবে। ঐ যে মিষ্টি কালার শার্ট পরা যে ছেলেটাকে দেখছো তার সাথে। আমার হবু বর।

আমি জানি মিথ্যে বলেছি। না বললে তো মেয়েটা ওর দিকে সারাক্ষণ এনাজের দিকে তাকিয়ে থাকবে। যেটা আমার সহ্য হবে না। আমার কথা শুনে জেরিন নামের মেয়েটি চমকে উঠলো। এনাজ আজকে মিষ্টি কালার শার্ট ও কালো প্যান্ট পরে এসেছে। জেরিন, এনাজকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে আমাকে প্রশ্ন করলো,

— ঐ ছেলেটা আপনার হবু বর?

— জ্বি আপু।

— ওহ্

— কেন আপু, কোন সমস্যা? আমার হাসবেন্ডটা দেখতে সুন্দর না?

— না মানে হ্যাঁ খুব সুন্দর। আচ্ছা আপু আমি একটু আসছি।

জেরিন কোনমতে সেখান থেকে কেটে পরলো। আমি মুখ টিপে বেশ কিছু সময় হেসে নিলাম। বেচারীর মুখটা দেখার মতো হয়েছিলো। মন ভেঙে গেছে নিশ্চয়ই। একদম ঠিক হয়েছে। এত ছেলে থাকতে আমরটার দিকে নজর দিবে কেন? এবার বুঝুক মজা।এবার গিয়ে আরেকজনকে টাইট দিতে হবে। কে বলেছিলো তাকে এত সুন্দর করে সেজে আসতে।

“জামাই বাজার” বিক্রমপুরের বিয়ের একটা রিতী। একেক অঞ্চলে বিয়ের একেকটা রিতী থাকে। যেগুলো শুধু সেই অঞ্চলভেদে পালন করা হয়। আমাদের এই রীতিটা অন্য কোথাও পালন করা হয় কিনা তা আমি জানি না। বৌ-ভাতের আড়াই দিন পর এটা পালন করা হয়। যাকে আরেক ভাষায় আড়াই নাহারি ও বলা হয়। জামাই বাজারের দিন সকালবেলা নতুন জামাই রুমাল মেলে ধরে। সেখানে মেয়েরপক্ষের আত্মীয়রা যার যার সামার্থ্য অনুযায়ী দুই হাজার, পাঁচ হাজার, সাত হাজার টাকা যে যা পারে ততটুকু টাকা দেয়। মোট টাকা ও নিজের টাকা মিলিয়ে সেদিন নতুন জামাই রান্নার প্রয়োজনীয় যাবতীয় জিনিসপত্র কিনে নিয়ে আসবে। সেই জিনিসপত্র দিয়ে মেয়েবাড়ির লোক রান্না করবে। তাতে ছেলেপক্ষের লোককেও দাওয়াত করা হবে। ছেলেপক্ষের লোক দাওয়াত রক্ষা করে নতুন বর-কনে কে নিয়ে যাবে।

— এই যে শুনুন। এদিকে একটু আসুন তো।

এনাজের সামনে গিয়ে তাকে ডাকতেই তার কপাল কুঁচকে এলো। শান্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

— কি হয়েছে?

— আমার সাথে একটু আসতে বলছি।

তায়াং ভাইয়া শয়তানি হাসি দিয়ে এনাজকে বললো,
— আরে যা যা। দেখ তোর টিডি পোকা তোকে কি জানি দিবে।

আমি ভাইয়ার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে এনাজের দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। সে কোন কথা না বলে আমার সাথে চলে এলো। হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির পাশে সেই বালুর মাঠে চলে এলাম। সেখানে আসতেই তার চুলগুলো সব এলোমেলো করে দিলাম। শার্টের বোতাম একদম কলার অব্দি লাগিয়ে দিলাম। ফোল্ড করা হাতা নামিয়ে কব্জি অব্দি নিয়ে আসতেই সে বললো,

— আরে করছো কি? পাগল হলে নাকি? আমার স্টাইলগুলো সব নষ্ট করে দিলে। এমন পাগলামি করছো কেন?

শার্টের হাতা কব্জি অব্দি এনে বোতাম লাগিয়ে তাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে আমার মুখে হাসি ফুটলো। আমি হাসিমুখে বললাম,

— এবার ঠিক আছে।

— এই নিরিহ ছেলেটার ওপর এমন অত্যাচার কেন? একা একটা ছেলেকে পেয়ে এভাবে অত্যাচার করতে পারো না তুমি। কি করলে দেখো তো?

— খবরদার যেভাবে আছে সেভাবেই থাকবে। যদি কোনকিছু ঠিক করেছেন তাহলে আপনার সাথে আমার কোন কথা নেই।

— এমন আবুল সাজানোর মানেটা কি?

— কে বলছিলো নায়ক সেজে আসতে?

— কোথায় নায়ক সেজেছি? সমন্ধির শ্বশুর বাড়ি আসছি একটু ভালো গেটআপে আসতে হবে না? নয়তো মানুষ কি বলবে?

—তাই বলে এমন নায়ক সেজে আসবেন?

— তোমার হঠাৎ কি হলো বলো তো? তুমি তো কখনো আমার ড্রেসআপ নিয়ে মাথা ঘামাওনি? আজ এমন আবুল সাজিয়ে দিলে কেন?

আমি তার কথার উত্তর না দিয়ে এক হাত কোমড়ে আরেক হাতের আঙুল ঠোঁটে দিয়ে তাকে পা থেকে মাথা অব্দি স্ক্যান করতে লাগলাম। তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম,

— চুপ করেন তো। কি জানি একটা মিস পরে গেছে। কি মিস পরেছে, কি মিস পরেছে? ওহ পেয়েছি। প্যান্টটাকে পায়ের দিকে কিছু অংশ ভাজ করে দিতে হবে। তাহলে ঠিক হবে।

যেমন ভাবা তেমন কাজ। নিচে বসে তার টাখনুর দিকের প্যান্টে কয়েকটা ভাজ দিয়ে দিলাম। তারপর উঠে গাল দুটো টেনে দিয়ে বললাম,

— হু এবার ঠিক আছে। পুরো পারফেক্ট। এখন আর কোন মেয়ে নজর দিবে না।

— তুমি ঠিক আছো তো?

— এতখন ছিলাম না। এখন ঠিক আছি।

— তাতো দেখতেই পাচ্ছি।

— এবার চলুন।

— এই অবস্থায়?

— বেশি কথা বলবেন আপনার সাথে আর কথাই বলবো না।

উনি আর কথাই বললেন না। চুপচাপ আমার সাথে চলতে লাগলো।বেচারাকে যা লাগছে না। তাতে আমার কি? কেউ তো এখন আর আমার এনজিও সংস্থার দিকে নজর দিবে না। তার এক বাহু ধরে হাঁটতে লাগলাম। উনি বোকার মতো একবার আমার দিকে তাকিয়ে নিরবে আমার সাথে পথ চলতে লাগলো।তায়াং ভাইয়ার সামনে যেতেই সে চোখ কপালে তুলে বললো,

— কি রে এনাজ তুই এমন আবুল সাজে কেন?

— আর বলিস না ভাই। তোর বোনের হঠাৎ কি হলো আমি কিছুই বুঝলাম না। দেখ তো আমাকে কি সাজিয়ে দিলো?

তায়াং ভাইয়া হো হো করে হাসতে হাসতে চেয়ার থেকে পরে যাওয়ার জোগাড়।আমি মিটমিট করে হেসে ঘরের ভেতর ঢুকে পরলাম।আমার জিনিস নিয়ে যদি আমি না ভাবি তাহলে কে ভাববে!

💖💖💖

আজও এনাজের পিঠকে বালিশ বানিয়ে নিয়েছি। সকাল সকাল ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা হয়েছি। মনটা ভীষণ খারাপ। দিনগুলো কত দ্রুত চলে গেলো। মনে হচ্ছে সেদিন বাসায় গেলাম। আজ ফিরে আসছি। বাসার সবার মুখ থমথমে ছিলো আম্মু,ইভা,অনন্যা,
অর্থি সবার মনটা খারাপ করে রেখেছিলো। আম্মুর মুখটা পুরো কাঁদো কাঁদো ছিলো। তাদের রেখে আসতেই মন চাইছিলো না। সবাই অনেক জোর করেছিলো আরেকটা দিন থাকার জন্য। কিন্তু আমার বিটলার খালাতো ভাই কিছুতেই থাকবে না। নূর আপিরা আমাদের সাথেই বের হয়েছে। এতখনে বোধহয় বাসায়ও চলেও গেছে। আমি ও এনাজ আজও বাইকে এসেছি। তন্বী,তায়াং ভাইয়া ও খালামণি সিএনজি ঠিক করে তাতে করে আসছে। আমরা তাদের থেকে অনেক এগিয়ে।

— মন খারাপ করো না টিডি পোকা। আবার ডিসেম্বরে চলে যেয়ো।

নীরবতা ভেঙে এনাজই প্রথম কথা বলে উঠলো।আমি কোন কথা বললাম না। চুপ করে রাস্তার দুই ধারের পরিবেশ দেখতে ব্যস্ত হলাম। এনাজ থেমে আরেকবার বললো,

— তোমার মনের অবস্থা আমি বুঝতে পারছি। সত্যি বলতে আমার নিজেরই খারাপ লাগছে। তোমার লাগাটা তো একেবারেই স্বাভাবিক। সবাই কত সহজে আমাকে আপন করে নিয়েছিলো। ভালোবেসে একেকটা কাজের দায়িত্ব দিচ্ছিলো। আমার তখন মনে হয়েছে আমি নিজের বাসায় আছি। সময়গুলো কত দ্রুত চলে গেলো। আমার স্মৃতিতে এই ছয়টা দিন বেস্ট থাকবে। আমি কখনও ভুলতে পারবো না। ধন্যবাদ তোমাকে। তুমিও কিন্তু আমায় অনেক সুন্দর সুন্দর মোমেন্টের সাথে পরিচিত করে দিয়েছো।

একটা দীর্ঘশ্বাস বুক চিঁড়ে বের হয়ে গেলো। বিষন্ন মনে কোন কথা বলতেও ইচ্ছে করছে না। তার পিঠে মাথা ঠেকিয়ে চোখ দুটো হালকা বন্ধ করে রাখলাম। হঠাৎ ব্রেক কষতেই আমি কিছুটা চমকে তাকে জিজ্ঞেস করলাম,

— কি হয়েছে?

— কিছু না।

আমার দিকে না তাকিয়ে সামনের একটা ফুল বিক্রতা ছোট ছেলেকে জিজ্ঞেস করলো,

— গোলাপ ফুল কত করে?

— একটা দশ টেহা ভাইজান।

— দুইটা দাও তো।

—আইচ্ছা।

ছেলেটা তার নীল বালতি থেকে সতেজ দুটো লাল গোলাপ এনাজের হাতে তুলে দিলো। এনাজ মানিব্যাগ খুলে বিশ টাকার নোট ছেলেটার হাতে দিয়ে দিলো। ছেলেটা অন্য দিকে চলে গেল। আমার দিকে ফিরে মিষ্টি হেসে বললো,

— এই দুটো তোমার জন্য।

— শুকরিয়া।

হাত বাড়িয়ে ফুল দুটো নিয়ে মুঠ করে রেখে দিলাম।বিনিময়ে মিষ্টি হাসি ফেরত দিয়ে দিলাম। সে মাথা চুলকে বিষন্ন মনে বললো,

— আমার তো এতো এতো টাকা নেই। তাই মাত্র দুইটা গোলাপ উপহার দিলাম। আমার অঢেল টাকা থাকলে তোমাকে পুরো বালতির ফুল উপহার দিতাম।

— কি শুরু করলেন বলেন তো? এই পুরো বালতি ফুল দিয়ে কি আমি মাথায় বেঁটে দিবো? দুটো দিয়েছেন তাতেই আমি খুশি। আপনি ভালোবেসে আমাকে একটার বদলে দুটো গোলাপ দিয়েছেন তাও বা কম কিসের? আমি সামান্য কিছুতেই খুশি থাকি।তাই আপনার মন খারাপ করার কোন দরকার নেই।

এনাজ মুচকি হেসে বাইক স্টার্ট দিলো। গোলাপের ওপর পানি ছিটানোর দরুন সেগুলো মুক্ত দানার মতো পাপড়ির গায়ের ওপর বসে আছে। আমি একবার গোলাপের ঘ্রাণ নিয়ে সেগুলোকে হাতেই রেখে দিলাম।ভালোবাসার প্রতীক বলে কথা💖।

#চলবে।

#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Part_51
#রহস্য_সমাধান
#Writer_NOVA

মাঝে কেটে গেছে দুই দিন। আজ থেকে কলেজ খোলা।আমি কলেজে এসে মনোযোগ দিতে পারিনি। কেমন জানি সবকিছু বিস্বাদ ঠেকছে। এই দুইদিনে এনাজের সাথে কোন যোগাযোগ হয়নি। তাকে ভীষণ মিস করছি ।গতকাল রাতে তায়াং ভাইয়া বলেছিলো তার পায়ে একটু ব্যাথা পেয়েছে। তারপর থেকে কতবার যে তাকে কল করতে চেয়েছি কিন্তু সাহসে কুলায়নি। কেন জানি ভীষণ ভয় এসে ঘিরে ধরছিলো। তবে তার খোঁজ নেওয়ার জন্য তো কল করা উচিত আমার। শারমিনের সাথে নিরবে রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। তন্বী ক্লাশ করছে।অন্য সময় হলে এতখনে শারমিনের কান পচিয়ে ফেলতাম। কিন্তু আজ আমি চুপচাপ। শারমিন হঠাৎ ধাক্কা দিয়ে আমাকে বললো,

— কিরে কি হয়েছে তোর? সকালে কলেজে আসার পর থেকে দেখছি তুই কেমন মনমরা হয়ে আছিস।

— কিছু না। আমি ঠিক আছি।

— বিয়ের আনন্দ কেমন কাটলো?

— আলহামদুলিল্লাহ ভালো।

— গ্রামের বিয়েতে অনেক মজা হয় তাই না?

— হুম অনেক।

— শুনলাম এনাজ ভাইয়া নাকি তোদের সাথে গিয়েছিল।

— হ্যাঁ। কিন্তু তুই জানলি কি করে?

— তওহিদ ভাইয়া বললো।

— তার সাথে তোর দেখা হলো কি করে?

— একদিন চাচাতো বোনের সাথে শপিং করতে গিয়েছিলাম সেদিন দেখা হয়েছিলো।

— ওহ্ আচ্ছা।

— কফি হাউসে যাবি?

— না ভালো লাগছে না।

ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে ডায়াল লিস্টে গেলাম। এনাজের মোবাইল নাম্বারটা এনজিও সংস্থা দিয়ে সেভ করা আছে। কিন্তু আজ অব্দি কখনো কল করা হয়নি। কল দিবো কি দিবো না তাই ভেবে দ্বিধাদ্বন্দে পরে গেলাম। ভাবতে ভাবতে কল দিয়ে ফেললাম। বুকের ভেতরটা ধুকপুক করছে।এই বুঝি কল ধরে ফেললো। একসময় কল রিসিভও হয়ে গেলো। অপরপাশ থেকে তার কণ্ঠস্বর পাওয়া গেলো।

— আসসালামু আলাইকুম।

আমি দ্রুত কল কেটে দিলাম। হুট করে এতো ভয় এসে হানা দিলো যে মনে হলো সে আমাকে বকবে।যদি জিজ্ঞেস করে কেন কল করেছি তাহলে কি বলবো? তাও তো জানি না। তার শরীরের কন্ডিশন কেমন তা আদোও জিজ্ঞেস করতে পারবো কিনা সন্দেহ। হাত-পা কাঁপছে আমার।তাকে মিস করছি তাতো বলতে পারবো না। এখন তো কথা বলার সাহস পাচ্ছি না। শারমিন আমার কান্ড দেখে বললো,

— কিরে কাকে কল করিস?

— কাউকে নয়, চল তো।

হঠাৎ পেছন থেকে একটা মেয়েলি কন্ঠে কেউ ডেকে উঠলো,

— রাই দাঁড়া!

কণ্ঠস্বরটা ভীষণ পরিচিত লাগছে। আমি থমকে দাঁড়িয়ে পেছনে তাকাতেই আরেকদফা অবাক। এ আমি কাকে দেখছি! আমার সামনে স্বয়ং জারা দাঁড়িয়ে আছে। এতদিন পর একে দেখে আমার কপাল কুঞ্চিত হয়ে গেলো। জারা সামনে এসে বললো,

— তুই শুরু করেছিসটা কি?

আমি কপালে কুঞ্চিতভাব রেখে শারমিনের দিকে তাকাতে দেখলাম ওরও সেম দশা। আমি বিস্মিত কন্ঠে বললাম,

— সরি!

— এখন সাধু সাজছিস?

— দুই গালে দশ আঙুলের ছাপ বসাতে না চাইলে আমার চোখের সামনে থেকে ভাগ তুই কাল নাগিনী।
নয়তো কানের নিচে এমন থাপ্পড় দিবো কানে কিছু শুনবি না।

আমার কথা শুনে জারা, শারমিন দুজনেই অবাক হয়ে গেলো। আমার মাথায় চিনচিন করে রাগ উঠছে। কখন জানি সত্যি আমি এই জারার সাদা গাল লাল করে ফেলি। জারা সম্ভবত আমার কথাটা হজম করতে পারলো না। কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,

— তুই তো এরকম ছিলি না।

— আগের নোভার সাথে এই নোভার আকাশ-পাতাল তফাৎ। গাল দুটো লাল না করতে চাইলে আমার সামনে থেকে সরে যা।

— আমি থাকতেও আসিনি। তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে।

— বৈইমানের সাথে আমার কোন কথা থাকতে পারে না। ভালো থাকলে রাস্তা মাপ কাল নাগিনী। তোর মতো বান্ধবীতো দূরে থাক শত্রুও যাতে কারো না হয়।

— তুই কিন্তু এবার বেশি বলছিস।

— তুই আমার সামনে থেকে না সরলে বলার সাথে সাথে হাতও চলবে।

— রোশানকে মার কেন খাইয়েছিস?

আমি চমকে ওর দিকে তাকালাম। আমি রোশানকে মার কেন খাওয়াবো? কি বলে এসব? আমি মুখটাকে থমথমে করে বললাম,

— মানে?

— রোশান রাত থেকে হসপিটালে ভর্তি। ওকে একটা ছেলে ইচ্ছে মতো ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে মেরেছে।

— মরে নাই?

—গুরুতর আহত হয়ে হসপিটালে ভর্তি আছে। এক হাত, এক পা ভেঙে দিয়েছে।রোশান বললো ঐ ছেলেটা নাকি তোর নতুন প্রেমিক।

— একদম ঠিক করেছে। তা তোর নাগর রোশান দেওয়ান কি আছে নাকি পটল তুলেছে?

জারা রেগে বললো,
— কি ধরনের কথাবার্তা এসব?

আমি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললাম,
— কেন শুনতে পাচ্ছিস না?

— তুই কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি করছিস।

— আমি কোনকালেই বেশি বাড়াবাড়ি করিনি। করেছে রোশান তাই ও হসপিটালে ভর্তি। তুই করলে তোকেও ভর্তি করবো। যাতো কাল নাগিনী পথ ছাড় আমার। তোর মতো ফালতু মেয়ের সাথে কথা বলে আমি আমার মুড নষ্ট করতে চাই না। চল তো শারু।

শারমিন আমাদের মাঝে একটা কথাও বলেনি।ওকে নিয়ে পেছনে ঘুরতেই জারা বললো,

— এই সবকিছুর পেছনে আহাদ ভাইয়া ছিলো। সেই ছিলো মেইন কালপ্রিট। সে আমাকে তোর বিরুদ্ধে যেতে বাধ্য করেছিলো। রোশানের কানে বিষ ঢুকিয়েছিলো। তোর ছবি অন্য ছেলের সাথে এডিট করে ওকে দেখিয়েছিলো। তোকে রোশানের কাছে খারাপ করেছে।

💖💖💖

আমি ওর দিকে ঘুরে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললাম,
— আমি জানি।

জারা অবাক হয়ে বললো,
— তুই জানিস?

— হ্যাঁ, আমি জানি। তাও দেড় বছর আগের থেকে।

— কে বললো তোকে?

— রোশানের আরেক বন্ধু। ফয়সাল ভাইয়াকে চিনিস সে বলেছে।আহাদ আমাকে একবার কুপ্রস্তাব দিয়েছিলো। তাতে আমি রাজী হয়নি বলে এতো কিছু করেছে। রোশান জানতে পেরে আহাদকে আমার কাছে মাফ চাইয়েছিলো।এতে আহাদের প্রেস্টিজে লেগেছে। তাই আমার ও রোশানের প্রতি প্রতিশোধপরায়ণ হয়েছিলো। দুজনের ওপর প্রতিশোধ নিতে এমন করেছে। সে ভেতরে ভেতরে ছকের গুটি সাজাতে লাগলো। অথচ সে উপরে আমাকে রোশানের সাথে সেটিং করে দিলো।এমন একটা ভান ধরেছিলো যে আমাদের দুজনকে সেটিং করে দিয়ে সে এতো খুশি, সাথে তার পুরনো কাজের জন্য সে লজ্জিত।আর সে মাঝ থেকে ভালো হয়ে গেলো।
আমাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে সে ভালো সাজতে আমাকে পরে অনেক হেল্পও করেছে। সব বন্ধুদের বিপরীতে সে যখন আমাকে এসে হেল্প করেছে তখুনি আমার খোটকা লেগেছে। কথায় আছে না অতিভক্তি চোরের লক্ষণ। তুই রোশানকে পছন্দ করতি। তাই তোকেও হাত করে নিলো।ভালোবাসার মানুষকে পাওয়ার জন্য বান্ধবীর সাথে বৈইমানী করলি।তোর কাছে বন্ধুত্বের থেকে রোশান বেশি হয়ে গেলো।তুই তো জেনেশুনে আমার সাথে এমন করেছিস। দোষ তিনজনেরি। কারো একটু কম কিংবা কারো একটু বেশি নয়। বরং সবারই সমান।নিজে এখন এসে রোশানের মতো ভালো সাজছিস? হাহ, তোদের তিনজনকে ক্ষমা আমি জীবনেও করবো না। ভাগ এখান থেকে। নয়তো রোশানের পাশের সিটে তোকে ভর্তি হতে হবে। না আমার প্রেমিক মারবে না, আমি মারবো তোকে।

জারার উত্তরের অপেক্ষা না করে আমি শারমিনের হাত ধরে দ্রুত অন্য দিকে চলে এলাম। আরেকটু সময় থাকলে জারার গালে ঠাটিয়ে দুটো চড় মারতাম। কিন্তু আমি ওর মতো মেয়েকে থাপ্পড় মেরে নিজের হাত নষ্ট করতে চাই না। তবে একটা বিষয় ক্লিয়ার হয়ে গেলো গতকাল রাতে রোশানকে একা পেয়ে এনাজই মেরেছে। একদম ঠিক করেছে। কিন্তু সমস্যা হলো মারতে গিয়ে নিশ্চয়ই রোশানের হাতে কয়েক ঘা খেয়েছে। সাথে পায়ে ব্যাথাও পেয়েছে। এবার হিসাব পুরো মিলে গেলো।

এই সবকিছুর পেছনে আহাদ ছিলো। হ্যাঁ সেই মেইন কালপ্রিট। সে এখন আব্দুল্লাহপুর জেলে আছে। না আমার জন্য নয়। ড্রাগের ব্যবসা করতে গিয়ে ধরা খেয়েছে। মাস দুই আগে ফয়সাল ভাইয়ার থেকে খবর পেয়েছিলাম। ফয়সাল ভাইয়া আমার সাথে হওয়া অন্যায়টা মেনে নিতে পারেনি। তাই পরবর্তীতে আমাকে সব জানিয়ে দিয়েছিলো। সব বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ নষ্ট করে দিয়েছে। তাও শুধুমাত্র এই জন্য যে ওরা আমার সাথে সবাই অন্যায় করেছে বলে। ভাইয়া আমাকে হাতজোড় করে বলেছিলো,

—আমি যদি প্রথম থেকে এসব জানতাম, তাহলে কখনো তোমার সাথে এমনটা হতে দিতাম না নোভা। তাই আমাকে কেউ কিছু বলেওনি।আমি তখন ঢাকায় ছিলাম। ঢাকা থেকে এসে যখন সব জানতে পারলাম তখন সব শেষ। তবু্ও আমি হাল না ছেড়ে সবকিছু খুঁজে বের করে তোমাকে বলে দিলাম। তুমি এসব ভুলে গিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করো।যারা তোমাদের সাথে এমন করেছে তাদের পাপের ফল তারা অবশ্যই পরবর্তীতে ভোগ করবে।

আমি নিরব চোখে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এর জন্য আমি বলি পৃথিবীর সব ছেলে খারাপ নয়। খারাপ হলে পৃথিবী ঠিক থাকতো না।

আমাকে চুপ থাকতে দেখে শারমিন বললো,

— মন খারাপ?

— না তো!

— তুই এতকিছু সহ্য করেছিস কি করে? আমি হলে সত্যি মরে যেতাম।

— মরতেই তো চেয়েছিলাম। কিন্তু ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছি৷ তবে এখন আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাই। কি ভুল করতে গিয়েছিলাম।এত সুন্দর জীবনটাকে আমি নিজ হাতে নষ্ট করতে চেয়েছি।

— এই নোভা ঐদিকে দেখ।

— কি দেখবো?

— দেখনা।

আমি শারমিনের দৃষ্টি বরাবর তাকাতেই দেখি এনাজ এক পায়ে হালকা খুড়িয়ে আমাদের দিকে দৌড়ে আসছে। আমি তাকে এভাবে আসতে দেখে বেশ অবাক হলাম।সে সামনে এসে দুই হাত হাঁটুতে রেখে কিছুটা দম নিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলো,

— তুমি ঠিক আছো?

— আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কেমন আছেন?

— এতখন খারাপ ছিলাম। এখন ঠিক আছি।

— আপনি এমন দৌড়ে কোথা থেকে এলেন?

এনাজ আমার কথার উত্তর না দিয়ো শারমিনের দিকে তাকিয়ে বললো,

—তোমাকে তওহিদ গেইটের সামনে যেতে বলেছে। তুমি একটু গিয়ে দেখে এসো।

শারমিন কপাল কুঁচকে বললো,
— কেন?

— আমি বলতে পারবো না। তুমি গিয়ে দেখো।

শারমিন চলে গেল। ও হয়তো বুঝতে পেরেছে আমাদেরকে একটু স্পেস দেওয়া দরকার।তাই অমত না করে সেদিকে রওনা দিলো। এদিকে মানুষ একদমি নেই। ক্লাশ চলাকালীন সময় মানুষের আনাগোনা কমই থাকে। শারমিন যেতেই আমার গালে শক্ত করে একটা চড় পরলো৷ ঘটনার আকস্মিকতায় আমি গালে হাত দিয়ে বোকা বনে গেলাম। তাকিয়ে দেখি এনাজ ফুঁসছে। আমি গালে হাত দিয়ে কাঁদো কাঁদো ফেস করে বললাম,

— কি হয়েছে মারলেন কেন🥺?

— আরেকটা কথা বলবে আরো দুটো দিবো। সাধারণ কমোন সেন্স নেই তোমার?

— কি করেছি আমি?

— আবার জিজ্ঞেস করো কি করেছো? মারবো আরেকটা?

উনি হাত তুলতেই আমি দুই হাতে মুখ ঢেকে কুজো হয়ে গেলাম। উনি হাত নামিয়ে এক হাতে কোমড়ে রেখে আরেক হাতে কপালের অর্ধেক অংশ স্লাইড করতে করতে রাগী গলায় বললো,

— তোমার ধারণা আছে আমি কি একটা অবস্থায় ছিলাম। কল দিয়েছিলে কেন? কল দিয়ে কথা কেন বলোনি? কতবার কল দিয়েছি আমি, তা কি জানো? আমি ভেবেছিলাম তোমার কোন বিপদ হয়েছে। তাই দ্রুত বাইক নিয়ে চলে এলাম। এটলাস্ট আমার কলটাতো পিক করতে পারতা। আমি এক মুহুর্তের জন্য চোখ, মুখে অন্ধকার দেখছিলাম। আমি ভেবেছিলাম তোমার কোন ক্ষতি হয়েছে। কলিজা শুকিয়ে গিয়েছিল। তায়াং থাকলে এতখনে আরো দুটো থাপ্পড় তোমার গালে পরতো।

আমি গালে হাত দিয়ে কাঁদো কাঁদো মুখে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। চোখ দিয়ে দুই ফোঁটা পানি গরিয়ে পরলো।থাপ্পড় মেরেছে তার জন্য নয়,অভিমানে। ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে দেখলাম ২৭ টা মিসড কল। মোবাইল সাইলেন্ট করে রেখেছিলাম তাই রিং হয়নি। আর উনি আমার বিপদ ভেবে এখানে চলে এসেছে। নিজের পা ব্যাথা সেদিকেও খেয়াল নেই। কিন্তু আমি কোন কথা বলবো না। আমাকে মারছে কেন? আমি কি জানতাম তাকে কল দিলে সে ভাববে আমার বিপদ হয়েছে। আর এভাবে ছুটে আসবে। সেগুলো না হয় বাদ দিলাম। তাই বলে আমায় মারবে? এত জোরে কেউ থাপ্পড় দেয়? আমার গাল জ্বলে যাচ্ছে। আরেকটু আস্তে দিলে কি হতো? হু হু আমি একটুও কথা বলবো না তার সাথে। মোবাইল যে সাইলেন্ট ছিলো তাও বলবো না।তাকে মিস করছিলাম, তার শরীরের খবর নেওয়ার জন্য কল দিয়েছিলাম সেটাও বলবো না। কোন কথাই বলবো না। মারলো কেন আমায়? ছোট বাচ্চা মেয়েকে কেউ এভাবে মারে🥺?

#চলবে