শিশিরে ভেজা আলতা পর্ব-১৯+২০+২১

0
390

#শিশিরে_ভেজা_আলতা
(২য় খন্ড)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
১৯.

মধ্যরাত; বাস চলছে হাইওয়েতে। শীতের রাত বলে চলন্ত বাসে জানালা দিয়ে হু হু করে শীতল বাতাস ঢুকেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে শিশিরের। কিন্তু জানালা আটকে দিলেই আলতা বমি করে ভাসিয়ে দিবে আবার সেই ভয়ে বড় বিপদে পড়েই কিছুটা খোলা রেখেছে সে। পুরো জানালা খুললে আবার বাসের ভেতরের অন্য যাত্রীরা রেগে চেঁচামিচি শুরু করবে৷ রাতের বেলা বাসে করে পৌঁছুতে পাঁচ সাড়ে পাঁচ ঘন্টার বেশি লাগবে না বলেই ফিরতি পথে বাসের টিকিট কেটেছে তারা। মাঝামাঝি সিটগুলোর একটাতে সোহা আর অনু বসেছে তাদের পেছনের সিটে আলতা আর শিশির। বাসে উঠে সোহা নিজেই বলেছিলো, “আমি আর অনু সামনে বসছি তোমরা দুজন পেছনে বসো।”

আলতা তখন খেয়াল করেছিলো কোন এক কারণে সোহা একদমই নিশ্চুপ আর কেমন যেন নির্লিপ্ত আছে। সে সন্ধ্যেবেলায় শিশিরদের বাড়ি গিয়েও তাকে এমন দেখেছিল এমনকি সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো শরত ভাইয়ের দোকানে যাওয়া নিয়ে ভীষণ আপত্তি তুলছিলো। আর বাড়ি থেকে বাসস্ট্যান্ডে যখন শরত ভাই এলো তাদের সাথে তখন সোহা একটিবারের জন্যও কোন কথা বলেনি। বাসে উঠার সময় শরত ভাই সবাইকে একে একে বিদায় বললেও সোহা কোন জবাব দেয়নি। আর সেই থেকেই আলতার মনে হচ্ছে তার এতদিনের জানায় ভুল ছিলো। সোহা আপু তার শিশির ভাই না বরং শরত ভাইকেই পছন্দ করে। আর কি আশ্চর্য ব্যাপার যখন থেকে তার মন মানলো সোহা আপু শরত ভাইকে পছন্দ করে তখন থেকেই তার অন্তরের অন্তস্থলের এক অদৃশ্য চাপ উধাও হয়ে গেছে। এ কেমন অনুভূতি তার মনের ভেতর আজকাল! হু হু করে রাতের বাতাসে শীতের তীব্রতা বেড়ে যাচ্ছে। আলতার নিস্তেজ দেহের অসাড়তাও বাড়ছে সেই সাথে। আজ কোন দ্বিধা ছাড়াই শিশির তার আলতাকে বড় স্বস্তির সাথে বাহুতে জড়িয়ে আছে। রাতের আঁধারে আজ তার মন বড় চঞ্চল হয়ে উঠছে। বয়সটা কত তার! এখনই এই অনুভূতির এই তীব্রতা ক্ষ*তি করে ফেলবে না তো তার আর তার এই চঞ্চল পাখিটির? নাহ্ তার বেসামাল হওয়া চলবে না কিছুতেই এখনও অনেক কিছু করা বাকি তার। বাকি তার আলতারও কত কি করা। আলতাকে স্বাবলম্বী হতে হবে নিজের ভরসার জায়গা তার নিজেকেই হতে হবে। আলতাকে সে কখনোই অন্যের ওপর ডিপেন্ডেড হতে দিবে না বলেই তো তার মাথায় এই শহুরে জীবনে আনার ভূত ঢুকিয়েছিল। ফুপুআম্মার মত ভাঙাচোরা জীবন নয় বরং আলতাকে বাঁচতে হবে স্বনির্ভর এক সফল জীবন। এই ভাবনাগুলো ভাবতেই শিশিরের হাতটা শিথিল হয়ে এলো আলতার বাহু থেকে। কোথাও যেন একটু সাবধানতার ছল করেই সে আলতাকে আলগা করে ধরল।

ভোর পাঁচটা ; ঝাপসা ভোর সেই সাথে চোখের দৃষ্টিও ঝাপসা এই ভোরে। আলতা রাতভর শিশিরের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়েছে এখনো ঘুমাচ্ছে। কাঁধ ব্যথায় চুরচুর হয়ে আসছে শিশিরের অথচ একটুও তার আভাস নেই তার মুখে। চোখ খুলে ঝাপসা চোখে বাইরে তাকালো। বাস চলছে এখনো হয়ত গন্তব্যের খুব কাছেই আছে তারা এখন। মধ্যরাতে বাস একবার থামলে অনুরা নেমেছিলো কিন্তু শিশির পারেনি। আলতার কোন সমস্যা হয় ভেবে সে বসেই ছিলো আলতাকে নিয়ে। তা দেখে অবশ্য সোহা কফি নিয়ে এসেছিলো শিশিরের জন্য। কিন্তু এই মুহুর্তে আর কিছুতেই কাঁধটা সোজা রাখা সম্ভব হচ্ছে না। সে আলতো হাতে আলতাকে কাঁধ থেকে সরিয়ে সিটে মাথা রাখলো। মিনিট কয়েক গড়াতেই গাড়ি এসে পৌঁছুলো গন্তব্যে। শিশির বড় ধীর স্বরে একবার সোহাকে ডাকতেই সে জবাব দিলো। শিশির বুঝতে পারলো সোহা রাতভর চোখের পাতা এক করেনি কোন এক দুঃসহ কারণ আছে এর পেছনে। কিন্তু আপাতত এ নিয়ে কথা বলার সময় এবং সুযোগ কোনটাই নেই। সোহা অনুকে ডাকছে আর শিশির আলতার মাথায় হাত বুলিয়ে আলতাকে ডাকছে। ভোরের আলো তখনো চরাচরে এসে পৌঁছুয়নি তবুও পূব আকাশটার কমলাভ রঙ একটু একটু চোখে পড়ছে। হয়তো আর একটু পরই সেই রঙ কাচা হলদে রঙ ধারণ করে ধরনীর ফ্যাকাশে আলোকে উজ্বল করে তুলবে। চারজনই বাস থেকে নেমে নিজ নিজ ব্যাগ হাতে তুলে নিলো। আলতার ব্যাগ মানেই যেন শিশিরের বহনের জিনিস তাই আলতাকে ব্যাগে হাত দিতে হলো না। ব্যস্ত ঢাকা নগরী রিকশার শহর হলেও এত ভোরে রিকশা চোখে পড়লো না কারো। অনু চারপাশ খেয়াল করে শিশিরকে বলল, “সব একটু অপেক্ষা কর আমি আম্মুকে বলছি গাড়ি পাঠাতে।”

শিশির একবার বারণ করতে গিয়েও করলো না সোহার দিকে তাকিয়ে। সোহার চোখ মুখ কেমন যেন লালচে আর ফোলা মনে হলো তার। সে কি বাসে বসে কেঁদেছে খুব! কই সামনেই তো ছিল কান্না করলে টের পেতো না সে! তবুও সোহার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে যত দ্রুত সম্ভব তাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া উচিত। পরে না হয় কথা বলা যাবে এসব নিয়ে এখন সে একটু নিজেকে একা সময় দেক। খারাপ লাগছে শিশিরের যাওয়ার পথে সবচেয়ে বেশি উচ্ছ্বাস তার মাঝেই ছিল আর ফিরতি পথে দুঃখী মানুষটাও সে-ই।

অল্প সময়ের মাঝেই অনুর মা তাদের বাড়ির গাড়িটি পাঠিয়ে দিয়েছেন। যাওয়ার পথে প্রথমেই আলতার হোস্টেল পড়ে, তারপর সোহার বাড়ি। হোস্টেলের সামনে আসতেই দেখা গেল গেইট তখনও খোলেনি। অনুকে একরকম জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছে সোহাকে পৌঁছে দিতে আর শিশির থেকে গেছে আলতার সাথে। গ্রামে থেকে চারটা দিন সকালটা ধোঁয়াশায় কেটেছে অথচ আজ কুয়াশা এখানে নামমাত্র। শিশিরের হাঁটু আর কাঁধে প্রচণ্ড ব্যথা তবুও তার এই কাকডাকা ভোরে ফুটপাতে হাটতে ভালো লাগছিলো আলতাও হাটছে তার পাশাপাশি। মিনিট কয়েক হাটার পর প্রথম মুখ খুলল আলতা, “সোহা আপুর কি হইছে? উনি কালকে থেকে খুব মন খারাপ করে আছে।”

আলতার কথা শুনে চকিতে তাকালো শিশির।
“তুই খেয়াল করেছিস?”

“হুম”

“আর কি খেয়াল করেছিস?”

“শরত ভাইয়ের সাথে কোন কথা বলেননি আসার সময়।”

“আর!”

“কোন কারণে মনে হয় শরত ভাইয়ের সাথে সোহা আপু অভিমান করছে। আর…”

চুপ হয়ে গেল আলতা। পরের বাক্যটা শিশিরের সামনে বলতে তার লজ্জা লাগছে বলেই থেমে গেছে কিন্তু শিশির কৌতূহলী জানার জন্য।

“আর!”

ভোরের আলোয় সফেদ পর্দা সরে পৃথিবী এখন হলদে হয়ে উঠছে। গাছের পাতায় একটু আধটু কুয়াশা লুকিয়ে আছে গুপতচরের মত। আলতার নীরবতা শিশিরকে অধৈর্য্য করে তুলল। সে আবারও বলল, “বল আর কি?”

ইতস্তত করতে করতেই আলতা এবার বলে ফেলল, ” সোহা আপু মনে হয় শরত ভাইকে ভালোবাসে।”

পা থামিয়ে শিশির তাকালো আলতার দিকে। সে বিষ্ময়ে বাকরুদ্ধ রইলো কিছুটা সময় তারপরই ফিচেল হেসে বলল, “তুই বুঝিস ভালোবাসা?”

আলতা বোধহয় এমন কিছু কল্পনাও করেনি। শিশির তাকে এমন কোন প্রশ্ন করতে পারে তা ভাবেনি কখনও। ভালোবাসা কি সে জানে না তবে জানতে চেষ্টা করে। প্রতি মুহূর্তে তার সকল কাজের মাঝে এই উজ্জ্বল শ্যামলা মুখের মানুষটা তার ভাবনঘরে পায়চারী করে সেটাই কি ভালোবাসা! তার সকল যন্ত্রণা, একাকীত্ব আর অস্বস্তির মাঝে এই মানুষটার একটা, দুটো মুখের কথাই তৎক্ষনাৎ যন্ত্রণানাশকের মত কাজ দেয় সেটাই কি ভালোবাসা! এই মানুষটাকে দেখার জন্য, হুটহাট তার কণ্ঠ শোনার জন্য এই যে তার চঞ্চল মনটা যখন তখন ছটফটায় সেটাই কি ভালোবাসা! মন বলে হ্যা এটাই ভালোবাসা তাছাড়া আর কি হবে! আর এগুলোই যদি ভালোবাসা হয় তবে আলতা নিশ্চিত সোহা আপু শরত ভাইকে ভালোবাসে। সে দেখেছে গত চারটা দিন সোহা আপু যখন যখন শরত ভাইকে আশপাশে পেয়েছে ঠিক তখন তখনই খুব হেসেছে। মুচকি হাসি, উচ্ছল আর প্রাণবন্ত ছিলো সেই হাসি। মনে পড়ে তার মেলায় যখন শরত ভাই কানের দুল কিনে দিলো সোহা আপু খপ করে সবগুলো দুল নিয়ে কেমন বুকের কাছটায় ছুঁয়ে রাখলো। যেন শরত ভাইয়ের কিনে দেওয়া দুল নয় ওগুলো খোদ শরত ভাইকেই হাতে পেয়ে গেছে।আর সারাক্ষণ কেমন আড়চোখে শুধু শরত ভাইকেই দেখেছে।

শিশির প্রশ্নের জবাব না পেয়ে হাঁটা থামিয়ে দিলো। আলতার দিকে মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে গেল সে।

“তুই এত বদলে গেলি কেন রে! এত ভাবুক, এত নীরব তো ছিলো না কখনো আমার আলতা।”

আমার আলতা! ভীষণ এক গভীর ধাক্কা লাগলো বুকের ভেতর। শিশির ভাই তাকে ‘আমার আলতা’ বলল!

“এ্যাই আলতা তুই কি কোন কথার জবাব দিবি না বলে পণ করেছিস?”

“শিশির ভাই কয়টা বাজে?”

“কয়টা বাজে দিয়ে কি করবি?”

“হোস্টেলে যাব না!”

“ওহ হু” বলে শিশির উল্টোপথে হাটা শুরু করলো আলতাকে নিয়ে৷ এ পর্যায়ে আলতা স্বস্তি পেলো শিশিরের প্রশ্ন এড়ানো গেল বলে। আজকাল লোকটা বড্ড উগ্র হয়ে ধরা দিচ্ছে। আগে তো এমন ছিলো না!

আলতাকে পৌঁছে দিয়ে সকাল আটটায় শিশির নিজের হলে পৌঁছুলো। রাতভর জেগে থাকার ক্লান্তি একমাত্র ভরপেট খাওয়ার পর একটু ঘুমাতে পারলেই দূর হবে জানে শিশির কিন্তু এখন মাথায় ঘুরছে সোহার কথা। মেয়েটার যে কাল সকাল থেকে কি হলো কে জানে! হলে ঢুকে নিজের ঘরে গিয়ে সে আগে একটু বিছানায় গা এলিয়ে দিলো।

চলবে

#শিশিরে_ভেজা_আলতা
(২য় খন্ড)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
২০.

গ্রাম ছেড়ে চলে আসার প্রায় মাস হয়ে গেল।কোথাও কিছু থেমে নেই কারো জন্য। আলতা পুরোপুরি ব্যস্ত তার পড়াশোনা নিয়ে। শিশির প্রতিদিন ফোন দেয় তাদের মধ্যে এখন কথার ধরণ বদলে গেছে। আগের মত শুধু প্রয়োজনেই ফোনালাপ হয় না শিশির এখন যখন তখন ফোন করে আর তাদের কথার ধরণ শীতল। এই যেমন আজ দুপুরেই আলতা সবে কলেজ থেকে এসেছে আর তখনই ফোনটা বেজে উঠলো। কলেজের জামা বদলে গোসলের জন্য কাপড় নিতে নিতে সে ফোনটা কানে ধরে সালাম দিতেই শিশির বলল, “কলেজ থেকে ফিরেছিস?”

“হ্যা”

“আজ ক্লাসে কি কি হলো? আজকে আবার ফুচকা খেয়ে আসিস নাই তো!”

” ফুচকা…”

“কি ফুচকা…. তার মানে খাইয়া আসছিস! তোর কি আমার কথা একদমই শুনতে ইচ্ছে করে না? এইসব আলতুফালতু জিনিস খাইয়া অসুস্থ হলে কে দেখবে এখানে!”

“বেশি খাই নাই। মাত্র এক প্লেট।”

“মাত্র এক প্লেট বাহ! ধুর হুদাই ফোন দিয়া নিজের মেজাজই নষ্ট করলাম।” কথাটা বলেই শিশির কল কেটে দিলো। শিশির ভাইকে এজন্যই সে ফুচকা, পানিপুড়ির কথা বলতে চায় না। কিন্তু তার বেয়াদব মুখটা একদমই মিথ্যে বলতে পারে না। কি করে এখন! এবার সে নিজেই কল দিলো। শিশির তুলল না আরও কয়েকবার করার পর শিশির কলটা তুলে বলল, “আর একবার ডিস্টার্ব করলে শাস্তি পাবি। যেন তেন শাস্তি নয় একদম তোর হলে এসে চুমু খেয়ে যাব।”

রোদ্রময় ভর দুপুরে বিনামেঘে বজ্রপাতের মত কানে লাগলো কথাটা। আলতা ফোন কানে ধরেই হা করে আছে। এটা কি বলল শিশির ভাই! কয়েক সেকেন্ড তো আলতা বিবশ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। গোসলের জন্য কাপড়গুলো এক হাতে ছিল তার সেগুলোও কখন যে হাত থেকে মোঝেতে পড়েছে বুঝতেই পারেনি। শিশির ভাইটা যে আজকাল একটুখানি পা*গল হয়েছে তা জানে আলতা কিন্তু আজ তো একদম পাবনায় পাঠিয়ে দেওয়ার মত পাগল হয়ে গেছে।

অনু আর শিশির একই ডিপার্টমেন্ট এর কিন্তু সোহার ভিন্ন। সেই সুবাদেই মাঝেমধ্যে সোহার সাথে তাদের কারোরই দেখা হয় না। অবশ্য এই দেখা না হওয়াটা মানসিক টানাপোড়েনই মূল কারণ। সোহা হঠাৎ করেই খুব ভেঙে পড়েছে তা বন্ধুরাও বোঝে। কিন্তু তাদেরইবা কি করার আছে সবাই ব্যক্তি জীবনের ব্যস্ততা কাটিয়ে জোরজবরদস্তি তাকে একটু সঙ্গ দিতে পারে কিন্তু শরতকে তার জীবনে এনে দেওয়া তো তাদের সাধ্যে নেই। ঢাকায় ফিরে প্রথমেই অনু আর শিশির মিলে সোহার সাথে এই নিয়ে কথা বলেছে। তারা যতোটা পেরেছে সোহার মানসিক শান্তির জন্য কোনপ্রকার সান্ত্বনা দিতে ত্রুটি রাখেনি। কিন্তু মানব মন তো বড়ই বিচিত্র ধরণের। এই মন কখনো সান্ত্বনা বাণীতে পরিতুষ্ট হয় না তার যা চাওয়া পাওয়া তা নিয়ে বরাবরই জেদ করে। কেউ কেউ তা উগ্রতায় প্রকাশ করে কেউ বা চেপে যায় ভেতরেই। সোহার ক্ষেত্রে প্রথম দিকে সবটা অন্তর্মুখী হলেও আজকাল তা বেপরোয়া রূপ ধরছে। সে বন্ধুদের সাথে কিছু শেয়ার করছে না কিন্তু নিজে নিজে অনেক কিছুই করছে আর সেসব মুখ বুঁজে সহ্য করছে শরত। এইতো গত সপ্তাহে সোহা শরতকে ফোন করে বলল সে দেখা করতে চায়। শরত কিছুতেই মেয়েটাকে প্রশ্রয় দিতে চাইছে না তাই মুখের ওপর বলে দিয়েছে আমার পক্ষে অসম্ভব। সোহা নাছোড়বান্দা সে দিনরাত সুযোগ পেলেই কল দিয়ে একই কথা বলতে থাকে বাধ্য হয়ে শরত তাকে কলব্লক, হোয়াটসঅ্যাপ সব জায়গা থেকেই ব্লক করেছে। মেয়েটা এতে আরও বেশি উত্তেজিত হয়ে তার আম্মুর ফোন থেকে শরতকে কল করেছে। কল রিসিভ করেই শরত যখন বুঝলো সোহা করেছে তখনই সে সেই নম্বর ব্লক করেছে। সোহা একে একে তার আম্মু, আব্বু, ছোট ভাই আর তার খালার ফোন থেকেও কল করায় শরত সবগুলো নম্বরই ব্লক করেছে। শরতের ধারণা কোন একভাবে কথা বললেই সে ফেঁসে যাবে। সোহার চোখে সে দেখেছে তো নিজের জন্য পাগলমি ভরা ভালোবাসা সেই কুয়াশামাখা ভোরেই। কোন এক ভাবে একবার মন গলে গেলেই শরত ফেসেঁ যাবে সোহার মোহে। আর সে এবার কিছুতেই চায় না নিজেকে আবারও কারো মাঝে হারাতে।ছোট্ট একটা জীবন তাতে এভাবে অন্যদের দখল মেনে নেওয়ার কোন মানেই হয়। মা আর বোনকে ঘিরে তার যে দুনিয়া তাতে আর নিজে যেচে সে কাউকে জড়াতে চায় না। মায়ের সিদ্ধান্তই হবে তার সিদ্ধান্ত শুধু তাকে আরও কিছু সময় দেওয়া হোক। হচ্ছেও তাই জয়তুন আজকাল ছেলেকে খুব একটা জোর করেন না বিয়ের জন্য৷ বলে রেখেছেন, “তোরে আরও বছর খানেক সময় দিলাম এরই মইধ্যে নিজের মন মানাইয়া নে। হেরপর আর একদিনও আমি অপেক্ষা করমু না বউ আনতে।”

শরত মেনে নিয়েছে মায়ের এই কথা৷ এখন শুধু দিনরাত নিজেকে বোঝাচ্ছে অলি বলতে কারো অস্তিত্ব তার জীবনে নেই। মায়ের পছন্দের মেয়েই হবে তার ভালো লাগা, ভালোবাসা আর জীবনের একমাত্র প্রিয় সঙ্গী। তার এই মনের ভাবনাকে হুটহাট তীরবিদ্ধ করে তোলে সোহার ফোনকল কিংবা ছোট্ট বার্তা। কাল বিকেলেও একটা ছোট্ট বার্তা এসেছে শিশিরের ফোন থেকে, ” এ সপ্তাহে আমি আসছি শরত আপনার সাথে দেখা করতে।”

মেসেজটি শিশিরের ফোন থেকে আসলেও শরত জানে শিশির নিশ্চয়ই জানে না এ ব্যপারে। নিজের ভাইকে সে ভালো করেই জানে সোহা যা করছে তা শিশির জানলে তাকে বাঁধা দিতো। দোকানে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে শরত। ভর দুপুরেও আজ সে দোকান বন্ধ করেনি অথচ কাকা যাওয়ার সময় বার দুয়েক বলে গেছে দোকান বন্ধ করে বাড়ি যেতে। শরত অন্যমনস্ক হয়ে বাজারের দক্ষিণ দিক থেকে দেখা যায় সরষে ক্ষেতটার দিকে তাকিয়ে আছে৷ শীত শেষের এই ঋতুতে বসন্তের আগমনী হাওয়া গায়ে কেমন কাঁটার মত বিঁধছে তার। ভালোবাসা এত যন্ত্রণাদায়ক কেন হয় সবসময়। এই যে কষ্ট পায় কারো জন্য তার এই কষ্টের দায় তো ‘ভালোবাসা’র ওপরই বর্তায়। এই যে সোহা নামের মেয়েটা উন্মাদের মত তার পেছনে পড়ে আছে। ভালো মন্দ, সম-অসম বাছ-বিচার ভুলে তার জন্য ছটফটায় তার দায়ও ‘ভালোবাসা’র ওপর পড়ে। গোসল করে আসেনি আজ শরত আর দুপুরের নামাজের সময়টাও কাযা হলো বসে থেকে৷ নিজেকে এভাবে সময় দিলে শুধু সময় বয়েই যাবে সে আর সামনে এগোতে পারবে না। তাই এই মুহুর্তেই শরত সিদ্ধান্ত নিলো আজই সে তার মাকে গিয়ে বলবে, আম্মা পাত্রী পছন্দ করেন আমি বিয়ে করব। তার মন বলছে বিয়ে হয়ে গেলে যখন নিজের ঘরে নতুন একজন থাকবে তখন সে না চাইতেও সেই মানুষটাকে নিয়ে ভাববে, সেই মানুষটার এক লিখিত দ্বায়িত্ব তার কাঁধে ভর করবে। তখন সেই অতীত, অতীতের স্মৃতির ভীড়ে নিজেকে আর দাবিয়ে রাখতে পারবে না। জীবন কখনও একই জায়গায় স্থির থাকে না। জীবন বহমান এক নদীর ধারা যা নিত্য বয়ে চলবে আপন গতিতে। এতে রোধ করার প্রক্রিয়া নেই আছে রূপ বদলের সুযোগ তাকেও রূপ বদলে সামনে আগাতে হবে। সে দোকান বন্ধ করে বাড়িতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতেই ফোন বেজে উঠলো। পকেট হাতড়ে ফোন বের করতেই দেখলো ‘বড় জামাই’ নামটা। শিউলির বরের ফোন নম্বরটা সে মজা করেই বড় জামাই লিখিয়েছিলো। শিউলির বিয়ের তারিখ যেদিন ঠিক হয়েছিলো সেদিনই নম্বরটা তার ফোনে নেওয়া হয়। সে কোন কাজে ব্যস্ত থাকায় আলতাকে ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বলেছিলো পাত্রের নাম্বারটা সেভ কর তো। তখন তার পাশেই বসা ছিল আহসান আর শিফা। শিফা ফোনে শিশিরের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত। আলতা নাম্বার টুকে জানতে চাইলো কি নামে সেভ করবে! শরত তার দিকে তাকিয়ে বলেছিলো, ‘বড় জামাই’ লিখ। শরতের কথায় প্রত্যেকেই অবাক হয়ে তাকালে শরত বলল, “আলতাকে বিয়ে দিলে আরও একটা নাম্বার যুক্ত হবে না! সেটা ছোট জামাই নামে থাকবে।”

শরতের কথা শুনে হাসে খুব আহসান আর শিফা। আলতা একটুখানি রাঙা হয় কিন্তু ফোনের ওপাশ থেকে শিশির যখন মাকে জিজ্ঞেস করে হাসির কারণ শিফা তখন শরতের বলা কথা গুলোই বলে। শিশির অবশ্য সেকথা শুনে মনে মনে বলে, ইশ, ভাইয়ের ইচ্ছেটা তবে পূরণ হলো না। আমার ফোন নম্বর তো আগেই সেভ করা ছোট জামাই লেখাটা আর হলো না!”

এই মুহুর্তে শরতের কপাল কুঁচকে উঠলো শিউলির বরের কল পেয়ে। শিউলিকে এ মাসের শেষেই বাড়িতে আনার কথা আগামী মাসে তার ডেলিভারি ডেইট৷ রিসিভ করতেই জামিল উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, “আসসালামু আলাইকুম শরত ভাই। শিউলির শরীরটা ভালো না তাকে হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছি আম্মাকে জানিয়ে দিয়েন।”

আচমকা বোনের অসুস্থতার কথাটা শরতকে একটু ভীত করে তুলল। ক’দিন আগেই ডাক্তার কিছু সমস্যার কথা বলেছিলেন কিন্তু সেজন্য ট্রিটমেন্টও চলছে ভালোমত। সে আর কিছু ভাবতে পারলো না দ্রুত বাড়ির দিকে রওনা দিলো। যেতে যেতে অবশ্য সে বুদ্ধি করে কাকিকে ফোন করে বলে রাখলো সবটা। সে বাড়ি ফিরেই অল্প সময়ে টাকা পয়সা যা ক্যাশ ছিলো গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো জামিলের দেওয়া হাসপাতালের উদ্দ্যেশে। শিফা আর জয়তুন দুজনেই গেল শরতের সাথে।

রাত তখন ঘড়িতে আটটা পঁচিশ। শিশির টিউশনি থেকে বের হয়ে নিজের হলের দিকে রওনা করলো। আজ দুপুরের পর আর আলতার সাথে কথা হয়নি একবারও। বাড়িতে কথা হয়েছিলো সকালে তাই ভাবছিলো একবার আম্মাকে ফোন দিবে৷ কিন্তু রাস্তায় থেকে কথা বললেই আম্মা রাগ করে খুব৷ হলে ফিরে কল করবে ভেবে এখন একটু সোহাকে কল দিতে ফোন হাতে নিয়েছিল অমনি তার ফোনটা বেজে উঠলো। স্ক্রীণে ‘আম্মা’ নামটা দেখে তার চোখদুটো চকচক করে উঠলো। রিসিভ করে সালাম দিতেই শোনা গেল মায়ের হাসি হাসি কণ্ঠ। শিউলির মেয়ে হয়েছে শিশিরকে মামা হওয়ার শুভেচ্ছা জানিয়ে বললেন, “ভাগ্নির মুখ দেখতে কি দিবি প্রস্তুতি নে জলদি।”

বাড়িতে প্রথম নাতনির সংবাদ সবার জন্য খুব আনন্দদায়ক ব্যাপার৷ মাস্টার বাড়ির প্রতিটি সদস্য শিউলির মেয়ে হয়েছে বলে আনন্দে আত্মহারা। শিফা আনন্দ শিশির ফোনের এপার থেকেই টের পাচ্ছে। সেও প্রচণ্ড খুশি তাই মায়ের সাথে কথা শেষ করেই সে আলতাকে ফোন করে জানালো। আলতাও খুশি তার উচ্ছাস টের পেয়ে শিশির হঠাৎ বলে বসল, “বাড়ি যাবি আলতা? চল আমরা গিয়ে দেখে আসি বাবুটাকে।”

হুট করে শিশিরে বলা কথাটা শুনে আলতার কেন জানি খুব লজ্জা লাগল। সে তৎক্ষনাৎ কিছু বলল না দেখে শিশিরই বলল, “আচ্ছা থাক, এখন আর গ্রামে যেতে হবে না।”

দিন চারেক পরের ঘটনা ; শিশির আর অনুর দুটো ক্লাস ছিলো সেদিন। তারা ক্লাস শেষে টিএসসিতে এসে চা নিয়ে বসলো। সোহার ক্লাস ছিল সে করেনি বন্ধুদের ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলো কোথায় আছে? অনু তাদের বসার জায়গার কথা জানাতেই সে বলল, বোস তোরা আমি আসছি।

সোহা এসে প্রথমেই শিশিরকে বলল, “কি ভাগ্নির মামু মিষ্টি খাওয়ানোর ভয়েই কি আজকাল সামনে আসিস না?”

সোহার মুখে ভাগ্নির কথা শুনে চমকে গেল শিশির। গত চারদিনে সে বিভিন্ন কারণে আলতা আর মাকে ছাড়া কাউকেই কল দেয়নি। অনু একদিন দিলো সেও প্রয়োজনীয় কিছু নোটস এর জন্য। কিন্তু সোহা জানলো কি করে শিউলির মেয়ে হয়েছে! অনু বিষ্মিত হয়ে বলল, “কিসের মামু, ভাগ্নিরে! ”

“শরৎচন্দ্রের বোনের মেয়ে হয়েছে৷ পরশু আমি ফোন করেছিলাম তাকে সে তখন হাসপাতালে ছিল। জানতে পারলাম ভাগ্নি হয়েছে কিন্তু কি কান্ড দ্যাখ, শরতবাবু না হয় আমাদের কেউ না কিন্তু এই হারামি একটাবার বললও না মিষ্টি তো দূর।”

সোহার কথা বলার ধরণে শিশিরসহ অনুও ভীষণ থমকালো। এই শান্ত, সহজ মেয়েটা এমন কুটিল স্বরে কথা বলতে পারে তা কল্পনাও করেনি তারা। অনুর এবার মনে পড়লো গত একমাসে সোহা একটু উদ্বাস্তু হয়ে কথাবার্তা বলে। সে একটু হাসি হাসি মুখে মজা করলো, তুই কি সোহা শরৎবাবুর নায়িকা থেকে হঠাৎ সমরেশ বাবুর কঠিন নায়িকা হয়ে উঠলি নাকি!

“ধরে নে তাই!” বড্ড সাবলীল শোনালো সোহার কথা৷ শিশির একটু লজ্জাই পেল। সে তার বন্ধুদের ভেবেছিলো জানাবে কথাটা কিন্তু বিভিন্ন ভাবেই ব্যস্ততায় বলা হয়নি। সে এখন বসা থেকে উঠে চায়ের দাম মিটিয়ে বলল, চল তোদের মিষ্টি খাওয়াবো।

“নাহ, তোর আর খাওয়াতে হবে না। আজকে মিষ্টির ট্রিট দেব আমি মানে ভাগ্নির মামি।”

“কিহ!”

চোখ দুটো রসগোল্লার মত বড় হয়ে গেল অনুর। তুই কি পাগলটাগল হয়ে গেলি নাকি সোহা! এতো দেখছি শরৎচন্দ্রের প্রেমে উন্মাদ হয়ে উল্টাপাল্টা বকছে রে শিশির!

চলবে

#শিশিরে_ভেজা_আলতা
(২য় খন্ড)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
২১.

উত্তরায় নতুন এক কাচ্চি শপ হয়েছে। সন্ধ্যের শেষটায় শীত শেষের রুক্ষ হাওয়ায় গা ভাসিয়ে তিন বন্ধু এসে উপস্থিত হয়েছে সেখানে। অনুর গাড়ি ছিল সাথে তাই আসতে খুব একটা সময় নষ্ট হয়নি। রাস্তায় আজ জ্যামও পায়নি খুব একটা তাতেই স্বস্তিতে আসা গেল। রেস্টুরেন্টে ঢুকেই সোহা হাস্যজ্বল মুখে অর্ডার কনফার্ম করালো। অনু শুরতেই কোল্ড ড্রিংস নিয়ে আগে গলা ভেজালো আর বিরসমুখে বসে বসে দুই বান্ধবীর মুখের ভাব মুখস্থ করতে লাগল শিশির। অতি অনিচ্ছায় তার উপস্থিতি এখানটায়। সোহার আচরণ তার একদমই পছন্দ হচ্ছে না আর অনুর জবরদস্তি ট্রিট নেওয়াটাও। তার ভাগ্নি হয়েছে সেই খুশিতে বিনাবাক্যে সে ফ্রেন্ডদের ট্রিট দিতো কিন্তু সোহার বাড়াবাড়ি মোটেও পছন্দ হচ্ছে না। এই ভর সন্ধ্যায় কাচ্চি কেন তার প্রিয় রসগোল্লাও যদি এখন দেওয়া হয় সে খুশি হতে পারবে না। আগে তাকে ক্লিয়ারলি জানতে হবে সোহা যা বলছে তা কি দু পক্ষ থেকেই সমাধান হয়ে এসেছে নাকি সোহা একাই এসব কাহিনি করছে। সাদাসিধা, নম্র মেয়েটা হুট করে এমন উগ্র হয়ে উঠছে তা শিশিরের ভাল লাগছে না। এমনটা যদি অনু করত তবে নিঃসন্দেহে স্বাভাবিক বলেই মেনে নিতো সে কিন্তু স্বভাবগত দিক থেকে এসব সোহার সাথে একদমই যায় না। এই ট্রিট শিশির নিলেও হজম করতে পারলো না ঠিকঠাক । ফিরতি পথে সে সোহাকে সরাসরি প্রশ্ন করলো, তুমি যা করছ, বলছো ভেবে চিন্তে বলছো তো!

“কিসের কথা বলছ?”

“বুঝতে পারছো না কেন শিশির এই আমার বন্ধু হলে তুমি!” বড় মন খারাপের ভাণ করে বলল সোহা।

“দেখো সোহা, আমার ভাই কিন্তু অন্য আর সবার মত না। সুন্দরী মেয়ের প্রপোজ পেতেই একদম ঝাপিয়ে পড়বে তেমন ভাবলে ভুল করবে। প্রেমের নামে টাইম পাস করার পক্ষপাতী কখনোই নয়। ”

শিশির আরও কিছু বলার জন্য মুখ খুলত কিন্তু তার আগেই সোহা তাকে থামিয়ে দিলো, “তোমার মনে হয় আমি তোমার ভাইয়ের সাথে টাইমপাস করতে চাচ্ছি? সিরিয়াসলি! শিশির টাইমপাসই যদি করার হতো তাহলে এই ঢাকা শহরে ছেলের অভাব পড়েছে নাকি আমার পেছনে ঘোরে এমন ছেলে একটাও নেই! তুমি নিজেও জানো আমাদের সিনিয়র টিটু ভাই আমার পেছনে কেমন করে পড়ে আছে। সে দেখতে সুদর্শন, টাকা পয়সাওয়ালা তবুও তো আমি তার দিকে ফিরে তাকাই না অথচ তোমার ভাই তোমাদের এলাকার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স পাস করে মুদি দোকানি হয়ে বসে আছি যেখানে আমার বাবা সচিবালয়ে প্রথম স্তরের লোক৷ তবুও আমি শরতকে চাই কারণ তাকে আমি মন থেকে ভালোবাসি।”

সোহার সাথে হওয়া কথোপকথনের জের ধরেই শিশির ভাবছিলো অনেক কথা। সোহার উন্মাদনা সত্যিই চোখে পড়ার মত অথচ ভাই তো আজও অলিকে মনে করে কষ্ট পায়। শিশিরের হঠাৎ করেই খুব রাগ হলো নিজের প্রতি। কেন তারই বান্ধবীগুলো তার সহজ, সাধারণ ভাইটার জড়াতে চায়! তার ভাইটার জন্য একজন সাদা মনের মানুষ দরকার। যে মানুষটা ভাইয়ের নিশ্চুপ শব্দগুলোকে নিরবে বুঝতে পারবে। কঠিন ধাতুর মত ভাইয়ের সাথে মিশে থাকবে আজীবনের সঙ্গী হয়ে। অলি মাঝপথে ছেড়ে গেল৷ সোহার সাথে যদি ভাইয়ের কোন প্রকার সম্পর্ক হয় তবে সোহাও ভাইকে ছেড়ে যাবে তা কাউকে বিস্তারিত বলে বোঝাতে হবে না। সামাজিক অবস্থান, পরিবেশগত জীবন সবটাই তাদের দুজনকে আলাদা করে। সোহার পরিবার তাদের সুন্দর, শিক্ষিতা শহরে বেড়ে ওঠা মেয়ের জন্য কখনোই কোন গ্রাম্য মুদি দোকানী ছেলের সাথে বিয়ের মত সম্পর্ক হোক চাইবে না কখনও। আর না সোহা ভাইকে বিয়ে করে গ্রামের পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে৷ আর ভাই! সে তো ভুল করেও নিজস্ব ভিটা ছেড়ে শহরে আসবে না নইলে সেই কবেই তার শহরে আসা হয়ে যেত। অলিকেও হারাতে হতো না। সে রাতে শিশির আর আলতাকেও ফোন করেনি। দুশ্চিন্তা ঢুকে গেছে তার মাথায় সোহা আর ভাইকে নিয়ে। আরও সপ্তাহ খানেক সময় শিশির এ বিষয়ে অনেক ভেবেছে সোহার সাথে কথা বলে বোঝাতে চেষ্টা করেছে। কাজের কাজ কিছুই হয়নি উল্টো সোহা অনুর সাহায্য নিয়ে আজ রাতে শিশিরদের গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। খবরটা শিশির যখন পেল তখন সে আলতা নিয়ে রিকশায় বসা। আজ শিশিরের টিউশনি ছিলো একটা৷ আলতার কোচিং থেকে ফেরার সময় শিশির ফোন করে জানতে চাইলো সে কোথায় আছে। আকাশে তখন সূর্যডুবির শেষ মুহূর্ত। পশ্চিমের রক্তিমাভা কেটে আবছা আঁধারে ঢাকতে শুরু করেছে ভূলোক৷ সে জানালো মাত্রই কোচিং থেকে বেরিয়ে রিকশা খুঁজছে৷ শিশির বলল, “অপেক্ষা কর এখানেই আমার পৌঁছুতে আর দু মিনিট লাগবে।”

আলতা ফুটপাতের দাঁড়িয়ে বাদাম খাচ্ছিলো। কলেজে যাওয়ার পথে সকালে কিনেছিল কিন্তু খাওয়া হয়নি৷ এখন শিশিরের আসার অপেক্ষা করতে করতে সেগুলো ব্যাগ থেকে বের করেছে৷ একটা দুটো করে মুখে পুরতে পুরতে সে এদিক ওদিক দেখছিল। ছুটি হয়েছে বলে তাদের ব্যাচের অনেকেই আছে আশপাশে। দু একটা মেয়ে এটা সেটা বলে যার যার মত চলে গেল আর ছেলেরা অনেকেই রাস্তার এধারে, ওধারে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। শিশিরের বিশেষ নিষেধাজ্ঞা আছে তার ছেলেদের সাথে এখন বন্ধুত্ব না করার৷ শিশির বলেছে, “কলেজ এর সময়টা অনেক গুরুত্বপূর্ণ তোর জন্য আলতা। খুব ভালো একটা রেজাল্ট ভালো একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি তারপর জীবনটাকে দারুণভাবে একটা উপযুক্ত জায়গায় স্থির করা। এ সবে টিকতে হলে এখন বন্ধুত্বের আবেগে রাশ টানতে হবে। বলছিনা, একদমই বন্ধুবান্ধব ছাড়া থাকতে৷ সেটা অসম্ভব ! আমাদের জীবনে বাবা মায়ের পরে বন্ধুদের একটা জায়গা থাকা জরুরি তবে সেটা ব্যালেন্স করার মতও একটা শক্তি থাকা চাই। তোর মধ্যে এখনও সেই শক্তির রেশ দেখতে পাইনি আমি। ছেলে বন্ধুরা তোর জন্য উপকারের চেয়ে ক্ষতিকরই বেশি হবে তা আমি জানি।”

শিশির ভাইয়ের বলা এই “জানি” শব্দটায় সে কিছু একটা অনুভব করেছিলো। তার মনে হয়েছে শিশির ভাই যা বলছে তাই ঠিক। সে সত্যিই ব্যালেন্স করতে পারবে না বন্ধুত্ব। এই যে এই কোচিংয়েই তো আছে রায়হান নামের ছেলেটা। সেই ছেলের সাথে মাস দেড়েক কোচিং করার পর একটু আধটু গল্প আড্ডা হতো। একসাথে পড়তো বলেই ওইটুকু হয়েছিল কিন্তু ছেলেটা কি করল! গত মাসেই তাকে একটা চিরকুট দিলো চকলেট সমেত। তাতে সরাসরি প্রেম নিবেদন করেছে ছেলেটা। তারপর পুরো মাস জুড়ে কিছু না কিছু লিখছেই অনবরত কখনোবা ডেকে ডেকে এটা ওটা বলছে। ভয়ে আলতার বুক কাঁপে এই নিয়েই৷ শিশির ভাইয়ের কানে যদি যায় কথাটা! না আর ভাবতে ইচ্ছে করে না তার। ইন্টার শেষ করতে এখনও বছর বাকি তার। পড়াশোনা ভালো না হলে সে কি করে চান্স পাবে শিশির ভাইদের বিশ্ববিদ্যালয়ে? এদিকে আর মাত্র মাস দশেক বাকি শিশির ভাইয়ের অনার্স শেষ হতে এমনটাই বলছিলো অনু আপু। আলতার তার ভাবনায় এতোটাই বিভোর ছিল যে সে খেয়ালই করেনি শিশির কখন এসে দাঁড়িয়েছে তার পাশে। চারপাশে তখন আঁধার ঢেকেছে কিন্তু নগরী জ্বলছে নিয়ন আলোয়। শিশির বড্ড আলতো করে নিজের হাতের উল্টোপিঠে আলতার হাতের উল্টোপিঠ ছুঁয়ে দিলো। আকস্মিক বড় আকস্মিক সেই স্পর্শে আলতা ভয়ে শিউরে ওঠে। দ্রুত কাঁধ ঘুড়িয়ে পাশে তাকাতেই হৃৎস্পন্দন থেমে যায় কয়েক সেকেন্ড এর জন্য।

নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে বসে সে। চোখ বড় বড় হয়ে উঠেছে, পাতলা গোলাপি রুক্ষ ঠোঁট দুটো তার তিরতিরিয়ে কাঁপছে আর বুকটা কেমন ধড়ফড় করছে ভয়ে। শিশির পূর্ণ দৃষ্টি মেলে আলতাকে দেখলো। গোলাপি ফর্সা আলতার মুখটা নিয়ন আলোয় কেমন রহস্যময়ী কোন অপ্সরী বলে ভ্রম হচ্ছে তার। কত চেনা খুব চেনা সাধারণ মেয়েটা কয়েক মুহূর্তের জন্য তার কাছে খুব অসাধারণ আর রহস্যময়ী বলে মনে হলো। সে আঙ্গুল ছড়িয়ে আলতার হাতের আঙ্গুলের ফাঁকে গুঁজে দিলো, “ভয় পেয়েছিস খুব!”

আলতা কিছু বলল না। শিশিরও আর প্রশ্ন না করে রিকশা ডেকে উঠে পড়লো। রাস্তাটা এখন বেশ শুনশান লাগছে। শিশির হাত বাড়িয়ে আলতাকে উঠতে ইশারা করতেই আলতা উঠে বসল। শিশির ডান হাতটা পেছন থেকে আলতার কোমর জড়িয়ে নিজের আরেকটু কাছে টেনে নিলো৷ রিকশা চলছিলো গন্তব্যে শিশির কিছু হয়নি এমনটা ভাব করে সামনে তাকিয়ে বসে ছিল৷ আজকাল রিকশায় উঠলেই শিশির ভাই এমনভাবে তাকে জড়িয়ে নিয়ে বসে৷ আলতা অনুভব করে এই পাশাপাশি বসা, শিশিরের স্পর্শ কিন্তু তার কখনোই এই স্পর্শে ভয় হয়নি, খারাপ লাগেনি। সত্যি বলতে সেই যে শিশির ভাইয়ের মামার বাড়িতে তাকে শিশির ভাই চুমু খেয়েছিল! সেই চুমু, সেদিনের স্পর্শ সবটাই আলতার অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দিয়েছিল কিন্তু এই স্পর্শে তার তেমন হয় না। শুধু মনে হয় এটাই স্বাভাবিক, এমনটাই হবার কথা। অলিখিতভাবে সে শিশির ভাইয়েরই আর শিশির ভাই শুধুই তার। সারাটা পথ শিশির ভাই একভাবেই বসেছিল চুপচাপ। ঘটনাটা জানলো তারা যকন রিকশা এসে থামলো আলতার হোস্টেলের সামনে। শিশির রিকশায় বসেই আলতাকে গেইট পেরুতে বলল তখনি তার ফোনটা বাজলো। আলতা যেতে গিয়েও কি মনে করে থেমে গেল। শিশির ফোন কানে তুলতেই বলল, হ্যাঁ অনু বল। তারপর মিনিট খানেক চুপ রইলো শিশির। এরপর ফোন কান থেকে নামিয়েই সে খুব ধীরে বলে উঠলো, বুলশীট। কথাটা যে দাঁতে দাঁত পিষে বলল শিশির তা বুঝতে পেরেই আলতা এগিয়ে এসে বলল, “কি হয়েছে শিশির ভাই?”

“সোহা আর অনু আমাদের এলাকায় যাচ্ছে।”

“কেন!”
উদ্বিগ্ন হয়ে আলতা জানতে চাইলেই শিশির বলল, তুই যা, কালকে কথা হবে।”

আলতা আর দাঁড়ানোর সাহস করলো না। সে যেতেই শিশির হলে ফিরলো। মনের ভেতর একটা ভয় ঢিপঢিপ শব্দ করতে লাগলো। এই সোহার জন্য ভাই কি তাকে ভুল বুঝবে!

শিউলির মেয়ে হওয়ার খুশিতে তার শ্বশুর বাড়ির আত্মীয়স্বজন প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ আসছে যাচ্ছে। হাসপাতালে তিনদিন রাখা হয়েছিলো সে তিনদিন ঠিক ছিল কিন্তু এখন বাড়িতে আনার পরও তাদের আনাগোনা কমছে না দেখে জয়তুন বেশ বিরক্ত৷ মেহমান একদিন দুদিন হলে ভাল্লাগে কিন্তু রোজ রোজ কি এসব ভাল্লাগে! এমনিতেই ছোট বাচ্চার ঘর তারওপর শিউলির শরীর তো এখনও ঝরঝরে হয়নি। বাচ্চা আর মা দুজনেরই বাড়তি একটা যত্ন প্রয়োজন আর জয়তুন একসাথে দুজনের যত্ন আবার মেহমানের আদর আপ্যায়ন কি করবে! বিরক্ত হয়েই বিড়বিড় করছে, আজ যদি ছেলের বউ থাকতো কতোটা উপকার হতো৷ অন্তত রান্নার কাজটা করলেও তার একটু উপকার হতো। কথাগুলো তিনি বিড়বিড় করলেও ঠিক এতখানি উচ্চস্বরে করলেন যেন খাওয়া পাতে শরতও শুনতে পায়। এমন নয় যে তিনি কাজে সহযোগিতা পাচ্ছেন না কারো থেকে। বরং শিফা আর নকশি দিনের অনেকটা সময় তার কাজেই হাত লাগায়। জহিরের কাজকর্ম বেড়েছে আগের থেকে অনেক বেশিই তাই দিনের বেশিরভাগ সময় বাড়ির বাইরেই থাকে। নকশিও স্কুলের চাকরিটা করতে পারছে না বলে বাড়িতে একা সময় কাটে। এজন্যই সে চলে আসে এ বাড়িতে বিকেলের পর শিফা অথবা জয়তুন তাকে বাড়ি দিয়ে আসে। আজও তেমনই হয়েছে আর আজ তো শরত বাড়ি এসে দেখেছেও কাকী রান্না করে দিচ্ছে । তাহলে মায়ের এমন কথার কারণ কি! আবার বিয়ে নিয়ে উঠেপড়ে লাগতে চাইছে নাকি! বিয়ের কথা মনে হতেই মনে পড়লো সোহার মেসেজটা। কাল রাতে মেয়েটা আবার বলল সে গ্রামে আসবে তার সাথে দেখা করতে। মেয়েটা কি পাগল হয়ে গেল পুরোপুরি! কি যে করা দরকার কিছুতেই বুঝতে পারছে না সে। বড় অস্থির মন নিয়ে সে রাতের খাবার শেষ করে নিজের ঘরে গেল। মায়ের কথাগুলো আপাতত কানে নেওয়া সম্ভব নয় প্রথমে সেই মেয়েটাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে পাগলামি ছাড়াতে হবে।

চলবে