#শিশিরে_ভেজা_আলতা
(২য় খন্ড)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
৩০.
সকাল থেকে ঝুম বৃষ্টি ; আকাশ কালো করে দিনটাকে আঁধারে ঘিরে নিয়েছে। কাল রাত থেকে এলাকায় বিদ্যুৎ নেই কারো ফোনে একফোঁটা চার্জও নেই। শিশির, অনু লন্ডনে পৌঁছেছে আজ তিন দিন হলো কিন্তু শিশিরের সাথে যোগাযোগ হয়েছে কাল সন্ধ্যেতে। ছেলে সহিসালামত পৌঁছে গেছে কথাটা শুনতেই যেন শরীর ঝরঝরে হয়ে উঠেছে তার। শিশির তার জন্য বরাদ্দ জায়গাতেই গিয়ে উঠেছে এবং সপ্তাহের শুরুতেই সে ক্লাস জয়েন করবে। বাড়ির পরিবেশ আগের মতোই আছে শুধু শিফার মনটা আগের চেয়ে বেশি ভয়ার্ত হয়ে গেছে। আগে তো ছেলে এক দেশেই ছিল বিপদে আপদে বাড়ি এসেছে জ্বর, স্বর্দিতেও নিজে না পারলেও ছেলের বাবাকে পাঠিয়ে দিয়েছে দেখার জন্য কিন্তু এখন তো আর তা সম্ভব নয়। এতেই আরো ভয়, চিন্তা দুটোই বেড়ে গেছে। আজ সকালে আহসান দোকানে যাওয়ার সময় কিছু একটা বলতে ছেয়েছিল শরতকে নিয়ে পরে আবার থেমে গিয়ে বলল, ভাবী বাড়ি এলে মনে করাবে একটা আলোচনা করার আছে তোমাদের সাথে। শরতকে আমি কখনো শুধু ভাতিজা বলেই ভাবিনি নিজের বড় সন্তান তাকেই মনে করি তাই একটা সিদ্ধান্তও নিয়েছি তার জন্য।”
শিফাও ছেলেকে নিয়ে চিন্তিত বলে খুব একটা কৌতূহল নিয়ে আর জেরা করেনি।
দোকানের শাটার টেনে অর্ধেকটা নামিয়ে রেখেছে শরত৷ কাকার দোকানের শাটারটা সে নিজেই নামিয়ে দিয়ে এসেছে বৃষ্টি দেখে। সবে মাত্র শরীরটা ভালো হয়েছে কাকার তাই সে সাবধান থাকতে বলে দোকান থেকে বের হতে দেয়নি শাটার লাগাতে। যদি বৃষ্টির ছাট লেগে জ্বরজারি হয়! আহসানের তখন মনে হয়েছিল শরতকে একবার সরাসরি প্রশ্ন করবে আলতার ব্যাপারটা নিয়ে। ছেলে মেয়ে বড় হয়েছে তাদের মাঝে গোপন কিছু থাকলেও সেখানে তাদের করার কিছু নেই তবে তা প্রকাশ্যে ঝড় তোলার মত হলে নিজেদের সচেতনতার সাথে সেই ব্যাপারগুলো সামলে নেওয়াই বুদ্ধিমানের মত কাজ হবে। ভাবী গেছে মেয়ের বাড়ি দু দিনের জন্য । তিনি ফিরলেই কথা বলে একটা ব্যবস্থা নিতে হবে। আলতারও খুব শিগগির ফাইনাল পরীক্ষা তারপর তো বাড়ি চলে আসবে অনেক দিনের জন্য হয়ত!
শরত গিয়ে বসে আছে নিজের আসনে। আধ খোলা শাটার দিয়ে সে বৃষ্টি দেখছে আর অন্যমনস্ক হয়ে ভাবছে সোহার কথা। সেদিন এয়ারপোর্ট থেকে ফেরার সময় না চাইতেও সোহাকে বলতে হলো চলো একসাথেই বের হই। সিএনজি ডেকে দুজনেই উঠে বসেছিল পাশাপাশি। ভদ্রতার খাতিরেই শরত জিজ্ঞেস করেছিলো, “কেমন আছো, নাশতা করেছো?”
সোহা জবাবে বলেছিলো সে ঠিক আছে৷ নাশতার কথাটা কিছু বলেনি। শরত ভাবলো বলবে চলো তবে কোথাও নেমে কিছু খেয়ে নাও কিন্তু তার আর সে সুযোগ হয়নি। বড় অকস্মাৎ, পাশ থেকে জড়িয়ে ধরেছিলো সোহা শরতকে। ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে শরত তাকে এড়ানোর চেষ্টা করতেই টের পেল সে কান্না করছে ফুপিয়ে। সে বুঝতে পারছিলো তার মত সিএনজি ওয়ালাও প্রথমে ভড়কেছে এবং পরে লোকটা উপভোগ করে মিটমিটিয়ে হাসছে আয়নায় তাকিয়ে। এমতাবস্থায় অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে শরত। তার ধারণায় নেই এমন মুহূর্তে ঠিক কোন কাজটা করা উচিত। তবে এমন সিচুয়েশনে বেশিক্ষণ থাকাটাও অশোভন। কয়েক সেকেন্ডে আকাশপাতাল ভেবে সে সোহার মাথায় হাত রাখল। আলতো বুলিয়ে সে ডাকলো, “সোহা থামো, স্বাভাবিক হও প্লিজ। থামো”
আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে শরত সোহাকে শান্ত হবার সময় দেয়। হঠাৎ সোহা আবার সোজা হয়ে বসে যেমনটা অকস্মাৎ জড়িয়ে ধরেছিলো। চোখের পানি মুছতে মুছতে স্যরি বলল শরত কে। শরত হঠাৎ কেমন যেন গম্ভীর হয়ে যায় এবং সিএনজি ওয়ালাকে বলে সামনে কোন রেস্টুরেন্ট বা ক্যাফে দেখলে দাঁড়াতে। কিছুদূর যেতেই একটা ক্যাফে কাম রেস্ট্রুরেন্টের সামনে সি এন জি দাঁড় করায়। ভাড়া মিটিয়ে সোহাকে নামতে বলে ক্যাফের দিকে হাঁটতে থাকে শরত । এতো কিছুর মধ্যেও শরত সোহাকে নিয়ে ক্যাফেত বসার জন্য কোন অনুমতি নেবার প্রয়োজন মনে করেনি। যেন সে ভাবছে আজই তার ভেতরের ক্ষতের কথা জানানো উচিত। হৃদয় ভাঙার যে ক্ষত এবং যন্ত্রণা শরত অনুভব করে সে চায়না তার মত সোহাও সেই একই অনুভুতিতে দংশিত হতে থাকুক । এসব ভাবতে ভাবতেই তারা এক কোণের একটা ডাবল চেয়ার টেবিলে বসে পড়ে। শরত ওয়েটার কে ডেকে দুটো কফির অর্ডার দেয়ার আগে পর্যন্তও কোন কথা বলে না সোহা। ওয়েটার অর্ডার নিয়ে চলে যেতেই শরত বলতে শুরু করে তার নিজের প্রতারিত হবার কথা। অলির সাথে জুড়ে থাকা তার অতীতটাকে পরতে পরতে খুলে যেন চোখের সামনে তুলে ধরেছে। সোহা সব শুনে কিছু মুহূর্ত নির্বাক রইলো পরমুহূর্তেই সে বলতে লাগল অতীতের কোন কিছু নিয়ে তার মাথা ঘামানোর নেই। সে বর্তমানটাতে বাঁচতে চায় শরতের সাথে। দীর্ঘ সময়ের কথোপকথনে শরত নাকাল হলো সোহার সামনে। তার দেওয়া যুক্তি ছিল শরত কখনোই শহরে জীবনে পা বাড়াবে না আর সোহার পক্ষেও সম্ভব নয় গ্রাম্য জীবনে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া। মানুষ পরিকল্পনা যত সহজে করতে পারে জীবনটাকে তত সহজে চালিয়ে নিতে পারে না। মুখে আওড়ানো বুলিকে বাস্তব রূপ দেওয়া সবার সাধ্যে নেই। শরতের এ কথার জবাবে অবশ্য সোহা বলেছিলো, “তবুও মানুষ চেষ্টা চালায়।”
” সম্পর্ক কোন সল্প মেয়েদি প্রজেক্ট নয় যেটা চেষ্টা করে দেখলাম না চললে স্থিগত করে অন্য পন্থা অবলম্বন করলাম।”
শরত এমন করেই বোঝাতে চেয়েছিলো সোহাকে কিন্তু সে মানেনি কোন যুক্তি বরং নিজেই বলে অন্য পন্থাও অবলম্বন করে মানুষ।
“তারমানে তুমি কি ভাবছো আমি জীবনটাকে তেমন পন্থায় চালিয়ে দেখবো তোমার কথা শুনে!”
শরতের এবারের কথাটা সম্পূর্ণ কটাক্ষ করে বলা তাতে বিন্দু পরিমাণ সন্দেহ ছিল না সোহার। সে আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ ক্যাফে থেকে বেরিয়ে গেল।বেয়ারা কফি নিয়ে এলে শরতও বিল মিটিয়ে বেরিয়ে গেল। টেবিলে পড়ে রইল গরম দু কাপ কফি দুজনের যুক্তি তর্কের নিরব সমর্থন হয়ে। শরতের অবচেতন মন বারংবার এই মুহুর্তগুলোকেই এখন স্মৃতিচারণ করে চলছে। এর মাঝে সোহা দু দিন কলও করেছে শরত রিসিভও করেছে। কেন করেছে তা নিজেও জানে না শুধু নিশ্চুপ ফোন কানে চেপে রেখেছে অথচ মেয়েটাও একটা রা করেনি যেন দুজনে মিলে পায়াতারা করেছে নিরবতাকে শাস্তি দেওয়ার।
ক্লাস জয়েন করার আরও তিন দিন বাকি শিশির, অনুর। তিনদিনেই শিশির নিজস্ব থাকার জায়গা আর আশপাশের কিছু জায়গা জুড়ে নিজেকে পরিচিত করে তুলেছে। তার গ্রাম থেকে ঢাকায় গিয়ে যতোটা সময় লেগেছিল এখানে যেন ততোটাও লাগেনি। তবে এই তিনদিনে একবারও দেখা হয়নি অনুর সাথে। সুযোগই হয়নি তারওপর অনু উঠেছে লন্ডনে তার রিলেটিভের এপার্টমেন্টে। লন্ডন থেকে প্রায় পঞ্চান্ন মাইলের দূরত্ব কেমব্রিজ এর। কিং ক্রস স্টেশন থেকে বিশ পাউন্ডস যাতায়াত খরচ তাও কিনা টিকিট সপ্তাহ খানেক আগেই কনফার্ম করাতে হয়। অবশ্য খরচ বাড়িয়ে সেটা আরেকটু দ্রুত ব্যবস্থা করা হয়ত সম্ভব কিন্তু অনুর ভাবনা তার রোজকার ক্লাস নিয়ে। নয়টা -পাঁচটা ক্লাস প্রায় ঘন্টাখানেক জার্নি এসবে তার বোধহয় পড়াশোনার আগ্রহটাই মরে যাবে। তিন দিনে মাত্র দু বার কথা হয়েছে তার শিশিরের সাথে আর দুবারই সে শিশিরকে বলেছে যে করেই হোক একটা থাকার জায়গা জোগাড় করতে। সে কেমব্রিজ এর আশেপাশেই থাকতে চায় আর তার তো ফান্ড ঝামেলা নেই বাবার পয়সা নিবে কয়েক মাস এরপর সে তার কাজিনকে বলে রেখেছে কিছু একটা করতে চায়। কিন্তু শিশিরের এখানে অবস্থান কচু পাতার পানির মত। একটু ভুল হলেই ক্ষতি অপূরণীয় হবে। সে মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এ দেশ থেকে তাকে সফলতা নিয়েই ফিরতে হবে। কিন্তু কি করে! মাত্র তিনদিনেই জীবন বিষাক্ত ঠেকছে তার কাছে। চোখের সামনে যার জন্ম বেড়ে ওঠা সেই ছোট্ট মেয়েটার ভাবনায় তার দিনরাত্রি তমসায় ঢেকে গেছে। সুদূরে দেহ নিয়ে পড়ে থাকা শিশিরের মন পড়ে আছে ওই ছোট্ট মেয়েটার দ্বারে। কি ভুল করেছিল সে ওইদিন! আসছি বলেও কেন এলো না আলতা তার কাছে। তার সকল আয়োজন দাহ্য করে কেন লুকিয়ে রইলো তার বিদায় বেলায়! কি ভুল, কোন ভুল আর কতোটা ভুল করেছিলো শিশির এ কয়টা দিনে তার হিসেব মিলিয়ে নিতে পারেনি। ফুপুআম্মার কাছ থেকে যা শুনেছে তাতে তো পরিষ্কার আলতা রিকশায় চড়েছিল শিশিরের কাছে যাবে বলে। তবে কেন সেই আসা শেষ পর্যন্ত অদেখা রইলো! কিছুতেই উত্তর মেলাতে পারেনা শিশির। সে সোহার সাথেও এ নিয়ে কথা বলেছে কয়েকবার এমনকি সোহাকে আলতার নাম্বার দিয়ে বলেছে একটু যোগাযোগ করে জানাও সে কেন এমন করলো? সোহা একবার বলেছে লাইনে পায়নি, একবার বলেছে আলতার ফোন বন্ধ আর আজ এই শেষ রাতেও শিশির কল করতেই সোহা বলল আলতার ফোন এখনও সুইচড অফ। শিশির সময় দেখলো বাংলাদেশে এখন প্রায় দুপুর হয়ে এসেছে। সে এবার নিজেই আলতার নাম্বারে ডায়াল করলো। ভেবেছিলো রাগ অভিমান চেপে বসে থাকবে। আলতাকে নিজে থেকে আর কলই করবে না অথচ মন মানলো না। সোহা বলল ফোন বন্ধ তবুও সে অস্থির মনটাকে সান্ত্বনা দিতেই আলতার নাম্বার ডায়াল করলো।
কি আশ্চর্য! আলতার ফোনে কল ঢুকছে। তবে সোহা যে বলল আলতার ফোন বন্ধ! কি হচ্ছে এসব? সে অধৈর্য্য হয়ে ফোন কানে রেখেছে। কল বেজে চলল একবার, দুইবার, তিনবার বারবার অথচ সেটা ওপাশ থেকে কেউ তুলল না।
প্রচণ্ড অস্থিরতায় হাত পা গরম হয়ে আসছে আলতার। গাল বেয়ে অঝোর স্রোত বয়ে চলছে তার। পুরো রুমটাতে এলোমেলো পা ফেলে পায়চারী করছে আর তাকাচ্ছে বিছানায় থাকা ফোনটার দিকে। সেখানে স্পষ্ট ভেসে আছে একটা নাম্বার যার ওপর সেই দেশের নাম যেখানটায় আছে শিশির ভাই৷ তার বুঝতে একটুও বাকি নেই কলটা কে করেছে কিন্তু অন্তরের দগদগে ক্ষত নিয়ে এই ফোন রিসিভ করা তার পক্ষে সম্ভব না। কিশোরী মেয়ের প্রথম আবেগে ধোঁকার প্রলেপ বড় কঠিন আর গাঢ় হয়। সেই প্রলেপ কি দিন কয়েকের দূরত্বে পাতলা হবে! আলতার বুকভাঙা কান্নায় ভেতরটা চুরমার হয়ে আসছে তবুও ঘৃণার আস্তরণ ভেদ করে ফোনটা রিসিভ করার শক্তি পাচ্ছে না সে। অথচ মনটা তো সারাক্ষণ এই দোয়াই করল যেন শিশির ভাই একটাবার কল দেয়। কল দিয়েই বলে, তোর সাহস তো কম না আমি দেশ ছেড়েছি অথচ তুই আমায় বিদায় দিতে আসিসনি। তোর কলিজা ঠিক কতখানি বড় হয়েছে এবার আমি তাই দেখব তুই অপেক্ষা কর৷ কিন্তু না এখন এই কল পেয়ে আর হাত তুলে ফোনটা ধরার ক্ষমতা আর শক্তি তার মন একদমই পাচ্ছে না। কান্নায় চোখ, নাকের ডগা রক্তজবার মত রক্তিম হয়ে আছে। ফোনের দিকে তাকিয়ে এবার আর নিজেকে সামলাতে না পেরে ফোনটা সে তুলেই নিলো।
চলবে
#শিশিরে_ভেজা_আলতা
(২য় খন্ড)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
৩১.
আসন্ন সন্ধ্যার অস্তমিত অতি নরম আলোটা ফুটপাত ধরে আলতাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। পশ্চিমের রঙ তখন কমলাভ হয়ে আঁধারে ডুবার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। সেই সাথে মনটাও ব্যস্ত তাকে কাঠ কয়লার মত জ্বালিয়ে দিতে। আজ কোচিংয়ের জন্য বেরিয়েও সে যেতে পারেনি সেখানে। পা চলছিলো না, মন বলছিল বইয়ের পাতায় চোখ রাখলেও মস্তিষ্ক কিছুই আহরণ করতে পারবে না সেই বইয়ের পাঠ থেকে। তাই সেখানে নিজের উপস্থিতি জানিয়ে সময়টাকে খুইয়ে দেওয়ার মানে হয় না। ফোনে অনেক টাকার ব্যালেন্স নেই তবে ইন্টারনেট প্যাকেজ আছে। হঠাৎ মাথায় এলো যে নম্বরটা থেকে কল এসেছিল সেটা যদি শিশির ভাইয়ের নিজস্ব নম্বরই হয়! পথ চলতে চলতেই আলতা ব্যাগ থেকে ফোন বের করল। দ্রুত সেই নম্বরটাকে সেভ করে প্রথমে ইমো পরে হোয়াটসঅ্যাপে চেক করল। ইমো হোয়াটসঅ্যাপ দুটোতেই একাউন্ট শো হলো কিন্তু আফসোস একটাতেও প্রোপিকে মানুষের ছবি নেই। একটা প্রোপিকে বিশাল বাস্কেট বল গ্রাউন্ড এর ছবি অন্যটাতে খোলা ময়দানে ঘোড়ার রেস। হতাশ হলো আলতা দুটোতে পরিচয় পাওয়ার মত কিছুই না পেয়ে কিন্তু মন সাহস হারালো না। সাহস হারালে তো তার চলবে না৷ শিশির ভাইয়ের সাথে একটাবার কথা না হলেই নয় এখন আর। সেদিন যা দেখেছিল অন্তত সেটার কৈফিয়ত নিতেই তাকে কথা বলতেই হবে। এত সহজেই তাকে ভুলে যেতে দেবে না সে। কতগুলো বছরের অপ্রকাশ্য ভালোবাসা এতোটাও ঠুনকো নয়। শিশির ভাই সেই অনুভূতির উদয় ক্ষণে তার জীবনটাকে নিজের মুঠোয় পুরে নিয়েছিল আর আজ শহুরে জীবনে এসেই তার অনুভূতিকে অপমান করবে! নিজেকে অন্য কারো হাতে তুলে দেবে আর আলতা সেটা চুপচাপ কেন মেনে নেবে! সে তো জোর করেনি তাকে মনের অন্দরে টেনে নিয়ে আবার তা অন্যের দখলে দিতে তবে এটাতো প্রতারণাই হলো তার সাথে। আজ কতগুলো বছর! সেই যে আলতা একটুখানি মেয়ে, কৈশোরের প্রথম আলোতেই তো শিশির ভাইয়ের আলতা হয়ে সে ভিজে উঠেছিল শিশিরে তবে এখন কেন অনু আসবে সেখানটায়! মনের সাথে যুদ্ধে অপারিজত হয়ে আলতা সেই নম্বরটাতে ভয়ে ভয়ে ‘হাই’ লিখে মেসেজ সেন্ড করলো। যদি শিশির ভাই হয় তবে নিশ্চয়ই এই মেসেজ সিন করতেই তাকে কল দিবে। হাঁটতে হাঁটতে তাকাচ্ছে ফোনের স্ক্রীণে। মেসেজ ডেলিভারি হয়ে গেছে কিন্তু সিন হচ্ছে না। পথ চলতে চলতে কখন যে হোস্টেলে এসে পৌঁছেছে খেয়াল নেই সেদিকে৷ এখন পর্যন্ত মেসেজটি সিন হয়নি দেখে মন খারাপটা এবার গাঢ় হয়ে উঠলো আলতার। চারপাশ থেকে মাগরিবের আজান ভেসে আসছে। হোস্টেলে ফিরে নামাজ আদায় করে বই নিয়ে বসল বিছানায়। খাতা-কলম, বই, নোটস সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে অথচ পড়ায় একটুও মন নেই তার। আম্মা ফোন করেছে বিকেলে একবার সে কথা বলেনি কেনো জানি তার আজ সারাটা বিকেল মনে হয়েছে কোন একভাবে শিশির ভাইয়ের সাথে কথা হবে, হয়েই যাবে আজ কিন্তু না সন্ধ্যেটাও পেরিয়ে যাচ্ছে।
ঘরের সামনে একটুখানি লনের মত জায়গায় আজ গ্রিল পার্টি করছে সোহা। তার ফুপু আর ফুপুর পুরো পরিবার এসেছে সিলেট থেকে সেই সাথে এসেছে বিলেত ফেরত ফুপাতো ভাই জাহাঙ্গীর। জাহাঙ্গীর দেশে থেকেই ডাক্তারি পড়াশোনা শুরু করলেও পরে সুযোগ পেয়ে লন্ডনে এবং পরে সিঙ্গাপুরেও ছিল। মাত্র কিছুদিন আগেই সে দেশে ফিরেছে উদ্দেশ্য বিয়ে করে বউ নিয়ে যাওয়া। সোহা তার ফুপি এলে এমনিতেই খুব খুশি হয়ে যায় আর এবার একসাথে সব কাজিনরাও এসেছে মানে আনন্দ দ্বিগুণ। সোহা আর জাহিন দুজনে মিলেই আয়োজনটা বেশ জমজমাট করে দিয়েছে আর একপাশে তা বসে বসে উপভোগ করছে জাহাঙ্গীর। এখানে আসার আগে অবধি সে তার মায়ের ওপর নাখোশ ছিল সোহাকে বিয়ের কথা শুনে। একেতো আপন মামাতো বোন তারওপর সোহা দেখতে কেমন বাচ্চা বাচ্চা অন্তত তার পাশে বারেই ছোট লাগবে দেখতে। তার অবশ্য এমন ধারণা হয়েছিল মাস কয়েক আগে সোহার ক্যাম্পাসে বন্ধুদের সাথে তোলা কিছু ছবি দেখে। ছবিতে সোহার ফ্রেন্ড অনু, শিশির, অপু রাহা আরও অনেককে দেখেছে আর সোহা নিজেই কথা বলতে বলতে ফ্রেন্ডদের পরিচয় দিয়েছিল। কিন্তু আজ এখানে এসে তার ধারণা বদলে গেছে। তার দেখে যাওয়া সোহা এখন বেশ বড় হয়ে গেছে। ছবিতে যাকে দেখতে আঠারোর মনে হয় বাস্তবে সে প্রায় পঁচিশ ছুঁই ছুঁই তা চেহারাতে স্পষ্ট। জাহাঙ্গীর বসা থেকে উঠে ঘরে চলে গেল। মাকে দেখতে পেল মামীর সাথে বসে কোন পিঠা তৈরির আয়োজন করছে। চোখের চশমাটা ঠেলে ঠিক করে সে ডাকলো একটু দূর থেকেই, “আম্মু একটু শুনবে।”
জাহাঙ্গীরের মা উঠে এসে দাঁড়ালেন ছেলের পাশে। প্রশ্নবোধক চোখে তাকাতেই সে কিছুটা ইতস্তত করে বলে ফেলল, সোহাকে আমার পছন্দ হয়েছে তুমি মামীর সাথে কথা আগাতে পারে তবে,,, অবশ্যই মামীকে সোহার মতামত জানতে বলবে।
জাহাঙ্গীরের কথামতই তার মা নিজের ভাই আর ভাইয়ের বউয়ের সাথে কথা বলল সে রাতেই। আর এও বলে রাখলেন সোহার মতামত জেনে তবেই যেন কথা আগায়। সোহার অমত থাকলে জাহাঙ্গীর আগাবে না এমনকি সোহার ফুপিও না।
শরতের মা মেয়ের বাড়ি থেকে আজ বাড়ি ফিরেছেন। বরাবরের এসেই তাকে রান্নাঘরে যেতে হয়নি আজও শিফা রান্না করে রেখেছে। এদিকে জহির আবার খাসির মাংস কিনে এনেছিলো বলে নকশি বড় এক বাটি ভরে খাসির মাংসের তরকারিও পাঠিয়েছে। দুপুরে শরত আহসানুল্লাহ বাড়ি ফিরলে চারজনে একসাথে বসে খাবার খেতে বসেছে। আহসানুল্লাহ প্লেটে এক টুকরো মাংস নিয়ে মুখে পুরে একপলক দেখে নিলো স্ত্রী, ভাবী আর ভাতিজাকে। তারপর কথা তুলল, আমার নিজের কোন বোন ছিলো না। ভাবী যেদিন এ বাড়ি এলো সেদিন থেকে বোনের অভাব ঘুচে গেল আমার ভাবী তো বড় বোনের মত ছিলেন সর্বদা কিন্তু নকশি যখন এ বাড়ির একজন হলো তখন থেকে ছোট বোনের জায়গাটাও পূরণ হয়ে গেল। আমি ভাবীর মত নকশিকেও বোন হিসেবে যত্ন করেছি, স্নেহ করেছি আর তাই তাই ভাবছি..”
শরতের পকেটের ফোন বেজে উঠলে আহসানুল্লাহ কথার মাঝে থেমে গেল। শরত ফোন বের করে নাম্বার দেখে বুঝলো দোকানের মাল এসে গেছে। তার খাওয়াও তখন শেষ প্রায়। শেষ দু লোকমা দ্রুত মুখে পুরে সে বলল এখনই দোকানে যেতে হবে। আহসানুল্লাহ বলতে চাইলেন, “কথাটা আমার তোকে উদ্দেশ্য করেই বলার ছিল তুই একটু পরে যা।” কিন্তু তেমনটা আর বলা হলো না। শরত চলে গেল কোন দিকে না তাকিয়ে। জয়তুন অবশ্য আহসানুল্লাহকে বললেন, “তুই আরও কি কইবি জানি!”
“হু, বলতেছিলাম শরতের বিয়ের জন্য কি আরও পাত্রী দেখবেন?”
‘আরও পাত্রী দেখবেন?’ প্রশ্নটা কেমন একটু শোনালো জয়তুন আর শিফার কানে। তারা দুজনেই বুঝে নিলেন আহসানুল্লাহ কোথায় মেয়েটেয়ে দেখেছে হয়ত তাই আগে জয়তুনের কাছে জানতে চাইছে এ ব্যাপারে। জয়তুন ভাত মুখে দিতে গিয়েও আবার থামলো। ভাইতূল্য দেবরের মুখের দিকে বিষ্ময়ে তাকিয়ে রইলেন কয়েক সেকেন্ড । তারপরই তিনি বলে উঠলেন, তুই কি মাইয়া দেখছোস কোন জায়গায়? পছন্দ হইছে!” কথাটা বলতে বলতে আবার শিফার দিকেও তাকালেন জয়তুন। শিফা জায়ের মনোভাব বুঝতে পেরে বলল, “আমি কিছু জানি না। আমারে তো এমন কিছুই বলে নাই।”
“আমি কাউকেই কিছু বলি নাই। এজন্য একসাথে আপনাদের বলতে চাইছি কিন্তু শরত তো চলে গেল।”
“তুই আগে আমাগো বল শরতে তোর কোন কথা ফালাইবো না।”
জয়তুন আশ্বাস দিয়ে শুনতে চাইলেন। আহসানুল্লাহও আর সময় না নিয়ে বলে দিলেন, “আলতার সাথে শরতের বিয়ে হলে কেমন হয় ভাবী? আলতা আমাদের কাছে বড় হয়েছে, আমাদেরই মেয়ে তাকে যাচাই বাছাইয়ের দরকার পড়বে না আর সে দেখতেও মাশাআল্লাহ!”
আহসানুল্লাহ কথা শেষ করার আগেই হাত থেমে তরকারির বাটিসহ চামচ পড়ে গেল শিফার। আহসান, জয়তুন দুজনেই আকস্মিক ঘটনায় ভড়কে তাকান শিফার দিকে। সেও অপ্রস্তুত হয়ে জবাব দিলো, “তরকারির ঝোলে হাত পিছলে পড়ে গেছে।”
“ওহ, থাক খাওয়া শেষ করো আগে পরে এগুলো পরিষ্কার করো৷” আহসান স্ত্রীর উদ্দেশ্যে কথাটা বলেই আবার ভাবীকে বললেন, “আপনি কি বলেন ভাবী?”
” এত সুন্দর প্রস্তাব তো আর হইতেই পারে না রে তুই কি কস শিফা!”
শিফা থতমত খেয়ে আছে শরতের জন্য আলতার কথা শুনে। এখনই কি কিছু বলে দেওয়া উচিত নাকি আগে শিশিরের বাবাকে বলবে সে বুঝতে পারছে না? এখন সে হুট করে শিশিরের নাম তুললে ভাবী কি মনে করবে না আমি হিংসা করছি! শিফা বলতে পারলো না কিছু সে শুধুই বলল, “ভালো তো!”
জয়তুন ভীষণ খুশি হলেন আহসানের দেওয়া প্রস্তাবে। আহসানকে জিজ্ঞেস করলেন নকশিকে কিছু বলেছে কিনা! আহসান লুকিয়ে গেলেন বাজারে বন্ধু রফিকের মুখে কি শুনেছিলেন শুধু বললেন জহিরকে আমি একটু ইঙ্গিত দিয়েছিলাম এবার আপনার আর শরতের কথা শুনে তবেই নকশিকে জানাব। জয়তুন বলে দিলেন আহসান যেন নিজেই কথা বলে শরতের সাথে। আর তেমনটাই হলো, রাতে দোকান থেকে ফেরার সময় শরতকে আলতার কথা বলা হলো। শরত প্রথম বাক্যেই জবাবে ‘না’ বলে দিল। তার এক কথা আলতা তার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট তারওপর ছোট থেকে বোনের মত আদর স্নেহে বড় করেছে। এখন এমন কিছু ভাবতেও তার অস্বস্তি হবে। শরতের জবাব শুনে আহসান প্রথমে একটু অবাকই হলো। রফিক যেমনটা বলেছে তেমন কিছু হলে তো শরত একবাক্যেই ‘না’ বলতো না নিশ্চয়ই৷ এখন তাকে রফিকের বলা কথাটাই শরতকে বলে দিলো।
লন্ডনের সেই নম্বরটিতে আলতা মেসেজ করেছে আজ দু দিন হলো। কোন রেসপন্স আসেনি বলে এবার সে অধৈর্য্য হয়ে নিজেই কল দিয়ে বসলো। প্রথম কল রিসিভ হলো না আলতা হতাশ হলো। চোখে তার জমে উঠলো শিশির কণার মত অশ্রুবিন্দু৷ কিন্তু মন যে মানে না তাই সে পুনরায় কল দিলো। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে ভেতরে ভেতরে তৃষ্ণা একটি মাত্র কণ্ঠ শোনার অপেক্ষায়৷ দ্বিতীয় বার কল বাজার প্রায় দু সেকেন্ডেই তা রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে ভেসে এলো একটা পুরুষ কণ্ঠ, “হ্যালো।”
অপরিচিত কণ্ঠস্বর! আলতা বুঝতে পারলো নম্বরটি কাঙ্ক্ষিত নম্বর নয় কিন্তু এখন তো থেমে গেলে চলবে না। ততক্ষণে ওপাশ থেকে আরও একবার ‘হ্যালো’ শব্দটি উচ্চারিত হলো ব্রিটিশ একসেন্টে। আলতা ইংরেজি ভাষায় একটানা কথা বলতে জানে না কিন্তু ওপাশের ব্যক্তিটি হয়তো ইংলিশ না বললে তার হেল্প করতে পারবে না। নিজের জানা শব্দগুচ্ছ মিলিয়েই সে বলল, “আই এম আয়শা ফ্রম বাংলাদেশ।”
“ব্যাংলাডেশ!” ওপশ থেকে ভাঙা উচ্চারণে দেশের নামটা উচ্চারণ করেই ব্যক্তিটি আবার বলল, “ওহ আই সি ইউ ওয়ান্ট টু টক সিসির!”
“সিসির! ইয়েস আই ওয়ান্ট টু টক শিশির প্লিজ ক্যান ইউ হেল্প মি?”
আলতা মনে মনে ওপরওয়ালার শুকরিয়া জানায়। এতটুকু তো হয়ে গেল লোকটা শিশির ভাইয়ের পরিচিত। কিন্তু এখনও যে অপেক্ষা কথা বলার সুযোগ হয় কিনা! ওপাশের ব্যক্তিটি মাত্র ত্রিশ সেকেন্ডের বিরতিতে বলে উঠলো, ওয়েট আ মিনিট হি ইজ কামিং।
“হ্যালো আলতা!” সত্যিই মিনিট খানেকের মাথায় ভেসে এলো ওই আজন্মকালের চেনা কণ্ঠটি এবং সেই সাথে ভিজে উঠলো আলতার কপোল। যেন প্রতীক্ষায় ছিল তারা শিশির ডাকবে আর তারা বর্ষণে ভিজে শীতল হবে।
আলতা হ্যালো’র জবাবে ডুকরে কেঁদে উঠলো। চেয়েও গলা দিয়ে অন্য কোন স্বর বের হলো না তার। আজ গুণে গুণে পুরো ছয়টি দিন পেরিয়ে গেছে তাদের বিচ্ছেদের। হ্যাঁ বিচ্ছেদই বটে! যে মানুষটার সাথে কথা না বলে একটি দিন কাটানো মুশকিল সেই মানুষটির সাথে আজ ছয় দিন পর কথা হচ্ছে। আলতার কান্নার আওয়াজ শিশিরের কানে পৌঁছুতেই সে ধমকে উঠলো, “এ্যাই বেয়াদব এখন কাঁদছিস কেন? আমাকে কষ্ট দেওয়ার সময় কান্না পায়নি? চুপ একদম কাঁদবি না নইলে আমি এসে তোর গলা টিপে ধরব।”
শিশিরের ধমক আর শাসানিতে যেন আরও বেড়ে গেল কান্নাটা। কিন্তু ওদিকে তারও যে হাতে সময় কম। সে অস্থির হয়ে আলতাকে থামানোর চেষ্টা করলো, ” কান্না থামা তুই না আমার লক্ষিসোনা প্লিজ কথা শোন এই ফোনটা আমার না। আমি আজই নিজস্ব সিম পেয়েছি তোকে আর ঘন্টা তিনেকের মধ্যে কল দিব। প্লিজ কাঁদিস না আমার কিন্তু কষ্ট হচ্ছে। আমি ফোন রাখছি এখন কেমন তুই কাঁদলে তো আমি থাকতে পারবো না।”
আলতা কান্না থামানোর চেষ্টায় দাঁতে চেপে ঠোঁট কামড়ে ধরলো। কিন্তু কান্না তো থামার নয় তা বুঝতে পেরে শিশিরও উদ্বাস্তু হয়ে গেল। এদিকে তার হাতেও সময় নেই কলটা কাটতেই হবে তাই সে একটা বাক্য উচ্চারণ করেই ফোন কাটবে বলে সিন্ধান্ত নিলো, “ভালোবাসি তো তোকে আর কত কাঁদবি?”
চলবে
(, বানানে অনেক ভুল থাকতে পারে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো।)