#শিশিরে_ভেজা_আলতা
(২য় খন্ড)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
শেষ পর্ব (প্রথম অংশ)
শরতের শেষ ; তীব্র গরম কিংবা স্যাতস্যাতে ভেজা রাত নয় তবুও শেষ ঘুমটা ছাড়া ছাড়া হচ্ছে আলতার। খুব সম্ভবত সারা সন্ধ্যে শিশিরের জন্য যে অস্থিরতা ছিল সেটাই মস্তিষ্কে ঘোট পাকাচ্ছে। ভেতরে ভেতরে চাপা অভিমানও ছিল একটা ঠিক সেকারণেই ঘুমের এই বেহাল দশা। আবার হতে পারে এ ঘরে প্রথমবার ঘুমাচ্ছে তাই এমন হচ্ছে। বিছানায় কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে সে উঠে বসল। কিছুতেই আর ঘুম হবে না বুঝতে পেরে ফোন হাতে নিলো। ফোন বন্ধ পড়ে আছে দেখতেই মনে পড়ল ঘন্টা দুই আগেও সে ফোন টিপেছে আর অপেক্ষা করেছে শিশিরের ফোনকলের। চার্জ শেষ হতেই ফোনটা রেখে চোখ বুঁজেছিল। এখন ফোন চার্জে লাগিয়ে আর চালু করা হলো না। রাতটা এখনো শেষ হয়নি আর নিদ্রাহীনতায় কি করবে ভেবে না পেয়ে আলতা বাতি জ্বালালো। এ ঘরে চেয়ার টেবিল নেই তবে একটা ছোট্ট বুকশেলফ আছে৷ তাতে ক্লাস এইট আর সিক্সের বই আর কিছু খাতা কলমও আছে। ভাই দুটোরই এগুলো আন্দাজ করা যায়। আলতা প্লাস্টিকের কলমদানিটা থেকে একটা কলম আর একটা খাতা নিয়ে বসলো। চোখ বুঁজে কিয়ৎক্ষণ ভাবনায় ডুবলো। মনে করলো সেই দিনটার কথা, যেদিন প্রথম দেখেছিল শিশির ভাইয়ের চোখে তার জন্য জমে ওঠা মুগ্ধতা। সেখানে মিশে ছিলো সদ্য তারুণ্যে পা দেওয়া এক ছেলের গোপন অনুভূতির নীলাভ আকাশ। আলতা নিরবে লিখে গেল ছোট ছোট মুহূর্তগুলো যে ক্ষণগুলোতে তার মনটা চমকে উঠতো, আবেগে ডুবতো। মনে পড়তে লাগল আহসান মঞ্জিলে সেই স্নিগ্ধ মুহূর্ত, মনে পড়ছে কাশফুলের মাঝে বসে তার পায়ে ছুঁয়ে দেয়া আলতার তুলি। লিখতে লিখতে হাতের কলম থেমে গেল আচমকা কড়া নাড়ার শব্দে। প্রথম শব্দে ঠাওর হলো না শব্দের উৎস। দ্বিতীয় বার কড়ার সাথে কানে এলো নিজের নামটা। আঁতকে উঠল আলতা ভয়ে গা শিউরে উঠছে।
“আলতা ঘুমিয়ে আছিস। আলতা আমি শুনতে পাচ্ছিস?”
কান সজাগ রেখে শুনলো আলতা। ফিসফিসে গলায় তাকেই ডাকছে কেউ। আওয়াজটা আসছে জানালার দিক থেকে। ভয় ভয় মনে সে বিছানা ছেড়ে কান পাতলো জানালার পাল্লায়। সেই মুহূর্তে আবারও ডাক শোনা গেল, আলতা জানালা খোল আমি শিশির।
আর এক সেকেন্ডও বিলম্ব না করে আলতা জানালা খুলে দিল। বাইরে এখনো গাঢ় আঁধার রাত কয়টা বাজে এখন! আলতা দেখলো না সময় সে সামনে তাকালো মানুষটাকে দেখতে। লাভ হলো না আঁধার রাতের পর্দা ভেদ করে শ্যামবর্ণ মুখটা স্পষ্ট ধরা দিল না চোখে। বা পাশের জানালার পাল্লাটা সরিয়ে দিল আলতা। অকস্মাৎ, ভেসে এলো বাতির আলো ওপাশের মানুষটার মুখে। আহ্ কত তৃষ্ণা, কত পিপাসার জলাঞ্জলি হলো সেই আলোকিত মুখটা দেখে! চোখের কোটরে চিকচিকে জল আর পেলব ঠোঁট জোড়ায় তৃপ্তির হাসি। কত অপেক্ষার অবসান ঘটে গেল এ ক্ষণে দুজন মানুষ ছাড়া এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আর কেউ জানলো না। জানালার শিকে হাত গলিয়ে শিশির গাল ছুঁলো আলতার। শিরশিরে এক হাওয়া এক লহমায় কাঁপিয়ে দিয়ে গেল আলতাকে এই স্পর্শ। দৈবাৎ এক সুখও বুঝি ছুঁয়ে গেল হৃদয় আঙিনায়।
“কেমন আছিস?”
এ প্রশ্নের জবাব নেই। উত্তরে শুধু অশ্রুর দেখা মিলল। শিশির এবার দু হাতে আলতার দু গাল ধরে আরেকটু কাছাকাছি হলো। ফিসফাস স্বরে বলল, আমি কি তোর কান্না দেখতে এলাম এত রাতে? বিশ্বাস কর একটুও সুযোগ মেলেনি কল করার মত। সারাটা দিন অস্থির হয়ে ছিলাম কিন্তু আম্মাও তোর মত কান্নাকাটি করল। বুঝি না আমি তো ফিরে এলাম এখনো তোদের কান্না কেন পায়! আর তারপরই খা খা করে সবাই আরো অস্থির করে দিল। পুরনো সিমটা পর্যন্ত ফোনে লাগানোর সুযোগ পাইনি। ভাবীকে বললাম কথা বলবো সেও ভাইয়ের সামনে ক্ষেপিয়ে দিলো। থাম না সোনা এত কাঁদলে আমি তোর সাথে কথা বলবো কি করে?”
পাগল, উচ্ছল কণ্ঠে শিশির একনাগাড়ে কথা বলতে বলতে শেষে তার স্বর ভারী হয়ে উঠল। কাঁদতে পারে না অথচ তারও যেন কান্না জমলো কণ্ঠদেশে। মাত্র তো একটা দিন আর রাত পেরিয়েছে যোগাযোগবিহীন তাতেই এ দশা দুজনার! ভাবতেই শিশির অবাক হয়ে যায় অথচ তাদের আর তিনদিন পরই বিয়ে। দিন পনেরো পর আবারও দুজন দু প্রান্তে থাকবে মাস ছয়েকের জন্য তখন কেমন লাগবে?
আলতার এবার কান্না চাপার বৃথা চেষ্টা করে বলল, “ভাবীর সাথে আমি রাগ করব”
“ওই কেন?”
“আমি তোমার কথা জানতে চাইলাম সে তা না বলে হেঁয়ালি করেছে আমার সাথে।”
“ধুর পাগলী, ভাবী তো মজা করেছে৷ আচ্ছা শোন কাল দেখা করবি লুকিয়ে?”
আলতা অবাক হলো৷ লুকিয়ে কেন দেখা করতে হবে তারা কি চুরি করেছে নাকি! শিশির বুঝলো আলতা কি ভাবছে তাই আবার বলল, “বিয়ের আগের শেষ প্রেম করবি না?”
“সেটা আবার কি?”
“ওইইই আর কত দেরি করবি। ভোর হয়ে যাচ্ছে কেউ দেখলে কেলেঙ্কারি হবে বুঝতে পারছিস?”
হঠাৎই শরতের গলা পাওয়া গেল ফিসফিসিয়ে বলতে গিয়েও জোরে বলে ফেলেছে সে। আলতা এবার সকল আবেগি কথা ভুলে বিষ্ময়ে তাকালো শিশিরের দিকে। তার চোখে মুখে প্রশ্ন স্পষ্ট। শিশির বুঝতে পেরে বলল, “শরত ভাই এসেছে আমার সাথে। তোর ঘর আমি চিনি না আর ভাইও ভাবছিলো আমি এখানে এসে চোর বলে ধোলাই না খেয়ে যাই তাই!” মাথা চুলকে বোকা বোকা মুখ করে বলল শিশির।শরত ওপাশ থেকে আবারও তাড়া দিতেই আলতা বলল, “যাও তুমি৷ ছি ছি কি লজ্জা শরত ভাইকে নিয়ে আসছে আমার সাথে দেখা করতে। নাক, কান আমার সব কাটা গেল।” বকতে বকতে আলতা জানালার পাল্লা লাগিয়ে দিলো শিশিরের মুখের ওপর। শিশির বোকা বনে গেল, মনে মনে আওড়ালো, বাহ্ যার জন্য করলাম চুরি সেই বলে চোর।
“চলে যাচ্ছি আমি বিকেলে না হয় সকালে দেখা করবি বলে গেলাম।”
জানালার কাছে কথাটা বলে চলে গেল শিশির। শরত সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আলতাদের বাড়ির রাস্তায়। দশ কদম দূরের এই রাস্তা থেকে আরেকটু সামনে গেলেই গ্রামের প্রধান রাস্তা। এখনো এ রাস্তা পাকা বলে সাইকেল আসতেও বেশি একটা সমস্যা হয়নি৷ রাত আড়াইটায় বেরিয়েছিল শিশির। শরতের ঘুম ভেঙেছিল রূপসার নড়াচড়ায় তখনি কানে এলো গেইটের শিকল খুলছে কেউ। মনে সন্দেহ ঢুকতেই সে টর্চ লাইট হাতে জানালা দিয়ে উঁকি দেয়৷ বুঝতে পারে শিশির বাইরে যাচ্ছে কিন্তু এত রাতে কোথায় যায় তাও কিনা সাইকেল নিয়েছে। মনে সন্দেহ এবার অন্যকিছু হতেই শরত ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। কিন্তু ততক্ষণে শিশির সাইকেলে চেপে মাটির রাস্তায় রওনা দিয়েছে। শরতের মনে খটকা লাগল ভাই তার প্রেমিকার বাড়ির দিকে যাচ্ছে নাতো! ঘড়ির কাটা তখন অনেক রাত বলছে। ছেলেটার কি মাথা বিগড়ালো! এটা না বিদেশ, না শহর এত রাতে ও আলতার বাড়ি গিয়ে ঢিল ছুঁড়লে নির্ঘাত গ্রামবাসীর হাতে মার খাবে তারওপর আলতার বদনাম তো উপরি হিসেবে থাকবেই৷ এদিকে শিশির ফোনে তার সিম ঢুকিয়েছে কিনা কে জানে! আর কিছু না ভেবে শরতও তার পুরনো সাইকেল বের করলো৷ ভাগ্যিস ভাঙা ঘরটাতে তালা লাগানো থাকে না দ্রুত সাইকেল নিয়ে গেইটে বাইরে থেকে তালা মেরে সেও পিছু নিলো৷ ততক্ষণে শিশির চলে গেছে অনেক দূর। শরত যত দ্রুত সম্ভব চালাতে লাগল৷ গ্রামের বাড়িঘর ছেড়ে ক্ষেতের পাশের রাস্তায় উঠতেই চোখে পড়ল সামনেই শিশির নিচে বসে সাইকেলে কিছু করছে৷ শরত আরও এগিয়ে যেতেই বুঝলো সাইকেলের চেইন পড়ে গেছে শিশিরের।
“তোর মাথা খারাপ হইছে শিশির?”
“ভাই তুমি!” ভরকে গেছে শিশির ভাইকে দেখে। শরত সেদিকে পাত্তা না দিয়ে আবার ধমক লাগালো, “কোথায় যাচ্ছিলি আলতার কাছে?”
“ইয়ে মানে… ”
“মাথায় কি ঘিলু নাই নাকি বিদেশে থেকে দেশের অবস্থা ভুলে গেছিস? এতরাতে তুই আলতার বাড়ি গেলে লোকো টের পাবে না?”
“ভাই যাব আর আসব। ইয়ে,, ভাই তোমার ফোনটা একটু দিবা!”
“আমি ফোন নিয়ে আসিনি।” কথাটা বলেই শরত ভাবলো শিশিরকে আটকানো যাবে না। কোন না কোন ভাবেই সে আলতার কাছে যাবে আর এরপর কোন এক কেলেঙ্কারি ঘটাবে৷ লম্বা করে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে সে নিজেই সাথে যাবে বলে ঠিক করলো। আলতাদের বাড়িটাও যে শিশির ঠিকঠাক চেনে না সে জানে। কিন্তু গত সপ্তাহেও শরত আর আহসান সে বাড়ি গিয়েছিলো বলে তার চেনা সবটাই। সাইকেলের চেইন ঠিক হতেই দু ভাই মিলে চলে গেল আলতাদের গ্রামে। শেষমেশ ঘরটা আন্দাজ করে শিশিরকে পাঠিয়ে শরত পাহারায় ছিল রাস্তায়। মনে মনে ভীষণ হেসেছিল এই ভেবে, সে বড় ভাই হয়ে ছোট ভাইয়ের ডেটে পাহারাদার হয়ে আছে। এমনও দিন আসার ছিল তার অভিজ্ঞতাতে!
শিশির দেশে আসার পর আলতা আর শিশিরের প্রথম সাক্ষাৎ সেই মধ্যরাতে৷ তারপর দিনে শিশিরের কথা রাখতে আলতা দেখা করলো সদরের বড় মার্কেটে। কেনাকাটার নামে দুজনে ঘুরলো এ দোকান, সে দোকান তারপরই শিশির অটো ভাড়া করে আলতাকে নিয়ে চলে গেল নদীর পাড়ে। সেখানে ছইওয়ালা নৌকা ভাড়া করে দুজনে বসলো ছইয়ের ভেতর। শিশির আসার সময় এনেছিল একটা তাতের শাড়ি আর আলতার কৌটা। প্যাকেট খুলে শাড়িটা আলতার হাতে দিয়ে শিশির বলেছিল, ” কোন এক ঝুম বৃষ্টির দিনে এই শাড়িটা পরে আসবি আমার কাছে। পা ভরে দিবি আলতা আর আমি সেদিন তোকে ছুঁয়ে আমাতে সিক্ত করব। আমাদের প্রেমের সমাপ্তি টানতেই আজ তোকে দেখা করতে বললাম৷ আজকের পর আমার জীবনে প্রেমিকা থাকবে না তোর জীবনেও থাকবে না কোন প্রেমিক। ঠিক দু দিন পর আমার জীবনে দ্বিতীয় নারী হিসেবে থাকবে শুধুই আমার স্ত্রী।”
পানপাতার মত গোল গোলাপি বর্ণের মুখটা আচমকাই লাজে লাল হয়ে উঠেছে আলতার। শিশির ভাইয়ের চোখে চোখ রাখার চেষ্টায় বৃথা হয়ে দু হাতে মুখ ঢেকে ফেলল আলতা। আকাশ জুড়ে পেঁজা তুলোর মত মেঘ ভাসতে ভাসতে নদীর মাঝ বরাবর এসে থেমে গেল৷ জড়ো হয়ে সবে এক শুভ্র মেঘের রাজ্য হয়ে। ছইয়ের ভেতর দুটি মানুষ দীর্ঘ দূরত্বের অবসান ঘটিয়ে খুব কাছে এলো৷ বাহুতে বাহু ঠেকিয়ে গুনতে লাগল শিরশিরানি অনুভূতির মুহূর্তগুলো। শিশির বেসামাল হয়ে উঠছিল প্রিয়সখীর নিকটত্বে। ভেতরের সত্তা আগুনের মত গরম হয়ে উঠছে তা টের পেতেই শিশির মাঝিকে ডেকে বলল নৌকা ভিড়াও পাড়ে। আলতার ঘোর কাটে শিশির ভাইয়ের কথায়। সে মুহূর্তে ছিটকে সরে দূরত্ব তৈরি করে দুজনের মাঝে। সল্প সময়ের সাক্ষাৎ যথেষ্ট দীর্ঘ হয়ে গেছে বুঝতে পেরে আলতাও তাড়া দিল ফিরতে হবে। এখনো বিয়ে হয়নি এখনই শিশির বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিলে আলতাদের গ্রামে কথা ছড়াবে৷ তাই শিশির বাজার থেকে অটো করে আলতাকে পাঠিয়ে দিল একাই। নিজেও বাড়ি ফিরে গেল যথা সময়ে। দিনের বাকিটা সময় আর কথা হয়নি দুজনের। আলতা ভেবেছিল রাতে হয়ত শিশির ভাই কল করবে কিন্তু না রাতেও কোন কল এলো না। সেও বোধহয় আকস্মিক দ্বিধায় পড়ল তাই আর নিজেও করেনি। সে রাতও কাটলো তার ছাড়া ছাড়া ঘুমে। সকাল হতেই কানে এলো আম্মার কণ্ঠ। ধড়ফড় করে বিছানা ছেড়ে ঘরের বাইরে পা দিয়ে খুশিতে কান্না করে দিল আলতা। আম্ম, জহির কাকা আর তার পাঁচ বছরের ভাই এসেছে৷ আওলাদ ঘরেই ছিল আজ সকাল সকাল বাড়ি সাজাতে লোক আসবে, বিয়ের জন্য মুরগি, একটা খাসি আরও কত বাজার হাট করবে তাই সে আর আজ খামারে যায়নি৷ নকশি এসেছে দেখতেই তার চোখেমুখে আনন্দের লুকানো এক ছাপ। আওলাদের স্ত্রী ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাঁকাচোখে দেখলো নকশিকে আর তার পাশে থাকা জহিরকে৷ বিড়বিড় করে উঠলো, “বেডি যেমুন সুন্দর সুরতের জামাইও পাইছে হেমুন এজন্যই উনি ফিরাইয়া আনতে চাওয়ার পরেও আহে নাই।” কথাটা বিড়বিড় করে বললেও কিছুটা কানে গিয়েছে আওলাদের। সে এদিকে পাত্তা না দিয়ে আলতাকে বলল, “তোর আম্মারে তোর লগের ঘরটা খুইলা দে আলতা।আর নাশতা পানিও দে আমি একটু বাজারে যাইতাছি।” আওলাদ যাওয়ার আগে স্ত্রীকে ভালো করে সতর্কবার্তা দিয়ে গেলেন কিছুটা শাসিয়েও গেলেন, “নকশি কিংবা তার স্বামীর সামনে যেন কোনরকমে বাজে আচরণ আর কথাবার্তা ভুল করেও না বলে। মাত্র দুটো দিন থাকবে তারা শুধু মাত্র মেয়ের বিয়ে বলে। কালই আবার মেয়ে বিদায়ের পর চলে যাবে৷ ভুল করেও যদি কিছু কানে আসে তবে সারাজীবনের জন্য সংসার হারাবে।”
চলবে
#শিশিরে_ভেজা_আলতা
(২য় খন্ড)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
শেষ পর্ব( শেষাংশ)
শিশির ভেজা ভোর
অল্প অল্প দূর
মনের ঈশান কোণ
সে একান্তই আপনজন…. তবুও তারে ছোঁয়া আজ বারণ
মন মানছে না আর শাষণ
হাতের মেহেদী শুকিয়ে গিয়েছিল রাতেই। ভোর বেলায় বিছানা ছেড়ে হাতে লেগে থাকা অল্পসল্প শুকনো মেহেদী উঠিয়ে মোবাইল হাতে বসেছে আলতা। রাতে সে কাল একটুও ঘুমাতে পারেনি৷ চারটার পর চোখ লেগেছিল এখন ছয়টা বাজার আগেই জেগে গেছে। নির্ঘুম রাতের ছাপ দু চোখের নিচে কালচে হয়ে ধরা দিয়েছে। মনের ভেতর প্রেমিক পুরুষটার দু দিনকার অবহেলা আকুলিবিকুলি করছে একটাবার তাকে দেখার। কিন্তু কই সে, কেন এই অবহেলা শেষ বেলায় এসে! মনের ভেতর ভয়টা এখন উল্টোপাল্টা ভাবনায় এসে ধরা দিচ্ছে বারংবার। হাতে খাতা কলম নিয়ে আবারও কিছু শব্দগুচ্ছ একত্র করে মনের অশান্তিগুলোকে কাগজে লিপিবদ্ধ করছে। বাইরে থেকে আওয়াজ আসছে সকলেই কাজে ব্যস্ত কিন্তু তার যে কিছুতেই মন লাগছে না। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো। আম্মা ডাকছে আবারও হলুদ লাগাবে গোসলের আগে৷
আলতার বিয়ের দাওয়াত তাওহীদ পেয়েছে ভাই হিসেবে। পাতানো ভাই হলেও সে আচরণে আপন ভাইয়ের ভূমিকাই পালন করছে পরিচয়ের পর থেকেই। আলতার বাবার একবার বলা কথাটা রাখতেই কাল দুপুরে এসে হাজির হয়েছে তাওহীদ বউ সমেত। এতে করে অবশ্য যারপরনাই বিরক্ত আলতার সৎ মা কিন্তু মুখে বেচারি রা কাড়তে পারছে না আওলাদের ভয়ে। স্বামীর প্রাক্তন স্ত্রী স্বামী-বাচ্চা নিয়ে হাজির, সৎ মেয়ের পাতানো ভাই বউ নিয়ে হাজির, সৎ মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে তাকে সকাল বিকাল হাসি হাসি মুখ করে বড় বড় ডেগ বসিয়ে রাঁধতে হচ্ছে এসব কি করে সহ্য করা যায়। তবুও বেচারি করছে ভয়ে ভয়ে। মেয়েটার বিয়ে দিয়ে বিদায় করার দু তিনটা দিনই কষ্ট এরপর সে কিছুতেই কিছু সহ্য করবে না ভেবে নিয়েছে। কাল গায়ে হলুদ ছিল গ্রাম্য রীতিতে কত কি হলো সবটাই পাড়া প্রতিবেশীরাও যুক্ত হয়েছিল। নকশির মনে ভয় ছিল এ গ্রামে পা রাখতেই হয়ত, নানা লোক নানা রকম কথাবার্তা শোনাবে তাকে। কিন্তু না, শেষ পর্যন্ত তেমন কিছু শুনতে হয়নি বলে স্বস্তির শ্বাস ফেলেছিল নকশি। এ বাড়ি এসে পা দিতেই দেখা হয়েছিল আলতার বড় চাচার ছেলে আলিমের সাথে। ছেলেটা আজও তাকে চাচী বলেই সম্মোধন করে আর একইরকম সম্মান করে অথচ এক সময় এ বাড়ির মানুষগুলো এই ছেলের সাথে তার নাম জড়িয়ে কুৎসা রটিয়ে সংসার ছাড়া করলো। গ্রাম ছাড়লো নকশি পর মানুষের বাড়ি গিয়ে মেয়ে জন্ম দিলো আবার সেই বাড়িতেই এখন মেয়ের বসতি গাড়তে চলেছে। দুনিয়াটা কত আজব যারা একসময় আপন ছিল তারা এখন পর আর যারা ছিল অচেনা, অজানা তারাই একমাত্র আপনজন।
“আর কত পালিশ করবেন দেবর সাহেব?” চোখ মুখ কুঁচকে কোমরে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো রূপসা। শিশির আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শেরোয়ানির বুক পাশে ব্রোঞ্জের সাহায্যে একটা তাজা গোলাপ কলি আটকে নিচ্ছে খুব যত্ন সহকারে। রূপসার কথার জবাব না দিয়ে সে পারফিউম এর কৌটা তুলে ভুস ভুস করে পারফিউম লাগাতেই রূপসা নাক মুখ চেপে এবার অস্পষ্ট শব্দে বকতে লাগল শিশিরকে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সে বেরিয়েও গেল শিশিরদের ঘর থেকে তা দেখে শিশির জানালর কাছে দাঁড়িয়ে বলল, ” আমাকে ডিস্টার্ব করার শাস্তি দিলাম ভাবী। আজকে আমার বিয়ে এত তাড়া দিলে আমি তৈরি হব কি করে?”
রূপসা মুখ গোমড়া করে শিউলিকে ডাকলো, “শিউলি আপা আমি যাব না শিশির ভাইয়ের শ্বশুর বাড়ি।”
“ওমা! কি হইছে ভাবী?” শিউলি রুমাল দিয়ে নিজের গলা আর গালের দিকে হালকা পাউডার চেপে চেপে বসাচ্ছিল। ওদিকে তার বর নিজে তৈরি না হয়ে মেয়েকে তৈরি করছে। শিউলিকে কত করে বলল, আগে মেয়েকে সাজিয়ে দাও আমি জামাই মানুষ আগে ভাগে গাড়ির দিকে না গেলে সবাই কি ভাববে! কিন্তু না শিউলি আজ এক কথায় বলে দিয়েছে, পারব না তোমার মেয়ে তুমি সাজাও৷ তার মনে খেদ বড় ভাই বিয়ে করলো তার কত সাধ ছিলো পার্লারে গিয়ে সাজবে৷ অথচ বড় ভাই দাওয়াতে গিয়ে বিয়ে করে আসলো৷ এখন এত বছর পর শিশির ভাই বিয়ে করছে ভেবেছিল পার্লারে যাবে সেখানেও বিধিবাম! আবারও বাচ্চা হবে পাঁচ মাসের পোয়াতি বলে আম্মা, চাচী আর তার শ্বাশুড়ি সকলেই বাঁধা দিলো। তাই এখন সব ফেলে নিজে নিজে সাজে ব্যস্ত বাকি দুনিয়া তার দেখার বিষয় না এখন৷ শিশিরের বিয়ে মানে মাস্টার বাড়ির এই জেনারেশনের শেষ বিয়ে এটাই। আত্মীয়-স্বজনে বাড়ি গিজগিজ করছে। শিশিরের নানী বাড়ির আত্মীয়ও নেহাৎ কম নয়। মামা-মামী, মামাতো ভাই, বোন তাদের স্বামী- স্ত্রী , ছেলে-মেয়ে সব মিলিয়ে বাড়ির আঙিনায়ও তিল ধারণের জায়গা নেই। রূপসা এত ভীড়ে অস্থির হয়ে পড়ছে তারওপর একমাত্র দেবরের বিয়ে বলে মূখ্য ভূমিকা পালনের চেষ্টায় খুব বেশিই ছুটোছুটি করতে চাচ্ছিল। শরত নিজের ঘরে দাঁড়িয়ে তৈরি হয়ে জানালা দিয়ে উঠোনে তাকালো। স্ত্রীর ছটফটে আচরণ অনেকক্ষণ ধরেই লক্ষ্য করছিল কিন্তু এবার আর ধৈর্য্য হলো না তাই গম্ভীর স্বরে ডেকে উঠলো, “রূপ”
রূপসা শুনলো কিন্তু পাত্তা দিলো না। শিশির নিজের ঘর থেকেও দেখেছে ভাবীর অবস্থা তাই সেও তার ঘরের জানালা থেকে রূপসাকে ইশারা দিলো, পেছনে দেখো। রূপসা দেখছে না উল্টো শিশিরকে ধমকালো, ইশারা দ্যান ক্যা আমি আপনার বিয়াতে যাব না হুহ।
” বিয়েতে যাওয়া না যাওয়া পরে ভাবীজান আগে পেছনে দেখেন।” মুখ টিপে হেসে বলল। রূপসাও তৎক্ষনাৎ পেছনে ফিরে তাকাতেই শরতকে দেখে চমকে উঠলো। প্রেগন্যান্সির শুরু থেকেই কত যে চোখে চোখে রাখছে তাকে!
ঘড়ির কাঁটা দুই পেরিয়েছে। জুম্মার নামাজ আদায় করে বরযাত্রী রওনা হয়েছিল বাড়ি থেকে। আধঘন্টার পথ আসতে চল্লিশ মিনিটের মত লেগেছিল রাস্তায় একবার রূপসা আরেকবার শিউলির জন্য গাড়ি থামাতে হয়েছে বলে। শিশিরের বড় মামীও বরযাত্রী এসেছে তাই সে সর্বসম্মুখে বলেই ফেলেছিল, “এসব পোয়াতি মাইয়া মানুষ সাথে কে আনতে বলছিল?”
রূপসা চুপ থাকলেও শিউলি রেগে গিয়ে অনুচ্চস্বরে বলে দিয়েছিল কিছু কথা। তবে বাড়াবাড়ি কিছু হওয়ার আগেই শিউলির বর তাকে থামিয়ে দিয়েছিল। বাকি পথ চুপচাপ ছিল সবাই। আবারও হাঙ্গামা হলো গেইটে এসে। আলতার চাচাতো ভাই, ভাবীরা সবাই এসে বরকে আটকে দিল৷ তাদের ডিমান্ড অনুযায়ী টাকা না দিলে ভেতরে প্রবেশ নিষেধ। তাদের সাথে যুক্ত আছে তাওহীদ আর তার বউ। শরত বলল, কত দিতে হবে বলেন আমরা দিয়ে দিচ্ছি। তাওহীদ কনের বড় ভাইয়ের ভূমিকায় আছে বলেই হয়ত এমনিই ছেড়ে দিতে চাইল৷ কিন্তু তার স্ত্রী তা মানলো না তার এক কথা দুলাভাইয়ের পকেট না খসিয়ে ননদ দিচ্ছি না৷ এদিকে রূপসাও বলে দিল তারা শুনছে না কোন আবদার। শরত বাঁধা দিতে গেলে উল্টো চোখ রাঙালো তার একমাত্র দেবরের বিয়ে সে কারো কথা শুনবে না৷ ব্যস, শরত আর তাওহীদ দু দিকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে হজম করছে দুই রমনীর লড়াই। কেউ কাউকে ছাড় দিতে চাইছে না এক চুলও৷ প্রায় বিশ মিনিট তর্কবিতর্কের পর হার মানলো ছেলে পক্ষ। তারা দশ চেয়েছে শরত পাঁচ দিয়েছে৷ গ্রামের বিয়েতে হাজার দুই দিলেই অনেক হতো কিন্তু বেচারা শিশির ফেঁসে গেল বিলেত ফেরত খ্যাতির জোরে৷ পুরো পাঁচ নিয়েও পোষায়নি তাদের তারা জুতো চুরি করতেও ছাড়লো না। সব ক্ষেত্রেই নাটের গুরু হিসেবে পূর্ণ দ্বায়িত্ব পালন করল তাওহীদের স্ত্রী নেহা। শিশির অবশ্য স্টেজে উঠে বসার সময় নেহাকে বলে দিলো, “সব উসুল করবো ভাবী সুমুন্দি সাহেবের থেকে”
“সে যা খুশি করোগে তা তুমি আর তোমার বউয়ের ভাই জানে।”
তাওহীদ চোখ রাঙালো নেহাকে তাতে কিচ্ছু এলো গেলো বলে মনে হলো না। চলতে থাকলো খুনসুটি দু পক্ষেরই সেই সাথে এগোলো বিয়ের লগ্ন। শিশির মনে মনে অস্থির হচ্ছিলো আলতাকে দেখার জন্য আর তা যেন বুঝতে পারলো রূপসা। সে আর দেরি না করে নেহাকে ডেকে সঙ্গে নিয়ে গেল আলতাকে দেখতে। উদ্দেশ্য আলতদর দুটো ছবি তুলে দেবরের অন্তরে শান্তি পাঠানো।
“দেখি হা কর আর এক লোকমা খা এরপর আর দিচ্ছি না।” নকশির হাতে পোলাও লোকমা করে তোলা। কাল থেকে নাওয়া খাওয়া প্রায় বন্ধ করে বসে আছে মেয়েটা। সবাই ধরেই নিয়েছে বিয়ে বলে মেয়েটা উদাস হচ্ছে, কষ্ট পাচ্ছে। অথচ আলতার সকল উদাসী, সকল কষ্টের একমাত্র কারণ, শিশির ভাই। আজ দুটো দিন পেরিয়ে গেছে কোন খোঁজ নেই মানুষটার। সেদিনের পর আর কোন কথা হয়নি তার সাথে। আলতা কল করেছিল রূপসাকে অথচ লজ্জায় জিজ্ঞেস করতে পারেনি শিশির ভাইয়ের কথা, যদি ভাবে দুটো দিন বাকি বিয়ের আর এখনই এত উতলা। কিন্তু এখন তার রাগ লাগছে, সে অভিমান করে আছে মানুষটার সাথে৷ কাজী সাহেব বিয়ে পড়ানোর সময় আলতা সময় নিয়েছিলো অনেকটা কিন্তু শিশির নাকি এক সেকেন্ডও দেরি করেনি। রূপসা আর নেহার হাসিঠাট্টায় এ কথা কানে আসতেই আলতার রাগ উবে গেল হাওয়ার মত। ছিহ বেশরম মানুষটা এত তাড়া তার বিয়ের! অথচ দুটো দিন তাকে কতই না তড়পালো! বিয়ে সম্পন্ন হতেই বড়রা তাড়া দিলো আনুষ্ঠানিকতা শেষ করার। এদিকে বাচ্চা আর মহিলারা মিলে বর-কনের আয়না দেখা আর মিষ্টিমুখ পর্ব আরম্ভ করবে বলে শিশিরকে স্টেজ থেকে ঘরে নিয়ে এলো। শিশির এসে আলতার পাশে খাটে উঠে বসতেই সে জড়োসড়ো হয়ে গুটিয়ে গেল হঠাৎই। শিশির ভাই এখন তার স্বামী কথাটা মনে হতেই লজ্জায় রাঙা হলো তার গাল দুটো। শিরশিরে এক অনুভূতি বুকের ভেতর কম্পন তুলল। কত কাছে এসে বসেছে মানুষটা! নাকে এসে লাগছে তাঁর গায়ের গন্ধ। আলতার মাথায় লম্বা ঘোমটা থাকায় সকলের অদেখা তার মুখাবয়ব৷ তার রক্তিম কপোলের নীলচে শিরার ভেসে ওঠা ভাব সকলের অগোচর কিন্তু তার হাতের কম্পন! শিশির যে অপলক চেয়ে আছে তার হাতের দিকেই। ঘরভর্তি মানুষ পাশেই নেহা দাঁড়িয়ে আছে মিষ্টির বাটি হাতে৷ রূপসার হাতে মাঝারি আকারের প্লাটিকের ফ্রেমবন্দী আরশি আছে বর-কনের মুখ দেখা পর্বের জন্য৷ নেহাই প্রথমে বলল, “আগে মিষ্টিমুখ হোক?”
“আচ্ছা ” রূপসা সম্মতি দিল। মিষ্টির বাটি এগিয়ে দেওয়া হলো শিশিরকে। সে কাটা চামচে মিষ্টি তুলে আলতার মুখের কাছে ধরল৷ ঘোমটার আড়ালে মিষ্টি তার মুখ ছেড়ে নাকে গিয়ে ঠেকলো প্রথমেই। দ্রুত বেগে মুখ সরিয়ে নিতেই সকলে হো হো করে হেসে উঠেছে। শিশির বুঝলো তার আন্দাজ ভুল হয়েছে। এক পলক ঘরভর্তি সকলকে দেখে আচমকা উঠিয়ে দিল আলতার ঘোমটা। ঘটনার আকষ্মিকতায় ভড়কে গেছে আলতা। অবাক চোখে শিশিরের দিকে তাকাতেই সে আবারও মিষ্টি ধরলো মুখের কাছে।
“ধুর এত ফরমালিটি ভাল্লাগছে না জলদি একটু খেয়ে নে বাড়ি যাব।”
“হ্যায়!” অস্ফুটে বেরিয়ে এলো আলতার মুখ থেকে৷ বোধকরি, ঘরে উপস্থিত প্রত্যেকেই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে নতুন জামাইয়ের এহেন আচরণে। পরবর্তী আয়োজন আয়না দেখার শুরু হতে শিশির নিজেই আলতার ঘোমটা টেনে আয়না ধরলো। নিজের মুখখানা এগিয়ে এনে বলল, আমি তোকে দেখতে পাচ্ছি তুই আমাকে দেখতে পাচ্ছিস?
মধ্যরাত; টিনের চালে ঝুম বৃষ্টির রিমঝিম ছন্দ। হেমন্ত আসি আসি বেলায় এমন ধারা বৃষ্টি বড় কাঁপন তোলা৷ নিশীথ বাদলধারায় মাস্টার বাড়ি নিদ্রায় আচ্ছন্ন। কিন্তু বাড়ির নতুন দম্পতি জেগে আছে প্রণয়ের অনাবিল সুখসাগরে জোয়ার এসেছে বলে। কবুল বলে আপন হওয়া দুটি সত্তা সারা সন্ধ্যা একে অপরের সাক্ষাৎ পায়নি আত্মীয়স্বজনে ভীড়ে ডুবে। আজ হঠাৎ করেই সন্ধ্যের আকাশে মেঘ ডাকলো। আঁধার রাতে কালো থেকে নিগূঢ় কালোয় ঢেকে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নামালো। অসময়ি বৃষ্টির হঠাৎ আগমনে প্রত্যেকেই রাতের খাওয়ার পাট চুকিয়ে নতুন বর কনেকে ছেড়ে দিলো সহজেই। শিশির আলতাও মেঘের ডাক শুনে বন ময়ূরের মত পেখম মেলতে ছটফট করছিলো। রাত বাড়তেই দুজনার সাক্ষাৎ হলো একান্তে সেই সাথে মন নেচে উঠলো ভিন্ন কোন ছন্দ তুলে। শিশিরকে দেখে প্রথমে লজ্জায় নুয়ে পড়লেও তাৎক্ষণিক কিছু মনে পড়ায় নড়েচড়ে উঠলো৷ প্রথমেই প্রশ্ন করলো, “আমার ব্যাগ কোন ঘরে শিশির ভাই?”
প্রশ্নটা শুনতেই তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় শিশির। মুখে কিছু না বলে হাতের ইশারায় আলমারির কাছে থাকা ব্যাগটা ইশারা করে৷ আলতা সেটা দেখতে পেয়ে শিশিরকে অনুরোধ জানায় ঘর ছেড়ে বাইরে যাওয়ার। শিশির বিনা বাক্যে ঘর ছাড়ে আলতাও দ্রুত পায়ে দোর আটকে দেয়। কেন, কি হলো কিছুই বুঝে উঠতে পারে না শিশির৷ মাত্র কিছুক্ষণ আগেই আলতাকে সাজপোশাক বদলে সুতি এক শাড়ি পরিয়ে রূপসা তাকে ঘরে দিয়ে গেছে। এই মুহুর্তে তার ঘরে একা কিছু করার আছে বলে মনে হয় না শিশিরের। তবুও হাতে হাত চেপে দাঁড়িয়ে রইলো বারান্দায়। বাইরে বৃষ্টি অঝোর সেই সাথে থেকে থেকে বিজলি চমকাচ্ছে৷ টানা দশ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে মেজাজ যখন পুরোপুরি বিগড়ে গেল ঠিক তখনই খুট করে শব্দ এলো কানে। বাইরে ঝুম বৃষ্টি, ঘরের ভেতর অন্ধকার৷ দরজা খুলে আলতা সরে গেছে সেখান থেকে! শিশির এবার চঞ্চল পায়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলো। অন্ধকার হাতরে বিছানায় হাত রাখতেই আবারও কানে আওয়াজ এলো৷ এবারের আওয়াজ জানালা খোলার। আঁধার ঘর আচমকাই আলোকিত হয়ে আবারও আঁধারে ঢাকলো৷ খোলা জানালা দিয়ে বিজলির আলোর বিচ্ছুরণ থেকে ঘরটাকে আলো আঁধারির রঙ্গশালায় পরিণত করছে। সেই আলোয় শিশির দেখতে পেল জানালায় দাঁড়ানো ছায়ামানবী৷ দু চার পা এগিয়ে এসে সেও দাঁড়ালো সেই ছায়ামানবীর পেছনে৷ চোখ সয়ে গেছে আঁধারে, অনুভব ছুঁয়ে গেছে সামনে থাকা মানবীকে৷ সময় লাগলো কিছুটা টের পেল শিশির মেয়েটির গায়ে জড়ানো সেই তাতের শাড়ি৷ তমসায় ঢাকা ঘরটাতে বোঝা গেল না পায়ে আলতা আছে কিনা তবে বোঝা গেল তার প্রিয় নারীটি সাজহীন অঙ্গে শুধুই শাড়িটি জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে৷ সে আলতো হাতে কাঁধ ছুতেই চমকে গেল মুহূর্তে যেন কয়েক হাজার ভোল্ট বিদ্যুৎ এই মাত্র বয়ে গেল তার গায়ে।
“এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন আলতা আমি যে পাগল হয়ে যাব।”
“তুমিই তো বলেছিল কোন এক ঝুম বৃষ্টিতে তোমার দেওয়া শাড়িটা গায়ে জড়াতে।”
“হ্যা বলেছিলাম কিন্তু তুই শুধুই শাড়ি পরেছিস কেন?” গলার স্বর উত্তেজনায় কেঁপে উঠছে বারবার।
“তবে আর কি জড়াতাম সাথে?” কথাটা বলেই আলতা ফিরে তাকালো শিশিরের দিকে৷ ততক্ষণে শিশির আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার হাত উঠে এসে আলতার কটিদেশ দখল করে নিয়েছে। বাইরে বৃষ্টির তেজ বেড়েছে সেই সাথে বেড়েছে শিশিরের মনের প্রেম আর কামের মিলিত জন্তুরা। আলতার কথার জবাব ঠিকঠাক দিতে পারছে না সে কোনমতেই বলল, “ব্লাউজ!”
“তুমি তো দাওনি সেটা শুধুই শাড়ি দিয়েছিলে।”
“আমি বুঝতে পারিনি ” বলেই শিশির ছুঁয়ে দিলো আলতার ঠোঁট। ধীরে হাতে ফেলে দিলো কাঁধের আঁচল। চঞ্চল হলো হাত সজাগ হলো দেহের প্রতিটি রন্ধ্র। প্রেমিক মন স্বামী সত্তায় আপন নারীর দেহে ডুবতে লাগলো প্রতিটি সেকেন্ড। নারী দেহের ভাঁজে লুকানো সকল রহস্য খু্ঁজে নিতেই মজে গেল সদ্য আপন করা স্ত্রীর মাঝে৷ আলতা কি তার বিপরীত! একদমই না। দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে প্রণয় আর পরিণয়ের মিষ্টিমধুর ক্ষণ লুটে নিচ্ছে দুজনাতে। প্রকৃতিও সমান তালে মেতে উঠেছে অসময়ের বৃষ্টি নামের প্রেমোছন্দে। শিশিরে ভিজে আলতা হয় মুক্তোর মতোন দামী।
সামনের ঘরেও তেমনই জমে উঠেছে আরও এক দম্পতির মিষ্টি, মুগ্ধ মুহুর্ত। সেখানে বইছে আনন্দ নতুন সত্তার আগমনের শিহরিত মুহূর্ত। একটু আগেই ঘুমের মাঝে রূপসা আর্তনাদ করে উঠে৷ পাশেই ঘুমন্ত শরত ধড়ফড় করে উঠে বসে৷ দু হাতে আগলে নিয়ে জানতে চায় কি হয়েছে? রূপসা ভীত চোখে চারপাশে চোখ বুলায়। বাইরে বৃষ্টি , কারেন্ট গেছে হয়ত এখনই। ঘর জুড়ে অন্ধকারের একচ্ছত্র রাজত্ব। রূপসা ভীত পাশাপাশি আনন্দিত স্বরে জানায় পেটের ভেতর বাচ্চাটা লাথি মেরেছে। শরত ভয় পায়; শুনেই সে মাকে ডাকতে চাইলে রূপসা তাকে বাঁধা দেয়। এটা স্বাভাবিক ব্যাপার এ সময়ে৷ কিন্তু শরতের আগে কখনো জানার সুযোগ হয়নি। দুজনের কথার মাঝেই রূপসা আরো একবার টের পায় লাথি। নিজেই শরতের হাতটা টেনে পেটের ওপর ছোঁয়ায়। অপেক্ষা করে আরও একবার লাথির আভাস তাকে অনুভব করানোর। অপেক্ষা দীর্ঘ হয় রাত বাড়ে। সুখের মুহূর্তগুলো এমন করেই এগিয়ে চলে অনেক অনেক দূর।
সমাপ্ত