#শুক্লপক্ষের_পরিশেষে
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
|৪৩|
সপ্তাহ খানেক যেতে না যেতেই একদিন হুট করেই ফেরার পথে মুখোমুখি হলো শ্রেয়ান ও প্রিয়। প্রিয় বাস স্টপেজে বসে ছিল। শ্রেয়ান ওকে বসে থাকতে দেখে গাড়ি থামিয়ে সোজা সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। প্রিয়র মুখের ওপর কোলাহলপূর্ণ শহরটির গাড়িগুলোর হেডলাইটের আলো আর পড়ছে না। সচকিত হয়ে সামনে তাকাল প্রিয়। কালো ক্যাজুয়াল শার্ট পরে সামনে দাঁড়িয়ে আছে শ্রেয়ান। চেহারায় গাম্ভীর্য। প্রিয়র তাকানোর সাথে সাথে শ্রেয়ান সামান্য হাসল। বলল,
-“এখানে কী করছ?”
প্রিয় স্বাভাবিক হলো দুটো শ্বাস টেনে,
-“বাসের অপেক্ষা।”
-“চলো, বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।”
প্রিয় এমনভাবে তাকাল যেন শেয়াল নিজে থেকে মুরগীর বর্গা নিতে চাইছে। ভেতর থেকে হাসি এলো। প্রিয় হেসে ফেলে বলল,
-“আর তুমি ভাবছ, আমি তোমার সাথে যাব?”
শ্রেয়ান প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে টানটান হয়ে দাঁড়াল। প্রিয়র চোখে চোখ রেখে বলল,
-“তুমি আর আমাকে চাও না, প্রিয়শ্রী.. তাই-না?”
প্রশস্ত হেসে প্রিয় বুকে হাত বেঁধে বলল,
-“নিঃসন্দেহে।”
শ্রেয়ান মাথা নুইয়ে হেসে ফেলল,
-“ঠিক আছে।”
প্রিয়র বুকে বেঁধে রাখা হাতদুটোর মাঝে বাঁ হাতের আঙুলগুলো ডানপাশের বাহু ধরে আছে। আর ঠিক অনামিকাতে একটি গোল্ডের রিং জ্বলজ্বল করছে। শ্রেয়ানের দৃষ্টি সেখানে পড়তেই কপাল কুঁচকে গেল। একবার প্রিয়র দিকে তাকাল, আরেকবার হাতের দিকে। অবিশ্বাস্য সে দৃষ্টি। একটা অবিবাহিত মেয়ের হাতের অনামিকাতে স্বর্ণের আংটি কখনোই দেখা যায় না।
প্রিয় শ্রেয়ানের সেই দৃষ্টিতে নির্বিকার তাকিয়ে রইল। শ্রেয়ান হতভম্ব হয়ে ডাকল,
-“প্রিয়শ্রী?”
প্রিয় একই ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল, জবাবে বলল না একটি শব্দও। প্রিয়র নির্লিপ্ততায় শ্রেয়ানের কম্পনরত আওয়াজটা পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম প্রশ্নটাও করে ফেলল,
-“আমি কি তোমায় হারালাম?”
_____
সমগ্র রুম পিনপতন নিঃস্তব্ধতায় ছেয়ে আছে। ঝড়ের পর প্রকৃতি যেমন শান্ত হয়ে যায় না? ওমন। ড্রেসিং মিররের গ্লাস ভেঙে ফ্লোরে পড়ে আছে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অন্যান্য সামগ্রী। একপাশে ফ্লোরে হাত-পা ছিটিয়ে চুপ হয়ে বসে আছে শ্রেয়ান। প্রচণ্ড মাথা ব্যথা হচ্ছে তার। নিঃশ্বাসের ঘনত্ব বাড়ছে। চোখ দুটো লাল হয়ে আছে, জ্বলছে।
শেষ মুহুর্তে প্রিয় উত্তরে বলেছিল,
-“যেই মুহূর্তে আমি টের পেয়েছিলাম, আমি তোমার অবসরের প্রয়োজন মাত্র। মন থেকে উঠে গেছিলে, আমায় হারিয়ে ফেলেছিলে। আর এখন সর্বোপরিভাবে।”
নিশ্চিত হওয়ার জন্য শ্রেয়ান আবারও বলেছিল,
-“এখন এটা বোলো না, বিয়ে করে নিয়েছ। প্লিজ।”
প্রিয়র দৃঢ় আওয়াজ,
-“করে নিয়েছি বিয়ে।”
শ্রেয়ান আর ওসব ভাবতে পারছে না। মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। দু-হাতে চুলগুলো টেনে ধরল। প্রিয় তার না, সে মেনে নিতে পারবে। তবে প্রিয় অন্য কারো, এটা কীভাবে মানে সে? পারছে না তো। পুরো পৃথিবী ভেঙে ফেলতে মন চাইছে। সে স্বীকার করে, কখনও প্রিয়কে ভালোবাসেনি। কিন্তু প্রিয় নিজে একটা খেলার বস্তুর ন্যায় আচরণ করে শ্রেয়ানকে কতগুলো বছর কর্তৃত্ব দিয়েছিল, সেটা শ্রেয়ান ভুলতে পারে না।
তার খারাপ লাগছে, অসহ্য লাগছে, দমবন্ধ হয়ে আসছে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে সে অনুভব করে, সে প্রিয়কে ভালোবাসে। বিশ্রী বিশ্রী বিশ্রী! হারানোর পরই কেন প্রাপ্তির উপলব্ধি হলো? কী অসহ্য! যন্ত্রণার সর্বোচ্চ সীমানায় গিয়ে তখন তার মুঠোফোনটা বেজে উঠল। শ্রেয়ান ফ্লোরে স্ক্রিন ভেঙে পড়ে থাকা ফোনটার দিকে তাকাল। ভাঙা স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে একটা লেখা,
-“মিস্টার রহমান।”
শ্রেয়ান কল রিসিভ করে স্পিকারে দিয়ে সামনে ধরল। ওপাশ থেকে গম্ভীর আওয়াজ এলো,
-“সন্ধ্যের মধ্যে আমার অফিসে তোমার থাকার কথা ছিল। তুমি কোথায়?”
শ্রেয়ান থেমে থেমে বলল,
-“ধানমন্ডি।”
-“ফেরোনি?”
-“না, বাবা।”
-“কবে ফিরবে?”
-“কবে ফিরব?”
শ্রেয়ানের পালটা প্রশ্ন দেখে আনোয়ার সাহেব বললেন,
-“কাল ফেরো।”
-“আচ্ছা।”
-“সত্যি কথা শুনতে চাই একটা।”
-“বলুন, বাবা।”
আনোয়ার সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,
-“তুমি কি ওখানে প্রিয়কে ফের ডিস্টার্ব করতে গিয়েছ?”
শ্রেয়ান চোখ বন্ধ করে ফেলল। শক্ত আওয়াজে বলল,
-“হুম।”
-“তোমাকে বারণ করে..”
আনোয়ার সাহেবের কথা শেষ করতে দিলো না শ্রেয়ান। বলে উঠল,
-“বাবা, মেয়ে দেখুন। আমি বিয়ে করতে চাই।”
____
শ্রেয়ান বিয়ে করতে চাইলেও, বিয়ের দিকে এগোতে পারেনি। হাজার মেয়ে দেখল, কারোর ওপরই ফিলিংস কাজ করে না। সিগারেটের ধোঁয়া সহ্য হয় না আর, নেশা চড়ে না কোনো কিছুতেই। মেয়েদের থেকেও আস্তে-আস্তে দূরে সরে যাচ্ছে। এভাবে মাস তিন-চার গেলে, এক বিকেলে সে তার ধানমন্ডির অ্যাপার্টমেন্টে এসে গা ছেড়ে শুয়ে পড়ে।
পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট, কুড়ি মিনিট ওভাবেই পড়ে থেকে নতুন সিম দিয়ে কুহককে কল লাগায় শ্রেয়ান। কুহক অফিস আওয়ার শেষে একটা ক্যাফেতে বসে রেস্ট নিচ্ছিল, নিজেকে টাইম দিচ্ছিল। এমন সময় ফোনে কল আসায় সচরাচর সে রিসিভ করে না। তবে আজ কেন যেন মুডটা একটু বেশিই ভালো। করে ফেলল কল রিসিভ। ফোন কানে তুলে কিছু বলল না, অপর পাশের ব্যক্তির থেকে প্রথম কনভারসেশন শুরুর অপেক্ষায় রয়েছে সে। শ্রেয়ান অনেকটা সময় চুপ রইল। শ্বাস ফেলতে লাগল ধীরে-সুস্থে। তারপর একসময় গিয়ে ডেকে উঠল,
-“কুহক?”
কুহক মুচকি হাসল তৎক্ষণাৎ,
-“বলো, শ্রেয়ান। হঠাৎ কল দিলে যে?”
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শ্রেয়ান বলল,
-“এমনিই। কেমন আছ?”
-“বিন্দাস।”
-“আমাকে জিজ্ঞেস করবে না?”
কুহক চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বলল,
-“যখন কোনো ব্যক্তি, কাউকে শুধু শুধু কল দিয়ে পাঁচ মিনিট চুপ হয়ে থাকে আর এরপর কেবল জিজ্ঞেস করে—কেমন আছ। দ্যাট মিনস, সে নিজে ভালো নেই।”
শ্রেয়ান মলিন হেসে বলল,
-“তুমি খুব বুদ্ধিমতী, জ্ঞানী। আমাকে কিছু উপদেশ দেবে?”
মিহি হেসে কুহক বলল,
-“জীবনের সবক্ষেত্রে এই জ্ঞানটা কাজে লাগে না, শ্রেয়ান। কিছু ক্ষেত্রে আমাদের থেমে যেতে হয়। তুমি যেই উপদেশ চাইছ, আমি সেক্ষেত্রে হেরে বসে আছি।”
-“কাকে ভালোবাসতে তুমি? বাই এনি চান্স, আমাকে?”
শব্দ করে হেসে ফেলল কুহক,
-“আমাদের মধ্যে যা ছিল, তাকে কোনোভাবেই ভালোবাসা বলা যায় না। তুমি বরং আয়োজন করে তাকে ‘মিউচুয়াল রিলেশনশিপ’ বলতে পারো।”
শ্রেয়ান বরাবরের মতো আবার বলল,
-“একটা মেয়ে হয়ে কীভাবে এসব কথা বলতে পারো, আমি বুঝি না।”
-“আমি নম্র-ভদ্র হয়েও দেখেছি, সে আমায় চায়নি।”
-“কে?”
-“ঢাকায় আছ?”
-“হ্যাঁ।”
-“লোকেশন পাঠিয়ে দিচ্ছি, চলে এসো।”
____
শ্রেয়ান আর কুহক, মুখোমুখি দু’জন বসে আছে। কুহক কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল,
-“কী খবর, শ্রেয়ান?”
-“যেটা শোনাতে ডেকেছ, তা বলো!”
হো হো করে হেসে ওঠে কুহক,
-“বাব্বাহ! এক ডাকে ছুটে এলে? এত আগ্রহ! রিজন কী, মশাই?”
সুদীর্ঘ শ্বাস টেনে শ্রেয়ান বলল,
-“আমার গাট ফিলিংস আমাকে জানাচ্ছিল, তোমার সাথে কথা বললে সলিউশন পাব।”
কুহকের বাঁকানো হাসিটার মানে শ্রেয়ান বুঝল না। কুহক বলল,
-“শরৎ, আই মিন প্রিয়র হাজব্যান্ড। ওকে আমি পছন্দ করি। আচ্ছা পছন্দ না, ভালোবাসি। ওর থেকে সেই অনুভূতি আমি পাইনি। ওর ভাষ্যমতে, প্রেম নাকি যন্ত্রণা ছাড়া কিছুই দেয় না। আমি বহু চেষ্টা চালিয়েও যখন পেলাম না, তখন ভাবলাম ওর মন জিতি। সেজন্য ওর আশে-পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। ও যখন প্রিয়র ফাইল ঘাটছিল, তোমার ডিটেইলস নিয়ে এলো, আমি গিয়ে ওর থেকে ঘটনার বিবরণ পাই। আমি নিজ থেকে অফার করি, ওকে সাহায্য করার। আমি চাইলাম, তোমাকে প্রেমে ফেলতে। আর তারপর মন ভেঙে চলে যেতে। মন ভাঙার কষ্টটা উপলব্ধি করাতে চেয়েছিলাম তোমাকে। এরপর তোমার সাথে দেখা হওয়া, সম্পর্কে জড়ানো, সবটাই আমার ধোঁকা ছিল। আমি তোমার মন ভাঙতে গিয়ে লক্ষ করলাম তুমি হৃদয়হীনা। ততদিনে আমি প্রিয়র প্রতি শরতের ফিলিংস টের পাই।
আমি নিজের প্ল্যান চেঞ্জ করে ফেললাম। আমি তোমাকে শুধু মন ভাঙার কষ্টটা রিয়ালাইজ করাতে নয়, চেয়েছিলাম প্রিয়র কাছে ফিরিয়ে দিতে। ভেবেছিলাম, তুমি হয়তো আমার অবহেলার মাধ্যমে প্রিয়র ভালোবাসার গভীরতা টের পাবে। ওর কাছে ফিরে যাবে। এরপর হয়তো আমিও শরৎকে পেতাম। আর বোকা ছেলে তুমি, তুমি তাও হেরে গেলে! তোমার মানুষকে অন্য একজন নিয়ে গেল। আমার মানুষটা অন্যের হলো।”
শ্রেয়ান অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। কুহক হেসে ফেলে বলল,
-“চেষ্টা তুমিও করেছিলে, আমিও করেছিলাম। তবুও পাইনি। এর মানে বুঝতে হবে, ওরা আমাদের জন্য ঠিক ছিল না। আমি তোমার থেকে সরে এসে পুরোপুরি নিজের ক্যারিয়ারে ফোকাস করেছি। বাবা-মা বিয়ের জন্য প্রেশার দিচ্ছে। বাট ম্যারিটাল লাইফ আমার জন্য নয়। দেখি, কপালে লেখা থাকলে করে নেব বিয়ে।”
দ্বিধায় পড়ে শ্রেয়ান শুধাল,
-“আমার কী করা উচিত?”
-“আমি বলে দেবো?”
-“হু।”
-“জীবনকে একটা নদী ভাবো, স্রোতের ধারা অনুযায়ী যেভাবে চলছে চলতে দাও। বিপরীতে যাওয়া সম্ভব নয়।”
শ্রেয়ান নির্নিমেষ তাকিয়ে রইল। তারপর বলল,
-“ঠিক আছে।”
কুহক উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
-“আজ আসি। আবার দেখা হবে।”
-“আচ্ছা।”
কুহক ব্যাগটা উঠিয়ে হাতে নিয়ে চলে যেতে গিয়েও আরেকবার শ্রেয়ানের দিকে ফিরে এলো। তার সচরাচর স্বভাবটা সাইডে রেখে মিষ্টিমুখে বলল,
-“শ্রেয়ান, তোমার চোখ আজ কেবল আমার চোখেই স্থির ছিল। তোমার নারী দেহের লোভ নেই আর। সম্ভবত আর কোনো ধরনের নেশা-টেশাতেও নেই। চেহারাটা অ্যাট্রাক্টিভ ছিল, এখন ম্যাচিওর লাগে। ব্যাপারটা ইপ্রেমসিভ। আই অ্যাপ্রিশিয়েট ইট। নিজের ব্যক্তিত্বকে এত সুন্দর করার বিপরীতে তুমি পেলে শূন্যতা। লাভ নেই শ্রেয়ান, যখন এই বদলে যাওয়াটা প্রয়োজন ছিল তখন তুমি বদলাওনি। এখন তাকে পাবে না। আই উইশ, তোমাকে এরপর যে পাবে, সে এই বর্তমানের তুমির মাঝে অতীতের ছায়া যেন দেখতে না পায়। এই তুমিটা ভীষণ সুন্দর।”
কুহক চলে গেলেও শ্রেয়ান সেখানে বসে রইল পুরো এক সন্ধ্যে। লাস্টের কথাগুলো মনে আঁচড় কাটল। কুহক তাকে অনেক ধরনের শিক্ষা দিয়েছে, তার মধ্যে শেষেরটা তার মারাত্মক পছন্দ হলো। সে অতীত থেকে দূরত্ব বাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টায় আরও একবার নিজের মানুষ খোঁজার অভিলাষে মেতে উঠল। নিজের চিকিৎসা করাল। এবার আর পছন্দ-অপছন্দের ধার ধারল না। তাকে যেই মেয়েটা পছন্দ করল, সেই মেয়েটাকেই বিয়ে করে নিল। আর ঠিক বিয়ের ক’দিন পরই মস্তিষ্কে যখন প্রিয় নামক পোকাটা কিলবিল করতে লাগল, সে প্রিয়কে ম্যাসেজ করে নিজের বউয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় তিনটে ছবি পাঠিয়ে দিলো। পুরোনো প্রেম, অত্যাধিক ভালোবাসার মানুষটার বুকে যখন আরেকটি নারীকে প্রিয় দেখবে, তখন সে কষ্ট পাবে। কেন যেন সেই কষ্টটা শ্রেয়ান উপভোগ করতে চাইলো।
____**____**_____
অতীতের গল্পটা অবশ্যই সুন্দর ছিল, ততখানি ভয়ঙ্করও ছিল। প্রিয় দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগে বার বার। আজ অফিসে সে ভীষণ অমনোযোগী। এজন্য বসের কাছে একটু কথাও শুনতে হয়েছে। প্রিয় হাফ টাইমে লিভ নিয়ে নিল। অফিস থেকে বের হয়ে সে শরৎকে কল লাগাল। শরৎ সঙ্গে সঙ্গে কল রিসিভ করে বলল,
-“হ্যাঁ বলুন।”
-“কিছু না।”
ফিক করে হেসে ফেলে শরৎ শুধাল,
-“কিছু না?”
-“নাহ, কিছু না।”
-“কল দিলেন যে?”
-“এমনি।”
-“এমনিই?”
-“হুঁ। আমার ইচ্ছে।”
শরৎ খুব করে অনুভব করল তার সুখের আজ মন খারাপের। সে দ্রুত হাতে কাজ গোছাতে গোছাতে বলল,
-“অফিসে আছেন?”
প্রিয় হাঁটছে। পায়ের গতি স্বাভাবিক রেখেই বলল,
-“লিভ নিলাম।”
-“গুড। উলটো দিকের ক্যাফেতে বসে কফি খেতে থাকুন, আমি আসছি।”
প্রিয় ক্যাফেতে গিয়ে বসল। এর ঠিক আধ ঘন্টার মাথায় শরৎ এসে পড়ল। প্রিয় বিল দিয়ে বাইরে গিয়ে দাঁড়াতেই শরৎ এগিয়ে এলো। একহাত বাড়িয়ে প্রিয়র হাত ছুঁয়ে নিজের কাছে এনে বলল,
-“সুখ, চলুন আপনার মনের অসুখ সব দূর করি…”
চলবে..
#শুক্লপক্ষের_পরিশেষে
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
|৪৪+৪৫|
প্রিয় ক্যাফেতে গিয়ে বসল। এর ঠিক আধ ঘন্টার মাথায় শরৎ এসে পড়ল। প্রিয় বিল পে করে বাইরে গিয়ে দাঁড়াতেই শরৎ এগিয়ে এলো। একহাত বাড়িয়ে প্রিয়র হাত ছুঁয়ে নিজের কাছে এনে বলল,
-“সুখ, চলুন আপনার মনের অসুখ সব দূর করি…”
শরৎ প্রিয়কে নিয়ে গাড়িতে বসল। প্রিয়কে জিজ্ঞেস করল,
-“কোথায় যেতে চান, ম্যাডাম?”
-“নির্জনে।”
-“ওকে!”
শরৎ এখানকার সবচেয়ে নিরবিলি একটি জায়গায় নিয়ে গেল প্রিয়কে। চারপাশে সজীবতায় ভরপুর। শান্ত পরিবেশটায় একটা অশান্ত নদীর ধার ধরে প্রিয় বসে পড়ল। পাশে বসল শরৎ নিজেও। প্রচুর নমনীয়তা নিয়ে বলল,
-“আপনার ব্যাকুলতা জাহির করুন, বিবিজান।”
প্রিয় ভ্রু-কুঁচকে বলল,
-“বিবিজান ডাকেন কেন?”
-“ভাল্লাগে তাই।”
মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকাতেই শরৎ টুপ করে প্রিয়র কোলে মাথা রেখে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল। প্রিয় ঘাবড়ে উঠল। সরে যাওয়ার আগেই শরৎ বলে উঠল,
-“আপনাকে এত আমার আমার লাগে কেন, প্রিয়?”
প্রিয় সরে না আর, উত্তরে কিছুই বলে না। মলিন দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকায়। শরৎ প্রিয়র সেই দৃষ্টিকে লক্ষ করে একবার আকাশে তাকাল, তারপর আবার প্রিয়র দিকে। চোখে চোখ রেখে ডাকল,
-“প্রিয়?”
নরম আওয়াজ প্রিয়র,
-“হুম?”
-“আপনাকে উদাসীন লাগছে।”
প্রলম্বিত শ্বাস টেনে প্রিয় বলল,
-“জীবন একভাবে চলে না কেন? সুখে থাকলে কেন সেখানে দুঃখের উপস্থিতি চলে আসবে?”
শরৎ মিহি হেসে বলল,
-“দুঃখ না থাকলে সুখ ফিকে হয়ে পড়বে। একঘেয়ে লাইফ কেউই লিড করতে চায় না। এডভেঞ্চার লাগে, মাঝে মাঝে একটুখানি দুঃখের উপস্থিতিও বড়ো প্রয়োজন। ধরুন আপনি সুখে আছেন ভীষণ, এভাবেই চলতে থাকত। আপনি যা চাইছেন, তাই পাচ্ছেন। আপনার অপ্রাপ্তিগুলো সব প্রাপ্তি হয়ে গেল। আর তারপর একসময় হুট করেই লক্ষ করবেন, আপনার বেঁচে থাকার ইচ্ছে হারিয়ে যাচ্ছে। সূর্য, চন্দ্র আর পৃথিবী যেমন সত্য, আমার এই কথাটাও তেমন সত্য।”
আচমকাই প্রিয় বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে শুধাল,
-“কেন?”
বড়ো করে শ্বাস টেনে শরৎ বলল,
-“মানুষ বেঁচে থাকে স্বপ্ন পূরণের আশায়। যখন স্বপ্নগুলো বাস্তবে হাতে চলে আসে, সে বেঁচে থাকার ইচ্ছে হারায়।”
প্রিয় মুখ গোমড়া করে বসে থাকে। শরৎ প্রিয়র একহাত নিজের মুঠোয় নিয়ে, সেই হাতের আঙুলগুলোর সাথে খেলতে খেলতে বলে,
-“পথশিশুদের দেখেছেন, প্রিয়? তারা প্রতিমুহূর্তে সমাজের সাথে লড়ে গিয়েও বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা কোথায় পায় জানেন? আবার কেউ কেউ আছে চোখে দেখে না, হাত-পা নেই, চলতে পারে না একাকী, ওরাও বেঁচে থাকে। মা-বাবা নেই, অনাদরে আত্মীয়ের বাড়িতে লাঞ্চিত হয়ে বড়ো হওয়া মানুষদের সংখ্যাও নেহাৎই কম নয়। কেউ আবার হসপিটালের বেডে শুয়ে শুয়ে রাতের পর রাত কাটিয়ে দেয়। তারা কিন্তু ম্যাক্সিমামই সুইসাইড করে না। সুইসাইডাল এটেম্পট সব আমাদের মতো মানুষেরাই নেয়। যারা সুখে আছি। ওদের চোখে স্বপ্ন আছে, প্রিয়। বেঁচে থাকার তীব্র আকাঙ্ক্ষা আছে। আপনাকে একদিন আমি খুব কাছ থেকে তাদের জীবনটা দেখাব। আপনাকে আমি খুব কাছ থেকে অন্যের দুঃখ দেখাব, প্রিয়। আপনি নিজ থেকেই তখন দেখতে পাবেন, আপনি ভালো আছেন। আপনি কতখানি ভালো আছেন।”
প্রিয়র ভেতরে কেমন একটা হওয়া শুরু করে তখন, অশান্ত মনটা বলে ওঠে,
-“ও আমাকে ম্যাসেজ দিয়েছিল গতকাল।”
শরৎ থেমে যায়, সেকেন্ড পাঁচেক যেতেই শুধায়,
-“কে? শ্রেয়ান?”
-“হু-উম!”
-“ও না বিয়ে করে ফেলেছে?”
-“হ্যাঁ।”
-“তারপর কী চায় আর?”
-“আমি জানি না, কী চায়। কিন্তু.. মানে ওই ম্যাসেজগুলো.. ওসব.. আমি ভুলতে পারি না ও আমার খুব কাছের কেউ ছিল.. বোঝাতে পারছি না, আপনাকে, নীরজ।”
প্রিয়র এলোমেলো কথার শেষে ভীষণ ব্যাকুলতা নিয়ে ‘নীরজ’ নাম নেওয়ার বিপরীতে শরৎ উঠে বসল। প্রিয়র গালে হাত রেখে মুখোমুখি করে বলল,
-“আমি কি দেখতে পারি?”
প্রিয় নৈঃশব্দ্যে নিজের ফোন এগিয়ে দেয় শরতের দিকে। শরৎ ম্যাসেজগুলো পড়ল। শান্ত রইল। এরপর শ্বাস ফেলে ডাকল,
-“প্রিয়?”
প্রিয় তাকাল শরতের দিকে, চোখ কেমন টলমল করছে তার। শরৎ বড়ো মলিনতা নিয়ে শুধাল,
-“আপনার নিজেকে সময় দেওয়া শেষ হয়নি, প্রিয়?”
আনমনেই প্রিয় জবাবে বলল,
-“বুঝতে পারছি না।”
প্রসঙ্গক্রমে শরৎ জিজ্ঞেস করে বসল,
-“আমার হবেন কবে?”
______
আজ নিজের ভার্সিটিতে না গিয়ে আয়াত সরাসরি প্রহরের ক্যাম্পাসে চলে এসেছে। এসে এদিক-ওদিক কিছুক্ষণ হেঁটে প্রহরের ডিপার্টমেন্টের সিঁড়ির সামনে দাঁড়াল। এরপর কল করল। প্রহর লাইব্রেরিতে ছিল। ফোন ভাইব্রেট করায় কেটে দিলো। আয়াত আবার কল করল। প্রহর এবার ওখান থেকে বেরিয়ে চলে এলো। বাইরে এসে কল রিসিভ করে বলল,
-“বল।”
-“কী বল? কল কাটিস কেন? কোথায় তুই?”
প্রহর হাঁটতে হাঁটতে বলল,
-“আমি ক্যাম্পাসে।”
-“ক্যাম্পাসে কোথায়?”
-“লাইব্রেরি রুমের সামনে।”
-“ওহ ওকে।”
-“তুই ভার্সিটিতে যাসনি আজ?”
-“এসেছি, তবে নিজেরটায় নয়। তোরটায়।”
-“ওয়েট!”
বিষয়টা বোঝার আগেই প্রহরের চোখ গেল সিঁড়ির ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির দিকে। একটা সাদা চুরিদার পরে আছে। চুলগুলো বিনুনি করে একপাশে রাখা। বিনুনির ভাঁজে ভাঁজে বেলি গুঁজে দেওয়া। ডান হাতের কব্জিতে একটি বেলির মালা জড়িয়ে রাখা। চোখে কাজল দেওয়া আর কপালে ছোট্ট কালো টিপ। প্রহরের হৃদস্পন্দন থেমে থেমে স্পন্দিত হতে লাগল। বিমুগ্ধ নজরে তাকিয়ে রইল। পা দুটো থেমে রইল ওখানেই। আয়াত কল কেটে সিঁড়ি বেয়ে নামল। প্রহরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল,
-“ক্যাম্পাসে যাচ্ছিলাম ফ্রেন্ডসদের সাথে। তারপর হুট করেই মাঝে মনে হলো, আমি তোকে মিস করছি। তারপর চলে এলাম এখানটায়। আসার পথে ফুলের গলিতে দেখলাম এই ফুলগুলো কী সুন্দর করে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে! প্রহর দেখ, সুন্দর লাগছে না?”
প্রহর আস্তে-ধীরে স্বাভাবিক হয়ে বলে,
-“হুঁ? হ্যাঁ, চল।”
এত সুন্দর করে সেজেগুঁজে এলো; অথচ নো কম্পলিমেন্টস, নো ইম্প্রেস করার চেষ্টা, নো নাথিং! আয়াত চরম ক্ষেপে গেল। মুখটাকে গম্ভীর করে প্রহরের পিছে পিছে এগোতে লাগল। সিরিয়াস ভঙ্গিমায় বলল,
-“প্রহর, শোন!”
প্রহর তাকাল না আয়াতের দিকে। এগোতে এগোতে বলতে লাগল,
-“চল হাঁটি।”
-“আচ্ছা। প্রহর একটা সিরিয়াস কথা ছিল।”
-“বল।”
-“বাবা আমার হাবভাব লক্ষ করছে।”
-“যেমন?”
-“যেমন এই যে, এই বয়সী মেয়েরা যেভাবে ওড়াউড়ি করে, তার চেয়ে বেশিই আমি করি। তুই যদিও আমাকে কোনো স্কোপ দিসনি, তবুও আমি করি। হুটহাট শাড়ি পরে সাজুগুজু করি, খুব ভালো মুড নিয়ে মাঝেমাঝে তাদের সাথে আড্ডা দিই। আবার হুট করেই সেই মুহূর্তেই চিল্লিতে উঠি। মুড সুইং হয় প্রচুর। এক গবেষণায় জানা গেছে, অল্পবয়সী মেয়েদের ঘন ঘন মুড সুইংয়ের কারণ শি ইজ ইন লাভ। বাবা টের পাচ্ছে বিষয়টা।”
প্রহর বিষয়টা আমলে নিচ্ছে না। আয়াতের প্যারেন্টস আগে থেকেই ভীষণ সাপোর্টিভ। মেয়ে কাউকে পছন্দ করে থাকলে, তার সাথেই বিয়েটা দেবে। তাই প্রহর বলল,
-“তারপর?”
-“তারপর বাবা জিজ্ঞেস করেছে, আমার কোনো পছন্দ আছে কি না। সরাসরিই জিজ্ঞেস করেছে, আমি তখন খানিকটা ভড়কে গেছিলাম। মানে দেখ প্রহর, আমি খেতে বসেছি। খেতে খেতে এই-সেই নিয়ে আলোচনা করছি। এরকম সময়ে এসে হুট করেই বাবা বলে উঠল, ‘আম্মু, তুমি কি কাউকে পছন্দ করো?’ প্রহর, বাবার সাথেই যতোই ফ্রি হয়ে থাকি না কেন, এভাবে হুট করে জিজ্ঞেস করা কি উচিত হয়েছে বল? আমার ছোট্ট একটা দূর্বল মন! আমি ভয় পেয়ে যাই তো।”
হাসি চেপে নিল প্রহর। সেভাবেই শুধাল,
-“কী বলেছিস তুই?”
-“কী আর বলব? বললাম না ভয় পেয়েছি? ভয়ের চোটে বলে দিয়েছি কেউ নেই। শোন প্রহর, এখন থেকে প্র্যাক্টিস করে রাখছি, পরে আবার জিজ্ঞেস করলে ফটাফট তোর নাম নিয়ে নেব। বাবা যখনই জিজ্ঞেস করবে, আম্মু, তোমার কি কোনো পছন্দ আছে? ফটাফট বলে বসব, ‘আছে মানে! আলবাৎ আছে। নাম প্রহর, অনার্স করছে, লাস্ট সেমিস্টারে আছে। দেখতে শুনতে মাশাআল্লাহ। বাবা, তুমি বললেই আমি কবুল।’ তারপর তোর বায়োডাটা দিয়ে দেবো। প্রহর, শোন?”
ডাকশোনা উত্তর নিল প্রহর,
-“হু?”
-“তোর একটা সিভি দিয়ে যাস, প্রহর। বিয়ের বাজারে এপ্লাই করতে গেলে, আমার বাবার হাতে ওটা ওঠাতে হবে, বুঝেছিস?”
মাথা নাড়ায় প্রহর,
-“ওকে।”
আয়াত হাঁটতে হাঁটতে হুট করেই থেমে যায়, তারপর প্রহরকে বলে,
-“এই বলদ! জানিস না? একসাথে হাঁটার সময় প্রেমিকার হাত ধরা একজন আদর্শ প্রেমিকের নৈতিক দায়িত্ব! হাত ধর আমার। ফাস্ট!”
প্রহর ভ্রু-কুঞ্চিত করে তাকিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়ল। থেমে থেমে অল্প ক’টা শব্দ বলল,
-“এটা দায়িত্ব তা বলেছে কে?”
আয়াত প্রহরের বাঁ হাতটা নিজের ডান হাত দিয়ে ধরে আঙুলের ভাঁজে আঙুল গুঁজতে গুঁজতে বলল,
-“কে আবার? আমি। এই-যে মশাই, শোনেন! এই হাত ছাড়ছি না। আপনি ছাড়তে চাইলে হাতটা কেটে কাঁধ থেকে আলাদা করে, এরপর ধরে বসে থাকব। তাও ছাড়ব না। বুঝেছেন?”
ফিক করে হেসে ফেলে প্রহর৷ দুদিকে মাথা নেড়ে বলে,
-“বুঝলাম।”
আয়াত প্রহরের গাল টেনে দিয়ে বলল,
-“তুই কী জোস, মাম্মা! আমি লাভিউ।”
প্রহর প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেল সুন্দরভাবে,
-“হঠাৎ এখানে আসা?”
আয়াত প্রহরের বাঁ বাহু জড়িয়ে নিয়ে বলল,
-“এমনি প্রহর, এমনিই। তোকে আমি মাঝে মাঝে অসম্ভব মিস করি। মনে হয় কী জানিস? মনে হয় এখন তোর কাছে না এলে আমার দমবন্ধ হয়ে যাবে। তোকে দু’চোখ ভরে না দেখলে আমার চোখ বন্ধ হয়ে যাবে। তোকে আমার আমার লাগে। প্রহর, জানিস? যেই দিন তুই আর আমার থাকবি না, সেইদিন আমি নিজেও থাকব না। তুই কীভাবে কীভাবে যেন আমার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে নিজের রাজত্ব চালিয়ে যাচ্ছিস। আচ্ছা প্রহর, আমাকে শেষ করার কি আর কোনো উপায় ছিল না? তুই কেন তোর আজন্ম ভালোবাসাটাই বেছে নিলি?”
প্রহর জবাবে কিছু বলে না। অন্যদিকে তাকিয়ে বলে,
-“বি প্র্যাক্টিকাল। এত আবেগী হয়ে তোকে মানায় না। তুই-ই তো আমাকে বাস্তবতার সাথে পরিচয় করালি। নয়তো ছিলাম আমি এক গার্ভেজ! এখন তুই কেন এত ইমোশনাল হচ্ছিস? আমি কি তোর নই?”
এক চিলতে হাসি এসে ধরা দিলো আয়াতের ঠোঁটে। প্রহরের সাথে জড়িয়ে বলল,
-“মাম্মা, শোন! চল ফুচকা খাই।”
-“না, এসব আনহাইজেনিক খাবার খাওয়ার প্রয়োজন নেই।”
-“আরেহ ও বলইদ্যা, ফুচকা খেতে চেয়েছি, তোকে না। বেশি তিড়িংবিড়িং করলে খেয়ে দেবো।”
-“মুখের ভাষার কী শ্রী!”
আয়াত মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
-“দেখ প্রহর, আমি আদ্যোপান্ত তোরই। ভালোটাও তোর, খারাপটাও তোর। একটা মানুষের ভেতর সবসময় কেবল ভালোটা থাকে না। খারাপও থাকে। আমার ভালো দিকগুলোকে ভালোবাসতে পারলে তুই আমার খারাপ আমিটাকেও বাসবি। আমার সবটাকে যত্নে রাখবি। না-হলে তোকে এই মুহূর্তে ত্যাজ্য প্রেমিক বানিয়ে দেবো। তারপর বনবাসে যাব আমি। তারপর তোরই কষ্ট। তাই ভালোয় ভালোয় বলছি। নিজেকে যদি এত কষ্ট না দিতে চাস, ফটাফট আমাকে ফুচকা খাওয়া।”
_____
হুট করেই জন্ম নেওয়া ভালো লাগা,
পত্রের শুরুতেই একটা এমন উদ্ভট সম্বোধন তোমাকে দেওয়ার জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। হয়তো তুমি রেগে যাবে। কিন্তু কিছু করার নেই আমার। সম্বোধনে এক বিন্দুও ত্রুটি নেই। এর চেয়ে সত্যও নেই।
আমার গোছালো জীবন, গ্রামের সম্ভ্রান্ত ও ভীষণ রক্ষণশীল ঘরের মেয়ে আমি। আমার জন্য জীবনটা গ্রামের আর বাকি দশটা মেয়ের চেয়ে ভিন্ন। ওরা বাইরে বেরোলে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে, আমি পারি না। দূর হতে কিছু দৃষ্টি ভীষণ বাজেভাবে আমার ওপর পড়ে। কিছু কিছু আঙুলও মাঝে মাঝে এদিকটায় তুলে ধরা হয়, বলা হয়, ‘ওই দেখ! শিকদার বাড়ির মেয়ে যাচ্ছে।’
দৃষ্টিতে কারো কারো তো থাকে তীব্র লালসা। আমি সেগুলোকে ভয় পাই। যেভাবে আভিজাত্যের সাথে বড়ো হয়েছি, সেভাবে আর বাকি দশটা মেয়ের চেয়ে আলাদা বড়ো হয়েছি। একা রাস্তায় বেরোতে পারিনি। গেলে সাথে দু-তিনজন লোক অবশ্যই গেছে। বাবা রহমান কাকাকে সবসময় আমাদের স্কুল-কলেজে দিয়ে-আসা নিয়ে-আসার কাজে রেখেছেন। সেই হিসেবে ছেলেদের ওই দূরে দাঁড়িয়ে তাকানো অবধিই ক্ষমতা। যদি কেউ সাহস করে প্রেমপত্র দিতে চায়, পত্র আমার হাতে পৌঁছানোর আগে বাবা জেনে যায়। তারপর এলাকায় সালিশি বসে। একজন বহুকাল আগে রিধিমাদিকে সিটি বাজিয়ে টিজ করেছিল, দাদাভাই তাকে দ্বিতীয়বার কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকানোর অবস্থায় রাখেনি। তো বোঝো, সেখানে আমার কোনো ছেলেজনিত কান্ড ঘটানো কতটা অসম্ভাব্য ব্যাপার? আমি জড়াইনি তাই কারো সাথে। সবচেয়ে লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে হয়ে ছিলাম। সবার আদরের, সবার যত্নের। সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা দাদাভাইয়ের পর আমিই পেয়েছি। সবাই মাথায় করে রেখেছে।
আর তারপর হুট করেই শিকদার বাড়ির সবচেয়ে নাজুক মেয়েটা একটা ভুল করে বসল। এক নির্লিপ্ত পুরুষের মায়ায় জড়িয়ে গেল। সে পুরুষ মেয়েটিকে এইটুকুন পাত্তাও দেয় না, আর তাই মেয়েটা ভালোবেসে ফেলল। সেই পুরুষটা তুমি, আর মেয়েটা সম্ভবত আমিই।
কেমন কেমন করে যেন একজনকে ভালোবাসার মতো গুরুতর অপরাধের সাহস করে ফেললাম। গুণিজনেরা বলেন, প্রেমফল না খেতে। কিন্তু এ যেন দিল্লির লাড্ডু। যে খাবে, পস্তাবে। না খাবে, তবুও পস্তাবে। না খেয়ে পস্তানোর চেয়ে খেয়ে পস্তানোটা একটু বেশিই ভালো। এই যে, তোমায় ভালো না বাসলে আমি এই অদ্ভুত চিনচিনে ব্যথার আভাসটা পেতাম না। থেকে থেকে ডুকরে কেঁদে উঠতাম না। আড্ডার আসরে হুট করেই মলিনমুখে এদিক-ওদিক তাকাতাম না। রাত করে পড়তে পড়তে পড়া থামিয়ে নিরব হয়ে বইয়ের অক্ষরগুলোর মাঝে তোমার মুখ খুঁজতাম না। নিঃশ্বাসে টান পড়ে। বুকটা কেমন খাঁ খাঁ করে। উফফ! মরনসুখ! তোমায় না ভালোবাসলে এমন বিশ্রী সুখ আমার পাওয়া হতো না। আমি তোমায় চাই না আর। আমার ভাগ্যকে আমি মেনে নিয়েছি। আমি স্রোতের অনুকূলে যাচ্ছি।
তোমার গন্তব্য আমার বিপরীত শীর্ষে হলে, আমি শত চেয়েও তোমায় আমার করতে পারব না।
তোমার গন্তব্য আমি হলে, পুরো দুনিয়া চেয়েও তোমায় আমার হতে আটকাতে পারবে না।
ইতি
নীহিন
পুরোটা লিখে নীহিন মুচকি মুচকি হাসল। শব্দগুলোর মাঝে নজর বুলিয়ে নিতে নিতেই হুট করেই আরহা রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
-“নীহিন! বড়োবৌ কেমন অসুস্থ হয়ে পড়েছে একটু। তাই বাবুকে নিয়ে এলাম। কী করিস তুই?”
নীহিন দ্রুততার সাথে চিঠিটা বইয়ের ভাঁজের ভেতর লুকিয়ে ফেলল। এরপর উঠে দাঁড়িয়ে আরহার কোলে সুহাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এসে গাল টিপে দিয়ে বলল,
-“আরেহ সুহাসিনী, আজ কি আপনি মামনিদের সাথে থাকবেন?”
আটমাসের সুহা খিলখিল করে হেসে দু-হাত বাড়িয়ে নীহিনের গায়ের দিকে হেলে পড়ল। নীহিন কোলে নিয়ে বলল,
-“আরে বাপরেহ, এত আহ্লাদ আসছে হঠাৎ। আসেন আমরা গপ্পসপ্প করি। এই আরহা, ও কি আজ থাকবে?”
-“হ্যাঁ। ওকে দেখ, আমি ওর ন্যাপিগুলো নিয়ে আসি।”
আরহা গেলেই নীহিন আমোদিন হয়ে সুহাকে বুকে জড়িয়ে বারান্দায় চলে যায়। পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলে,
-“জানেন, সু্হাসিনী? আপনার নীহি মামনির অনেক কষ্ট! কেন কষ্ট? কারণ আপনার প্রহর বাবাই তাকে পাত্তা দেয় না। আমিও পাত্তা চাই না। কিন্তু আম্মু, ভালোবাসি তো! লোকটা কী খারাপ! জঘন্য খারাপ! আসেন আমরা অন্য কথা বলি। আপনার বড়ো আব্বু আছে না? আমার দাদাভাই, সে তো বিয়ে করে নিয়েছে। খুব জলদি একটা জোস জোস অনুষ্ঠান হবে বাড়িতে। শিকদার বাড়ির বড়ো ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠান। আমি আর আপনি মিলে প্ল্যানিং করব, ওকে?”
সুহা ছোট ছোট দুইহাত দিয়ে নীহিনের গাল ধরে বলল,
-“অওওঅ!”
ওমন বাচ্চামো শুনে নীহিন বলল,
-“কী, আম্মু? হু? শোনেন, আপনার বড়ো আম্মুর ভাই-ই আমার সেই জঘন্য মানুষ। আবার দেখা হবে এবার। এভাবে তো আমার মন চুরি করল, শাস্তি দিলাম না। এবার বেয়াই লাগে, কিছু অবশ্যই করতে পারি। এককাজ করব, আপনাকে ন্যাপি না পরিয়েই কোলে তুলে দেবো, বাকিকাজ আপনার। ঠিক আছে? বোঝানো লাগবে আর?”
সুহা খিলখিল করে হেসে উঠল, নীহিনও সঙ্গে হাসতে লাগল।
_____
ভীষণ শীতল এক সন্ধ্যেতে শরৎ অফিস থেকে ফিরে প্রিয়কে কল দিলো। বরাবরের মতো শুধাল,
-“কী করছেন, প্রিয়? আমি লেট আজ, তাই না?”
জবাবে প্রিয় প্রসঙ্গক্রমে নিজের মতামত দিলো,
-“নীরজ, চলুন সোশ্যাল ম্যারেজ করি। কার্ড ছাপাতে বলুন। আজ ৯ তারিখ। আগামী শুক্রবার, ২০ তারিখ আমরা বিয়ে করব।”
চলবে…